চারুকাব্য পর্ব-০২

0
312

#চারুকাব্য ২
লেখা : #azyah_সূচনা

“শ্বাশুড়ি মা!আমি আপনার নতুন জামাই।বিয়ে করলাম আপনার মেয়েকে।উম! ঘন্টাখানেক হয়েছে”

দরজা ধরে দাঁড়িয়ে শায়লা।মেয়েকে দেখছে দরজার ওপারে।গলায় লাল টকটকে গোলাপের মালা পরিহিত।সাথেই কালো রঙের ব্লেজারে উচা লম্বা তাগড়া একজন পুরুষ।চোখে চশমা।আর মুখে লম্বা প্রসারিত হাসি।তাজ্জব বনে আছে সেই পুরুষের মুখের বাণী শুনে।চোখ আটকে।মাত্র দুটো কান যা শুনলো?সেটা কি সত্যি?ধ্যান ভাঙে।মেয়ের দিকে পূনরায় চায়।এগিয়ে এসে অপরাধীর ন্যায় দাড়িয়ে থাকা মেয়ের হাত চেপে ধরলো।

বললো, “কিরে চারু!কি বলছে এই লোক?তুই!”

কাব্য বলে উঠলো, “আস্তে হাত ধরেন শাশুড়ি মা।আমার স্ত্রী ব্যাথা পাবে।আপনি মা আপনি ওর হাত ধরতেই পারেন।শুধু একটু সাবধানে”

শায়লা রেগে গেলেন। চেচিয়ে বললেন, “চুপ অসভ্য ছেলে!কে তোমার শ্বাশুড়ি হ্যা?আর চারু তোমার স্ত্রী মানে?”

স্বাভাবিকতা মুখে বজায় রেখে কাব্য উত্তর দেয়, “স্ত্রী মানে বউ।আমার বিয়ে করা বউ!”

“আমি মানি না।আমার মেয়ে এই কাজ করতেই পারেনা। কক্ষনো না!”

মুখ খুললো চারু।বললো, “পারে মা!করে ফেলেছে!বাধ্য হয়েছে করতে।সে যা বলছে সত্যিই বলছে”

শেষ কথায় চোখ বেয়ে জলও গড়িয়ে পরে।গাল বেয়ে যেতেই কাব্য হাত বাড়িয়ে মুছে দিলো।

বললো, “খবরদার!তোমাকে আমি দ্বিতীয়বার কাদতে না দেখি! অস্রু তোমার জন্য না।”

গলায় পরিহিত মালাটি ফাসির দড়ির মতন লাগছে।দম বন্ধ হয়ে আসছে।টেনে ছিঁড়ে ফেললো তৎক্ষনাৎ।গোলাপের পাপড়িগুলো ছড়িয়ে পড়লো সাদা ফর্সে। কাব্যর কিছু আসে যায়না তাতে।অথচ সবাইকে চমকে দিয়ে জমিনে পড়ে থাকা ফুলগুলো দুহাতে তুলে শায়লার হাতের দিকে এগিয়ে বললো,

“আমাদের বরণ করেন এই ফুল ছিটিয়ে।আমি এই বাসায় ঘরজামাই থাকবো”

স্তম্ভিত শায়লা।কি বলছে আবোলতাবোল? চারুও চোখ তুলে তাকালো।এত নির্লজ্জ মানুষ কি করে হতে পারে?শায়লা বেগম কিছু বলবেন বলবেন ভাব। এমতাবস্থায় কাব্য বললো,

“শ্বাশুড়ি মা?আমি ছেলে ভালো।কিন্তু কি বলেনতো আমি যত ভালো তত আবার খারাপও।কিন্তু আপনার মেয়ের প্রতি সৎ।মাঝেমধ্যে একটু মাথার তার এদিক সেদিক হয়ে যায় আরকি।”

বলে শ্বাস নিলো কাব্য।মনে পড়লো আরো একটি বাক্য এখানে যোগ করা উচিত।তাই আবার বলে উঠলো, “চারুলতা আমাকে সামলে নিলে?আমি ঠিক ভালো হয়ে যাবো”

তুচ্ছ হাসি হাসলেন শায়লা।বললেন, “নিশ্চয়ই অনেক বড়লোক?”

“জ্বি।অনেক টাকা আমার!”

পিছনে কারো পদচারণের ধ্বনি শোনা গেলো। বুটের আওয়াজ।আমজাদ চারটে লাগেজ নিয়ে হাজির। আমজাদকে দেখে চিনতে এক বিন্দু ভুল করেনি শায়লা। বিস্ফোরিত চোখে দেখছেন তাকে।বললেন,

“এই টাকার পাওয়ার দেখিয়ে এসব করছেন না?জোরজবরদস্তি করছেন আমাদের সাথে?এই বাড়ি,এই সুযোগ সুবিধা?সব আপনার?কিনতে চাচ্ছেন আমাদের মতন গরীব মানুষদেরকে?আর কিই বা করবেন? আমরাতো নিচু জাতি। আমাদের উপর আপনাদের সব জোর খাটে ”

“জোর জবরদস্তি করতে আসিনি।ভালোবাসতে এসেছি,ভালো রাখতে এসেছি।সময় দেন আমাকে।নিজেরাও সময় নেন।জানেন,বুঝেন আমাকে।”

ফুল হাতে দিয়ে দাড়িয়ে রইলেন শায়লা।জীবনে অনেক ভালো খারাপ পরিস্থিতি দেখেছেন।এমন সময়ও দেখতে হবে সেটা ভাবেননি কখনো।মেয়ের বিয়ে বলে তার খুশি হওয়ার কথা।কিন্তু এমনভাবে বিয়ে কোনো কল্পনাতেও আনতে পারেননি।চারুর মুখ দেখেই বুঝতে পারলেন সে নিজেও খুশি না এই বিয়েতে।খুশি?ভীষণ খুশি শুধু একজনই।কাব্য যেকিনা এখন তার মেয়ের স্বামী।

অপেক্ষা করতে করতে বিরক্তির ভাজ পড়লো কাব্যর কপালে।চারু নির্বাক। শায়লাকে টপকে ভেতরে ঢুকে গেলো।যাওয়ার পথে চারুর হাত ধরে নিয়ে আসতে ভুলেনি। হাঁটার পথে চোখ যায় পাশের ফুলদানির দিকে।হাত বাড়িয়ে সামান্য বেকে থাকা ফুলদানি সোজা করে নিলো। নিখুঁতভাবে।এক ইঞ্চিও এদিক ওদিক নয়।

“শ্বাশুড়ি মা?আমার বউয়ের রুম কোনটা?ফ্রেশ হবো।রাতের খাবার রেডিতো?ক্ষিদে পেয়েছে আমার”

এখনতো সে শুধু এই বাড়িতে না চারুর ঘরেও থাকবে। সেটা এতো সময় মাথায় ছিলো না। কাব্যর বাণী যেনো স্মৃতিশক্তি ফিরিয়ে আনে।এই লোকটাকে এতদিন চিনেছে নিজের শিক্ষক হিসেবে।একজন শান্ত, বুঝদার মানুষ হিসেবে।আজ তার এমন রূপ?বারবার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে চারুর।এটাই কি আফনান স্যার?কত মানুষের উপর সন্দেহ করেছে। অবিশ্বাসের চোখে দেখেছে।কোনোদিন কাব্য আফনান এর দিকে ভুল করেও সন্দেহ হয়নি।মাথা ঘুরে যাচ্ছে সবকিছুতেই।হিসেব নিকেশ কোনটার সাথেই কোনটা মিলল না। দমবন্ধকর চারিদিক।একটু নিঃশ্বাস নিতে ঘরের দিকে তেড়ে গেলো চারুলতা। কাব্যও ছুটলো তার পিছু পিছু। শায়লার ধমককে উপেক্ষা করেই।

“খবরদার আমার মেয়ের কাছে যাবে না!”

___

রাতের প্রহর।সারাদিন ক্লাস আর কোচিং শেষে বাড়ি ফিরছিল।পুরো দেহটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। প্রত্যেকদিন এর দিনচারিতায় এক কালো অধ্যায় যোগ হয়েছে।অথচ কাব্য বিছানায় পা গুটিয়ে বসে ড্যাবড্যাব আখিতে চেয়ে। ভোলাভালা মুখ তার ঘন দাড়ির আড়ালে। আদৌ কি শ্রী যেমনটা তেমনই ভোলা সে?হলে হয়তো আজ চারুর এত বড় সর্বনাশ করতে পারতো না।এইতো সকালে তাকে হাসি খুশি দেখে এসেছে।একজন শিক্ষক,একজন মেন্টর হিসেবে। স্বাভাবিক আচরণে।কে জানতো?এত ভয়ঙ্কর এক মোড় নিবে তার ব্যক্তিত্ব।শায়লা মাত্র চলে গেলেন।অনেকক্ষন যাবৎ দরজা পিটিয়েছেন।কোনো লাভ হয়নি। খাবারটাও জোর করেই ঘরে অনানো হয়েছে।ঠিক একই ভাবে চারুকেও ঘরবন্দী করে রেখেছে কাব্য।

ব্লেজার খুলে সাদা শার্টের হাতাটা গুটিয়ে নিল।প্লেটে নিজের দিকে টেনে চারুর উদ্দেশ্যে বললো, “এসো খেয়ে নাও”

নির্বাক চারু।আধ ঘন্টা যাবৎ দাড়িয়ে পূনরায় হিসাব মিলাচ্ছিলো।লাভ হয়নি।তবে কাব্যর কণ্ঠে ধ্যান ভেঙেছে।উল্টো প্রশ্ন করে বসলো,

“কেনো করলেন এমন?”

“কি করেছি?”

“আমার জীবন নষ্ট করে দিলেন।”

“ভুল বললে চারুলতা!এতদিন তোমার জীবন নষ্ট ছিলো।তুমি যা যা পাওয়ার যোগ্য তুমি সেগুলো কিছুই পাচ্ছিলেনা।তোমার থাকার কথা রাজকুমারীর হালে।অথচ কতই না কষ্ট করেছো”

ভারী গলায় চারু উত্তর দিলো, “আমি অভ্যস্ত!আমি সুখে ছিলাম”

অহেতুক হেসে কাব্য বলে উঠে, “এখন দ্বিগুণ সুখে থাকবে।যা কিছুর কমতি ছিলো পূরণ করে দিবো।”

“আমার এসব বিলাসিতা চাই না!”

“ভালোবাসা চাও?”

ভালোবাসা শব্দটি শুনে চারু এক দৃষ্টিতে চাইলো কাব্যের দিকে।মন, মস্তিষ্ক,চোখ কোনোটাই এখন অব্দি বিশ্বাস করতে পারছে না।ঘটে যাওয়া সবকিছুই যেনো ঘোর।সব ধোঁকা।নয়তো সপ্ন।চোখ খুললেই দেখা যাবে সব মিথ্যা।যদি কল্পনা হয়েও থাকে তাহলে অতিশয় দীর্ঘ,অনেকটা ভয়ঙ্কর?

“খাবে না?”

একজন প্রভাষক হিসেবে তার বচনভঙ্গী ছিলো সত্যিই মনোমুগ্ধকর।খুব ভালো বোঝায় সে। প্রিয় শিক্ষকের তালিকায় যোগদানের আগেই একজন বিষাদময় মানুষ হয়ে উঠলেন। অদ্ভুত বাক্যে বিশ্লেষণ করলে ‘ অনিচ্ছায় গ্রহনকৃত স্বামী ‘।তার এই সুন্দর বচন ধ্বনি বিষাক্ত মনে হচ্ছে এখন।

“আপনি খান!আপনার বাড়ি।আপনার ঘর।আর আপনার টাকার খাবার।”

“ঘরের প্রত্যেকটা জিনিসের পাশাপাশি তুমিও আমার”

স্বামীর মুখে এমন কথা মধুর হওয়ার কথা ছিলো। লজ্জায় দর্শননত হওয়ারও কথা ছিলো।চারুর ক্ষেত্রে হলো না।ঘেন্না হলো তার মুখ থেকে প্রস্ফুটিত এই বাক্যে।

“খেতে এসো”

“আমি খাবো না।”

“খাবার নিয়ে অনীহা করে না চারুলতা।তাছারাও অনেক রাত হলো?ঘুমোতে হবেতো নাকি?”

জীবনে নতুন চরিত্রে আগমন ঘটেছে তার। এখন এই মুহূর্ত থেকে হয়তো নিঃশ্বাসের আগ অব্দি তার মুখ দেখেই থাকতে হবে।ঘুমোতে হবে এই কথাটি চারুর মনে ভয়ের সৃষ্টি করে। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক তার কাছে অজানা নয়।ভীত হচ্ছে এই মানুষটিকে নিয়ে!চারুকে ভালোবাসে বলেই দাবি করেছে।যদি সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে?যদি চরিত্রহীন হয়?

প্রসঙ্গ পাল্টাতে চারু বলে উঠে,

“একজন সরকারি চাকরিজীবীর মন মানসিকতা সভ্য আর গোছানো হওয়ার কথা।তাদের জীবনের নীতি,আদর্শ সবই ভিন্ন।আপনার মধ্যে আমি একজন খারাপ, নীতিহীন মানুষের ছাপ দেখতে পাচ্ছি”

অদ্ভুত রহস্যময় চাহনি ছুঁড়ে দিলো চারুর দিকে।পরপর হেসে উঠে বেশ শব্দ করেই।চারু কি কৌতুক বলেছে?নাহ!সে কৌতুকপূর্ণ তেমন কিছুই বলেনি।তাহলে তার হাসির মানে কি দারাচ্ছে? প্রশ্নবিত্ত চোখে চেয়ে রইলো চারু।

“তোমাকে কে বলেছে আমি সরকারি চাকরি করি?মানুষ মাত্রই মিথ্যে।ভুল!ভ্রম!ছলনা”

আকাশ থেকে পড়লো চারু।চেহারার মুখভঙ্গিও ঠিক তেমন। আশ্চর্যে ভরপুর।তার চোখ গুলোই হাজার প্রশ্ন করে ফেলে যেনো। কাব্যের মুখের হাসিতে একবিন্দু কমতি দেখা গেলো না।এবার নিঃশব্দে ওষ্ঠ প্রসারিত করে আছে।

এবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি কাজে আসলো না।কাব্য নিশ্চুপ। অগ্যতা চারুই চেয়ে বসে তার উত্তর,

“এটাও কি তাহলে মিথ্যে ছিলো?”

“হ্যা!” সোজাসাপ্টা উত্তর আসে তৎক্ষনাৎ।

“তাহলে আপনি কে?সেই কোচিংয়ে একজন টিচার হিসেবে?”

“আমি নিজেকে সব প্রফেশনের জন্য যোগ্য করেছি। সবকিছু নিজের হাতের মুঠোয় নেওয়ার জন্য যতটুকু ক্ষমতা প্রয়োজন?সেটাও আছে আমার।”

ঝাঁকে ঝাঁকে প্রশ্ন চারুর মনে।এক এক করে যেনো সকল চিন্তাধারাকেই কাব্য ভুল প্রমাণ করে দিচ্ছে।উদ্দেশ্য কি?শিক্ষক নয় সে?তাহলে কেনো একজন শিক্ষকের বেশে ছিলো?

চোয়াল শক্ত করে চারু প্রশ্ন করলো,

“আপনার উদ্দেশ্য কি?”

“তুমি”

চেচিয়ে উঠে চারু,

“আমি আমি আমি! এই একথা কতবার বলবেন?আমার জীবনে কেনো আসলেন? আমিই কেনো?”

“সব প্রশ্নের উত্তর সময় দেবে চারুলতা।আমার ক্ষিদে পেয়েছে।”

বলেই ভাত মাখিয়ে খাওয়া শুরু করলো। মিনিট দুয়েক অতিবাহিত করে বোধহয় মনে পড়ে চারুর কথা।উঠে দাড়ায়। হাতে প্লেট চারুর দিকে এগিয়ে বললো,

“অবশ্যই চাইবে না যাকে তুমি ভালোবাসো না সে তোমাকে স্পর্শ করুক।বারবার হাত টেনে সামনে বসিয়ে খাইয়ে দেক।তার চেয়ে ভালো নিজে হাতে খেয়ে নাও।……কিন্তু হ্যাঁ! কাদলে অস্রু মুছে দিবো অধিকার খাটিয়েই ”

ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথাটি বলল। ইতিবাচকভাবে নেবে তার এই উক্তি?নাকি বরাবরের মতই নেতিবাচকভাবে?তার স্পর্শের চেয়ে ভালো নিজে হাতেই খেয়ে নেক।আজ যা ঘটেছে?তারপর খাবার গলা দিয়ে নামবে না।তারপরও কাব্যের মানসিক অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে প্লেট হাতে তুলে নেয়।

কোনো রকম দু লোকমা ভাত মুখে তুলে গটগট করে পানি খেয়ে নিল চারু।বসে আছে বিশাল সজ্জিত ঘরের সোফায়।আরো একটা প্রশ্ন করতে চায়।হাত কচলে চলেছে অনেক সময় যাবত। কাব্যের দৃষ্টি তার দিকেই নিবদ্ধ।

হঠাৎ আওয়াজ ভেসে এলো, “আমাকে করার মতন অনেক প্রশ্ন আছে তোমার কাছে।বলো কি জানতে চাও?আজ রাতের জন্য এটাই যেনো শেষ প্রশ্ন হয়?”

চারু নীরব।কাব্য অপেক্ষারত। নিস্তব্ধতা কাটাতে কাব্য পূনরায় বললো,

“প্রতিদিন একটা একটা করে প্রশ্নের উত্তর দেবো তোমার।করো প্রশ্ন”

“আপনি আমাকে কবে থেকে চেনেন?”

“আট মাস নয়দিন চারঘন্টা আটত্রিশ সেকেন্ড”

চলবে?