চারুকাব্য পর্ব-০৫

0
256

#চারুকাব্য ৫
লেখা : #azyah_সূচনা

“তুমি কি তোমার বাবার মতন কাব্য?”

আঁধার রজনীতে ঝঙ্কার তুললো পুরুষালি কন্ঠস্বর।কিছু সময় আগে চারুর বলা কথাগুলো মস্তিষ্কে বারি খাচ্ছে।অজান্তেই ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে হৃদয়।সে জানে সে ভুল।মস্ত বড় অপরাধ।ইচ্ছার বিরুদ্ধে কারো জীবনে নিজেকে চাপিয়ে দিয়েছে।

ঘুরে চাইলো কাব্য।সেও একই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো, “আপনিও কি আমার বাবার মতন?”

একে অপরের দিকে দৃষ্টি প্রগাঢ়।হুইল চেয়ারে চঞ্চল সাহেব।একাধারে পলকহীন কাব্যর দিকে চেয়ে।খোলা ছাদে দুজন পুরুষ একে ওপরের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে।তার উত্তরে উভয়ই নির্বাক।

“আমি তোমার বাবার মতন হলে আজ এখানে অন্যের অধিনস্ত পঙ্গু হয়ে বসে থাকতাম না। সব হারিয়ে নিঃস্ব হতাম না।”

“আমার জবাবও এটাই”

“অথচ আমার সামনে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছো।”

” শেষে বাক্যে বললেন না নিঃস্ব?সেটাই।”

কোনো ভীতি নেই চঞ্চল সাহেবের মুখে।নেই কোনো আক্রোশ।পিটপিট করে চোখের পলক ফেললেন।দুহাতে হুইল চেয়ার ঘুরিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হন।ভাবলেশহীন দাড়িয়ে আছে কাব্য।পকেটে হাত গুজে চঞ্চল সাহেবের দিকে চেয়ে।দরজা অব্দি গিয়ে থেমেছেন।মাথা ঘুরিয়ে বলে উঠলেন,

“আমার মেয়েকে ছেড়ে দাও।”

“সম্ভব না।”

“প্রতিশোধ নিচ্ছো?”

“আপনার মেয়ের সাথে আমার প্রতিশোধের সম্পর্ক না”

চলে যাচ্ছিলেন।হাতের জোর চালিয়ে পিছন ঘুরে আবার ফিরে আসেন কাব্যর দিকে।লম্বা চওড়া ছেলেটির মুখে তার বাবার প্রতিচ্ছবি জ্বলজ্বল করছে।এত মিল?

“আমার মেয়ে কষ্ট পাচ্ছে।কেনো ওর পিছনে পড়েছো?কি চাই তোমার?”

মন মর্জি মতন উত্তর দেয় কাব্য।ইচ্ছে হলে মুখ খুলবে নয়তো নয়।কপালের মধ্যিখানে ভাজ ফেলে ঘুরে তাকালো দুরাম্বরের দিকে।ইচ্ছে হচ্ছে না এসব ব্যাপারে আলোচনা করতে।বাবা এবং মেয়ে।উভয়ই তাকে জেরা করে,করছে!চাপ পড়ছে তার দুর্বল হৃদয়ে।

“অবশ্য আমাদের তোমাকে দেওয়ার মতোন কিছুই নেই।সবই কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ধ্বংস করা হয়েছে।নিঃশেষ!একদম শেষ সব।” বলতে বলতে গলা কেপে উঠে চঞ্চল সাহেবের।

পুরুষালি কম্পিত কন্ঠে তৎক্ষনাৎ ঘুরে চায় কাব্য।চঞ্চল সাহেব দুহাতে চেপে আছেন মাথা।নিচু হয়ে আছেন।হাঁটু ভাঁজ করে বসে পরে কাব্য তার কাছে।বলে,

“যা কেড়ে নেওয়া হয়েছিলো সেগুলোতো ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি।কেনো বুঝতে পারছেন না?”

“লাগবে না!তোমার দয়া আমার লাগবে না”

“দয়া না প্রায়শ্চিত্ত”

“প্রায়শ্চিত্ত?আমি তোমার চেহারায় তোমার বাবার ছাপ দেখতে পাই।….হাত জোড় করছি!আমার মেয়েকে কষ্ট দিও না।ওকে ভালো থাকতে দাও।আমরা দুমুঠো ভাত খেয়ে সুখী।চলে যাও এখান থেকে।”

কথাটি বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন চঞ্চল সাহেব।হাত জোড় করে আছেন কাব্যর কাছে। নিস্তার চাচ্ছেন।আবার সব হারানোর হয়ে কাতর হয়ে উঠেছেন।কাব্যর চোখে লাল আভা ছড়িয়ে পড়লো। জল জমতে শুরু করেছে।ভারী হৃদয়ের আর্তনাদ!মুখ ফুটে বেড়িয়ে এলো,

“সবাই কেনো আমাকে দূরে ঠেলে দেয়?”

__

চয়ন সকাল সকাল দাড়িয়ে আছে গেটের সামনে। গুনগুনে তেরো বছরের ছোট সে চারু থেকে।বাহিরে তুমুল বৃষ্টি।রাতের সাইসাই বাতাস জানান দিয়ে গিয়েছিলো পরদিনের আবহাওয়া।প্রথম সেমিস্টার পরীক্ষা শুরু আজ থেকে।নাহয় আজ স্কুল কামাই করার সেরা উপায় ছিলো। অসহায় মুখ বানিয়ে রেখেছে চয়ন।পরীক্ষাটা পেছালে কি হতো?স্কুলের লোকেরা বড্ড নিষ্ঠুর।বাচ্চাদের সুবিধে অসুবিধে বুঝে না।শুধু পরীক্ষা নেয়।বারবার ফোঁসফোঁস নিঃশ্বাস নিতে লাগলো দরজা ধরে দাড়িয়ে।পরীক্ষা শুরু হতে আরো পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাকি।এর আগে বৃষ্টিটা থেমে গেলেই বাঁচা যায়।

“কি ব্যাপার শালাবাবু?”

চোখ রসগোল্লার মতন হয়ে উঠে চয়নের।ভরকে দুয়েক কদম পিছিয়ে দাড়ায়।মা বলেছে উনি খারাপ লোক।আমাদের বন্দী করে রেখেছে।সেই চিন্তাকে মাথায় নিয়েই কাচুমাচু হয়ে দাড়ালো।

কাব্য বললো, “কি সমস্যা তোমাদের ভাই বোনের বলোতো?আমাকে দেখলেই পিছু হটে যাও।ভয়ে মুখ বিড়ালের বাচ্চার মতন হয়ে যায়”

এর উত্তরে কি বলবে চয়ন?তাকে যা বলা হয়েছে সেই আদেশই পালন করছে সে।দূরে থাকতে বলা হয়েছে।কোনোভাবে যেনো কথা না বলে কাব্যর সাথে সেই পাঠদানও দিয়েছেন শায়লা। নীরবতাকেই বেছে নেয় সেও। চয়নকে স্কুল ড্রেসে এবং বাহিরের বৃষ্টি দেখে দুয়ে দুয়ে চার মিলে গেলো।বোঝা গেলো স্কুলে যেতে চাচ্ছে। বৃষ্টির দাপটে আটকা।মুচকি হেসে চয়নের উদ্দেশে বললো,

“স্কুলে যাবে?”

“হুম”

“ক্লাস শুরু কখন থেকে?”

“আজ আমার পরীক্ষা। দশটায় শুরু”

“ওহহো!আচ্ছা।চলো আমি দিয়ে আসছি।”

কন্ঠস্বর উচুতে তুলে চয়ন বললো, “না না আমি আপনার সাথে যাবো না।”

চয়নের আওয়াজ শুনে চারু দৌড়ে এসেছে।আজকাল চোখ, কান বেশিই সজাগ করে চলে।স্বাভাবিক কথার শব্দেও আত্মা কেপে উঠে।এই বুঝি কোনো অঘটন ঘটলো।

“কি হয়েছে চয়ন?”

আঙ্গুল কাব্যর দিকে তাক করে উত্তর দিলো, “উনি আমাকে স্কুলে দিয়ে আসবে বলছে”

“কক্ষনো না!আমি আমার ভাইকে আপনার সাথে ছাড়বো না।দরকার হলে আমি দিয়ে আসবো”

প্রতিউত্তরে কাব্য বললো, “বাহিরে বৃষ্টি।গাড়ি দিয়ে একটানে দিয়ে আসবো।ওর পরীক্ষার সময় পেরিয়ে যাবে”

“অসম্ভব।একবিন্দু ভরসা নেই আমার”

“ঠিক আছে।তুমিও চলো সাথে তাহলে।বিশ্বাস যেহেতু নেই”

হ্যাঁ নায়ের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে অবশেষে তারা দুজনই যাবে চয়নকে স্কুলে দিতে। হাতে মাত্র পনেরো মিনিট বাকি।ভয়ে কাদো কাদো অবস্থা ছোট ভাইটার।তার মুখ দেখেই এই লোকটার সাথে যেতে রাজি হয়।একা আসতে চাইলে কাব্য বকে বসে।সাফ জানিয়ে দেয় আজ থেকে তার একা চলাফেরা বন্ধ। ক্ষোভ প্রকাশ করার সময়টুকু ছিলো না হাতে।

“পেছনের সিটে কেনো যাচ্ছো?”

“আমি পেছনেই বসবো”

“আমার পাশের সিটটা তোমার অধিকার।আসো”

ফ্রন্ট ডোর খুলে দাড়ায় কাব্য।পেছনের সিটে আগেই চয়ন চড়ে বসেছে। তর্কাতর্কি আর মতবিরোধের সময় নেই।স্কুল এখান থেকে ভালো দুরত্বে।দ্রুত উঠে বসলো সেও।হুট করে চারুর মনে হলো কাব্য কি স্কুলের রাস্তা চেনে। হন্তদন্ত স্বরে রাস্তা বলতে শুরু করেছে।চারুর কথার তোয়াক্কা না করেই কাব্য গাড়ি অন্যদিকে ঘোরালো।

“আপনি কোথায় যাচ্ছেন? এটাতো ওর স্কুলের রাস্তা না।”

“জানি আমি”

“তাহলে? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাদের?”

“স্কুলে”

“এটাতো…”

“চারুলতা আমি জানি ওর স্কুল কোনটা। শর্টকাট নিচ্ছি যেনো দ্রুত পৌঁছানো যায়।বিশ্বাস রাখো”

‘ বিশ্বাস ‘ শব্দে তুচ্ছ হাসে চারু।আড়ালে।কাব্যর দৃষ্টির অগচরে।কেমন ভয়ঙ্কর মিথ্যে শোনাচ্ছে শব্দটি তার মুখে?চারু মনে মনে ভাবলো এই পৃথিবীতে কখনো কাউকে ঘৃনা করা হয়নি। ঘৃণিত ব্যক্তির তালিকা ছিলো একদম শূন্য।এখন পুরোটা পৃষ্ঠা জুড়েই কাব্য আফনান।এভাবে জড়িয়ে যাওয়া যায় কারো জীবনে?একে ছিনিয়ে নেওয়া বলে।নিজের কাছ থেকে নিজেকে ছিনিয়ে নেওয়া।অন্যের অধীনে নিজেকে অনিচ্ছায় সমর্পণ করা।

“ও আপু।আপু?”

চয়নের ডাকে ধ্যান ভাঙ্গে।মুখ ঘুরিয়ে দেখলো তাকে দরজার বাহিরে।তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে চোখ যায় সদর দরজায়।স্কুল এসে গেছে।

“আপু আসি।”

গাড়ির উইন্ডো থেকে হাত বের করে ভাইয়ের মাথায় বুলিয়ে দিয়ে বললো, “ভালো মতন পরীক্ষা দিবি।একদম মাথা ঠান্ডা করে।আর এখন দ্রুত যা ভিজে যাচ্ছিসতো!”

“ওকে টাটা।”

যাওয়ার পূর্বে চয়ন পা উচিয়ে কাব্যর উদ্দেশে বললো, “ধন্যবাদ খারাপ ছেলে”

দৌড়ে স্কুলের ভেতরে ঢুকে গেলো চয়ন।উভয়েই বীমুঢ়।সময় নিয়ে হেসে উঠলো কাব্য। গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে সমস্ত গাড়ি জুড়ে।এক মুহূর্তে ইচ্ছে হলো ঘুরে তাকাক।দেখুক কাব্যর মতন খারাপ লোকের মুখের হাসি।কেমন দেখায়?জেদের বসে আটকে গেলো। ঘৃণিত ব্যক্তির মুখে কি দেখবে?শুধুই বিতৃষ্ণা!

গাড়ির ভেতরের পরিবেশ থমথমে।রেইন গার্ড সামনের গ্লাস পরিষ্কার রাখতে রীতিমত যুদ্ধ করছে।এতটাই জোর বৃষ্টির যে বারবার ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে।চারু আনমনে ভাবতে থাকলো।কিছুই দেখা যায় না সামনে।তারপরও গাড়ীর চালকেরা কিভাবে হ্যান্ডেল করে এতবড় গাড়িটাকে?ভয় করেনা তাদের?মিনিট পাঁচেক পর গাড়িকে স্থির আবিষ্কার করে চারু। এবার মুখে ফিরে চেয়েছে কাব্যর দিকে।থামলো কেনো?বৃষ্টির পানি জমে থাকা গ্লাসের আড়ালে যতটুকু দেখছে এটা তাদের বাড়ি নয়।তার ভাবনা চিন্তার মধ্যেই কাব্য বেরিয়ে পরে বাহিরে।চারুর পাশে এসে দরজা খুলে দাড়ায়।অল্প সময়ে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেলো।সাদা শার্ট শরীরে লেপ্টে। চুলগুলো লেপ্টে ঝুঁকে আছে মুখে।

মুখে হাসি টেনে বললো, “ভিজবে চারুলতা?দেখো কি সুন্দর বৃষ্টি”

মুখ কুচকে ফেলে চারু।ভেজার কথা ছিলো? কেনোই বা ভিজবে?সরাসরি জানিয়ে দিলো চারু, “আমি ভিজবো না!”

“বৃষ্টির পানিতে রাগ,কষ্ট,অভিমান,অতীত সব ধুয়ে মুছে যাবে।”

“সাময়িকভাবে”

“না চারুলতা।বৃষ্টি পবিত্র।আনন্দের বর্ষণ।এই বর্ষণ দুঃখ কেড়ে নিয়ে অভিলাষ ছড়িয়ে দিয়ে যাবে অন্তরাত্মায়।”

বৃষ্টি অপ্রিয় মানুষের সন্ধান এই পৃথিবীতে দেখা মেলে না।লোভী হয়ে উঠে মন এই ধারায়। ছুয়ে দেখতে ইচ্ছে হয়। সিক্ত হতে চায় দেহ আর হৃদয় অমত্ত।বুক ভেঙে কান্না আসছে চারুর। তিনটে দিন খুব করে অস্রু ঝরাতে চেয়েছে।পারেনি।একাকীত্বে নিজের মর্মযন্ত্রণার হিসাব মেলানো হয়নি।এই বোধহয় সুযোগ। প্রকৃতির বর্ষণের আড়ালে নিজের অস্রু লোকানো যাবে।

বেরিয়ে এলো চারু।সামনেই বড় একটা পুকুর।রাস্তার দ্বারে সবুজের সমারোহ।এটা ভিন্ন রাস্তা।একটুখানি থেমে চারু কাব্যর দিকে না চেয়েই বললো, “বৃষ্টি আমার ভীষণ পছন্দের।আপনি অপছন্দের।তাই বৃষ্টির ডাকে সাড়া দিলাম।আপনার কথায় নয়।”

এবার গায়ে মাখেনি চারুর ধারালো কথা।হেলান দিয়ে দাড়িয়ে রইলো গাড়ীর কাছে।ভিজছে সেও,তার চারুও।দুজনের দর্শনশক্তিতে পরিবেশ ভিন্ন।চারু বৃষ্টি দেখবে আর কাব্যর দৃষ্টি থাকবে চারুতে আবদ্ধ।পুকুর পাড়ে হাত ছড়িয়ে দাড়িয়ে পড়লো চারু।মুখ তুলেছে আকাশপানে।প্রবল বেগে আসা বৃষ্টির ছিটে আঁচড়ে বিবর্ণ মুখশ্রীতে।পুষ্কর বেয়ে যাচ্ছে সর্বাঙ্গে। শৈত্য হচ্ছে মস্তিষ্ক।অদ্ভুত অনুভূতি!প্রতিবার এই শান্তিটাইতো চাচ্ছিলো সে।কোলাহল শূন্যতা চারিদিক। কাব্যর উপস্থিতিও ভুলতে বসলো চারু।পেছনে হাত পকেটে গুজে ঠায় দাঁড়িয়ে। অক্ষিপল্লবে জল জমেছে।ভিজে জুথুবুথু হয়ে দৃষ্টিশক্তিতে ধারণ করছে এক লাবণ্যতা।মাধুর্যে ভরপুর তার নজর। বৃষ্টি তাকে বিশেষ টানছে না।যতটা চারুর শ্রী।মস্তিষ্ক জ্বলে উঠে যখন উপলদ্ধি করলো চারুর কাপড় লেপ্টে আছে দেহে।দেখা মাত্র একক্ষণ অপেক্ষা করলো না।গাড়ীর ভেতরে খোজাখোজি অভিযান চালিয়ে দিলো।একটা জ্যাকেট এখানে থাকার কথা।পেলো না।কিন্তু গতরাতে ফেলে রাখা ব্লেজার পেয়েছে। হাতে তুলে চারুর দিকে দৌড়িয়ে গেলো।তার মনোযোগ হরণ না করেই পড়িয়ে দেয় তাকে।পিত্তি জ্বলে উঠে চারুর।এতখন সম্পূর্ণ নিস্তেজ হয়ে ছিলো।

“আমি চাই না তোমার উপর কারো কু দৃষ্টি পড়ুক।আমারও না”

___

প্রবল জ্বরে পুরো দেহটা যেনো পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে।তার সাথে মাথার প্রচণ্ড যন্ত্রণা। চোখজোড়া রক্তবর্ণ ধারণ করেছে চারুর।ঊষ্ণ নিঃশ্বাস ভারী হলো।কম্পন ধরলো সারা শরীরে। গুঙ্গানির আওয়াজ পাচ্ছে কাব্য। একপর্যায়ে বাতি জ্বালায়।গুটিয়ে থাকা চারুর মুখপানে চেয়ে বোঝা হলো সে ঠিক নেই।

“কি হয়েছে চারুলতা?”

উত্তর নেই চারুর।বুকে দুহাত গুজে মাথা নিচু করে শুয়ে আছে।
কাব্য পূনরায় প্রশ্ন করলো,

“তোমার খারাপ লাগছে?”

এবারও কোনো উত্তর আসেনি।কাব্যর কন্ঠস্বর কান অব্দি পৌঁছেছে।তবে মস্তিষ্কে পৌঁছাচ্ছে না।কুকিয়ে উঠলো আবারো।হাত বাড়ালো চারুর কপালের দিকে।অনেকটা এগিয়ে নিয়ে থেমে গেছে। ঠোঁট কামড়ে ভেবে নিলো আনমনে কিছু।বিছানা থেকে নেমে পা বাড়ালো ঘরের বাইরে।

দরজার বাহিরে এতরাতে কাব্যকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে শায়লার মনে প্রশ্নের ছড়াছড়ি।মুখ ফুটে প্রশ্ন করবে বলে।তার আগে কাব্য বললো,

“চারুলতার শরীরটা বোধহয় ভালো না। একটু দেখবেন ওর কি হয়েছে?”

শরীর ভালো না শুনে আর কোনো কথা বলেনি।সোজা কাব্যকে টপকে ঘরের দিকে ছুটেছেন।কাব্য উকি দিয়ে একবার চঞ্চল সাহেবকে দেখে নিলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজায় দাড়িয়ে থাকা আমজাদের দিকে সেও ছুটে গেলো।

“আমজাদ!”

কাব্যর আওয়াজে ঘুমটা কাথাবালিশ নিয়ে একটা দৌড় লাগিয়েছে।বসে বসে ঝিমাচ্ছিলো।কি হয়েছে সেই প্রশ্ন করার আগে আমজাদ ভাবলো।আজ তার স্যার সুরেলা কণ্ঠে লম্বাটে টানে তাকে ‘আমমমজাআআদদদ’ বললো না কেনো?

“শুনছো তুমি?”

“জ্বি? হ্যা হ্যা স্যার বলেন”

“ডাক্তার ডাকো”

“ডাক্তার?কিন্তু কেনো স্যার?”

“প্রশ্ন করবে না।ডাক্তার ডাকতে বলেছি ডাকো।”

অসহায় মুখ বানিয়ে আমজাদ উত্তরে বলে, “এত রাতে ডাক্তার কোথায় পাবো স্যার?”

মুখ কুচকে ফেলে কাব্য।রাগী দৃষ্টি ছুঁড়ে দিলো আমজাদের দিকে।বলে উঠলো তেজী স্বরে, “সেদিন রাত তিনটে বাজে ডাক্তার কোথায় পেয়েছিলে?”

হটাৎ সেদিনের কথা মনে পড়লো।ওই লোককে পায়ে গুলি করা হবে সেটা কাব্য রাত আড়াইটের সময় জানায়। আধঘন্টার মতন রাতের আঁধারে ডাক্তার খুঁজেছে। সময় ছিলো তার হাতে আধ ঘন্টা।একমাত্র সেই সাজে কি করে এত রাতে সবকিছু ম্যানেজ করেছে।আজ আবারো একই কান্ড?

“মেয়ে ডাক্তার আনবে।পুরুষ আনবে না। দ্রুত যাও দ্রুত আসো।আমার চারুলতা অসুস্থ”

মেয়ে ডাক্তারের কথা শুনে মাথাটা আরো ভনভন করে উঠে আমজাদের।ছেলে হলে একটা কথা।মেয়ে মানুষকে আনবে কি করে?মুখের ওপর দরজা বন্ধ হওয়াতে আত্মা উড়ে যাওয়ার উপক্রম।বলেছে যেহেতু করতে বাধ্য। উপরওয়ালার কাছে প্রার্থনা করতে করতে সিড়ি বেয়ে নেমে পড়লো।

“কি হয়েছে চারুলতার?”

থমথমে গলায় শায়লা উত্তর দিলেন, “জ্বর”

“বেশি?”

“হুম”

“এখন?”

“ওষুধ খাইয়ে দিয়েছি”

উৎকণ্ঠা হয়ে কাব্য শায়লাকে প্রশ্ন করে, “না জেনেই ওষুধ দিয়ে দিলেন?”

“আমি মা ওর!ছোটোবেলা থেকে ওর সুস্থতা, অসুস্থতা আমি দেখে এসেছি।এতটুকু জানি কখন কি ব্যবস্থা নিতে হবে আমার মেয়ের জন্য।তোমার এসব ন্যাকা চিন্তা না করলেও চলবে”

ডাক্তার এসেছেন।মহিলা ডাক্তার। পেশেন্টকে দেখেছে খুব বিনয়ের সাথে।কিন্তু রাগী দৃষ্টি আমজাদের দিকে।কত কাঠখড় পোহাতে হয়েছে একে আনতে সেটা তো আর কাব্যর জানা নেই।এভাবে একটা ডাক্তারকে তুলে আনা যায়? হেফাজতে ডাক্তারকে ফিরিয়ে দিয়ে আসার দায়িত্বটাও আমজাদকেই দেওয়া হলো।শান্তি নেই কপালে।চারুর অবস্থা একটু ভালো দেখে আশ্বস্ত হয় কাব্য।এগিয়ে গেলো রান্না ঘরের দিকে।বোতলে সরিষার তেল নাম পড়ে বসিয়েছে চুলোয়।সাথে হাতটাও পুড়লো বেখেয়ালিতে।সাদা তোয়ালেতে পেঁচিয়ে নিয়ে চারুর পায়ের কাছে এসে বসে। আলতো হাতে চারুর পায়ে তেল মালিশ করছে।

ছোট্ট স্বরে ঘুমন্ত চারুর পানে করুন দৃষ্টি রেখে বললো, “সরি।সরি তোমাকে বৃষ্টিতে ভিজিয়েছি।আর সরি তোমাকে বিনা অনুমতিতে স্পর্শ করছি”

চলবে…