চারুকাব্য পর্ব-১১+১২

0
226

#চারুকাব্য ১১
লেখা : #azyah_সূচনা

কাব্যর মাদকমিশ্রিত কণ্ঠে ‘ বউ ‘ বলে সম্বোধন কানে বাজছে চারুর।এক মুহূর্তে তড়িৎ গতিতে বিচলনে চেয়ে গেছে হৃদয়। শিরশির অনুভূতি সর্বাঙ্গে।একটা শব্দ কতটা প্রভাব ফেলতে পারে?কিছু শব্দ,কিছু অনুভূতি হটাৎ করে এসে মস্তিষ্কে গেঁথে যায়।এর মধ্য দিয়েই যাচ্ছে চারু।সন্ধ্যা থেকে রাতের গভির পর্যন্ত এই চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো।সকালে গায়ে কাথা দেখে অবাক হয় চারু। সেতো গায়ে কাথা ঘুমায়নি।কাথা ছিলোও না আশেপাশে কোথাও।তাহলে? অনুমতি ছাড়া কেউ এই ঘরে আসবে না।হুট করে কাব্যর কথা মাথায় এলো। সে আসেনিতো?

গেটে করাঘাতের আওয়াজ শুনে গায়ে ওড়না জড়িয়ে উঠে দাড়ায়।বললো,

“আসেন”

আমজাদ এসেছে দরজার বাহিরে দাড়িয়ে থেকেই বললো, “ম্যাডাম বইগুলো কোথায় রাখবো?”

“বই?কিসের বই?”

“আপনার পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য”

কাব্য বিচলিত হয়ে আমজাদের সামনে এসে দাঁড়ায়।বলে, “আপনি ঢাকায় গিয়েছিলেন?আমার বাবা মাকে দেখেছেন?কেমন আছেন ওনারা?”

“না ম্যাডাম ঢাকা যাইনি। কিনে এনেছি বইগুলো।আর আপনি চিন্তা করবেন না আপনার পরিবার ঠিক আছে”

এরই মধ্যে কাব্য এসে উপস্থিত।বইগুলো আমজাদের হাত থেকে নিয়ে ভেতরে চলে আসে।চারুর সদ্য জাগ্রত মুখটা দেখে স্মিথ হাসলো।বললো,

“ফ্রেশ হয়ে আসো।আমি বইগুলো টেবিলে সাজিয়ে দিচ্ছি।”

চারু ফ্রেশ হতে চলে গেলো। টেবিলটা ময়লা হয়ে আছে এক কোনায় পড়ে থেকে। রুনাকে ডেকে একটা কাপড় হাতে নিয়ে নিজেই পরিষ্কার করতে লাগে।পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কাজের এক পর্যায়ে হাতে খিলের সাথে লেগে রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগলো।কাব্য হাত তুলে বুঝতে পড়লো অনেকটা কেটে গেছে। অনর্গল রক্ত পড়ছে।তাওয়াল হাতে বেরিয়ে এলো চারু।মুখ মুছে কাব্যর দিকে চাইলেই দেখতে পেলো রক্তের বন্যা।চক্ষু কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম।

“এই!” বলে দ্রুত গতিতে এগিয়ে গেলো কাব্যর দিকে।

কাব্যর হাত চেপে ধরলো।ওড়নায় হাত চেপে চারু বলতে লাগলো, “হাত কাটলেন কি করে? ইশ!কত রক্ত বেরোচ্ছে।”

শুভ্র ওড়নায় রক্তের দাগ। আঘাতপ্রাপ্ত হাত নিজের দুহাতে আগলে নিয়ে আছে।চোখ মুখ ভর্তি অস্থিরতা।এদিক ওদিক করে রক্ত মুছে দেওয়ার চেষ্টায়।কাব্য চুপচাপ।চারুর একের পর এক প্রশ্নের কোনো উত্তরই দিলো না।চোখ গেঁথে আছে চারুর চিন্তিত মুখমণ্ডলে।

স্তম্ভিত কাব্যর মুখপানে চেয়ে চারু বললো, “কি হলো? বোবার মতন দাড়িয়ে আছেন কেনো?অনেক কেটেছে দেখছি।ঘরে মেডিসিন আছে?”

কাব্য নিরুত্তর এবারও।রেগে উঠলো চারু।কাব্যকে নিষ্পলক চেয়ে থাকতে দেখে মুখের কাছে তুড়ি বাজিয়ে বললো, “কি সমস্যা? মেডিসিন আছে নাকি জিজ্ঞেস করছি কানে কথা যায়না?”

“নাহ”

হেয়ালি উত্তর দেয় কাব্য।চারু আরো খানিকটা তেতে উঠলো।কাব্যর শক্ত হাত টেনে এনে বসিয়েছে তাকে।বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,

“বসে থাকেন এখানে।আপনার ঐ চ্যালা কোথায়?আমজাদ?কাজের সময়তো একে খুঁজে পাওয়া যায় না”

মিনিট খানেক কাব্য বসে আছে।চারু হনহন করে বেরিয়েছিলো।ঠিক একই গতিতে ফিরে এসেছে আমজাদকে নিয়ে। জানিয়েছে তাকে তার স্যারের আঘাত পাওয়ার কথা।সেও তাড়াহুড়ো করেই মেডিসিন বক্স এনে কাব্যর সামনে দাড়ালো।নিজেই আগ বাড়ে কাব্যর হাতে ব্যান্ডেজ করার জন্য।

চারু সামান্য চেচিয়ে উঠে।বলে, “এই সরেন আপনি।”

“আমি করছি ম্যাডাম”

“আপনি কেনো করবেন?আমি করবো সরেন দেখি”

আমজাদ দুয়েক কদম পিছিয়ে নেয়।কাব্য কম ছিল?এখন চারুও ঝাড়ি দিতে শুরু করেছে।কাব্য যতবার আঘাত পেয়েছে পূর্বে কে ব্যান্ডেজ করেছে?খোদ আমজাদ।আজ কিনা তার এই অধিকারও কেড়ে নেওয়া হলো?মুখ লটকে দাড়িয়ে রইলো একদিকে।অন্যদিকে অতি সযতনে কাব্যর হাতে মেডিসিন লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলো চারু।এই ক্ষত তার মধ্যে কোনো প্রভাব ফেলছে না।প্রভাব ফেলেছে চারুর চিন্তা।সামান্য রক্ত দেখে বিচলিত হওয়া তার মন।বিনা শব্দে এই অস্থির মুখের দৃশ্য মনে ধারণ করে রাখলো।পারলে আজও ছবি তুলে রাখতো।

“জ্বলছে?”

“উহুম”

চারু মুখ তুলে মলিন কণ্ঠে প্রশ্ন করে, “কিছু খাবেন?”

“নাহ”

কাব্যর ‘ নাহ ‘ কথাটি কানে তুললো না চারু।পূনরায় নিজের তেজী ভাবমূর্তি বজায় রেখে বলে উঠে,

“চা দিতে বলবো?”

“তুমি বানিয়ে খাওয়াবে?”

চারু থামলো।একবার চেয়ে নিলো কাব্যর দিকে।আবদার করছে মিহি কণ্ঠে। নিঃশ্বাস ফেলে চারু সম্মতি জানিয়ে বললো,

“ঠিক আছে”

এতটা দিন পর প্রথম এই বাড়ির রান্নাঘরে পা রেখেছে।ইচ্ছে হয়নি এতদিন।নিজের মধ্যেই মত্ত ছিলো চারু।রান্না ঘরটা পরিপাটি।সুন্দর। সৌন্দর্য্য বর্ধন করেছেন রুনা এবং টুনি। চুলোয় চা বসিয়ে আনমনে ওড়নায় লেগে থাকা রক্তের দিকে চেয়ে।চোখ জোড়া সেখানে অদ্ভুতভাবে আটকে আছে।লাল টকটকে রক্ত তার শুভ্র ওড়নাকে রাঙিয়ে।এক পীড়া অনুভব করলো চারু।খারাপ লাগলো বোধহয় কাব্যর জন্য।প্রথমবার! মানুষটাতো শান্ত।একদিনের স্বভাবে তাকে নিয়ে অনেকটা ভেবে ফেলেছে। বিয়ে করাকে কেন্দ্র করে তাকে ঘৃণিত ব্যক্তির তালিকায় ছুঁড়ে দিয়েছে।কই?এতদিন কাছে থেকেওতো কোনো ক্ষতি করলো না তার?উল্টো যত্নে রাখার চেষ্টা করছে।পারছে না। বোধগম্যতার অভাব!

“আপনার চা”

বিনয়ের সুরে কাব্য বলে উঠে, “ধন্যবাদ”

“ব্যথা কমেছে?”

চায়ে চুমুক দিয়ে কাব্য উত্তর দিলো,

“কোনো ব্যথা নেই চারুলতা।….চা-টা খেতে বেশ হয়েছে”

মুচকি হাসে চারু।কাব্য তার দিকে চাইলে পূনরায় মুখ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ফিরে আসে।টেবিলে রাখা বইগুলো নিয়ে বসলো।খুলে দেখছে।নতুন বইয়ের ঘ্রাণ শুকতে লাগলো। পৃষ্টা এপিঠ ওপিঠ দেখতে লাগলো আনমনে।

“ভয় পেয়েছিলে রক্ত দেখে?”

মাথা উপর নিচ দুলিয়ে বললো, “হুম।রক্ত ভয় পাই অনেক”

“আমার সামান্য রক্ত কেমন তোমার মন অস্থির করে তুলেছে চারুলতা।যদি কোনোদিন মৃত্যুর ডাক পড়ে ভুলে যাবে আমায়?”

“এগুলো কেমন কথা?”

“ভুলে যাবে আমি জানি।আমি মনে রাখার মতন কিছু করিইনি।শুধু কষ্ট দিয়েছি তোমাকে।তোমার স্বপ্নকে বাঁচতে বাঁধা দিয়েছি।”

কাব্যর কথার পিঠে কোনো কথা বলতে পারলো না চারু।কেমন করে যেনো কথা বলে।তার মুখে উচ্চারিত মৃত্যু শব্দটি অসস্তি অনুভব করাচ্ছে।মুখ কালো করে বসে রইল চারু।কাব্য চায়ের কাপটা পাশে রেখে দিয়ে বললো,

“আজ থেকে পুরো দমে পড়ালেখা শুরু করো চারুলতা।আমি সাহায্য করবো। কাল আমজাদ ল্যাপটপ আনবে।সেখানে ভিডিও কলে তোমাকে তোমার প্রিয় মাহমুদ স্যারও সাহায্য করবেন প্রিপারেশনে।আর শুনো!মাহমুদ স্যারের সাথে যেনো পড়ালেখা বিষয়ক কথা হয়।”

একটু ভেবে আবার বললো, “আমিও পাশে থাকবো তখন।আমার ওই লোককে দিয়ে ভরসা নেই।তোমার জন্য নাকি ওর মায়া হয়।যত্তসব আদিখ্যেতা!তোমার দিকে ওর ভিন্ন নজর থাকলে থাকতেও পারে।রিস্ক নেবো না।”

বাচ্চাদের মত মুখ ফুলিয়ে বললো কাব্য। জেলাসিতে ভরপুর সম্পূর্ণ মুখমণ্ডল।নিজের অজান্তে হেসে ফেলে চারু। হাস্যকর দেখাচ্ছে কাব্যকে। হিংসায় এত দ্রুত নাক মুখ লাল হয়ে গেল?হাসিকে কাব্যর দৃষ্টির আড়ালে রাখতে হাত দিয়ে আলগোছে মুখ ঢেকে নেয়।

___

অনেকটা পিছিয়ে পড়ায়।একটা ঘটনা চারুর জীবনকে থমকে দিয়ে গেছে।আগ বাড়ানোর শক্তি হয়ে উঠেনি। স্তব্ধ মস্তিষ্ক নিয়েই পড়েছিল এতদিন।দিন এসেছে দিন গেছে।কোনো ইয়াত্তা নেই চারুর। স্বাভাবিক দিনের মধ্যেও কেমন যেনো অস্বাভাবিকতা।নিজের কথামত চারুকে পড়তে বসায় কাব্য। পূনরায় আগের রূপ।একজন শিক্ষকের মতন আচরণ। সন্ধ্যার সময় মাহমুদ ভিডিও কলে থাকে।দুই ঘণ্টা সময় নিয়ে তাকে প্রত্যেকটা টপিক বোঝায়।সেখানে থাকে আরো একজন।কাব্য।তার সামর্থের বাহিরে যেসব বিষয় সেগুলোর দায়িত্ব মাহমুদ এর।কল করে কড়া গলায় জানিয়েছে।তার স্ত্রীকে যথা সম্ভব ভালো প্রিপারেশন নিতে সাহায্য করতে হবে।ঠান্ডা হুমকি হিসেবেই নেয় মাহমুদ এবারও।নিজের সারাদিনের কাজ শেষে এখন চারুকে পড়াতে হয়।

রাত একটায় কাব্য এলো চারুর ঘরে।বইয়ের দিকে পূর্ন মনোযোগী চারুর পানে চেয়ে বললো,

“চারুলতা? একটু ব্রেক নাও।চা করে দেই?”

একটু আধটু স্বাভাবিক হয়ে কথা বলতে শুরু করেছে চারু।পড়ার ব্যাপারে বেশ সিরিয়াস।কাব্যর আওয়াজে বললো,

“এখন ব্রেক নিতে পারবো না।আমি অনেক পিছিয়ে।সময়ে কুলানো যাচ্ছে না।”

“অসুস্থ হয়ে পড়বে চারুলতা।”

“আমি পারবো।আপনি ঘুমোন গিয়ে।”

একহাত চুলের গভীরে ডুবিয়ে আছে চারু। মাঝেমধ্যে টেনে ধরছে। মাথা ব্যাথা করছে নিশ্চয়ই। তিনঘন্টা যাবৎ বইয়ে মুখ গুজে।কাব্য গেলো না।সামনে দাড়িয়ে ইচ্ছা প্রকাশ করলো নিজের।

শান্ত সুরে শুধালো, “এখন চা খেলে রাতে ঘুম আসবে না।চুলে তেল ম্যাসাজ করে দেই?ভালো লাগবে।”

বিব্রতবোধ করে চারু।বলে উঠে, “কি দরকার?”

“ভালো লাগবে চারুলতা।মাথা ব্যাথাটাও কমবে।”

চারুকে উত্তর দেওয়ার সুযোগ দিলো না কাব্য।পা বাড়িয়ে ড্রেসিং টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ায়।চারুর জন্য সর্বরকমের প্রসাধনী সামগ্রী এনে সাজিয়েছে সে নিজে।তেল নিয়ে পূনরায় ফিরে আসে।চারু মাথা বেকিয়ে তার দিকে চেয়ে।

“দেখি চুল খুলো”

চারু আড়ষ্ট বোধ করলো।সাথে মাথাটা ম্যাজম্যাজ করছে।’না’কথাটা গলায় আটকে।একজন পুরুষ মানুষ চুলে তেল দিয়ে দেবে?তাকে অনুমতি দেওয়া ঠিক হবে?চিন্তা ভাবনার সাগরে ডুব দিতেই যাচ্ছিলো তার আগে কাব্য নিজ হাতেই পিছনে পড়ে থাকা চুলের বিনুনী খুলতে লাগলো। কাব্যর মধ্যে যে অধিকারবোধ খেলছে সেটা উপলব্ধি করার সাথেসাথে হাত থামায়। নিরব চারুর পানে একবার চেয়ে নিজের কাজে আবার মনোযোগী হলো।রুক্ষ হয়ে আছে চারুর চুলগুলো। কখনও তার কেশমালা ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্য হবে? কল্পনাও করতে পারেনি।আলতো হাতে চুলে তেল দিয়ে দিচ্ছে কাব্য।চুলের গভীরে হাতের স্পর্শ পেয়ে শিরশির অনুভূতি হয়।নড়েচড়ে উঠে তৎক্ষনাৎ।

ঠোঁট ভিজিয়ে বললো, “আপনি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেই পারেন। অযথা আমার পেছনে সময় নষ্ট করছেন”

“সময় কাটাচ্ছি তোমার সাথে।নষ্ট করছি না”

পুরুষালী আঙ্গুলের বিচরণ চলছে কেশমালায়।অতি যতনে। চেষ্টা করছে তার মনোহরীর ক্লান্তি দূরীকরণের।কাব্যর দৃষ্টির আড়ালে উসখুস করতে করতে চোখ নিভু নিভু হয়ে আছে চারুর। বেলী ফুলের সুবাস ভেসে আসতে লাগলো ঘ্রাণইন্দ্রিয়তে। ঘোরে আচ্ছাদিত হতে শুরু করেছে চারুর চারিপাশ।পিঠ এলিয়ে দিলো চেয়ারে।আবেশে চোখটাও বুজে নেয়। দীর্ঘ সময় নিজে বসেই পাড়ি জমিয়েছে গভীর তন্দ্রার রাজ্যে।

চারুকে বসে ঘুমিয়ে পড়তে দেখে নিশ্চিন্ত হলো কাব্য।এটাই চাচ্ছিলো সে।বেশ কিছুদিন যাবত নিজের খাওয়া ঘুমের কোনো খেয়ালই রাখছে না।জোর করার সাধ্য নেই আর তার। অন্তরালে কতটা হেরে গেছে চারুর কাছে?এই বিষয়ে নিজেই অজ্ঞ।খুব সাবধানে কোলে তুলে নিলো চারুকে। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে কাতর গলায় বলে উঠলো,

“কি করে বোঝাবো কতটা দুর্বল আমি তোমার কাছে।তোমাকে নিয়ে কত অস্থিরতা পুষে রেখেছি।ভালোবাসা কিভাবে জাহির করতে হয় চারুলতা?আমার অনুভূতিরা আমার সাথে ঠাট্টা করে।জ্বালাতন করে আমাকে।অনেক অনেককিছু বলতে চাই।বলা হয়না।তোমার মায়াভরা মুখের সামনে এসে প্রতিদিন হেরে যেতে হয় আমাকে”

চলবে..

#চারুকাব্য ১২
লেখা : #azyah_সূচনা

অশ্বের গতিতে সময় পরিবর্তন করে এসেছে সেই কাঙ্ক্ষিত দিন।চারুর খুশিতে ঝুমছে গাছ পালাও।কাব্য জানিয়েছে ঢাকা ফিরবে। কাল বাদে পরশু চারুর পরীক্ষা।খুশি দ্বিগুণ।বাবা মায়ের দেখা পাবে।অবশেষে তার পরীক্ষাটাও দেওয়া হবে।ভয় আর খুশিতে মিশ্র অনুভূতি।আজ জানান দিয়ে কাব্যর প্রতি সন্তুষ্টি এসেছে।চারুর হাসিমাখা মুখ গুটিসুটি হয়ে বসে দেখছে কাব্য।আনমনে তার ঠোঁটও প্রসারিত। অনেকটাদিনতো হলো।এত সুখের ছড়াছড়ি চারুর শ্রীতে দেখা মেলেনি।

“খুব খুশি তাই না?”

ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নেয়। দুষ্টু মিষ্টি হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বলে উঠে, “হ্যা”

“কিন্তু চারুলতা?”

“হ্যা?”

“একটু সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে তোমার।সাথে আমারও।আমরা ঢাকায় আছি সেটা যেনো ভ্রুনাক্ষুরে কেউ টের না পায়”

প্রাণোচ্ছল মুখটা মিয়ে আসে।আবারো সন্দেহেরা হানা দিলো।বললো,
“কেনো?”

“এখন তোমার এসব নিয়ে ভেবে লাভ নেই।তুমি মাথা ঠান্ডা রাখো।”

চোরাবালিতে ফেলে দিয়ে বলে তলিয়ে যাওয়া নিয়ে ভাবতে হবে না।এই লোকটা কখনো স্পষ্ট উত্তর দিতে জানেনা নাকি?শুধু শুধু মাথায় চিন্তা ঢুকিয়ে দিয়ে এড়িয়ে যায়।ভাবতে নিয়েও ভাবলো না। হাতে সময় কম।আজ বিকেলে এই চর থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে।কতটা দিন কাটিয়েছে এখানে। লাগেজের চেইন আটকে বের হয়।মাথাটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে।আজ হটাৎ মায়া ধরলো কেনো?এইযে অল্প সময়ের ব্যবধানে এত সুন্দর জায়গাটি ফেলে চলে যাবে?মনটা আকস্মিক বিষিয়ে উঠলো।যখন সময় ছিলো কদর করা হয়নি।চারু বাড়ির নেমপ্লেটেটির দিকে চায়।সেদিন যে গোলাপগুলো তরতাজা ছিলো?সেগুলো ঝড়ে গেছে। পাতাগুলো শুকিয়ে জমিনে গড়াগড়ি খাচ্ছে।চারুর মনে হলো সৌন্দর্য ঝড়ে গেছে এই নেমপ্লেটের।তারাও কি বিরহ চারুর বিদায়ে?

মধ্যরাতে গাড়ি নড়ছে। পেছনে আরো একটি গাড়ি।তাদের সম্পূর্ণ পাহারার দায়িত্বে। গম্ভির থমথমে কাব্য। অন্যদিন স্বাভাবিক গেটআপে থাকলেও আজ আবার কালো ব্লেজার জড়িয়েছে পরনে।মুখটা মাত্রাতিরিক্ত ভার। এমনিতে কতবার তাকায় চারুর দিকে।আজ তাকাচ্ছে না। অনেকক্ষন যাবতই জানালার বাহিরে মুখ করে আছে। অন্যমনস্ক কাব্যকে পাশে বসে বারবার পর্যবেক্ষণ করে চলেছে।আবার আগের রূপে ফিরে গেলো?ঢাকা আসলেই বোধহয় তার মনের শয়তান জেগে যায়।

কয়েক ঘন্টা অতিবাহিত করে কাব্য থমথমে গলায় বললো,

“ঘুমাবে?সরে বসবো?”

“নাহ”

“আমার কাঁধে মাথা রাখতে পারো।”

ইতস্তত বোধ করে চারু বললো, “না আমার ঘুম আসছে না”

ঘুম আসছে না বলার আধঘণ্টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে চারু।কাব্য মাথা দুলিয়ে হাসলো।ভালোবাসার মানুষ সবভাবেই সুন্দর। সিটে মাথা এলিয়ে ঘুমিয়ে আছে চারু।ঠোঁট কিঞ্চিত ফাঁকা হয়ে আছে।ঘুমোলে তার হুশ থাকে না।সেটা এতদিন সাথে থেকেই বুঝেছে।চারুর বাহু আলগে মাথা রাখলো তার কোলে। আমজাদকে আদেশ করলো পাতলা কাথাটা এগিয়ে দিতে। কাব্যর কোলে মাথা রেখে কুকড়ে থাকা চারুর গায়ে চাদর টেনে ঢেকে দিয়েছে।

মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।একহাত টেনে নিজের বুকে রেখে ফিসফিসিয়ে বললো, “মনোহরী?হৃদয়ের রানী আমার?আমার অন্তর ক্ষয় হচ্ছে তোমার অনুরাগে। অনুভব করতে পারছো কি তুমি?”

__

গাড়ি এসে থেমেছে অন্যত্র।চোখ খুলে তাকাতেই চারু বিষম খেলো। কোথায় নিয়ে এসেছে কাব্য?এটাতো সেই বাড়ি নয়।ভোরের আলো ফুটছে সবে।এখনও কিছুটা আবছা চারিদিক। আলো আর আঁধারের মাঝামাঝি। প্রকৃতির নতুন রূপের চেয়ে স্থানের ভিন্নতা বেশি ভাবাচ্ছে চারুকে। জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে চাইলো কাব্যর দিকে।

“নেমে এসো চারুলতা”

“এটা কোথায় এনেছেন?বাবা মা চয়ন কোথায়?”

“এখানেই আছে”

কাব্যর হাত ধরেই নেমে আসে চারু।বাড়িটা দেখে বোঝা গেলো বেশ পুরনো। জং পড়া গেট টপকে ভেতরে যেতেই স্যাঁতস্যাতে মাটিতে পা পড়ে।পাশেই একটা পুকুর।গাছ গাছালিতে ঘেরা। কয়েক কদম এগিয়ে বাড়ি চোখে পড়লো।কাব্যর হাত ছেড়ে দেয় চারু।

কাব্য পিছু ডেকে বললো, “হাতটা ছেড়ে দিলে চারু?তোমার হাতের উষ্ণ স্পর্শ আর কিছুক্ষণ রেখে গেলে হতো না?”

নিশ্চুপ মুখখানা।কাব্য চেয়ে থেকে হেসে উঠলো।এগিয়ে এসে বলল,

“চলো তোমার বাবা মা অপেক্ষা করছে”

“এখানে কেনো?”

“ওই বাড়িটায় রিস্ক ছিলো চারুলতা।তাই তাদের নিরাপদে এনে রেখেছি”

চারু প্রশ্ন করতেই যাচ্ছিলো।তার আগেই ওষ্ঠে কাব্যর আঙ্গুলের ছোঁয়া পেয়ে থেমে গেলো।থামিয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে। একজোড়া গভীর ভাসমান চোখ কথার সাথেসাথে নিঃশ্বাসও আটকে। ঘোরযুক্ত স্বর ভেসে এলো,

“আর কোনো প্রশ্ন করবে না।”

হাত সরাতেই চারু মুখ খুলে, “আপনিতো সবসময়ই এড়িয়ে যান।আপনাকে প্রশ্ন করে এই পর্যন্ত কোনো লাভ হয়েছে?”

মেয়ে এসেছে। আকষ্মিক! খুন্তিটা হটাৎ হাত থেকে পড়ে গেলো শায়লার। ‘ আমার চারু,আমার মা! ‘ বলে দৌড়ে আসলেন। শক্ত করে বুকে চেপে করেছেন।কান্নার পাশাপাশি গলা উচিয়ে চঞ্চল সাহেব এবং চয়নকেও ডেকে দেন।প্রায় একমাস।একমাস পর মেয়েকে পেয়ে পাগলপ্রায় অবস্থা শায়লার।মেয়ের মুখে চুমু খেয়ে চলেছেন। চয়নও এসে বোনের সাথে লেপ্টে আছে। শায়লার নজর কাব্যর দিকে পড়লো।চোখ কটমট করে ফিরে যেতে লাগলেন মেয়েকে নিয়ে।

কাব্য বলে, “আমিওতো একমাস পর ফিরলাম। আমাকেতো এভাবে ভালোবাসলেন না….মা?”

কাব্যর কথা শুনেও না শুনার ভাব করে হেঁটে চলেছিলেন।তাকে ভালোবাসার প্রশ্নই উঠে না। একটু থেমে যখন ‘ মা ‘ ডাকটা কানে আসলো।চারজোড়া পা থেমে যায়। শায়লার সাথে চারুরও।থমকে দাঁড়াতে বাধ্য করে কাব্যর মায়াময় কন্ঠস্বর।চারুর হৃদয়ে হাতুড়ি পেটা শুরু হয়েছে।সেতো জানে।সে জানে কিভাবে ফেলে রেখে চলে যাওয়া হয়েছিলো তাকে।বাবা মা বেচে থাকতেও তাদের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়ে গেছে বছরের পর বছর।শায়লা এই ব্যাপারে অজ্ঞ।কি প্রতিক্রীয়া দিবে বুঝতে পারছে না।কিন্তু মা ডাকটা তার মন নাড়িয়ে দিয়েছে।

কাব্য হেসে বললো, “আরেহ আপনারা দেখছি ইমোশনাল হয়ে গেলেন।আমি এমনেই বলেছি। পানি পেতে পারি? তৃষ্ণা পেয়েছে”

চয়নের কি যেনো হলো।দৌড়ে গিয়ে পানি এনেছে।কাব্যর দিকে এগিয়ে বললো, “এই নাও খারাপ ছেলে।সেদিন তুমি আমাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়েছিলে না?”

চয়নের চুলে হাত বুলিয়ে কাব্য বললো, “শোধবোধ করলে শালাবাবু?”

“হ্যা” দুষ্টু হাসে চয়ন।

___

ঘুম বাদ দিয়েই পড়ায় মনোযোগী।ভয়টা একদিন আগে বেশি মাথায় চড়ে বসলো।ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ।মাথা গুলিয়ে আসছে।যা পড়েছিলো সবই ভুলে যাচ্ছে।আওয়াজ করে বই বন্ধ করে নিজের চুল মুঠ করে ধরে।নিচু হয়ে জোরেজোরে নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো।এমন কেনো লাগছে তার?আগেও পরীক্ষা দিয়েছে।ভয় পেয়েছে। অস্থির লাগেনি।

“কি হয়েছে চারুলতা?”

করুন গলায় বললো, “আমার খুব ভয় করছে।আমি একবারে টিকে যেতে চাই পরীক্ষায়। একবার না পারলে আমি শত চেষ্টা করেই পারবো না পরবর্তীতে। সব ভুলে যাচ্ছি।এমনেতেই জানা নেই প্রশ্ন কোথা থেকে আসবে।তার মধ্যে যদি এই অবস্থা হয়!”

চেয়ার টেনে চারুর পাশে এসে বসলো কাব্য, “শুনো মেয়ে।তুমি ভীত।আর এই ভয়টাই এখন তোমার মস্তিষ্কে ভর করে আছে। যার ফলে তোমার মনে হচ্ছে তুমি সব ভুলে গেছো।আসলে কিন্তু এমন কিছুই না।ঝেড়ে ফেলে দাও সব চিন্তা।”

চারু কাদো কাদো হয়ে বললো, “পারছি নাতো!”

“পরবে চারুলতা।আমি বলছি পারবে।আগামী কাল তোমার পরীক্ষা অনেক ভালো হবে।এখন বই রাখো।তোমার মা চা আর পাকোড়া করেছেন।খাবে চলো।তোমার উসিলায় আমারও খাওয়া হবে”

পরিবারের মিলন মেলা চলছে।মেয়ে বাবা মা ভাইকে পেয়ে খুশিতে গদগদ।পরীক্ষার ভয়টা নেমেছে তাদের মাঝে বসে। সস্তি পেলো কাব্য। কয়েকবার চোখাচোখি হয় চঞ্চল সাহেবের সাথে।তিনি হয়তো কিছু বলতে চাচ্ছেন। ইচ্ছেকৃত এড়িয়ে যাচ্ছে কাব্য।

সকাল সকাল ছোটাছুটি।চারু পরীক্ষা দিতে যাবে। শায়লার উঠতে দেরি হয়ে গেছে।নাকে মুখে নাস্তা রেডি করতে লাগলেন।সাথে দুজন হেলপিং হ্যান্ড।তারাও একই গতিতে কাজে মনোযোগী।চারু এক এক করে সব কাগজ গুছিয়ে নিলো। কাল রাতে এসব না করে কিভাবে ঘুমিয়ে পড়ল সে?চারু আর অন্যদের তাড়াহুড়ো দেখে কাব্য বসে বসেই হাপিয়ে উঠেছে।এক পর্যায়ে উঠে দাড়ায়।কাপড় চেঞ্জ করে বেরিয়ে আসে।সেই যাবে চারুকে হলে নামিয়ে দিতে।

নাস্তার টেবিলেও বইয়ে মুখ গুজে।শেষ সময়ের রিভিশন চলছে।শায়লা সাদা রুটি ছিঁড়ে মেয়ের মুখে পুড়ে দিচ্ছেন একের পর এক। কাব্যর দিকে নজর যায়।নিজের খাওয়া বাদ দিয়ে ফ্যালফ্যাল নয়নে তাদের দিকে চেয়ে।মায়ের নরম মন। অথচ নমনীয়তা দেখাতে চাচ্ছে না কাব্যর প্রতি। চয়ন বললো,

“তোমারও খেতে ইচ্ছে করছে আমার মার হাতে তাই না খারাপ ছেলে?”

“নাহ নাহ”

“মা আমাকেও কম ভালোবাসে,আপুকে বেশি।তোমাকে বোধহয় ভালোবাসে না।আমি তোমাকে খাইয়ে দেই আসো”

বলেই কাব্যর মুখে রুটি পুড়ে দিলো।হাসতে হাসতে খেয়েও নিয়েছে।চারুর সেদিকে খেয়াল নেই।খাবার শেষ করে মেয়েকে দোয়া দুরুদ পড়ে বিদায় জানায়। চিঞ্চল সাহেব কাব্যর কাছে এসে বললেন,

“শুনো কাব্য”

চঞ্চল সাহেবকে এড়িয়ে যেতে যেতে উত্তর দিল,

“এখন সময় নেই।প্লিজ আটকাবেন না!”

গাড়ি চলছে।চারু চুপচাপ বসে।চোখ খিচে বন্ধ করে আছে।মাঝেমধ্যে হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিচ্ছে চোখ খুলে।ঢাকার জ্যাম ঠেলে পঁচিশ মিনিটে এসে হাজির এক্সাম সেন্টারে।তরুণ তরুণীদের কোলাহলে মুখরিত চারিপাশ।চারু কাব্যর দিকে চাইলো।

ছোট্ট করে বললো, “আসি”

কাব্য চারুর হাত ধরে আমজাদকে বললো, “একটু বাহিরে যাও। চারুর সাথে কথা আছে আমার।”

আমজাদ বেরিয়ে যেতেই কাব্য বলে, “আমি যদি তোমার কপালে একবার ঠোঁট ছুঁয়ে দেই?আমাকে আরো ঘৃনা করবে চারুলতা?শুধু একবার!আর কক্ষনো না…”

থরথর কাপছে কাব্যর হাত।ব্যাপক অনুরক্ত এই কন্ঠ।খুব করে চাইছে চারুর কপালে ছোট্ট স্পর্শ দিতে।তার চোখজোড়া হিপনোটাইজ করতে জানে।বিশেষভাবে।চারু নিরুত্তর।

“বলো ঘৃনা করবে?আমি কোনো অপবিত্র ইচ্ছায় তোমাকে ছুঁতে চাই না! প্লিজ চারু!”

অস্ফুট গলায় জবাব দেয় চারু, “করবো না ঘৃনা”

মাথার পেছনে হাত পেঁচিয়ে কপালে ওষ্ঠ ছোঁয়ায় কাব্য।সময় নেয়নি এক মুহুর্ত।যদি এই সময়টা চলে যায়? আটকানো দায় হয়ে পড়ে?অধর সরিয়ে কপালে কপাল ঠেকায় অল্প সময়ের জন্য।

অস্থির গলায় বলতে লাগলো, “মুক্ত পাখির মতোন ডানা মেলে উড়ে বেড়াও চারুলতা।নিজের স্বপ্নকে বাচো। ভালোবাসো সবাইকে।নিজেকে ভালোবাসো।তোমার সকল ইচ্ছেরা পূর্ণতা পাক!”

চারু চলে গেলো।গেটের ভেতরে প্রবেশ করে একবার ফিরে চেয়েছিলো।তার ফিরে চাওয়া আন্দোলন শুরু করলো বক্ষে। বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে অনুভতির দল। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে কাব্য।ডান চোখের কোণ বেয়ে ঝড়ে পড়লো একফোঁটা অস্রুদানা।গোলগোল ব্যথিত নয়নে চেয়ে আছে গেটের দিকে।আরেকটা বার যদি দেখা পেতো?

“স্যার”

লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো কাব্য।আমজাদ গাড়িতে উঠে বসেছে। গুরুগম্ভীর গলায় আদেশ করে উঠে,

“চলো আমজাদদদদদ”

“স্যা.. স্যার একটা কথা….”

“না আমজাদ কোনো কথা না।গাড়ি টানো”

চারুর পরীক্ষা শেষ হয়েছে।খুব ভালো পরীক্ষা দিয়েছে সে।নিজের উপর বিশ্বাসী।ফলাফল তার মন মত হতে পারে।কাব্য ঠিকই বলেছিলো। সবই তার ভয়। আসলেতো সে কোনো পড়া ভুলেইনি।উচ্ছাসের জোয়ার নিয়ে গেটের দিকে এসেছে।কাব্যর অবদান আছে এতে।সাথে মাহমুদ স্যারেরও।এতটা খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে গিয়েও ভালো পরীক্ষা কেনো পরীক্ষা দেওয়ার আশাটাই বাদ দিতে চলেছিল।মনে মনে ভেবে নিলো কাব্যকে একটা ধন্যবাদ দিবে আজ।যতই খারাপ হোক,ভুল করুক একটা ধন্যবাদ তার প্রাপ্য।

বড়ো কালো গাড়িটা রাস্তার দ্বারে দাড়িয়ে আছে। চিনতে ভুল করলো না।আমজাদ ড্রাইভিং সিটে বসে হাত দেখাচ্ছে। কাব্যও হয়তো সেখানেই বসে।চারু এগিয়ে যায়।গাড়ীর দরজা খুলে পুরো ফাঁকা গাড়ি দেখে কপাল কুঁচকে নিলো।প্রশ্ন করলো,

“আপনার স্যার কোথায় আমজাদ সাহেব?”

আমজাদ এদিক ওদিক চেয়ে বললো, “উনি একটা কাজে আটকা পড়েছেন।তাই আসতে পারেননি।আপনি উঠে বসুন।বাড়ি পৌঁছে দিতে বলেছে আপনাকে ঠিকমতো”

“আচ্ছা”

চারু বাড়ি ফিরেছে অনেক আগে।ফিরে এসেই বাবা মাকে জানায় তার পরীক্ষার কথা।তারা মেয়ের কথায় মাথায় হাত বুলিয়েছেন।আরো বেশি দুআ করছেন রেজাল্টের জন্য।জানেন তারা।ভরসা আছে চারুর উপর।ছোটোবেলা থেকেই অধ্যবসায়ী।পড়ালেখা ছাড়াও সমস্ত কাজে তার জুড়ি নেই। চঞ্চল সাহেব এখনো বুক ফুলিয়ে বলেন।কপাল গুনে এমন মেয়ে পেয়েছেন। রাত্রীর প্রহর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর।রাতের খাওয়া দাওয়া সারতে অনেক সময় লেগেছে।ঘরে এসে কাব্যর শার্ট ঝুলতে দেখে তার কথা মনে পড়লো।সেতো এখনও ফিরেনি।অনেক সময় হয়ে গেছে। বিয়ে করার পর তাকে বেশি সময়ের জন্য একা থাকতে দেয়নি।এমনকি ঘরেও না। আজ সারাদিন পাড় হলো।বারান্দায় দাড়িয়ে পুকুর পাড়ে আমজাদকে বসে থাকতে দেখে আরো বিস্মিত হলো।আজ তার চ্যালাকেও নেয়নি সাথে।গেলো কোথায়?

জোরালো কণ্ঠে ডাক পড়ে আমজাদের।চারু হাত উচু করে তাকে ডাকছে।আসতে বলছে।আমজাদ প্যান্ট ঝাড়া দিয়ে উঠে এগিয়ে আসলো। ঘরের দরজার সামনে এসে মনমরা হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“জ্বি ম্যাডাম?”

“আপনার স্যার ফিরছে না কেনো?”

উত্তর দিলো না আমজাদ।মাথা নত করে রইলো।চারু আবার প্রশ্ন করলো,

“আজ আপনি সাথে যাননি কেনো?”

আমজাদ পকেট থেকে কিছু একটা বের করলো।এগিয়ে দিলো চারুর দিকে।একটা চিরকুট। ভেবেছিল দিবে না চারুকে। বসের কথার অনাম্য করবে।কিন্তু পারলো না।এগিয়ে দিয়ে চলে গেলো হনহন করে। চিরকুট হাতে নিয়ে ঘরে এসে বসে। আমজাদকে পিছু ডেকে লাভ হয়নি।

বিছানায় বসেছে চারু।দমকা হাওয়া চুলগুলোকে এক ঝটকায় এলোমেলো করে দিয়ে গেলো।শীতল অনুভূতির মধ্যে কালো কালিতে লিখিত কিছু বাক্য মনোযোগ সহকারে পড়তে লাগলো,

“ভালোবাসি..ভীষণ রকমের ভালোবাসি।ব্যাস এতটুকুই!”

বাতাসের দাপটে কাগজ উড়ে যায় হাত থেকে।উল্টে পড়লো জমিনের অন্যদিকে।চারু উঠে পূনরায় হাতে তুলে নিল। পিছনের পৃষ্টায় লেখা,

“আসি।কাছে থেকে পারলাম না।কিন্তু চারুলতা? হাওয়ায় মিশে একদিন সত্যিই আসবো ভালোবাসা অনুভব করাতে।”

চলবে…