চারুকাব্য পর্ব-১৭+১৮

0
207

#চারুকাব্য ১৭
লেখা : #azyah_সূচনা

“কবির আফনানের কোনো আপডেট?”

পুকুর পাড়ে এক নতুন সঙ্গী।মাস খানেক হবে এই সঙ্গীর। আমজাদের নারী বসের সাথে কাজ করার পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই।এখন করতে হবে।মাঝেমধ্যে একটু ঠিকঠাক কথা বলে।আবার মেজাজ দেখায়।পুকুর পাড়ে চেয়ারে বসে আছে চারু।সিড়িতে আমজাদ।

“না ম্যাডাম।পলাতক।”

“শুধুই পলাতক! মরেতো যায়নি।খুঁজে বের করতে পারেন না?ওই খারাপ লোক!আপনার স্যারকে এভাবে মেরে ফেললো।মনে জেদ জাগে না?কি শিখেছেন ওই খারাপ লোকের সাথে থেকে?শুধুই গুলি চালানো?”

নতজানু হয়ে আমজাদ উত্তর দিলো, “সেটাও ঠিকঠাক পারি না।স্যার বেশ ভালো পারতেন”

“আচ্ছা কোথা থেকে শিখেছে?”

“ম্যাডাম কাব্য স্যার সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণাই নেই।জানেন উনি অল রাউন্ডার।”

ভ্রু উচু করে আমজাদের দিকে বিচিত্র দৃষ্টি ফেললো। তাচ্ছিল্য করছে যেনো এমন তার মুখের ভঙ্গি।মাঝেমধ্যে আমজাদ ভেবে পায় না।আদৌ কি কাব্যর জন্য চারুর মনে কিছু আছে?নাকি নেই?কথায় কথায় অপমান করে বসে।

“আমজাদ সাহেব দেখি ধারণা দেন আপনার স্যারের ব্যাপারে।”

“স্যার প্রফেশনাল শুটার ছিলেন।সুইমিংয়ে তার কোনো জুড়ি ছিলো না।”

“পড়ালেখা? ফার্জি শিক্ষক হয়ে ঘুরেছেন কি যোগ্যতা নিয়ে।”

“সেটাতো জানি না।তবে শুনেছি ওনার দাদী ওনাকে পড়ালেখা করিয়েছিলেন।ইন্টার পাশ করার পর ওনার পড়ালেখা ওনার বাবা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।এরপর আবার শুরু করেন।কিন্তু সেটাও বেশিদিন করতে পারেননি। দ্বিতীয় বর্ষে এসেই বাবার সাথে ঝামেলায় জড়ায়।কিন্তু স্যারের যে বইয়ের প্রতি একটা আলাদা টান আমি দেখেছি।এই বাড়ির লাইব্রেরীতে একটা আলাদা আলমারি আছে দেখেছেন?”

চারুর চোখে ভেসে আসলো লাইব্রেরির একপ্রান্তে থাকা আলমারিটার কথা।যেটাকে সবসময় বন্ধই দেখেছে।চারু বলে উঠলো, “ওই পুরোনো আলমারিটা?”

“হ্যা ওই আলমারিতে সকল ধরনের বই আছে।সকল ধরনের মানে সব বিষয়ের।স্যার দিনের অন্তত তিনঘন্টা এখানেই কাটাতেন।জানার প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিলো তার।”

আমজাদ এর মুখে কাব্যর ব্যক্তিত্বের সাথে ‘ ছিলেন ‘ শব্দটা ব্যবহারকে বিশেষভাবে খেয়াল করে শুনছে।ছিলেন অর্থ অতীত।সে ছিলো।এখন নেই।আর কি দরকার পড়ে হৃদয়কে ছারখার করতে?তবে বুঝতে দিলো না আমজাদকে।

আমজাদ আবার বললো, “তারপর আপনি আসলেন।স্যার দিন দুনিয়া ভুলে গেলেন”

চোখ কটমট করে তাকায় চারু।খোচা মার্কা কথাবার্তা। আমজাদ চারুর প্রতি জেলাস।এটা হারেহারে টের পেয়েছে চারু।তাতে কি আসে যায়?চারুর চোখ দেখে দমে গেলো আমজাদ।নিচু করলো চোখ।

“আপনার স্যার কাজ কি করতো?”

“পিস্তল তৈরির কাজ”

চারু হতবাক।আমজাদ অর্ধেক কথা বলে নিজেই ফেঁসে গেল।বাকিটা পূর্ণ করতে মুখ খুলে,

“ম্যাডাম ইলিগ্যাল নাতো।লিগ্যাল।স্যারের কাছে লাইসেন্স আর অনুমতি দুটোই আছে।আপনাকে কাগজ দেখাবো? নাহয়তো আপনি বিশ্বাস করবেন না।”

কাব্যর কথায় মাথা নাড়ায় চারু।সে দেখতে ইচ্ছুক নয়।হাতের থাকা ঘড়ির দিকে নজর বুলিয়ে নিলো চারু।এখন উঠতে হবে।যাওয়ার আগে আমজাদকে বললো,

“আপনাকে আমি এক সপ্তাহের সময় দিবো।নিজের মাথার যত বুদ্ধি আছে আর আপনার স্যার আপনাকে যত ট্রেনিং দিয়েছে সব কাজে লাগান।কবির কোথায় আছে খুঁজে বের করবেন।”

“কবিরকে দিয়ে কি করবেন আপনি ম্যাডাম?”

“যেটা সে আপনার স্যারের সাথে করেছে”

“মেরে ফেলবেন?”

“ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথাটি বলেছি।কিন্তু বাংলায় বলেছি।এতটুক কথার অর্থ বোঝার কথা আপনার আমজাদ সাহেব”

“জেলে নিয়ে যাবে আপনাকে।”

“জেলে নেওয়ার জন্য আমি থাকলে তবে”

___

পৃথিবীর বুকে একটি ভুক্তভুগী প্রাণীর নাম হলো আমজাদ।তার জন্মই হয়েছে মূলত ভোগান্তি পোহানোর জন্য। রৌদ্র তেজ দেখাচ্ছে।ভাবলো নাম পরিবর্তন করবে।আকীকা দেবে।নিজের নাম রাখবে ‘ ভুক্তভুগী লোক আমজাদ ‘ ।খারাপ স্যার আর ভালো ম্যাডামের একমাত্র অ্যাসিস্টেন্ট ভুক্তভুগী আমজাদ।নয় বছর কাব্য তাকে নাকানি চুবানি খাইয়েছে।এখন দশতম বছর চলে।রেখে গেছে অগ্নীমানবীকে।বাকি যতটুক শুকনো ছিল সেগুলো চুবানি খাইয়ে নিঃশেষ করতে।তার অর্ডার মতই এদিক ওদিক হাঁটছে। কোথায় পাবে কবিরকে?এখানে আছে নাকি দেশের বাহিরে তাও জানা নেই।চারু কি ভেবেছে চেষ্টা করেনি আমজাদ?বিগত এক বছর কি হাত পা গুটিয়ে ছিলো? সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে কবিরকে বের করার।লাভ হয়নি।

শেষ চেষ্টা করতে প্রমোদের বাড়ির আশেপাশে আড়ি পাতলো।সেই লোকও পলাতক।দুই দুইবার নির্বাচিত নেতা ভেগেছে।এই তার ক্ষমতা!ছেহ!ঘামে ভেজা কোট খুলতে গা থেকে খুলতে খুলতে চোখ গেলো সামনে।চক্ষু ছানাবড়া। এতো প্রমোদের ছেলে! কোট খোলার ব্যাপারটা আপাদত বাদ দিয়ে গার্ডদের আদেশ করলো তার পিছু নিতে।তারাও দ্রুত গাড়ি নিয়ে তার পিছু নিলো। কোলাহলবিহীন রাস্তায় গাড়ি এসে থামে শ্যামল এর সামনে।বুঝতে বাকি নেই এই গাড়ি থামার কারণ।উল্টো ঘুরে দৌড় লাগাতে নিলে আমজাদ গুলি ছোড়ে।একদম পায়ের গোড়ালি বরাবর লেগেছে।

এক ঝুড়ি খুশির ঝলক দেখা দেয় তার মুখে।সে শুট করেছে!তাও আবার কাট টু কাট! ড্রাইভারও মুগ্ধ। হাজারখানেক বার এই কারণে কাব্যর কাছে আমজাদকে গালি খেতে শুনেছিল।আজ স্যারের অবর্তমানে সে এই কাজটা করতে পারলো।সে দেখলেই নিশ্চয়ই খুশি হতেন।

ড্রাইভার বললো, “সাব্বাস স্যার!কাব্য স্যার থাকলে আপনি যে ঠিকঠাক শুট করা শিখেছেন এটা দেখে গর্বিত বোধ করতেন।”

আমজাদ এর এখানেই জোর চলে।সেও একটু বস বস ব্যবহার করে বাকি গার্ডদের সাথে। চড়াও গলায় বললো, “শাট আপ।ওই পাতি মাস্তানরে ধরো আগে।হাঁটার শক্তি নেই ও দৌড়ানোর চেষ্টা করছে।”

পেছনে বসা একজন গার্ডসহ ড্রাইভার এগিয়ে গেলো দৌড়ে।আমজাদ হাঁটছে ধীর গতিতে। ল্যাংড়া শ্যামল আর দৌড়ে কতদূর আগাবে। গুলিটাতো আর যেনতেন লোক ছোড়েনি। ভুক্তভুগী আমজাদ ছুড়েছে। ধস্তাধস্তি করে রেহাই পেল না শ্যামল।তাকে এক প্রকার তুলে গাড়িতে বসানো হলো।নিয়ে যাবে ওয়ের হাউজে।খাতির যত্ন করবে ভালোভাবে।বাবার বদলে ছেলে।

“বলো বাবা তোমার বাবা কোথায়?”

আমজাদ এর কথায় শ্যামল বুঝে উঠতে পারলো না কিছুই।ধমকে জিজ্ঞেস করছে নাকি রসিকতা? বয়সেতো মোটেও আমজাদ তার বাবার বয়সের না। আদুরে কণ্ঠে বাবা বলে সম্বোধন করার মানে কি?

আমজাদ পূনরায় প্রশ্ন করলো, “কি হলো?মুখ খুলছো না কেনো?”

“আমি জানি না বাবা কোথায়”

“উহুম।বিশ্বাস করতে পারলাম না।সত্যি করে বলো।নাহয় যে গুলিটা তোমার পায়ে লেগেছে সেটা মাথার খুলতে যাবে”

কাদো কাদো গলায় শ্যামল উত্তর দেয়, “আমি সত্যিই জানি না।আমার কথা বিশ্বাস করুন।বাবা যাওয়ার পর থেকে আমাদের সাথে কোনোভাবে কন্টাক্ট করেনি।”

“আচ্ছা!আমরা জানি তোমার বাবা কোথায়।কিন্তু তার আগে একটা উত্তর দাও?কবির নামটা কোথাও শুনেছো?”

উত্তেজিত কন্ঠস্বরে শ্যামল জানতে চায়, “সত্যিই!সত্যিই আপনি জানেন বাবা কোথায়?”

“হ্যাঁ।আর তোমার বাবা একদম ফিট আছেন।যদি চাও বাবাকে পেতে তাহলে বলো কবির আফনানকে চেনো?”

“হ্যা চিনি আমি কবির আফনানকে।”

বোকা বাবার বোকা ছেলে।শুধু প্যাক প্যাক মুখটাই চলে।সুযোগ বুঝে দান খেলেছে।অথচ আমজাদ নিজেও জানে না প্রমোদ কোথায়।

“কোথায় আছে সে এটা জানো?”

“সে?সেতো জেলে!”

বিস্মিতবোধে ভরে উঠে আমজাদের চেহারা।এই উত্তরটা মোটেও আশা করেনি সে।কবির আফনান জেলে?কি করে হতে পারে?সেতো খবর নিয়েছে। কোথাও কবিরের কেস চলে না।দুয়েক কদম শ্যামলের দিকে এগিয়ে আমজাদ প্রশ্ন করে,

“জেলে মানে কোন জেলে? অনর্গল সব বিস্তারিত বলো শ্যামল।বাবাকে সুস্থ সবল দেখতে চাওতো নাকি?”

“ইতালি।সে আমার বাবার কাছ থেকে টাকা চাইতে এসেছিল।তার একাউন্ট হ্যাক করা হয়।তার পেছনে নাকি পুলিশ লেগেছে।যে করেই হোক তাকে পালাতে হবে। পালাতে সক্ষমও হয়।কিন্তু সেখানে গিয়েও বাচতে পারেনি।তথ্য ফাঁস হয়েছে তার।একটা মার্ডার কেস ছাড়াও পুরোনো অন্য সব খারাপ কাজের তথ্য। ইতালিতে তাকে আটক করা হলে আমার বাবাকে কল করেছিলো।কবির নানানভাবে তাকে বাঁচানোর জন্য হুমকি দিয়েছিলো বাবাকে।আমার বাবা এরপর থেকেই নিখোঁজ।শেষ তথ্য এটাই কবির আফনানকে সামনের মাসে দেশে আনা হবে।”

কপালে হাত রাখে আমজাদ।এতদিন আসল মানুষকে না খুঁজে দ্বারে দ্বারে ফিরেছে।আগেই প্রমোদের ছেলেকে পেলে হয়তো এই তথ্য আগেই জানা হতো।শ্যামল বারবার তার বাবার কথা জিজ্ঞেস করছে।আমজাদ কোনো উত্তর না দিয়েই বেরিয়ে গেলো। গার্ডকে অর্ডার করলো যেনো হসপিটালে নিয়ে তাকে ড্রেসিং করানো হয়।

__

মুখোমুখি আমজাদ এবং চারু। শায়লাও সেখানেই উপস্থিতি। বিছানার কোণে শুয়ে চঞ্চল সাহেবও কান পেতে।সবটা শোনার পর সবার মাঝেই নির্বাক ভাব কাজ করছে।পাশাপাশি চারুর মুখমণ্ডল।ভাবনায় মশগুল।পলক ফেলেনি একবারও।এক ধ্যানে চক্ষু নামিয়ে বসে আছে।

নীরবতা ভাঙলো মিনিট পাঁচেক পর, “আপনি কি বললেন আমজাদ সাহেব?তার অনৈতিক কাজের সব তথ্য আর?”

“একটা মার্ডার কেস”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে চারু বলে উঠে, “দেশে আনা হলে কবির আফনানের সাথে দেখা করার কোনো উপায় আছে?”

“স্যার থাকলে হয়তো সম্ভব হতো।কিন্তু এখন আমি কিই বা করবো একা?”

মার্ডার কেস এই কথাটা ঘুরপাক খাচ্ছে চারুর মস্তিষ্কে। মন ধরেই নিয়েছে এই মার্ডার কেসটা কাব্যর।তাছারাও যে প্রমাণ তার বাবা নিজ হাতে তুলে দিয়ে এসেছে কবিরের হাতে সেটা ফাঁস কি করে হয়?

“আমাকে নিয়ে যাবেন?”

“কোথায় ম্যাডাম?”

“সন্দ্বীপে।”

হঠাৎ সন্দ্বীপে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলো কেনো?সেখানে গিয়েই বা কি করবে?এই ভাবনা নিয়েই আমজাদ জিজ্ঞেস করে,

“সন্দ্বীপে কিন্তু কেনো ম্যাডাম?”

“এত প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই আমি।যেতে ইচ্ছে হচ্ছে আমার।এখনই বের হবো। ফ্লাইট বুক করেন।আমি দেরি করতে চাচ্ছি না।”

মাথাটা হয়তো পুরোই গেছে। সন্ধ্যা নামছে।এখন ফ্লাইট পাবে কোথায়? ভাবান্তরহীন চারু।বলেছে মানে সে যাবেই।যে করে হোক।আরেক দফা দৌড় ঝাঁপ শুরু আমজাদের।শান্তি নেই কপালে।ফোন হাতে নিয়ে তন্ন তন্ন করছে।কোনো ফ্লাইট আছে কিনা। ভাগ্যক্রমে একটা ফ্লাইট পেলো।রাত সাড়ে নয়টার ফ্লাইট।হিসেব করতে লাগলো আমজাদ।এক থেকে দেড় ঘণ্টা লাগবে চট্টগ্রাম পৌঁছাতে।তারপর কুমিরা ঘাট হয়ে সন্দীপ।এক ক্লিকে বুক করে নিলো।চারু যাবে সেই সুবাদে তারও যাওয়া অনিবার্য।কল করলো রুনা আপাকে।ম্যাডাম আসছেন জানিয়ে দিল।তার পাশাপাশি আবদ্ধ পড়ে থাকা বাড়িকে ঝাড়া মোছার আদেশও দিয়েছে।

নিজের জেদ অনুযায়ী তৈরি চারু।বাবা, মা, ভাইকে বিদায় দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে এয়ারপোর্ট এর উদ্দেশে। সাড়ে নয়টার পরিবর্তে দশটায় ফ্লাইট উড্ডয়ন হয়।ফ্লায় করার সাথে সাথে চারু আমজাদের উদ্দেশ্যে বলে উঠে,

“জানেন সন্দ্বীপে কেনো যাচ্ছি?”

“কেনো ম্যাডাম?”

“ভালো লাগেনা আমার এই শহর।সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়ার শখ জেগেছে।সেখানে আপনার স্যার মিলবে?”

চারুর কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে আমজাদ প্রশ্ন করে,” কি বলতে চাচ্ছেন ম্যাডাম?”

“বুঝেননি?”

“না ম্যাডাম।কি চাচ্ছেন আপনি?”

“মুক্তি!অনেকতো বেচেঁ থাকা হলো।আমার প্রত্যেকটা নিঃশ্বাস আমার এখন যন্ত্রণাদায়ক মনে হয়”

চলবে…

#চারুকাব্য ১৮
লেখা : #azyah_সূচনা

অস্থির বিচরণ আমজাদের পায়ের।কি চলছে ম্যাডামের মাথায়?কোনোভাবে নিজের জীবন নিতে চাইছে নাতো?প্রশ্ন করতে চেয়েছে ইনিয়ে বিনিয়ে।লাভ কোথায়? রক্তচক্ষু ছুঁড়ে দিয়ে দমিয়ে রেখেছে তাকে।পায়চারি করছে ঘরে।কঠিন আদেশ। ঘর থেকে এক পা বের করলে তার গুলি দিয়েই তাকে মেরে ফেলা হবে। সমুদ্রদ্বারে যেনো তাকে একা থাকতে দেওয়া হয়।একই আদেশ রুনা এবং তার মেয়ে টুনির জন্যও।তবে শান্ত স্বরে।তাদের ধমকায় নি।মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়নি।বাহানা খুঁজতে লাগলো আমজাদ।কিভাবে নজর রাখা যায়।কিন্তু সেতো আবদ্ধ।দরজা বাহির থেকে লাগানো। এমনকি জানালাটাও।শরীরের বল প্রয়োগ করে যে বের হবে সেটাও পারছে না।কাব্যর কালো শার্ট জড়িয়ে বেরিয়েছে চারু। উল্টোপাল্টা না কিছু করে বসে?

স্মৃতিচারণও অদ্ভুত একটা জিনিস।সেই জিনিসগুলোই মনে করায় যা মানুষকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয়। এককালের সুন্দর মুহূর্তগুলো রাত পেরোবার পর বিষদায়ক হয়ে উঠে।চারুর মতনই হয়তো বিষাদ এই সিন্ধু। পুরোপুরি চুপচাপ,নিস্তব্ধ। তারাও কি শোক পালন করছে? ঢেউ খেলছে না যে।কাব্যর উপস্থিতিতেতো উত্তাল ছিলো।প্রতিদিন উচু ঢেউ এসে আঁচড়ে পড়তো কূলে।এক পা দু পা করে নিস্তেজ সমুদ্রের দিকে এগিয়ে চললো চারু।ধীর গতি পায়ের।নিজের তলিয়ে যাওয়াকেও উপভোগ করতে চাইছে হয়তো।অর্ধ ডুবে হুহু করে কেদে উঠলো।

বললো, “রাত হয়েছে কাব্য।আজ কেনো ডাকছেন না?এই সময়টাতো আপনার জ্বালাতন করার।আমি স্বীকার করলাম।আপনার মতন খারাপ লোককেই আমি ভালোবাসি।আমাকে নিয়ে যান আপনার কাছে।আমি এই শূন্যতা সহ্য করতে পারছি না”

“চারুলতা?”

শ্রুতিভ্রম কি আর পিছু ছাড়ে। এতবার বারণ করার পরও একটা কন্ঠ ভাসে।বেহায়া কাব্য এখনও। আগে বারবার বলতো ভালোবাসি।চারুলতা চারুলতা বলে কান ধরিয়ে ফেলতো। এখনো ঠিক তাই।আবার ডাক পড়েছে।মুচকি হাসে চারু।আজ সাড়া দিবে ভেবে নিলো।এভাবে প্রতিদিন পুড়ে ছাই হওয়ার ছেয়ে মৃত্যু শ্রেয়।জীবনের প্রতি কোনো আক্রোশ না রেখেই আরো কয়েক কদম নির্বিঘ্নে এগিয়ে যায় সমুদ্রের দিকে।

গলা অব্দি পানি এসেছে।তার আগেই বাহু চেপে পেছনের দিকে ধাবিত করা হয় তাকে।পেছনে না ঘুরেই পুরুষালি হাতে শক্তভাবে আবদ্ধ হয় তার হাত।প্রশ্ন আসে অস্থির গলায়,

“পাগল হয়ে গেছো?কি করতে যাচ্ছিলে?”

সমুদ্র আজ নিস্তব্ধ হলেও বক্ষস্থলে বিশাল জোয়ার বয়ে যাচ্ছে।ফিরে তাকালো না চারু।ভুল হচ্ছে তার।এসবই ভ্রম।কাব্যর স্পর্শ আর কন্ঠ দুটোই তার কল্পনা।আর এই কল্পনাটাও অনেক বেশিই বাস্তবের মতন।এখনও হাতটি চারুর হাতে। শরীরের মধ্যে অস্বাভাবিক কম্পন শুরু হয়েছে। খিচে চোখ বন্ধ করে ফেললো চারু। বাহুর ঝাকুনিতে সেটাও বেশিক্ষণ টেকে নি। তড়িৎ গতিতে ফিরে তাকায়।একরাশ অবিশ্বাসের সাথে একজনকে দেখছে চোখ জোড়া। উস্কখুস্ক লম্বা চুল ঘাড় ছুঁয়েছে। দাড়ির আড়ালে পুরো মুখটাই যেনো অর্ধ ঢাকা।কল্পনার জগতে ভেসে বেড়ানো চারু বাস্তবে ফিরে আসতে সময় নেয়।মলিন মুখটা ডাকছে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে। কাব্য দুহাতে টেনে নিতে চাইলে বুকে ধাক্কা দিয়ে বসে। সজোড়ে থাপ্পড় পড়ে ডান গালে।মুখ তুলে তাকাতেই আরেক গালে ঠিক একইভাবে চড় পড়লো।

আজও চোখ দুটো ভাসমান। হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে চারুর দিকে।হয়তো যোগ্য ছিলো এই চড়ের।তাই মেনে নেয় কাব্যর হৃদয়।

গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে চারু।বলে, “যা এদিক থেকে।দুর হ!কেন এসেছিস।নাটক দেখাতে?এতদিন বাঁচতে দিচ্ছিলি না।এখন মরতে এসেছি সেটাও দিলি না।”

“চারুলতা..”

কাব্যর দিকে তর্জনী আঙুল তুলে বললো,

“একদম চারুলতা বলে ডাকবি না।”

কথা বলার কোনো সুযোগই রাখলো না।নরম হাত কঠোর হয়েছে।গাল চেপে ধরলো শক্ত করে। লার্ভার মতন জ্বলছে চক্ষু।তেজী গলায় বললো,

“কই ছিলি তুই?কেনো এসেছিস?এসেছিস যেহেতু গিয়েছিলি কেনো?”

নতুন রূপে চারুকে দেখে হতবাক কাব্য।এটাতো চারুর চরিত্র নয়।হতেই পারেনা।এতদিন পর সামনে পেয়ে চোখ সরাতে পারলো না কাব্য। কতটা তরপেছে এই মুখটা দেখার জন্য।তাকে কাছে পেয়ে তার অত্যাচারও মধুর মনে হলো।

শক্তিহীন হয়ে পড়লো চারু।এই দৃষ্টির কাছে তার রাগের কোনো জো আছে?কাব্যর মুখটা আরো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। আঘাতেরা দ্বিগুণ হয়েছে।চোখের উপর নিচ সম্পূর্ণ কালচে। ঘন দাড়ির আড়ালেও আছে অনেক ক্ষতের চিহ্ন। এগুলোতো আগে ছিলো না?চোখ নামিয়ে কাব্যর দুহাত টেনে ধরলো নিজের সামনে।শার্টের হাতা সরিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে।এখানেও ক্ষতের ব্যাপকতা।
বল প্রয়োগের বিপরীতে শীতল হাত জোড়া মোলায়েমভাবে ছুঁয়ে দিলো কাব্যর দু’ গালে।

কাতর কন্ঠে প্রশ্ন করলো, “আপনাকে এত ব্যথা ওই লোকটা দিয়েছে না?”

“হুম”

“কি অবস্থা করে ফেললেন নিজের!”

অজানা অধিকারবোধে কোমড় জড়িয়ে কাছে টেনে নেয় চারুকে।কপালের সাথে নিজের কপাল মিশিয়ে কম্পিত গলায় বলতে লাগলো,

“তুমি ছিলে নাতো”

থেমে যাওয়া অস্রু জল আবার গড়িয়ে পড়তে লাগে চোখ বেয়ে। নিঃশ্বাসের উঠানামা করার গতি বেগতিক। কান্নায় জর্জরিত হয়ে চারু প্রশ্ন করে,

“আপনি সত্যিই ফিরে এসেছেন তাই না? মিথ্যে নাতো কোনো?”

চোখ বুজে নেয় কাব্য।এই শান্তির খোজে পড়ে ছিলো এতদিন।কাছে এসেও স্বাদ মিটছে না। তৃষ্ণা মিটছে না হৃদয়ের।বুকে জরিয়ে ধরলো চারুকে।অতিরিক্ত শক্ত বন্ধনে আবদ্ধ করে নিলো তৎক্ষনাৎ।এতদিনের হাহাকার মিটতে অনেক সময়ের প্রয়োজন।

“সত্যিই ফিরে এসেছি।”

কাব্যর চুলের গভীরে হাত ডুবিয়ে আটকে রইলো চারু। বলিষ্ঠ বাহুডোরে। ক্রন্দনে পুরো মুখমণ্ডল সিক্ত। অন্যদিকে কাব্য সম্পূর্ণরূপে বাকশক্তিহীন।এখনও পারছে না প্রকাশ করতে মনের কাকুতি।গুলিয়ে আসছে ভেতরের সবটা। এতোটা দিন হাসপাতালের বিছানায় পরে শুধু প্রার্থনারাই ছিলো। রুহুটা দেহ ত্যাগ করার আগে একবার যেনো তার চারুলতার দেখা মেলে।তার আর্জি স্বীকৃতি পেয়েছে।

চারু মাথা তুললো।ছাড়িয়ে নিলো নিজেকে কাব্যর বাঁধন থেকে।পায়ের উপর পা রেখে উচ্চতার দূরত্ব মেটানোর চেষ্টা করে।অকস্মাৎ কাব্যর কপালে অধর ছোয়ায়।কাব্য তৎক্ষনাৎ না ঝুঁকায়।ভালোবাসা উজাড় করে দিতে যেনো তার চারুলতার কোনো কষ্ট না হয়। দ্রুততার সাথে কাব্যর সারা মুখে অজস্র মিষ্ট স্পর্শে ভরিয়ে দিতে লাগলো।বেছে বেছে আঘাতের স্থানগুলোতে। ব্যথাগুলো যেনো শুষে নেওয়ার চেষ্টা করছে ওষ্ঠের আভায়।পরপর হাতের উপরিভাগেও ঠোঁট ছোঁয়ালো।

জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো,

“আমি আপনাকে কোনোদিন ক্ষমা করবো না”

__

চোখের সাদা অংশ সেকেন্ডে সেকেন্ডে লাল টকটকে আভায় ছড়াচ্ছে।মেজাজের পারদ যত উচুতে উঠছে তার সাথেই অক্ষির ভয়ানকতা বাড়ছে।এই শীতশীত মৌসুমেও অনবরত ঘামছে আমজাদ।চোর ধরা পড়লে গণধোলাই এর স্বীকার হয়।তারপর নয়তো পুলিশে দেওয়া হয় নয়তো ছেড়ে দেওয়া হয়।এখানে কোনো সুযোগই নেই।সে এখন আসামি। তার সাথেই আরেকজন আসামি।কিন্তু পাশের জন ভাবলেশহীন। হাতে থাকা ব্যান্ডেজ খোলার চেষ্টা করছে।মাথা নামিয়ে। কোথায় তাকে বাঁচাবে তা না।সে নিজের কাজে মগ্ন।

সামনে বসে আছে চারু।চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে। উত্তাপ ছড়াচ্ছে বসে বসে।হুট করে বলে উঠলো,

“দুইজনের কাছে যতগুলো বন্দুক আছে আমার কাছে দেন।”

“ক..কি করবেন ম্যাডাম?”

“দুজনকে একে একে মারবো”

এবার চোখ তুলে তাকালো।একটু আগেই ভালোবাসা উজাড় করে দিয়ে এখন মেরে ফেলার কথা বলছে?মেয়েটার মাথা হয়তো পুরোটাই গেছে।কাব্যর শূন্যতা অতি ব্যাপক বদলে দিয়েছে।রেখে যাওয়া ফাঁকা স্থানে জায়গা নিয়েছে রাগ,জেদ।

আমজাদ কাব্যর পানে চেয়ে বললো, “আপনাকে আমি কয়দিন আগেও বলেছি। ম্যাডামকে সত্যিটা বলে দেন।দেখেন দুজনই ফাসলাম।”

একটা ভয়ানক দৃষ্টি কম ছিলো যে কাব্যও চোখ দিয়ে আগুন বর্ষণ শুরু করলো?আমজাদ বেচারা করবেতো করবে কি? দেবদাসের মতন লুক নিয়েছে।চুল বড় রেখেছে।মুখ ভর্তি দাড়ি।

কাব্য বললো,

“আমি হাসপাতালের বেডে পড়ে আছি সেটা তুমি সহ্য করতে পারলেও আমার চারুলতা পারতো না”

আমজাদ মনে মনে বলে উঠলো, “হ্যা আমিতো হৃদয়হীন মানুষ”

চেঁচিয়ে উঠে চারু,

“চুপ!দুইজনই ধোঁকাবাজ লোক।এই আমজাদ!উনি সব জানতো।তারপরও আমার সামনে এমন ব্যবহার করেছে সে আপনার শোকে মূহ্যমান।পুকুর পাড়ে বসে দুঃখ বিলাস করেছে”

“ম্যাডাম আমি জেনেছি মাত্র পনেরো দিন আগে।” নিজের পক্ষ নিয়ে মিনমিনিয়ে বললো।

“আর কবিরের কথা?সেটাতো কাল জেনেছেন?”

“ম্যাডাম স্যারের অবস্থা এক সপ্তাহ আগেও অনেক খারাপ ছিলো।সে নিজে নিজের কোনো সেন্সে ছিলেন না।তিন ধাপে অপারেশন করা লেগেছে। হসপিটালকেই নিজের ঘর বানিয়ে নিয়েছিলেন।উনি আমাকে কিছু জানাননি।আমি সত্যিই বলছি আমি কবিরের কথা জানতাম না।লুকিয়ে রাতের বেলায় স্যারের সাথে দেখা করতে যেতাম।একজন নার্স হেল্প করতো আমাকে।পুলিশের এত কড়া গার্ড!আমাকেও সন্দেহের পাত্র বানিয়ে ফেলেছিলো ”

চারু হাত তুলে থামিয়ে দিলো আমজাদকে। মনোনিবেশ করে কাব্যর দিকে।তুড়ি বাজিয়ে আদেশ করলো,

“এই খারাপ লোক!এবার আপনি শুরু করেন।সেদিন বাবার চলে যাওয়ার পর কি হয়েছে?কোনো থামাথামি নাই।এক নিঃশ্বাসে বলবেন।”

অতীত,

যতই প্রমাণ তুলে দেওয়া হোক না কেনো হাতে?কাব্যকে বিশ্বাস করা যায় না।তার জীবিত থাকা কবির আফনানের জন্য মঙ্গলজনক নয়।এই মস্তিষ্কে নানান পরিকল্পনা ঘুরে।তাই সিদ্ধান্ত নিলো বন্দুকের গুলিতে মস্তিষ্ক ছিন্নবিচ্ছিন্ন করবে। ট্রিগার চাপার আগেই মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠে কাব্য।গুলি গিয়ে দেয়াল ভেদ করেছে।হাতের বাঁধন অনেক আগ থেকেই খোলা। উঠে দাড়িয়ে সজোড়ে ধাক্কা লাগায় কবিরকে।

নিজের গা ঝাড়া দিয়ে বললো,

“সেন্সলেস ভেবেছিলেন আমাকে কবির সাহেব?”

কথার উত্তর দেওয়ার সুযোগ হয়নি।দুর কোথা থেকে পুলিশের সাইরেনের আওয়াজ ভাসছে।ভরকে উঠে কবির আফনান। মাটি থেকে উঠে দাড়িয়ে হন্তদন্ত হয়ে উঠলো।কাব্য এগিয়ে আসলে জমিনে পড়ে থাকা পিস্তল তুলে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে লাগল কাব্যর দিকে।একটি বাহুতে লেগেছে। অন্যটি পায়ে।বাকিগুলো সৌভাগ্যবশত মিস করে গেছে।পুলিশ এগিয়ে আসছে আভাস পেয়ে রয়ে যাওয়া গার্ডকে নিয়ে পেছনের রাস্তা নিয়ে দ্রুতগতিতে পলায়ন করে।

“কাব্য আর ইউ ওকে?আমরা বোধহয় দেরি করে ফেললাম অনেক”

“পুলিশ জীবনে সময় মতন এসেছে এই দেশে!বলেছিলাম রেডি থাকতে!”

অফিসার মুহিত কাব্যর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে।ঝাপসা চোখে যতটুক দেখছে আরো অনেক পুলিশ সেখানে উপস্থিত। রক্তাক্ত শার্ট আর ধূসর জমিন।আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে বললো,

“আমার কোটে একটা আলাদা পকেট আছে।সেখানে একটা চিপ পাবেন।আর কিছু কাগজ।সেগুলো নেন!”

“নিচ্ছি আমি বাবা।তোমাকে আগে হসপিটালে পৌঁছাতে হবে।”

“আরেহ রাখেন আপনার বাবা।বারবার এসে পড়েন সম্পর্ক জুড়ে বসতে।নিজের কাজ করেন।ওই কবিরকে ধরেন।সে পালাচ্ছে ”

মুহিত সাহেব অন্য অফিসারদের আদেশ করলো কাব্যকে হাসপাতালে পৌঁছে দিতে।কিন্তু সাবধানে। যেনো কোনো কাক পক্ষীও টের না পায়।তাদের মূল প্ল্যানই এটা। কাব্যকে মৃত দেখানো।

চলে যাওয়ার আগে কাব্য শার্টের কলার থেকে আরো একটি মাইক্রোচিপ বের করে দিলো।এখানে ঘটে যাওয়া সমস্ত কিছুর রেকর্ড এটায় রয়েছে। মুহিত বেরিয়ে পড়লো।অন্ত টানতে কবির আফনানের।

বড়ো বড়ো দুটো অপারেশনের পর কাব্যকে বেডে ট্রান্সফার করা হয়।একজন ছেলে এবং মেয়ে দৌড়ে আসলো।তাদের সাথে তাদের জননী। অস্পষ্ট চোখে নারীটিকে দেখে চিনতে ভুল করলো না কাব্য।এই অবস্থায়ও কপাল মাত্রাতিরিক্ত কুচকে নেয়।মুখ ঘুরিয়ে ফেললো অন্যদিকে।

মেয়েটি কাব্যর কাছে বসে বললো, “ভাইয়া আপনি ঠিক আছেন?ভালো লাগছে একটু?”

তাল মিলিয়ে ছেলেটিও বলে, “কোনো সমস্যা হলে বলেন।আপনার জন্যে টুয়েন্টি ফোর সেভেন ডক্টর আছেন।ব্যথা অনুভব করছেন?ডেকে দিবো?”

কথা বলতে পারছে না।তারপরও জোর খাটিয়ে বললো, “ভাইয়া ভাইয়া করছো কেনো?কোন জনমের ভাই আমি তোমাদের।আমার চোখের সামনে থেকে দুর হও সবাই।”

নির্বাক একপ্রান্তে সাবিনা। গুটিসুটি হয়ে দাড়িয়ে।অপরাধীর মতো নেত্র নত করে।এরই মাঝে মুহিত সাহেব প্রবেশ করলেন।কাব্যর দিকে এগিয়ে প্রথমেই মাথায় হাত রাখলেন।

আদুরে কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন,
“কেমন বোধ করছো বাবা?”

কাব্যর সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গেলো।কি বাবা বাবা লাগিয়েছে!কি সম্পর্ক তার সাথে কাব্যর?কোনো সম্পর্ক নেই।বিরক্তি ছেয়ে গেলো মুখে।অনেক কষ্টে আবার বললো,

“আমি আপনার ছেলে হই?এত দরদ দেখাচ্ছেন কেনো?”

মুহিত হাসে বলে, “না ছেলে হও না।এটা চিরন্তন সত্য।কিন্তু যে তোমাকে জন্ম দিয়েছে তাকে আমি স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছি।সেই সুবাদে তোমার সাথে আমার একটা সম্পর্ক আছে বটে”

“কোনো সম্পর্ক নেই। আপনার স্ত্রী আছে।ছেলে মেয়ে আছে।আপনার দায়িত্ব পালন করুন। কবিরকে জেলে ঢুকান।এরপর আপনার সাথে আমার আর কোনো কাজ নেই।আর প্লিজ আমার ভালো লাগছে না।বেরিয়ে যান এখান থেকে।আর ওই মহিলা অর্থাৎ আপনার স্ত্রী তাকে নিয়ে যান সবার আগে।”

“তোমার মা হয় কাব্য!”

“আমার কোনো মা নেই।কোনো বাবা নেই।আমি এতিম।”

মুহিত সাহেব বোঝানোর সুরে কাব্যকে বললেন, “এভাবে বলে না বাবা।আমি জানি তোমার মা ভুল করেছেন।আমিও অনেকাংশে এই ভুলের ভাগীদার।তোমার মা তোমাকে রক্ত দিয়েছে।আর কারো সাথে তোমার রক্ত মিলছিলো না।সে নিজের দুর্বলতাকে উপেক্ষা করেই ছুটে এসেছে এখানে”

“হটাৎ ওনার মমতা জাগলো কেনো?ফেলে রেখে যাওয়ার সময় এই মাতৃত্ববোধ কোথায় ছিলো?”

নিজের অস্রু লুকিয়ে বেরিয়ে পড়েন সাবিনা।কাব্য যা বলছে সত্যিইতো বলছে। কোথায় ছিলো তার মমতাবোধ?ছয় বছরের শিশুকে ফাঁসির দড়ি হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলো।পিছু না চেয়েই ফেলে চলে গিয়েছিল। এখন কেনো এত দরদ?কোনোভাবে ফিরিয়ে দিতে পারবে তার বাল্যকাল? যেথায় বাবা না হোক মায়ের আদরে বেড়ে উঠার বয়স ছিলো তখন জন্মদাত্রী মা নিষ্ঠুরভাবে তাকে দূরে ঠেলে চলে গেছে।আবার নিজের সংসার শুরু করেছে।নতুন মানুষের সাথে।আরো দুজন সন্তানের জননী হয়েছে।একটাবার খোজ নেওয়ার চেষ্টাও করেনি।ভুলতে বসেছিলো তার আরো একটা সন্তান আছে।সে বেচে আছে নাকি মরে গেছে জানার ইচ্ছে হয়নি।সামান্য রক্ত দিয়ে তার ভুলের ক্ষমা আশা করতে এখানে এসেছিল?সে একজন খারাপ মা। সুবিধাবাদী মা।

চলবে…