চারুকাব্য পর্ব-৭+৮

0
250

#চারুকাব্য ৭
লেখা : #azyah_সূচনা

‘আমার মনো মত্ত এই সন্দীপে
নিস্তব্ধ কায়াবনে।
মরুর বুকে তরঙ্গ খেলেছে
ঘিরে ধরছে চারুলতায়’

পূর্ণ উদ্যমে দুলছে কেশমালা।কদম জোড়া থেমে নেই। সর্বাঙ্গের শক্তি নিয়ে দৌড়াচ্ছে।বুকের মাঝে বিশাল অস্থিরতার জোয়ার।সামনে থাকা জলরাশির তরঙ্গও বড্ড নগণ্য।প্রশ্নের মহা সমুদ্র মস্তিষ্কটাও খালি।হাপিয়ে উঠছে।তারপরও ক্ষ্যান্ত দিলো না।দ্রুত বেগে বাহু চেপে ঘুরিয়ে ফেললো অর্ধ ডুবে থাকা কাব্যকে।এই উত্তাল মোহনায় কি করে স্থির দাড়িয়ে ছিলো সে?

“কি করছেনটা কি?”

শীতল চক্ষু ঘোরালো চারুর দিকে।প্রশ্ন করলো, “ঘুমাও নি?”

মস্তিষ্ক জ্বলে উঠে।যে কারণে ধড়ফড়িয়ে এখানে এসেছিল সেই প্রশ্নটি করার তোড়জোড় শুরু হয়।বলেই ফেলে চারু,

“ঘুম?আমাকে এখানে তুলে এনে কি স্বাভাবিকভাবেই না প্রশ্ন করছেন ঘুমাইনি কেনো?”

“হুম”

বুকের মাঝে আঘাত করে উঠে অকস্মাৎ।দুহাতের সাহায্যে ঠেলে দিলো কাব্যকে পেছনে।আওয়াজ তুলে বললো,

“কেনো করছেন এমন বলেন না?কি এমন শত্রুতা আমার সাথে? কোথায় নিয়ে এসেছেন এটা আমাকে?”

যতদূর চোখ যাচ্ছে শুধু সমুদ্র।তার মাঝেই সমতল ভূমি। সম্পূর্ণ খালি, নিস্তব্ধ। একটামাত্র বাড়ি এখানে।যেখান থেকে প্রাণপণে দৌড়ে এসেছে চারু এইমাত্র।

“আমার নীর, সন্দীপ”

সন্দ্বীপ কথাটি শুনে চারিপাশে ভালোভাবে চেয়ে দেখে চারু।কি ভয়ঙ্কর?এখানে মনে হলো তারা দুজন ব্যতীত অন্য কোনো প্রাণের অস্তিত্ব নেই।

“আমাকে বাঁচতে দিবেন না আপনি?”

মুচকি হাসে কাব্য।চাঁদের আলোয় হাসিটা স্পষ্ট দৃশ্যমান। পুরোপুরি প্রশ্নের বিপরীতে অনুমতি চেয়ে বললো, “হাতটা ধরি?”

“নাহ্!একদম না”

“আজ কিছু কথা বলবো চারু।এই কথাগুলোর মধ্যে নিজের প্রশ্নের উত্তরও পেতে পারো।”

শান্ত হলো চারু।কি কথা বলতে চায়?ঠিকঠাক উত্তর পাবে কি আজ?এই আশায় হেঁটে চলা কাব্যর পিছু নিলো।সাহস যোগায় মনে।একটু দুরত্বে গিয়ে বসেছে। চারুও সামনে গিয়ে দাড়িয়ে পড়ে।তার দিকে চোখ তুলে কাব্য বলে,

“পাশে বসো”

দীর্ঘশ্বাসের সাথে পাশে বসলো চারু।এই মুহূর্তে তার প্রশ্নের উত্তর অত্যন্ত জরুরি।যে করেই হোক জানতে হবে।কি কারণ এসবের পেছনে।কেনোই বা এসে জুড়ে গেলো তার জীবনে।

“আমি অত্যন্ত জঘন্য রকমের একজন মানুষ চারুলতা।যা করেছি নিতান্তই অন্যায় করেছি তোমার সাথে।ভালোবাসা এক অদ্ভুত বিষাক্ত অনুভূতি।চোখে দেখা যায় না,কোনো সঙ্গা নেই।কিন্তু হৃদয় গহ্বরে কেমন অদ্ভুত বিচলন চালায়।এরমধ্যে দিয়ে গিয়েছি আমি। যাচ্ছি।ক্ষয় করছি হৃদয়।আমার বর্ণহীন জীবনে এক বিচিত্র মেয়েকে চোখে ধারণ করেছিলাম সেই কবে।একদিন,দুদিন,তিনদিন।মাসের পর মাস।আমার মস্তিষ্ক তোমার ঘামে ভেজা মুখ ভুলতে রাজি ছিলোই না।আমি তোমার শহরের বাসিন্দা না।এসেছিলাম অন্য উদ্দেশ্যে।জানতাম না এখানে এসে পথভ্রষ্ট হবো।যদি প্রশ্ন করো কেনো বিয়ে করলাম।তাহলে বলবো লোভে পড়ে। একটু হাসির,একটু সুখের,একটু ভালো থাকার লোভে।”

বলে থেমে যায় কাব্য।চারুর কাছে আদৌ এসবের অর্থ আছে?নেই। সেতো তাকে ভালোবাসে না।তবে ভারী হৃদয়টা হালকা হচ্ছে।কত কথা জমে এই অন্তরে।সব কি বলা যায়?

নির্বাক শ্রোতা হয়ে শুনলো কথাগুলো।বললো, “কেনো এসেছিলেন এই শহরে?”

“কিছু ভুল শুধরাতে।”

“কি ভুল?”

অম্বরপান থেকে মুখ নামিয়ে চারুর দিকে চাইলো।কেমন ঘোর লাগানো চোখগুলো। নক্ষত্রের মতন চিকচিক করছে। আকুতিভরা কণ্ঠে বলে উঠে,

“একটা আবদার করবো চারুলতা?পূর্ণতা দেবে?”

“মানে?”

“আমাকে একমুঠো স্মৃতি দাও।যদি কখনো পথ আলাদা হয়ে যায়?কি নিয়ে বাঁচবো আমি? বেচে থাকার জন্য অন্তত তোমার কোলে মাথা রেখে চোখ বুজতে চাই”

নিদারুণ আবদার।চোখ ভরা আশা।চারু ভাবনা চিন্তার সাগরে ডুবে। আসলেই কি ভালোবাসে?তাহলে কেনো তার ভালোবাসা দেখে তার প্রতি মায়া জন্মায় না।শুধু সেই একটা ভুলের কারণেই।

“কোনো অপবিত্র অনুভূতির স্বীকার হবে না।কথা দিচ্ছি”

চারুর নীরবতা আর ভাবুক চেহারাকে সম্মতি ধরে নিলো।নিজ ইচ্ছেয়। মূল কথা তার নিজের প্রশান্তি দরকার।মনটা ভারী অস্থির তার। চট করে মাথা কোলে এলিয়ে গুটিসুটি হয়ে রইলো উদোম মৃত্তিকায়। ইতস্তত বোধ করলো চারু।হাসফাস করতে লাগলো বসে।

“আমাকে কতটুকু ঘৃনা করো চারুলতা?”

সময় নিয়ে এলোমেলো ভাবনায় ডুবে উত্তর দেয়, “জানি না। পরিমাপ করিনি”

“আমার মৃত্যু তোমার জন্য সুখদায়ক হবে?”

মৃত্যু আদৌ কারো জন্য সুখদায়ক হতে পারে?হোক সে আপন,পর অথবা ঘৃণিত কোনো ব্যক্তি।এই শব্দটাইতো ভয়ঙ্কর।সবকিছুর অন্ত।কেউ দূরে সরে গেলে মনে অন্তত একটা আশ্বাস থাকে আছে কোথাও।পৃথিবীর কোনো প্রান্তে।মৃত্যু মানে হারিয়ে যাওয়া অস্তিত্ব।মোটেও সুখদায়ক হবে না।এটাই উত্তর চারুর অথচ মুখ ফুটে বললো না।

“চারুলতা তোমায় বলেছিলাম ভালো থাকা,সুখে থাকা তোমার প্রাপ্য।তোমার শহরে তোমার বর্তমান অবস্থান আমার দয়া নয় তোমার হক।”

কাব্যর মাথাটা ভীষণ রকমের ওজনদায়ক বস্তুর মতন লাগছে।পাথরের ন্যায়। চাইলেই সরে যেতে পারছে না। অপরিচিত এক ধরনের বাঁধায় আটকা পড়ে আছে।থমকে আছে।

“ভীষন ভালোবাসি তোমাকে।”

নমনীয় সুরে চারু বললো, “আমি বাসি না। সত্যিই বাসি না। হ্যা আপনি ভুল করেছেন মানলাম।কিন্তু ভুল মানুষকে ভালোবেসে আপনি নিজেকেই কষ্ট দিবেন।আমাকে ভালোবাসা বন্ধ করুন!”

“কেনো ভালোবাসার বিনিয়মে ভালোবাসার পেতে হবে?আমার কাছে তোমার ঘৃনাটাই অমূল্য, প্রিয়।”

“ভুল করছেন আবারো”

বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো কাব্য। দৃষ্টির অগোচরে তার দিকে চেয়ে দ্রুত চক্ষু সরিয়ে নেয় চারু।মুখে তার কোনো কষ্টের প্রতিচ্ছবি নেই।আছে শুধু এক জোড়া মুগ্ধ চোখ।ডানপাশে সমুদ্রের পান থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল চারুর দিকে।বললো,

“দেখো কি সুন্দর যামিনী?বিশুদ্ধ নারীর কোলে মাথা পেতে আছে এক নিকৃষ্ট পুরুষ।সাক্ষী হচ্ছে এই শশী,অর্ণব আর রাশি রাশি নক্ষত্র।….. এই লগ্নে আমার মৃত্যু হোক!”

___

মাথায় হাত রেখে বসে শায়লা।মেয়েকে সারাবাড়ি হন্যে হয়ে খুজেছে।পায়নি। এমনকি কাব্যকেও না।সেই সময়টুকু মনে ভয় জাগেনি।আলমারি হাতড়ে যখন দেখলো কোনো কাপড় নেই।কাব্যর আনা লাগেজগুলোও নেই। ঘর এলোমেলো সম্পূর্ণরূপে।কপাল চাপড়ে বারবার আওড়াচ্ছে,

“আমার মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছে ওই ছেলে!”

মায়ের আর্তনাদে ছোট চয়নের মুখটায় একই ভঙ্গি।এবার কি হবে? বোনকে এভাবে নিয়ে চলে গেলো।কেউ টের অব্দি পায়নি?নিশ্চয়ই চারু যেতে চায়নি।সরাসরি বারণ করেছে?সেতো জানে না।তাকে সম্পূর্ণ জ্ঞানহীন ভাবে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।বারণ করার সুযোগটুকু পায়নি।

চঞ্চল সাহেব গম্ভীরমুখো।স্ত্রীর কাকুতি আর ছেলের প্রশ্নের কোনোটারই জবাব দিচ্ছেন না। বিনিময়ে কোনো মনোভাবও প্রকাশ করছেন না তিনি।শেষ অব্দি শায়লার কান্নার জোর বাড়লে তিনি বলেন,

“নিজের স্বামীর সাথে আছে চারু।তোমার এইভাবে কান্নার কোনো মানে হয়না শায়লা”

বিস্ফোরিত নয়ন নিজের স্বামীর পানে তুলে দিতে সময় নিলেন না।যতদ্রুত চঞ্চল সাহেবের বাক্য কর্ণপাত হয়েছে তত দ্রুত প্রতিক্রীয়া দিয়েছেন তিনি।এমন কথায় তার মনে একটাই প্রশ্ন জাগলো।এতটা হেয়ালি?কিভাবে করতে পারে বাবা হয়ে?যেকিনা মেয়েকে জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসে?

“হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছেন আপনি?”

“না শায়লা”

“মাত্র কি বললেন তাহলে?স্বামী?ওই ক্রিমিনালটাকে মেয়ের স্বামী হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জা করলো না?”

বিচিত্র মুখভঙ্গিতে চঞ্চল সাহেব প্রশ্ন করে বসেন, “তুমি জানো কাব্য ক্রিমিনাল?”

হেসে উঠে এমন পরিস্থিতিতে।সেটি সুখের হাসি নয়। ব্যঙ্গাত্মক হাসি।বললেন, “একটা মেয়েকে তুলে নেওয়া,তাকে বিয়ে করা,আমাদের টাকার লোভ দেখানো?পিস্তলের ভয় দেখানো।এসব কি একজন ভালো মানুষের চরিত্রকে ইঙ্গিত করে?”

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললেন চঞ্চল সাহেব।খুবই গাঢ় দৃষ্টি দেন স্ত্রীর দিকে। নিরবতায় কিছু সময় অতিবাহিত করলেন চেয়ে থেকে। শায়লাও তার প্রশ্নবিত্ত চোখ বুঝতে অক্ষম। চঞ্চল সাহেব প্রশ্ন ধিরোগম্ভীর স্বরে,

“তুমি সত্যিই কাব্যকে চিনতে পারছো না শায়লা?”

শায়লা থমকালেন।সময় ছিলেন চিন্তাধারাকে। কাব্যকে চেনার কথা ছিলো?হয়তো ছিলো।নয়তো চঞ্চল সাহেব অযথা এইরূপ প্রশ্ন করতেন না।মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করেতো লাভ হচ্ছে না। অগ্যতা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলেন স্বামীর দিকে।

“শায়লা মনে করে দেখো।ঠিক চিনবে তুমি কাব্যকে।আমার যৌবনকাল থেকে এই মধ্যবয়স পর্যন্ত তুমি সাথে ছিলে।তার পাশাপাশি আরও একজন ছিলো।যেকিনা ছুরি বসিয়েছিলো আমার পিঠ পিছে”

কন্ঠ কেপে উঠে।বলে, “কাব্যই কি সেই বাচ্চা ছেলেটা?”

“হ্যাঁ শায়লা”

“কিন্তু ওকেতো ওর বাবা…”

“কিছুই করতে পারেনি!”

ভয় দ্বিগুণ হলো।আরো জোড়ে চিৎকার করে উঠলেন শায়লা।বললেন, “এটা কি করে হলো চারুর বাবা?ঘুরে ফিরে আবার এসেছে আমাদের কাছে।…আপনি পুলিশে খবর দেন।আগে ভয় ছিলো মেয়ের ভবিষ্যতের।এখন আমার মনে হচ্ছে ওর জীবন সংকট।আমার মেয়েকে মেরে ফেলবে। আমার মেয়েকে মেরে ফেলবে!”

“কিচ্ছু করবে না”

আকুতি এবার রাগে পরিণত হয়। রক্তচক্ষু শায়লার। চিৎকার করে গলা ভেঙে যাওয়ার উপক্রম তারপরও বললেন,

“কি করে এত স্বাভাবিক আছেন আপনি?একজন কুলাঙ্গারের ছেলে কুলাঙ্গারই হবে। ক্রিমিনালের ছেলে ক্রিমিনাল।আমি বলে রাখছি চারুর বাবা।আমার মেয়ের কিছু হলে কিন্তু আপনিও দায়ী থাকবেন।”

“মেয়ের কিছুই হবে না শায়লা।তোমার মেয়ে ভালো আছে।”

“আপনি জানেন ওরা কোথায়?”

“জানি না কোথায়।তবে এটা জানি যেখানেই আছে নিরাপদ আছে।”

শায়লা চারুকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারলো না। ঘাপটি মেরে বসে পড়েছে কাঠের চেয়ারে।আবারো মাথায় হাত চেপেছেন।ভনভন করে ঘুরছে মাথাটা। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রশ্ন করছে মনেমনে ‘ আবার কেনো? ‘

“সংগ্রাম হতে চলেছে শায়লা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিগ্রহ।আমি কাব্যর জয়ের অপেক্ষায়”

___

গতরাতের চাঁদ হারিয়েছে।নতুন সূর্যের আলোয়।সমুদ্রের তেজ কমে নেই।বিশাল ঢেউ তুলছে।মোহনায় জেগে ওঠা চড়এ নেই কোনো মানুষের অস্তিত্ব।উচু লম্বা গাছ গাছালি আর ভিন্ন ভিন্ন পাখির সমারোহ।উড়ে বেড়াচ্ছে।সুর তুলছে। বাথরোব হাতে তীরে দাড়িয়ে আমজাদ। মৎসমানবের মতন ডুবে ডুবে বেড়াচ্ছে একজন।একটু পরই চেঁচামেচি শুরু করবে।আধ ঘন্টা হলো।সমুদ্রের বুকে সাঁতরে বেড়াচ্ছে।আসার নাম নেই। মাঝেমধ্যে অর্ধ গর্দন এর দেখা মেলে।আবার তলিয়ে যায়। রোদে পুড়ে পাখির গলার গানও কাকের ‘কা কা ‘ এর মতন মনে হচ্ছে আমজাদের।

এক তলা বিশিষ্ট বাড়িটিতে কোথাও সৌন্দর্যের কমতি নেই। সম্পূর্ণটা কাঠ দ্বারা নির্মিত। নজর কাড়ছে এদিক ওদিক ফ্রেমে আবদ্ধ চারুর ছবিগুলো। ঘর সাজিয়েছে কেউ তার মনের মতন করে। নিশ্চয়ই কাব্য করেছে এসব।কোনো মুগ্ধতা ছুঁতে পারলো না চারুকে।এসব দেখে চোখ আকর্ষিত হলেও মোহিত হয়নি।পা বাড়িয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। কোণায় দড়ি দিয়ে পুরনো দিনের দোলনা বাঁধা।ছুঁয়ে দেখে একবার। ঘাড় ঘুরলেই দূরে দেখা যায় আমজাদকে।এই লোকটা এখানে কি করে এলো? কালতো ছিলো না।কাব্যর কোনো কথাই কাল চারুর প্রশ্নের উত্তর বলে মনে হয়নি। আমজাদকে প্রশ্ন করবে? সেতো তার স্যারের বিশ্বস্ত।উত্তর দেবে কিনা কে জানে?

স্বাভাবিক গতির চেয়ে একটু দ্রুতই এগিয়ে গেলো তার দিকে।কোনো রকম কুশল বিনিময় না করে প্রশ্ন ছুড়ে মারলো,

“এখানে কি করেন আপনি? আপনাকেতো কাল দেখলাম না?”

“ম্যাডাম স্যার ডুবছে”

গোলগোল ভীত চোখে চারু বললো, “ডুবছে মানে?”

“ডুবছে মানে সাতরাচ্ছে।আমি এখানে ওনার জন্য বাথরোব নিয়ে দাড়িয়ে অপেক্ষা করছি তার জন্য”

নিঃশ্বাস ছাড়লো চারু।ক্ষণিকের জন্য শ্বাস আটকে গিয়েছিলো।ছোট্ট একটা শব্দের পরিবর্তন কি অর্থ বয়ে আনে সেটা কি এই বোকা লোক জানে?

“এসব বাদ দেন।আপনি আমাকে একটা কথা বলবেন প্লিজ।আমি জানি আপনি সব জানেন।কিন্তু ওনার অনুমতি ছাড়া একটা অক্ষরও বলবেন না।আমাকে শুধু এতটুকু বলুন।আমার পরিবার কেমন আছে জানেন?”

“ম্যাম আপনার পরিবার একদম ভালো আছে।নিরাপদ আছে আপনি কোনো রকম চিন্তা করবেন না।ঘরের বাহিরে গার্ড আছে।আপনার ভাইকে স্কুলে আনা নেওয়া থেকে শুরু করে স্কুলের বাহিরে দাড়িয়ে থাকার জন্যও গার্ডরা আছে।ঘরের কাজের জন্য দুজন হেল্পিং হ্যান্ডও হায়ার করে রেখে এসেছি আজ দুপুরে।”

মনটা একটু শান্ত হলো।তারপরও পূর্ন বিশ্বাস কেনো রাখতে পারছে না?এরই মাঝে কাব্য বেরিয়ে আসে সমুদ্র গহ্বর থেকে।পরনে থ্রি কোয়াটার প্যান্ট ছাড়া আর কিছুই নেই।সেটিও ভিজে শরীরের সাথে মিশে আছে।দেহের ঘন লোমগুলোও লেপ্টে। আকষ্মিক ‘ আমজাদ ‘ ডাকে তারা উভয়ই ঘুরে তাকায়।আমজাদ এগিয়ে গেলো। যত দ্রুত দৃষ্টিপাত করেছে তত দ্রুত নজর সরিয়েও নিলো।এভাবে একজন পুরুষের দিকে তাকানো বিশাল লজ্জার ব্যাপার।দুরত্বে দাড়িয়ে বাথরোব গায়ে চারুর দিকে এগিয়ে এসে কাব্য

বললো,

“তুমি ভিজবে?”

সটাং করে সোজা হয়ে দাড়ায়।নুয়ে যাচ্ছিলো অন্যপাশে ঘুরে।কাব্যর কাক ভেজা মুখের দিকে চেয়ে তেতে উঠে।ধমকের সুরে বলে,

“একদম না!আপনার ভেজা আপনি ভিজেন।নির্লজ্জ্ব!”

ধমক খাওয়ার মতন কোনো প্রশ্ন করেনি।নির্লজ্জের হওয়ার মতন কোনো কাজও করেনি।তাহলে কেনো শাসানো হলো তাকে?আমজাদ মনের আওয়াজ তুলে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকলো। দোহাই দিচ্ছে যেনো কোনোভাবে এই মুহূর্তে তার বেলাজা মুখে হাঁসি না ফুটে। তবে কাব্য আফনানকে ধমক খেতে দেখে মজা পেয়েছে।হাসি আটকানো গেলেও মুখ আটকানো গেলো না।মনের বিরুদ্ধে বলে বসলো,

“আপনাকে ধমকেছে ম্যাডাম”

শান্ত-স্থির লোচন তুলে কাব্য। চোখজোড়া লাল টকটকে।বেশি ভেজার ফল।তাতে আমজাদের কি?সে মনে মনে নিজেকে গালি দিতে ব্যস্ত।হাসির পাশাপাশি মুখ সামলানোর জন্যও সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করা উচিত ছিল।

চলবে….

#চারুকাব্য ৮
লেখা : #azyah_সূচনা

মিটিমিটি হেসে চলেছে।এদিক ওদিক পা জোড়া থেমে নেই।হাসছে অথচ হাসি আড়াল করতে চাইছে।হাসির কারণ আমজাদ জানালো তাকে। কেনো ধমক খেয়েছে চারুর কাছে।আমজাদ স্পষ্ট ভাষায় বলেছে ‘ আপনি হটাৎ ভেজা শরীরে ম্যামের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন তাই তিনি লজ্জা পেয়েছেন হয়তো।তাইতো ধমক দিলো ‘।এরপর কাব্যর মুখ থেকে মুচকি হাসি সরে না।আনমনে মনের খুশি উদযাপনে ব্যস্ত।আমজাদ ফিরে চাইলেই মুখটা ভার করে ফেলে।দেখাতে চায় না।এমনভাবে এড়িয়ে যায় যেনো নজর লাগবে। বেতের চেয়ারে বসে আচমকা সিগারেট ধরালো।

অস্পষ্ট স্বরে ডেকে উঠলো, ” আমমমজাআআদদদ”

আহা! কতদিন পর সুরেলা ডাকটি শুনলো আমজাদ।আজকাল ডাকে না।ধমকের সুরে ডাকে। চারুলতা জীবনে এসে তার গলার টোনও পরিবর্তন করে ফেলেছে। যাক গে!আজ ডেকেছে হাসিমুখে সামনে এসে দাঁড়ায়।

“বসো”

আদেশ অনুযায়ী বসে পরে আমজাদ।কাব্য প্যাকেট থেকে আরো একটি সিগারেট বের করে আমজাদের দিকে এগিয়ে দেয়।বলে,

“নাও”

আজ কাব্যর মন ভালো বোধহয়।দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।সাহস দেখিয়ে আমজাদ বলে, “স্যার একটা কথা ছিলো?”

“হুম”

“স্যার আমি বিয়ে করতে চাই”

খুক খুক করে কেশে উঠে কাব্য।ধোঁয়া নাকে মুখে ঢুকে গেছে।আমজাদ ভরকে উঠে।এগিয়ে গিয়ে কাব্যর পিঠে হাত বোলাতে থাকে।এমন কি বলেছে সে?এভাবে কেশে উঠার মানে কি?

নিজেকে সামলে কাব্য বললো, “আমার বিয়ে দেখে তোমার মনে শখ জেগেছে?”

“না স্যার…আসলে!”

“কি আসলে?”

“বয়সতো কম হলো না। সাতত্রিশ শেষ করে আটত্রিশে পা দিলাম।”

বাঁকা হাসলো কাব্য। জবাবে বললো, “দেবো।যেদিন চারুলতা আমাকে ভালোবাসবে সেদিন তোমাকে ঘটা করে বিয়ে দেবো”

ইহজনমে এটা সম্ভব বলে মনে হলো না আমজাদের। মুড়ির মোয়া নাকি?ইচ্ছের বিরুদ্ধে একটা মেয়েকে বিয়ে করে নামমাত্র সংসার শুরু করেছে।আবার ভালোবাসা আসা করে।সম্ভব না।এই ভালো নামক বাসা পাওয়া সম্ভব না। পাশাপাশি আমজাদের বিয়ে করার ইচ্ছেটাও আর সম্ভব না।যেই শর্ত দিয়েছে?এই শর্তে আরো আটত্রিশ বছর পেরোবে। নিজেতো ত্রিশে পা রাখতে না রাখতেই শুভ কাজ সেরে ফেললো। ফান্দে ফেললো আমজাদকে।জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল তার জন্য কাজ করা।

__

“এগুলো কি?”

হাতে বড় একটা বাক্স আমজাদের। হাতে তুলে রেখেই চারুর প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। সত্যবাদিতা দেখিয়ে বলে উঠলো,

“ম্যাডাম এগুলো সিগারেট”

“এত্ত বড় বক্সের মধ্যে সব সিগারেট?”

“হ্যা ম্যাডাম।”

বুকে হাত বেধে তীর্যক দৃষ্টি ছুঁড়ে চারু জিজ্ঞেস করলো, “কে খাবে শুনি?”

“কাব্য স্যার। দশ পনেরো দিনের স্টক আছে”

খয়েরী রঙের চার কোণাচে বাক্স। মাঝারি আকৃতির। আন্দাজ করলো চারু। মোটামুটি ভারী হবে।এখানে কতগুলো সিগারেটের প্যাকেট থাকতে পারে বুঝতে বেগ পেতে হলো না চারুর। দশ পনেরো দিনে নাকি এগুলো খেয়ে সাবার করবে।ভাতের বিনিময়ে সিগারেট খায় নাকি এই লোক?আর আমজাদ লোকটাও কেমন?জেনে শুনে বিষ এনে দিচ্ছে নিজের বসকে।

ভাবলো চারু।পরপর বললো, “আমাকে দেন এগুলো”

“আপনি খাবেন?”

“মশকরা করেন আমার সাথে?আমাকে দেখে মনে হয় আমি সিগারেট খাই?”

তোতলানো সুরে আমজাদ জবাব দেয়, “না হঠাৎ স্যারের জিনিস চাইলেন যে?”

“আপনি দিবেন?”

বিনাবাক্যে এগিয়ে দিলো বক্সটি।চারু মুখে অদ্ভুত ভঙ্গিতে চেয়ে আছে বাক্সের দিকে।আমজাদ হাবভাব বোঝার চেষ্টায়। মতলব কী?ভালো বলেতো মনে হচ্ছেনা।এতদিন গোয়েন্দাগিরি করে যাকে তাকে অযথা সন্দেহ হয়।চারুর ক্ষেত্রেও বিকল্প হলো না এর।

এই চরের মধ্যেও কোথাও যাওয়ার কায়দা আছে কিনা কে জানে।তবে কাব্য গিয়েছে।কালো রঙের লম্বা চওড়া গাড়িটা এসে থামলো বাড়ির সামনে।বাধ্য হয়ে এখানে থাকা লাগে।বারান্দার দোলনায় বসে ভাবনা চিন্তার ব্যাঘাত ঘটালো কাব্য।গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে।তার সাথে বেরিয়ে আসে চারজন।দুজন মহিলা।একজন মধ্য বয়স্ক আরেকজন তরুণী।আর বাকি দুজন পুরুষ।ক্লান্ত দৃষ্টি তুলে চেয়ে রইলো চারু তাদের দিকে।না চাইতেই এসে বর্ণনা দেবে।কি লাভ আগ বাড়িয়ে প্রশ্ন করার। কসরত ছাড়াই যেহেতু সবটা জানবে।

হলোও তাই কাব্য চারুর দিকে মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো, “চারুলতা?এনারা তোমার সঙ্গী আজ থেকে।”

চারুর চোখ গেলো পুরুষ দুজনের উপর। মহিলারা নাহয় সঙ্গী। পুরুষদ্বয়?নজর পড়ে ফেলে দ্রুত বলে উঠে,

“ওনারা টুকটাক বাহিরের কাজ করবে”

“বাহিরের কাজ করার জন্য বাহিরের একটা পরিবেশ দরকার।আমি এখানে গাছ গাছালি আর সমুদ্র ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছি না”
“সেটা নিয়ে তোমার ভাবতে হবেনা।”

“আমাকে বাড়ি ফিরতে দিবেন না?”

“দিবো।খুব শীগ্রই। একটু এখানে মানিয়ে নাও?”

“কতদিন!”

“অল্পকিছুদিন চারুলতা”

গ্যাস সিলিন্ডার কাধে আমজাদকে আসতে দেখে কাব্য প্রশ্ন করলো,

“তোমাকে যে কাজ দিয়েছিলাম করেছো?”

“করেছিলাম স্যার”

ভ্রু কুঁচকে কাব্য জানতে চায়, “করেছিলাম মানে? সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে তীরে এসো।মাথাটা ধরেছে আমার”

“স্যার..”

পরিস্থিতির সাথে চারুর মেজাজে পরিবর্তন এসেছে।ভীতু ভাবটা অজান্তে কেটে যাচ্ছে।হয়তো উপলদ্ধি করেনি। চোপা করার এক অদ্ভুত শক্তি নিজের মধ্যে উপলদ্ধি করলো।

“কষ্ট করে তীরে নেওয়া লাগবে না।আপনার সিগারেটের সমস্ত প্যাকেট তীরের পর যে সমুদ্র আছে?সেখানে ভেসে বেড়াচ্ছে”

কথার অর্থ বোঝেনি।অবুঝ স্বরে প্রশ্ন করলো, “মানে?”

“মানে স্যার ম্যাডাম পুরো বাক্সটা সমুদ্র গর্ভে বিসর্জন করে দিয়েছে”

কাব্যর চক্ষু চড়কগাছ।চারু?সে পুরো বক্সটা ফেলে দিয়েছে।কিন্তু কেনো?এই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে তার মাথায়।অন্যদিকে চারুর ভেতরকার অবস্থা নাজেহাল।তবে প্রকাশ করছে না।ঠিক যেমনটা ভীত হয়েছিলো কাজটা করার সময়। বাক্সটা ফেলতে গিয়েও আটকে গিয়েছিলো একবার। ভেবেছিলো সিগারেট ফেলে দেওয়ার দায়ে না তার মস্তিষ্কে পিস্তলের গুলি ভরে দেয়। পরক্ষণেই সাহস যোগায় মনে।এতদিন কাব্য তার মনমত কাজ করেছে।এমনকি চারুর জীবন ওলটপালট করেছে একরাতে।কবুল পড়িয়ে।সাহস কুড়িয়ে সেও কাব্যর প্রয়োজনীয় জিনিস ফেলে দেয়। বড়সড় না হোক ছোটোখাটো প্রতিশোধ।শুনেছে ধূমপান করা ছেলেগুলো সিগারেট ছাড়া বাঁচতে পারেনা।এদের জীবন পানি পান বিহীন চলবে কিন্তু ধূমপান ছাড়া নয়।সেটাই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য।

দুরুদুরু মন আড়ালে কাপছে।এই বুঝি বজ্রপাত হলো!কাব্য শান্ত স্বরে প্রশ্ন করলো,

“কেনো ফেলে দিয়েছো?”

“ইচ্ছে হয়েছে!”

“ফেলেছো যেহেতু সমুদ্রে কেনো ফেললে? সমুদ্র দুষণ হবে।”

এটাতো মাথায় ছিলো না।জেদের বশে করেছে কাজটি।এতকিছু কি ভাবনা চিন্তা করেছিলো ফেলার সময়?

কাব্য হাসলো। আমজাদের দিকে চেয়ে বলল, “গাড়ীতে আরো একটা সিগারেটের বক্স আছে।নিয়ে আমার ঘরে রেখে আসো”

কোনো লাভ হলো না।কাজটা কাজে দিলো না। অযথাই সমুদ্র দুষণ করেছে।লাভের চেয়ে ক্ষতি। কাব্যতো তার মতন করেই নিজের জন্য আগেই ব্যবস্থা করে ফেলেছে।মুখ ঘুরিয়ে সেখানে উপস্থিত বাকিদের চলে যাওয়ার জন্য ইশারা করে।বাকিরা স্থান ত্যাগ করলে কাব্য বলে উঠে,

“নিকোটিনের ধোঁয়া মস্তিষ্ক শীতল করে আর বুক ঝাঁঝরা।আমার দুটোই দরকার”

“মরে যাওয়ার এত শখ?তাহলে আমাকে জড়ালেন কেনো নিজের জীবনে?”

“তাতে তোমার কিছু আসে যায়?সমাজ জানে তুমি বিবাহিত?”

“নাহ!”

“তাহলে?আমার মৃত্যুর সাথে তোমার জীবন থেকে আমার নামের অস্তিত্বও মুছে যাবে।”

মুখ বুজে দাড়িয়ে রয় চারু।তার কণ্ঠে যে কেউ মোহিত হতে বাধ্য। অস্বাভাবিক পন্থায় তার জীবনে না আসলে বোধহয় চারুও হতো।এতটা মাদকতা এই গম্ভির সুরে। গুছিয়ে ধীরে স্পষ্ট কথা বলে।এই স্পষ্টতায়ও ভ্রম মেশানো।ভারী আওয়াজ।উল্টোপাল্টা কথা বলে।তবে রাশভারী গলায়।শুনলে মনে হয় প্রত্যেকটা অক্ষর হৃদয় থেকে আসছে।

সমুদ্রের ঢেউ আওয়াজ তুলছে।দুর থেকে বারান্দায় দাড়িয়ে থাকা চারুকাব্যকে দেখছে দূরাকাশের শশাঙ্ক। পলকহীন গভীর দৃষ্টি কাব্যর।চারুর ভাবুক মুখের দিকে।ডান ভ্রু উচিয়ে সহসা বলে উঠে,

“মৃত্যুর পরও আসবো।বলেছিলাম না আমি লোভী।সুখে থাকার লোভে বাতাসের সাথে মিশে আসবো।নয়তো বৃষ্টি হয়ে ছুঁয়ে দিয়ে যাবো।প্রথম বর্ষায় মাটি থেকে ভেসে আসা ঘ্রাণে আমাকে অনুভব করতে পারবে। শৈত্যের বিষণ্ণতায়ও আমাকে মনে পড়বে।”

__

সমুদ্র চড়ে একুশতম দিন।বন্দী পাখির ন্যায়।মানুষ হয়েও আটকা পড়ে আছে এখানে। ছটফট করছে জঞ্জালে ভরা শহরে ফিরে যাওয়ার জন্য।পারছে না।এখানে শুধু একটাই সৌভাগ্য হয়েছে।বাবা মা আর ভাইয়ের সাথে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছে কাব্য।সময়ের সাথে এই কাঠের ঘরটাও কেমন যেনো প্রিয় হয়ে উঠলো।তবে কাব্য নয়।কেনো যেনো পেরে উঠে না কাব্যর সাথে।চেষ্টা করেছে অনেক জেদ দেখাবে রাগ দেখাবে।সম্ভব হয়নি।তার মুখ দেখলেই সব হাওয়া হয়ে যায়।শুধু জীবনের ভয় জাগে।চোখ যতদূর যায় শুধু গার্ড আর গার্ড।ঘরের ভেতরে রুনা এবং তার মেয়ে টুনি।এই দুজনকেই এনেছিল চারুর সাথে সময় কাটানোর জন্য।সাথে রান্না আর টুকটাক কাজের জন্য।তাদের সাথে ভালো সখ্যতা হয়েছে চারুর।অন্যদিকে কাব্য পড়ে থাকে একদম কোনার দিকের ঘরে।দুজন বাড়ির দুই আলাদা প্রান্তে।চোখের আড়ালে কোথাও যায়।আবার সময়মতোই ফিরে আসে।এইসব পর্যবেক্ষণে দিন কেটে যাচ্ছে চারুর।অথচ কোনো রকমের কোনো ক্লু পেলো না।খোঁজার চেষ্টায়ও বরাবরই ব্যর্থ।নিজেকে বকে দেয় বারবার।এতবড় অধম কি করে হতে পারে সে? বোকার মতন যেভাবে নাচানো হচ্ছে নেচে যাচ্ছে।

“কেমন আছিস মা?”

“কেমন থাকতে পারি বাবা?শ্বাস আটকে আসে আমার এখানে।আমি তোমাদের কাছে ফিরতে চাই। দরকার হলে ওই লোকটাও থাকবে।চোখের সামনে সহ্য করেছি এতদিন বাকিদিনও সহ্য করে নিবো।শুধু তোমাদের চাই বাবা।আমার কিছুই ভালো লাগেনা।”

মেয়ের কাতর গলায় চঞ্চল সাহেবের মন খারাপ হয়ে এলো।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

“চারু মা? তোকে একটা কথা বলবো।শুধু এর বিপরীতে কোনো প্রশ্ন করবি না।”

“কি কথা বাবা?”

“এই শহরে তুই নিরাপদ না।নাই কাব্য নিরাপদ।তোদের কথা ভেবে আমি বুকে পাথর রেখেছি।না চাইতেও দূরে সরিয়ে রেখেছি তোকে।আমরা ভালো আছি। তুইও যেখানে আছিস সেখানেই থাক।কাব্য তোর কোনো ক্ষতি করবে নারে মা।উল্টো তোকে সযতনে রাখবে”

বাবার কথা বুঝে উঠতে পারেনি।কাব্যর সাপোর্টে কথা বললো সে?কেনো?বাবার বারণ সত্বেও চারু প্রশ্ন করে।বলে,

“তুমি কাব্যকে চেনো?”

“চারু বলেছিলাম প্রশ্ন করবি না”

“আমার দিব্যি বাবা আমার দুটো প্রশ্নের উত্তর তোমার দিতে হবে”

“দিব্যি কাঁটা ভালো না চারু।”

“না বাবা আমি এতকিছু বুঝি না।তুমি কাব্যকে চেনো?”

মেয়ের কাছে হার মেনে চঞ্চল সাহেব বললেন, “হ্যা”

“কিভাবে?তার পরিচয় কি? কোথা থেকে এসেছে?কেনো এসেছে?”

“কাব্য আফনান এটাই ওর পরিচয়।কেনো এসেছে, কোথা থেকে এসেছে,আমি তাকে কি করে চিনি?সব প্রশ্নের উত্তর পাবি।কাব্য নিজে দেবে।এখন মনে কর তোর সবচেয়ে পছন্দের জায়গায় আছিস তুই।ধরে নে তোর নতুন জীবন।”

বলে ফোন রেখে দিলেন চঞ্চল সাহেব। কাব্য তাকে বারন করেছে।সে চায় তার সত্য সে নিজেই বলুক। লুকোচুরি খেলার ইচ্ছে তারও নেই।শুধু বাঁধা পরে আছে।সঠিক সময়ের অপেক্ষায় আছে।

“চারুলতা?ঝড় হবে মনে হচ্ছে।দরজা জানালা ভালোভাবে আটকে ঘুমিও”

সমুদ্র কূলে ঝড়? আত্মা কেপে উঠলো। মস্তিষ্কে উদ্ভট কল্পনারা গাদাগাদি করতে লাগলো।শুনেছে ঘরবাড়ি উড়ে যায়। উপকূলের ঝড় ভয়ঙ্কর। প্রাণহানিও হয়।কাব্য কি স্বাভাবিকভাবেই না বলে গেল কথাটা।মনে ভয় নেই নাকি?এরই মাঝে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে।চোখের সামনে আঁধারে চেয়ে গেলো সবটা। ঝড়ো হাওয়া চলছিলো বেশ কিছুক্ষন যাবৎ।আরো বেগ পেলো। সইসাই শব্দে হাতপা কম্পন ধরে।ধরেই নিলো এখনই ঘরবাড়ি উড়ে যাবে। সমুদ্রের পানি তলিয়ে নিয়ে যাবে সবকিছু। শশব্দে চিৎকার তোলে চারু।
চারুর ছবি হাতে তুলে বিছানায় পিঠ ঠেকিয়েছিলো সবে। ভাবছিলো হৃদয় দখল করা নারী কাছে থেকেও পাশে নেই। শর্ত দিয়েছিল চারু।তাকে এখানে রাখতে হলে একই ঘরে থাকা যাবে না।একই বাড়িতে আলাদা কামড়ায় হবে তাদের অবস্থান।তার চিৎকারে হন্তদন্ত হয়ে দৌড় লাগিয়েছে চারুর ঘরে। শব্দ করে দরজা ধাক্কা দিয়ে ভেতরে আসে।অস্থিরতা ভরা কন্ঠে প্রশ্ন করে,

“কি হয়েছে চারুলতা?”

“ঘর বাড়ি উড়ে যাচ্ছে।এখনই তলিয়ে নিয়ে যাবে সমুদ্রের জল।কিছু করেন!”

অতিরিক্ত ভয়ে আবোলতাবোল বকছে। ঘর বাড়ি উড়ে যাচ্ছে? কোথায়? সবতো স্থির। মুঠোফোনের ফ্ল্যাশ লাইট অন করে এগিয়ে গেলো।বললো,

“ভয় পেও না চারুলতা।এমন কিছুই হবেনা।”

“হবে!আপনি আমাকে মেরে না ফেললেও এই ঝড়ে আমি নিশ্চয়ই প্রাণ হারাবো!”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাব্য।কেনো সে ভাবে সে চারুকে মেরে ফেলবে?এখন এসব ভাবার সময় না।তাই এই ভাবনাকে পাশে রেখে আরো নিকটে এসে দাঁড়াল।ফোনটা কাত করে টেবিলের উপর রেখেছে।বললো,

“আমি বলছিতো চারু কিছুই হবে না।কত ঝড় এলো গেলো।তুমি শান্ত হয়ে বসো”

বিছানার চাদর শক্ত করে চেপে বসে চারু।বুক ধড়ফড় করছে রীতিমত।আকড়ে বসে আছে পা তুলে।তার ঠিক বরাবর কাব্য।কখনো চারুর দিকে আবার কখনো এদিক ওদিক চেয়ে।ঝড়ের বেগের কোনো ঠিক নেই।কখনো বেগ পাচ্ছে আবার কখনো একদম নিস্তব্ধ।যতবার বাতাসের বাতাসের দাপট বাড়ে চারু লাফিয়ে উঠে।

বাহিরের অবস্থা দেখার উদ্দেশ্যে কাব্য উঠে দাড়াল। আকষ্মিক হাত টেনে ধরে চারু।বলে ধমকের কণ্ঠে,

“কোথায় যান?চুপচাপ বসেন এখানে!”

“আমিতো বাহিরের অবস্থা….”

“শাট আপ!বসে থাকবেন।কোনো কথা বলবেন না”

“আচ্ছা”

জীবনে বুঝি প্রথম কারো ধমকে দমে যাচ্ছে কাব্য।তাও আবার পরপর দুবার।চারু মাঝেমধ্যে রেগে যায়।সেদিন লজ্জায় আজ ভয়ে।আজ মজা লুটার জন্য আমজাদ নেই।বেচারা গিয়েছে শহরে। কাব্যকে বসতে অর্ডার করে নিজে উঠে দাড়ালো চারু।পা টিপেটিপে জানালার থেকে সামান্য দূরত্ব নিয়ে উকিঝুকি দিচ্ছে।অবাক হয় কাব্য।সেওতো ঠিক এই কাজটাই করতে চাচ্ছিলো।আদেশ অমান্য করে সেও সাথে এসে দাঁড়িয়েছে।ঝোড়ো বাতাস আর গুড়িগুড়ি বৃষ্টির মধ্যে যোগ হলো ভয়ঙ্কর শব্দে বজ্রপাত।চারুর আরেকদফা চিৎকারে কাব্যও কেপে উঠে। পিছু ঘুরে জাপ্টে ধরলো কাব্যর শার্ট।মাথা নুয়ে লেপ্টে আছে কাব্যর বুকে।চারুর সন্নিকটে উপলদ্ধি করে দমটা সেখানেই আটকে।নড়চড় নেই কোনো।কেমন একটা অনুভুতি!আগে এই অনুভুতির স্বীকার কখনো হওয়া হয়নি।মূর্তি বনে দাড়িয়ে।

হিতাহিত জ্ঞানশূন্য চারু আবারো বলে উঠে, “চলেন পালাই এখান থেকে।সামনে উচু স্থান আছে।এখানে থাকলে আমি আপনি কেউই বাঁচবো না। ঝড় থামলে নাহয় আবার ফিরে আসবো”

চলবে…