চারুলতা তোমার জন্য পর্ব-০১

0
1

#চারুলতা_তোমার_জন্য
#সূচনা_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি

“ভারী অসভ্য লোক তো মশাই, আপনি! মেয়ে-মানুষ কি জীবনে দেখেন নি নাকি? এমন হ্যাঙলার মতো কারোর কোমড়ের দিকে তাকিয়ে থাকা কেনো শুনি?”

বাসে ঠিক সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা অপরিচিত মেয়েটির এমন অভিযোগে মুহূর্তের জন্য হতবিহ্বল হয়ে গেল শ্রাবণ। চোখ মুখের ভাব মুহূর্তেই বদলে গেলো। ভিড়ে ঠাসা লোকের স্রোতে ভাসা বাসে যেখানে একজন অপরজনের শরীরের ভেতর ঢুকে পড়ছে, সেখানে একজন সুন্দরী রমনী এক যুবকের উপর অশালীন আচরণের দোষারোপ করা হয় তখন ক্লান্ত দৃষ্টিগুলো এসে ঠেকে যুবকের উপর। তাও সেই দৃষ্টিগুলো হয় ক্রুর, কঠিন, ঘৃণায় ঘেরা। শ্রাবণের সাথে ব্যতিক্রম কিছু হলো না। বাসের প্রতিটি মানুষের দৃষ্টির মধ্যমনি হল সে। অথচ শ্রাবণ এই রমনীর কোমড়ে এক মুহূর্তের জন্য তাকায় নি। বরংচ তাকিয়ে ছিলো রমনীর পাশের সিটের দিকে। কখন সেটা খালি হবে আর শ্রাবণ লুফে নিব। শ্রাবণ, শ্রাবণ তালুকদার। তার এই আঠাশ বছরের দীর্ঘ জীবনে বাসে চলার অভিজ্ঞতা খুব কম। যাত্রাবাড়ীতে হুট করেই তার গাড়িটা নষ্ট হয়ে গেলো। ড্রাইভার খুব অসহায় স্বরে জানালো,
“স্যার, টায়ার পাংচার হয়ে গেছে”

বিরক্তিতে শ্রাবণের চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেলো। ভারি বর্ষণ তখন ধরণীতে। অক্লান্ত সেই বৃষ্টি সকাল থেকে শুরু হয়েছে। আকাশের এক অংশে সূর্যের দেখা নেই। মিরপুর পৌছানো অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। যখন ঘড়িতে ছয়টা বাজে। ব্যস্ত শহর মাত্রাতিরিক্ত ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। সবার তাড়া বাড়ি ফেরার। এর মধ্যেই গাড়িটা নষ্ট হতে হল! সে তাড়াতাড়ি মোবাইল ফোনটা বের করেই উবার কল করা চেষ্টা করলো। কিন্তু তিনবার রাইড রিকুয়েস্টের পরও একটা গাড়ি পাওয়া গেলো না। বারংবার রাইড ক্যান্সেল হচ্ছে। শ্রাবণের শ্রান্ত মুখখানা আরোও বেশি কঠিন হয়ে গেলো। ড্রাইভার তখন রয়ে সয়ে বললো,
“স্যার, বাসে যাবেন?”

প্রথমে কঠিন দৃষ্টির বর্ষণ করলেও ড্রাইভারের কথা মেনে নিলো শ্রাবণ। ভিড় ঠেলে কোনোমতে সে উঠলো বাসে। মানুষে ঠাসা বাসে দম নেওয়ার সুযোগ অবধি নেই। যাত্রাবাড়ী থেকে মিরপুর এই ভিড়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সারাদিন অফিসের ধাক্কা খাওয়ার পর শরীরের শেষ নির্যাসটুকুও শুষে নেয় এই বাসগুলো। ফলে তীর্থের কাকের মতো ধাক্কা সহ্য করেও তাকিয়ে থাকা একটি সিটের দিকে। বসার সিট তো নয় যেন রণভূমিতে রাজ্যের লড়াই। ফলে শ্রাবণ সেই তখন থেকেই সিটের দিকেই তাকিয়ে আছে। সে মোটেই এই সুন্দরী রমনীর কোমড়ের দিকে তাকায় নি। টানাটানা লোচনে তখন রাগের স্ফুলিঙ্গ। শ্রাবণ অনুনয়ের সাথে বললো,
“আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে…”
“সব লাফাঙ্গাই ধরা পড়লে এমন বলে”

মেয়েটির তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বাসের পারিপার্শিক অবস্থা গমগমে হয়ে উঠলো। অফিসের যাতাকলে পৃষ্ট জনগন হুট করেই যেন তাদের হারানো মনোশক্তি ফিরে ফেলো। ক্লান্তিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বলল,
“দিনে দুপুরে মেয়ে-মানুষের ইজ্জতে হাত, শালাকে মেরে থুতমা ভেঙ্গে দিতে হবে”

কি যন্ত্রণা! তাকালো-ই না আর ইজ্জতে হাত? এ তো রীতিমত শ্রাবণ তালুকদারের মান সম্মানের টায়ারে ফুটো করা। শ্রাবণ হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রমনীকে আবার বোঝানোর চেষ্টা করলো,
“দেখুন ম্যাডাম, আপনার ভুল হচ্ছে। আমি মোটেই আপনার কোমড়ে তাকাই নি। আমি আপনার পাশের সিটের দিকে তাকিয়ে ছিলাম”
“আপনি তো মশাই চোখে মুখে মিথ্যা বলেন। আমি কি অন্ধ নাকি?”
“আপনি তো সামনে তাকিয়ে ছিলেন, চোখেটা দেখলেন কখন?”

মেয়েটির অপবাদের আঘাতে শ্রাবণও তেঁতে উঠলো। মেয়েটি নাকের পাটা ফুলিয়ে বললো,
“মেয়েদের সিক্স সেন্স থাকে বুঝলেন। মেয়েরা না তাকিয়েও বলে দিতে পারে কোন শকুনের কেমন এবং কোথায় নজর”

শ্রাবণের মেজাজ এবার সপ্তম আকাশে উঠলো। শ্রাবণ তালুকদার সাথে এমনভাবে কথা বলার সাহস তার আশেপাশের মানুষগুলোর নেই। ফলে এমন ব্যবহার তার দম্ভের প্রাচীরে তীব্র আঘাত হানলো যেন। দৃষ্টি কঠিন, সরু হল তার। এক পলক ঘড়ির দিকে তাকালো। ক্লাইন্টের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে সে। মেজাজ খারাপ করা যাবে না। নেহাৎ জঘন্য একটা পরিস্থিতির শিকার হয়েছে সে। ফলে গম্ভীর স্বরে বললো,
“দেখুন আপনি এতোটাও সুন্দরী কেউ নন যে আপনার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতে হবে। ইউ আর নট মাই টাইপ। সো ক্লিয়ার ইউর হেড”

শ্রাবণের কথা রমনীর পছন্দ হলো না। শ্রাবণের কথায় যেন তীব্র অপমানে মুখবিবর নীল হয়ে গেলো তার। কঠিন স্বরে বললো,
“আপনি তো মশাই খুব চালু, দোষ এড়াতে আমাকে অসুন্দর বলছেন?”
“লিসেন, মেজাজ খারাপ করতে চাচ্ছি না বলে এড়িয়ে যাচ্ছি। আমি আপনার দিকে তাকাই নি। অহেতুক কথা বাড়াবেন না। এই হল আপনাদের মেয়েদের সমস্যা, তিলকে কি করে তাল বানাতে হয় সেটা আপনারা ভালোই জানেন। আপনার কাছে কি প্রুফ আছে শুনি আমি আপনাকে দেখেছি? নাকি এগুলো স্কিম? চেঁচামেচি করে টাকা কামাই করার ধান্দা? যতসব”

শ্রাবণের গাঢ়, রাগী স্বর বাসে প্রতিফলিত হলো যেন। মেয়েটি তার গালে সজোরে থাপ্পড় মেরে বসলো। বিরবির করে বললো,
“অসভ্য”

মেয়েটি কন্ডাকটরকে বাস থামাতে বললো। হনহন করে নেমে গেলো। শ্রাবণ স্তব্ধ দাঁড়িয়ে রইলো। এই প্রথম কেউ তাকে এমনভাবে অপমান করলো। তীব্র অপমানে শ্রাবণ তালুকদারের কপালের রগ ফুলে উঠলো। সকলের দৃষ্টি তার দিকে। দৃষ্টিতে তাচ্ছিল্য। এই মেয়েকে তো সে ছাড়বে না।

****
শ্রাবণ ভেবেছিলো মেয়েটিকে খুঁজে বের করতে তার বেগ পোহাতে হবে। কিন্তু সেটা হল না। মেয়েটির সাথে দ্বিতীয়বার দেখা হলো নিজের অফিসেই। শ্রাবণের অফিসে কিছু পোস্টের জন্য ইন্টারভভিউ চলছিলো। শেষ পর্যায়ের সিলেকশনটা শ্রাবণ করবে। ফলে তার টেবিলে সিভি গুলো স্তুপকার করে রাখা হল। সিভিগুলো দেখতে দেখতেই তার চোখ আটকে গেলো একটি সিভিতে। মেয়েটির মুখখানা তার মস্তিষ্কে ছেপে আছে। সাথে সাথেই চোখজোড়া কঠিন হয়ে গেলো। নামটার চোখ বুলালো একবার। “মেহেনাজ চারু”। শ্রাবণ মনে মনে আওড়ালো নামটা। “চারু… চারু…… চারুলতা”। শ্রাবণের ঠোঁটের কোণায় দূর্বোধ্য হাসি ফুটে উঠলো।

বাহিরের ওয়েটিং রুমে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে চারুর। সপ্তমবারের মতো কোনো ইন্টারভিউয়ের শেষ পর্যায় অবধি এসেছে সে। খাতায় টুকে রাখা চ্যাট জিপিটি থেকে সব প্রাপ্ত সব উত্তরগুলোকে ঠোটস্থ করছে সে। বুক ধুকপুক করছে। ভয় হচ্ছে সে পারবে তো! নাকি অপমানিত হতে হবে? তোতলাবে না তো? চারু ভালো বক্তা নয়। সে ঘাবড়ে যায়। সকাল থেকে তাই ভয়ে হাত পা হজমে যাচ্ছে। তখন ঘোষণা হলো ইন্টারভিউ ক্যান্সেল। কথাটা শুনতেই মন বসে গেলো চারুর। এতো পরিশ্রম সব ব্যর্থ। সেই কত দূর থেকে আসা। টাকাটাই জলে।

******

সকালের কাঁচা সোনা রোদ লুটোপুটি খাচ্ছে চারুর ঘরে। চারুর ঘুম তখনও ভাঙ্গে নি। বাহিরে বাবার কর্কশ স্বর শোনা যাচ্ছে। আবারো বাড়িওয়ালা এসেছিলো বোধহয়। চারু চোখ মেললো। চাকরি একটা তার খুব দরকার। আবারো ল্যাপটপ নিয়ে বসলো সে। চাকরির সন্ধ্যানে বিডিজবস এ ঢুকলো। একবার ইমেইল চেক করলো। হঠাৎ একটা ইমেইল নজরে আসতেই সে থমকে গেলো যেন। ইমেইলটা খুলতেই যা দেখলো তা হলো,
“Dear Mehenaj Charu,
You are selected for the post…..”

চারুর খুশি দেখে কে! এই কোম্পানির জন্য সে কবে আবেদন করেছে তার স্মরণ নেই। ইন্টারভিউ তো অনেক দিয়েছে কিন্তু এই প্রথম তার নিয়োগ পত্র এলো। হৃদয়ের স্পন্দন বেড়ে গেলো। মনে হলো হুট করেই এক রাশি সুখ এসে ধরা দিয়েছে তার হাতে। ছুটে গিয়ে মাকে সুসংবাদ দিল সে। অবশেষে তার পরিশ্রমের ফল পাবে সে।

****

আজ অফিসের প্রথম দিন। খুব বড় কোম্পানির ভাইস ম্যানেজিং ডিরেক্টরের সেক্রেটারি হিসেবে সে চাকরি পেয়েছে। বেতন অনেক। তবে চাকরির একটাই শর্ত চারু তিন বছরের আগে চাকরি ছাড়তে পারবে না। শুধু তাই নয়, তার বস যত সময় কাজ করবে তাকে তত সময় অফিসেই থাকতে হবে। চারু কিছু চিন্তা না করেই সকল শর্তে সাইন করে দিয়েছে। কিন্তু আসল ধাক্কাটা লাগলো যখন বসের সাথে প্রথমবার তার সাক্ষাৎ হলো। তার বস আর কেউ না, বাসের সেই অসভ্য ব্যক্তিটি যাকে সে চ’ড় দিয়েছিলো…………

চলবে