চারুলতা তোমার জন্য পর্ব-০২

0
22

#চারুলতা_তোমার_জন্য
#২য়_পর্ব

বাসে যে অসভ্য পুরুষকে থাপ্পড় মেরেছিলো রুপবতী সেই পুরুষ তার সম্মুখে ঠোঁটে বক্রহাসি লেপ্টে বসে আছে। তার চাহনী তার ভিন্ন। চারু পারছে না ছুটে পালিয়ে যেতে। তার ভাগ্যকে এতোটা খারাপ কেন হতে হবে? একটা অসভ্য, চরিত্রহীন মানুষকেই কেন তার বস হতে হবে? এ কেমন ঠাট্টা? ঠাট্টা ই বটে। নয়তো ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা শহরে প্রায় দু কোটি মানুষের বাস অথচ কেন এই মানুষটিকেই তার বস হতে হবে। চারুর চোখ কাঁপছে। সে হয়তো কেঁদে দিবে এখনি। তিনটে বছর এই মানুষের সাথে কাজ করতে হবে? লোকটির কি সেদিনের চড়ের কথা স্মরণে আছে? যদি স্মরণে থাকে তবে কি করবে চারু?

শ্রাবণ তালুকদার সামনে থাকা রুপবতী নারীর হতভম্ব, বিমূঢ় মুখখানা দেখছে নিলীন চোখে। মেয়েটির মুখের রঙ উড়ে গেছে। ফর্সা মুখখানা রক্তশূন্য হয়ে গেছে যেন। সেদিনের সেই তেজী রমনী আর আজকের রমনীর মাঝে আকাশ পাতাল তফাৎ। মেয়েটির চোখে মুখে ভয় কাজ করছে। তার নেত্রপল্লবে সংকোচ লক্ষ করলো যেন। তেজী চারুলতা থেকে সংকুচিত, ভীত চারুলতাকেই যেন মানাচ্ছে বেশি। শ্রাবণ তার ঠোঁটের হাসিটা উধাও করে শীতল স্বরে বললো,
“আপনি আপনার কাজ বুঝে নিয়েছেন?”

শীতল, সাঁড়াশির মতো স্বর কানে যেতেই চারু কিছুটা অপ্রস্তুত হলো। হ্যা, সে বুঝে নিয়েছে। গত সেক্রেটারি তার জন্য একটা লম্বা চার্ট বানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তার মস্তিষ্ক এখন শূন্য। কিচ্ছু মনে নেই। তবুও মাথা উপর নিচে নাড়ালো। শ্রাবণ আগের ন্যায় শীতল স্বরে শুধালো,
“তাহলে আমার ব্লাক কফিটা টেবিলে নেই কেন মিস মেহেনাজ?”
“ব্লা…ব্লাক কফি?”

হতবাক স্বরে শুধালো চারু। শ্রাবণ পুরু ভ্রুযুগল একত্রিত করে শুধালো,
“ইয়েস, ব্লাক কফি? ডোন্ট সে, আপনি জানেন না আমি অফিসে এসে প্রথমে এক কাপ ব্লাক কফি খাই”

চারুর মুখখানা আরোও ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। সে সত্যি মনে করতে পারছে না এমন কিছু তার তালিকায় ছিলো কি না। তার ওয়ার্ক শিডিউলে কফির পয়েন্টটি মনে করতে না পারায় চারু আমতা আমতা করে বললো,
“সে……সেটা তো”
“আপনার তোতলানোর স্বভাব আছে বুঝি? বাসে তো গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিলেন। তখন তো এমন কিছু লক্ষ করলাম না”

বাসের কথাটা শুনতেই নিদারুণ লজ্জাবোধে সংকুচিত হয়ে গেলো চারু। এই ভয়টাই পাচ্ছিলো। লোকটি কি এখন তাকে চাকরিচ্যুত করবে? করলেই ভালো? চুক্তিতে লেখা ছিলো চারু চাকরি ছাড়তে পারবে না। কিন্তু বস স্বেচ্ছায় চাকরিচ্যুত করলে তাকে পেনাল্টি ভরতে হবে কি না এমন কোনো কথা সেখানে বলা ছিলো না। চারুও চায় না এই অসভ্য লোকের সাথে কাজ করতে। চারুকে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শ্রাবণের কপালে ভাঁজ প্রগাঢ় হলো। সে ভেবেছিলো মেয়েটি আবার জংলী বেড়ালের মতো আঁচড় বসাবে। কিন্তু এমন কিছুই সে করলো না। শ্রাবণ ভারী গলায় বললো,
“আপনি কি ভূতের মতোই দাঁড়িয়ে থাকবেন? নাকি কফিটা আনবেনও। দেখুন আমার আপনাকে দেখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। ইভেন ইউ আর নট প্রিটি”

চারু ঠোঁট কামড়ে শ্রাবণের কটুক্তি সহ্য করলো। “ইউ আর নট প্রিটি?”—হাহ! চারু সুন্দরী রমনী তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই তার। সৌন্দর্য্য নিয়ে সে দম্ভ করে না। তবে বয়ঃসন্ধিকাল পার হবার থেকেই তার কাছে কম প্রেম নিবেদন আসে নি। স্কুল, কলেজ, ভার্সিটিতে তাকে কেন্দ্র করে প্রেমিকের পরিধিটা সুবিশাল ছিলো। তার জন্য মনে আবেগ পুষে নি এমন পুরুষ বন্ধু একটিও জোটে নি। তাদের হৃদয়ে ছিলো তার প্রতি প্রেম এবং চোখে ছিলো মোহ। এ থেকেই সে নিশ্চিত হয়েছে সে সুন্দরী। হয়তো ডাকসাইটে সুন্দরী নয়। কিন্তু “ইভেন ইউ আর নট প্রিটি” এই উক্তিটা তার জন্য খাটে না। চারুর তর্ক করতে ইচ্ছে হলো না। মনে মনে গালমন্দ করলো,
“যদি প্রিটি না হই তাহলে হাভাতের মত আমার কোমড়ে তাকিয়ে থাকা কেন?”

কিন্তু তা ঠোঁটে আনার সাহস হলো না। চাকরিটা তার চাই এটা ভীষণ রকমের বিরক্তিকর সত্য। সে যেতে নিলেই শ্রাবণের ভারী স্বর কানে এলো,
“আমার কফি মেশিনটার দাম উনসত্তর হাজার টাকা। সো বি কেয়ারফুল”

কথাটা যে একরকমের সতর্কবানী তাতে কোনোপ্রকার সন্দেহ নেই চারুর। মানে মেশিন নষ্ট হলে সেই ভর্তুকি আর কাউকে না চারুকেই দিতে হবে। চারুর ইচ্ছে করলো শ্রাবণের কোকড়ানো চুলগুলো ধরে ঝাকি দিতে কিন্তু সেটাও সে করতে পারবে না। কান্না পাচ্ছে। এই অসভ্য লোকটার সাথে কি করে কাজ করবে সে? তিন বছর অর্থাৎ ছত্রিশ মাস অর্থাৎ এক হাজার পচানব্বই দিন। ঘন্টার হিসেব করার সাহস হলো না চারুর। আফসোস হচ্ছে কেন একবার গুগল করলো না সে। এই অসভ্য লোকের কথাটা জানলে সে কখনোই এই কোম্পানিতে চাকরি নিতো না।

কফি মেশিনের সম্মুখে সে দাঁড়িয়ে আছে। দামী মেশিন। এতো দামী মেশিন কখনো দেখে নি সে। কালো কফি খাওয়ার জন্য উনসত্তর হাজার টাকার মেশিনের কি প্রয়োজন? পনেরো টাকার নেসকফের প্যাকেট পানিতে গুলে নিলেই তো হয়! বড়লোকদের মনে হয় টয়লেট পেপারেও সোনা লাগানো থাকে। কথাটা ভাবতেই নিজেই হাসলো সে। চারু বুদ্ধিমান রমনী, তার গিটে গিটে বুদ্ধি। এখন পৃথিবী খুব-ই উন্নত। শ্রাবণ তালুকদার চাইলেই তাকে নাকানিচুবানি খাওয়াতে পারবে না। ফটাফট সে চ্যাট জিপিটি খুললো। একটা ছবি তুলে তাকে পাঠিয়ে শুধালো,
“কিভাবে অপারেট করবো?”

চ্যাটজিপিটি সময় নিলেও তাকে সব বুঝিয়ে দিলো। সেও ফটাফট কফি গ্রাইন্ড করে এক কাপ এক্সপ্রেসো বানিয়ে আনল। শ্রাবণ তার দিকে সুঁচালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“এটা আপনি বানিয়েছেন?”

সগর্বিত স্বরে চারু উত্তর দিল,
“হ্যা”

শ্রাবণ তার বক্রহাসি বর্ধিত করে বললো,
“ইউ শ্যুড ইউজ ইউর ব্রেইন”
“হ্যা?”
“আমি নিশ্চয়ই কফি বানাতে আপনাকে চাকরি দেই নি। কফি বানানোর জন্য আলতাফ আছে। সেক্রেটারি হিসেবে আপনার কাজ কফিটা আমার টেবিলে পৌছেছে কি না সেটা মেক শিউর করা। আপনি নিজের আধা ঘন্টা নষ্ট করেছেন। প্রথম দিন তাই আমি এটা ওভারলুক করছি। নেক্সট টাইম, ইউ শ্যুড বি কেয়ারফুল। বাসে অপরিচিত মানুষদের থাপ্পড় মারলেই প্রমাণিত হয় না সে বুদ্ধিমতী। আসল সময়ে বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়”

শ্রাবণের অপমানগুলো নিতান্ত ইচ্ছাকৃত তা বুঝতে বাকি রইলো না চারুর। এই লোক এক থাপ্পড়ের বদলা তার অস্থিমজ্জায় অগ্নিপাত করে উশুল করবে তাতেও সন্দেহ নেই। চারু চোয়াল শক্ত করে সইলো সবকিছু। নতমস্তকে বললো,
“জি”
“এখন বলুন আমার নেক্সট মিটিং কবে?”
“সাড়ে তিনটে। বায়ারদের সাথে একটা মিটিং আছে”
“পিপিটি রেডি?”
“জি”
“সাবমিট করার জন্য কি চাঁদ দেখবেন?”

চারু মাথা নাড়ালো। যার অর্থ না। ফলে শ্রাবণ কঠিন স্বরে বললো,
“দেন ফাইলটা সাবমিট করুন। গো”

চারু কোনোমতে ছুটে বের হলো। চোখ টলমল করছে। লোকটির ভারী স্বরের সূঁচালো কথাগুলো বিছুটি পাতার মতো লাগছে। নির্দয়, পাষাণ। প্রথম দিনে এতোটা অপমান করে করে? চারু নিজের ডেস্কে যেয়ে পিপিটি ফাইল ইমেইল করলো। প্রায় সাথে সাথে ইমেইল এলো,
“ডু ইট এগেইন”

চারুর বুঝতে বাকি রইলো না তার আগামী দিনগুলো কেমন কাটতে চলেছে। বস তো নয় জল্লাদের হাতে পড়েছে সে। সেদিনের মতো তার পাওয়ার পয়েন্ট ফাইল বানাতে বানাতেই লাঞ্চ টাইমটা চলে গেলো।

****

শ্রাবণ উরফে জল্লাদ তালুকদার— তাকে বর্ণনা করতে হলে একটা শব্দই যথেষ্ট, তা হলো উনি একটা অসহ্য যন্ত্রণা। লোকটির পৃথিবীতে কিছুই ভালো লাগে না। সব কিছুতেই তার খুঁত ধরতেই হবে। চারুর প্রতিটি কাজে তার নাক শিটকানো চাই ই থাপ্পড়ের প্রতিশোধ সে সুদে আসলে নিচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেক্রেটারি হবার দরুণ চারু একটি তালিকা বানিয়েছে যার শিরোনাম “জল্লাদ তালুকদার এবং তার নকটামি”। সেই তালিকায় প্রতিদিন নতুন নতুন পয়েন্ট যুক্ত হয়। ত্রিশ দিনে মোট পয়ত্রিশটা পয়েন্ট যুক্ত হয়েছে। নতুন যুক্ত হয়েছে লোকটি পেঁয়াজ খায় না। সকাল পাঁচটা যখন কাকপক্ষীও ঝিমিয়ে থাকে সেই সময়ে জল্লাদের ইচ্ছে হল আজ অফিসে আসতে। কারণ টরেন্টোতে কোন ক্লাইন্টের সাথে তার মিটিং এর কথা আছে। চারুকেও লোকটির সাথে আসতে হয়েছে। নির্ঘুম রাত জেগে সব রিপোর্ট বানিয়ে, না খেয়ে তাকে ছুটতে হয়েছে অফিসে। মাত্র সাত মিনিট দেরি করার জন্য জল্লাদের কঠিন দৃষ্টিও সহ্য করতে হয়েছে। মিটিং শেষ করে জল্লাদ হুকুম দিলেন,
“আমার জন্য ব্রেকফাস্ট অর্ডার কর। ক্লাব স্যান্ডউইচ, নো অনিয়ন, নো ক্যাচাপ। আমি পেঁয়াজ খাই না”

সকাল সাতটায় জল্লাদের জন্য ক্লাব স্যান্ডউইচ কি গাছ থেকে পেরে আনবে চারু? এই সকালে রুটি, পরোটা ছাড়া কিছু পাওয়া যায়? ফলে দাঁতে দাঁত পিষে চারু শুধালো,
“স্যার, এখন সকাল সাতটা বাজে। এখন কোনো রেস্টুরেন্ট খোলা নেই। বলি কি, আমি পরোটা নিয়ে আসি? ডিমভাজি আর পরোটা? এখন সেটাই পাওয়া যাবে”

শ্রাবণ এমনভাবে তাকালো যেন চোখ দিয়েই তাকে ভস্ম করে দিবে। চারু সেই সুযোগ দিলো না। তাই আমতা আমতা করে বললো,
“আমি অর্ডার করছি স্যার”

জল্লাদ তালুকদারের এমন ফরমাইশ সহ্য করা যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে গেছে চারুর জন্য। ত্রিশ দিনে মোট সাত কেজি ওজন কমে গিয়েছে চারুর। খাওয়ার সময় নেই, ঘুমানোর সময় নেই। একদিন রাত বারোটার সময় তাকে বাড়ি যেতে হয়েছে। শ্রাবণ অবশ্য নিজেই পৌছে দিয়েছে। বড় কালো গাড়ি থেকে রাত বারোটায় নামতে দেখে বাড়িওয়ালা বারান্দা দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। হয়তো মাকেও সেটা পরদিন জিজ্ঞেস করেছিলো। চারুর শোনার সময় হয় নি। কারণ পরদিন আবার সকাল সাতটায় উপস্থিত হতে হয়েছে রিপোর্ট নিয়ে। আর চুন থেকে পান খসলেই,
“ডু ইট এগেইন”

এখন স্বপ্নেও চারু শুনতে পায়,
“ডু ইট এগেইন”

কিন্তু চারু সব মেনে নিয়েছে কারণ এক মাস পর যখন মোটা অংকের স্যালারিটা ঢুকলো তখন মনে হলো উফফ শান্তি।

প্রথম মাসের বেতন পেয়েই প্রথম চারু যা করলো তা হলো ঘরের জন্য ঘটা করে বাজার। বাড়িওয়ালাকে ঘরভাড়া দিলো। মায়ের হাতে বাকি টাকা দিয়ে বলল,
“তোমার সংসার নিয়ে এখন চিন্তা করতে হবে না”

মা খুব খুশি হলেও বাবা ছিলেন নির্বিকার। মেয়ের টাকায় ঘর চলছে ব্যাপারটি তার মনোঃপুত হয় নি। অবশ্য সেকেলে মানুষের চিন্তাধারা বদলানোর দায় ঠেকে নি চারুর। বাবার এমন আচারণে অভ্যস্ত সে। মা খুব আগ্রহ নিয়ে গরু মাংস রান্না করছেন। চারু সব গুছিয়ে দিচ্ছে। এর মধ্যেই ফোনের কর্কশধ্বনি। “Jollad”—নামটি ফুটে আছে স্ক্রিনে। চারুর ইচ্ছে হল ফোনটি ধরবে না। পরদিন বলবে,
“সরি স্যার, সাইলেন্ট ছিলো”

কিন্তু শ্রাবণ তখন খোঁটা দিয়ে বলবে,
“বাসে আবার কারোর সাথে মারপিট করছিলেন নাকি?”

খোঁচা খাওয়ার থেকে ফোন ধরা শ্রেয়। চারু ফোনটি ধরতেই ভারী স্বর শুনতে পেলো,
“মিস মেহেনাজ?”

শ্রাবণের কণ্ঠ শুনতেই ধাক্কা খেলো চারু। কেমন ঘোরলাগা স্বর, ধরা গলা। লোকটির কি ঠান্ডা লেগেছে? শ্রাবণ চুপ করে রয়েছে। কিছু বলছে না। পরমুহূর্তেই নেশাতুর স্বরে শুধালো,
“আপনি একটু আমার বাসায় আসতে পারবেন?”……………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি