#চারুলতা_তোমার_জন্য
#৩য়_পর্ব
চারু হতভম্ব হয়ে আছে। জল্লাদ ফোন কেটে দিয়েছে। ঘড়িতে সময় দশটা। রাত দশটার সময় এই মানুষটি তাকে ডাকছে কেনো? কি কাজ? আজ সব কাজ শেষ করে এসেছে সে। “ডু ইট এগেইন”— কথাটাও শোনা হয় নি। তবে কেন ডাকছেন? আর কথাটা বলার সাথে সাথেই লোকটা ফোন কেটে দিয়েছে। ফোন কাটার পর থেকে চারু হতভম্ব হয়ে বসে আছে। কি করবে বুঝতে পারছে না! সে কি লোকটার বাসায় যাবে? কিন্তু কেনো যাবে? তার সেখানে কোনো কাজ নেই। ঝি খাটুনী তো অফিস অবধি। চাকরির সময় কোথাও বলা ছিলো না। অফিস ব্যতীতও ঝি খাটুনী খাটতে হবে। তাই চারু ঠিক করলো সে যাবে না। কিন্তু এ নিয়ে আগামীকাল চোখ রাঙ্গালে। রাঙ্গালে আর কি! মিথ্যে বলবে। চারু বলবে,
“আসলে স্যার আমি আপনার ঠিকানা জানি না। আমি ঠিকানা জানার জন্য আপনাকে দু-তিনবার ফোন করেছি কিন্তু আপনি ধরেন নি”
প্রমাণ-স্বরুপ সে ডায়ালে জল্লাদের নাম্বার রেখে দিবে। কিন্তু জল্লাদকে দেখানোর পূর্বে বুদ্ধি খাটিয়ে নাম বদলে ফেলে “Sir” লিখতে হবে। জল্লাদ নয়তো গর্দান নিয়ে নিতে পারে। চারু নিজেকে স্বাভাবিক করলো। মায়ের রান্না শেষের দিকে। এখন সে কবজি ডুবিয়ে খাবে তারপর ঘুমাবে। আর জল্লাদের চিন্তা নয়। ব্যাটার ইচ্ছে হলে সে ফোন দিক। যদি ব্যস্ততা দেখায় তখন ভেবে দেখা যাবেক্ষণ।
***
থাই গ্লাসের পাশে থাকা ক্যাকটাস গাছে একটা ফুল হয়েছে। লাল টকটকে ফুল। সূর্যের আলোটা ফুলের গায়ে পড়ছে বলে লাল রঙটা আরোও উজ্জ্বল লাগছে। চারুলতা মুখে হাত দিয়ে বসে আছে। জল্লাদ আসে নি। সকালে তার দেরি দেখে ফোন দিলো চারু, কিন্তু সে ধরলো না। একঘন্টা বাদে একটি ম্যাসেজ এলো,
“আমি আজ আসবো না”
ব্যাস এতোটুকুই। সময়ের দায়রায় নিজেকে আষ্টেপৃষ্টে বাধা ব্যক্তিটি আজ অফিস আছে নি ব্যপারটি খুব ই অবাককর। শ্রাবণ তালুকদারের মতো মানুষ কি কাজ ছাড়া কিছু বুঝে? কাজ তার জন্য অক্সিজেনের মতো। কাজ ছাড়া তার ভালো থাকা দুষ্কর ব্যাপার। চারুর ধারণা মানুষের শ্বাসের সমস্যা হলে যেমন মানুষকে অক্সিজেন মাস্ক পড়াতে হয় শ্রাবণ তালুকদারকে ফাইলের স্তুপে মুখ ডুবিয়ে রাখিতে হবে। কাগজের গন্ধ তার জন্য হবে ভেন্টিলেশন সিস্টেম। এমন উদ্ভট চিন্তা করতে করতে নিজেই হেসে ফেললো চারু। লোকটি নেই তাই কাজের তাড়া নেই। শুধু সকাল থেকে ক্লাইন্টদেরকে “সরি” বলা ব্যতীত আর কিছুই করতে হচ্ছে না। এইচ. আর, আর.এন.ডি টিমের সাথের মিটিংগুলো ক্যান্সেল হয়েছে। ব্যাটা কত মিটিং করে। আজকের শিফিউল অনুযায়ী মোট সাতখানা মিটিং ক্যান্সেল করেছে। তার টেবিলে স্তুপাকারে রিপোর্ট জমা। অথচ জল্লাদ আজ ডুব দিলো। ব্যাপারটি অষ্টম আশ্চর্যজনক। মনে খুট খুট করছে। গতরাতে বাড়িতে যেতে বলেছিলো। কোনো বিপদ হলো কি? একবার কি খোঁজ নিবে?
*****
বসুন্ধরার ব্লক ডি এর রোড নং সাতের শেষের দোতালা বাড়ির সম্মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে চারুলতা। “স্বপ্নসদন” নাম বাড়িটার। প্রকান্ড গেটের ওপাশে ইট রঙের বাড়িটি দেখা যাচ্ছে। সবুজের আড়ালে লাল রঙটা দারুন লাগছে। বারান্দায় ঝুলছে নাম না জানা কিছু গাছ। ফুলের গাছ নয়। পাতাবাহারের মতো লাগছে। গেটের পাশের সাদা বাগান বিলাশ ফুলের ভারে নুয়ে পড়েছে। তাই অর্ধেক গেট ই দেখা যাচ্ছে। কালো লোহার গেটেও সুন্দর কারুকাজ। এতো সুন্দর বাড়ি বাহির থেকে দেখেছে চারু। কখনো ভেতরে যাবার সুযোগ হয় নি। এমন বাড়ির সম্মুখে দারোয়ান থাকে। বয়স্ক দারোয়ান। এখানেও ব্যতিক্রম হলো না। চোখ মুখ কুঁচকে দারোয়ান শুধালো,
“কাকে চাই?”
“শ্রাবণ স্যার বাসায় আছেন? আমি উনার সেক্রেটারি”
বুড়ো দারোয়ানের চোখ সুঁচালো হয়ে গেলো। তাকে সে চিনতে পারছে না। চারু তার কার্ড দেখালো। সে কার্ড দেখার পরও বললো,
“স্যার কি আপনেরে ডাকছে?”
চারু বুঝলো লোকটা এখানে “কে হবে কোটিপতি” খেলতে বসবে। নানাবিধ প্রশ্ন করবে। একটি প্রশ্নের উত্তর মানেই তাকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হবে না। তাই চট করে বললো,
“জি”
লোকটি তার কথা বিশ্বাস করলো না হয়তো। তাইতো চোখ কুঁচকে তাকালো। সে ইন্টারকোমে ভেতরে ফোন দিলো। কিন্তু অপরপাশের মানুষটি হয়তো ফোনটি ধরলো না। তাই শ্লেষ্মাজড়িত স্বরে অপ্রসন্ন ভঙ্গিতে বললো,
“ভেতর থেকে অর্ডার নাই”
“স্যার কি অসুস্থ?”
“জানি না”
“আজব তো, আপনি যার ঘরে কাজ করেন তার শরীরের অবস্থা জানেন না?”
কথাটা হয়তো দারোয়ানের পছন্দ হয় নি। অবশ্য জল্লাদের খোঁজ নেওয়ার কিছু নেই। সে একটি অতীব বিরক্তিকর, রসকষহীন যন্ত্রমানব। তার আর রোবটের মধ্যে পার্থক্য নেই। চারুর মাঝে মাঝে মনে হয় শ্রাবণ আসলেই রোবট। কেউ প্রোগ্রামিং করে তাকে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু যখন তাকে টিটকারি করে কথা শোনায় তখন সে নিশ্চিত হয় এই জল্লাদটি মানুষ। চারু একটা বিটলামি করলো। তার মোবাইলে অটো রেকর্ডিং অন করা। তাই সে গতরাতের রেকর্ডিংটা চালু করে ধরলো দারোয়ানের সামনে। রেকর্ডিং এ স্পষ্ট শ্রাবণের স্বর। সে তাকে আসতে বলছে। চারু রেকর্ডিং শোনা শেষে বললো,
“শুনলেন তো? এবার ঢুকতে দিন”
অবশেষে উপায়ন্তর না পেয়ে দারোয়ান তাকে ঢুকতে দিলো। বাহির থেকে যত বড় লাগছিলো বাড়িটা আরো বড়। গেট থেকে ঢুকে হাটার জায়গা। দুপাশে বড় বড় গাছ যেন এক একটা প্রকান্ড প্রহরী। তাদের ছায়ায় রোদের তাপ ঢেকে গেছে। মোটা মেহগনী গাছও আছে। দেখেই আন্দাজ করা যায় গাছটি খুব পুরোনো। আম গাছে মুকুল ধরেছে। টক গন্ধ নাকে লাগছে। ফুলের গাছ নজরে পড়লো না বেশি একটা। এতো গাছের পরিচর্চা কে করে? নিশ্চয়ই মালী আছে। কিন্তু কাউকে নজরে পড়লো না। কারুকার্যখচিত সেগুন কাঠের দরজার সামনে এসে কলিংবেল বাজালো সে। একবার, দুবার, তিনবার— কেউ দরজা খুলছে না। শ্রাবণ কি কা থাকে? জানা নেই চারুর। চিন্তাটা এবার একটু বাড়লো। লোকটি বেঁচে আছে তো? তখনই একটি মহিলা দরজা খুললো। মধ্যবয়স্ক মহিলা। পরণে ময়লা কাপড়, বিরক্তির সাথে শুধালো,
“কারে চাই?”
আবার “কে হবে কোটিপতি” টাইপ প্রশ্ন। চারু আবারো বললো,
“শ্রাবণ স্যার আছেন?”
মহিলা সরে দাঁড়ালো। তাকে দেখে মনে হলো তার প্রশ্ন করার সময় নেই। তাড়া আছে। হাতে সময় নেই। চারু ঘরে এলো। মহিলা তাকে একটি ছোট রুমে তাকে বসতে বললো। রুমটি খুব ছোট। একটি টেবিল এবং তিনটি চেয়ার। আর কোনো আসবাবপত্র নেই। এটা হয়তো গুরুত্বহীন মানুষদের জন্য। তারা এখানে বসবে, কথা বলবে বিদেয় হবে। তাদের ভেতরঘর দেখার অনুমতি নেই। এই ঘরের ফ্লোরে কোনো কার্পেটও নেই। মহিলা কিছু না বলেই ভেতরে চলে গেলো। এরপর নিরবতা। এতোটাই নিস্তব্ধ যে একটু পর তা কাঁটার মতো লাগছে। বিশ মিনিট পর শ্রাবণ এলো। পরনে কালো টি-শার্ট, একটি ঢোলা প্যান্ট। চোখ-মুখ শুষ্ক তবে তাতে রাজ্যের বিরক্তি। অর্ধচোখা চাহনীতে চারুর দিকে তাকিয়ে বললো,
“আপনি এখানে কেন মিস মেহেনাজ?”
রুক্ষ্ণ, ভাঙ্গা স্বর। তার চাহনী, কণ্ঠ শুনে তাকে সুস্থ ঠেকলো না চারুর কাছে। সে একবার ভালো করে দেখে নিলো। শ্যাম কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ধীরে ধীরে সে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। চারু ঠোঁট কামড়ে ধীর স্বরে বললো,
“আপনি আমাকে গতরাতে আসতে বলেছেন। তখন রাত ছিলো, আসা হয় নি। আজ আপনি অফিসেও আসেন নি। তাই………”
ওপাশের মানুষটি একদৃষ্টিতে তাকে দেখছে। মুখে কোনো কথা নেই। কপালে ভাঁজ ঘন হলো। কিছুসময় ছোট ঘরটিতে গাঢ় নিঃশ্বাসের শব্দ বাদে কিছুই শোনা গেলো না। তারপর ভারী স্বর নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে বললো,
“তারমানে আপনি কোনো কাজে আসেন নি তাই তো?”
“জি?”
“মিস মেহেনাজ একজন ব্যাচেলর পুরষের বাসায় আসার মানে বুঝেন আপনি?”
চারু হতভম্বের মত চেয়ে রইলো। জল্লাদ বলে কি? অথচ এই লোকটি তাকে রাতে আসতে বলেছিলো। চারু পাথরের মত বসে রইলো। কান জ্বলছে যেন। কঠিন দৃষ্টি তার শ্রাবণের দিকে। শ্রাবণ নির্বিকার। চারুর ইচ্ছে হলো শ্রাবণের মাথা ভেঙ্গে দুভাগ করে দিতে। কিন্তু হাতের কাছে কিছুই নেই। ফলে ধারালো স্বরে বললো,
“স্যার, আপনি আমাকে কাল আসতে বলেছিলেন। আমি ভেবেছি হয়ত জরুরি ব্যাপার”
“কিন্তু এখন তো কাল নয়। এখন আজ। আমি যখন বলেছি আপনি আসেন নি, সো সেই দরকার ফুরিয়ে গেছে। দেখুন, আমার শরীরটা ভালো নেই। আমি রেস্ট করবো। আপনার কোনো কাজ না থাকলে আজকে পারেন। আর এভাবে হুটহাট আমার বাসায় আসবেন না। কারণ আমি একা থাকি। আমি চাই না আমার কাজের খালা আর দারোয়ান আমাকে আর আপনাকে নিয়ে গোসিপ করুক। গেট দ্যাট?”
আপনাকে শব্দটা এমন ভাবে বললো যেন খুবই জঘন্য কেউ চারু। নর্দমার কিট! যার সাথে এই মহামহীমের কোনোভাবেই কিছু যায় না। চারু এখনো কঠিন নজরে তাকে দেখছে। একটা খুন করলে কি ফাঁসি হয় নাকি যাবজ্জীবন? সেটাই সে ভাবছে। শ্রাবণ উঠে দাঁড়ালো। তার পা এলোমেলো ভঙিতে হাটছে। দরজা পার হতে ধরাম করে শব্দ হল। ছয় ফুট বিশালাকার ব্যক্তিটি একেবারে সটাং হয়ে মেঝেতে পড়ে গেলো। হতবাকের মাত্রা আকাশ ছুলো চারু। আপনা-আপনি মুখে হাত চলে গেলো।
****
রাত বেশি না। সবে সন্ধ্যের গন্ধ মিলিয়ে গেছে। ধীর পায়ে তমসাকন্যার পদচরণ হয়েছে পৃথিবীতে। মেঘহীন আকাশে থালার মতো চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলো শরীরের কৃত্রিম আলোর জন্য পৌছাতে না পারলেও শ্রাবণের লাল ইটের বাড়িতে ঠিকই পৌছেছে। একটা মৌমাছি ঘুরছে। সে বাহিরে যাওয়ার পথ খুঁজছে। মাথায় তীব্র যন্ত্রণা, ভার হয়ে আছে। তাও টিপটিপ করে চোখ খুললো শ্রাবণ। তার হাতে সূক্ষ্ণ যন্ত্রণা। কোনো কিছু শরীরের ভেতরে যাচ্ছে হয়তো। চোখ মেলে তাকাতেই নিজেই ঘরের সিলিং নজরে পড়লো। মস্তিষ্ক এখনো জাগ্রত নয়। দৃষ্টি ঝাপসা। সে কি বিছানাতেই ছিলো? মনে করতে পারছে না। মাথার যন্ত্রণাটা কপাল ছাড়িয়ে গেছে। চোখ মেলে রাখা কষ্টকর। কিন্তু ঘুমানোর মানে নেই। মনে হচ্ছে অনেকটা সময় সে ঘুমিয়েছে। যার কারণে পানি পিপাসা পেয়েছে। একটু পানি পেলে ভালো হত। সাথী খালা আছেন নাকি চলে গেছেন। দরজা কে দিয়েছে? সে কি বাহির থেকে লক করে গিয়েছে? ভাবতে ভাবতেই পাশ ফিরলো। তখনই নজরে পড়লো। তার হাতের কাছে একটি অপরুপ সুন্দরী মেয়ে। হাতের উপর মাথা রেখে চোখ বুজে আছে। শ্রাবণ কিছুসময় তাকিয়ে রইলো। তার দৃষ্টি এখনো ঝাপসাটে। অস্পষ্ট স্বরে বললো,
“চারুলতা?”
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি