#চারুলতা_তোমার_জন্য
#৬ষ্ঠ_পর্ব
চারু স্থির নয়নে চেয়ে রয়েছে মোবাইলের ফিডের দিকে। শেষ লাইনটা দু তিন বার পড়লো। শরীর কাঁপছে তার। সজীব ইসলামের মতো মানুষের মৃত্যুতে ব্যথিত হবার কোনো কারণ নেই। অন্তত গতরাতের কুৎসিত স্মৃতির পর তো একেবারেই নয়। স্মৃতিটা এখনো মনে কুপ্রভাব ফেলে রেখেছে। কিছু মানুষ পৃথিবীতে শুধু ভার বাড়ানোর দায়িত্বে থাকে। তাদের কাজ শুধু বোঝা বাড়ানো। ধরনীকে তাদের কিছু দেবার নেই। শুধু কিছু অপ্রীতিকর স্মৃতি তারা নিজেকে ম্লান করতে রেখে যায়। সজীব ইসলাম তেমন একজন মানুষ। অথচ এই মানুষটির মৃত্যু ভীষণভাবে ভাবাচ্ছে চারুকে। তার ঘুমহীন মস্তিষ্কে অদ্ভূত উচাটন অনুভূত হল। ভালোলাগছে না। গা গুলাচ্ছে। অস্থির অস্থির লাগছে। এমনটা হবার কারণটিও বুঝতে পারছে না। মোবাইলটা হাত থেকে নামিয়ে রাখলো চারু। বেশি চিন্তা করতে চাইছে না। হয়তো রাতে ঘুম হয় নি বিধায় শরীর খারাপ লাগছে। চারুর একটা দোষ, ঘুম থেকে উঠলে আর ঘুমোতে ইচ্ছে করে না। তাই চা খাবার উদ্দেশ্যে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো।
চুলায় টগবগ করে ফুটছে গোসলের পানি। চারুর বাবার ঠান্ডার সমস্যা রয়েছে। তিনি বছরের বারোমাস গরম পানি দিয়ে গোসল করেন। গ্যাসের লাইন থাকার কারণে সুবিধা। নয়তো সিলিন্ডার কিনতে হলে এই নবাবী দেখানো যেতো না। চারুর মা পটল ছুলাচ্ছেন। আজ পটল আর ট্যাংরা মাছ রান্না করবেন তিনি। স্বামীর ট্যাংরা মাছ খেতে ইচ্ছে করছে। চারুকে দেখে পটল কাটতে কাটতেই শুধালেন,
“কিছু লাগবে? চুলা ফাঁকা আছে। একটু পর কিন্তু রান্না বসাবো তখন চুলা ফাঁকা পাবি না”
“চা করবো”
“এই বেলায়?”
“মাথা ধরেছে। ঘুম হয় নি কালকে”
মেয়ের কথায় চারুর মা মুখ তুললেন, পূর্ণদৃষ্টিতে মেয়েকে দেখলেন। চিন্তিত স্বরে বললেন,
“শরীর কি বেশি খারাপ?”
“না তেমন কিছু না। কাজের অনেক চাপ তো তাই আর কি”
“আচ্ছা তোর চাকরিটায় অনেক কাজ তাই না?”
“সব চাকরিতেই কাজ। কেউ কি আর মুখ দেখে টাকা দেয় মা? তোমাকে খাটিয়ে তোমার আখের ছোবড়া না বানালে কোম্পানির থেকে এক পয়সাও পাবে না। এটাই বাস্তবতা। ঐ মাসের শুরুতে একগাধা টাকা যদি ব্যাংকে না আসতো তাহলে কেউই মরার চাকরি করতো না”
চারুর মা ধীর স্বরে বললেন,
“সবাই কি আর তা বুঝে বল, নানারকম কথা বলে। বাজে কথা। শুনতে মনে হয় কেউ গরম পানি ঢেলে দিয়েছে। এই তো পরশুদিন, বাড়িওয়ালার বউ বলছিলো…”
“ওই মহিলার কথা ছাড়ো তো মা। উনার সব কিছুতে নাক গলানো স্বভাব আছে। বলি চাকরি না করলে মাস শেষে টাকা আসবে কি করে? পাঁচ তারিখ হলেই তো হাত ঘষতে ঘষতে তার স্বামী নিজের থোবড়া দেখিয়ে যায়। টাকা পেলে হাসি মুখে বিদায় হয়, আর না পেলে কথা শোনায়। তাই এই মহিলার কোনো কথায় কান দিবে না”
“সে কি হয়? মা হবার জ্বালা তুই কি বুঝবি। বিয়ের বয়স হচ্ছে তোর। এই তো সেদিন তোর বাবার থেকে একজন তোর ছবি দেখে পাগল হয়ে গেছে তোকে ঘরের বউ বানানোর জন্য। এখন যদি আশেপাশে তোকে নিয়ে বাজে বাজে কথা রটে তখন কি ভালো লাগবে বল?”
“কি চাইছো তাহলে মা?”
চারুর কণ্ঠে অপ্রসন্নতা। চারুর মা মেয়ের এমন কাঠ গলার অর্থ জানেন। এখন কিছু বলা মানেই চারু ভীষণ রেগে যাবে। তবুও মিনমিন করে বললেন,
“চাকরিটা ছেড়ে দে”
“কি বলছো মা? মাথা ঠিক আছে? চাকরি ছাড়লে সংসার চলবে? আর চাকরি ছাড়া কি মুখের কথা? আমি তিন বচ্ছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ। এখন চাকরি ছেড়ে দিলে মোটা অংকের টাকা জরিমানা দিতে হবে। কেস কাচারির ঝামেলা তো আছেই। আচ্ছা এমন জগৎউদ্ধারকারী বুদ্ধিগুলো পাও কোথায় বলো তো?”
চারুর মা চুপ করে রইলেন। চারু দীর্ঘশ্বাস ফেললো। রাগে মাথার তালু দপদপ করছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মেজাজখানা নিয়ন্ত্রণে এনে বললো,
“আমি কোনো খারাপ কাজ করছি না মা। চাকরি করছি। একটা ভালো কোম্পানিতে চাকরি করছি। যে আমাকে বিয়ে করবে সে বুঝেই বিয়ে করবে। সবাই বাড়িওয়ালার বউয়ের মতো মাথায় ভুসি চাষ করেন না”
“তোর বিয়েতে আপত্তি নেই তো?”
চারু শান্ত দৃষ্টিতে কিছুসময় চেয়ে রইলো মায়ের দিকে। চাপা বিষাদের ছায়া ফুটে উঠলো সেই দৃষ্টিতে। খুব বিষন্ন স্বরে উত্তর দিলো,
“তোমাদের যেটা ভালো মনে হয় কর”
মেয়ের বিষন্নতা কোথাও না কোথাও আঁচ করতে পারলেন চারুর মা। অতীতের রেশ হয়তো এখন তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। মানুষের মন তার সবচেয়ে দূর্বল স্থান, একবার আঘাত পেলে চিরটাকাল সেই চিহ্ন থেকে যায়। চারুর ক্ষেত্রেও ভিন্ন নয়। কিছু স্বপ্ন সেও লালন করেছিলো নেত্রপল্লবে। চঞ্চল হৃদয়টা কাউকে সপেছিলো নিভৃতে। কারোর বিশেষ মানুষ হবার ইচ্ছে জন্মেছিল যৌবনে পা রাখা তরুনীর মনে। আকাশ পাতাল ভাবনার আগেই সে প্রেমে পড়লো। অদ্ভুত প্রেম তা। যেখানে বিষাদগুলোও ছিলো মিষ্টি। কারোর নেশাভরা আঁখিতে নিজেকে আকণ্ঠ ডুবিয়ে রাখতেও দ্বিধা ছিলো না। মাথার ভেতর অবিরাম ধ্বনিত হতো তার নাম, যেন অগণিত পায়ের শব্দে মুখরিত কোনো নীরব মিছিল। তাকে পাওয়ার জন্য একটা সময় চারুর কোমল মন ছটফট করত, আর না-পাওয়ার বেদনায় রাতের ঘুম হয়ে উঠত ছিন্নভিন্ন। সমস্ত সুখ যেন তার এক ঝলক দেখার মধ্যেই নিহিত ছিলো। তাকে হারানোর ভয়ে কখনো কখনো চারুর চোখেও জমে উঠত অশ্রুর কুয়াশা। অথচ প্রণয়ের যুদ্ধে হৃদয় হারিয়ে পরাজিত হলো চারু। বিনিময়ে মিললো শুধু ক্ষত বিক্ষত একরাশ দুঃখ, নীল দুঃখ; যে দুঃখ হৃদয়ের কোনে আগলে রেখেছে সে। কোনো গভীর রাতে বিষন্ন চোখে ঠায় পায় সেই দুঃখ। চারু চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে চলে গেলো। অতীত আগলে রাখার মানে হয় না, কিছু কিছু মানুষের আগমণ ক্ষণিকের জন্যই হয়। তারা আসে, একমুঠো স্মৃতি ফেলে চলে যায়। তিক্ত যন্ত্রণার থেকে সেই ক্ষুদ্রকালীন মিষ্টি স্মৃতিগুলোই শ্রেয়।
****
কেবিনে পিনপতন নীরবতা। ল্যাপটপের কি-বোর্ডের টাইপিং এর শব্দই শোনা যাচ্ছে কেবল। চারু ধীর পায়ে এসে কফির মগটা রাখলো। সেই সাথে কিছু ফাইল এগিয়ে দিলো শ্রাবণের দিকে। নরম স্বরে বললো,
“স্যার, সাইন লাগতো। নতুন প্রজেক্টের ফাইনাল পেপার এগুলো”
শ্রাবণ চোখ না তুলেই শুধালো,
“আপনি কেমন আছেন মিস মেহেনাজ?”
“জি?… ভালো আছি”
“আপনার শরীর এখন কেমন?”
“জি ভালো”
শ্রাবণ এবার মুখ তুললো। একনজর দেখলো চারুকে। ফাইলগুলো স্বাক্ষর করে দিয়ে বৃহদাকার শরীরটা চেয়ারে এলিয়ে দিলো। সরু তার দৃষ্টি। চারুলতা ঈষৎ অপ্রস্তুত হলো। ইতস্তত স্বরে শুধালো,
“কিছু বলবেন স্যার?”
“সেদিন পার্টিতে আপনি আমাকে না বলে চলে গিয়েছিলেন কেন মিস মেহেনাজ?”
চারু হতচকিত হলো না। সে জানতো শ্রাবণ তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। সে তার দায়িত্ব পালন করে নি। চারু ধীর স্বরে বললো,
“আমার শরীরটা ভালো ছিলো না”
“তাই?”
গাঢ় হলো শ্রাবণের স্বর। দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণতা বাড়লো। চারু মাথা উপরনিচে নাড়িয়ে বললো,
“জি”
শ্রাবণ তার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে এলো চারুর কাছে। দাঁড়ালো ঠিক তার মুখোমুখি। তাদের মধ্যকার দুরত্ব খুব কম। চারু নতমস্তক দাঁড়িয়ে আছে। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। শ্রাবণ বুকে হাতগুলো বেঁধে ঝুকলো কিছুটা। ভারী স্বরে আবার শুধালো,
“সেদিন পার্টিতে আপনি আমাকে না বলে চলে গিয়েছিলেন কেন মিস মেহেনাজ?”
শ্রাবণ গাঢ়, স্মিত স্বর কানে পৌছাতেই চারু কেঁপে উঠলো ঈষৎ। কথাগুলো দলা পাঁকিয়ে গেলো। মিথ্যেগুলো গুবলেট হয়ে গেলো। শ্রাবণ ঠিক তার কানের কাছে এসে বলল,
“আমার মানুষ আমার থেকে কিছু লুকালে আমার ভালো লাগে না মিস মেহেনাজ?”
“আমি কিছু লুকাইনি”
“সত্যি?”
চারু ভাষা খুঁজে পেলো না। অস্থিরতা অনুভূত হলো ভেতরে। বুকটা কাঁপছে যেন। অনুভূতি এমন যেন নকল করতে যেয়ে হুট করেই ধরা পড়ে গেছে। অথচ সে কোনো নকল করে নি। শ্রাবণ তার কপালে আঙ্গুল ঠেকিয়ে বললো,
“আপনি কি জানেন আপনি খুব বাজে মিথ্যুক? আমি শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করছি, কেনো আমাকে না জানিয়ে চলে গিয়েছিলেন?”
“বলতে কি হত?”
“বা/স্টা/র্ডটাকে বুঝিয়ে দেওয়া হত শ্রাবণ তালুকদারের মানুষদের ছোঁয়ার পরিণাম”
চারু মাথা তুলে তাকালো। শ্রাবণের গাঢ় নয়ন তার মাঝে নিবদ্ধ। দৃষ্টিটি বড্ড বিচিত্র। জ্বলজ্বল করছে আগুনের লেলিহান শিখার মত। চারু ধীর স্বরে বললো,
“থাক না স্যার, যা হয়ে গেছে সেটা তো হয়ে গেছে”
“যা হয়ে গেছে সেটা যেন কখনো না হয় সেটার জন্যই বলছি। আগামীবার থেকে যেন অন্যের থেকে আমার জানতে না হয় মিস মেহেনাজ। সেক্রেটারি হিসেবে আমার দায়িত্ব যেমন আপনার। বস হিসেবে আপনার দায়িত্বও আমার। আমার মানুষকে কেউ আঘাত করবে আমার তা সহ্য হয় না। ভাগ্যিস সে মরে গেছে, নয়তো মৃত্যুর থেকেও জঘন্য কিছু তাকে উপহার দিতাম”
শেষ কথাটায় চারুর শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল শিহরণ বয়ে গেলো। তীব্র হিংস্রতা ছিলো যেন কণ্ঠে। গায়ে কাঁটা দিলো শীতলতায়। চারুর আর দাঁড়াতে ইচ্ছে হলো না। এখান থেকে চলে গেলেই যেন মুক্তি। ঈষৎ কাঁপা স্বরে বললো,
“আমি আমার চেয়ারে যাই স্যার?”
“আমি না বললে কি করবেন?”
“জি?”
চারুর চোখগুলো বড় হয়ে গেলো। তার চোখ মুখ ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করলো। শ্রাবণের আচারণ তাকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। অচেনা লাগছে এই চেনা জল্লাদকে। শ্রাবণ বাঁকা হাসলো। মৃদু স্বরে বললো,
“যান”
চারু এলোমেলো পায়ে দ্রুত প্রস্থান করতেই চাইলো। কিন্তু সেখানেই বাধলো গোল। স্বাক্ষরকৃত ফাইলগুলো নিতে যেয়ে তড়িঘড়িতে শ্রাবণের গরম কফির মগে ধাক্কা লাগলো। আর কফিশুদ্ধ মগ মেঝেতে পড়ে ঝণঝণ করে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলো। ঘটনায় বিমূঢ় হয়ে কিছুসময় চেয়ে রইলো চারু। তার মুখখানা চুপসে গেলো। শ্রাবণ অবিচলিত। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে চারুর দিকে। চারুর চটজলদি ভাঙ্গা মগের কাচে হাত দিতেই হাতে কাচ বিঁধলো। চিনচিনে ব্যথায় চোখ মুখ কুচকে গেলো তার। আঙ্গুল কেঁটে ঝরঝরিয়ে পড়লো রক্তিম লহুধারা। শ্রাবণ এবার খপ করে তার হাতখানা ধরলো। টেনে তুললো সে চারুকে। তার চোখের দিকে তাকাতেই চারু ভাষাশূন্য হলো। কিছু বলতে পারলো না। শ্রাবণ তাকে একরকম টেনে বসালো সোফাতে। চারুর রক্তাক্ত হাত তখন শ্রাবণের বিশাল হাতের মাঝে। চারু হাতটা সরাতে চাইলেই শ্রাবণের কড়া স্বর কানে এলো,
“একদম নড়বেন না। ঝিম মেরে বসে থাকুন”
আঙ্গুলে বিঁধে থাকা ক্ষুদ্র কাঁচের অংশটা খুব সাবধানে বের করলো শ্রাবণ। ধীরে ধীরে ডেটল লাগিয়ে দিলো। খুব সাবধানে আঙ্গুলে ব্যাণ্ডেজ লাগলো। চারু জবুথুবু হয়ে বসে রইলো। সে লজ্জিত। তার অসাবধানতার জন্য শ্রাবণের মগটাও ভেঙ্গে গেলো। ফাইলগুলো ভিজে গেলো। কাজ বাড়লো শুধু শুধু। হঠাৎ কানে এলো,
“আমার সামনে ঠোঁট কামড়াবেন না মিস মেহেনাজ, আমি এমন কিছু করি নি যে ঠোঁট কামড়াতে হবে”
তড়িৎ গতিতে চোখ মেললো চারু। হতভম্বের মতো চেয়ে রইলো। চিন্তার কারণে অজান্তেই ঠোঁট কামড়াচ্ছিলো সে। অথচ শ্রাবণ এমন ভাবে বললো কথাটা যা শুনেই লজ্জায় গাল গরম হয়ে গেলো। শ্রাবণের ঠোঁটে বাকা হাসি। সে তার হাত ছেড়ে দিলো। চারুর কপালের এলোমেলো চুলগুলো খুব যত্নে কানের পেছনে গুঁজে দিলো। তার স্পর্শে কেঁপে উঠলো চারু। শ্রাবণ তখন গাঢ় স্বরে বললো,
“সাবধানে কাজ করবেন মিস মেহেনাজ। মনে রাখবেন আপনি আমার অতি গুরুত্বপূর্ণ মানুষ”
চারু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো। অস্পষ্ট স্বরে শুধালো,
“জি?”
“আপনি সেক্রেটারি। আপনার কিছু হলে আমার কাজ হ্যাম্পার হবে”
“ওহ”
“আপনি কি অন্যকিছু ভেবেছিলেন?”
চারু দ্রুত মাথা নাড়িয়ে বললো,
“না”
“এখন কি আমার কাছেই থাকবেন?”
“জি?”
“বলছি, এখানেই থাকবেন নাকি নিজের চেয়ারে যাবেন? যদি এখানে কাজ করার ইচ্ছে থাকে আমি আপনার ডেস্ক এখানে এ্ররেঞ্জ করে দিচ্ছি”
সাথে সাথেই দাঁড়িয়ে পড়লো চারু। তোঁতলাতে তোঁতলাতে বললো,
“আমি আসছি স্যার”
বলেই একরকম ছুটে পালালো যেন সে। শ্রাবণের ঠোঁটে বাঁকা হাসি প্রসারিত হলো। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো চারুর দিকে; চারু উহু চারুলতা, কেবল তার চারুলতা, কেবল এবং তারই চারুলতা।
******
বিকেলের পড়ন্ত সূর্য তখন ডোবার প্রস্ততিতে ব্যস্ত। একটি দীর্ঘ মিটিং শেষ করে অবশেষে বের হলো শ্রাবণ এবং চারু। খুব নামী রেস্টুরেন্টের প্রাইভেট কামড়া বুক ছিলো। টানা আড়াই ঘন্টা মিটিং এর পর অবশেষে বেশ বড় একটি ডিল ফাইনাল হলো। এতে কোম্পানির বিশাল অংকের লাভ। দুপুরের খাবারটাও ক্লাইন্টের সাথেই করেছে তারা। চারু হাত টান দিলো। তার এখন অফিসে ফেরত যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু অফিস টাইম এখনো শেষ হয় নি। শ্রাবণের মাঝে ক্লান্তির লেশ নেই। মুখমন্ডলে কোন ক্লেশ নেই। শার্টের হাতাখানা গুটিয়ে বললো,
“মিস মেহেনাজ, নেক্সট শিডিউল কি?”
“আপাতত কোনো শিডিউল নেই। নতুন প্রজেক্ট সাইটে একবার ভিজিটের কথা বলেছিলেন। আজ যাবেন? কিন্তু এখন তো সন্ধ্যে হয়ে এসেছে স্যার”
শ্রাবণ ঘড়ির দিকে তাকালো। পূর্বাঞ্চল যেতে যেতে সন্ধ্যে হয়ে যাবে। সাইটের কাজ কিছুই দেখা যাবে না। কিছু একটা ভেবে বললো,
“অফিসেই চলুন”
“এখন অফিসে যাবেন। আমি বলি কি আজ বরং থাক। আপনি বরং বাসায় যান। একটা লম্বা ঘুম দিন। শরীরের রেস্টও দরকার স্যার”
“আপনি চরম মাত্রার ফাঁকিবাজ মহিলা, ফয়সালকে ফোন করুন। গাড়ি আনতে বলুন”
“যথাআজ্ঞা, এই ক্ষুদ্র জীব ভুল করেছে। ক্ষমা করে দিন”
ভর্ৎসনার স্বরে বললো চারু। ড্রাইভারকে ফোন করলো বিরস ভঙ্গিতে। তারপর ধীর স্বরে বললো,
“স্যার, চা খাবেন?”
“আমি চা খাই না”
“তাহলে আমি আমি খাই, আপনি দেখুন”
“আপনি কি রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খাবেন?”
শ্রাবণের প্রশ্নে চারু অবাক স্বরে শুধালো,
“রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খাওয়া কি অপরাধ মূলক কিছু? আমাকে কেউ জরিমানা করবে? নাকি এখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খেলে আমাকে জেলে ভরা হবে কোনটা?”
“উফফফফ, এতো কথা বলেন আপনি”
“তাহলে চা খেতে যাই?”
“জাহান্নামে যান”
“ধন্যবাদ। যাবেন আমার সাথে”
“জাস্ট গো”
“জি জাহাপনা”
বলেই দাঁত বের করে হাসলো চারু। হনহন করে হাটলো চা খাবার উদ্দেশ্যে। চায়ের দোকানে এককাপ দুধ চা অর্ডার করলো। চা আসলে সে আয়েশ করে চা খেলো। এদিকে যে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে তাকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। আয়েশ করে চা খেয়ে চায়ের বিল চুকালো সে। বিশ মিনিট হয়ে গেছে। জল্লাদ নিশ্চয়ই রাগে লাল-বেগুনী হয়ে গেছে। এখন না গেলে আকাশ কাঁপিয়ে হুংকার ছাড়বে। ফলে যাবার জন্য পা বাড়ালো চারু। ঠিক তখনই একটি পরিচিত কণ্ঠে থমকে গেলো চারুর পৃথিবী। বিমূঢ় দৃষ্টিতে চাইলো যখন চিরচেনা সে কণ্ঠে বহুকাল পর শুনলো,
“ভালো আছো চারু?”…………………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি