#চারুলতা_তোমার_জন্য
#৮ম_পর্ব
শ্রাবণ মিষ্টি পছন্দ করে না। তবুও একটা মিষ্টি ভেঙ্গে একটু খেলো। তার চেহারার ভাব বদলালো না। চোখজোড়া শান্ত সরবরের মতো স্থির। চারু মিষ্টির প্যাকেটটা সাথে সাথেই গুছিয়ে ফেললো। শ্রাবণ কিছুসময় তার দিকে তাকিয়ে রইলো। অতঃপর উত্তাপহীন স্বরে শুধালো,
“আপনি কি খুশী এই বিয়েতে?”
চারু থমকালো। বিমূঢ়তা ফুটে উঠলো চোখেমুখে। শ্রাবণ তার দিকে তাকিয়ে আছে। নির্নিমেষ দৃষ্টি। চারু প্রকাশ করলো না। কিন্তু সূক্ষ্ণ দ্বিধার রেখা তার চোখে পরিলক্ষিত হলো। শ্লেষ স্বরে বললো,
“নিজের পছন্দের মানুষের সাথে বিয়ে হচ্ছে স্যার, খুশী হব না কেন?”
“মানুষের মন খুব জটিল চারু। তারা মাঝে মাঝে বুঝতে পারে না তারা আদোপি তারা কি চায়! যাক শুনে ভালো লাগলো, আপনি হ্যাপি। বিয়েটা কবে হচ্ছে?”
“সামনের মাসে”
“আপনার উড বি হাসবেন্ডের আপনার চাকরি এবং তার রেগুলেশনের সাথে কোনো সমস্যা নেই তো?”
চারু মাথা দুপাশে নাড়িয়ে বললো,
“না স্যার”
কিন্তু তাকে আত্মবিশ্বাসী ঠেকলো না। আবছা সন্দেহ ছিলো যেন কণ্ঠে। শ্রাবণ দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। ল্যাপটপে দৃষ্টি টিকিয়ে রেখেই বললো,
“কংগ্র্যাচুলেশন্স এন্ড বেস্ট অফ লাক”
“বেস্ট অফ লাক?”
“ফর ইউর নিউ লাইফ”
চারুর ঠোঁট বিস্তৃত হলো। সে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। ঘরময় নিস্তব্ধতা। শ্রাবণের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। নিদারুণ কাঠিন্যে মুখশ্রী ছেয়ে গেলো। চোখজোড়া জ্বলছে যেন। ক্লান্তিতে ডুবন্ত চোখজোড়া লাল হয়ে আছে। ঘুম হয় নি বলেই কি এমন অনুভূতি? গলার কাছটা তেঁতো লাগছে। সিংহের মুখ থেকে শিকার কেড়ে নিলে তার মনস্থিতি যেমন অসহনীয় এবং ক্ষুদ্ধতাপূর্ণ হয়ে যায় শ্রাবণের অবস্থাও ব্যতিক্রম নয়। জোরে জোরে ল্যাপটপের কি-বোর্ডের ব্যাকস্পেস চাপতে লাগলো সে। মনের জলন্ত্ব অগ্নির রোষের শিকার হলো যেন সেই নির্জীব কি-বাটনটা।
****
আজ প্রকৃতি বেপরোয়া কিশোরের মতো উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠেছে। অনিয়মেই তার তান্ডব শুরু হয়েছে। তীব্র বাতাসে ধুলো মিশে ধুলোঝড়ের সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা শহরের রাস্তার সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য মাথা উচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো মাথা নত করে ফেলেছে অবাধ্য প্রকৃতির জেদে। মনে হচ্ছে কোনো কিশোর ছোকরার থেকে তার খেলনাটা কেড়ে নেওয়া হয়েছে যার ফলে সে জেদ ধরেছে সব তছনছ করে নিবে। পশ্চিম আকাশে সূর্যটা ঢলে পড়তেই এই তান্ডবখেলা। এদিকে বিপাকে পড়লো চারু। ধুম করে বৃষ্টি শুরু হলে সে হয়ে যাবে নিরুপায়। কারণ তার কাছে ছাতা নেই। আজ ভাগ্যক্রমে বিকালের দিকেই জল্লাদের থেকে মুক্তি পেয়েছে। জল্লাদ তার নিজের ব্যক্তিগত কাজের জন্য অফিস থেকে বেরিয়েছে। সব মিটিং, কাজ শিফট করা হয়েছে অন্য দিন। চারুর জন্য অবশ্য ভালো হলো। এখন বাসায় যাবে, লম্বা একটা গোসল দিবে। তারপর বের হবে রুশানের সাথে। গহনা, ব্লাউজ, পেটিকোটের মাপ দিতেও হবে। রুশানের মা খুব পুরানো ধাঁচের মহিলা। তিনি মোটেই আগ্রহী নন হবু বউকে বগলদাবা করে শপিং করতে। এতে অবশ্য চারুর জন্য ভালো হয়েছে। শ্রাবণের ধারালো দৃষ্টিতে ঝাঁঝরা তো হতে হবে না।
বাড়ি আসতে আসতেই মেঘেদের কান্না শুরু হয়ে গেছে। ধরণী ভিজে গেছে তাদের অশ্রুতে। মাটি সুধা গন্ধ নাকে আসছে। মোটামুটি ভিজেই বাসায় ডুকলো চারু। ঘরে ঢুকতেই ধাক্কা খেলো। ঘরের চিত্র বদলে দিয়েছেন মা। পর্দা পালটে দিয়েছেন, সোফায় নতুন কভার চড়িয়েছেন। একটা লাল কার্পেট বেতের সোফার সামনে দেখতে পেলো চারু। ডাইনিং টেবিলে নতুন একটা টেবিল ক্লথ। চারুর বুঝতে বাকি রইলো না, এসবের হেতু কি! মেয়ে বিয়ে দিচ্ছেন। ঘর পরিপাটি হবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু চারুর ব্যাপারটা যেন ভালো লাগলো না। চাপা স্বরে শুধালো,
“এগুলো কি মা? তুমি তো দেখছি আমাদের ঘরকে তাজমহল বানিয়ে দিয়েছো”
“সুন্দর লাগছে না? রুশানের মা দেখলে নিশ্চয়ই চোখ সরাতে পারবেন না। সেদিন একটু মুখ কুচকাচ্ছিলেন। এরপর দিন আসলে উনার চোখ কপালে উঠে যাবে। আমি-ই আসলে বেক্কেল। আমার উচিত ছিলো এগুলো প্রথমেই করা”
“শাক দিয়ে মাছ ঢেকে তো লাভ নেই মা। উনার যদি আমাকে উনার বাড়ির বউ করতে হয়, আমাকে পুরোপুরি দেখেই উনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমার বাবার অবস্থা মেনেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে”
“তুই রেগে যাচ্ছিস কেন?”
“আমি রাগছি না মা”
“আলবত রাগছিস। মা তোর, হাড়ে হাড়ে চিনি তোকে”
চারু ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
“বেশ, আমি রাগছি। কেন রাগবো না মা? তুমি তাই দেখাতে চাইছো যা আমরা নই। আচ্ছা এই টাকা পেলে কোথায়? ঘর দেখে তো মনে হচ্ছে বেশ খরচা করেছো”
চারুর মা মিয়ে গেলেন। চারু এবার কিঞ্চিত রুক্ষ্ণ স্বরে বললো,
“মা, আমি কিন্তু দেনা করে বিয়ের পক্ষপাতী নই”
বলেই পা বাড়ালো নিজের ঘরে। গলা থেকে ওড়নাটা খুলেই ভেজা শরীরে গা এলিয়ে দিলো বিছানায়। খুব ক্লান্ত লাগছে তার। এই ক্লান্তির কারণ সে জানে না। মনের ভেতর এক বিষন্নতা ছেয়ে আছে। সব কেমন মূর্ছিত, বেরং লাগছে। অথচ চারুর এখন হওয়া উচিত পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী তরুনী। তার জীবনের প্রথম পুরুষ যে কি না তার হৃদয়ে ঝড় তুলে, সব কিছু তোলপাড় করে দেয় তীব্র আবেগের ঢেউয়ে, যার বিরহে চারুর জীবনে বিষাদের কালবৈশাখী এসেছিলো— কিছুদিন পর সেই পুরুষ তার একান্ত পুরুষ রুপে জীবনে আসছে; অথচ কেনো যেন কোনো উৎসাহ পাচ্ছে না। সব কিছু নির্জীব লাগছে। অথচ সকালবেলায় যখন ঘুম ভেঙ্গে প্রথম রুশানের মোহময় কণ্ঠ শুনেছিলো, চারুর বুক কেঁপেছিলো। বুকের ভেতরে এক অব্যক্ত শান্তি অনুভব করেছিলো। আপনাআপনি সে হেসেছিলো। অথচ এখন যেন সেই অনুভূতিগুলো উবে গেছে। এতো বছরের বিচ্ছেদের কারণেই কি এমন খাপছাড়া লাগছে সবটা? অফিসে যখন শ্রাবণ শুধিয়েছিলো,
“আপনি কি খুশি?”
চারু তখন উত্তর দিতে পারে নি। কেন যেন হাজারো দ্বিধা গ্রাস করেছিলো মস্তিষ্ক। অথচ এমনটা হবার কথা ছিলো না। আসলেই মানুষ খুব অদ্ভুত। মাঝে মাঝে তীব্র আকাঙ্খার বস্তু পেলেও সেই আনন্দ অনুভূত হয় না যা তারা কল্পনা করে। ফোন বাজছে। রুশান ফোন করেছে। সে হয়তো কয়টায় বের হবে সেটা জানানোর জন্য ফোন করেছে। অথচ চারুর ফোন ধরতে ইচ্ছে হচ্ছে না। তার ঘুম পাচ্ছে। চোখের পাতাগুলো বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে কত কত রাত সে বিনিদ্র ছিলো।
***
রাতের আকাশে মেঘ জমেছে। চাঁদহীন আকাশটা আরোও বেশি কালো লাগছে। বৃষ্টির পর ঝিরিঝির বাতাসে প্রকৃতি শীতল হয়ে আছে। গরমের কোনো লেশ নেই। এমন আবহাওয়া ঘুমের জন্য একেবারে উপযুক্ত। গলা অবধি কম্বল টেনে ঘুমিয়ে থাকা যায়। এ যেন স্বর্গীয় প্রাপ্তি। অথচ চারু সেই সুখের ঘুমের বলি দিয়েছে। ল্যাম্পপোস্টের নিচে একদলা হলুদ আলোর নিচে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রুশান বলেছে দেখা করতে, স্বর্ণের দোকানে আজ না গেলে বিয়ের আগে গহনা কেনা হবে না। প্রায় আঁধা ঘন্টা হয়ে গেছে অথচ রুশানের আসার নাম নেই। ফোন দেবার উপায় নি, কারণ সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। চারুর রাগ হচ্ছে। বাসায় চলে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু ওখানে মায়ের হাজার প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। এর চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভালো। হঠাৎ চারুর সামনে একটা সিএনজি থামলো। রুশান সিএনজি থেকে নামতেই লজ্জিত স্বরে বলল,
“সরি, বসের একটা কাজে আটকে গেছিলাম”
“আজকে বের হওয়ার দরকার ই ছিলো না তাহলে?”
“রাগ করো না প্লিজ”
ভাড়া চুকিয়ে চারুর সম্মুখে দাঁড়িয়ে তার গাল হালকা টিপে বললো,
“ওয়েদারটা কি রোমান্টিক দেখেছো? চলো আজ বরং আমরা রিক্সা করে ঘুরি। তোমার তো খুব পছন্দ”
রুশান কাছে আসতেই তার গা থেকে মেয়েলি পারফিউমের গন্ধ নাকে বিঁধলো চারুর। এই পারফিউমটা সে ব্যবহার করে। ফলে সসংশয়ে শুধালো,
“তুমি কি আজকাল মেয়েদের পারফিউম ব্যবহার করছো?”
রুশান কিঞ্চিত অপ্রস্তুত হলো যেন। আমতা আমতা করে বলল,
“না তো”
“তাহলে তোমার গা থেকে মেয়েদের গন্ধ আসছে কেন?”
রুশান নিশ্চিত হতে গা শুকলো। তার কপালের সমান্তরাল রেখাগুলো সাথে সাথেই কুঞ্চিত হলো। খানিকটা ঝাঁঝের সাথে শুধালো,
“তুমি কি আমাকে সন্দেহ করছো?”
“অদ্ভুত, এটা খুব সাধারণ প্রশ্ন”
রুশান তেঁতো স্বরে বললো,
“শোনো চারু, বিয়ের আগেই এমন সন্দেহ করছো তাহলে বিয়ের পর তো হাতে খুন্তি নিয়ে দৌড়ানি দিবে। যেমনটা ভাবছ তেমন কিছু না। আজকে একটা অফিস পার্টি ছিলো। ইনচার্জ সবাইকে নিয়ে গেছিলেন। এরমধ্যে আমার এক কলিগ ব্যালেন্স না রাখতে পেরে আমার উপর পড়ে গিয়েছিলো। ও অনেক কড়া পারফিউম ব্যবহার করে। তাই হয়তো”
চারু আর প্রশ্ন করলো না। মনের ভেতরের খচখচানিটাকে টাইম প্লিজ করে বললো,
“আমি এমন কিছুই ভাবছিলাম না”
রুশান তার চিবুক ধরে মুখখানা সামান্য উঁচিয়ে বললো,
“আমাদের বিয়ে হতে যাচ্ছে চারু। একটু বিশ্বাস করতে শেখো। রোমান্টিক মুডের তেরোটা কি করে বাজাতে হয় সেই ব্যাপারে তুমি একেবারে পিএইচডি করে ফেলেছো। এখন চলো, জুয়েলার্সের দোকানেই যাই”
****
রুশানের মা, খুঁজে খুঁজে একটা তিন ভরির হার পছন্দ করলেন। চারু সোনার প্রতি আকর্ষণ কম। সোনা দেখলেই পাগলিয়ে যাবার মত মেয়ে সে নয়। কিন্তু হবু শ্বাশুড়ির উপর কথা বলতেও পারছিলো না। বিয়ে যত সাধারণ হয় ততই মঙ্গল। এতে চারুর পরিবারের উপর চাপটা কম পড়ে। রুশান যখন বিল করতে বসলো, তখন দেখা গেলো তার কার্ড কাজ করছে না। কি বিপদ। রুশানের কাছে টাকাও নেই। বলে খুব লজ্জিত স্বরে বললো,
“চারু তুমি কি একটু সাহায্য করতে পারবে?”
“আমার কাছে তো এতো টাকা নেই”
“কিছু কি হবে?”
চারুর কাছে নিজের ডেবিট কার্ড আছে, যাতে ত্রিশ হাজারের মতো টাকা আছে। মাস শেষ হয় নি। চারু খুব নিচু স্বরে বললো,
“এটা আমার মাস চলার টাকা রুশান। মাসের এখনো পনেরো দিন বাকি। এটা দিলে আমার হাতে কিছু থাকবে না”
“আমি তো ধার নিচ্ছি, কালই দিয়ে দিব। মা ভুলে টাকার ব্যাগ রেখে এসেছে। আমার কার্ড কাজ করছে না। তুমি না দিতে চাইলে সমস্যা নেই। আমরা অন্যদিন গয়নার অর্ডার দিয়ে দিব”
চারু একদফা রুশানের মায়ের দিকে তাকালো। তিনি বেজার মুখ করে বসে আছেন। ফলে চারু না করতে পারলো না। অর্ডার দেবার জন্য তাকেই টাকা দিতে হলো। রুশান যদিও বারবার আশ্বস্ত করছিল,
“আমি কালই তোমাকে টাকাটা ফেরত দিব। চিন্তা করো না”
তবুও চারুর চিন্তা কাটলো না। বাবা চাকরি নেই, পেনসনের টাকা আটকে আছে বহুদিন। সব ধার শোধ করেছে চারুর চাকরির জন্য। সংসার চলে তার টাকায়। বিয়ে উপলক্ষে মা মামাদের কাছে নিজের জমিজমা দিয়ে দিয়েছেন, নিজের পুরোনো গহনা বদলিয়ে একটা গলার হার আর কানের দুল গড়িয়েছেন। বাবা ধার করেছেন যেন ছেলের বাড়ির লোকের কাছে মান থাকে। চারু মা-বাবার উৎসাহকে মাটি করতে চায় না। সে ভেবেছিলো আগামী দু-তিন মাসে সব পরিশোধ করে দিবে। কিন্তু এখন তাকে ভাবতে হচ্ছে। বিয়ের কেনাকেটার মধ্যে যে আনন্দ থাকে সেটা কেমন ফিঁকে লাগলো চারুর। গয়নার দোকান থেকে বেরিয়েই বলল,
“রুশান, আমার কাল অফিস আছে। আমি আজ বাসায় যাই। আন্টি আসছি”
বলেই হাটা দিলো সে। একা একাই বাসে উঠে পড়লো। রুশানের অপেক্ষা করলো না।
****
শ্রাবণের কাছে একটি আবেদন জমা দিলো চারু। তিনলাখ টাকার একটি লোন। এতো লোন মাত্র কমাস কাজ করা কর্মচারীকে দেওয়া হয় না। শ্রাবণ তীর্যক দৃষ্টিতে চাইলো চারুর দিকে। চারুর হাত কচলাচ্ছে। একটু পর পর ঠোঁট ভেজাচ্ছে। শ্রাবণ শীতল স্বরে শুধালো,
“এতো টাকা কেন? ঋণ করে বিয়ে করবেন?”
শ্রাবণের প্রশ্নে কটাক্ষভাব অনুভব করলো চারু। বিশ্রী উপহাস গিলে বললো,
“ধরে নিন তাই”
শ্রাবণ আর কিছু বললো না। সাইন করে দিলো। নিরুদ্বেগ স্বরে বললো,
“ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্টে দিয়ে দিন”
শ্রাবণের বক্রোক্তির জন্য প্রস্তুত ছিলো চারু। কিন্তু তেমন কিছু ঘটলো না। শুধু মানুষটি ধীর স্বরে বললো,
“আপনি কিন্তু আমার কাছে দায়বদ্ধ হয়ে গেলেন মিস মেহনাজ”
****
বিকেল এবং সন্ধ্যার সন্ধিক্ষন। আকাশের পশ্চিমকোনে বিক্ষিপ্ত হয়ে রয়েছে লাল রঙ। রক্তিম সূর্য ডোবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। রুশান কোথা থেকে একটি বেগুনি ফুল গুজে দিয়েছে চারুর কানের ফাঁকে। চারু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে ঝিলের শান্ত পানির দিকে। পানিতে লাল আকাশের প্রতিচ্ছবি ভাসছে। ভেজা ঘাসে বসে এক দৃষ্টিতে পানি দেখতে ভালো লাগছে। রুশান আগ্রহ করে বললো,
“কিছু বলছো না কেন?”
“কি বলব?”
“কথা ফুরিয়ে গেছে?”
উত্তর খুঁজে পেলো না চারু। একটা সময় রুশানের সাথে কথার তুবড়ি ছোটাটো। অথচ আজ কথা খুঁজে পাচ্ছে না। রুশান টাকা ফেরত দিয়েছে। তার ব্যাংক একাউন্টের ঝামেলা ছিলো বিধায় সমস্যা হয়েছে। চারু নিজ থেকে কিছু শুনতে চায় নি। রুশান যতটুকু বলেছে সেটুকুই জেনেছে। সে নিজেকে দ্বিধায় জড়াতে চায় না। নতুন সম্পর্ক শুরু করবে এর মাঝে খচখচে ভাব আনতে চায় না। তবুও মন অশান্ত। তাই শান্ত স্বরে শুধালো,
“রুশান একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“কর”
“তুমি আমাকে কেন বিয়ে করছো?”
“কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি”
কথাটা মনোপুত হলো না চারুর। সব কেমন ধোয়াশা লাগছে যেন। রুশানের ফুপা তাদের ঘটকালি করেছেন। তারমানে রুশান এরপূর্বেও অনেক মেয়ে দেখেছে। সে কি জানতো চারুর সাথেই তার বিয়ের কথা হচ্ছে? চারু দ্বিধান্বিত স্বরে শুধালো,
“তুমি জানতে পাত্রী যে আমি?”
“অবশ্যই, আমি তোমার ছবি দেখেই বলেছিলাম বিয়ে করলে ওকেই করবো”
“আন্টিকে কি করে রাজী করালে”
“এসব জানা খুব দরকার?”
“না, কৌতুহল বলতে পারো”
“আচ্ছা বাদ দাও। শুনেছি তোমাদের কোম্পানি এবারের এম.আর কোম্পানির এমিউজমেন্ট পার্কের টেন্ডার পাওয়ার জন্য কোটেশন দিচ্ছেন। কত কোটেশন দিলে?”
“এটা কোম্পানির গোপন তথ্য। তোমাকে বলবো কেন?”
“বাড়ে একই ধরণের কোম্পানিতে চাকরি করি। বললে কি ক্ষতি? আচ্ছা যাও বলো না। আমি বলছি”
রুশান অবাক হয়ে শুধালো,
“ও মা, তুমি আমার হবু বউ। তোমার অধিকার আছে শোনার”
“আমি তাও শুনতে চাইছি না। এটা আমাদের কাজের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা হবে”
রুশান হার মেনে নিলো। মৃদু হেসে বললো,
“আচ্ছা, সরি। আর হবে না। আমার বউ যে এতো সৎ আমি জানতাম না”
“এমনি এমনি কি আমি শ্রাবণ তালুকদারের সেক্রেটারি”
“মাথায় রাখলাম। চলো ফুসকা খাবে?”
“না খেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি বরং আমাকে আইসক্রিম কিনে দাও”
“যথাআজ্ঞা”
*****
দিনটা সকাল থেকে রুক্ষ। কড়া রোদে খা খা করছে পৃথিবী। সেই সাথে অফিসেও খুব টেনশন। শ্রাবণের মেজাজ সপ্তম আসমানে। এতো কষ্ট করে পাওয়া টেন্ডার হাত ছাড়া হয়ে গেছে। সবচেয়ে কম কোটেশন দেবার পরও টেন্ডারটা অন্য কোম্পানির কাছে চলে গেছে। ব্যাপারটি দুঃখজনক। কিন্তু শ্রাবণের জীবনে ব্যর্থতা শব্দটি নেই। একারণেই তার মন মেজাজ তেঁতে আছে। চারু জল্লাদকে শান্ত করতে কাজে কোনো ভুলের অবকাশ রাখছে না। সঠিক সময়ে তার কেবিনে কফিও পৌছিয়ে দিয়েছে। জল্লাদ অমানুষের মতো একের পর এক মিটিং করছে। প্রতিটা স্টাফ আতংকিত। হেন ডিপার্টমেন্ট নেই যে তার কবলে পরে নি। ইতিমধ্যে বিকাল হয়ে গেছে। দুপুরের খাবার খাওয়ার সুযোগ হয় নি চারুর। ক্ষিদেতে পেট জ্বলছে। ফলে জল্লাদের রুমের কাচের দরজায় মৃদু টোকা দিলো সে, শ্রাবণ তখন কাজ করছিলো। মাথা তুলে চাইতেই চারু শুকনো গলায় শুধালো,
“আসবো স্যার?”
“আমি ই আপনাকে ডাকতাম মিস মেহেনাজ। আসুন”
শ্রাবণের কথায় রোষের রেশ। চারু দুরুদুর মন নিয়ে প্রবেশ করলো। স্মিত স্বরে বললো,
“কোনো দরকার?”
“আপনার তো বিয়ে তাই না? বিয়ের জন্য কি টাকার অনেক প্রয়োজন?”
“বুঝলাম না স্যার”
“আমাদের রাইভাল কোম্পানির কোটেশন ফাঁস করার জন্য আপনাকে কত টাকা দিয়েছে মিস মেহেনাজ?”……
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি