চারুলতা তোমার জন্য পর্ব-১১

0
17

#চারুলতা_তোমার_জন্য
#১১তম_পর্ব

চারু স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। মায়ের এমন অপরিচিত রুপ এই প্রথম দেখছে চারু। তার মতে মা বোকা ধরণের মহিলা। সব সহ্য করে সংসারের জন্য হাসা তার একমাত্র কাজ। কঠিন থেকে কঠিন সময়েও মাকে মুখ বুজে সবটা সহ্য করতে দেখেছে সে। কখনো চারুর বাবার উপর উচ্চবাচ্য করতে দেখে নি চারু। মামাদের কাছ থেকে প্রতারিত হবার পরও তিনি ছিলেন শান্ত। তার মাঝে কোনো প্রকার প্রতিবাদ করার সাহস বা ইচ্ছে পরিলক্ষিত হয় নি। চারুর গায়ে কখনো হাত উঠান নি তিনি। তিনি শাসন করতে পারেন না। অথচ আজ তার অগ্নিমূর্তি চারুকে বিমূঢ় করে উঠলো। অস্পষ্ট স্বরে বললো,
“তুমি আমাকে মারলে মা?”
“তুমি এমন কোনো কাজ করো নি যে তোমাকে মাথায় তুলে নাচবো”
“আমি মার খাবার মতো কোনো কাজ করি নি মা”

চারুর দৃঢ় কণ্ঠে মার রাগ যেন বেড়ে গেলো। তিনি হিংস্র গলায় বলে উঠলেন,
“রাতে একটা পুরুষের সাথে ফষ্টিনষ্টি করার সময় খেয়াল ছিলো না তোমার? এখন বড় গলায় কথা বলছো? তোমার উগ্রতা দেখে আমি তাজ্জব বনে যাচ্ছি”
“কি বাজে কথা বলছো তুমি? মাথা ঠিক আছে তোমার?”
“এই খবরদার গলা উচু করবি না। একদম গলা টিপে মেরে ফেলবো। চিনিস তুই মানুষকে। এতোদিন যখন মানুষ আমাকে বলতো তোমার মেয়ে ব্যা*শ্যামি করে আমি বিশ্বাস করতাম না। আজ নিজের চোখে দেখছি। ছিঃ ছিঃ এই মেয়েকে পেটে ধরলাম কি করে? আজ থেকে তুমি আমাকে মা বলে ডাকবি না। আমি মনে করবো আমার মেয়ে মরে গেছে”

মায়ের মুখে এমন অকথ্য ভাষা শুনতে কান ঝাঁঝাঁ করতে লাগলো চারুর। কাটা স্থানে কেউ যেন বেরহমের মতো মরিচ বাঁটা ঢলে দিয়েছে। এতোটা বিশ্রী যন্ত্রণা কখনো হয় নি চারুর। মার চোখ লাল হয়ে আছে। তাকে ভয়ংকর দেখাচ্ছে। চারু নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। কাঁন্না মিশ্রিত স্বরে বললো,
“মা গো, আমি কি করেছি? আমার সাথে এতোটা কঠিন কেন হচ্ছো তুমি?”

চারুর মা নিজের চোখ মুখ কুচকে ফেললেন। কিছু একটা খুঁজলেন, হাতড়ালেন উন্মাদের মত। বাড়ির বাকি মানুষ দর্শক। তাদের মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না। চারুর বাবা এক স্থানে পাথরের মত বসে আছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, বাঁচার ইচ্ছে যেন হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি, সেই দৃষ্টিতে কোনো আশার কিরণ নেই। চারুর মা অবশেষে নিজের ফোনটা খুঁজে পেলেন। একটা ছবি বের করে চারুকে দেখিয়ে বললেন,
“নিজের চোখে দেখ তুই কি করেছিস! তোর জন্য মানুষ আমাকে কি বলে জানিস? মেয়ের শরীর বেঁচা টাকা আমরা খাই”

চারু তাকিয়ে রইলো ছবিটার দিকে। শ্রাবণকে সে জরিয়ে ধরে রেখেছে। ছবিটা কিছুক্ষণ পূর্বের তোলা। দৃশ্যটা দেখে যতটা ঘনিষ্ঠতা প্রকাশ পাচ্ছে এমন ততটা ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত ছিলো। মুহূর্তটা ছিল সমবেদনার। শ্রাবণ তাকে কেবল মানুষ হবার দরুন সান্ত্বনা দিচ্ছিলো। তাদের মধ্যকার সম্পর্ক মোটেই এমন নয়। চারু অসহায় স্বরে বললো,
“মা আমাকে ভুল ভাবছো তুমি?”
“খবরদার আমাকে মা ডাকবি না। রুশানের মা বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছে। শুধু ভাঙ্গে নি, সাথে এমন এমন কথা শুনিয়েছেন”

চারুর মা থেমে গেলেন। তার চোখ লাল হয়ে আছে। বুকের ভেতর অসম্ভব ব্যথা করছে। ঘন্টাখানেক আগেও সব স্বপ্নের মত ছিলো। মেয়ের বিয়ের উৎসাহে তার মন গদগদ ছিলো। এতোটা আনন্দিত ইহজীবনে কখনো তিনি হয়েছেন কি না সন্দেহ। রান্নাবান্না করছেন নিজ হাতে। আগামীকাল মেয়ের হলুদ। হলুদের ব্যবস্থাপনায় কোনো ত্রুটি তিনি রাখবেন না। বিয়ের পর যেন মেয়েকে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা কোনো খোটা না দিতে পারে তাই বরের জিনিসপত্র কেনার সময় কোনো কার্পন্য করেন নি। দশহাজার টাকা দিয়ে একটি স্যুট পিস কিনেছেন। ঘড়ি কিনেছেন দাম দিয়ে। এছাড়া একটা সোনার আংটিও কিনেছেন। আংটিটা বিয়ের সময় পড়িয়ে দিবেন নিজের হাতে। এখন স্বর্ণের যে দাম। তবুও কোনো কার্পন্য করেন নি। বিয়ের খরচটা চারুদের আয়ত্তের বাহিরে চলে গিয়েছে। তবুও কোনো আফসোস নেই চারুর মার। একমাত্র মেয়ে বলে কথা।

রান্না শেষে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন তিনি। চারু বাসায় আসে নি এখনো। বিয়েশাদীর ব্যাপার, এতো রাত বাহিরে থাকলে কথায় কথা বাড়বে। চারুর নামে তো কম কথা হয় না। তিনি ঠিক করলেন মেয়ে আসলে তাকে বলবেন বিয়ের আগ পর্যন্ত যেন অফিস না যায়। নজর-টজরের ব্যাপার আছে। ছেলেমানুষ রাত বিরাতে ঘরে আসলেও কথা উঠে না। অথচ মেয়েমানুষ দেরি করলেই নানা কথা উঠে। মেয়েদের চরিত্র নিয়ে কথা বলতে মানুষের এক সেকেন্ড সময় লাগে না। সমাজের সবচেয়ে ঠুংকো বিষয় নারীর চরিত্র এবং শরীর। এই তুচ্ছ শরীরটার জন্যই যত ফাঁসাদ। ধর্ষকের থেকে ধর্ষিতার লাঞ্চনা এই সমাজে বেশি হয়। ধর্ষককে তার মহাপাপের জন্য দায়ী করে না কেউ, করে নারীর চালচলনকে, তার শিক্ষাকে, তার উচ্চাকাঙ্খাকে। এটাই সমাজের কুৎসিত রুপ। চিন্তার ঘোর কাটলো পোড়া গন্ধে। ঝোল লেগে এসেছে তরকারিতে। চারুর মা দ্রুত হাতে চুলার আঁচ কমালেন, পানি দিলেন। তখন-ই তার ফোন বেঁজে উঠলো। “রুশানের আম্মা” নামটি দেখতেই চারুর মার মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে গেলো। তিনি ফোনটি কানে দিয়ে আনুগত্যের স্বরে বললেন,
“আসসালামু আলাইকুম আপা, কেমন আছেন?”
“আপনারা ভালো থাকতে দিলে তো?”

মহিলার ত্যাড়া কথার আগা-মাথা বুঝতে পারলেন না চারুর মা। খানিকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন। তবুও নরম স্বরে বললেন,
“কি হয়েছে আপা?”
“আর কি হবে আপা, আপনার মেয়েকে ঘরের বউ করছি। এটাই কি অনেক না? ছেলের কথাটা শোনাটাই আমার কাল হলো বুঝলেন তো। মানুষ বলে বিয়ের আগে দেখেশুনে আগাতে হয়। আমার ভুল, আমার বোঝা উচিত ছিলো। শুধু শুধু নিশ্চয়ই এতো বড় কোম্পানিতে চাকরি করবে না। আজ সেই ভ্রান্ত ধারণা ভেঙ্গে গেছে। শুনুন আপা, আমাদের একটা সম্মান আছে। সমাজে থাকি। ছেলেকে ভালোবাসি, তাই একটা নোংরা মেয়েকে তার জীবনে আনতে পারি না। এই বিয়ে হবে না। আমাদের দেওয়া গয়না, আংটি ফেরত দিবেন”

রুশানের আম্মার ঝাঁঝালো স্বর শুনতেই চারুর মা থ মেরে গেলেন। তার মাথা কাজ করছে না। বিয়ে ভেঙ্গে গেলো মেয়ের? উপর থেকে তার এতো সুন্দর মেয়েকে নোংরা বলছে মহিলা? শান্ত স্বভাবের চারুর মা ক্ষিপ্ত স্বরে বললেন,
“বিয়ে ভেঙ্গে দিচ্ছেন মানে? আর আমার মেয়েকে কোন সাহসে নোংরা বলছেন শুনি? দেখুন আপা, আমি ভালো মানুষ তাই কিছু বলছি না। কিন্তু আর একটা শব্দ বললে বাসায় এসে আপনার চুল ছিড়ে ফেলবো”
“চুল ছিড়বেন তাই না? চোরের মায়ের দেখছি বড় গলা! আপনার মেয়ে কি এখনো বাসায় ফিরেছে? কাল তো গায়ে হলুদ? কোথায় সে?”
“অফিসে”
“অফিসে? হ্যা অফিসেই বটে। বসের সাথে সময় কাটাচ্ছে। ভালো মানুষ তাই নোংরা কথা মুখে আসে না আমার। তবে বলতে বাধ্য হচ্ছি আপনাদের লজ্জা শরম নেই। তাই দেহবিক্রির টাকা খেতে পারেন। শুনে রাখুন, আমাদের পরিবার ভদ্র পরিবার। এসব নোংরা মেয়েদের মুখে থুথু দেই আমরা। বুঝলেন”
“আপনার কাছে কোনো প্রমাণ আছে? এসব নোংরা কথা কিসের ভিত্তিতে বলছেন?”
“প্রমাণ লাগবে? যদি দিতে পারি কি করবেন?”
“নিজের হাতে মেয়ের গলা টিপে মারবো। আর যদি প্রমাণ না থাকে, আপনার জিভ টেনে ছিড়ে ফেলবো”

বলেই ফোন কেটে দিলেন চারুর মা। তার মাথায় আগুণ ধরে গেছে। চারুকে সাথে সাথেই ফোন করলেন তিনি। কিন্তু সে ফোন তুললো না। এরমধ্যেই তার হোয়াটস এপে একটি ম্যাসেজ এলো। ম্যাসেজ খুলতেই ধপ করে বসে পড়লেন। মাথা ঘুরছে। বুকের উপর কেউ যেন একটা পাথর রেখে দিয়েছে। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে চারুর। নিজের মেয়ের এমন ছবি দেখবেন এতো একটা দুঃস্বপ্ন।

*****

চারুর মা পাথর মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। চারু নির্বাক। কি বলবে বুঝতে পারছে না। এর মধ্যেই কঠিন স্বর কানে এলো,
“তুই বেড়িয়ে যা। আমি তোর মুখ দেখতে চাই না। এ বাড়িতে থাকলে আমি তোকে খুন করে ফেলবো”
“মা, তুমি যা ভাবছো তা কিছুই সত্য না। এসব মিথ্যা মা। রুশান আমাকে ঠকিয়েছে। কাউকে শাস্তি দিতে হলে রুশানকে দেওয়া উচিত। আর ওরা কি বিয়ে ভাঙ্গবে। বিয়ে তো আমি ভেঙ্গেছি। আমি মরে গেলেও ওকে বিয়ে করবো না। তুমি তো মা, একটু আমার কথা শুনো মা। আমি কিচ্ছু করি নি মা। আমার কোনো ভুল নেই”

চারু তাকে ছুঁতে গেলেই চারুর মা আবার হিংস্র হয়ে গেলেন। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন চারুকে। চারু টাল সামলাতে পারলো না। পায়ের নিয়ন্ত্রণ হারালো। তাকে সাথে সাথেই সামলে নিলো শ্রাবণ। এতোটা সময় সে নির্বাক শ্রোতার মত সবটা দেখেছে। খুব কষ্টে নিজেকে আটকে রেখেছে। মা-মেয়ের মধ্যে সে প্রবেশ করতে চায় নি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অনিয়ন্ত্রিত। চারু নিজেকে সামলালো। সে এবার কাতর স্বরে অনুনয় করলো,
“আমি কোথায় যাব মা? আমার কি যাওয়ার জায়গা আছে?”
“কেনো? যে নাগর বাঁধিয়েছো তার কাছে যাও। শুনতে খারাপ লাগছে? লাগার তো কথা। তোমার নষ্টামি করতে খারাপ লাগে নি তাহলে শুনতেও খারাপ লাগবে না। দাঁড়িয়ে আছে তো। তার সাথে যাও”
“স্যারের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই মা”
“তাই নাকি? ও হ্যা, এনারা ভোগ করতে পারে, সম্মান দিতে পারে না। দোষ আমার, আমি ভেবেছি আমার মেয়ে বড় কোম্পানিতে চাকরি করে, পরিশ্রম করে। কিন্তু আমার মেয়ে যে…… ছিঃ ছিঃ। তুমি এখনি বেরিয়ে যাবে। নয়তো আমি গলায় দড়ি দিব”
“মা”
“ভেবো না আমি ভয় দেখাচ্ছি”

স্পষ্ট স্বর চারুর মার। গলা কাঁপছে না। শুধু একটু পর পর হাফাচ্ছেন। তরতর করে ঘামছেন। চারুর অসহায় দৃষ্টিতে দেখছে মার দিকে। বুকটা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। মৃত্যু যন্ত্রণাও কি এমন?
“আমি যদি মিস মেহেনাজকে বিয়ে করি, আপনার রাগ কমে যাবে?”

এতো সময় পর মুখ খুললো শ্রাবণ। চারুর মা চোখ তুলে চাইলেন। তার চোখ লাল হয়ে আছে। উভ্রান্ত দৃষ্টি। চারু বিমূঢ় চোখে চাইলো শ্রাবণের দিকে। মস্তিষ্ক কাজ করছে না। শ্রাবণ স্বাভাবিক গলায় বললো,
“আমি এই মুহূর্তে মিস মেহেনাজকে বিয়ে করলে আপনি শান্তি পাবেন? আমার কোনো সমস্যা নেই মিস মেহেনাজকে বিয়ে করতে। এমনটা ভাববেন না যে, আমি দোষ ঢাকতে এমনটা করছি। একদম না। আমার এবং মিস মেহেনাজের মাঝে বস এবং সেক্রেটারির সম্পর্ক ছাড়া কোনো সম্পর্ক নেই। তবে যা হয়েছে সেটা আমার জন্য হচ্ছে। তাই এটা দায়ভার। যদি মিস মেহেনাজকে বিয়ে করলে তিনি কলঙ্কমুক্ত হন। আই উড হ্যাপিলি ম্যারি হার”

চারুর মা কিছুক্ষণ মৌন রইলেন। থমথমে হয়ে গেলো ঘরের অবস্থা। সবার মধ্যে কৌতুহল। মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে তারা। মৌনতা ভেঙ্গে চারুর মা শুধু এতোটুকু বললেন,
“এ রাতে কাজি কোথায় পাব?”

চারু কিছু বলার সুযোগ পেলো না। তার পূর্বেই শ্রাবণ কাউকে ফোন করে বললো,
“এখনই একটা কাজি নিয়ে আমার পাঠানো এড্রেসে আসো”

ওপাশের মানুষটি ঠিক কি বললো শোনা গেলো না। শুধু শ্রাবণের কঠিন স্বর কানে এলো,
“আমি বিয়ে করবো। আমি তোমাকে ত্রিশ মিনিট সময় দিচ্ছি। কুইক”

সত্যি সত্যি আঁধা ঘন্টার মধ্যে একটি কালো শার্ট পরিহিত যুবক স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরা কাজি সাহেবকে নিয়ে হাজির হলো। চারুর মনে হচ্ছে সে খুব বাজে কোনো স্বপ্ন দেখছে। চোখ মেললেই স্বপ্ন ভেঙ্গে যাবে আর সে তার স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসবে। যেখানে কেউ তাকে ব্যবহার করে নি, কেউ তাকে প্রতারিত করে নি, কেউ তাকে কলঙ্কিত করে নি। এসব কেবলই তার একটা দুঃস্বপ্ন। এমনটা কিছুই হল না। সত্যি সত্যি রাত একটার সময় তার বিয়ে হয়ে গেলো। শ্রাবণ তালুকদার, যাকে জল্লাদ বলতো সেই মানুষটি হয়ে গেলো তার স্বামী। স্বাক্ষর হলো কাবিননামায়। সব কিছু যেন একটা ঘোর।

বিয়ের পর পর শ্রাবণ কঠিন স্বরে বললো,
“আজ থেকে মিস মেহেনাজ, শ্রাবণ তালুকদারের স্ত্রী। আমার স্ত্রীর অসম্মান যেখানে হয়েছে সেখানে এক মুহূর্ত আমি তাকে রাখবো না। মিস মেহেনাজ কখনো এই বাসায় আসবে না। আপনাদের তাকে দেখতে ইচ্ছে হলে আমার বাসায় আসবেন”

চারু অবাক নয়নে শ্রাবণকে দেখছে। শ্রাবণের মুখশ্রী প্রচন্ড গম্ভীর। তার গলার শিরা ফুলে আছে। তাকে খুব রাগান্বিত লাগছে। অথচ দৃষ্টি শীতল। শ্রাবণ কিছু খেলো না। কাজী চলে যেতেই সে বেরিয়ে পড়লো। চারুও তার পিছু পিছু বেরিয়ে গেলো। সে একটা ঘোরের মধ্যে আছে। যন্ত্রমানবের মতো সে শ্রাবণের সাথে গাড়িতে উঠল। শ্রাবণ চারুর সিট বেল্ট লাগিয়ে দিলো। তাদের চোখাচোখি হল বটে। কিন্তু কথা হল না।

***

আধ ঘন্টার মধ্যে শ্রাবণের সেই গাছ ঘেরা বসুন্ধরার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো গাড়ি। দারোয়ান গেট খুলে দিল। শ্রাবণ গাড়ি পার্ক করলো গ্যারেজে। তারপর গাড়ি থেকে বের হলো। চারু এখনো গাড়িতে বসা। শ্রাবণ তার দরজাটা খুলে দিতেই চারু শূন্য দৃষ্টিতে তার দিকে চাইলো। তাকে বিভ্রান্ত লাগছে। যেন তার বোধবুদ্ধিগুলো শূণ্য হয়ে গেছে। চিন্তা চেতনা লোপ পেয়েছে। শ্রাবণ স্বাভাবিক স্বরে বললো,
“গাড়িতেই থাকবেন?”

চারু বুঝতে পারল তাকে বের হতে হবে। সে গাড়ি থেকে বের হলো। নীরব নিস্তব্ধ পরিবেশ। জনশূণ্য এই বাড়িতে আগেও একবার এসেছে। মুগ্ধ হয়েছে তখন এই বিশাল বাড়ির নির্জনতায়। আজ অনুভূতিটা বিচিত্র। সে এখন এই বাড়িতেই থাকবে। কিন্তু কতদিন? কত মাস? শ্রাবণের সাথে বিয়েটার অস্তিত্ব কি? চারু পা ভারী হয়ে গেলো। চলতে চাইছে না। এলোমেলো হয়ে গেলো পদচিহ্ন। শ্রাবণ তার সামনে। সে বাড়ির মেইন গেটের কাছে চলে গেছে। চারু ক্লান্ত পায়ে হাটছে। হঠাৎ শ্রাবণ বলে উঠলো,
“ডু ইউ নিড এনি হেল্প মিসেস তালুকদার?”

“মিসেস তালুকদার”? কথাটা মাথায় আন্দোলিত হলো। বিমূঢ় চাইলো চারু। তার হতভম্ব দৃষ্টিকে কলাগাছ দেখিয়ে এগিয়ে এলো শ্রাবণ। মুহূর্তের মধ্যেই চারুকে কোলে তুলে নিলো সে। হনহন করে ঘরে প্রবেশ করলো। জনমানবহীন ঘর। এই ঘরেই থাকবে তারা? শ্রাবণ ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
“ফ্রম নাউ, ইটস আওয়ার হোম। ইউর হোম, মিসেস তালুকদার”

চারু এখনো তার দিকে নির্বাক তাকিয়ে আছে। আজ থেকে সত্যি সত্যিই কি মিসেস শ্রাবণ তালুকদার হয়ে গেছে? শ্রাবণের চারু? শ্রাবণের চারুলতা?………

চলবে