#চারুলতা_তোমার_জন্য
#১২তম_পর্ব
শ্রাবণের বিছানায় জবুথুবু হয়ে বসে আছে চারু। তার বিভ্রান্ত দৃষ্টি মাটির দিকে নিবদ্ধ। শ্রাবণ তাকে কোলে করে এনে এই বিছানাতেই বসিয়েছে। টাইটা ঢিলে করতে করতে বললো,
“কি খাবেন বলুন?”
“হু?”
“আজকে কি রোজা রাখার প্লান আছে? আমার যতদূর জানা আপনার পেটে দুপুরের পর থেকে কিছু যায় নি। ভুল বললাম?”
চারু মাথাখানা নত করে দুপাশে আস্তে করে নাড়লো। শ্রাবণ কিছুসময় নির্বাক চোখে তাকে দেখলো। তার সামনে উড়ন্ত ঘাসফড়িং এর মতো চঞ্চল মেয়েটি কেমন পাখা ভেঙ্গে নেঁতিয়ে পড়ে আছে যেন। এই শান্তভাবখানা একেবারেই বেমানান চারু মেয়েটার সাথে। সারাক্ষণ শ্রাবণকে মাত দেওয়ার পরিকল্পনা করা মেয়েটি কেমন যেন মিঁইয়ে গেছে। চোখের উজ্জ্বলতাগুলো উবে এক বিশ্রী বিষন্নতা ঢলে পড়েছে। শ্রাবণ তার কপালের চুলগুলো টেনে পেছনে নিলো। কোটটা খুলে রাখলো। হাতার বোতামগুলো খুলে তার কনুই অবধি গুটালো। হালকা স্বরে বললো,
“নুডুলস চলবে? ইন্সট্যান্ট রামেন?”
চারু মাথা কাত করে “হ্যা” বোঝালো। সত্যিই ক্ষুদা লেগেছে। দুপুরেও সে খায় নি। সকালে কোনোমতে একটি রুটি মুখে গুঁজে বেরিয়েছিলো। এখন কয়টা বাজে জানা নেই চারুর। তবে পেট জানান দিচ্ছে সে কিছু খেতে চায়। এই রাতে মুড়িও চারুর কাছে অমৃত মনে হবে। শ্রাবণ বিশ মিনিট পর ফেরত এলো। বাটিতে নুডুলস। কিন্তু ম্যাগি নুডুলসের মত চিকন নয়, মোটা মোটা। উপরে চিজ দেওয়া। শ্রাবণ বসলো ঠিক তার বিপরীতে। তার হাতে চপস্টিক। চারুর বাটিতে অবশ্য কাটা চামচ দেওয়া। সে খুব স্বাভাবিক স্বরে বললো,
“এটা রামেন। কোরিয়ান একটা ইন্সট্যান্ট নুডুলস। বাসায় এটা ছাড়া কিছু ছিলো না। সাথী খালা আজ রান্না করে যান নি। হোপ আপনি খেতে পারবেন”
চারু চুপচাপ খেতে শুরু করলো। স্বাদটা একেবারে অচেনা। একটু ঝাল, মিষ্টি ধরনের। অন্যসময় হলে হয়তো বলতো,
“এ বাবা, এর থেকে তো আমাদের ম্যাগি নুডুলস ভালো। পানি গরম কর, মশলা দাও, খেয়ে ফেলো”
কিন্তু আজ এমন কিছু বলা হলো না। সে দশমিনিটের মধ্যেই সবটা শেষ করলো। শ্রাবণ এক দফা তা দেখে বললো,
“ওয়ান্ট সাম মোর? আই ডোন্ট মাইন্ড শেয়ারিং”
চারু লজ্জিত মুখে বসে রইলো। তার শুভ্র গালখানা লালচে হয়ে গেলো। তার লজ্জামাখা গালজোড়া চোখে পড়তেই শ্রাবণের দৃষ্টি মোলায়েম হলো। ফিঁচেল হেসে বলল,
“হোয়াটেভার আই হ্যাভ, ইট অলরেডি বিলংস টু ইউ মিসেস তালুকদার”
এবার মৌনতা ভাঙ্গলো চারু। খুব ধীর স্বরে বললো,
“আপনি আজ শুধু শুধু এমনটা করলেন। আমি এখনো বুঝতে পারছি না, আমাকে কেন বিয়ে করলেন আপনি? আমাকে এতো বড় দয়া করার কোনো কারণ আমি দেখছি না। হতেই পারে ঐ সময় আপনি প্রেসার খেয়ে গিয়েছিলেন। আমি জানি না এই দয়ার ঋণ আমি পরিশোধ কি করে করবো? আমাকে সমাজের চোখে স্বীকৃতি দেওয়া, নিজ ঘরে আশ্রয় দেওয়া মুখের কথা নয়। এর প্রয়োজনও ছিলো না। ঝোঁকের মাথায় এমন একটা কাজ আপনাকে চিরটাকাল ভোগাবে।”
“মিসেস তালুকদার!”
হিমেল স্বরে ডাকলো শ্রাবণ। চারু এতোটা সময় নতমস্তক কথা বলছিলো। এবার মাথাখানা তুললো। চোখ রাখলো শ্রাবণের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। শ্রাবণের চোখের দৃষ্টি স্থির, নিশ্চল এবং শীতল। চারু কথা বাড়াতে সাহস করলো না। অন্যদিকে ফিরে বললো,
“আমার ঘরটা দেখিয়ে দিতেন যদি”
“আপনার কি মিনিটে মিনিটে শর্ট টাইম মেমোরি লস হয়? এই মাত্র বললেন আমাদের বিয়ে হয়েছে আবার বলছেন ঘর দেখিয়ে দিতে! আপনি এই ঘরেই থাকবেন মিসেস তালুকদার, এই বেডে, আমার পাশে। ব্যাপারটা মাথায় ঢুকিয়ে নিন। আর আপনি আমার আন্ডারে কত দিন কাজ করছেন?”
“জি?”
“আপনার চাকরির বয়সকাল জানতে চাইছি”
“চার, সাড়ে চার মাস”
“এক্সাক্ট?”
“চার মাস বাইশ দিন”
“আপনার কি আমাকে খুব দয়াবান মনে হয়?”
চারু উত্তর দিল না। বিমূঢ় চোখে তাকিয়ে রইলো শ্রাবণের নির্লিপ্ত মুখশ্রীর দিকে। তাকে খুব দ্বিধান্বিত লাগছে। মনের মধ্যে জমে থাকা প্রশ্নগুলো যেন চিন্তা চেতনা যাতাকলের মত পিষছে। শ্রাবণ এগিয়ে এলো। চারুর চিবুকে আঙ্গুল ঠেকিয়ে মুখখানা উঁচু করলো। চারুর ভ্রান্ত মুখখানার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে সে গাঢ় স্বরে বললো,
“মিসেস তালুকদার, এস মাই পার্সোনাল সেক্রেটারি ইউ শ্যুড নো শ্রাবণ তালুকদার ঝোঁকের মাথায় কোনো সিদ্ধান্ত নেয় না। আমি খুব দয়াবান মানুষও নই। সুতরাং আপনাকে আমি ঝোঁকের মাথায় বিয়ে করি নি, দয়া দেখাতে বিয়ে করি নি আবার প্রেসার খেয়েও বিয়ে করি নি। ইন এডিশন নিজের নাম কামাতেও বিয়ে করি নি”
“তাহলে কেন বিয়ে করেছেন?”
শ্রাবণ দূর্বোধ্য হাসলো। এ হাসি বুঝার ক্ষমতা নেই চারুর। সে ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে রয়েছে। শ্রাবণ হাসি অক্ষত রেখে আরেকটু ঝুঁকলো চারুর দিকে। তাদের চোখ একে অপরের মধ্যে নিবদ্ধ। কণ্ঠ খাঁদে নামলো। চারুর কানের কাছে পুরুষালী ঠোঁট এনে খুব ধীরে বললো,
“কারণটা না হয় আপনি ই খুঁজে নিন”
চারুর বিমূঢ় দৃষ্টি উদ্ভ্রান্তের মত চাইলো। শ্রাবণ তার চুলগুলো হাত দিয়ে গুছাতে গুছাতে বললো,
“এখন থেকে আপনি আমার স্ত্রী। অধিকার, সত্তা সব আমি আপনার কোলে অর্পণ করলাম। বিনিময়ে পুরোদস্তর আপনাকে নিজের করে নিলাম। আমি বলছি না আপনাকে আজকে থেকে আমার স্ত্রী হয়ে যেতে হবে। বিয়েটা যেহেতু স্বাভাবিক ভাবে হয় নি, সুতরাং আমি আপনাকে জোর করবো না। আপনি সময় নিন মিসেস তালুকদার, তবে.. তবে মনে রাখবেন শেষ উত্তরটি যেন পজেটিভ হয়। “না” শব্দটি আমার পছন্দ নয়। শুধু তাই নয়, ডিভোর্স নামক শব্দটিও আমার নিতান্ত অপছন্দ। আমি মুখে মুখে বিয়ে করার পক্ষপাতী নই। সুতরাং আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আপনাকে আমারই থাকতে হবে, ওকে মিসেস তালুকদার?”
“আমি তো আপনার স্ট্যাটাসের সাথে যাই না। আপনার পরিবারের মানুষ কেউ বিরোধিতা করলে?”
“আমার কেউ নেই মিসেস তালুকদার। ইউ নো দ্যাট!”
শ্রাবণের মুখের দিকে নির্বাক চেয়ে রইলো চারু। শ্রাবণের পরিবারের গল্পটা সে বিস্তারিত না জানলেও কিছুটা হলেও জানে। কথাগুলো শুনেছিলো এইচ.আর হেড তাহমিন ভাইয়ের কাছে। শ্রাবণের বাসায় যেদিন প্রথম চারু এসেছিলো সেদিনই তার মনে কৌতুহল জন্মেছিলো। কথায় কথায় একদিন তাহমিন ভাইকে বলেই বসলো,
“আচ্ছা, স্যার একা থাকেন কেন? এতো বড় বাড়ি! ভয় টয় করে না?”
“স্যার বরাবরই একা থাকে চারু”
“বরাবরই?”
“হ্যা। স্যারের জন্মের পর পরই তার মা মারা যান। স্যারের বাবা নতুন বিয়ে করেন। তখন তার আশ্রয় হয় নানাবাড়ি। সেখানেও খুব আদর যত্ন জুটে নি তার। স্যার যখন আঠারো বছর তিনি নানাবাড়ি ছেড়ে দেন। বসুন্ধরার বাড়িটা তার মায়ের নামে। এই কোম্পানিটাও তার মায়ের নামে ছিলো। যদিও মামারা খুব ঝামেলা করেছিলো। কিন্তু স্যার তাদেরকে ছেড়ে কথা বলেন নি। অবশ্য তার নানা তাকে সাহায্য করেছেন। স্যারের আপন বলতে তিনিই ছিলেন। দুবছর হয়েছে তিনি মারা গেছেন”
“আর স্যারের বাবা?”
“স্যার তার সাথে যোগাযোগ রাখেন নি কখনো”
চারুর সেদিন শ্রাবণের জন্য খুব মায়া হয়েছিলো। একটা মানুষ এতোগুলো বছর একা একা থেকেছে। এই বিশাল পৃথিবীতে তার আপন বলতে কেউ নেই। কথাগুলো পুনরায় স্মরণ হতেই মিইয়ে গেলো সে। শ্রাবণ তার বিষাদমাখা মুখখানা নিজের হাতের আদলে নিয়ে বললো,
“ডোন্ট ওভারথিংক। শাওয়ার নিন। আপনার ঘুম দরকার”
“এগুলো?”
“আপনার হাসবেন্ড আছে”
বলেই হাসলো শ্রাবণ। এতটা সুন্দর করে জল্লাদ হাসতে পারে চারুর জানা ছিলো না। সে মন্ত্রমুগ্ধের মত দেখতে থাকলো শ্রাবণকে। চুলগুলো আবার বিশৃঙ্খল হয়ে চোখের উপর পড়ে আছে। ঢিলে কালো টাইটা এখনো ঝুলছে গলায়, ওয়েস্ট কোট খুলে নি সে। কনুইয়ের পশমগুলো ঘামে চ্যাটচ্যাটে হয়ে আছে। অহেতুক আজ তার জন্য মানুষটাকে কতকিছু সহ্য করতে হয়েছে। প্রথমে রুশানের সাথে মারপিট করেছে, তাকে সান্ত্বনা দিয়েছে, মায়ের অপমান সহ্য করেছে। হঠাৎ কিছু মনে পড়লো চারুর। মিনমিনিয়ে বললো,
“রুশান কি বেঁচে আছে?”
কথাটা শুনতেই শ্রাবণের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। কঠিন চোখে তাকালো সে চারুর দিকে। হিমেল স্বরে শুধালো,
“এতো কিছুর পর ওই বাস্টার্ডের কথা জানার ইচ্ছে আছে?”
“না, আসলে ওর কিছু হলে আপনি ঝামেলায় পড়বেন”
“মিসেস তালুকদার, আপনি কি আমাকে নিয়ে চিন্তিত?”
চারু চট করে উত্তর দিতে পারলো না। তবে একটু হলেও চিন্তা হচ্ছে। শ্রাবণ মৃদু স্বরে বললো,
“বলেছি তো ডোন্ট ওভারথিংক। আপনার হাসবেন্ড সব সামলে নিবে”
“শুনুন”
“আবার কি?”
“আসলে আমি তো কোনো লাগেজ আনি নি। শাওয়ারের পর কি পড়বো?”
কথাটা বলতে বলতেই দলা পাকাচ্ছিলো শব্দগুলো। শ্রাবণের তখন স্মরণ হলো সে এতটা দ্রুত এসেছে যে চারুর ব্যাগ গুছানোর সময়টাও দেয় নি। কিছু একটা ভেবে নিজের আলমারী থেকে একটা বিশাল টিশার্ট আর থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট বের করে চারুর হাতে দিয়ে বললো,
“আজকের জন্য এগুলো পড়ুন। কালকে সকালে আমি ম্যানেজ করে দিব”
“আপনার ঘরে কোনো মেয়েদের পোশাক নেই?”
“অদ্ভুত নারী তো আপনি! আপনি চান আমার ঘরে নারীর পোশাক থাকুক?”
“না আসলে……”
“আমি সভ্যতামি করেও আপনার কাছে এত অসভ্য হয়েছি, যখন সত্যি সত্যি অসভ্যতামি করবো তখন না জানি কি ভাববেন?”
শ্রাবণের গাঢ় স্বর হৃদয়ে বিচিত্র অনুভূতির জোয়ার তুললো যেন। শিরদাঁড়া বেয়ে উষ্ণস্রোত বয়ে গেলো যেন। লজ্জায় গাল লাল হয়ে গেলো চারুর। তাকাতেও পারছে না সে। রাগী, জল্লাদ মানুষটি এতোটা বেপরোয়া, বেলেহাজ হতে পারে জানা ছিলো না চারুর। শ্রাবণ হেসে বললো,
“শাওয়ার নিয়ে নিন। আমি যদি এসে দেখি আপনি এখানে বসে আছেন তাহলে আপনাকে কোলে করে নিয়ে আমি শাওয়ারে ঢুকবো। এজ হাসবেন্ড ওয়াইফ আজ আমাদের বিশেষ রাত”
চারু এক মুহূর্ত বসলো না। একরকম ছুটে যেন বাথরুমে চলে গেলো। শ্রাবণের ঠোঁটের হাসি বিস্তৃত হলো। বাটি ধুয়ে এসে দেখলো চারু শুয়ে পড়েছে। গলা অবধি কম্ফোর্টার টেনে চোখ বুজে বিছানায় এক কোনায় হাত পা গুটিয়ে শুয়ে আছে। চুলগুলো এখনো ভেজা। মেয়েটা এতো খামখেয়ালী করে! শ্রাবণ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সাদা টাওয়ালটা দিয়ে মুছে দিলো চুলগুলো। সে জানে চারু মোটেই ঘুমায় নি। সে ঘুমের ভান ধরে আছে। সে এই ভান ধরেছে যেন শ্রাবণের মুখোমুখি না হতে হয়। শ্রাবণও ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। সবটা সুদে আসলে বুঝে নিবে।
কিছুক্ষণ বাদে শ্রাবণ গোসল করে এলো। পরণে কেবলমাত্র একটা কালো ট্রাউজার। মাথা মুছতে মুছতে তাকালো চারুর দিকে। চারু সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে গেছে। এলোমেলো চুলগুলো মুখের উপর পড়ে আছে। কম্ফোর্টার সরে গেছে গা থেকে। হাত পা ছড়িয়ে আছে। শ্রাবণের টি-শার্ট তার ছোট দেহের তুলনায় অনেক বড় হয়ে গেছে। ফলে কাঁধ থেকে হাতা ঢলে পড়েছে। উন্মুক্ত হয়ে আছে কাঁধ, গলার নিচের অংশটা। শ্রাবণ যেন চোখ সরাতে পারলো না। তার হৃদস্পন্দন তীব্র হয়ে গেলো। তার ভেতরকার পুরুষটা হিংস্র হবার জন্য প্রস্তুত। শিরা উপশিরার রক্তপ্রবাহ কি বেড়ে গেলো। নিঃশ্বাস ঘন হলো। সাথে সাথেই চোখ বুজে নিলো শ্রাবণ। নিজেকে নিজেই বললো,
“কন্ট্রোল, কন্ট্রোল। আরেকটু ধৈর্য্য ধর। আরেকটু। সে তোমারই, শুধু তোমার। চারুলতা তোমাকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। বিশ্বাস ভেঙ্গো না”
শ্রাবণ এসির তাপমাত্রাটা কমিয়ে দিলো। চারুর কম্ফোর্টারটা ভালো করে টেনে দিলো। বসলো তার পাশে। নিবিড় দৃষ্টি তাকেই দেখছে। মনে মনে হাসলো, মৃদু স্বরে বলল,
“তুমি আমাকে পাগল করে দিবে চারুলতা। কি করবো আমি তোমাকে নিয়ে!”
চলবে