চারুলতা তোমার জন্য পর্ব-১৩

0
1

#চারুলতা_তোমার_জন্য
#১৩তম_পর্ব

থাই গ্লাসের ফাঁক দিয়ে রোদ গলে টাইলসের মেঝেতে হুটোপুটি খাচ্ছে। কোনো এক অচেনা পাখির মিষ্টি সুর কানে আসছে। পাখিটি কি গান গাইছে! নাকি নিজের মনের কথা এই সাতসকালে প্রকৃতিকে জানাচ্ছে! হয়তো বলছে,
“এই যে সুবিশাল আকাশ! তুমি এতো বিশালকার হবার পরও তোমার কোলে আমার ঠাঁই নেই কেন!”

চারুর চোখে রোদ এসে পড়তেই তার ঘুম ভাঙ্গলো। টিপটিপ করে চোখ মেললো। প্রথমে নিজেকে অচেনা ঘরে, অচেনা বিছানায় পেয়ে চমকে গেলেও ধীরে ধীরে মস্তিষ্ক জানান দিলো,
“তোমার বিয়ে হয়ে গেছে। এখন থেকে এটাই তোমার আশ্রয়স্থল”

শ্রাবণ যদিও বলেছে এই ঘরটা তার, তবুও কোনো এক অজানা কারণে ঘরটাকে নিজের মানতে পারছে চারু। ইতস্ততবোধ হচ্ছে! মনে হচ্ছে সবটাই একটা স্বপ্ন। এই বুঝি স্বপ্নটা ভাঙবে আর চারু নিজেকে আবিষ্কার করবে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতে। ভালোবাসার মানুষটির কাছ থেকে চরম প্রতারণা এবং নিজের মা-বাবার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হবার পর এখন কাউকেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না। জীবনটা কেমন যেন বিভীষিকার মতো লাগছে। হৃদয়ের যন্ত্রণাটা তাও সহ্য করে নিতো চারু। কিন্তু শ্রাবণের এই দয়া যদি কখনো শেষ হয়ে যায়। এই আদুরে, মোলায়েম মুহূর্তগুলো যদি শেষ হয়ে যায়! ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ঢরায়। মনটা সর্বদা বিচলিত থাকে। চোখ বুজে দীর্ঘশ্বাস ফেললো চারু। পাশের জায়গাটা ঠান্ডা। শ্রাবণকে দেখতে পারলো না। বারান্দার উইন্ড চিমটা বাতাসে টুং টাং শব্দ করছে। চারু বিছানা ছাড়লো। ওয়াশরুমে যেয়ে দেখলো একটা নতুন ব্রাশ রাখা। সাদা টাওয়ালের পাশে একটি গোলাপি টাওয়াল রাখা। হাতমুখ ধুঁয়ে ঘরে এলো সে। কি মনে করে আলমারীর দরজা খুললো। দরজাটা খুলতেই চোখে মুখে বিস্ময় উঁকি দিলো। শ্রাবণের জামা কাপড়ের পাশে সুন্দর করে সদ্য কেনা শাড়ি ঝুলছে। থাক ভর্তি সালোয়ার কামিজ, কুর্তি, জিন্স। এতো সব কি এই সকালবেলা কিনে এনেছে জল্লাদ! কৌতুহল দমাতে নিচে গেলো সে।

বিশালকাল ডাইনিং টেবিলে বসে নাস্তা করছে শ্রাবণ। সাথী খালা রান্নাঘরে কাজ করছেন। ভীত পায়ে চারু সিড়ির কাছটাতে দাঁড়াতেই চোখ তুলে তাকালো শ্রাবণ। ঠোঁটে এক ফালি হাসি ফুটিয়ে বললো,
“গুড মর্নিং মিসেস তালুকদার। ফ্রেশ হয়েছেন? আসুন ব্রেকফাস্ট করবেন”

চারু সংশয়াকুল স্বরে শুধালো,
“আলমারীর জামাগুলো!”
“সেগুলো আপনার। আসলে আমি আপনার সাইজ জানতাম না। গতকালের ড্রেসটার বেসিসে কিনেছি। তাও ফিটিং না হলে জানাবেন”
“এতো খরচ করার প্রয়োজন ছিলো না”
“সেটা আমার উপর ছেড়ে দিন। আসুন নাস্তা করে নিন। আমরা এগারোটার দিকে বের হব”

চারু ঘড়ির দিকে চাইলো। অনেক বেলা হয়ে গেছে। আজ থেকে অবশ্য তার অফিসের ছুটি শুরু হবার কথা। আজ তার গায়ে হলুদ। মা বলেছিলেন,
“হলুদের পর বাড়ি থেকে বের হতে নেই”

অথচ কিছুই হলো না। উলটো মিথ্যে কলঙ্ক লাগলো গায়ে। নিজের মাও মুখ ফিরিয়ে নিলেন। চারু ধীর পায়ে এসে বসলো শ্রাবণের পাশের চেয়ারটাতে। সাথী খালা এসেছে খ্যাটখ্যাটে স্বরে শুধালেন,
“কি খাইবেন?”

এই মহিলাকে সেদিনও নিতান্ত নির্বিকার রোবট মানব লেগেছিলো আজও তাই লাগছে। চোখে মুখে কেমন অব্যক্ত বিরক্তি। চারুর কিছু বলতে হল না। শ্রাবণই তাকে বললো,
“ওর জন্য দুটো পরোটা আর একটা ডিম পোচ করে আনুন। উনার ছাইপাস খেতে ভালো লাগে না”

শ্রাবণ যদিও ওটস খাচ্ছে। তার কালো কফিও সেখানে হাজিরা জানিয়েছে। সাথী খালা বিশ মিনিটের মধ্যেই নাস্তা নিয়ে চারুর সামনে রাখলো। তিনি যেতে নিলে শ্রাবণ গম্ভীর স্বরে বললো,
“এখন থেকে কি রান্না হবে উনার থেকেই শুনে নিবেন”

কথাখানার মধ্যে সুপ্ত দায়িত্ব অর্পণ ছিলো যেন। চারুর মনে এক শীতল সিক্ত বাতাস যেন বয়ে গেলো। রৌদ্রদাহে তপ্ত প্রকৃতির উপর প্রথম বর্ষার পূর্বে বয়ে যাওয়া শীতল বাতাসের অনুভূতিটা যেমন অবর্ণনীয়, অতুলনীয় লাগে, চারুর মধ্যের অনুভূতিটাও তেমন। কিন্তু খারাপ স্মৃতিগুলো এখনো মিলিয়ে যায় নি। যেখানে মা-বাবাই তাকে এই সুবিশাল পৃথিবীতে নির্দয়ের মতো ছেড়ে দিয়েছে সেখানে অন্যকাউকে ভরসা করা বোকামি। অমোঘ সত্য এই যে পৃথিবীতে তোমার প্রতি দেখানো ভালোবাসা, প্রেম, সহানুভূতিগুলো নিখাঁদ নয়, একাংশ মেকিও। শ্রাবণ কফিকাপে চুমুক দিতে দিতে বললো,
“তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন। আমাদের বের হতে হবে”
“আমরা একসাথে যাব?”
“আলাদা যাবার কারণ আছে?”
“না, আসলে……”

শ্রাবণের কপালে বক্রভাঁজ দেখতে পেলো চারু। ফলে কিছুটা রয়ে সয়ে বললো,
“আমি আসলে চাচ্ছিলাম না এখনই অফিসে বিষয়টা জানাজানি হোক। অহেতুক কথা হবে। এমনিতেও কম কথা তো হয় না। নিন্দুক মানুষের অভাব নেই পৃথিবীতে”

শ্রাবণ শুনলো। কিছু বললো না। নাস্তার টেবিল হুট করেই গম্ভীর হয়ে উঠলো যেন। চারুও ঘাটালো না।

***

অফিসের একটু দূরেই শ্রাবণের গাড়ি থেকে নেমে গেলো চারু। শ্রাবণকে অনুরোধী স্বরে বললো,
“আপনি কিন্তু একটু পরে আসবেন”

শ্রাবণ এবারো কোনো উত্তর দিলো না। স্থবির চোখে তাকিয়ে রইলো। মনে মনে হাসলো বোধ হয়। চারু যথারীতি নিজ ডেস্কে যেয়ে বসলো। ভেবেছিলো অফিসের কেউ হয়তো প্রশ্ন করবে। কারণ আজ থেকে যে তার ছুটি সবাই জানে। সবাইকে ঘটা করে দাওয়াত করেছিলো। একবার চেয়েছিলো অফিসে আসবে না। কিন্তু শ্রাবণ সেই সুযোগ দিবে বলে মনে হল না। তাই বৃথা চেষ্টাও করে নি। আর.এম.ডি ডিপার্টমেন্টের শ্রেয়া কিছু ফাইল নিয়ে উপস্থিত হলো। চারুকে দেখে তার আচার ছিলো স্বাভাবিক। ফাইলগুলো রেখে বললো,
“স্যারের সাইন লাগবে। স্যার আসেন নি?”
“আসছেন”

শ্রেয়া যেন অবাক হলো। কিন্তু সেই বিস্ময়কে খুব একটা প্রগাঢ় হতে দিলো না। বরং শুধালো,
“স্যারের মেজাজ কি ভালো না খারাপ?”
“আমি জানি না”
“সে কি? তোমার তো জানার কথা”

চারু বিস্মিত স্বরে শুধালো,
“আমার জানার কথা?”

শ্রেয়া কথার উত্তর না দিয়ে কিছু ভাবলো। তারপর স্বাভাবিক স্বরে বললো,
“ফাইলগুলো দেখে স্যারের মেজাজ খারাপ হতে পারে, সামলে নিও”

শ্রেয়ার কথাবার্তা খুব বিচিত্র ঠেকলো চারুর। এমন আচারণ সে কখনো করে না। পুরো অফিস জানে চারুর সেই ক্ষমতা নেই যে শ্রাবণ তালুকদারকে সামলাবে। বরং সবাই আড়ালে আবডালে একটাই প্রশ্ন করে,
“চারু কি করে শ্রাবণ স্যারের আন্ডারে চাকরি করে? ওর জায়গায় আমি হলে দু দিনেই ছেড়ে দিতাম”

অথচ আজ ভিন্ন কথা বলছে। এর মধ্যেই শ্রাবণ অফিসে ঢুকলো। শ্রেয়া তাকে সালাম দিয়ে কেটে পড়লো। অফিসের সেদিনটা খুব বিচিত্র কাঁটলো। শ্রাবণ তালুকদার একবারও মিসেস তালুকদার সম্বোধন করলো না। আগের মত মিস মেহেনাজ ই সম্বোধন করলো। আগে এমন খটখটা মেজাজ প্রদর্শন করতো তেমনই মেজাজ দেখালো। একটু আগের মানুষের সাথে এই মানুষটির যেনো কোনো মিল নেই। অথচ বাড়িতে তার আচরণ খুব-ই ভিন্ন ছিলো। চারু এমনটাই চেয়েছিলো বটে, কিন্তু এখন যেন কেমন খা খা করছে মনটা। তবে এই খা খা মনের আবহাওয়া কিছুতে বুঝতে দিলো না কাউকে।

মিটিং, কাজের পাঠ চুকিয়ে গাড়িতে উঠলো সদ্য দম্পতি জীবনে পা রাখা দুজন। এখন অফিসে গার্ড ছাড়া কাকপক্ষীও নেই। তাই একই গাড়িতে উঠলেও কারোর চোখে পড়ার কথা নয়। চারু গাড়িতে বসতে বসতে শুধালো,
“কি খাবেন?”

শ্রাবণ ভ্রু কুঁচকালো। অবাক স্বরে শুধালো,
“সাথী খালা তো রান্না করে যাবার কথা”
“উনার রান্না আমার পছন্দ হয় নি। লবন বেশি, ঝাল বেশি, তেল বেশি। রান্না তো না যেন তেলের সাগরে সাঁতার কাটছে। দুপুরে কোনো মতে ভাতগুলো গিলেছি। আপনি কি করে বুঝবেন? আপনি তো গিলেছেন রেস্টুরেন্টের খাবার। রাতের জন্য আমি রাধতেও বলি নি। আমিই রান্না করবো। তাই জিজ্ঞেস করছি কি খাবেন?”
“আপনি রান্না করতে পারেন”
“টুকটাক। আপনার যা নমুনা, বাঙ্গালী খাবার মুখে রচে?”

শ্রাবণ ঠোঁট চেপে হাসলো। ব্যাঙ্গ করে বলল,
“বউয়ের হাতের বিষও নাকি পঞ্চভোগ”
“ঠাট্টা করছেন?”
“করা বারণ?”
“হজম হচ্ছে না”

শ্রাবণ একটু এগিয়ে এসে বললো,
“অভ্যাস করে নি মিসেস তালুকদার। আমার সব রুপের সাথে আপনার পরিচিতি থাকা উচিত”

শ্রাবণের ফিঁচেল স্বর আবারো ফিরে এসেছে। অথচ অফিসের বিগত নয়টা ঘন্টা ছিলো একেবারে ভিন্ন। ঘরে ঢুকে হাত মুখ ধুঁয়ে কাপড় ছেড়ে রান্নাঘরে গেলো চারু। ঘরের বাজারের অবস্থা ভালো না। সবজির বালাই নেই। ফ্রিজ ভর্তি সসেজ, সালামি আর কিসব কিসব। বড়লোকি কারবার। ভেজিটেবল বক্সে দামী দামী জিনিস, যার নাম বা রান্নার প্রণালীও জানে না চারু। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। হতাশ স্বরে বলল,
“বাজার তো কিছুই নেই”

শ্রাবণ গোসল সেড়ে এসেছে। চুল মুছতে মুছতে সে এসে দাঁড়ালো চারুর সামনে। স্বভাবত তার শরীরে শুধুমাত্র একটি নীল রঙ্গা ট্রাউজার—তার অনাবৃত বুকখানা দেখেই চারু দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। শ্রাবণ বিষয়টা খেয়াল করেও যেন একেবারে উপেক্ষা করলো। স্বাভাবিক স্বরে বলল,
“আমি এসব জানি না। সাথী খালাকে বলি কি খাবো, উনি ই রান্না করেন”

চোখজোড়া কোনোমতে সংযত করে বললো,
“কালকে বাজারে যাব, আপনি নিয়ে যাবেন। আজ মুরগী ভুনা আর ডাল রাধছি”

বলেই একপ্রকার রান্নাঘরে ছুটে পালালো। বুকখানা ধকধক করছে। অনভ্যস্থ চারুর অস্বস্তিবোধ হচ্ছে। সে ঠিক করলো শ্রাবণের সামনেই যাবে না। কিন্তু সেটাও হলো না। শ্রাবণ ঠিক এসে দাঁড়ালো তার পাশে। উৎসুক স্বরে বলল,
“ডু ইউ নিড মাই হেল্প?”
“হ্যা, যেয়ে জামা পড়ে আসুন”
“হোয়াট?”
“বলছি, এভাবে নেংটো হয়ে ঘুরার কি মানে? আমি তো একটা মেয়ে নাকি! যান জামা পড়ে আসুন”

শ্রাবণ কিছুসময় স্থির নয়নে তাকিয়ে রইলো চারুর দিকে। চারুর শুভ্র গাল লাল হয়ে আছে। সে লজ্জা পাইছে। সেই লাজুকতা মাদকীয়, যেকোনো পুরুষের হৃদয়ে এই মাদকতা লিপ্সা জাগাতে সক্ষম। শ্রাবণ তাদের মধ্যকার দূরত্ব কমিয়ে ফেললো। দাঁড়ালো চারুর গা ঘেষে। চারু তখন মুরগী কাটছিলো। শ্রাবণের সুঠাম বুকের স্পর্শ পেলো নিজের পিঠে। নিঃশ্বাস আটকে যাবার মতো অবস্থা তার। শ্রাবণ তার বলিষ্ঠ হাতখানা চারুর কটিদেশে রাখলো। থুতনি ঠেকালো ঠিক চারুর কাঁধে। এমন কাজ বিপজ্জনক। চারুর হাতে ধারালো ছুরি। রেগে গেলে নারীদের হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায়। এমনটা হতেই পারে সে আক্রমণ করে বসলো। কিন্তু শ্রাবণের ধারণা এমন কিছুই হবে না। চারু লজ্জায় মোমের মতো গলে যাবে। এমনটাই হলো। চারুর গাল আরোও লাল হয়ে গেলো। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে গেলো। শ্রাবণ তার কানে ঠোঁট মিশিয়ে বললো,
“কি যেন বলছিলেন!”

চারু চুপ করে রইলো। শ্রাবণ তার উন্মুক্ত ঘাড়ে নাক ঘষলো। আবারো শুধালো,
“মিসেস তালুকদারে কথা ফুরিয়ে গেছে বুঝি?”
“নির্লজ্জ পুরুষের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না”
“আমার নির্লজ্জতা দেখালাম কোথায়?”
“দেখতে চাই না”
“সে বললে তো হবে না। ধৈর্য্য ধরেছি বলে আজীবন সন্ন্যাসী থাকার ইচ্ছে নেই। অন্তত আপনার কাছে তো না”

চারু দলা পাকানো স্বরে কোনোমতে বলল,
“আমার হাত কাটলে আপনি দায়ী হবেন”

শ্রাবণ সাথে সাথেই চারুকে ছেড়ে দিলো। কাউন্টারে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। চারু মৃদু কৌতুক করে বললো,
“ভয় পেলেন?”

শ্রাবণ হাসলো কিন্তু উত্তর দিলো না। বুকে হাত দিয়ে বললো,
“শ্রাবণ তালুকদার ভীত নয়, সে সাবধানী”
“তাই?”

শ্রাবণ একটু ঝুকে ফিসফিসিয়ে কিছু বললো। চারু জমে গেলো। গাল রক্তিম হয়ে গেলো। শ্রাবণ মৃদু হাসতে হাসতে ফ্রিজের পানি বের করলো। পানি খেতে খেতে বললো,
“কি মিসেস তালুকদার? ভুত দেখলেন যেন!”
“আপনি একটা অসভ্য”
“নতুন কিছু শব্দ খুঁজুন, বিছানায় এগুলো শুনতে চাই না”

বলেই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলো সে। চারুর কান গরম হয়ে গিয়েছে। শ্রাবণ নিরেট প্রজাতির জল্লাদ ছিলো, সেটাই ভালো ছিলো। এগুলো নেওয়া যাচ্ছে না।

****

চারুর ফোনটা বাজছে। অচেনা নম্বর। ফোনটা ধরলেই ওপাশ থেকে কিছু শোনা যায় না। দু-তিনবার হয়েছে ব্যাপারটা। তাই চারু বিরক্ত হয়ে গেছে। এখন অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসলে সে ধরে না। নিশ্চয়ই কোনো পাজি বদের কাছে নাম্বারটা পড়েছে। এই জগতে ভালো মানুষ নেই। সব লম্পট। তক্কে তক্কে বসে থাকে কোনো ছুতোয় যদি একটা মেয়ের নম্বর পায় তাহলে তাকে জ্বালিয়ে ফেলে। এই অচেনা নম্বরটিও তেমন। বিগত তিন-চারদিন খুব জ্বালাতন করছে। শ্রাবণ গোসল সেরে বের হলো। নিস্তব্ধ ঘরময় রিংটোনের শব্দ শুধু। শ্রাবণ চুল মুছতে মুছতে বললো,
“ফোনটা ধরছেন না কেন?”
“রঙ নাম্বার, তিন-চারদিন ধরে জ্বালাচ্ছে খালি”

শ্রাবণ সরু চোখে তাকালো। তারপর গম্ভীর স্বরে বললো,
“দেখি”

চারু বিনা দ্বিধায় ফোনের লকটা খুলে এগিয়ে দিলো। শ্রাবণ নাম্বারটা দেখলো। তার মুখশ্রী গম্ভীর। সে কিছু বললো না। দেখলো শুধু। চারু বললো,
“ধরে ঝামটি দিন তো”

শ্রাবণ মৃদু হাসলো। ফোনের একটি ম্যাসেজ ডিলেট করে নাম্বারটি ব্লক করে দিলো। ফোন এগিয়ে দিয়ে বললো,
“আবার ফোন আসলে, জাস্ট ব্লক”
“ঝামটি দিলেন না”
“মুড নষ্ট করতে ইচ্ছে হচ্ছে না”

বলেই বিছানায় শুয়ে গেলো শ্রাবণ। চারু পাশে বসতেই তাকে হ্যাচকা টানে নিজের বুকের মাঝে নিয়ে নিলো। চারু কিছু বললো না। নড়লো না। প্রশস্ত বুকে লেপ্টে রইলো বিড়ালছানার মত। শ্রাবণ চোখ বুজে ফেললো। চারুর চুলের মাঝে তার আঙ্গুল পেঁচিয়ে আছে। শ্যাম্পুর গন্ধ নাকে আসছে। এটা যেন তার কাছে চরম আনন্দের।

***

চারু এবং শ্রাবণের বিবাহিত জীবন স্রোতহীন নদীর মত চলমান। সম্পর্কটা সহজ হয়ে আসলেও চারুর পক্ষ থেকে অগ্রগতি ক্ষীণ। শ্রাবণের ঘরে তার বিচরণ রানীর মতো। সবকিছুতে তার অগ্রাধিকার। তবুও নিজেকে মেলে ধরতে ইতস্ততা। শ্রাবণের সাথে সম্পর্কটা এখন দা কুমড়োর নয়, শ্রাবণের হুটহাট স্পর্শ, কাছে আসাটা মনে সয়ে গেছে। চারু কিছুই বলে না, বরং লজ্জায় মিশে যায়। কিন্তু তাদের সম্পর্কটা খুব একটা আগায় নি। অফিসে কাউকে সে জানায় নি বিয়ের কথা রয়ে সয়ে বলবে ভেবে। হাতের পাঁচটা আঙ্গুল এক সমান নয়, শ্রাবণও রুশানের মত নয়। তবুও ভয় হয় চারুর। উপরন্তু শ্রাবণ তাকে সমীহ করলেও তাদের বিয়েটা স্বাভাবিক ভাবে হয় নি। শ্রাবণের হৃদয়ে কারোর অনুপ্রবেশ ছিলো কি না সেটাও জানে না চারু। শ্রাবণ নিতান্তই অন্তর্মুখী ব্যক্তি। চারু এবং তার মধ্যে কখনো যেভাবে কথাও হয় না। অফিসে যায়, বাসায় আসে, খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমানোর সময় লোকটি তাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে কিন্তু কখনো বলে নি,
“চারু, তোমাকে আমার মনে ধরেছে”

হয়তো শ্রাবণের থেকে কোনো ইঙ্গিত পায় নি বিধায়ই ইতস্ততা বাড়ছে। নিজ থেকেও আগাতে পারছে না। দীর্ঘশ্বাস ফেললো চারু। বারান্দার রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। এ বাড়ির বিকালটা খুব প্রিয় চারুর। কখনো যদি তাকে এ বাড়ি ছেড়ে দিতে হয় এই বিকেলকে খুব মনে পড়বে। কমলা মোলায়েম বিকেলটা খুব ধীর পায়ে পাতার ফাঁকে বারান্দায় আসে। মেঝেতে লুটোপুটি খায়। বাতাসে খুব একটা অস্থিরতা থাকে না। উইন্ড চিমটাও বাজে মৃদুমন্দভাবে। এক অনির্বচনীয় শান্তি।

ঘাড়ে কারোর স্পর্শ পেলো চারু। শ্রাবণ তাকে পেঁচিয়ে ধরেছে। গলায় নাক ঘষে বললো,
“ছোট একটা মাথা, এতো প্রেসার কেন দিচ্ছেন মিসেস তালুকদার?”
“আপনি আমাকে চারু বলে ডাকেন না কেন?”

শ্রাবণ হেসে শুধায়,
“এটা ভাবছিলেন?”
“যদি বলি হ্যা?”
“তাহলে বলবো, চারু নামটা আমার পছন্দ নয়”
“চারু নামটা আপনার পছন্দ নয়?”
“হুম, আপনার সাথে বেমানান লাগে”
“মিস মেহেনাজ? মিসেস তালুকদার মানানসই?”
“মানানসই বলবো না, তবে চারু থেকে তো ভালোই”
“তাহলে মানানসই কি?”

শ্রাবণ থামলো। তার স্থির দৃষ্টি চারুর গাল বরাবর। চারুর চোখে কৌতুহল। যেন উত্তরটা জানা প্রয়োজন। শ্রাবণ মৃদু স্বরে বললো,
“চারুলতা—কিন্তু সেটা ডাকার অধিকার আপনি দেন নি”
“নাম ডাকতেও অধিকার লাগবে”
“বিশেষ নামের জন্য বিশেষ অধিকারের প্রয়োজন হয় মিসেস তালুকদার। চারুলতা আমার একান্ত, আমার নিজস্ব, স্বকীয়; যার সর্বত্র আমারই বিচরণ, সেই অধিকারটা তো এখনো পাই নি মিসেস তালুকদার?”

চারু কিছু সময় চুপ করে রইলো। তারপর বলল,
“যদি সেই অধিকার না দেই?”
“তবে মিসেস তালুকদারেই সীমাবদ্ধ থাকবো”

চারু এক নয়নে তাকিয়ে শ্রাবণের দিকে। মানুষটির মুখোভাবের কোনো পরিবর্তন নেই। তার মুখোভাবের খুব একটা পরিবর্তন হয় না। তবে একই ঘরে থাকতে থাকতে চারু যেন তাকে বুঝতে শুরু করেছে। মানুষটি কখন রাগে, কখন খুশি হয়, কখন তার মনজমিনে বিষন্ন মেঘের ছায়া পড়ে চারু যেন একটু হলেও আঁচ করতে পারে। এখন যেমন নির্লিপ্ত মুখশ্রীর মধ্যেও কোথাও বিষন্নতা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। চারুর মনে হচ্ছে সে কোনো প্রগাঢ় প্রেমে ডুবন্ত কিশোরের সাথে কথা বলছে। ব্যাপারটি কিছুটা হলেও ভালো লাগলো যেন চারুর। সে একটা দুঃসাহসিক কাজ করে ফেললো। পায়ে বুড়ো আঙ্গুলের উপর সমস্ত দেহের ভর দিয়ে একটু উচু হয়ে চুমু খেয়ে ফেললো শ্রাবণের রুক্ষ্ণ গালে। চুমু খাবার পর মনে হলো সে ভয়ানক কিছু করে ফেলেছে। নেশাতুর শ্রাবণ স্থবির চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন এই মুহূর্তের অপেক্ষা বিগত মাসখানেক যাবৎ ছিলো। চারু ঠোঁটজোড়ার উপর হাত চেপে বলতে চেষ্টা করলো,
“আসলে, আসলে আমি”

কিন্তু বলার পূর্বেই তার ঠোঁটের কাছের হাত সরিয়ে শ্রাবণ গাঢ় স্বরে বললো,
“তুমি আমাকে সংযমী থাকতে দিলেন না চারুলতা”…………………….

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি