#চারুলতা_তোমার_জন্য
#অন্তিম_পর্ব
নির্জন গুদাম ঘর। বাহিরের ঝলমলে রোদ ঢাকা পড়েছে কৃষ্ণ মেঘের অতর্কিত হামলায়। বজ্রপাতের বিকট শব্দ কানে ভেসে আসছে। মনে হচ্ছে বিরাট এক দৈত্য ধরণীতে ছাপিয়ে পড়বার পূর্বে হুংকার ছাড়ছে। গুদাম ঘরে একটা উচ্চ ভোল্টের বাল্ব জ্বলছে। কিন্তু পুরাতন হয়ে যাবার জন্য, ক্ষণে ক্ষণে নিভে যাচ্ছে আবার জ্বলছে। টেবিলের এক পাশে এক সুন্দরী রমনী বসা। লম্বাটে মুখ, টানা টানা চোখ, সাধারণ সুতির একটি শাড়ী পরিহিত। তার ঠিক বিপরীতে অনির্বচনীয় গাম্ভীর্য নিয়ে বসে আছে শ্রাবণ। তার হাত টেবিলের উপর। তর্জনীর কোণ দিয়ে টেবিলের উপর আঁকাবুকি করছে সে। দৃষ্টি নারীর উপর আবদ্ধ। সহিংস, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। মেয়েটি হাসলো, হাসিতে শ্লেষ। খনখনে স্বরে বললো,
“স্যার কি বিরক্ত হলেন? আসলে আমি অত্যন্ত দুঃখিত আপনাকে এভাবে বিরক্ত করার জন্য। কিন্তু কি করবো বলুন, টাকা পয়সা শেষ হয়ে গেলে আসলে করার কিছু থাকে না”
শ্রাবণের দৃষ্টি ধারালো হল। মেয়েটি শুকনো ঢোক গিললো। বুকের ভেতরটা ত্রাসে জর্জরিত হলেও প্রকাশ করলো না সে। কারণ প্রকাশ করলেই মাঝে মাঝে দুঃসাধ্য কাজ করতে হলে ভয়, ত্রাসকে স্থান দেওয়া উচিত নয়। মেয়েটি তাই ভয়কে সরিয়ে খুব সহজ গলায় বললো,
“আমি জানি আপনার সাথে আমার ডিল মাত্র দুলক্ষ টাকার হয়েছিলো। কিন্তু তখন তো জানতাম না, আমার জন্য আপনার জীবনে এতোটা বিশাল পরিবর্তন ঘটবে। যদি জানতাম তাহলে এতো ঠুংকো টাকা চাইতাম না। আর আমি তো আর কোটি কোটি টাকা চাচ্ছি না। মাত্র প্রতি মাসে দু লক্ষ টাকা ব্যাস। আপনি চাইলে আরোও দিতে পারেন, আমি জানি। কিন্তু আমি তো লোভী নই। দেখুন এটা তো মানবেন আজ আপনি আপনার স্ত্রীকে বিয়ে করেছেন সেখানে অনেকটা হাত আমারো। মানছি আমি যা করেছি তা টাকার বিনিময়ে। কিন্তু এটা তো মানবেন, আমার চার্মটাই এমন যে রুশান বাধ্য হয়েছে আমার সাথে ইনভল্ভ হতে। ক্রেডিট তো আমার। আমার বদলে অন্যকে ঠিক করলে দেখা যেত প্লান কাজই করতো না, টাকা তো লস হত। সেইটা ভেবেও আপনার উচিত আমাকে পুরস্কার দেওয়া। আমি কথা দিচ্ছি, মাসের শুরুতে টাকা পেয়ে গেলে আমি চুপ করে থাকবো। দেখুন আপনার নাম্বার যেমন আপনার কাছে আছে আপনার ওয়াইফের নাম্বারও আছে। আমি কিন্তু তাকেও ফোন করতে পারি। ভাবুন, আমি যদি ফোন করে বলি, সেদিন যা দেখেছিলো সবটা বানোয়াট কি হবে? আপনার কাছে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার কোনো অপশন নেই কিন্তু”
শ্রাবণের কপালের শিরা ফুলে উঠেছে। মুখে অস্বাভাবিক কাঠিন্য ফুঁটে উঠল। জলদগম্ভীর স্বরে বললো,
“আমার স্ত্রী তোমার মিথ্যে কথা বিশ্বাস করবে কেন?”
“পৃথিবীটা তো এমনই স্যার, মিথ্যের সাথে সত্য মিলিয়ে দিলেই দেখবেন মিথ্যে আর মিথ্যে লাগছে না। আর আপনিও একই কাজ করেছেন। আপনিই নিজেই সরবকে দিয়ে একটা জটিল ফাঁদ ফেলেছেন। কোটেশনের পুরো নাটক রচনা করেছেন। সরবকে দিয়ে রুশানকে ওদের কোম্পানির জব অফার পাঠিয়েছেন। রুশান গাধাটা এই জালে পা দিয়েছে। ওর উচ্চাকাঙ্খা ওকে বানিয়ে দিয়েছে সেই মাকড়সার শিকার যে ভেবেছিলো সব সুতো তার হাতে। অথচ কাঠিটা তো অন্য কেউ নাড়ছিলো। সরবকে নিয়ে ওর একাউন্টের টাকাটা আপনিই পাঠিয়েছে। কোটেশন লিকটাও আপনি করেছেন। বিনিময়ে সরবকে ইউএস এ একটা স্যাটেলড লাইফ গিফট করেছেন। রুশান বলদ ভেবেছে ওর চাল ধরা পড়েছে, অথচ এই চাল যে আপনি বুনেছেন। সেদিন আমাকে বলেছিলেন রুশানকে যেন ক্লাবে ইনভাইট করি। রুশান নিজের প্লান সাক্সেসফুল হবার আনন্দে ক্লাবে এসেছিলো। আপনি চেয়েছিলেন যেন চারু সেখানে আসে এবং আমাদের একত্রে দেখে। যাতে সে যদি রুশানের মনভুলানো কথায় তাকে ক্ষমা করে দেয় যেন নিজেকে প্রতারণা করাকে ক্ষমা না করতে পারে। রুশানের মেজাজ সংযমে থাকে না। আপনি চাইছিলেন যে সে তার পাশবিক চিত্র চারুর সম্মুখে রাখে, সেটাই হয়েছিলো। তারপর আপনার আর চারুর ছবি? সেগুলোও তো আপনি পরিকল্পনা করে রুশানের আম্মুকে পাঠিয়েছিলেন, যেন একটা কান্ড ঘটে। রুশানকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন যেন সে সব হারিয়ে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটা ক্ষুধার্ত হায়েনা হয়ে যায়। আপনি চাইলেই রুশানকে সরিয়ে দিতে পারতেন, কিন্তু তখন রুশান চারুর সমবেদনা পেত। আপনি সেই সুযোগটাও রাখেন নি। আপনার সত্য ভালোবাসায় তাহলে কি কপটতা নেই? তাহলে আমার মিথ্যেতেও সত্যর মিশ্রণ থাকতেই পারে, তাই না?”
শ্রাবণ তার পাশে দাঁড়ানো কালো কোট পরা যুবককে ইশারা করলো। সে কঠিন স্বরে বললো,
“তোমার মোবাইল দাও, হৃদি”
হৃদি নামক নারী তার মোবাইলটা সামনে রাখলো। ব্যঙ্গ করে বললো,
“আমার কাছে সব প্রমাণ আছে। তাই আমার মোবাইল সিজ করে লাভ নেই। আর যদি ভেবে থাকেন আমাকে রুশানের মত সরিয়ে দিবেন তাহলে ভুল ভাবছেন। আমি সেই সুযোগ দিব না। আমি রুমমেটকে বলে এসেছি, সে দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে তারপর আমার মিসিং ডাইরি করবে”
শ্রাবণ শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে হৃদির দিকে। তার মুখোভাব দেখে মস্তিষ্ক বুঝার উপায় নেই। শ্রাবণের সাথে থাকা যুবক এক হাজার টাকার দুটো বান্ডেল হৃদির সামনে রাখলো। টাকা দেখতেই তার লোভী সত্তা উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। চোখ চকচক করছে। শ্রাবণ হিমেল কণ্ঠে বললো,
“আমার স্ত্রীর সামনে যাবার সাহস যেন না করা হয়”
“আপনি শুধু ভাত ফেলবেন স্যার, আমি কাক আপনার দাসী হয়ে থাকবো”
বলেই উঠে দাঁড়ালো হৃদি। গদগদ স্বরে বললো,
“আসি স্যার”
“বেস্ট অফ লাক”
হিমেল স্বরে বললো শ্রাবণ। হৃদি পাত্তা দিলো না। তার মস্তিষ্ক এখন আকাশকুসুম চিন্তায় ব্যস্ত। শ্রাবণের কথা শোনার সময় তার নেই। গুদাম থেকে বের হতেই সে তার রুমমেটকে ফোন করলো,
“এতো, শোন আমি আজ আসবো না। তুই ঘুমিয়ে যাস”
হৃদি এখন ট্রেনে উঠবে। সোজা বাড়িতে যাবে। ঢাকায় আপাতত থাকাটা তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। অনেকদিন যাবৎ নিজের বাসায় যাওয়া হয় না। এই আমনবিক ঢাকা শহরকে তার প্রয়োজন নেই। মাসের শুরুতেই টাকা পেলে কে কাজ করবে। সে জানে সে অনেক বড় গেম খেলছে। কিন্তু ঝুঁকি ছাড়া জীবন চলে না। শ্রাবণ তার মোবাইলের সব ডকুমেন্ট ডিলেট করে দিয়েছে কিন্তু সব ডকুমেন্ট তার গুগল ড্রাইভ আর ল্যাপটপে আছে। হৃদি সরাসরি গেল কমলাপুর স্টেশনে। ট্রেন তার দুটোর সময়। ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। যে কেউ দেখলেই বলবে সন্ধ্যে গড়িয়ে এসেছে। ট্রেন ছেড়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো হৃদি। ভীতির কুহেলিকা কেঁটেছে অবশেষে। শ্রাবণ তালুকদার এখন তাকে ধরতে পারবে না। ট্রেন থামলো ঈশ্বরদী স্টেশন। সামনে ক্রসিং। আধা ঘন্টা দেরি হবে। বৃষ্টি ঝিমিয়ে এসেছে। ট্রেনে বসে থাকার থেকে যদি স্টেশনে ধোঁয়া তোলা চা খাওয়া যায় মন্দ হয় না। হৃদি টাকার ব্যাগ সমেত নামলো ট্রেন থেকে। আশপাশ দেখলো। নাহ কোনো ঝামেলা নেই। স্টেশনের এক চা ওয়ালা থেকে গরম চা খেলো সে। একশ লিচু কিনলো। বাড়িতে বহুদিন পর যাচ্ছে। বিশ্রামাগারে তখন কেউ নেই। ট্রেনে উঠার আগে একটু ওয়াশরুমে গেলো সে। ট্রেনের ওয়াশরুমে যেতে ভালো লাগে না। যাওয়ার মত অবস্থাই নেই। কিন্তু ওয়াশরুম থেকে আর বের হলো না হৃদি। দেড়ঘন্টা পর তার লাশ বিশ্রামাগারের সোফায় আবিষ্কার করলো স্টেশন মাস্টার। শরীরে বিন্দুমাত্র ক্ষত নেই। যে কেউ দেখলেই বলবে মেয়েটি ঘুমিয়ে আছে।
****
বৃষ্টির বেগ বেড়েছে। বারান্দা ভিজে গেছে। গাছগুলো সতেজ লাগছে। চারুর পরণে জারুল রঙ্গা শাড়ী। শাড়ীটা শ্রাবণের দেওয়া। সকালে ফোন আসার পর মানুষটি বেরিয়ে গেছে অথচ এখনো ফিরে নি। খিঁচুড়ি ঠান্ডা হয়ে গেছে। কত শখ ছিলো গরম গরম খিঁচুড়ি, বেগুন ভাঁজা, মরিচের ভর্তা আর মুরগী ভুনা খাবে। একা একা খেতে কার ভালো লাগে? তখনই কলিংবেল বেজে উঠলো। চারু ছুটে গেলো দরজা খুলতে। দরজা খুলতেই তার মন ভালো হয়ে উঠলো। কিন্তু প্রকাশ না করে বললো,
“এতো দেরি? আপনার ঔষধ আছে দুপুরে ভুলে গেছিলেন?”
শ্রাবণ হাসলো। চারুর গা ভেজা। শাড়িটা শরীরে লেপ্টে আছে। শ্রাবণ নিজের কোটটা খুলে চারুর সামনে মেলিয়ে দিলো। ধীর স্বরে বললো,
“এভাবে আমাকে ওয়েলকাম করলে আমার ঘর থেকেই বের হতে পারবো না”
চারু নিজেকে লক্ষ করতেই কথাটার মর্মার্থ বুঝলো। ফলে মেকি রাগী স্বরে বললো,
“এতো অসভ্য কেন আপনি? বাসে আপনাকে প্রথমে দেখে যা ভেবেছিলাম সেটাই ঠিক ছিলো”
“কিন্তু সেদিন আপনি তোমাকে দেখছিলাম না”
“আমি কিভাবে জানবো? আপনি কখন কি করেন না কি আমি জানি? এই যে সকাল থেকে হাওয়া; গিয়েছিলেন কোথায় শুনি?”
শ্রাবণ মৃদু হেসে চারুর ঠোঁটে আলতো চুমু এঁকে বললো,
“অনেক তো হলো জেরা, এবার এই ক্ষুধার্ত প্রাণকে একটু খাবার দেও। ক্ষুধা লেগেছে চারুলতা”
চারু তাকে শাসানোর জন্য প্রতীজ্ঞাবদ্ধ ছিলো। অথচ সব গলে গেলো। বেঁচারা অসুস্থ। এই অসুস্থতায় তার সাথে রাগারাগী করা ঠিক হবে না। তাই রাগগুলো তুলে রাখলো সুস্থ হলেই হিসেব বুঝে নিবে।
****
বৃষ্টি শেষ হয়েছে। কিন্তু আদ্রভাবটা কাঁটে নি। বিকেল হয়ে এসেছে। সূর্যের তেজ নেই। হিমেল হাওয়ায় পাথরকুঁচি গাছটা দুলছে। শ্রাবণ ফোনে কথা বলছিলো। নিজের জন্য গরম চা আর শ্রাবণ কালো কফি বানিয়ে আনলো। শ্রাবণের ঠোঁটে হাসি। হাসির শুধাতেই বললো,
“একটা ডিল খুব যন্ত্রণা করছিলো। অবশেষে ফাইনাল হল”
চারু ঘাটালো না। শ্রাবণের সাথে বিয়ের পর সে জানতে পেরেছে তার কোম্পানি একটি নয়। সে তার নানার কোম্পানিরও প্রাইমারি স্টেকহোল্ডার। চারু চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললো,
“আচ্ছা, আপনি আপনার বাবার সাথে সম্পর্ক রাখেন নি তাই না?”
শ্রাবণের হাসি মিলিয়ে গেলো। তার দৃষ্টি তখন আকাশ পানে। বাহিরের রক্তিম আকাশের দিয়ে তার চোখের দৃষ্টি মিশে রইলো। চারু ম্লান স্বরে শুধালো,
“আপনি না চাইলে আমি আর শুধাবো না”
“চারুলতা……”
এই ডাকে যেন অব্যক্ত বিষাদের উপস্থিতি অনুভব করলো চারু। শ্রাবণ এখনও তাকিয়ে আছে বাহিরের দিকে। বর্ণহীন স্বরে বললো,
“কিছু স্মৃতি খুব যন্ত্রণা দেয়, আমি সেগুলোকে বুকে আগলে রাখি না। আমার শৈশবটাও তেমন। আমার শৈশবটা খুব তিক্ত। আমার নামক পুরুষটাও সেই তিক্ত স্মৃতির একটা অংশ। তাই সেই স্মৃতিগুলোর সাথে আমি তাকেও ভুলে গেছি। আশা করি তুমি আমাকে এ নিয়ে আর প্রশ্ন করবে না”
চারু চুপ করে গেলো। শ্রাবণ এবার তার দিকে চাইলো। কাতর স্বরে বললো,
“চারুলতা, এই পৃথিবীতে তুমি আমার, আর আমি তোমার এটুকু সত্যি নিয়ে থাকা কি খুব কঠিন?”
চারুর মনে হলো, সে ভীষণভাবে আঘাত করে বসেছে শ্রাবণকে। অথচ তার এমন কোনো উদ্দেশ্যই ছিলো না। শ্রাবণ আর সেখানে দাঁড়ালো না। সে ঘরের ভেতর চলে গেলো। চারু দাঁড়িয়ে রইলো। মুগ্ধকর পরিবেশটা যেন হুট করেই গুমোট হয়ে গেছে। নিঃশ্বাস নেওয়াও দায়।
***
নিজের স্টাডিরুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণ। চারপাশটা নীরব। তার বসুন্ধরার এই বিশাল প্রস্থর ঘেরা বাড়িতে আঁধারটা হয় কালচে, নিকষ। মানুষতো মাত্র দুজন। তাই নীরবতাটা আরোও ঘন। শ্রাবণ সেই আঁধারে তাকিয়ে আছে। মনটা বড্ড অশান্ত, তিক্ত। হাতে স্কচ হুস্কির গ্লাস। সে মদ্যপান করে কালেভাদ্রে। আজ তেমনই একটি দিন। পৃথিবীতে খুব কম সন্তান হবে যে তার বাবাকে ঘৃণা করে। সেই ঘৃণার অংশটিকেই আজ চেপে ধরেছে চারুলতা। চারুলতা কাজটা ঠিক করে নি। এখন এই যন্ত্রণার স্মৃতিগুলো মাথায় চড়ে বসেছে। বদ্ধ খোলস ছেড়ে নিজেকে উন্মুক্ত করে তুলেছে শ্রাবণের সম্মুখে। কালো আঁধারে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে স্বগোতক্তি করলো,
“আঁধারকে কখনো জিজ্ঞেস করতে হয় না, সে এতোটা নিস্তব্ধ, কৃষ্ণ কেন? স্রষ্টা তাকে এমনটাই বানিয়েছে। আজ মজবুত, প্রস্তর হৃদয়ের মানুষের পেছনে একটি শিশুর দুঃস্বপ্নে ভরা শৈশব আছে। সেটা খুব নোংরা, বিশ্রী, বীভৎস। তুমি সইতে পারবে না চারুলতা”
শ্রাবণের শৈশবটা গতানুগতিক কখনো ছিলো না। আর্থিক অভাব সে কখনোই বোধ করে নি। অভাব ছিলো তো একটা সুস্থ পরিবেশের। শ্রাবণের বাবা-মার সম্পর্কটা আর পাঁচটা দম্পত্তির মত ছিলো না। শ্রাবণের মা প্রেমে মত্ত হয়ে বিয়ে করেছিলো শ্রাবণের বাবাকে। কিন্তু সে মানুষটির কাছে কেবল প্রাধান্য পেয়েছিল তার অর্থ। শ্রাবণের নানা বিত্তবান ছিলেন। সেই সুবাদে অর্থের মালিক ছিলেন শ্রাবণের মা। একজন ভালোবাসার পিপাসু, আরেকজন অর্থলোভী। একটা সময় প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলো যেন। শ্রাবণের বাবার ভালোবাসাও মলিন হতে লাগলো। অন্যদিকে শ্রাবণের মা ভালোবাসা পাবার জন্য উন্মাদ হয়ে উঠলেন। যখন তিনি বুঝতে পারলেন তার স্বামী তাকে কখনোই ভালোবাসে নি। তখন জীবন থেকে সব মায়া ফুরিয়ে গেলো যেন। তার উন্মাদনা তীব্র হলো। তবে বাঁচার জন্য নয়। বরং মৃত্যুর মাদকতা। তিনি নিজ হাতে খু*ন করলেন তার স্বামীর প্রেয়সীকে। স্বামীকে সেই যন্ত্রণা দেবার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা ছিলো যেন। যখন তাতেও শান্তি মিললো না, তিনি ঠিক করলেন তিনি আত্মহত্যা করবেন। নিজের ছেলেকেও সেই নাশকতায় সামিল করলেন। সে তো শ্রাবণের নানা তাকে সঠিক সময়ে আটকেছিলেন। নয়তো শ্রাবণের দুধের মধ্যে বিষ মিশিয়ে তাকেও মারতে চেয়েছিলেন শ্রাবণের মা। এই সুযোগে শ্রাবণের মাকে পাগল সাব্যস্ত করে পাগলাগারথে পাঠায় শ্রাবণের বাবা। তারপর তিনি দেশ ছাড়েন, নতুন করে বিয়ে করেন। এদিকে শ্রাবণের ঠাঁই হয় নানা বাড়িতে, অযাচিত সদস্য হিসেবে। ছোট্ট শ্রাবণ সচক্ষে মায়ের হিংস্র রুপখানা দেখেছিলো। নিজ চোখে দেখেছিলো মায়ের সেই অসহায় আকুতি, তার উন্মত্ত ভালোবাসার ফল আর বিশ্রী পরিণতি। শ্রাবণের মা পাগলখানায় আত্মহত্যা করেন। শ্রাবণ তার বাবাকে ঘৃণা করে। তাই তার জীবনের প্রথম হত্যাটাও ছিলো তার বাবা। শ্রাবণের মতে সেই লোকের বাঁচার কোনো অধিকার নেই। এই পৃথিবী ভালো মানুষের, নরকীটের জায়গা এখানে নেই। শ্রাবণের এই আঁধারের জীবনে চারু একদলা উষ্ণ কিরণ। যাকে শ্রাবণ নিজের মধ্যে আটকে রাখতে চায়। যার কোলে মাথা রেখে নিজের তিক্ত স্মৃতি ভুলে শান্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারে। চারুর শুভ্রতায় শ্রাবণ ভুলে যায় তার জীবনের সব পাপ। তার জীবনের এখন একটাই কেন্দ্র তা হলো চারু, তার চারুলতা। তার জন্য নোংরা হতেও তার দ্বিধা নেই।
স্মৃতির তিক্ততা কাঁটলো যখন চারুর স্বর কানে এলো। পেছনে তাকালো শ্রাবণ। চারু একবার হাতের গ্লাসটা দেখে চোখ কুচকালো। তারপর এগিয়ে এসে গ্লাসটা ফেলে দিলো চোখের পলকে। কড়া স্বরে বললো,
“আর কখনো যেন এগুলো খেতে না দেখি”
শ্রাবণ হাসলো যেন। মাপা, অস্পষ্ট হাসি। চারু তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো,
“আমি কখনো আপনার অতীতের কথা জিজ্ঞেস করবো না। আমার কাছে সেগুলোর দাম নেই। আমার কাছে অতীত জানার থেকে আপনার সাথে ভবিষ্যতটা দেখা বেশি মূল্যবান। সরি”
“তুমি কখনো আমার কাছে ক্ষমা চাইবে না চারুলতা। আমার ভালো লাগে না। আমি যখন তোমার, আমার বিষাক্ত অতীতও তোমার। কিন্তু সেই অতীতটা তোমার উজ্জ্বলতাকে মলিন করে দিবে। আমার চারুলতাকে উজ্জ্বলই মানায়। তুমি উষাকিরণ আমার নিকষ কালো জীবনে। মনে থাকবে?”
“থাকবে”
বলেই চারু জড়িয়ে ধরলো শ্রাবণকে। শ্রাবণ নিজের বাহুবেষ্টনীতে আবদ্ধ করলো থাকে। মিশিয়ে ফেললো নিজের বলিষ্ট বুকের মাঝে। গাম্ভীর্যের বলয়টা অক্ষত রেখে গাঢ় স্বরে বললো,
“কখনো যদি জানতে পারো আমি খুব খারাপ, আমাকে ঘৃণা করো না চারুলতা। মনে রাখবে, আমি পৃথিবীর সর্বনিকৃষ্ট মানুষটিও হতে পারি, চারুলতা তোমার জন্য”
।।সমাপ্ত।।
মুশফিকা রহমান মৈথি