চিত্তনামা পর্ব-০১

0
1

#চিত্তনামা —০১
#প্রানেশা_আহসান_শীতল

“আমি একটা মেয়েকে পছন্দ করি বাবা, সেখানে অন্য আরেকজনের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছ? তুমি আমাকে একবারও জিজ্ঞেস করেছ?”

ছেলের কথা শুনে নাজিম সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে বলে—–

“দেখ নাশফিয়ান, আমি তোমার বাবা। আমি তোমার জন্য যা নির্বাচন করব তা নিশ্চয়ই তোমার জন্য ভালো কিছুই বয়ে আনবে… তাই এসব করেছি!”

“তাই বলে জোরপূর্বক…”

নাশফিয়ানের কথা সম্পূর্ণ করার পূর্বে আনজুম বেগম এসে টেবিলের উপর চা রাখলেন তারপর বিরক্ত কণ্ঠে বলে—–

“আহ, নাশফিয়ান, বাবা যা বলছে শোন একটু; দেখা করে আসলে এমন কিছুই হবে না।”

একটা শ্বাস ফেলল তারপর এখান থেকে উঠে চলে যায় নাশফিয়ান। নাজিম সহেব বিরক্ত নিয়ে বলে—–

“দেখেছ? আরও আদর দেও তোমার ছেলেকে; এত আদর দিয়েই একেবারে অবাধ্য বানিয়েছ তুমি।”

আনজুম বেগম গায়ে লাগালেন না কথা, উল্টো বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলে—–

“অবাধ্য হলে আনজুমের ছেলে, বাধ্য হলে নাজিম সাহেবের ছেলে!”

নাজিম সাহেব আর জবাব করলেন না। উঠে চলে গেলেন৷ সে চলে যেতেই আনজুম বেগম এদিক সেদিক তাকিয়ে বলে—–

“সব ড্রামাবাজের দল!”

——–

“আমি বিয়ে করতে চাই না আম্মু। আমি আগে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করবো তারপর এসব নিয়ে ভেবে দেখবো।”

ইনতিহার কথার বিপরীতে সাবিনা বেগম কিছু বলার আগেই দাদী খ্যাক করে উঠে তারপর বলে—–

“মাইয়া মানুষ এতো পড়ালেহা কইরা কি হইব? ওই যাইয়া তো হউরবাড়ির বাসুনই মাজতে হইব, তা তুমি যতবড় ডক্টরই হও না কেন।”

ইনতিহার বিরক্তি নিয়ে উঠে চলে গেল। এখানে কথা বলাই বেকার। তা দেখে সাবিনা বেগম ঘুরে দাদীর দিকে তাকিয়ে বলে—–

“মেয়েটাকে একটু বুঝাতে চেয়েছিলাম আম্মা। আর আপনি উল্টো মেয়েটাকে চেঁতিয়ে দিলেন।”

দাদী মুখ কুঁচকালেন। তারপর বলেন—–

“বয়স কম তো। রক্ত গরম এট্টু পরই ঠিক হইয়া যাইবো চিন্তা কইরো না। আমার আলমারিতে একটা নীল কাফুর আছে ওইটা পইড়া যাইতে কইও।”

কথাটা বলেই মুখে পান গুঁজলেন সাবিনা বেগম। সাবিনা বেগম হতাশ শ্বাস ফেলল। এই বাড়িতে এত বছর সংসার করেছে অথচ কার মনে কখন কি চলে বুঝাই মুশকিল। তাই সেখান থেকে চলে যোয়ে রান্নাঘরে ঢুকলেন তিনি।

——-

ফোন বেজে উঠতেই দ্রুত ফোনটা রিসিভ করে নাশফিয়ান। তারপর দ্রুত বিপরীত থাকা মানুষটিকে উদ্দেশ্য বলে—–

” বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে। কিছুতেই আমার কথা মানতে চাইছে না। আমি কি করব? একটু পরই দেখা করতে যেতে হবে মেয়েটার সাথে!”

কলের বিপরীত থাকা ব্যক্তিটির অভিব্যক্তি বোঝা না গেলেও নাশফিয়ান একটু শান্ত হল। তারপর বলে—-

“আচ্ছা। একটা বাজে ইমপ্রেশন দিলেই তো মেয়েটা নিজে থেকে ক্যান্সেল করে দেবে। আমি এতো বাজে বকছি কেন! আচ্ছা রখছি!”

কথাটা বলেই কলটা বিছিন্ন করার আগেই নিজের এক্সাইটেডমেন্ট কমাতে না পেরেই ফোনের উপর চুমু দিয়ে বসে আবারো ছেহ্ ছেহ্ করে যে সে ভুল করে ফেলেছে।

ফোনের লাইন বিছিন্ন করে সময় দেখে এখন সাতটা। নাশফিয়ান কিছুক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে ভাবে তারপর বলে—–

“এখন বিয়ে ক্যান্সেল করানোর জন্য নিজেকে ছাপ্রি আর ক্রিজ উপস্থাপন করা লাগবে… হাহ্ এই দিনও দেখা লাগল দ্যা গ্রেট নাশফিয়ান যাওফিন এর?”

খুঁজে খুঁজে একটা সাদা টিশার্ট বের করে একটা কালো জ্যাকেট বের করে। প্যান্ট পড়ে একটা সানগ্লাস লাগিয়ে নিজেই কিটকিট করে হেসে বলে—–

“রাতের বেলা সানগ্লাস কে পড়ে?!”

এটা বলে আবারো নিজে নিজেই হেসে বলে,

“কুল নাশফিয়ান। ইট’স ওকে। এমন উল্টাপাল্টা চালচলন দেখলে মেয়েটা তোকে রিজেক্ট করে দেবে।”

কথাটা বলেই নিজে রেডি হয়ে পারফিউম লাগিয়ে গাড়ির চাবি নিয়ে বেড়িয়ে যায়। যাওয়ার সময় মায়ের সাথে দেখা করে বলে—–

“আম্মা দোয়া করে দেও যাতে মেয়েটা রিজেক্ট করে দেয়!”

আনজুম বেগম ছেলেকে দেখে হা করে তাকিয়ে থেকে বলে,

“সে না হয় করবো। কিন্তু তুই এসব কি সেজেসিস আব্বা? কেমন দেখাচ্ছে।”

নাশফিয়ান চওড়া করে হেসে বলে—–

“এমন দেখার জন্যই পড়েছি। এখন আমি গেলাম টাটা।”

কথাটা বলেই নাশফিয়ান টেবিলের উপর থেকে একটা আপেল তুলে চলে নিয়ে খেতে খেতে চলে যায়। এদিকে ছেলের কর্মকাণ্ড নিয়ে ভীষণ চিন্তিত আনজুম বেগম।

————-

“আম্মা বললাম তো পারব না! তোমাদের এত কথায় দেখা করতে রাজি হয়েছি৷ তাই বলে এখন শাড়ি পড়তে হবে, এটা কোথাকার নিয়ম?”

“দেখ তুই কি চাস তোর জন্য তোর বাবার অপমান হোক? এখন যদি তুই দেখা করে আসার পর তোর বাবাকে ওইপাশ থেকে কিছু বলে ভালো লাগবে?”

“না লাগবে না।”

“তাহলে পড়ে নে মা না আমার ভালো।”

গোমড়ামুখে শাড়িটা টেনে নেয় ইনতিহা। তা দেখে সাবিনা বেগম হেসে চলে যায়। যাক এবার শুধু সব ঠিক হোক৷ ভালো দিন দেখে মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে দেবে তাহলে…!

———

জ্যামের মধ্যে বসে আছে নাশফিয়ান। এর মধ্যে গাড়ির জানলায় কেউ টোকা দিলে কি মনো করে জানলার কাচঁ নামায়, দেখা মেলে এক বাচ্চা ছেলের সে নাশফিয়ানের দিকে দুটো সাদা ও গোলাপি মিশেল রংয়ের গোলাপ আর বেলীফুলের গাজরা এগিয়ে দেয়। নাশফিয়ান না করতে যেয়েও ছেলেটার মুখ দেখে বলে,

“গোলাপ যতগুলো আছে, সব গুলো দিয়ে দেও।”

কথাটা বলেই টাকা এগিয়ে দেয়। ছেলেটাও খুশি মনে সব গোলাপ এগিয়ে দিয়ে টাকা নিয়ে ভো দৌড়ে চলে গেছে। নাশফিয়ান দেখলো তারপর গাড়ির জানলা উঠিয়ে দিয়ে সব গোলাপ গাড়ির সামনের স্থানে জায়গা করে দিয়ে রেখে দেয়। ততক্ষণে জ্যামও ছেড়ে দিয়েছে। শ্বাস ফেলে আবারও গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ক্যাফের দিকে রওনা দেয়।

অনেকটা সময় ধরে নর্থ এন্ড ক্যাফেতে বসে আছে ইনতিহা। সাথে একবার কোল্ড কফি খাওয়াও শেষ অথচ এই লোকের হদিশ নেই। ইনতিহা ফিউচার ডক্টর। সে জানে প্রতিটা সময়ের মূল্য কতটা দামী, আর শেষে কিনা বাবা এমন একটা ইউজলেস, আনডিসিপ্লিন লোকের সাথে তার বিয়ে ঠিক করেছে? টেডিওউস!

কথাটা ভাবতেই এক উদ্ভট দেখতে লোক রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করলো। ইনতিহা লোকটা দেখে মনে মনে ভাবে, এটা যদি ওইলোক হয় তাহলে আরো আগে রিজেক্ট। আরো আগে এই বিয়েতে সে রাজী না। তার মতো একজন ডক্টর বিয়ে করবে এমন টাইমের মানে না বোঝা ছাপ্রিদের মতো ড্রেসিংসেন্স ওয়ালা লোককে? অসম্ভব! ম রে গেলেও না! কথাটা ভেবেই চমকে দাড়িয়ে যায় ইনতিহা।

নাশফিয়ান থমকে দাঁড়িয়ে যায়। ইনতিহাকে দেখে সে এখন পাড়লে দৌড়ে এই রেস্টুরেন্টের বাহিরে চলে যায়। আচ্ছা এই মেয়েই কি সেই মেয়ে, যার সাথে বাবা বিয়ে ঠিক করেছে? এটা ভেবে নিজের দিকে তাকায়; একটা ছেঁড়া ফাঁড়া স্টাইলিস জিন্স প্যান্ট, একটা লাল জুতা, সাদা টিশার্ট আর তার উপরে জ্যাকেট। আল্লাহ! এখন নাশফিয়ানের মনে হচ্ছে গড়াগড়ি দিয়ে ফ্লোরে কান্নাকাটি করতে। এই মেয়েই সেই মেয়ে, যেই মেয়েকে নাশফিয়ান পছন্দ করে। আর এই মেয়ের সামনেই… আল্লাহ মান ইজ্জত শেষ! মেয়ে রিজেক্ট করলেও যেভাবেই হোক বাবাকে পটিয়ে এই মেয়েকে বিয়ে করতে হবে। আর ইনতিহা নাশফিয়ানের সব কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে মনে মনে বলে, ” হ্যান্ডসাম। কিন্তু এই ছাপ্রড়িকে আমি বিয়ে করবো না৷ আবারও রিজেক্ট।”

নাশফিয়ান জোড় পূর্বক হেসে এগিয়ে এসে বলে —

“হায় আমি নাশফিয়ান যাওফিন!”

“তো?

বোকা হয়ে যায় নাশফিয়ান হুট করেই ভরকনো গলায় বলে – “হু?”

শক্ত গলায় জবাব এলো,
” তো? আমি কি করবো?”

নার্ভাস হলো নাশফিয়ান তবুও হেসে বলে,

“আপনি ইনাম আংকেলের মেয়ে না? ক্যান আই হ্যাভ এ্য সিট?”

এইবার একটু গুরুত্ব দিয়ে বলে,

” ও হো আপনি? আচ্ছা বসুন!”

সাথে সাথেই নাশফিয়ান হেসে চেয়ার টেনে বলে,

“আসলে রাস্তায় অনেক জ্যাম তাই দেরি হলো। নাহলে আরো…!”

“আপনি জানেন আপনার এই দেরীতে আমার জীবনে কতটা সময় নষ্ট করেছেন?”

হা করে তাকায় নাশফিয়ান তারপর বলে,

“হ্যাঁ? কি?”

“আপনি আমার জীবনের ছাব্বিশ মিনিট এগারো সেকেন্ড নষ্ট করপছেন। এখন আপনাকে শাস্তি হিসেবে কি দেয়া উচিত?”

সাথে সাথেই নাশফিয়ান অবাক মুখে তাকিয়ে বলে,

” শাস্তি?”

” জ্বি শাস্তি।”

নাশফিয়ান মুচকি হাসল তারপর বলে,

” ওয়েট আই হ্যাভ ওয়ান থিং ফর ইউ!”

কথাটা বলে ক্যাফ থেকে বেড়িয়ে এসে গাড়ির কাছে যে সব গোলাপ গুলো নিয়ে এসে টেবিলে। সবাই অবাক চোখে তাকায়। ইনতিহাও অবাক চোখে তাকায় আর অস্ফুটে বলে —- ” রোজেস? ”

“ইয়েস… ম্যাডাম, ফর –
বিরবির করে বলে, “মাই রেজ!”

চলবে।