চিত্তে অঙ্কিত কৃষ্ণরেখা পর্ব-২০+২১

0
383

#চিত্তে_অঙ্কিত_কৃষ্ণরেখা
#পর্বঃ|২০|
#ফাহমিদা_নূর

হানিফা বেগমের কক্ষ নিচের ফ্লোরে অবস্থিত ।যেখান থেকে ড্রয়িং রুম নজরে আসে।দ্বোরের সামনে ঝুলন্ত পর্দার আড়াল থেকে দুচোখ বের করে জহুরি দৃষ্টিতে সেখানকার পরিস্থিতি অবলোকনের চেষ্টা করছে চম্পা। হানিফা বেগমের পায়ে তৈল মালিশ করে দিচ্ছিলো সে।হঠাৎ কাঁচের ন্যায় কিছু ভাঙচুরের শব্দ কর্ণকোহর হতেই দ্রুত বেরিয়ে আসতে চাইছিলো মেয়েটা।কিন্তু পথিমধ্যে পদযোগল থামিয়ে দেয় ড্রয়িং রুমে শ্রেয়াণের সাথে প্রথাকে একত্রে দেখে ।আর বেরিয়ে আসা হয়নি মেয়েটার।আড়াল থেকেই রপ্ত করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। পেছন থেকে হানিফা বেগম ডেকে উঠল —“ কি রে চম্পা,চুরের মতো উঁকি দিয়ে কি দেখছিস?

চোখ মুখ কুঁচকে পেছনে ফিরল চম্পা। একপল দ্বোরের বাইরে চেয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে পরপর এগিয়ে গেল তার দিকে।বুড়ি হলো ঠিকই কিন্তু গলায় ধাঁচ যেনো কমেনি‌।আরেকটু আওয়াজ হলে নিশ্চয়ই ড্রয়িং রুম অব্ধি চলে যেতো, তখন যদি আপামনি এসে জিজ্ঞেস করে –চম্পা দাদু কি চুরির কথা বলছে রে? তখন চম্পা কি জবাব দেবে?এটাই যে–আপনাদের দুজনের মাঝে কি বিনিময় হচ্ছে সেটা ঠাহর করার সামান্য চেষ্টা করছিলাম!
মনে এলোমেলো ভাবনার ছন্দ নিয়ে হানিফা বেগমের পায়ের কাছে বসল।বাটি থেকে সরিষার তেল তুলে পায়ে মেজে দিতে দিতে আপন মনে বলে উঠে চম্পা –“ বুড়ি তোমার গলা এতো বড়ো কেনো? একটু ছোট করলেও তো পারো, নাকি?

তেতে উঠলেন হানিফা।বললেন–“ দেবো এক থাপ্পর! ফাজিল মেয়ে একটা!নড়া চড়া তো ভালো মতন করতে পারি না, এখন কি তোর জন্য কথা বলাও বন্ধ করে দেবো?

–“ কৌ কি দাদিজান?আমি তোমারে কথা কইতে মানা করলাম কহন? খালি কইছি ভলিউম কমাই দিতে!

গাট্টা পড়লো চম্পার বিনুনি যুক্ত মাথায়।শুনা গেল হানিফা বেগমের গলার স্বর –“ তোকে না কতোবার বলেছি,এই ভাষায় কথা বলবি না?এতো বছর ধরে শহরে আছিস, তবুও ভাষা পাল্টাতে পারলি না?

–“ দাদিজান, নিজের মাতৃভাষায় কথা বলে যেই সাধ,এইডা কি শুদ্ধ ভাষায় কইয়া পাওয়া যাইবো?
–“ তাও ঠিক!
–“হ!

°

ঠোঁটের কোণে অমায়িক হাসি ঝুলিয়ে অপলক চেয়ে আছে শ্রেয়াণ। দৃষ্টি তার স্নিগ্ধ।প্রথা একমনে তার সামনে বসে আলতো হাতে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে । খোঁপা হতে ছোট ছোট চুল গুলো ছুটে এসে কপালে উপচে পড়ছে,আর প্রথা ক্ষণে ক্ষণে ডান হাতের পিঠে সেগুলো পেছনে ঠেলে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে।রমণীর কপালে মুক্তর ন্যায় চিকচিক করছে ঈষৎ জল বিন্দু।নাকের ডগাতেও জমেছে ঘামের পরশ।দেখতে দেখতে অচেতন মনেই প্রথার গালে হাত নিয়ে যায় শ্রেয়াণ। সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁড়া পরলো হাতে। আশাহত হয়ে হাত গুটিয়ে নিল,বলল–“ ব্যাথা!

চোখ মুখ কঠিন করে মাথা তুলল প্রথা। হিসহিসিয়ে বলল–“ খুব বাহাদুর মনে হয় নিজেকে, না?আরেকটা দিই গ্লাস? চেপে ভেঙে ফেলুন আর নিজেকে অধৈর্য,রাগী প্রমাণ করুন?

প্রথার নাক টেনে দিতে দিতে বলল–“ এমন ভালোবেসে কেউ যদি ব্যান্ডেজ করে দেয়,তাহলে আরেকটা গ্লাস ভাঙতে ক্ষতি কী?

ক্ষতস্থানে চেপে ধরতেই মৃদু চেঁচিয়ে উঠে শ্রেয়াণ।
–“ কি করছো জান?উপরে পাঠিয়ে দেয়ার পাঁয়তারা করছো নাকি?আমি কিন্তু তোমায় ছাড়া একা একা আর কোথাও যেতে পারবো না!

–“ চুপ করুন তো,সব সময় মজা আমার ভাল্লাগে না!

–“ তাহলে কি ভাল্লাগে?
ফের কঠিন চোখে তাকালে শ্রেয়াণ প্রসস্থ শ্বাস ফেলে মুখ বাঁকিয়ে বলে–“ ঠিক আছে বলতে হবে না!

মাথা নামিয়ে ব্যান্ডেজ করায় মনোযোগ দেয় প্রথা।না চাইতেও ঠোঁটে হাসি খেলা করছে। ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে রয় শ্রেয়াণ।খানিকটা সময় অতিবাহিত হতেই আচমকা হুট করে ঠোঁট বসায় প্রথার ডান গালে।নিজ কাছ সম্পন্ন করে প্রথার ভাবমূর্তি দেখার অপেক্ষায় রয়,আশ্চর্য!প্রথা চোখ রাঙালো না বরং হাসল মৃদু। আশ্কারা পেয়ে বসলো শ্রেয়াণ। দ্বিতীয় বার ঠোঁট বসাতে ঝুঁকতেই প্রথা ফট মাথা উপরে তুলে।চোয়ালের সাথে মাথার দ্বন্দ্ব গেলে আওয়াজ হলো মৃদু–“ ওহ,নো!

একজন চোয়ালে হাত রেখেছে, তো অন্যজন মাথায়।শ্রেয়াণ চোখ কুঁচকে মুখে হাত ঘষে বলে–“ এখনি মাথা তুলতে হলো,দিলে তো চোয়াল নড়বড়ে করে?

প্রথার হাতে তখনো শ্রেয়াণের আঘাতপ্রাপ্ত হাত মুঠোবন্দী ছিল।সেটা ফিরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে রাগত স্বরে বলে–“ শুধু নড়বড়ে না,খুলে চলে আসা উচিত ছিল!

–” কিহ!এতো বড়ো কথা?
–“ আমার সামনে একদম ঢং করবেন না বলে দিলাম! এমনিতেই হাতির মতো শক্ত চোয়াল দিয়ে একটুর জন্য মাথা গুঁড়িয়ে দেন নি!

এই পর্যায়ে অমায়িক হাসল।প্রথার দিকে হাত বাড়িয়ে নমনীয় গলায় বলল–“ কাছে এসো,আদর দিয়ে শোধ বোদ করে দিই?

একবার মুখের দিকে পরপর হাতের দিকে চেয়ে আলতো ঘুষি বসায় প্রথা। চোখ রাঙিয়ে বলে–“ লাগবে না!

–” কিন্তু আমার তো দিতে ইচ্ছে করছে। ইশশ্ কতো বছর ধরে জমে আছে!জমতে জমতে পাহাড় সম হয়ে উঠেছে বোধ হয়!

দুহাত কিড়মিড়িয়ে প্রথা শ্রেয়াণের মুখোমুখি এগিয়ে যায়।

–“ তোমরা দুজন টম এন্ড জেরির মতো কি নিয়ে ঝগড়া করছো?

দুজন একসাথে ফিরে তাকায়। সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে নেহমাত।দু গালে দু’হাতের তর্জনী ঠেকিয়ে ঠোঁট চুকা করে তাদের দিকে চেয়ে আছে। শ্রেয়াণ বাঁকা চোখে প্রথার দিকে তাকিয়ে মুখে ফুঁ দিয়ে নেহমাতের কাছে যায়।কোলে তুলে নিয়ে বলে–“ অ্যাঞ্জেল তুমি কখন নিচে নামলে?

–“ এক্ষুনি।আর এস্যে দেখ্যি তোমরা দুজন ঝগড়া করছ্যো?

–“ ওটা ঝগড়া ছিল?
পরপরই বলে–“ না নাহ! ঝগড়া করছিলাম না তো! তোমার মাম্মি শুধু শুধু বকছিল আমায়!

নেহমাত ঘাড় কাত করে মায়ের দিকে তাকায় চোখ কুঁচকে ঘন ঘন পলক ঝাপড়ে। থমথমে খেয়ে যায় প্রথা। অ’প্রস্তুত গলায় বলে–“ আজব! শুধু শুধু কেউ কাউকে বকে নাকি?
বলেই শ্রেয়াণের উদ্দেশ্যে তাকায় আক্রোশান্বিত চোখে। ঠোঁট গোল করে চুমু দেখায় শ্রেয়াণ। যেটা প্রথা কে আরো রাগিয়ে দিতে সহায়তা করে।

–“ পাপা তোমার হাত্যে ব্যান্ডেজ এলো কিভাব্যে? একটু আগে ত্যো ছিল না?

প্রথা নিকটে চলে আসে তাদের। হেঁয়ালি স্বরে বলে–“ মেয়ের কথার জবাব দিন বাহাদুর পাপা?

মাথা চুলকে প্রাণবন্ত হাসলো শ্রেয়াণ। অতঃপর সেই হাতে প্রথার কাঁধ জড়িয়ে এগুতে এগুতে বলে–“ চলো রুমে যেতে যেতে বলি?
প্রথা ছুটে আসতে চাইলো কিন্তু শ্রেয়াণ আসতে দিল না। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল তিনজন।যেতে যেতে বলল–“ তোমার মাম্মি বায়না ধরেছিল আমার হাতে কাঁটা এ্যাপেল খাবে।আমি যেহেতু তাকে ভীষণ ভালোবাসি তাই না করতে পারিনি। কিন্তু এ্যাপল কাটতে গিয়ে ছুরিটা হাতে লেগে গেলো ভুলবশত আর কুটুস করে হাতটা কেটে গেলো!

–“ ব্যাথ্থ্যা পাওনি?
–“ একটুখানি।
–“ মাম্মি এটা কিন্তু একদম ঠিক হয়নি।তোমার জন্যই কিন্তু পাপা হাত কেটেছে!
–“ আমার জন্য?
–“ তোমার জন্যই তো..
–“ থাক ,মাম্মি কে কিছু বলো না অ্যাঞ্জেল। অনেক দিন পর পাপা কে পেয়ে মাম্মি এইটুকু চাইতেই পারে!আমি কিছু মনে করিনি, শুধু খাবার খাইয়ে দিলেই হবে!
–“ পারবো না!
–“ দেখেছো অ্যাঞ্জেল।মাম্মি পারবে না? হয়তো ভালোই বাসে না আমায়!
–“ মাম্মি তুমি পাপা কে খাবার খাইয়ে দিবে। ইটস্ মাই অর্ডার!
–“ থ্যাঙ্কস মাই অ্যাঞ্জেল।লাভ ইউ!
–“ লাভ ইউ ঠ্যু পাপা!

হাঁটা থামিয়ে প্রথা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।তাকায় শ্রেয়াণ।
–“ কি হলো দাঁড়িয়ে পড়লে যে?
প্রথা উত্তর দেয় না।শ্রেয়াণ বিজ্ঞদের মতো বলে–“ ওও, অ্যাঞ্জেল কে লাভ ইউ বলেছি কিন্তু তোমায় বলিনি তাই অভিমান জমেছে?কোন ব্যাপার না এখুনি বলছি– লাউ ইউ প্রথা। অ্যাঞ্জেল তুমিও বলো!

–“ লাভ ইউ চ্যু মাচ মাম্মি!

–” একটা কিসিও দাও।
নেহমাত শ্রেয়াণের কোল থেকে ঝুঁকে প্রথার গালে শব্দ করে চুমু দিয়ে বলে–“ পাপা তুমিও একটা দাও।

–“ আর ইউ শিওর?
–“ অফকোর্স!

সুযোগ হাত ছাড়া করে না শ্রেয়াণ।টুপ করে ঠোঁট বসিয়ে দেয় প্রথার বা গালে।জোরে জোরে শ্বাস টানছে প্রথা।চোখে জলের আবাস। বিচলিত হয় বাবা মেয়ে দুজন–“ এই তুমি কাঁদছো?
–“ মাম্মি তুমি কাঁদছো কেন?আমরা কি ভুল করেছি?

ঠোঁট কামড়ে কতোক্ষণ অপলক শ্রেয়াণের দিকে চেয়ে থেকে হুট করে দুজন কে জড়িয়ে ধরে প্রথা।

–“ এই বোকা?মেয়ের সামনে কাঁদছো কেন?ও কি ভাবছে বলো তো?
প্রথার মাথায় হাত বুলিয়ে কানের কাছে বলল শ্রেয়াণ।প্রথার কান্না আটকে রাখা দায় হয়ে পড়েছে।ধরে আসা গলায় ছোট স্বরে বলে–“ এই মুহূর্তে একটা জিনিস নিয়ে খুব আফসোস করতে ইচ্ছে করছে–সবটা যদি আরো আগে মিটে যেতো?এমন সুন্দর মুহূর্ত গুলো যদি আরো আগে ধরা দিত?আজকের এই মুহূর্তের কাছে গত পাঁচ বছরের সুন্দর সময় গুলো ফিকে লাগছে খুব।
–“ আজ থেকে সব সুন্দর হবে।আই প্রমিজ ইউ। প্লিজ কেঁদো না।যা হয়েছে সব ভুলে যাও!

–“ মাম্মি!তুমি কাঁদলে আম্যিও কেঁদ্যে দিবো কিন্তু!

চোখের জল মুছে হাসার চেষ্টা করে প্রথা।মেয়েকে জড়িয়ে ধরে মুখে চুমু দিতে দিতে বলে –“ এই যাহ!আর কাঁদবো না!

–“ অ্যাঞ্জেল,মাম্মি করিডোরে কান্না জুড়ে দিয়েছে? নিশ্চয়ই চকলেটের কথা মনে পড়ে গেছিলো হঠাৎ,তাই না?ইশ্ আমিই আনতে ভুলে গেছিলাম।

প্রথা চোখ উল্টিয়ে তাকায়। শ্রেয়াণ রুমের দ্বোর খুলতে খুলতে বলে–“ তুমি কখনো মাম্মির মতো মাঝ পথে কান্না করেছিলে চকলেটের জন্য?

–“ না,তো!মাম্মি চকলেটের জন্য কাঁদছিল্যো এতোক্ষণ?
চোখ পাকিয়ে তাকায় নেহমাত।মুখে আশ্চর্যের রেশ।প্রথা চিমটি কাটল শ্রেয়াণের হাতে।

–“ তা আর বলতে?

দৌড়ে বেডের উপর উঠে লাফাতে লাফাতে খিলখিল হেসে উঠল নেহমাত, বলতে লাগলো –“ ছিঃ ছিঃ মাম্মি!তুমি বেবীদের মতো চকলেটের জন্য কাঁদছিলে!

শ্রেয়াণ নিজেও যুক্ত হয় মেয়ের সাথে।বেডে বসে আড়চোখে শ্রেয়াণের দিকে তাকিয়ে প্রথা বলে–“ তো কাঁদবো না? চকলেট আনবে বলে আনে নি কেন তোমার পাপা?

–“ অ্যাঞ্জেল,মাম্মি কে বলে দাও যে,পাপার দাবি মেনে নিলে চকলেটের গোডাউন এনে হাজির করবে।

–“ কেমন দাবি?

নেহমাত নিজেও জানতে চায়।
–“ এই যে একটু আগে মাম্মি কে পাপা লাভ ইউ বললো,কিসও করলো কিন্তু মাম্মি একটাও রিটার্ন দেয়নি অথচ অ্যাঞ্জেল কে দিয়েছে!

–” তাই তো!মাম্মি তুমি পাপা কে সব রিটার্ন করো।

–“ হোয়াট!আমি পারবো না!
কাঁধ দুলিয়ে বলল প্রথা। শ্রেয়াণ মেয়ের দিকে চেয়ে অসহায় মুখ করে বলল–“ দেখেছো অ্যাঞ্জেল?তুমি বাদে কেউ ভালোবাসে না আমায়! ব্যাপার টা জেনে খুবই দুঃখ পেলাম!

সরু দৃষ্টিতে তাকায় প্রথা। মনের ভেতর হাজার বকা দিয়ে দিচ্ছে শ্রেয়াণকে।এতোটাও ড্রামাবাজ হতে হয়?মেয়ের সামনে আজ ভালোবাসি শব্দটা বের করিয়েই ছাড়বে নিশ্চই?ঢুক গিলে ফাঁকা।

–“ দেখো পাপা দুঃখ পাচ্ছে!তুমি তাতাড়ি লাভ ইউ বলে দাও আর কিসি ফিরিয়ে দাও!

–“ আমি দিতে বলেছিলাম একবারো?নিজ থেকে দিয়ে আবার ফেরত চাইছে কেনো?

–“ মাম্মি,নো চিটিং!
–“ চিটিংয়ের কি করলাম?
–” ফাস্ট রিটার্ন করো,আমি দেখার জন্য বসে আছি কিন্তু!

গলা পরিষ্কার করে নিল প্রথা। চোখ বুজে ইতস্তত গলায় বলল–“ ভ্ ভালোবাসি!

দুহাতে মুখ ঢেকে রেখেছিল সে।ভালোবাসি শব্দ টা বলার পর এক হাতের আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে দেখে শ্রেয়াণ সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে এদিক ওদিক নজর বুলাচ্ছে। ভাবখানা এমন যেন — প্রথার কথাটা তার জন্য ছিলই না!মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখে–সেও পাপা কে নকল করছে। আশাহত হয় প্রথা।মুখ থেকে হাত সরিয়ে বলে –“ কি বলেছি শুনতে পাননি?

–“ আমাকে বলছিলে?

শ্রেয়াণের নির্বিকার ভঙ্গি দেখে অকারণেই মেজাজ বিগড়ে গেলো প্রথার।হাতের নাগালে পাওয়া বালিশ নিয়ে তেড়ে যায়। পিঠে এক নাগাড়ে আঘাত করতে করতে বলে–“ আই লাভ ইউ! আই লাভ ইউ! আই লাভ ইউ!

°

বিকেলের সূর্য তার আলোক রশ্মি ক্ষীণ করে এনেছে। রূপালী আলোয় এক ধরণের নমনীয় ভাব বিরাজমান। চারদিকে পাখির কিচিমিচি শব্দের সাথে হিলমিলে বাতাস এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। পাশাপাশি হেঁটে চলছে আনার্সের সাথে শ্রেয়া।পড়নে সাদা পাড় নীল শাড়ি। খোঁপায় বেলী ফুলের গাজরা। চোখে গাঢ় কাজল।দেখতে ঠিক বাঙালি প্রেমিকার মতোই দেখাচ্ছে।আনার্স আজ কালো পাঞ্জাবি পড়েছে। ফুটপাত ধরে হাঁটছে দুজন।

–“ এই যে ডাক্তার বাবু, আপনি এবার যেতে পারেন!

থেমে তাকায় আনার্স।সাহসা ভ্রু কুঁচকে বলে–“ যেতে পারবে তো একা? ঠিকানা জানো ?

–“ চিন্তার কিছু নেই।মার কাছ থেকে ঠিকানা জেনে নিয়েছি!
–“ আমি পৌঁছে দিই?
–“ না,নাহ!দাভাই ওখানে আছে! দুজন কে একসাথে দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে!
তড়িৎ জবাব দেয় শ্রেয়া। তপ্ত শ্বাস ছেড়ে আনার্স বলে–“ ঠিক আছে।গাড়ি ঠিক করে দিচ্ছি !

°

দুমিনিট যাবৎ গালে হাত দিয়ে শ্রেয়া কে পরখ করে যাচ্ছে নেহমাত।শেষ বারের মতো উপর নিচ পর্যবেক্ষণ করে বলে–“ তোমায় কি নামে ডাকবো আমি?ম্যাম নাকি ফিফিন?

শ্রেয়া হাত বাড়িয়ে বলে–“ আগে কাছে এসো?
নিকটে যায় নেহমাত। শ্রেয়ার কোলে চড়ে বসে।

–“ অ্যাঞ্জেল,তুমি ওকে নাক বুচা ফিফিন বলে ডাকতে পারো!
শ্রেয়াণ ফোড়ন কেটে বলে। শ্রেয়া নাক ছিটকে আহ্লাদি গলায় হাক ছাড়ে–“ বৌ মণি?
প্রথা হাসি গোপন করে মেকি রাগ দেখিয়ে বলে–“ এই ,মেয়েকে কিসব বাজে কথা শেখাচ্ছেন?

–“ বাজে কোথায় দেখলে?এটা ইউনিক!তাই না অ্যাঞ্জেল?

ব্যাপার না বোঝেই উপর নিচ মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় নেহমাত।ভাইয়ের বাহুতে ঘুষি লাগায় শ্রেয়া।রাগ দেখিয়ে বলে–“ কি এক অ্যাঞ্জেল আমদানি করেছো, শুরু থেকে দেখতে পাচ্ছি — পাপার কথায় হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলাচ্ছে শুধু!
–“ দেখতে হবে না?এটা শ্রেয়াণ জাওয়ানের একমাত্র অ্যাঞ্জেল!
পরপরই নেহমাতের উদ্দেশ্যে বলে–“ অ্যাঞ্জেল,পাপার কাছে চলে এসো।ফিফিন পঁচা!

নড়েচড়ে বসে নেহমাত।চতুর নজর বুলিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে নেয়।সবাই তার প্রতিক্রিয়া দেখতে চেয়ে আছে। বিপাকে পড়তো বুঝি বাচ্চাটা।বাবার ডাকে সাড়া দিতে চাইছে কিন্তু ফিফিন কষ্ট পাবে দেখে চলেও যেতে পারছে না। ঠোঁট চুকা করে শ্রেয়ার দিকে তাকায়।হাসিই পাচ্ছে শ্রেয়ার তবুও মুখটা গম্ভীর করে রেখেছে।ভালোও লাগছে ভাইয়ের প্রতি নেহমাতের এতোটা টান দেখে!

–“ পাপা ডাকছে,যাই?
–“ যাবে?তবে,যাও।

মন খারাপের ভঙ্গিতে বলে শ্রেয়া।নেহমাত নেমে যায় তাকে ছেড়ে। শ্রেয়াণের কোলে বসে এক হাতে গলা জড়িয়ে অন্য হাতে মুখে তুলে ফ্লাইং কিস ছুটতে ছুটতে শ্রেয়ার উদ্দেশ্যে বলে–“ ফিফিন লাভ ইউ।উম্মাহ!

আশ্চর্য হয়ে ক্ষণকাল হা করে দেখে পরপর ই শব্দ করে হেসে উঠলো শ্রেয়া সহ সবাই।

–“ ব্রো, তোমার অ্যাঞ্জেল কিন্তু অ্যাঞ্জেল কেও হার মানাবে!

–“ হ্যাঁ। এখন সব ক্রেডিট দাভাইয়ের,না?আমি বানের জলে ভেসে এসেছি?

–“ বৌ মণি! পাঁচ বছর যাবৎ যে একাই সবার ক্রেডিট নিয়ে এসেছো ,সেটা আগে ক্ষয় হতে দাও।
তাদের কথার মাঝে সেখানে উপস্থিত হয় প্রতাপ চৌধুরী। শ্রেয়া তার সাথে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে অতঃপর খোশগল্পে মেতে উঠে সকলে।বাদ যায়না আদওয়া, চম্পাও।

°

মাঝে কেটেছে আরো দুদিন।এই দুদিন শ্রেয়াণ প্রথার বাসাতেই ছিল। সেখানে থেকেই অফিস করেছে।জে.কে কেও ট্রেক করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে।

বেলা আড়াইটা। শ্রেয়াণ নিজের অফিসে বসে কাজ করছিল এমন সময় সেখানে হন্তদন্ত পায়ে উপস্থিত হয় প্রথা।চোখ ফুলে লাল বর্ণ ধারণ করেছে তার। জমায়েত হয়েছে অশ্রু কণা।ভেতরে প্রবেশ করেই দুহাতে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে উঠলো প্রথা। অবাক হয় শ্রেয়াণ।আসন ছেড়ে প্রথার নিকটে পৌঁছে বাহু ঝাঁকিয়ে বলে–“ কি হয়েছে প্রথা? এভাবে কাঁদছো কেন?সব ঠিক আছে?

কান্নার দাপটে শব্দ গুলো গুঙানিতে পরিণত হয়েছে। কান্না আটকানোর তাগিদে মুখে হাত দিয়ে ক্রন্দনরত গলায় বলে–“ ন্ ন্ নেহমাত কে পাওয়া য্ যাচ্ছে ন্ না, শ্রেয়াণ!আমার মেয়ে..আমার প্ প্রাণ..

–“ পাওয়া যাচ্ছে না মানে?ওকে না সকালে স্কুলে দিয়ে এসেছি?

উপর নিচ মাথা নেড়ে প্রথা বলে–“ কিন্তু এখন নেই।আমি আনতে গেছিলাম কিন্তু ম্যাম বলেছে ওকে কেউ নিয়ে গেছে!
কান্না রত গলায় মৃদু চেঁচিয়ে বলল প্রথা।

–“ কেউ নিয়ে গেছে মানে? শ্রেয়া?
–“ নাহ!
–“ তাহলে কে নিয়ে গেছে। দ্রুত বলো?
শ্রেয়াণের গাঁ ঘেঁষে ফ্লোরে বসে পড়ল প্রথা। ঠোঁট কামড়ে বলল–“ রাউনাফ!

শ্রেয়াণ চেঁচিয়ে উঠে –“ হোয়াট?

#চলবে ইনশা-আল্লাহ
||ভুল ত্রুটি মার্জনীয়||

#চিত্তে_অঙ্কিত_কৃষ্ণরেখা
#পর্বঃ|২১|
#ফাহমিদা_নূর

নেহমাত কে পাওয়া যাচ্ছে না সংবাদ টি জাওয়ান বাড়িতেও পোঁছে গেল দ্রুত।জে.কে সম্পর্কেও কিছু কিছু অবহিত হয়েছে।যে থেকে সায়লা খানম কথাটি শুনেছে সেই থেকেই হা হুতাশ করে কান্না জুড়ে বসেছেন।তাকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে শ্রেয়া।নিকটেই কাঁচুমাচু মুখে বসে আছে নিলিশা।চোখে একধরণের শঙ্কা কাজ করছে তার।
–“দাভাই আছে তো মা!ও ঠিক তার অ্যাঞ্জেল কে খুঁজে বার করবে!
–“আমার খুব ভয় হচ্ছে! এতো দিন পর আমার ছেলেটা তার আপনজনের সান্নিধ্য পেয়েছে আর এখনই…
বলতে বলতে আঁচলে মুখ গুঁজে কেঁদে উঠলো সায়লা। চারপাশের পরিস্থিতি ভারি ভারি লাগছে।

–“তোর বাবা কোথায়?কাল থেকে বাসায় ফিরে নি মানুষ টা!কল ও করলো না একবার।
চোখ মুছে জানতে চাইলো।

–“কি জানি বাবা কোথায়?

একটু পর কলিং বেল বেজে ওঠে । অনতিবিলম্বে ছুটে যায় শ্রেয়া‌।দ্বোর মেলে দেখে শাড়াত দাঁড়িয়ে আছে রক্ত চক্ষু নিয়ে। কিছু বলতে যাবে তার আগেই পাশ কাটিয়ে হন্তদন্ত পায়ে ভেতরে প্রবেশ করে শাহাদ। ড্রয়িং রুমে এসে এলোমেলো নজর নিক্ষেপ করে কাকে যেনো খুঁজলো। অতঃপর নিলিশার নিকটে এসে একটানে সোফা হতে দাঁড় করিয়ে ঠাস-স করে থাপ্পড় বসিয়ে দিল ডান গালে। আকস্মিক আক্রমণে মেয়েটা তাল সামলাতে না পেরে ছিটকে পড়ে গেল কিঞ্চিৎ দূরে টি টেবিলের উপর।সায়লা কান্না থামিমে মৃদু চেঁচিয়ে উঠল —“কি করছিস শাহাদ?ওকে মারছিস কেন?
আজ মা রূপি ছোট মায়ের কথা কর্ণকোহরে নিল না শাহাদ।এগিয়ে গিয়ে নিলিশা কে তুলে আবারো চড় দিয়ে চোয়াল চেপে ধরলো শক্ত করে।—“শ্রেয়াণের মেয়ে কোথায়?

বাকহারা হয়ে সায়লা চেয়ে রইলো শাহাদের দিকে। শ্রেয়া নিজেও হতভম্ব।তবে কিছুটা আন্দাজ করতে পারছে।নিলিশা ব্যাথায় চোখ খিচে নেয়। ব্যাথিত গলায় বলে—“আমি জানি না!আমার কাছে কেন জানতে চাইছো?

শাহাদ ক্ষোভে আরো শক্ত করে ধরলো চুলের গুচ্ছ।কঠোর গলায় বলল —“তুই ছাড়া আর কে জানবে, হ্যাঁ? সেদিন না ঔ জে.কের সাথে কথা বলছিলি তুই! শ্রেয়াণের কলিজায় আঘাত করবি বলেছিলিস না তখন, অকৃতজ্ঞের বা”চ্চা!বল ওর মেয়েকে কোথায় নিয়ে গেছে ওই জে.কে?

—“আমি সত্যিই জানি না !জে.কে’র সাথে সেদিনের পর আর কোন কথা হয়নি আমার!

–_“কি মনে হয় তোর কথা আমি বিশ্বাস করে নেব!আরে সেদিনই তো তোর উপর সকল আস্তা উঠে গেছে যেদিন জানতে পেরেছি– যে থালায় খাস সে থালাটাই ফুটো করে দিয়েছিস!

—“ ও কি করেছে?ওর সাথে এভাবে কথা বলছিস কেন শাহাদ!ছাড় বলছি?

নিলিশা কে ছাড়াতে হাত বাড়িয়ে বলল সায়লা।শাহাদ একবার তাকায় আহত চোখে,পরপরই ক্রুদ্ধ ধাঁচে বলল–“ আমায় আটকিউ না মা।সরে যাও তুমি!আজ ওকে আমি…
ক্রুদে কাঁপছে শাহাদ। ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাসের শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ঘরময়।কেবল বাকরুদ্ধ চোখে তাকিয়ে রয় সায়লা।শাহাদ বরাবরই শান্ত চিষ্ট স্বাভাবের। শান্তি বজায় রেখে চলতেই সাচ্ছন্দ্য বোধ করে।কখনো নিলিশার কে উচ্চ কন্ঠে ধমক দিতে শুনা যায়নি সেখানে আজ এমন উগ্র আচরণের কারণ ভেবে পায়না সায়লা। জানতে ইচ্ছে করছে খুব!
—“মাথা ঠান্ডা কর শাহাদ।ও কি ভুল করেছে সেটা বল আগে!
—“ভুল নয় মা! ক্রা/ইম করেছে ও! ক্রি/মি/নাল একটা!

রাগ যেনো মাথা ছাড়া দিয়ে উঠছে তার। নাসারন্ধ্র হতে ছিটকে আসা শ্বাস গুলো বড্ড ভয়ঙ্কর শুনাচ্ছে। শ্রেয়া খানিক এগিয়ে আসে।ধীমি আওয়াজ বলে–“শান্ত হও ভাইয়া!ভাবি কি করেছে বলো?

–“শান্ত হবো কিভাবে? ছোট বাচ্চাটা নিখোঁজ হওয়ার পেছনে কোথাও না কোথাও ওর হাত আছেই!

—“কি বলছিস তুই?নিলিশা কিভাবে…
—“হ্যা ও-ই!এই অকৃতজ্ঞ নারীই শ্রেয়াণের জীবন অন্ধকারে রূপান্তরিত করতে পাঁচ বছর যাবৎ ওই না দেখা না শুনা জে.কের সাথে যোগাযোগ রেখেছে। শ্রেয়াণের ক্ষতি করতে এই নারীই ওকে হ্যাল্প করেছিলো!

নিলিশার চোখ বেয়ে অনবরত অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ছে।খুব গভীর ভাবে খেয়াল করে দেখা যাবে তার চোখে অপরাধ বোধ, অনুতপ্ততা।সায়লা বিস্মিত চোখে চেয়ে থাকলো অপলক। আকস্মিক কথাটি বিশ্বাস করতে একটু কষ্ট ই হচ্ছে। শ্রেয়া কে কোন প্রতিক্রিয়া করতে দেখা গেল না।সে প্রথম দিকের মতোই শান্ত। সিঁড়িরঘরে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে কান্নারত ফিহাকে দুহাতে আগলে রেখেছে ফাইজা।তার দৃষ্টি ড্রয়িং রুমে মায়ের উপরেই নিবন্ধ।

–“শ্রেয়াণের মেয়েকে নিয়ে কোথায় গেছে জানলে প্লিজ বলো নিলিশা।শেষ বারের মতো জিজ্ঞেস করছি।যদি না বলতে পেরেছো তাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না!

–“আমি সত্যিই জানি না শাহাদ!

তাকে ছেড়ে দিল। চোখ বুজে প্রলম্বিত শ্বাস টানলো বার কয়েক। তারপর শিতল সুরে বলল শাহাদ—“আগের কোন ঠিকানা বা আড্ডাখানা সম্পর্কে কিছু বলেনি তোমায়?

আরো কিছুটা সময় গড়িয়ে গেল। পরিপক্ব হাতে ফুল স্পিডে ড্রাইভ করছে শ্রেয়াণ। শরীর ঘেমে জবজবে।মাথার পরিপাটি চুল গুলোও আজ এলোমেলো। কপাল ঘেঁষে কানের লতি পর্যন্ত ঘামের বিন্দু ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে পড়ছে।পাশেই বিরামহীন ফুঁপিয়ে চলেছে প্রথা।প্রলাপ বকছে বিভিন্ন। শ্রেয়াণ আহত চোখে তাকায় একবার।এক হাতে নিকটে এনে আগলে নিয়ে সান্ত্বনা বাণী দিয়ে বলে—“কাঁদছো কেনো বোকা মেয়ে?আমরা যাচ্ছি তো আমাদের মেয়ে কে ফিরিয়ে আনতে?

–“এতো নিখুঁত প্ল্যান করে যে এতো বছর ভালো মানুষের মুখোশ পড়েছিল।আজ খোলশ ছেড়ে বেরিয়ে এসে এতো সহজেই আমাদের পিছু ছাড়বে?আমার বাচ্চা কে ফিরিয়ে দেবে?

—“দেবে দেবে! তাকে দিতেই হবে!

শ্রেয়াণের কাঁধে মাথা রাখে নিরবে আশ্রু বিসর্জন দিতে মত্ত হয় প্রথা।–“আমার বাচ্চার কিছু হয়ে গেলে আমি বাঁচবো না শ্রেয়াণ। পাগল হয়ে যাবো আমি।

–“প্লিজ এভাবে ভেঙে পড়ো না। তুমি এমন করলে–দেখো আমি সাহস হারিয়ে ফেলছি!

তখন ই ফোনে কল আসে শ্রেয়াণের। তড়িৎ বেগে রিসিভ করে লাইড স্পিকার অন করে।
—“ঠিকানায় চলে আসছো তো ব্রো?

শ্রেয়াণ ক্রুদ্ধ বাঘের ন্যায় নিরব হুঙ্কার ছেড়ে দাঁতে দাঁত নিষ্পেষিত করে জবাব দিল;—“অচিরেই দেখা হচ্ছে তোর সাথে বা/স্টা/র্ড!
—“রিল্যাক্স ,এতো হাইপার হওয়ার কি আছে বুঝলাম না!
—“রাউনাফ! প্লিজ আমার মেয়ের কোন ক্ষতি করো না।ওকে কষ্ট দিও না প্লিজ!
ক্রন্দনরত গলায় আকুতি করে উঠে প্রথা। ওপাশ থেকে রাউনাফ হাসে কুটিল।—“কুল্ড প্রথা বেইব!আমি এখনো কিছু করিনি প্রিন্সেস কে। আফটার অল ও আমার আদরের প্রিন্সেস,তাকে কষ্ট দিলে আমারো বুকে জ্বালা করবে!

আবারো ফুঁপিয়ে উঠে প্রথা।বুকটা দুমড়ে মুচড়ে উঠছে বারবার। ছন্নছাড়া ছাড়া লাগছে সবকিছু।রাউনাফ বলে উঠে—“তোমরা একাই আসছো তো?নাকি স্পেশাল ফোর্সের কানে আমার নামে কুৎসা রটনা করেছো?আ হা! এমন কিন্তু ভুলেও করো না!মনে রেখো তোমাদের প্রাণ ভোমরা কিন্তু আমার হাতে!

—“আমরা একাই আসছি তুই ব্যাস আমার মেয়ের কোন ক্ষতি করবি না!
শ্রেয়াণ প্রত্যুত্তর করল।পিচেল হেসে রাউনাফ বলে–“বিশ্বাস থাকলে ভরসা দিতে পারি!

মুষ্টিবদ্ধ হাতে চোয়াল শক্ত করে রাখে শ্রেয়াণ।রাগের তুফে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় নিষ্ক্রিয় হয়ে আসতে চাইছে। নিজেকে সংযত করে বলে—“দেখা হচ্ছে শিঘ্রই!

বিশাল বড়ো গোডাউন। চারদিকে কেবল অন্ধকার আর অন্ধকার। কেমন গাঁ ছমছমে ভাব ধরিয়ে দিতে সক্ষম। সরু গলি টা আঁধারের ফলে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে ক্রমশই।শ্রেয়াণের বাহু খামচে ধরে প্রথা। গাঁ ঘেঁষে আরেকটু গভীর হয়। শরীরে কম্পন অনুভব হচ্ছে।পেছন থেকে পাঁচ জন এবং সামনে দুজন কালো মুখোশ ধারি তাদের দিশা খুঁজে দিচ্ছে।খানিকটা এগুতেই সরু পথের সমাপনী ঘটে একটা বিশাল কামরার সামনে এসে থামে তারা। একজন গার্ড বড় দরজাটা খুলে দিয়ে প্রথা আর শ্রেয়াণ কে ভেতরে ঢুকতে বলে। শ্রেয়াণ চতুর দৃষ্টিতে আশপাশ নজর বুলিয়ে নেয় বার কয়েক। অতঃপর প্রবেশ করে ভেতর ঘরে।কক্ষে পা রাখতেই ভেসে আসে রাউনাফের কন্ঠস্বর —“ওয়েলকাম! ওয়েল কাম! মিস্টার এন্ড মিসেস শ্রেয়াণ জাওয়ান!

তুরিতে দুজন সামনে তাকায়। খানিকটা দূরেই লম্বা কালো কোটে আবৃত রাউনাফ ওরফে জে.কে কুটিল হাসিতে উচ্ছসিত মুখাবয়বে দাঁড়িয়ে আছে।তার পাশের ছোট একটা টেবিলে পা গুটিয়ে বসে আইসক্রিম খাচ্ছে নেহমাত। খাওয়ার ফাঁকে দরজার সম্মুখে প্রথাদের দেখতেই—“মাম্মি।বলে উচ্ছিষ্ট আইসক্রিম ফেলে ছুটে আসতে উদ্যত হতেই তার হাত আঁকড়ে ধরে রাউনাফ।প্রথা নিজেও দিক শূন্য তাকিয়ে মেয়ের অভিমুখে ছুটছিল।নেহমাতের হাত আঁকড়ে ধরাতে তার পদ জোড়া থমকে দেয়। আশ্চর্য প্রতিমায় তাকিয়ে থাকে মেয়ের দিকে।রাউনাফ প্রথার উদ্দেশ্যে বলে—“আস্তে!এতো তাড়া কিসের? আশপাশটা একবার ভালো করে দেখে নাও।

স্তম্ভিত ফিরে প্রথার। অস্থির চোখে তাকায় এধার ওধার।রুমটায় সবুজ গোলাপী নিয়ন আলোয় পরিপূর্ণ। আবার সাদা আলোও চোখে পড়ে। একজায়গায় চোখ যেতেই থমকে যায় প্রথার নজর।স্থির চোখজোড়া ক্ষণকাল স্তম্ভিত রেখে অস্ফুট স্বরে বলে উঠে —“মা?
আকষ্মিক প্রথার মুখে ’মা’ ডাক শুনতে পেয়ে রাউনাফের উপর পতিত ক্রুদ্ধ আঁখি যোগলে কোমলতা এনে প্রথার দিকে তাকালো শ্রেয়াণ। একবার তার দিকে চেয়ে পরপর সামনে ইশারা করে প্রথা। শ্রেয়াণ প্রথার ইশারায় ধীরস্থির নজর মিলাতেই ঈষৎ আতঙ্ক মিশ্রিত বিষ্মিত চোখে চেয়ে থাকে।সায়লা খানম আর শ্রেয়া দুটো চেয়ারে বন্দী! দুজনের হাতে রশি বিদ্ধ।

হন্তদন্ত হয়ে প্রথার বাসায় যাওয়ার জন্য বেরিয়েছিলো সায়লা খানম,তাকে আটকাতে ব্যর্থ হয়ে শ্রেয়াও পিছু নেয়। পথিমধ্যে তাদের টেক্সি অবরোধ করে একটি কালো গাড়ি। ঘটনা আমলে নেয়ার আগেই হুরহুর করে গাড়িতে থেকে কালো পোশাক ধারী গার্ড এসে দুজন কে জোরপূর্বক তাদের গাড়িতে নিয়ে তুলে। এবং সে থেকে তাদের এখানে এনে বন্দী করে রাখা হয়।

–“ওদের কেনো এখানে আনা হয়েছে? যেখানে অদৃশ্য শত্রুতা তোর আমার সাথে?

রাউনাফ কাঁধ দুলিয়ে বলে—“ওরা না থাকলে এতো বছরের অজানা সত্যিটা জানবে কে?

—“মতলব?কিসের সত্যি?

—“বিরাট বড়ো এক সত্যি!
তৃতীয় ব্যাক্তি? এবং তা অতি পরিচিত!ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সবাই। শাহিন জাওয়ান দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে।
—“বাবা তুমি?
–“বাবা?কে বাবা?কার বাবা?

বলতে বলতেই রাউনাফের পক্ষের দিকে ধাবিত হয় শাহিন জাওয়ান। দুজন কোলাকুলি করে পাশাপাশি দাঁড়ায়। আকাশ ভেঙ্গে পড়লো যেনো উপস্থিত সবার মাথায়। আশ্চর্য,বিষ্ময়ে হারিয়েছে বাকশক্তি।শ্রেয়াণ দু কদম আগে বাড়িয়ে বিষ্ময় গলায় বলে—“বাবা,তুমি ওর সাথে…

তাকে থামিয়ে শাহিন ফের বলে —“কে তোর বাবা?

—“কে তোর বাবা মানে?তুমিই তো আমার বাবা!

হুঁ হুঁ করে হেসে উঠলো জে.কে আর শাহিন।মনে হলো তাদের সামনে মজার কোন বিষয় উপস্থাপন করা হয়েছে!না হাসলে তার ফায়দা হাসিল হবেই না।

হাসতে হাসতে সায়লার নিকটে চলে যায় শাহিন।জে.কে একবার সেদিকে লক্ষ্য করে পরপর ই শ্রেয়াণের উদ্দেশ্যে তাচ্ছিল্য ভরে বলে—“অন্যের বাবাকে বাবা বলে ডাকতে কন্ঠে একবারো বাঁধে না,না?

শ্রেয়াণ ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইলো ক্ষণকাল। সবকিছু কেমন গুলিয়ে আসছে। নিজের অবাকতা কে প্রাধান্য না দিয়ে শ্রেয়াণ জানতে চাইলো —“অন্যের বাবা মানে?

—“এই যে,দীর্ঘ দুই যুগের বেশী ধরে আমার বাবাকে বাবা বলে ডেকে আসছো?
—“হোয়াট!ওনি যদি তোর বাবা হয় তাহলে আমার বাবা কে?

—“তোর মার কাছেই জেনে নে?
সায়লার উদ্দেশ্যে বলল শাহিন। ঠোঁটে চতুর হাসি। মাথা নত করে রাখে সায়লা।চোখে পানি চিকচিক করছে। শ্রেয়া অবাক চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে রয় কেবল।তার মা কাঁদছেন কেন? কোন ভুল হয়ে যায়নি তো তার দ্বারা? ভাবতেই ভেতরে অদ্ভুত যন্ত্রণা অনুভব করে মেয়েটা!তাকায় শাহিনের দিকে।বলে উঠে —“দাভাইয়ের বাবা যদি আপনি না হোন তাহলে নিশ্চয়ই আমার বাবাও আপনি নন?

মুহূর্তেই তুমি থেকে আপনি তে পরিণত হলো শ্রেয়ার সম্বোধন!কিঞ্চিৎ ঝুঁকে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় শাহিন।হাসি মুখে বলে—“নাহ!আমিই তোমার বাবা!

—“মানে?
তার গলা অতি আশ্চর্য!

শাহিন জাওয়ান হাসলো কেমন করে।একপল দেখে নিল সায়লার অশ্রুসিক্ত মুখশ্রী। অতঃপর সামনের ফ্লোরে খালি জায়গাতে এদিক ওদিক হাঁটতে হাঁটতে বলে—“আজ তাহলে শুনো কিছু অজানা কথা!
তারপর দীর্ঘ দম নিয়ে বলতে শুরু করে–“আমি ছিলাম গ্রামের এক কৃষকের ছেলে।গরিবি দেখতে দেখতেই আমার বড়ো হওয়া। কিন্তু আমার স্বপ্ন আকাশচুম্বী।আমি একদিন বড়ো লোক হবো।অনেক অনেক টাকা আয় করবো।দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াবো আরো কতো কি। কিন্তু সেটা তো গ্রামে থাকলে কখনোই পূর্ণ হবার নয় তাই চলে এলাম ঢাকা শহরে। শিক্ষাগত যোগ্যতা মোটামুটি ছিল কিন্তু টাকা ছিলনা বলে কোন চাকরি পাচ্ছিলাম।আর না পাচ্ছিলাম থাকার জন্য বাসস্থান।তবে টাকা না থাকলেও সুন্দর চেহারা হওয়ায় সেতা নামের একজনের সাথে প্রেম হয়ে গেল ঠিকই। জীবিকার জন্য হোটেলে শেফের কাজ নিয়েছিলাম সামান্য মাইনের। হঠাৎ একদিন সেখানে মিটিং এ্যাটেন্ড করতে এলো–শিশির জাওয়ান নামের একজন বড় বিজনেস ম্যান।আহ,স্যুট বুট পড়া ভদ্রলোক কে কতোই না পরিপাটি দেখাচ্ছিলো। সেদিনের মতো উনার সাথে আমার কথা হয়নি।এরপর দ্বিতীয় বার যখন এলো,কথা বলে বুঝতে পারলাম মানুষটা বড্ড ভালো,নিরহোঙ্কার।নরম মনের মানুষ। তখন ই আমার মনে একটা বুদ্ধি উদ য় হলো–আমি যদি তার ঘনিষ্ঠ আর বিশ্বস্ত হয়ে উঠতে পারি।তাহলে জীবন লিড করতে অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে।যেই ভাবা সেই কাজ। ভদ্রলোক যখন একদিন অফিস করে ফিরছিল তখন মাস্তান ভাড়া করে তার উপর এ্যাটাক করালাম শেষে বীর বাহাদুরের মতো গায়ের রক্ত জড়িয়ে আবার তাকে বাঁচিয়েও নিলাম সিনেমাটিক স্টাইলে। ভেবেছিলাম ডোজ কম হবে কিন্তু আমায় ভুল প্রমাণিত তিনি এতোই আপ্লুত যে–আমার সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হলো।আমিও সুযোগে সৎ ব্যবহার করে ফেললাম। উপস্থাপন করলাম–জীবন নিয়ে অনিহা, অসহায়ত্ব,গরিবি। সেদিন আমার দুঃখী জীবনের জন্য সমবেদনা প্রকাশ করে ভদ্রলোক তার অফিসে দেখা করতে বললেন।এটাই তো চেয়েছিলাম আমি।তাই দেরি না করে তার অফিসে ছুটে গেলাম। তারপর আর কি? বীনা বাঁধায় আরামদায়ক চাকরি জুটে গেলো আমার।এরই ফাঁকে বিয়ে করে নিলাম প্রেমিকা সেতা কে। সুখেই চলছিল দিনকাল। কাজের একবছরের মধ্যে ম্যানেজার কে টাকা গায়েব করে দিচ্ছে বলে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসিয়ে তাকে কাজ থেকে বের করে আমিই ম্যানেজারে উপনিত হলাম।কিন্তু আমার আরো টাকা চায়।আরো আরো। ঠান্ডা মাথায় প্ল্যান করলাম–যদি শিশির জাওয়ান কে মেরে দেই?তাহলে তার জায়গায় আমি বসতে পারবো!

এই পর্যায়ে চোখ তুলে বিস্মিত হয়ে তাকায় সায়লা। শরীর নেতিয়ে আসছে তার। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে দুফোঁটা জল।শাহিন থামলো একটু।সকলে অবিশ্বাস্য চোখে উৎসুক তাকিয়ে আছে তার পানে। যদিও সবার মাঝে যাউনাফ নির্বিকার।আবারো বলা শুরু করে শাহিন—“প্ল্যান মোতাবেক একদিন…

#চলবে ইনশা-আল্লাহ