চিত্তে অঙ্কিত কৃষ্ণরেখা পর্ব-২২ এবং শেষ পর্ব

0
1084

#চিত্তে_অঙ্কিত_কৃষ্ণরেখা
#পর্বঃ২২||অন্তিম+প্রথম অংশ||
#ফাহমিদা_নূর_সাদি

( ১৮+এলার্ট )
স্ট্রেচারে শুয়ে আছে শ্রেয়াণ।পড়নে হসপিটালের নীতি অনুযায়ী আকাশী রঙের কাপড়।তার গভীর চোখ দুটো পলকহীন সেঁটে রেখেছে পাশের টুলে নেত্রদ্বয়ে অভিমান উপচে পড়া চোখের গহীনে। উহু পলক ফেলছে না মোটেও।এক পর্যায়ে ঠোঁট উল্টে নিঃশব্দে হাসলো শ্রেয়াণ।এক হাতে ক্যানুলা আটকে ছিল তার, সেদিকে একপল তাকিয়ে অপর হাত রাখলো প্রথার গালে। ভালোবাসার ছোঁয়া পেয়ে আরো অভিমানী হয়ে উঠেলো প্রথার চিত্ত।গাল থেকে ঝটকায় শ্রেয়াণের হাত সরিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। শ্রেয়াণ ঠোঁট চুকা করে ফের হাসে।তার অভিমানীটা কি একটু বেশিই ভয় পেলো তাকে হারানোর?হয়তো বা,নাহলে কি এতো অভিমান সেঁধে সেঁধে করবে?

—“কিছু হয়নি তো আমার!দেখো একদম ফিট আছি আমি?

মুখ খুললো না প্রথা। কুলুপ এঁটে ঈষৎ সামনে পিছে ঝিমাতে লাগলো ফুঁস ফুঁস নিঃশ্বাস টেনে।শ্রেয়াণ মাথা চুলকায় হালকা। ছোট ছোট চোখে চেয়ে বলল —“কথা বলবে না!
—“নাহ!
চিবিয়ে জবাব দেয় তড়িৎ!

ঠোঁট গোল করে ’ও’ এর মতো করে শ্রেয়াণ।একটু নিরবতার পর জানতে চাইলো কোমল স্বরে—“ভয় পেয়েছিলে খুব?

প্রথা ছলছল চোখে তাকালো। দৃষ্টিতে হারানোর ভয়। শ্রেয়াণের পেটে হালকা চাপড় মেরে বলল—“তো পাবোনা?কে বলেছিলো সামনে এসে দাঁড়াতে?

—“আমি না এলে তো তোমার গায়ে এসে লাগলো তীরটা? তখন আমায় কে সামলাতো?আর অ্যাঞ্জেল কেই বা…

কেবল চেয়ে রইলো প্রথা।কিছু বলল না।আজ দুদিন ধরে শ্রেয়াণ হসপিটালে এ্যাডমিট।শাহিন সেদিন স্বীকারোক্তি দিয়েছে যে— শ্রেয়াণের আসল বাবা শিশির জাওয়ান কে গাড়ির ব্রেকফেল করিয়ে এ্যাক্সিডেন্টের মাধ্যমে মৃত্যু ঘটিয়েছে শাহিন।তার উদ্দেশ্য ম্যানেজার থেকে মালিক হওয়া। কিন্তু বিপত্তি ঘটে তখন, যখন জানতে পারে যে শিশির জাওয়ানের স্থাবর অস্থাবর সকল কিছুর উত্তরাধিকারী তার তিন বছর বয়সী একমাত্র সন্তান শ্রেয়াণ জাওয়ানের নামে লিপিবদ্ধ। এবং তার পরিণত বয়স হওয়ার আগে সেগুলো সামলাবে শিশির জাওয়ানের স্ত্রী সায়লা খানম। তখন শাহিন দিশেহারা হয়ে পড়ে।কি করবে না করবে পথ খুঁজে না পেয়ে স্ত্রী সেতার সাথে প্ল্যানিং করে যে— সায়লা খানম কে বিয়ে করবে। কিন্তু সায়লা খানম নিজের সন্তান নিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে শাহিন শিশিরের বাবা আজম সাহেবের নিকটতম ব্যাক্তি হয়ে তাকে ইমপ্রেস করতে লেগে পড়ে আর বুঝায় যে সমাজে বেঁচে থাকতে হলে সায়লা খানমের একজন ঢাল প্রয়োজন। তাছাড়া শ্রেয়াণেরও প্রয়োজন বাবার ভালোবাসা!আজম সাহেবের কতোদিনই বা বাঁচবে?তাদের কতোদিন প্রোটেক্ট করতে পারবে?এক সময় তাকে বুঝাতে সক্ষম হয় শাহিন এবং নিজের বিয়ের কথা গোপন রেখে এটাও বলে যে– সে সায়লার প্রতি সহানুভূতিশীল হতে গিয়ে তার মায়ায় পড়ে গেছে, তাকে ভালোবেসে ফেলেছে। অতঃপর সায়লা খানমের পরিবার এবং আজম সাহেবের জোড়াজোড়িতে সায়লা তাদের মত কে সম্মতি জানাতে একপ্রকার বাধ্য হয়! তারপর?গ্রাম থেকে আসা শাহিন নিজের নামের পাশে পদবী পায়–শাহিন জাওয়ান নামের।ভোগ করতে থাকে আয়েশি জীবন।দেশে থাকলে তার বিবাহিত জীবন নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হবে তাই–নিজের স্ত্রী সেতা এবং সন্তান রাউনাফ কে পাঠিয়ে দেয় ইংল্যান্ড। সেখানে ই তাদের জীবন যাত্রা শুরু করে। শাহিন মাস কয়েক অন্তর যেকোনো সপ্তাহ নিজ পরিবারের সাথে কাটাতে সেখানে যায়।

আর রাউনাফ ওরফে জে.কে? সন্তানের সামনে নিজের পাপের কথা উপস্থাপন করতে যে কোন বাবারই দ্বিধা কাজ করবে!ছেলের কাছে নিজেকে সৎ প্রমাণ করতে এবং শ্রেয়াণের সম্পদ নিজের হাসিল করতে ছেলেকেই দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করল শাহিন। ছোট থেকেই বাবার ভক্ত ছিল রাউনাফ কিন্তু সে বাবাকে তেমন কাছে পায়নি। শাহিন তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে— এর পেছনে দায়ী একমাত্র শ্রেয়াণ ই! তাকে আগলে রাখতে গিয়েই শাহিন রাউনাফ কে সময় দিতে পারেনি জীবনে!সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ আর বাবার ন্যায় অর্থলোভীর জন্যই শ্রেয়াণের কাছ থেকে প্রথা কে আলাদা করেছিল।কারণ তারা পূর্ব হতেই জানতো যে— শ্রেয়াণের প্রাণ ভোমরা প্রথার মাঝেই লুকিয়ে আছে।তার কাছ থেকে প্রথা হারিয়ে গেলে– যেমন সে আপন জন আছে জেনেও তাকে ছুঁয়ে দেখতে না পারার কষ্ট উপলব্ধি করবে তেমনি তার জন্য ভেঙে পড়ে নিজেকে ব্যবসার কাছ থেকে গুটিয়ে নেবে।এতে এক ঢিলে দুই পাখি মরবে। কিন্তু প্রথা যাওয়ার পর তাদের প্ল্যান ফল করে। শ্রেয়াণ নিজেকে গুটিয়ে নেয়ার বিপরীতে আরো ব্যাবসায় নিজেকে ডুবিয়ে রাখলো। পরিপক্ব হয়ে উঠলো দ্বিগুণ!

সমস্ত সত্যি যখন সামনে প্রকাশ পেলো, দিকবিদিক ভুলে গিয়েছিলো যেনো সায়লা।হামলে পড়েছিল শাহিনের উপর।এতো বড়ো প্রতারণা?অভিনয়? মৃত্যু পথযাত্রী হয়েও এতো লোভ যে–এখনো শ্রেয়াণের কাছে প্রপার্টি দলিলে স্বাক্ষর চাইছে নেহমাত কে আটক করে?

শাহিন কেবল হাসে ক্রুর।তখনি তাদের আস্তানায় এটাক করে পুলিশ।রাউনাফ জানতো এমন কিছু হবেই তাই পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। কিন্তু পুলিশের দ্বিতীয় টিম যখন আক্রমণ করলো তখন তারা দিশা হারিয়ে ফেলে। শ্রেয়াণ নিজেও হতভম্ব ছিল।সে তো এক টিমের সাথেই কানেক্ট ছিল তাহলে দ্বিতীয় ফোর্স কে -কে ইনফর্ম করলো।পরে অবশ্য জানতে পারে যে নিলিশার সাহায্য নিয়েই তারা এ্যন্ট্রি নিয়েছে!

আন্ডার ওয়া!র্ল্ডে সি!ক্রেট সিরিয়াল কি!লার জে.কে। কন্ট্রাক্ট নিয়ে বড়ো বড়ো ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ কে খু!ন করতো এই জে.কে।দুটি রে!প ছয়টি খু!নের অপরাধে জে.কে ওরফে রাউনাফ কে গ্রেফতার করা হয়। তথ্য গুলো অবশ্য তার গ্রেফতারের পরেই উদঘাটন করা হয়েছে!শাহিন ও বর্তমানে পুলিশের হেফাজতে।

জীবনে এতো কিছু করেও খালি হাতে ফিরতে চাইছিলো না রাউনাফ।শেষ বারের মতো শ্রেয়াণ কে নিঃস্ব করে দিতে পুলিশের হেফাজত হতে ছুটে এসে প্রথার উপর দক্ষ হাতের নিশানাতে তীর ছুড়েছিল সে, ভাগ্যক্রমে প্রথা কে আগলে নিয়ে তার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ায় শ্রেয়াণ। তৎক্ষণাৎ তীর বিদ্ধ হ য় শ্রেয়াণ।সেই থেকে হসপিটালে আছে সে।

°

—“কাছে এসো?
—“নাহ!যাবো না!
কড়া জবাব প্রথার। শ্রেয়াণ চেয়ে রইলো আশাহত চোখে।খানিকটা পর পিচেল হেসে চোখ খিচে আর্তনাদি ভঙ্গিতে উচ্চারণ করলো— আহ!

টুল ছেড়ে তড়িৎ বেগে প্রথা উঠে দাঁড়ায়। শ্রেয়াণের নিকটে গিয়ে কিঞ্চিৎ ঝুঁকে বুকে হাত বাড়িয়ে বিচলিত গলায় বলল—“কি হয়েছে? কষ্ট হচ্ছে?

—“হু।
বলেই প্রথার ঘাড়ে হাত গলিয়ে বুকে চেপে ধরল তার মাথা। অতঃপর বলল—“এখানে চিনচিন ব্যাথা হচ্ছে।একটু আদর পেলেই সেরে যাবে বোধহয়!

নিজেকে আনতে অপারগ হয়ে ওভাবেই পড়ে রইলো প্রথা। ঠোঁটে লাজুক হাসি ধরে রেখে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো দুটু।
—“হয়েছে এবার? ছাড়ুন!মেয়ে এসে পড়বে এক্ষুনি!

দীর্ঘ শ্বাস ফেলে শ্রেয়াণ —“অ্যাঞ্জেল ছাড়া কেউই আমায় ভালোবাসে নাআ.. আহ, জীবনটাই বৃথা।

চোখ ছোট ছোট করে তীর্যক দৃষ্টিতে মাথা তুলল প্রথা।শ্রেয়াণের নজর গহীনে দুষ্টু ইঙ্গিত। দাঁতে দাঁত নিষ্পেষিত করে বুকের ডান পাশের ক্ষতস্থানে আলতো চাপড় মেরে রাগত স্বরে বলল—“সেদিন না আই লাভ ইউ বললাম?

—“চিড়ে ভিজেনি! ভালোবাসো যে প্রমাণ পেতে আমার অন্যকিছু চাই?
কন্ঠে মাদকতা। চক্ষু হাসছে চতুর ইশারায়। ভ্রু কুটি করে প্রথা– অন্য কিছু মতলাব? জানতে চাইলে ইশারায় কাছে ডাকে শ্রেয়াণ।বাধ্য মেয়ের মতো কান নিয়ে যায় শ্রেয়াণ মুখের নিকটে।পরে যা শুনলো চোখ পাকিয়ে তড়িৎ সরে আসে প্রথা। দুহাতে মুখ গুঁজে চেঁচিয়ে উঠলো —“ছিঃ বেল/জ্জ পুরুষ!

বাঁকা হেসে কোমর জড়িয়ে কাছে নিয়ে হাতের আজলে ঢেকে রাখা চেহারায় তাকিয়ে রইল অনিমেষ। হৃদয়ে সুখানুভূতি হচ্ছে তীব্র আকারে।আজ থেকে দূরে থাকার চিন্তা মুক্ত।কাছে আসার মৌসুম যেনো কড়া নাড়ছে নিকটে।

—“পাপা!
আবেগ মিশ্রিত বাচ্চা কন্ঠস্বর। তড়িৎে দূরে সরে আসে প্রথা। থমথমে মুখে তাকায় দরজার অভিমুখে।আদওয়ার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে নেহমাত। শ্রেয়াণ মেয়েকে দেখে হাসে স্নিগ্ধ।হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকতেই ছুটে আসে নেহমাত।রাউনাফের সাথে হাতাহাতির সংঘ/র্ষে ডান হাতে জখম হয়েছে শ্রেয়াণের,সেটা এখনো ব্যান্ডেজে আবৃত।নেহমাত সেখানে টুপটাপ দু চারটে চুমু খেয়ে বাঁ পাশের বেডে শুয়ে পাপা কে জড়িয়ে ধরে। কান্না মিশ্রিত গলায় বলে —“রাউকান ব্যাড আঙ্কাল তোমায় হার্ট করেছে? পঁচা আঙ্কাল!

মুখ বাড়িয়ে মেয়ের গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল শ্রেয়াণ পরম যত্নে।গালে গাল লাগিয়ে বলল—“পাপার জন্য দুঃখ পেয়েছো?

—“অনেএক.. এখান্যে ব্যাথা হচ্ছিল্যো?
বুকে হাত রেখে ঠোঁট উল্টে বলে। হেসে ফেললো শ্রেয়াণ,সাথে বাকিরাও।আদওয়া দূর থেকেই জানতে চাইলো —“স্যার এখন কেমন লাগছে?ব্যাটার ফিল করছেন!

সায় জানায় শ্রেয়াণ।একটু পর সেখানে পরিবারের বাকি সদস্য রাও প্রবেশ করে।সায়লা খানম অপরাধী মুখে দূরেই দাঁড়িয়ে আছে।তার ভেতরে তৈরি হয়েছে নিজের প্রতি তীব্র নিন্দা,অপরাধ বোধ।এই বলে যে– শাহিন সম্পর্কে না জেনেই গোটা জীবন পার করে দিল!আর তার সাথে জীবন জড়িয়েছে বলেই শ্রেয়াণ কে আজকের মতো জঘন্য পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়েছে!যদি সেদিনই শাহিন কে বিয়ে করা সম্পর্কে মত না দিত তাহলে আজ পরিস্থিতিটাই ভিন্ন হতো!

—“মা!
শ্রেয়াণের ডাক শুনেও মাথা নত করে রাখে সায়লা। লজ্জা, অপরাধ বোধে শ্রেয়াণের চোখে চোখ রাখার সাহস দেখাতে পারছে না।তার নিকটেই নিষ্প্রাণ চোখে অদৃশ্যে চেয়ে আছে শ্রেয়া।

—“মা?দূরে সরে আছো কেন? আমার কাছে আসবে না?
অশ্রুসিক্ত নয়নে মাথা তুলে সায়লা। ঠোঁট কামড়ে এগিয়ে আসে একপা দু’পা। স্ট্রেচারের নিকটে এসেই ডুকরে উঠে বলে—“আমি হয়তো মা ডাক শুনার যোগ্যতায় হারিয়ে ফেলেছি ,তাই না?ভুল করে ফেলেছি বড়ো!তোর কাছে কি ক্ষমা চাইবো আমি তো নিজেকেই নিজে ক্ষমা করতে পারছি না!এতো বড়ো ভুল কি করে করলাম আমি?একটা জঘন্য মানুষের সাথে এতো গুলো বছর…?

মলিন হেসে তার হাত মুঠো করে ধরে শ্রেয়াণ।পাশে বসিয়ে মাথা রাখে তার কোলে।
—“ভাগ্যের লেখন যায়না খন্ডন কথাটি তুমিই বলেছিলে আমায়।তাহলে আজ কেনো নিজেকে দোষারোপ করছো,?আমি জানি আমার মা কোন ভুল করতেই পারে না!শাহিন জাও.. থুড়ি শাহিন আলমের সাথে রক্তের কোন সম্পর্ক আমার নেই জেনে ডিপ্রেশনে পড়বো বলেই তো তুমি কথাটি কখনো জানতে দাওনি আমায়, তাই না?এই নিয়ে আমার কোন অভিযোগ নেই তোমার প্রতি!মা, ভুলে যাও যে শাহিদ নামের কোন মানুষ ছিল আমাদের জীবনে। সব পেছনে ছুড়ে ফেলে সামনে তাকিয়ে দেখো তোমার সন্তান আর নাতি নাতনিদের।বাকি জীবন পার করতে এটুকুই যথেষ্ট নয় কী?

অশ্রুসিক্ত চোখে উপর নিচ মাথা নাড়ে সায়লা।ছেলের মাথায় হাত রাখে আলতো।দূর থেকে মলিন হেসে শ্রেয়া। একবার রুমময় নজর বুলিয়ে দৌড়ে চলে যায় দরজার দিকে। শ্রেয়াণ ডাকে পেছন থেকে অথচ সে সাড়া দিল না আজ।

শাহাদ আসে কিছুক্ষণ পর।নিলিশা মাথা নিচু করে করিডোরেই দাঁড়িয়ে রয়।ভেতরে প্রবেশ করার সাধ্য তার কুলাচ্ছে না।কি করেই বা ঢুকবে?মুখ আছে কোন?

দীর্ঘ পনেরো দিন পর আজ শ্রেয়াণকে ছেড়েছে হসপিটাল থেকে। এখন সে প্রায় সুস্থ। শুধু বুকের ডান পাশের তীর বিদ্ধ স্থানের ঘা এখনো সম্পূর্ণ শুকায় নি,এই যা!

শ্রেয়াণের সাথে পা মিলিয়ে আজ প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর বাদে জাওয়ান বাড়িতে পা রাখল প্রথা। এখানে কতো স্মৃতি জড়িয়ে আছে তাদের ভালোবাসার, দম্পতি জীবনের।কতো হাসি, কান্না ,অভিমান, অভিযোগ মিশে আছে আনাচে কানাচে।প্রথার একে একে মনে পড়তে লাগলো এবাড়িতে কাটানো মুহূর্তগুলো। স্মৃতিরা চোখের সামনে এসে ভীড় জমিয়ে উঠলো।মনে হানা দিল বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার শেষ মুহূর্তের দৃশ্যপট।বাড়ির বাইরে পা রাখার আগ মুহূর্তে শ্রেয়াণের মুখশ্রীটা একবার দেখার বড্ড তৃষ্ণা পেয়েছিল তখন,কিন্তু?রাগ , ঘৃ!ণা, ক্ষোভের জন্য নিজের চাওয়া কে ধামা চাপা দিয়ে শ্রেয়াণের মায়া কাটাতে পাড়ি জমিয়েছিল অধরায়। সেদিন মনে জড়ো হয়েছিল শ্রেয়াণের নামে আকাশসম ঘৃ/ণা, অভিযোগ অথচ আজ? সেসবের রেশ টাও নেই। বরং সেদিনের ঘটনাগুলোয় বিচরণ করলে হৃদয়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে আফসোস আর দীর্ঘ শ্বাস!

একহাতে শ্রেয়াণের বাহু জড়িয়ে দূরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রথা।নেহমাত যেনো বিশালাকাশের এক খন্ড চাঁদ হাতে পেয়েছে। চোখে প্রফুল্লতা , কন্ঠে উচ্ছ্বাস নিয়ে ফিহা,ফাইজার সাথে দৌড় ঝাঁপ করছে দিক শূন্য।কখনো কখনো পাপা কে এসে আদর দিয়ে যাচ্ছে টুপটাপ আবার কখনো মা’কে জড়িয়ে আলিঙ্গন করছে কোমল হাতে। কখনো বা দিদুনের সাথে কথা বলছে আবার শ্রেয়ার কাছে ছুটে যাচ্ছে। পরিবরের এতো সদস্য দেখে নেহমাত সত্যিই মহা খুশি।

রাত প্রায় এগারোটা। ড্রয়িং রুমে আসর বসেছে সবার। পরিস্থিতি থমথমে। অশ্রুভেজা চোখে বসে আছে নিলিশা।চোখে হতাশার সাথে আরো কিছু একটা আছে,হয়তো লুকায়িত কোন কষ্ট। শ্রেয়াণ চেয়ে আছে গম্ভীর অথচ কঠিন চোখে। উপস্থিত আছে সায়লা খানম,শাহাদ, প্রথা,শ্রেয়া আর ফাইজাও।
ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ক্ষণকালের নিরবতা ভেঙ্গে শ্রেয়াণ শিতল গলায় জানতে চাইলো—“কেনো করেছো এমন?কোন ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ?কিই বা লাভ হলো?

চোয়াল শক্ত করে চুপ থাকলো নিলিশা। অধৈর্য হয়ে পড়ে শাহাদ। তেড়ে এসে বলল—“আজো চুপ!মুখে কুলুপ এটেছো নাকি?ভাইয়ের সাথে এমন বাজে খেলা কেনো খেলেছো?এ্যান্সার দাও কুইক!

নিলিশা চেঁচিয়ে উঠলো কান্নারত গলায়—“হ্যা!শ্রেয়াণের কাছ থেকে প্রথা কে দূরে সরাতে আমিই জে.কে কে হ্যাল্প করেছি!এতে আমার ক্ষোভ মিটেছে। শান্তি পেয়েছি শ্রেয়াণ কে কষ্ট পেতে দেখে!

—“কিন্তু কেন? তোমার কোন ক্ষতি করেছি বলে তো আমার মনে পড়ে না!
শ্রেয়াণ ভ্রু গুটিয়ে স্বাভাবিক সুরেই বলল।নিলিশা তাকায় শক্ত চোখে —“ক্ষতি করোনি তুমি?আনায়া কে মনে আছে?আরে,আনায়া শুধু আমার ফ্রেন্ড ছিল না ও আমার বোনের মতো ছিল। আমার সুখ দুঃখের সাথী। শুধু মাত্র তোমার জন্যই ও আজ আমার কাছে নেই। তোমাকে ভালোবেসেই মৃ!ত্যু কে বরণ করেছে!

চকিতে শ্রেয়াণের দিকে তাকায় প্রথা। দৃষ্টিতে অসংখ্য প্রশ্নের ঝড়। শ্রেয়াণ হতবাক হয়ে তাকিয়ে রয় ক্ষণকাল। অতঃপর বলে—“আমায় ভালোবেসে মৃ!ত্যু কে বরন করেছে মানে?কি বাজে কথা বলছো?

—“আমি বাজে বকছি? সেদিন আনায়া ক্যাফেতে তোমায় প্রপোজ করেনি?আর তুমিও তাকে রিজেক্ট করোনি?তুমি তাকে রিজেক্ট করার পরই তো…
বলতে বলতে কেঁদে উঠে নিলিশা।

—“আমি ওকে এক্সেপ্টই বা কি করে করতাম? যেখানে প্রথা কে আমি ভালোবাসি সেখানে আনায়া কে কিভাবে মেনে নিতাম?

ফট করে মাথা তুলে নিলিলা।বলে উঠে—“তাই বলে শাস্তি হিসেবে মৃ!ত্যু?

—“সেখানেই বা আমার দোষ কোথায়?আমি ওকে সেদিন স্পষ্টতই জানিয়েছিলাম যে–আমি প্রথা নামের কাউকে ভালোবাসি।তার জায়গায় আনায়া কেন পৃথিবীর কাউকে বসানো সম্ভব নয়! এরপর?আমার বাকি কথা শুনলোই না, ছুটে বেরিয়ে গেল ক্যাফে থেকে! দিকবিদিক না চেয়ে ছুটেছিল ও ,আর তখন ই সামনের লরি তাকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দিল
আর সেখানেই স্পট ড্যাথ!

একটু থেমে বলল—“অসাবধানতায় ছুটার জন্য ওর মৃ!ত্যু হয়েছিল। সেখানে কি আদৌ আমার কোন প্রকার হাত ছিল?

—“ছিলই তো!তোমায় ভালোবেসেই ওর এমন হয়েছে!তুমি ওকে রিজেক্ট না করলে ব্যাপারটা অন্য করম হতো!তাই সেদিন থেকেই আমি ঠিক করে নিয়েছি–তোমাকে ভালোবাসার মতো ভুল করেই আমার বোনের মৃ!ত্যু হয়েছে।তাই তোমার ভালোবাসা কেও সফল হতে দেবো না আমি।প্রথা মেয়েটাকে তোমার কাছ থেকে আলাদা করে বুঝিয়ে দেবো আপনজন হারালে বেদনা কেমন! জে.কের মাধ্যমে আমার আশা পূরণও হয়ে গেলো!
আরে প্রথা তো তাও পৃথিবীতে ছিল, শ্বাস নিচ্ছিলো কোন এক প্রান্তে। কিন্তু আনায়া?ও তো আমার কাছে নেই।বাড়িতে যখন ই তোমাদের দুজনকে একসাথে হাসিমুখে দেখতাম তখন ই চোখের সামনে আনায়ার র!ক্তা!ক্ত দেহটা ভেসে উঠতো আমার সামনে। তখন আমার কেমন লাগতো একবার ভেবে দেখো?

নির্বাক চোখে চেয়ে রইলো সকলে।শ্রেয়াণ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মাথা নিচু করলো একবার।চোয়ালে হাত বুলিয়ে মলিন হেসে বলল—“মনে এতো ক্ষোভ পুষে রেখে আমার সাথে হাসিমুখে কথা বলতে?বলেই তপ্ত শ্বাস নিল।নিলিশা চুপ মেরে রইলো।

প্রথা বলে উঠলো —“জে.কে যখন এ্যাটাক করেছিলো।হয়তো নিঃস্ব নয়তো মৃ!ত্যু দিতো আমাদের!তোমারো প্রতিশোধ নেয়া হয়ে যেতো ,তাহলে শেষে পুলিশ ফোর্স কে কেন ইনফর্ম করেছিলে?

নিলিশা মলিন চোখে তাকায়।–“মাঝে মাঝে আমারো অপরাধ বোধ কাজ করতো।মনে হতো–হয়তো আনায়ার ভাগ্য টাই এমন ছিল কিন্তু পরক্ষণে যখন তোমাদের হাসিখুশি দাম্পত্য জীবনের কথা মনে ভেসে উঠতো তখন ক্ষোভে ফেটে উঠতো হৃদয়।মনে হতো–আমার বোন কে মে/রে তোমরা সুখে সংসার করছো।সেই মুহূর্তে অপরাধ বোধ উধাও হয়ে তৃপ্তি আসতো মনে! কিন্তু সেদিন….

চোখ বেয়ে অনর্গল জল গড়িয়ে পড়ছে তার।দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ফাইজার দিকে আঙুল তাক করে বলে—“সেদিন শাহাদ আমার সাথে রাগারাগী করে বেরিয়ে যাওয়ার পর ফাইজা গিয়েছিলো আমার কাছে। আমার বাচ্চাটা কেঁদে কেঁদে বলছিল– আমরা তোমায় অনেক ভালবাসি মা। প্লিজ তুমি ভালো হয়ে যাও।তোমাকে খারাপ দেখতে ভালো লাগে না!সত্যি কথা বলে দিয়ে ছোট মা’কে ফিরিয়ে আনো।বাবা সত্যিটা যেখানে জেনে গেছে নিশ্চই তোমায় শাস্তি দিবে।আমরা তোমাকে ছাড়া কিভাবে থাকবো মা?বাবা তো বলে গেছে চাচ্চু ছোট মার উপর কোন আঁচ আসলে তোমায় ডিভোর্স দিয়ে দেবে।আমি টিভিতে দেখেছি ডিভোর্স মানে আলাদা হয়ে যাওয়া।

ভাঙা গলায় বলতে বলতে হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো নিলিশা।সকলে একবার ফাইজার দিকে তাকিয়ে আবার নিলিশার দিকে তাকায়।মুখ চাওয়াচাওয়ি করে একে অপরের।শাহাদ নিচের দিকে চেয়ে আছে কঠিন চোখে।নিলিলা বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়।প্রথার সামনে এসে মাথা ঝুঁকিয়ে বলে—“ আমিও আমার সন্তানদের ভালোবাসি কিন্তু ভুল করেছি না? এসবের মাঝে তোমারি বেশী ক্ষতি করেছি।আমায় যা শাস্তি দেবে মাথা পেতে নেবো আজ!
মুখের সামনে দুহাত জোড় করে বলে।প্রথা বাকরুদ্ধ হয়ে আছে। নির্বোধ তাকায় শাহাদের দিকে। তখনই শাহাদ বলে উঠে —“আদৌ ঠান্ডা মাথায় কখনো ভেবেছিলে তোমার বোনের মৃ!ত্যুতে ভাইয়ের কোন হাত ছিল কী না?আর কি যেন বলছিলে? ওদের আলাদা করে আপনজন হারানোর বেদনা উপলব্ধি করাতে চাইছিলে,রাইট?তাহলে তো সেটা তোমাকেও উপলব্ধি করতে হবে। ভুল করেছো তুমি আর শাস্তি একটাই –ডিভোর্স!কোন বাচ্চা পাবে না!ওরা আমার কাছেই থাকবে!
ডুকরে কেঁদে ওঠে নিলিশা।কথা বলার ভাষা খুঁজে পেলো না, তবুও শাহাদের কাছে গিয়ে বলে—“এতো বড় শাস্তি দিওনা প্লিজ।অন্য কোন….

—“আপনজনের অনুপস্থিতি উপলব্ধি করতে এটাই তোমার প্রাপ্য শাস্তি!

দীর্ঘ শ্বাস ফেলে শ্রেয়াণ এগিয়ে আসে ভাইয়ের দিকে। কাঁধে হাত রেখে বলে—“ছেড়ে দাওনা ভাই!যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।দেখো ফাইজা বেবী কাঁদছে বাবার কথা শুনে।
শাহাদ তাকালো মেয়ের দিকে। সত্যিই সায়লার পেছনে লুকিয়ে কাঁদছে মেয়েটা। ধ্বক করে উঠলো শাহাদের বাবা চিত্ত। কিন্তু নিলিশার তো শাস্তি প্রাপ্য?এতো বড় ভুল করে পার পেয়ে যাবে?

—“এতো বড় অপরাধের শাস্তি কি হতে পারে?
—“আহ,ভাই।দু দুটো নিষ্পাপ বাচ্চা রেখে ডিভোর্স কোন শাস্তি হতে পারে না।আর তাছাড়া ভাবি তো নিজের ভুল বুঝতেই পেরেছে,তাই না…
শেষের কথাটি নিলিশার দিকে চেয়ে বলতেই তড়িৎ উপর নিচ মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।

–“তুই বলছিস একথা?

মৃদু হাসে শ্রেয়াণ।প্রথার দিকে চেয়ে বলে —“এতো দিন পর আমার পাঁজর গুলো কে ফিরে পেয়েছি আমি! তাদের সাথেই শান্তিতে থাকতে চাই। আশপাশের কোন ভাবনা আপাতত নেই।তবে হ্যাঁ দ্বিতীয় বার আমার ভালোবাসা কিংবা কারো কোন আঘাত হানতে চাইলে ছেড়ে দেবো না কাউকে।সোজা পু!তে ফেলবো।মনে থাকবে?
নিলিলার উদ্দেশ্যে বলতেই নির্বোধ চেয়ে ঘাড় কাত করে মেয়েটা।শ্রেয়াণ উঠে দাঁড়ায় আসন ছেড়ে। প্রথার দিকে একবার কোমল চোখে চেয়ে সিঁড়ির অভিমুখে যেতে গিয়েও পাজোড়া থামিয়ে দেয় শ্রেয়ার দিকে নজর পড়তেই।মেয়েটার মুখ শুকিয়ে গেছে অনেকটা।মুখে মলিনতার ছোঁয়া।চোখের নিচে কালি পড়েছে।সাহসা ভ্রু গুটিয়ে নেয় শ্রেয়াণ।বোনের সামনে বসে হাঁটু গেড়ে বসে নরম স্বরে জানতে চাইল—“কি অবস্থা করেছিস নিজের?কোন সমস্যা?

নিষ্প্রাণ চোখে তাকায় শ্রেয়া।দুদিক মাথা নাড়িয়ে বলে–“কিছু না!

মুখে হাত রেখে বোনের সম্পূর্ণ চেহারায় নজর বুলিয়ে নিল শ্রেয়াণ। মজার ছলে বলে—“ডা. আনার্স কে ভালোবাসিস কথাটি পরিবার কে জানাতে হিম্মত জুটাতে না পেরে ডিপ্রেশন ভুগেই কি চেহারার এই অবস্থা করেছিস?

একটু মমতা মাখা সুর পেয়েই ছলকে উঠল শ্রেয়ার মন।ভাইয়ের হাতের উপর হাত রেখে শব্দ করে কেঁদে উঠলো মেয়েটা। বিচলিত হয় শ্রেয়াণ।তার সাথে বাকিরাও তাকায় প্রশ্নাতীত চাহনিতে।

—“এ্যাই পাগ/লের মতো কাঁদছিস কেনো?কে কি বলেছে ভাই কে বল?

—“আমি আজো মানতে পারছিনা যে,ওই জঘন্য মানুষটা আমার বাবা!ওনার র!ক্ত আমার শরীরে বইছে!আমার ইচ্ছে করে ছুরি দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে ওই জঘন্য মানুষের রক্ত শরীর থেকে বের করে নিতে।আমি এটাও মানতে পারছি না যে,যে শিশির জাওয়ানের র!ক্ত তোমার শরীরে বইছে তা আমার শরীরে নেই! আমার খুব কষ্ট হচ্ছে দাভাই…

শ্রেয়াণ হাসল মলিন। বলল—বাবার রক্ত বইছে না তো কি হয়েছে, মার রক্ত তো বইছে?পাগ/লি বনু আমার।এই সামান্য বিষয় নিয়ে চেহারার এই হাল করেছিস?পরশু দিন যখন আনার্স তার মাকে নিয়ে বৌ দেখতে আসবে তখন যদি রিজেক্ট করে দেয়?

কান্না থামিয়ে হতবাক হয়ে তাকায় শ্রেয়া।পরশু আনার্সরা দেখতে আসবে মানে?তাহলে কি ভাই সব জেনে গেল?

—“আর যেন এসব নিয়ে কথা না উঠে এ বাড়িতে।কাল নতুন সূর্যোদয় হওয়ার সাথে সাথে এ বাড়িতেও যেনো সবকিছু নতুন রূপে শুরু হয়!

বলতে বলতে পা চালায় সিঁড়ির দিকে।সবাই তাকিয়ে রয় সেদিন।সে সঙ্গে দীর্ঘ নিঃশ্বাসের সাথে মনকে স্থির করে নেয় সবকিছু নতুন রূপে শুরু করার অদম্য ইচ্ছা শক্তি নিয়ে।

°
—“ অ্যাঞ্জেল!
দ্বোর হতে মুখ বাড়িয়ে ডাকল।

ফিহার সাথে উল্লাসে মেতে উঠা নেহমাত তড়িৎ তাকায়।হাত বাড়িয়ে বলে—“পাপা!

—“এখনো ঘুমোও নি তোমরা?
এগিয়ে আসে শ্রেয়াণ।

—“আজ সব রুলস ব্রেক!

—“কেমন লাগলো দাদু বাড়ি? হ্যাপি তুমি?
—“এতোওগুলো হ্যাপি!
দুহাত প্রসারিত করে পরিমাণ বোঝায় নেহমাত। শ্রেয়াণ দু কোলে দুজন কে তুলে নিয়ে শুইয়ে দেয়।চুমু দিয়ে বলে–“আজকের মতো ঘুমিয়ে পড়ো!

—“পাপা,মাম্মি কই?
—“মাম্মি?আছে তো!
—“ওকেহ,মাম্মি কে বলে দিও–গুড নাইট!

°
নিজেদের বেড রুমের সামনে এসে ঢুক গিলে প্রথা।আজ দীর্ঘ দিন পর নিজেদের বরাদ্দকৃত কক্ষের সামনে এসে বুকের ভেতর অদ্ভুত ভয়ঙ্কর ধুকপুক করছে। অস্বস্তিরা গ্রাস করছে আষ্টেপৃষ্ঠে।মনে দ্বন্দ্ব চলছে ঢুকবে কি ঢুকবে না।

কাউচে বসে গভীর মনোযোগে একদৃষ্টিতে দ্বোরের পানে চেয়ে আছে শ্রেয়াণ। পর্দার আড়ালে এক অবয়বের দেখা মিলছে কিন্তু সেটা স্থির হয়ে আছে।

—“ভেতরে পা রাখতে ভয় পাচ্ছো জান?

ভেতর হতে এমন মাদকতা মিশ্রিত কন্ঠস্বর কর্ণকোহর পৌঁছাতেই শিরদাঁড়া বেয়ে শিতল কিছু বয়ে গেল প্রথার। চোখ খিচে জোরে শ্বাস টানে একবার। অতঃপর নিজেকে সংযত করে আলগোছে পা রাখে ভেতরে। ধীরস্থির এগিয়ে যায় বেডের দিকে।একপল আড়চোখে তাকানোর ক্ষুদ্র প্রয়াস চালায় শ্রেয়াণের মুখে।খট করে দরজা বন্ধের আওয়াজ আসতেই চোখ বুজে নিল প্রথা।কম্পিত হৃদয় নিয়ে নজর বুলিয়ে নেয় রুমময়। এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কতো শত স্মৃতি।দেয়ালে এখনো তাদের ছবিটা দৃশ্যমান।অবাক চোখে চেয়ে রয় প্রথা।শেষ দিন যেভাবে রেখে গিয়েছিলো রুমটা আজো তেমনি আছে।দেখার মাঝে শুভ্র আলো নিভে গিয়ে নীল রঙের ড্রিম লাইট জ্বলে ওঠে। চকিতে পিছে ফিরে প্রথা। শ্রেয়াণের অবয়ব তার দিকে এগিয়ে আসছে একপা দু’পা।কম্পিত হাতটা বুকের উপর রাখে, যেখানে ধড়ফড় করছে বুক। কাঁপছে হৃদয়। মনে হচ্ছে শরীর দুর্বল হয়ে আসছে প্রথার। দু’হাতে দুধারের উড়না খামচে ধরে ফট করে ঘুরে যায় রমণী।ক্ষণকাল পর টের পায় পিঠে উষ্ণ শ্বাসের ছোঁয়া আঁচড়ে পড়ছে।কোমরে দুটো হাত বিচরণ করছে।ঘনঘন শ্বাস ত্যাগ করে হাত দুটোতে হাত রাখে প্রথা। শ্রেয়াণ আরেকটু গভীর হয়। ঘাড়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে মুখ গুঁজে দিয়ে বলে—“ওয়েলকাম!

প্রথার কন্ঠ রোধ হয়ে আছে।ভারি নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া কিছু শুনা যাচ্ছে না আপাতত। কিছুক্ষণ কে!টে যাওয়ায় পর শ্রেয়াণ বলে উঠে কোমল গলায় —“আজ শান্তি মতন এক লম্বা ঘুম দিতে চাই, ডোন্ট ডিস্টার্ব!

#চলবে ইনশা-আল্লাহ

#চিত্তে_অঙ্কিত_কৃষ্ণরেখা
#পর্বঃ||অন্তিম+শেষাংশ||
#ফাহমিদা_নূর_সাদি

(১৮+এলার্ট)
প্রথার কন্ঠ রোধ হয়ে আছে।ভারি নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া কিছু শুনা যাচ্ছে না আপাতত। কিছুক্ষণ কে!টে যাওয়ায় পর শ্রেয়াণ বলে উঠে কোমল গলায় —“আজ শান্তি মতন এক লম্বা ঘুম দিতে চাই, ডোন্ট ডিস্টার্ব!

কথা শেষে প্রথাকে নিয়েই শুয়ে পড়ে বেডে। হতচকিত প্রথা বলে উঠে—“আমার ফ্রেশ হওয়া প্রয়োজন।ওয়াশরু…
বাকিটা শেষ করার আগেই ঠোঁট জোড়া শ্রেয়াণের আয়ত্তে চলে যায়। চেষ্টা করেও শব্দ বার করতে পারে না রমণী।দীর্ঘ চুম্বনের পর প্রথার অধর ছেড়ে গলায় মুখ ডুবিয়ে দেয় শ্রেয়াণ। নিঃশ্বাসের পাল্লা ভারী হয়ে আসছে প্রথার। দু’হাতে শ্রেয়াণের পিঠের দিকে খামচে ধরতেই –“আহ! শব্দ করে উঠল।

তড়িৎ হাত আলগা করে নিল প্রথা। বিচলিত গলায় বলল— ঘা’য়ে ব্যাথা দিয়েছি ফেলেছি?

ঘাড়ে ভেজা চুমু দিয়ে শ্রেয়াণ নেশাতুর সুরে বলে–“কোন ব্যাপার না,জান!

°

অন্ধকার রুমে অনবরত অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে নিলিশা। শ্রেয়াণ তাকে ছেড়ে দিলেও শাহাদ তাকে ক্ষমা করেনি।রাতেই বেরিয়ে গেছে বাড়ি ছেড়ে।নিলিশা তাকে হাত জোড় করেছিল না যেতে কিন্তু সে শুনে নি। শেষে না পেরে পা জড়িয়ে ধরেছিল মানবী। এতেও শাহাদের মন গলেনি।তাকে সম্পূর্ণে অগ্রাহ্য করে চলে গিয়েছে হসপিটালে।বাড়ির অনেকেই দেখেছে সেই দৃশ্যপট তবে কেউ কিছু বলেনি।নিলিশাও ভোগ করুক না কিছু কষ্ট,ক্ষতি কী?সবাই যদি ক্ষমা করে দেয়, শাস্তি দিবে কে?


কেটেছে ক’দিন ।মাঝে প্রথার কম্পানি থেকে ফিরে যাওয়ার অর্ডার এসেছিল। প্রথাও শ্রেয়াণ কে ভয় দেখানোর অযুহাতে ফিরে যেতে ব্যাগ পত্র গুছিয়ে নিয়েছে কিন্তু শেষ পর্যন্তে প্রথার হয়ে শ্রেয়াণ নিজেই রেজিগনেশন লেটার পাঠিয়ে দিয়েছে ই-মেইল করে!রমণীর সাধের চাকরীর রফা দফা করে ছেড়েছে শ্রেয়াণ।
°
আজ শ্রেয়া কে আংটি পরিয়ে গেছে আনার্সের মা সহ আরো কিছুজন এসে।সাথে এসেছিল আনার্স নিজেও।তার বন্ধু স্বরুপ শাহাদও এসেছে তাদের সাথে আবার ফিরেও গেছে।নিলিশা চেয়েছিল তার সাথে কথা বলতে কিন্তু বারবার অপারগ হয়েছে।আজকাল নিলিশা চুপচাপই থাকে।বাড়ির সবার সাথে ঠিক তেমন একটা কথা বলে না।হয়তো লজ্জায়, অপরাধ বোধে!প্রথা অবশ্য সবকিছু ভুলে তার সাথে সুন্দর মার্জিত ব্যাবহার করে।

রাত প্রায় বারোটা ছুঁই ছুঁই।অফিস থেকে মাত্রই ফিরেছে শ্রেয়াণ।গায়ের সাদা শার্টের উপর ব্ল্যাক কোট।মা, মেয়ের রুমে একবার উঁকি দিয়ে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হয়।গলার টাই ঢিলে করে দ্বোর খুলে কক্ষে প্রবেশ কালে পা জোড়া থমকে যায় তার। চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে রয় সামনের দৃশ্য পটে। চোখ সেঁটে আছে তার ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রমণীর উপর। দৃষ্টি স্থির রেখে দ্বোর লক করে দেয় শ্রেয়াণ। শুষ্ক ঢুকে গিলে সামনে চেয়ে থেকে জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয় বার কয়েক।

লাল রঙের পিনপিনে পাতলা শাড়িতে আবৃত প্রথা।লম্বা গলা বিশিষ্ট ব্লাউজ। শাড়ির উপর থেকে অনেককিছুই দৃশ্যমান। চুলগুলো ছেড়ে দেয়া কাঁধের এক পাশে।মুখে হালকা প্রসাধনী কিন্তু ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক। প্রথাকে আবেদনময়ী পূর্ণ রমণীর মতোই দেখাচ্ছে। ইতোমধ্যে ঘাম জমতে শুরু করেছে শ্রেয়াণের কপাল জুড়ে।ঘাড়ে গলায় স্লাইড করতে করতে একপা দু’পা এগিয়ে যায় শ্রেয়াণ।আয়নায় শ্রেয়াণের গতিবিধি লক্ষ্য করে ঠোঁট কামড়ে মৃদু হাসছে প্রথা। শ্রেয়াণ গায়ের কোট খুলে সোফায় ছুড়ে মারলো। দৃষ্টি আয়নার প্রতিবিম্বে নিস্তব্ধ রেখেই প্রথার পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। দৃষ্টি মিলিত হয় দুজনের। শ্রেয়াণ চেয়ে রয় অপলক।নেশা ধরে যাচ্ছে তার। এই বুঝি নিঃশ্বাস আটকে এলো। গলাটা ও শুকিয়ে আসছে,পানি ফেলে ভালো হতো!প্রথা ঠোঁট কামড়ে চোখ নামিয়ে নিয়ে চুলে হাত বুলায়। শ্রেয়াণ ধীরস্থির হাত উপরে তুলে, ব্লাউজের ফিতে খুলে দিতেই চোখ বুজে নিল প্রথা।পিঠে শ্রেয়াণের উষ্ণ শ্বাস বাড়ি খাচ্ছে।শাড়ি খামচে ধরে রমণী।পিঠে অনুভব করে শ্রেয়াণের ঠোঁটের বিচরণ। নিঃশ্বাসের উপর নিঃশ্বাস উঠছে তার। হৃদয়ে আন্দোলন হচ্ছে চরম হারে। ভেতর যন্ত্রে সুর উঠেছে টালমাটাল। শ্রেয়াণের হাতদ্বয় শাড়ির ফাঁক গলিয়ে প্রথার মেদহীন উদরে বিচরণ করছিল যখন, তখন রমণী সহ্য ক্ষমতা হারিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় শ্রেয়াণের মুখোমুখি। দু বাহুর শার্টের কলার খামচে ধরে শ্রেয়াণের। শ্বাস প্রশ্বাস তখন দুজনেরই এলোমেলো।কোমর জড়িয়ে ধরে কপালে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বুজে নেয় দুজন।

একসময় চোখ মেলে শ্রেয়াণ। দৃষ্টিতে মাদকতা মিশিয়ে দুহাতের আজলে প্রথার মুখ তুলে বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ঠোঁটে বুলিয়ে বলে–“ক্যান আই..

সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে প্রথা নিজেই ঠোঁটে আক্রমণ করে বসে।অত্যাচার্য হয়ে চোখ বড় বড় করে নেয় শ্রেয়াণ। প্রথা তাকে কিস করলো?তাও নিজ ইচ্ছায়?
অবাক তা কে পেছনে ঠেলে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ধীরে ধীরে চোখ বুজে নেয়।প্রথার চুলে হাত গলিয়ে আরো নিকটে নিয়ে আসে।মত্ত হয় দুজন গভীর চুম্বনে।

এক গভীর চুম্বন শেষে দুজন ক্লান্ত হয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে ভারী নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে ব্যস্ত হয়।শ্রেয়াণ প্রথার ইঙ্গিত আন্দাজ করে বলে—“আর ইউ শিওর?

প্রথা যেনো উত্তর দেয়ার অবস্থায় নেই, তবুও যথাসম্ভব মাথা ঝাঁকিয়ে বলে–“হু!

হট করে তাকে কোলে তুলে নেয় । চারপাশে বিভিন্ন ফুলের গন্ধে মৌ মৌ করছে।বেডে অসংখ্য ফুলের পাপড়ি তরতাজা পাপড়ি।বেডের উপর প্রথাকে শুইয়ে দিয়ে তার উপর নিজের ভার ন্যস্ত করে শ্রেয়াণ। মুখশ্রীতে, ঘাড়ে,বুকে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিতে দিতে অস্থির চিত্তে বলে উঠে—“আজ একটু বেশীই উম্মাদ হয়ে উঠলে জান তুমি সামলে নিও প্লিজ!
জবাব হিসেবে শ্রেয়াণ কে শক্ত আলিঙ্গন করে প্রথা।উম্মাদের ন্যায় শার্টের বোতাম খুলতে লাগে শ্রেয়াণ।আজ ভালোবাসার মানুষের সম্মতিতে শ্রেয়াণ সত্যিই উম্মাদ হয়ে যাবে। যন্ত্রণাময় ভালোবাসায় ভরিয়ে দেবে প্রথা নামক অস্তিত্ব কে।

শ্রেয়াণ-প্রথার গল্প এখানেই শেষ নয়।হয়তো ভোরের আলো ফুটতেই সূচনা হবে এক নতুন গল্পের।একসাথে হাতে হাত রেখে পাড়ি দেবে বহুদূর।যে পথের গন্তব্য অজানা।ভালো থাকুন তাদের ভালোবাসা।নিলিশা কিংবা জে.কের মতো কালো ছায়া না পড়ুক তাদের সংসারে।

|| সমাপ্ত||