চিত্তে অঙ্কিত কৃষ্ণরেখা পর্ব-১০

0
724

#চিত্তে_অঙ্কিত_কৃষ্ণরেখা
#পর্বঃ|১০|
#ফাহমিদা_নূর

-“ ঘেঁষতে হবেও না!
এইটুকু বলে প্রথার চোখের দিকে তাকায় শ্রেয়াণ।পরপরই বলে-” কারণ এক্ষুনি এই মুহূর্তে আমি আমার মেয়েকে নিয়ে চলে যাব!

কথা শেষ করেই বেডে ঘুমন্ত নেহমাতের দিকে এগিয়ে যায় শ্রেয়াণ। আতঙ্কে খেই হারিয়ে ফেলে প্রথা।কী করবে না করবে বুঝতে না পেরে দ্রুত পায়ে শ্রেয়াণের সামনে বাঁধ সেজে দাঁড়ায়। আক্রোশ মিশ্রিত কন্ঠে কম্পিত গলায় হিসহিসিয়ে বলে উঠে-“ আমার বাচ্চা কে টাচ করার সাহসও করবেন না মিস্টার শ্রেয়াণ জাওয়ান! সেদিন স্ত্রী হিসেবে মুক্তি দিয়ে দূরে সরে গেছিলাম কিন্তু মা হিসেবে একটুও ছাড় দেবো না! আমার মেয়েকে আপনি কেন পৃথিবীর কেউই কেড়ে নিয়ে যেতে পারবে না!

-“ ও আমারো মেয়ে!
-” আমিই ওকে জন্ম দিয়েছি!
-“ আমাকে ছাড়া সেটা অসম্ভব ছিল!

শ্রেয়াণের কথায় প্রথা নিভৃতে তাকিয়ে থাকে অপলক।মুখে শব্দ নেই অথচ চোখের দৃষ্টি স্পষ্টতই বিদ্রোহের ভাষা বলছে। হয়তো তার শিরাগুলো শক্ত হয়ে উঠেছে, মনের গভীর থেকে ওঠা অসন্তোষ তার অস্তিত্বের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে পড়েছে।

-” বিগত পাঁচ বছর কোথায় ছিল আপনার বাবা সত্ত্বা?
-“ তোমাদের ট্র্যাক করার কোন উপায় রেখেছিলে?
-“ উপায় রাখার মতো মহৎ কোন কাজ করেছিলেন বুঝি?এক শরীর আর পোষাচ্ছিল না আপনার, তাই তো মুক্তি দিয়ে হারিয়ে গেছিলাম তাহলে আজ কেন__

রাগে ফুঁসছে প্রথা, অতিরিক্ত রাগে মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না।পাঁচ বছরের পুষিয়ে রাখা অভিমান,ক্ষোভ,জেদ যেনো মাথা ছাড়া দিয়ে উঠেছে আজ।তার শরীর যেন তপ্ত লোহায় রূপান্তরিত হয়েছে। আঁখি যোগল এখন দুটি অগ্নিকুণ্ড, যার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে যেন শ্রেয়াণ কে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিতে চাইছে। নাসারন্ধ্র থেকে বেরিয়ে আসছে ভারী শ্বাস, যেন অন্তরের আগুন প্রশমিত করার ব্যর্থ চেষ্টা করছে।

শ্রেয়াণের স্থির নেত্র জোড়া প্রথাকে পর্যবেক্ষণ করছে গভীর ভাবে।অবাক , হতবাক, মুগ্ধ ,সুখ সব মিলিয়ে মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে তার। প্রতিক্রিয়ায় কি করবে খুঁজে পায়না মস্তিষ্ক বিচরণ করে।কথা হচ্ছে তাদের চোখে চোখ। একজনের চোখ শীতল বিপরীত জনের চোখে ক্ষোভ। দুজনের নিরবতা ছিন্ন করতে শ্রেয়াণের একটি ফোনই যথেষ্ট ছিল। ভাইব্রেশন দিয়ে উঠল পকেট হাতটে ফোন হাতে নেয় শ্রেয়াণ।একপল প্রথার দিকে চেয়ে ফোন রিসিভ করে কানে তুলে। ওপাশ থেকে ভেসে আসে উদ্বিগ্ন কন্ঠ-“ দাভাই তুমি কোথায়!

শ্রেয়াণ জানতে চাইলো-“ কেনো?
-“ আমি আজ স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রথা বৌ মণির মতো কাউকে দেখেছি!আমি শিওর ওটাই বৌ মণি ছিল!তুমি প্লিজ তাকে খুঁজে বের করো!আমরা তাকে আর ছোট বেবী কে দেখতে চাই!

পুরো দমে কথা শেষ করেই থামলো শ্রেয়া।বোনের কথাগুলো শ্রেয়াণ সবটাই মনোযোগ দিয়ে শুনে প্রথার চোখে চোখ রাখে। কিছুটা শান্ত হয়ে ভ্রু কুঁচকে শ্রেয়াণের দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। দৃষ্টি অনড় রেখে চাপা গলায় শ্রেয়াণ জবাব দেয়-“হু, খুব শিঘ্রই বেবী কে নিয়ে ফিরবো ও বাড়িতে।সাথে তোর বৌ মণিও থাকবে!

-“ তুমি তাদের পেয়েছো?
অস্থির চিত্তে জানতে চাইলো শ্রেয়া।

-“ নাহ। এখনো পায়নি তবে খুব তাড়াতাড়িই পেয়ে যাবো!আমি এখন ব্যস্ত পরে কথা বলছি।

সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফোন পকেটে গুঁজে নেয় শ্রেয়াণ।নিকটে চলে যায় প্রথার। মৃদু স্বরে বলে-“ যেই মা পাঁচটি বছর তার সন্তান কে নিজ হাতে লালন পালন করেছে,বাবা হিসেবে হুট করে তাকে নিয়ে যাওয়ার কোন অধিকার আমার নেই। শুধু দেখতে চেয়েছিলাম মায়ের অগ্নিশর্মা রূপটা কেমন হয়।

একটু থেমে ফের বলে,আমি এতোটাও পাষাণ নয়।তুমি নিজের মুখে যতক্ষণ না তাকে পরিচয় করিয়ে দেবে আমিই তার বাবা ততক্ষণ পর্যন্ত আমি তাকে কিছুই বলবো না।তবে শর্ত মানতে হবে!

প্রথা সরু চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল-“ কী শর্ত?

ডান হাতের সহায়তায় নিজ ভঙ্গিতে তর্জনী দিয়ে ডান দিকের ভ্রু চুলকে নেহমাতের দিকে একপল স্নিগ্ধ নজরে তাকায় শ্রেয়াণ।বলে উঠে-“ আমার যখন ইচ্ছে তখন তার সাথে কথা এবং দেখা করতে পারবো!তুমি বাঁধ সাজবে না!

-“ একদম নাহ!
তড়িৎ ফোড়ন কাটে প্রাথা।

-“ তো কি করবো তুমিই বলো? ছেড়ে দেবো সব অধিকার? হ্যাঁ মানছি স্বামী হিসেবে আমি ভুল করেছি কিন্তু সন্তান কে বাবার কাছ থেকে আলাদা রাখতে পারো না তুমি! ইতোমধ্যে পাঁচটি বছর ধুঁকে ধুঁকে কেটেছে আমার। প্লিজ আর শাস্তি দিও না!

মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয় প্রথা।মনে দ্বন্দ্ব চলছে,কী করবে সে?কী করা উচিৎ তার?নেহমাতের সাথে মিশতে দেবে শ্রেয়াণ কে?বাবা কে তার সন্তান থেকে আলাদা করার অধিকার তারও নেই! কিন্তু.. পাঁচ বছর আগে শ্রেয়াণ তাকে যেভাবে কষ্ট দিয়েছে সেভাবে যদি ছোট নিষ্পাপ নেহমাত কেও দেয়?তার সাথে ক্লোজ হয়ে ফের যদি প্রথার মতো তাকে দুঃখ দেয়? বাচ্চা মেয়েটা সহ্য করতে পারবে? অবশ্যই পারবে না! কোণা চোখে শ্রেয়াণের দিকে তাকায় প্রথা। নিম্ন আওয়াজে বলে-“ ভেবে দেখবো!

-“ ভেবে দেখবে মানে?ভুলে যেও না আমি ওর বাবা!

বুক ভর্তি প্রলম্বিত শ্বাস টানে প্রথা। দৃঢ় গলায় বলে-“ ঠিক আছে! আপনি ওর সাথে মিশতে পারবেন একজন বন্ধু হয়ে,তার সাথে দেখাও করতে পারবেন যখন খুশি! কিন্তু.. পাঁচ বছর আগে তার মায়ের স্বচ্ছ হৃদয়ে সেভাবে আঘাত করেছিলেন তার কিঞ্চিৎ পরিমাণও যদি আপনার জন্য আমার মেয়ে পায়।আমি হাত গুটিয়ে বসে থাকবো না তখন।

নিম্নাষ্ঠ কামড়ে ধরে দৃষ্টি ফ্লোরে নিবদ্ধ করে আছে শ্রেয়াণ। রাগের সময় মানুষের অস্তিত্ব যেন একটি উত্তপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো হয়ে ওঠে, যার অন্তর্গত আগুন তীব্র ক্রোধে জ্বলতে থাকে। শ্রেয়াণেরও বর্তমানে ঠিক এমনই হচ্ছে।ক্রুদে তার হৃদয় হয়ে উঠেছে এক বিশৃঙ্খল সমুদ্র, যেখানে ঢেউগুলো ক্রমাগত আছড়ে পড়ছে, শান্ত হওয়ার কোনো উপকূল খুঁজে পাচ্ছে না। শিরাগুলোও উত্তেজনায় স্ফীত এবং শরীরের প্রতিটি কণিকা যেন অস্থিরতার এক অদৃশ্য ঝড়ে ভেসে যেতে চাইছে। চোয়াল শক্ত করে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয় সে। বক্ষস্থল উঠানামা করছে ক্রমাগত।প্রথার কথাগুলো তার হৃদয় এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছে, সুচের মতো হৃদপিণ্ডের কোথাও গিয়ে যেনো বিঁধছে আক্রমণাত্মক হয়ে।সাথে প্রতিজ্ঞা জেঁকে ধরেছে পাঁচ বছর আগে যেই ফোন কলের জন্য আজ তারা বিচ্ছিন্ন?সে ই নাম্বারের মালিক কে আবারো খুঁজে বের করতে মাঠ নামবে সে! পৃথিবীর যে প্রান্তেই লুকিয়ে থাকুক, টেনে হিঁচড়ে সামনে এনে মনের খোয়াইশ মিটিয়ে ঔ জে.কে কে খু!ন করবে নিজ হাতে!প্রথার খুঁজে না পেয়ে ওর ব্যাপারে তখন আগ্রহ দেখায়নি শ্রেয়াণ।কিই বা দেখাবে?তার জীবনের আসল সম্পদ গুলো তো হারিয়ে গিয়েছিলো অজানায়। তখন জে.কে নামক কীট কে ধরতে পারলেও প্রথা তো ফিরবে না তাই ই ওসব মুছে ফেলেছিল স্মৃতি থেকে কিন্তু যে জীবনে প্রথা আর তাদের ভালোবাসার প্রাণ ফিরে এসেছে ,তাদের আর কোন ক্রমেই হারিয়ে যেতে দেবে না শ্রেয়াণ?সে এবার আর কোন ভুল করবে না।

শ্রেয়াণের ক্রুদ্ধ মুখশ্রীতে তীর্যক চোখে ভ্রু কুঁচকে নজর বুলায় প্রথা। হঠাৎ তার এমন প্রতিক্রিয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে মনে মনে তাচ্ছিল্য হেসে বলল -“ হয়তো কথাগুলো শুনতে তেঁতো লাগছে! লাগারই কথা, সত্যি সবসময় তেতোই হয়!

দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে চোখ বুজে নিল কিয়ৎক্ষণ।নিজের ভেতরের প্রজ্বল্লিত আগুন কে শান্ত করার চেষ্টায় সফল হয়ে ফট করে চোখ মেলে প্রথার দিকে তাকায়‌।মেয়েটা অন্যমনস্ক হয়ে কী যেনো ভাবছে।হয়তো তাকে নিয়ে অথবা তার কাছ থেকে কিভাবে পালিয়ে বেড়াবে সেটাই ভাবছে!

খোঁচা খোঁচা দাড়ি ভর্তি মুখে হাত বুলিয়ে স্মিত হাসল শ্রেয়াণ।প্রথার উদ্দেশ্যে অত্যন্ত কোমল গলায় বলল-“ শান্তিতে ঘুমায় না অনেক দিন!আজ এখানে থাকি?

অতি অসন্তুষ্ট চোখে ছোট ছোট করে তার দিকে তাকায় প্রথা। ফুঁস করে শ্বাস টেনে হাত কিড়মিড়িয়ে দু কদম এগিয়ে যায়,চিবিয়ে চিবিয়ে বলে -’’ ওই যে, লোকে কি একটা কথা বলে না ? বিড়াল কে কী যেন_

তার অসম্পূর্ণ বাক্য সম্পূর্ণ করে দেয় শ্রেয়াণ -“ বিড়াল কে লায় দিলে মাথায় ওঠে!বসতে দিলে শুতে চায়?

রাগে ,ক্ষোভে যেনো চারপাশ আঁধার দেখছে প্রথা। মানুষ টা কি তার কথাকে মজা হিসেবে নিল? দ্রুত শ্রেয়াণের বাহু টেনে বলল-“মজা নেন আমার সাথে?এক্ষুনি বেরিয়ে যান!

সর্বস্ব দিয়ে টেনে শ্রেয়াণ কে এক চুলও নড়াতে সক্ষম হয়না প্রথা। বাঁকা হাসিতে শ্রেয়াণ কে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রাগটা হলো আরো দ্বিগুন।হার মানার পাত্রী সে না,চেষ্টা অব্যাহত রাখতে ফের টান দিতে হুট করেই তাকে আপন বক্ষস্থল আঁকড়ে ধরে শ্রেয়াণ। শক্ত করে তার মাথা চেপে ধরলো বুকের বাঁ পাশটায়। আকষ্মিক কাজে অসাড় হয়ে যায় প্রথার সমস্ত সত্তা। শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসার উপক্রম প্রায়। বিষ্ময়ে চোয়াল ঝুলে আসে আপনাআপনি।কি হলো এটা?

সম্বিত ফিরতেই শ্রেয়াণের হাতের শক্ত বাঁধন থেকে ছুটার জন্য শরীরের চঞ্চলতা বাড়িয়ে দেয় প্রথা। অস্থির হারে নড়াচড়া করতে করতে মুখে কথা সংযোগ করে-“ছাড়ুন..ছাড়ুন বলছি?ভালো হবেনা কিন্তু!ছা ড়ুন _

শ্রেয়াণের কর্ণকৌঠরে তার রাগত বুলি গুলো পৌঁছাচ্ছে কিনা কে জানে?সে তো আবেশে চোখ বুজে রয়েছে প্রথাকে বুকের বাঁ পাশে জড়িয়ে।কতো দিন,মাস, বছর পেরিয়ে আজ এই বুকে প্রথা মাথা ঠেকিয়েছে? হোক সেটা জোর করে, কিন্তু তাও রেখেছে তো?আহ! জলন্ত অগ্নিশিখার ন্যায় অনুর্বর খরা ধরা মরুর বুকে যেনো এক পসলা বর্ষণের ছোঁয়া অনুভব করছে শ্রেয়াণ।প্রথার অস্থিরতায় শ্রেয়াণ অজান্তেই বলে উঠে -“ প্লিজ একটু স্থির হয়ে থাকো না!

শ্রেয়াণের কথায় প্রথার কি হলো কে জানে। থামিয়ে দেয় অস্থিরতা।হার মেনে নেয়।কান পাতে শ্রেয়াণের বুকে, অতঃপর চোখ বুজে নেয় আবেশে। ধুকপুক ধুকপুক ধ্বনিতে শ্রেয়াণের হৃদয়ের স্পন্দন শুনছে প্রথা।কতো মনোহর সেই শব্দ!যেনো পৃথিবীর সমস্ত সুর তাল কেও হার মানাবে!

দীর্ঘ পাঁচ বছর পর দুজন মানব মানবী একে অপরকে অনুভব করছে শক্ত আলিঙ্গনের মাধ্যমে! হৃদযন্ত্রের টালমাটাল ধ্বনি শ্রবণ করছে গভীর মনোযোগে। আচমকা চোখ পাকায় প্রথা। শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যা হচ্ছে শ্রেয়াণের সান্নিধ্যে।অসাড় শরীর শ্রেয়াণের বুকে ন্যস্ত করে কান্না করতে চেয়েও নিজেকে ধীক্ষার জানায় তীব্র ভাবে।সে কাঁদবে না এক ফুটাও।বিবস গলায় শ্রেয়াণের উদ্দেশ্যে বলে-“ অ্যাই হেট ইউ!অ্যাই জাস্ট হেট ইউ মিস্টার শ্রেয়াণ জাওয়ান। ঘৃণা করি আপনাকে..

শ্রেয়াণ শুনলো প্রথার মুখনিঃসৃত বাণী। মুক্তি দিল বক্ষস্থল হতে। অতঃপর গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো প্রথার মুখটায়।নজরে নজর মেলায় না প্রথা।দুকদম পিছু হটে শক্ত চোয়ালে দাঁতে দাঁত চেপে এদিক ওদিক মণি দ্বয় ঘুরিয়ে বলে -“ নিহাত ওঠে পড়বে!

শ্রেয়াণ বুঝে নিল প্রথা পরোক্ষভাবে তাকে চলে যেতে ইঙ্গিত দিচ্ছে। প্রতিবাদ করলো না সে বরং হাসল একটুখানি।ঘাড় বাঁকিয়ে নেহমাতের দিকে তাকিয়ে রইল পূর্ণ দৃষ্টিতে।
-“ কী নাম দিয়েছো আমার মেয়ের?

প্রথা ছোট স্বরে জবাব দেয়-“ নেহমাত!

-“ নেহমাত জাওয়ান!
-“ ও আমার মেয়ে..
-“ ইউ নোউ হোয়াট? সন্তান মায়ের হলেও পদবী বাবারই তাকে।সেটা তুমি মানো?বা না মানো!

-“ মেজাজ খারাপ দেখে তর্কে লিপ্ত হলাম না। রাত বাড়ছে,আপনি যাবেন কখন?

শ্রেয়াণ এবার প্রথার মুখোমুখি হয়ে বলে-“ আজকে রাতটা থাকার ব্যাপারে একটু ভেবে দেখলে হয় না?

বিনিময়ে প্রথা এমন ভাবে চক্ষু চাহনি নিক্ষেপ করলো যা দেখে শ্রেয়াণ আশাহত গলায় বলে-“ ওকেহ!যাচ্ছি তো, এভাবে তাকানোর কি আছে?

বলেই দরজার দিকে এগুতে নিলে প্রথা বলে উঠে -“ ওদিকে কোথায়?
আশ্চর্য হলো যেনো শ্রেয়াণ।সেই রেশ ধরে রেখেই শুধালো-“ তুমিই তো বললে চলে যেতে?
-“ ওদিকে যাচ্ছেন কেনো?যে পথে এসেছেন সে পথেই ফিরে যান!
-“ মানে কী ? ব্যালকনি টপকাতে যে পরিমাণ রিস্ক নিয়েছিলাম সেটা দ্বিতীয় বার নিতে বলছো?
আশ্চর্যান্বিত মুখাবয়বে বলে উঠে শ্রেয়াণ।

-“বাবা দাবি করছেন নিজেকে! অধিকার চাইছেন!তার জন্য এটুকু স্যাক্রিফাইস তো করতেই পারেন?
-“ ব্যালকনি টপকে হাত পা ছিঁলে ফেলার সাথে বাবার অধিকার চাওয়ার কি যোগসূত্র বুঝলাম।

-“ এই যান তো এখান থেকে।
মুখে বিরক্তির আভা প্রকাশার্থে শ্রেয়াণ কে ব্যালকনিতে পাঠিয়ে দ্বোর লাগিয়ে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে প্রথা।
-“ আরেহ বাচ্চা কে আরেকবার আদর করতে দাও..শুনেও শুনলো না প্রথা।দ্বারের ওপাশে শ্রেয়াণ বহু হতাশা আর একরাশ বিতৃষ্ণা নিয়ে ব্যালকনি থেকে পাইপে চড়ে নিচে নামে ।বাগান ক্রস করে গেইটের ওপাশে গিয়ে কোমরে দুহাত রেখে বুক ভর্তি শ্বাস নেয়। শান্তি শান্তি লাগছে বুকের মাঝে।আজ হয়তো একটু ভালো ঘুম হবে।খানিক পর সেখানে গাড়ি নিয়ে আফিফ উপস্থিত হয়।

নেহমাতের কপালে চুমু এঁকে কিছুক্ষণ তার সুশ্রী পানে তাকিয়ে রয় প্রথা।মানতেই হবে মেয়ের বেশীরভাগ গঠন বাবর মতোই হয়েছে।এই যেমন সরু নাকটা একদম শ্রেয়াণের মতো।নেহমাত হাসলে দু গালে টোল পড়ে,যেমনটা শ্রেয়াণের হয়।মুখের আকৃতিটাও শ্রেয়াণ শ্রেয়াণ লাগে তবে আবার প্রথার মতোও লাগে।এটা নিয়ে কনফিউজড প্রথা।তবে আদওয়ার ভাষ্যমতে চোখ গুলো প্রথার মতো মায়া মায়া কিন্তু দুষ্টু দুষ্টু হয়েছে নেহমাতের।
অপলক মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কী যেনো মনে করে শ্রেয়াণ যেগালে চুমু খেয়েছিল সেই জায়গায় ঠোঁট ছোঁয়ায় প্রথা। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ভালো ভাবে নেহমাতের গায়ে চাদর মুড়িয়ে দিয়ে নিজের কক্ষে প্রেরণের উদ্দেশ্যে দরজা পার করে কদম তিনেক আগে বাড়িয়ে কিছু একটা ভেবে হুট করে পিছে ঘুরে প্রথা।তাকে দেখেই হতভম্ব হয়ে যায় আদওয়া।হাসার চেষ্টা করলো জোরপূর্বক।এতোক্ষণ কক্ষের বাইরে থেকে ভেতরকার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিল সে গভীর দৃষ্টিতে।এতোটাই গভীরে ছিল যে, প্রথা যে তার দিকে এগিয়ে আসছে তা নজরেই পড়েনি।আদওয়া কে রুমের বাইরে দেখে নেত্র সরু হয় প্রথার। সন্দেহ জাগলো কিছুটা,সেই রেশ ধরে রেখেই স’ন্দিহান গলায় বলল-“ নিশ্চই তুমিই দিয়েছো এ্যাড্রেস?কি করেছে ওরা তোমার সাথে?
ক্ষণকাল মৌন থেকে আদওয়া মিনমিন গলায় জবাব দেয় -“ ভিক্ষা!
-“ হোয়াট!
মৃদু চেঁচিয়ে উঠল প্রথা। চোখ তুলে ম্যামের আশ্চর্যান্বিত মুখাবয়বে তাকায় আদওয়া। অতঃপর বলে-“ আপনি আমাকে ফেলে আসার পর শ্রেয়াণ স্যারের এ্যাসিস্ট্যান্ট গিয়েছিল আমার কাছে। তারপর আপনার বাড়ির এ্যাড্রেস জানতে চাইলো _
-” আর ওমনিই তুমি দিয়ে দিল?
-“ না নাহ।প্রথমে দিতে চাইনি দেখে ওনি আমার সামনে ঝুঁকে এ্যাড্রেস ভিক্ষা চেয়েছে! শুধু তাই নয় কান্নাও করেছে এই বলে যে, আজ বহু বছর পর শ্রেয়াণ স্যার আপনার দেখা পেয়েও হারিয়ে ফেলেছে,যদি আমি এ্যাড্রেস না দিই পৃথিবীর ইতিহাসে আমি খুবই নিষ্ঠুর রমনী খেতাবে ভূষিত হবো! আপনি তো জানেন ম্যাম?আমি ভীতু এবং ইমোশনাল তাই দিয়ে দিয়েছি এ্যাড্রেস!

কটমট চোখে তাকায় প্রথা, ঠোঁট কুঁচকে বলে-“কাঁদতে কাঁদতে যে কেউ এ্যাড্রেস চাইলেই দিয়ে দেবে?

-“ যে কাউকে দেবো কেনো?শ্রেয়াণ স্যার কেই দিয়েছি!

ক্ষণকাল চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে সন্দিহান গলায় প্রথা জিজ্ঞেস করে-“ তুমি শ্রেয়াণ কে চেনো?

হতচকিত হয়ে যায় আদওয়া।তাড়া দেখিয়ে পিছু ঘুরে হাঁটতে হাঁটতে বলে-“ অনেক রাত হয়েছে।যাই শুয়ে পড়ি!

-“আমার উত্তর দিয়ে যাও?
থেমে যায় আদওয়া। ধীরস্থির পেছনে ঘুরে বলে-“ শ্রেয়াণ স্যারের ছবি অনেকদিন আগে আপনার ল্যাপটপে দেখে ফেলেছিলাম।

থমথম হয়ে আসে প্রথার মুখখানি।চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলে-“ অন্যের পার্সোনাল জিনিসে উঁকি ঝুঁকি করা ভালো মানুষের লক্ষণ না।নেক্সট টাইম যেনো না দেখি।যেতে পারো তুমি।

হুঁ শব্দ করে সামনে এগুতেই প্রথার ডাকে ফের থেমে যায় আদওয়া!
-“ তুমি এতো রাতে এখানে কি করছিলে?

ভীরু মুখে পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে পরপরই সম্পূর্ণ ফিরে দাঁড়ালো মেয়েটা।গলা ঝেড়ে বলল -“ শ্রেয়াণ স্যার বলেছিলো নিহাত বেবীর রুম দেখিয়ে দিতে!

বলেই চোখ খিঁচে নেয়।চড় থাপ্পড় ও পড়তে পারে,ম্যামের কোমল হাতের!

-“ তারমানে বাড়িতে ঢুকতে তুমিই ওকে হ্যাল্প করেছো?

ধীরে ধীরে চোখ মেলে উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানায় আদওয়া। দাঁতে দাঁত নিষ্পেষিত করে তাকিয়ে রয় প্রথা।এই মুহূর্তে শ্রেয়াণের উপর ই বেশী রাগ হচ্ছে!কতো সুন্দর ভোলা ভালা আদওয়া টাকে নিজের দলে টেনে নিলো শ্রেয়াণ?

-“ চোখের সামনে থেকে এক্ষুনি সরো!হাত চালাতে ইচ্ছে করছে আমার!

প্রথার ঠান্ডা হুমকিতে দু গালে হাত চেপে অনতিবিলম্বে উল্টো ঘুরে যায়।বীনা বাক্য পদচালনা করে নিজ কক্ষের উদ্দেশ্যে ধাবিত হয় আদওয়া।বলা তো যায়না ,হাতটা আবার তার কানের নিচে চালিয়ে দেয়?

নিস্তব্ধ নিশি রাত।গাঢ় থেকে গাঢ় হচ্ছে প্রহর। অদূর থেকে ভেসে ভেসে আসছে নাম না জানা কীটপতঙ্গের ঝিঁং ঝিঁং ভয়ঙ্কর শব্দ। দিনের ব্যস্ত নগরী এখন প্রায় নিস্তব্ধ। এমন নিঝুম, নিরবতার মাঝে অন্ধকার রুমে শুনা যাচ্ছে কারো ফিসফিস শব্দ।রাত বাজে চারটা পাঁচ মিনিট। গভীর রাতে ফোনে ফোনে আলাপন চলছে প্রেমিক প্রেমিকার।হয়তো অন্যদিন হলে তারা এতোক্ষণ ঘুমে বিভোর থাকতো অথবা যদি জেগেও থাকতো ,তাহলে ভালোবাসার কথা বলতো। কিন্তু আজ তাদের মাঝে প্রেম, ভালোবাসার কোন কথা বিনিময় হচ্ছে না বরং যা হচ্ছে সবটাই একপাক্ষিক তর্ক তাও মূখ্যম বিষয় ’প্রথা’!

তর্কের সূচনা হয়েছিল ঠিক রাত দেড়টার সময়। যখন শ্রেয়া আনার্সের উদ্দেশ্য বলেছিল-“ আজ যাকে দেখেছি সেই বৌ মণি ছিল। ডাক্তার সাহেব আপনি একটু খুঁজ নিয়ে দেখুন?

আনার্স প্রত্যুত্তরে কেবল বলেছিল -“ যার বৌ সে ঠিকই খুঁজে বার করবে। তৃতীয় পক্ষের মতো আমাদের বাঁ হাত না ঢুকানোই শ্রেয়!

অতঃপর সেই সামান্য বাণী থেকে কথোপকথন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে হতে এই অব্ধি এসে পৌঁছেছে। আনার্স কতোবার ঘুমের দোহাই দিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে চাইলো,তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমাও চেয়ে নিলো দশ বারের অধিক কিন্তু কঠোর চিত্তের অধিকারী শ্রেয়ার হৃদয় গলেনি একটুও।তার একটাই কথা – আমি নাহয় বৌ মণি কে খুঁজতে বলেছি।যদি তাকে খুঁজা সম্ভব না হতো,তাহলে ভালোবেসে বুঝাতে পারবো কিন্তু তা না করে যার বৌ সে ঠিকই খুঁজে বের করবে। তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ না করাই শ্রেয়!এতো বড়ো কথা বলবে?

বরাবরের ন্যায় হতভম্ব হয় আনার্স, বিষ্ময়, বিমূঢ় ও হয়।তার মনে মস্তিষ্কে প্রশ্ন ঘুরঘুর করে-“ ভালোবেসে কিভাবে বুঝায়? ভালোবাসার ভাষা
ঠিক কেমন দেখতে হয়?শুনতে কেমন?

সকাল ০৯ঃ৪৬ মিনিট।
কচুরিপানা রঙের শার্ট,তার উপর ধূসর রঙা কোট। শার্টের সাথে ম্যাচিং প্যান্ট।হাতের কব্জিতে কালো বেল্টের ঘড়ির বেশভূষায় নিঃসন্দেহে সুদর্শন দেখাচ্ছে শ্রেয়াণকে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল সেট করে গায়ে পারফিউম স্প্রে করছে সে।কাজ শেষে আয়নায় একবার নিজেকে দেখে নেয়।গাল ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি।খেয়াল করে দেখলে ডান গালের চোখের কিঞ্চিৎ নিচে একটা কালো কুচকুচে তিল চোখে পড়ে। ভালোই লাগে।রেক থেকে একজোড়া কালো জুতা চ্যুজ করে সোফায় গিয়ে বসে পড়ে নিল শ্রেয়াণ। সম্পূর্ণ ফিট হয়ে কক্ষের এদিক ওদিক পায়চারি করতে থাকে।আজ প্রথার সাথে মিটিং আছে তার। কিন্তু মনে দোলাচল চলছে স্কুলে গিয়ে আগে মেয়ের সাথে দেখা করবে?নাকি অফিসে বসে মেয়ের মায়ের সাথে মিটিং সম্পন্ন করবে?

ভাবতে ভাবতে পায়চারি দ্রুততর হতে থাকে তার। অফিসের শোভার ঘরে অবস্থান করছে সে। বিগত পাঁচ বছরে অধিকাংশ রাত এই কক্ষেই বিতিয়েছে।

বাহিরের শীতল বাতাস কক্ষের সাদা পর্দা গুলো নাড়িয়ে দিচ্ছে বিরামহীন।কক্ষের একপাশে একটা কাবার্ড, ওয়্যারড্রপের আর মধ্যমণি বেড।এখানের অধিকাংশ জিনিসের রং সাদা।কাবার্ড, ওয়্যারড্রপে, বেডশিট সবকিছুই সাদায় সাদায় ভরপুর কক্ষের দেয়ালের রঙটাও সাদা।
ভাবনার সাথে পুরো কক্ষ অবলোকন করে ফুঁস করে শ্বাস ত্যাগ করে শ্রেয়াণ। ড্রেসিং টেবিল থেকে ফোন হাতে তুলে আফিফ কে কল লাগায়।আফিফ হয়তো রুমের দিকেই আসছিল।কল রিসিভ না করে স্বশরীরে হাজির হয় তার সম্মুখে।
-“ গাড়ি বার করো স্কুলে যাবো!
-“ ইয়েস বস! কিন্তু মিটিং..
-“ এসেই জয়েন করবো,তুমি এদিকটা সামলে নিও।

সম্মতি জানায় আফিফ।শ্রেয়াণ নিজ থেকে ড্রাইভ করে নেহমাতের স্কুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়।তর সইছে না তার।আজ মেয়ের সাথে কথা হবে!তার মেয়ের মিষ্টি মধুর কণ্ঠ শুনা হবে!তার হাঁটা চলা সবটাই দেখা হবে!

–“ শ্রেয়া ম্যাম, আপনার সাথে কেউ একজন দেখা করতে এসেছে!

দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রথম ক্লাস ছিল শ্রেয়ার। সেটা সম্পন্ন করে ক্লান্ত দূর করতে নিজের ডেস্ক বসেছিল শ্রেয়া। নিজে স্বপ্ন পূরণ করতে এই স্কুলের টিচার পদে জয়ের করেছিল রমনী।ভেবেছিল বাচ্চাদের সাথে হেসে খেলে সময় কাটাবে আর তাদের আদর্শ শিক্ষাদান করবে কিন্তু জয়েনের একমাস পর থেকেই শ্রেয়া উপলব্ধি করেছে বাচ্চাদের বশে আনা চাট্টিখানি কথা নয়! হতাশ শ্রেয়া। খুউব ই হতাশ। যখন বাচ্চা রা ডাক শুনে না তখন শ্রেয়ার মসজিদের মাইকে গিয়ে উচ্চ বাক্যে বুক ফুলিয়ে বলতে ইচ্ছে করে–“ বাচ্চাদের পড়ানোর দায়িত্ব্যের চেয়ে মাটি কাটার কাজ অনেক ভালো। অন্ততঃ তখন নৈঃশব্দ্যে কাজ সম্পন্ন করা যাবে !
কিন্তু আদৌ কি ভালো?বসে বসে এসবই ভাবছিল শ্রেয়া। হঠাৎ দপ্তরির ডাকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়।তার সাথে দেখা করতে কে আসবে আবার?আনার্স আসলে অবশ্যই জানিয়ে আসতো।তাহলে কে এলো! বাড়ির কেউ?

মনে বহু প্রজাতির প্রশ্নের ফিনিক্স নিয়ে দপ্তরির পিছু পিছু যায় শ্রেয়া।দপ্তরির দেখিয়ে দেয়া জায়গায় পৌঁছে কাঙ্ক্ষিত মানুষ কে অনাকাঙ্ক্ষিত স্থলে দেখে আশ্চর্যান্বিত গলায় বলে….

#চলবে ইনশা-আল্লাহ

ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।