#চিত্তে_অঙ্কিত_কৃষ্ণরেখা
#পর্বঃ|১৭|
#ফাহমিদা_নূর
–“ হেই বাসায় বসে কি করছো তুমি? ওদিকে প্রথার সাথে শ্রেয়াণ জাওয়ান ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে ভালোবাসা আদান প্রদান করছে।
ফোনে একের পর এক লাগাতার কল আসায় নাম্বার না দেখেই বিরক্তির আভা প্রকাশার্থে রিসিভ করেছিল নিলিশা। কিছু কটু কথা শুনিয়ে দেয়ার মনোভাবে। কিন্তু তার মুখ খুলতে না দিয়ে অপর প্রান্ত থেকে রুক্ষ স্বর মিশ্রিত কর্কশ গলার আওয়াজ ভেসে আসে।কুঞ্চিত হয় নিলিশার কপাল। ফোন সম্মুখে এনে নাম্বার দেখে ফের কানে ধরে বিচলিত সুরে বলে–“ ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নিয়েছে মানে?প্রথা দেশে ব্যাক করেছে জানতাম কিন্তু শ্রেয়াণের সাথে কিভাবে দেখা হলো তার?আর ভুল বোঝাবুঝিই বা মিটলো কিকরে?
–“ আমি মাত্রই জানতে পেরেছি,প্রথা যে কম্পানির সাথে ডিল কোলাবারেট করেছে ওটা শ্রেয়াণ জাওয়ানেরই!
–“ হোয়াট?
মুদৃ চেঁচিয়ে উঠলো নিলিশা।শ্রেয়াণের প্রতি অদৃশ্য ক্ষোভে চোয়াল শক্ত করে নেয়। খানিকটা সময় স্থির থেকে জোরে দম নিয়ে বেডে বসে পড়ে।পরপরই নিজেকে সান্ত্বনা দেয়– ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নিয়েছে তো কি হয়েছে? বিগত পাঁচ বছর তো দুজন আলাদা ছিল!শ্রেয়াণ বঞ্চিত হয়েছে বাবা ডাক শুনতে! বঞ্চিত হয়েছে বাচ্চার ছোট ছোট আঙুল আঁকড়ে ধরে হাঁটা শেখানোর উপলব্ধি অনুভব করতে! ধুঁকে ধুঁকে কেটেছে পাঁচ পাঁচটি বছর। দীর্ঘ শ্বাস নিল নিলিশা। একজোড়া ভালোবাসার সুখের সংসার ভাঙার পরও কোন অনুসূচনা হচ্ছে না তার মাঝে। বরং রাগ লাগছে ওদের উপর!কি যেন ভেবে নিলিশা বলে–“ শুনো জে.কে আজকের পর থেকে তোমার সাথে আমার যোগাযোগ থাকবে না। তুমি তোমার রাস্তায় আর আমি আমার।এতো বছর দুজন কে আলাদা রাখতে পেরে কিছুটা হলেও তৃপ্তি মিটেছে আমার।
–“ পথ আলাদা মানে?আরো কিছু ইনফরমেশন লাগবে ওই বাড়ির, যেটা তোমাকেই দিতে হবে!
–“ আমি তোমায় আর কোন কিছুতে হ্যাল্প করতে পারবো না।এমনিতেও যদি কখনো বাড়ির কেউ জানতে পারে যে তোমার সাথে হাত মিলিয়ে আমি এসব করেছি। তখন কি হবে ভাবতেই গাঁ শিউরে উঠছে। তাছাড়া শাহাদ কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে সত্যিটা জানতে পারলে?শ্রেয়াণ ই বা কি করবে?দু দুটো সন্তান আছে আমার, সুখের সংসার!
–“ অন্যের সংসারে ফাটল ধরিয়ে নিজে সুখি হতে চাওয়াটা ভালো মানুষের লক্ষণ না!সে যায় হোক,এ নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা নেই!যা বলছি মেনে নাও? শাহিন জাওয়ান আর সায়লা খানম বর্তমানে প্রথার বাড়িতে।সব মিটমাট হলে নিশ্চয়ই ফিরে যাবে প্রথা ওবাড়িতে,ইনফরমেশন দেবে প্রতিটি মুহূর্তের।
–“ বললাম তো আমি..
কথা সম্পূর্ণ করার আগে মেয়েটির শরীর এক অদৃশ্য শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে আসে বিষ্ময়ে।কানের ফোনটা চট করে হাতের ফাঁক বেয়ে গলে পড়ে টাইলসের শক্ত পোক্ত ফ্লোরে।ঠং ঠং ভয়ঙ্কর আওয়াজে মুখরিত হয়ে উঠে কক্ষজুড়ে। অজানা শঙ্কায় শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে এসেছে শীতল স্রোতের মতো। হাত-পা অবশ, রক্ত যেন ধমনীতে প্রবাহিত না হয়ে বরফ হয়ে আসছে তার। বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দ উঠছে, কিন্তু সে নড়তে পারছে না।
কাঁধে কেউ হাত রেখেছে।অনেকটা শক্ত থাবার ন্যায়। অনুভব করতে পারছে,এই ছোঁয়ায় অনেক ক্ষোভ লুকিয়ে আছে! নাসারন্ধ্রে কড়া পারফিউমের ঘ্রান প্রবেশ করতেই চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে আসে তার। শরীরে কম্পন সৃষ্টি হয়েছে মৃদু। ধড়ফড় বুকের বেসুরো ছন্দ মনে হচ্ছে কানে এসে ঠেকছে কঠোর ভাবে। অস্ফুট স্বরে মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে –’’ শাহাদ!
চারপাশের বাতাস গুলোও যেনো ভারী হয়ে উঠেছে,শ্বাস নেওয়াটাও দুঃসহ। অসাড় শরীর নিয়ে ধীরে ধীরে পিছনে ঘুরে নিলিশা।শাহাদ দাঁড়িয়ে আছে, প্রজ্বল্লিত চোখ জোড়া তার দিকেই স্থির।নিলিশা ফাঁকা ঢুক গিলে নিজেকে ধাতস্থ করার প্রয়াস চালায়।হাত পা শিথিল হয়ে আসতে চিইছে বোধহয়।হাসার চেষ্টা করে মেয়েটা জোরপূর্বক।তুতলে আসা গলায় বলতে চাইলো–“ শাহাদ তুমি এই সময়?আজ তো তোমার আসার কথা ছিল না,না?তাহলে..
আহ! শব্দাঘাত ঘরময় ছড়িয়ে পড়লো মুহূর্তেই।শাহাদের শক্ত হাতের চড় সামলাতে ব্যার্থ হয়ে কিছুটা ছিটকে পড়ে বেড সাইড টেবিলের উপর।খেই হারিয়ে ফেলে মেয়েটা। তবুও নিজেকে সামাল দিয়ে উঠে দাঁড়ায় গালে হাত রেখে অশ্রুসিক্ত চোখে। অত্যন্ত বিগড়ে যাওয়া মেজাজে তার দিকে কদম বাড়ায় শাহাদ।চোখ বে য়ে ক্রুদের স্ফুলিঙ্গ উপচে পড়ছে। মুষ্টিবদ্ধ হাত কাঁপছে রি রি। চুলের মুঠি ধরে খুব নিকটে নিয়ে আসে নিলিশার মুখ।
–“ যেই থালায় খাও ঔ থালা ফুটো করতে একবারো বিবেকে বাঁধলো না?কেন খেললে এই নোংরা খেলা? কোন অযুহাতে?
মুখে হাত চেপে চোখ খিঁচ মেরে রয়েছে নিলিশা । শঙ্কায় গাঁ কাঁপছে কিঞ্চিৎ।
দ্বোরের আড়াল থেকে ভয়ে ভয়ে সরে দাঁড়ায় ফাইজা। চোখের জমাটবদ্ধ তরল বিন্দু।মায়ের জন্য মন জ্বলছে তার আবার কিছুটা খুশিও।
প্রথা চলে যাওয়ার পরদিন ই আড়ালে থেকে মায়ের কথা আর বিদঘুটে হাসি দেখে ভয় পেয়ে গেছিলো মেয়েটা। তখন অবশ্য মা কি দোষ করেছে সেটা মাথায় ক্যাপচার্ড করতে সক্ষম হয়নি সে।তার হাসি আর কথাগুলো এতোই বিদঘুটে ঠেকেছিল যে মাঝেমাঝেই তার চোখে ভেসে উঠতো দৃশ্যটা।আস্তে আস্তে ফাইজা বেড়ে উঠতে থাকে সেই সাথে বৃদ্ধি পায় জ্ঞানের পরিধি।একটা সময় সে বুঝতে সক্ষম হয় যে– ছোট মা চলে যাওয়ার পেছনে হাত মায়েরই হাত ছিল! সেই থেকে চলে আসে মায়ের প্রতি অদৃশ্য অনিহা। কিন্তু মুখ ফুটে কাউকে বলার সাহস হতো না। হাজার হোক,মা তো? কোন সন্তানি চাইবে না–তার সামনে মায়ের অবমাননা-অপদস্থ,হোক!
:
শ্রেয়াণের বক্ষস্থলে চুপটি করে আছে প্রথা।বেডে আধশোয়া হয়ে শ্রেয়াণ তাকে আগলে রেখেছে পরম যত্নে।মাঝে মাঝে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিচ্ছে চুলে আবার কখনো কখনো চুলের মিষ্টি ঘ্রাণ টানছে আবেশে।
–“ আজ চলে যাবেন?
প্রশ্ন করে প্রথা। ঠোঁট বাঁকায় শ্রেয়াণ –“ থাকবো কার জন্যে?
–“ তাও ঠিক!
কেন যেনো অসন্তুষ্ট চোখে তাকালো শ্রেয়াণ।তাও ঠিক,মানে?কই বলবে,আজ আমার জন্য থেকে যাও!–তা না বলে কি বললো এটা?
শ্রেয়াণ মৌনতা ভেঙে জিজ্ঞেস করে–“ ফিরবে কখন?
–“ কোথায়?
–“ কোথায় আবার? শশুর বাড়ি!
–“ ফিরবো না বলেই কিন্তু চলে এসেছি, ভুলে যাচ্ছেন কেনো?
–“ তখন ব্যাপার ভিন্ন ছিল! এখন তো সব পরিষ্কার?
ঠক ঠক শব্দ হলো দরজায়।পরপরই ভেসে এলো নেহমাতের গলা–“ পাপা.. পাপা!
ছোট ছোট নয়নে মাথা তুলে চাইলো প্রথা।মুখটা বিকৃত করে ফেলেছে অদ্ভুত ভঙ্গিমায়।মৃদু হাসে শ্রেয়াণ।তার নাকে আলতো টোকা দিয়ে বলে–“ হিংসে হচ্ছে বুঝি?
প্রত্যুত্তর না করে তাকিয়ে রয় রমণী।শ্রেয়াণ দ্বোর খুলে মেয়েকে কোলে তুলে নেয় ।ফিহা কে দেখতে পায়না,হয়তো ড্রয়িং রুমে বড়দের সাথে আছে!
–“ পাপা কে চোখে হারাচ্ছিলে বুঝি?
গালে চুমু এঁকে জানতে চায় শ্রেয়াণ। তড়িৎ জবাব আসে –’’ অ নেক!
ফের বিমুগ্ধ হাসে শ্রেয়াণ। হৃদয় ছেঁয়ে যাচ্ছে প্রশান্তিময় এক শিতল স্রোতে।
সায়লা,প্রতাপ আর শাহিন জাওয়ান আলাপ করছিল বিভিন্ন বিষয়ে। হঠাৎ বেখেয়ালি ভাবে সায়লার চোখ সেঁটে যায় সিঁড়ির দিকে।মা মেয়েকে নিয়ে একসাথে নিচে নামছে শ্রেয়াণ। চেহারায় প্রাণবন্ত আভা। চক্ষু হাসছে মূল্যবান কিছু প্রাপ্তির।
মন ভরে আসে সায়লার।এমন দৃশ্যই তো দেখতে চেয়েছিল সে। চিত্ত জুড়িয়ে দেখা শেষে সায়লা দীর্ঘ শ্বাস নিল ।আজ থেকে হয়তো ছেলের জীবনে ভালো কিছু হবে!
–“ অনেকক্ষণ তো থাকলাম! এবার তাহলে উঠি?
–“ কি বলছেন মা?ডিনার না করে কোথাও যেতে দিচ্ছিনা আপনাদের!
–“ কিন্তু..
–“ কোন কথা নয়!
প্রথার কাছে দমে গেলো সায়লা। সুপ্ত নিঃশ্বাস টেনে কৃতজ্ঞতা জানায়।ফিহা সায়লার পাশ থেকে শ্রেয়াণের নিকটে চলে যায়।নেহমাতের উদ্দেশ্যে বলে–“ আজ থেক্যে তুমি আমার বনু?
ঠোঁট চুকা করে রয় ক্ষণকাল, অতঃপর নেহমাত মুখ ফুটে বলে–“ হুঁ!তুমি আমায় বনু বলে ডাকবে আর আমি তোমায়,
এটুকুন বলে ভাবুক হয় সে। শ্রেয়াণের গলা জড়িয়ে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে–“ ওকে আমি কি বলে ডাকবো পাপা?
তাকায় শ্রেয়াণ। স্মিত হেসে বলে–“ তুমিও ওকে ছোট বনু ডাকতে পারো অথবা নাম ধরে!
–“ ওওওও,আমি ওকে ছোট বলেই ডাকবো!হবে,?
শেষের কথাটি ফিহার উদ্দেশ্যে ছিল। বাচ্চা মেয়েটা কৃতজ্ঞতার সহিত মাথা নাড়ে।
—
রাত হানা দিয়েছে ধরণী জুড়ে। চারদিকে ছেঁয়ে আছে কেবল অন্ধকার আর অন্ধকার।অদূরে ল্যাম্পপোস্টের ক্ষীণ আলো চোখে পড়ে ।ডিনার সেরে ফের ড্রয়িং রুমে আসর বসেছে প্রথার বাসায়।ফিরে যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে,এক পর্যায়ে উঠে দাঁড়ায় সায়লা এবং শাহিন।প্রথার নিকটে গিয়ে বলে–“ আজ আসছি। তোমায় ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি না বলে ভেবোনা এভাবেই ছেড়ে দেবো? খুব শিঘ্রই নিতে আসবো তোমাদের!
–“ মা আপাতত এসব কথা থাক…
–“ থাকবে কেন?কথা দিয়ে কথা রাখোনি তুমি!কি ভেবেছো নাতির মুখ দেখে সব ভুলে গেছি? উঁহু,মনে আছে আমার আর থাকবে!
মাথা নিচু করে নেয় প্রথা। অপরাধী গলায় বলে –“ স্যরি মা! ভুল হয়ে গেছে,মাফ করে দিন!আর কখনো আপনার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করবো না।
–“ তার মানে আবারো নিরুদ্দেশ হওয়ার ইচ্ছে আছে?
প্রথা থমথম খেয়ে গেল যেনো। থমকে যাওয়া চোখে তাকিয়ে কিছু বলবে তার আগে সায়লা থামিয়ে দেয়।
–“ যায় হোক!ওসব ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হও!
নিকটেই ছিল শ্রেয়াণ।তার উদ্দেশ্যে তাকিয়ে কোমল গলায় বলে–“ তুমি কি ফিরবে আমাদের সা..
অসম্পূর্ণ রয়ে যায় তার বাক্যখানা।নেহমাত বাঁধ সেজে বলে উঠে –“ নাআ.. পাপা যাবেনা কোথাও।আমরা একসাথে ঘুমাবো আজ।আমি,পাপা আর মাম্মি!
খুঁক খুঁক কেঁশে উঠল প্রথা।চোখ পাকিয়ে তাকায় মেয়ের দিকে। মৃদু হাসল সায়লা।নেহমাতের মুখে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে–“ ওকে। পাপা কে তোমার কাছে রেখে গেলাম! অনেক ভালোবাসা দিও তাকে।
–“ উঁ!
আবারো হাসেন সায়লা। পলকহীন খানিকটা সময় চেয়ে রইলেন পাপা মেয়ের দিকে।মুখে মুখ লাগিয়ে রেখে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আছে বাবা মেয়ে। চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করছে না।
শেষ বারের মতো হানিফা বেগমের সাথে দেখা করতে তার কক্ষের দিকে অগ্রসর হয় সায়লা। বৃদ্ধার বয়স হয়েছে সাথে নানা রোগ ব্যাধি। আজকাল হাঁটা চলা করতে কষ্ট হয় তার।তাই বেশিরভাগ সময় রুমেই থাকেন তিনি। সঙ্গি হিসেবে চারু তো আছেই!
—
সায়লারা ফিরে গেছে একটু আগেই। ড্রয়িং রুমে বসে টিভিতে খেলা দেখছে শ্রেয়াণ।আজ এখানে থাকবে সে,যদিও ভনিতা করে চলে যাওয়ার ভান করেছিল প্রথার অনুমতি পাওয়ার লক্ষ্যে । পরবর্তীতে মেয়ের বায়নার কাছে হার মেনে প্রথা মুখ ফুটে বলতে বাধ্য হয়েছে–শ্রেয়াণ কে থেকে যেতে!প্রতাপ চৌধুরীর সাথে টুকটাক কথা হয়েছিল শ্রেয়াণের।পরে ভদ্রলোক নিজের কক্ষে ফিরে গেছেন। বর্তমানে সে একাই বসে আছে। প্রথা রান্না ঘরে কি যেন করছে।একটু পর সেখানে উপস্থিত হয় রমণী।হাতে পপকর্নের বাটি।শ্রেয়াণ সরু দৃষ্টিতে তাকাতেই বাটি এগিয়ে দেয়।ক্ষণকাল মুখের উপর দৃষ্টি স্থির রেখে বাটি হাতে তুলে শ্রেয়াণ।নেয়ার সময় প্রথার হাত ছুঁয়ে দিতে ভুলে না মোটেও। দাঁতে দাঁত খিঁচে তৎক্ষণাৎ চোখ বুজে নেয় প্রথা। পরপরই শ্রেয়াণের কথায় ফট করে চোখ মেলে–“ চোখ বুজে আছো যে? রোমান্টিক কিছু ফিল হচ্ছে বুঝি?চুমু টুমু খাওয়ার আগ্রহ আছে নাকি?থাকলে বলতে পারো কিন্তু?
পাশের সোফায় ধফ করে বসে পড়ে রমণী।রুক্ষ চোখে তাকায় অথচ শ্রেয়াণের চোখে দুষ্টু হাসি।মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে প্রথা জবাব দেয়–“বাজে কথা কিভাবে বলতে পারেন আমি বুঝে কুল পায়না!কোন কিছু আটকায় না,না?ওই মুখে?
–“ কথা বলার পরিবর্তে যেহেতু সরকার কে টেক্সট দিতে হয়না, সেহেতু আটকানোর প্রশ্ন ই উঠে না।ইউ নোউ– মনের কথা চেপে রাখতে নেই। সেটা বিপরীত মানুষের কাছে…
–“ আপনার লেকচার শেষ হলে রিমোট দিন!
–“ দেখছো না খেলা দেখছি?তোমার বাসায় আছি বলে কি সবকিছুতে জোর খাটাবে ভেবে নিয়েছো নাকি?
–“ অফকোর্স! বাসা যেহেতু আমার, হক ও আমার বেশী থাকার কথা।দিন রিমোট দিন?
হাত বাড়িয়ে দেয় প্রথা। শ্রেয়াণ তাকায় একপল।হাত টা তার মুখের সম্মুখেই।চতুর মণি দ্বয় এপাশ ওপাশ ঘুরিয়ে কালবিলম্ব না করে টুপ করে ঠোঁট বসিয়ে শব্দ করে চুম্বন এঁকে দেয় হাতে। হতভম্ব চেয়ে তড়িৎ হাত গুটিয়ে নেয় প্রথা। সতর্ক নজরে ঘরময় চোখ বুলিয়ে নেয়।পাছে কেউ যদি দেখে নেয়? মান সম্মানের রফা দফা!
–“ কেউ দেখেনি ডার্লিং! লজ্জা পাওয়ার ভয় নেই!
হাত কিরিমিরি করে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠে রমণী। আগুনে ঘি ঢেলে দেয় শ্রেয়াণ –“ উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছো কেন?প্লিজ সামলাও নিজেকে!এ্যাঁটাক ফ্যাঁটাক হয়ে যেতে পারে!
প্রথা হুট করে উঠে দাঁড়ায়।রাগত মুখশ্রীতে শ্রেয়াণের দিকে এগিয়ে আক্রমণ করে বসবে তার আগেই বাবার দল ভারি করতে সেখানে উপস্থিত হয় নেহমাত।
–“ মাম্মি তুমি পাপার সাথে কী করছো?
হাত গুটিয়ে তাকালো প্রথা। শ্রেয়াণও তাকায় বিজয়ী হেসে।নেহমাত ফের বলে–“ তুমি কি পাপা কে আঘাত করতে হাত বাড়িয়েছিলে?
–“ না নাহ! আঘাত করতে যাবো কেন?চুলে কি যেনো লেগেছিল সেটাই দেখছিলাম!
–“ মিথ্যা বলছো না তো?
–“ আজব! মিথ্যা বলবো কেন?আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না তোমার?
–“ ঠিক আছে,এই নিয়ে পরে কথা হবে।আগে পাপার সাথে একজনের পরিচয় করিয়ে দিই!
কথাগুলো মুরব্বিদের ন্যায় শুনালো। মেয়েকে হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকতেই কোলে চড়ে বসে নেহমাত।প্রথা একপাশে বসে ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে রয় কেবল।একটু পর নেহমাতের হাত বন্দী প্রথার ফোনে কল আসতেই রিসিভ করে সে।মুখের সম্মুখে তুলে ধরতেই ভেসে উঠে রাউনাফের চেহারা। উচ্ছ্বাসিত গলায় হাসি মুখে নেহমাত শুধায়–“ আঙ্কাল দেখো আমার হ্যান্ডসাম পাপা!
#চলবে ইনশা-আল্লাহ
#চিত্তে_অঙ্কিত_কৃষ্ণরেখা
#পর্বঃ|১৮|
#ফাহমিদা_নূর
অবরুদ্ধ কক্ষটা শুভ্র আলোতে ভরপুর। জানালার পর্দা গুলোও মৃদু হাওয়ায় আন্দোলিত করছে এলোমেলো।কক্ষের দ্বোর লক করা।বেডের মধ্যিখানে শুয়ে নেহমাত এক হাতে জড়িয়ে আছে শ্রেয়াণ কে।আর শ্রেয়াণ তাকে আদর দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে, কখনো কখনো খুনসুটিতে মেতে উঠছে দুজন হেসে কুঁদে।অপর প্রান্তে থেকে তীর্যক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে প্রথা।এক পর্যায়ে বেডে হেলান দিয়ে আধশোয়া বসে থাবা ছড়ানোর ন্যায় চাদর টেনে হাঁটু পর্যন্ত জড়িয়ে নিয়ে বুকে হাত গুজে দিল।বাবা মেয়ে তাকায় তার দিকে।
–“ মাম্মি তুমি কী কোন কারণে রেগে আছো?
দাঁতে দাঁত পিষে প্রথা। জোর পূর্বক হেসে শ্রেয়াণের উদ্দেশ্যে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে–“ আমি কেন রাগ করবো? আমার কি যেখানে সেখানে রাগ করা সাজে?
হাসল শ্রেয়াণ মৃদু ঠোঁট এলিয়ে।যেটা দেখে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয় রমণী। ফুঁস ফুঁস শ্বাস টানছে ক্ষোভ নিবারণের প্রয়াসে।
–“ অ্যাঞ্জেল।রাত অনেক বেড়েছে, এবার ঘুমিয়ে পড়ো?
–“ ঘুমাবো?
–“ জেগে থাকলে তো সকালে উঠতে দেরি হয়ে যাবে, তখন স্কুল মিস হবে না?
–“ আমি কাল তোমাদের দুজনকে নিয়ে স্কুলে যাবো, তারপর সবাই কে বলবো–তুমি আমার পাপা!
শ্রেয়াণ ঝুঁকে মেয়ের মুখে অজস্র চুমু এঁকে দিয়ে বলে–“ ওকে মাতা রাণী!
টুকটাক কথা আদান প্রদান করতে করতে একসময় নেহমাত চোখ বুজে নেয়।প্রথা তখনো শ্রেয়াণের দিকে তাকিয়ে ছিল ক্ষোভ ভরা দৃষ্টিপাতে। চোখাচোখি হয় দুজনের। যেনো এটারই অপেক্ষায় ছিল,শ্রেয়াণের নজর আকৃষ্ট করতে পেরে নিজে নিজেই বলতে লাগলো প্রথা–“ নয়মাস!নয় নয় টা মাস গর্বে রেখেছিলাম আমি!লেভার পেইনের মতো মৃত্যু যন্ত্রনা সহ্য করে জন্মও দিয়েছি আমি! পাঁচটি বছর নিজের হাতে গড়ে তুলেছিও আমি।আর আজ কিনা বাপ কে পেয়ে আমায় দূরদূর করে আপনার দলে চলে গেলো?এটা আমি কিছুতেই গ্রাহ্য করতে পারছি না!
চোকচোক শব্দ প্রয়োগে শ্রেয়াণ আফসোস করার ভঙ্গিতে বলে–“ এটা সত্যিই বেদনাদায়ক?
–’মজা নেন?
–“ সেই সাহস আছে নাকি আমার!শ্রেয়াণ জাওয়ানের ঘাড়ে ক’টা মাথা?
কিছু বললো না প্রথা। শুধু শুধু রাগ লাগছে তার।হাতে হাত ঘষে কিরিমিরি করছে।
–“ এপাশে আসো তো?
–“ যাবো না, ঘুমান?
–“ ঘুমাবো বলেই তো ডাকছি!
ফের মুখ কুঁচকে রইলো মৌনতা পালন করে।হাত ধরতে চাইলে শ্রেয়াণ কে থাবা দিল একটা। দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে শ্রেয়াণ। রমণী ক্ষেপেছে চরম!কি করা যায়? মেয়েকে ক্রস করে নিজেই প্রথার উপর উঠে পড়ে শ্রেয়াণ। হতবুদ্ধি তাকালো মেয়েটা। হচ্ছে কি এসব?অসাড় শরীর নড়াচড়া করার আগেই শ্রেয়াণ তার গলা জড়িয়ে ঘাড়ে মুখ গুঁজে দেয়। শিরশির করে উঠলো প্রথার কোমল শরীর খানা। ছলকে উঠল অন্তঃকরণে।
–“ ছাড়ুন বলছি?মেয়ের ঘুম ভেঙ্গে এই অবস্থায় দেখলে কি হবে একবার ভাবুন?
মুখ তুলল।চোখে চোখ রাখলো কুঞ্চিত কপালে। অতঃপর গালে গাল ঘষে মোহনীয় কন্ঠ শ্রেয়াণ শুধালো–“ শান্তিতে ঘুমায় না অনেক বছর। আজ একটু ঘুমাতে চাই তৃপ্তি সহকারে।
মৃদু কঁকিয়ে শ্রেয়াণের পিঠের টিশার্ট খামচে ধরে প্রথা। নাসারন্ধ্র হতে গভীর নিঃশ্বাস নির্গত হচ্ছে লাগাতার। ইতোমধ্যে হৃদয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে অস্থির গতিতে।চোখ বুজে নিল রমণী। সর্বাঙ্গ কাঁপছে থির থির। খোঁচা খোঁচা দাড়ির সংঘর্ষে প্রতিটি লোমকূপ সিঁধে হয়ে উঠেছে।সেই প্রথম ছোঁয়ার মতো আজো নতুন লাগছে শ্রেয়াণের স্পর্শ,কেনো?বহু বছর পর সান্নিধ্যে এসেছে বলে?নাকি ছোঁয়া গুলো কখনো পুরোনোই হয়নি?ভেবে পায়না প্রথা।আনমনে শ্রেয়াণের চুলে হাত গলিয়ে দেয়।বিলি কেটে দিতে থাকে আলতো হাতে। আশ্কারা পেলো বুঝি শ্রেয়াণ।মাথা তুলে তাকালো কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে ,অতঃপর আবদারের সুরে বললো–“ ঠোঁটে একটা কিস করি প্লিজ?
কিছু পলের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলো প্রথা।শ্রেয়াণের কথা কর্ণকোহরে পৌঁছাতেই চকিতে তাকায় ভ্রু কুঁচকে।মুখটায় ছেঁয়ে গেছে চরম অসন্তোষ্টি। তখন ই একটা কান্ড ঘটিয়ে বসে।শ্রেয়াণ কে এক ধাক্কায় নিজের উপর থেকে সরাতে চাইলো। দুজন বেডের কিনারায় ছিল, তাছাড়া শ্রেয়াণ আলতো ভর প্রয়োগ করেছিল বিধায় তাল সামাল দিতে ব্যর্থ হয়ে ধরাম করে পড়ে গেলো ফ্লোরে।আউচ–শব্দের মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো শ্রেয়াণ। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথা নিজেও হতভম্ব।তার ভাবনার বাইরে ছিল যে শ্রেয়াণ এভাবে পড়ে যাবে। দ্রুত ফ্লোরে নেমে পড়ে রমণী। শ্রেয়াণ তখনো ডান কোমরে হাত রেখে –মুখে আর্তনাদ বাণী উচ্চারণ করছে। উদ্বিগ্ন হতে দেখা যায় প্রথার সুশ্রী খানি। অস্থির চিত্তে বলে–“ খুব জোরে লেগেছে বুঝি?স্যরি স্যরি!
চোখ মুখ খিঁচকে শ্রেয়াণ ব্যথিত গলায় বলে–“ ফেলে দিয়ে এখন স্যরি বলা হচ্ছে?
–“ বুঝতে পারিনি এভাবে পড়ে যাবেন! কোথায় লেগেছে দেখি?
–“ আহ!মাদার,এ কোথায় রেখে গেলে আমায়? একজন হিটলারের কাছে কিভাবে তোমার নাড়ি ছেঁড়া ধন কে একা রেখে নিশ্চিন্তে চলে যেতে পারলে?কোমরটা তো কোমরের জায়গায় রাখলো না আমার। ইশশ্ কি ব্যাথা !
একবার ডান কোমরে তো একবার বাঁ কোমরে হাত দিয়ে মুখের গড়ন বিকৃত করে একনাগাড়ে বলে যাচ্ছে শ্রেয়াণ।প্রতিমায় ফুটে উঠেছে ব্যাথাতুর ভাব।প্রথার অনুসূচনা হচ্ছে এমন মুখাবয়বে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে জায়গা গুলোই,হঠাৎ কপালে ভাঁজ ফেলে স্থির তাকায় শ্রেয়াণের মুখশ্রীতে। তপ্ত শ্বাস টেনে হুট করে উঠে দাঁড়ালে শ্রেয়াণ নিজেও চুপ করে গিয়ে মাথা তুলে তাকালো।
কপালে তর্জনী ঘষে প্রথা শুধায়–“ আমি না এক মূহুর্তের জন্য ভুলেই গেছিলাম যে আপনি একটা ড্রামা কুইন স্যরি কিং। এবার আমি শিওর–কোন ব্যাথায় পাননি আপনি জাস্ট আমায় বিব্রত করার প্রচেষ্টা।
–“ এটা কিভাবে বলেতে পারলে জান? আমার দুঃখী দুঃখী চেহারা দেখেও তুমি বুঝতে পারছো,কতোটা আঘাত পেলে মানুষের মুখের আকৃতি এমন হয়?
প্রথা সম্মুখে বস পড়ে।মুখ বাড়িয়ে বলে উঠে –“ আগে ডিসাইড করুন কোন কোমরে লেগেছে?ডান নাকি বাঁম?
নির্বোধ নয়নে চেয়ে যায় শ্রেয়াণ।দু কোমরে হাত রেখে ব্যাথা অনুভব করার চেষ্টা করে, কিন্তু আফসোস কোন ব্যাথায় হচ্ছে না। উঠে দাঁড়ায় প্রথা,বেডে শুতে শুতে বললো–“ নিজের জায়গায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন আর আমাকে উদ্ধার করুন।
মাত্রাতিরিক্ত হতাশা নিয়ে নিজেও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে শ্রেয়াণ।কোমরে হাত রেখেই বলে–“ সত্যি ব্যাথা পেয়েছি?চাইলে দেখাতে পারি!
–“ আবার ঢং শুরু করেছেন? জানেন কতো ভয় পেয়েছিলাম? আপনার আর্তনাদ দেখে একবারো মাথায়ই আসেনি যে, সামান্য বেড থেকে গড়িয়েছেন।
চিকচিক করে উঠে শ্রেয়াণের চক্ষুদ্বয়। আনন্দে নেচে উঠল মন প্রাণ। তৎক্ষণাৎ ঝাঁপড়ে ধরলো প্রথা কে। পেঁচিয়ে ধরে পূর্বের ন্যায়। উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলে–“ তার মানে আমি আঘাত পেলে এখনো কোথাও না কোথাও তোমারো আঘাত লাগে? বুকের বাঁ পাশের হৃৎপিণ্ড কেঁপে উঠে?
–“ নেভার! আমার হৃৎপিণ্ড এখন আমার মেয়ের নামে। সেখানে শ্রেয়াণ জাওয়ানের আর ঠাঁই নেই!
হাত বাড়িয়ে সেন্টার টেবিলের সুইচ অফ করে শুভ্র আলো গায়েব করে দিল শ্রেয়াণ।কক্ষ এখন আঁধারে পরিণত। তবুও জানালা ভেদ করে চাঁদের ক্ষীণ আলো প্রবেশ করছে ঠিকই।
–“ প্রথম বারের মতো আবারো একবার ভালোবাসি বলো?
নাক কান ঘষে শুধালো শ্রেয়াণ।কন্ঠে তার মাদকতা উপচে পড়ছিল। ফাঁকা ঢুক গিলে প্রথা।এটা কন্ঠ,নাকি ইন্দ্রজাল?
–“ বলো না?
–“ পারবো না!
–“ কেনো?সব তো ক্লিয়ার যে,তোমার শ্রেয়াণ তোমারই ছিল,আছে এবং থাকবে! তাহলে ভালোবাসি বলতে প্রবলেম কোথায়?
–“ আমার অনুমতি ছাড়া ঔই বা/জে মেয়েকে ছুঁয়েছেন। আমাকে হার্ট করে কথাও বলেছেন! শুধু মাত্র আপনার ভুলের জন্য মিছেমিছি পাঁচ টা বছর হারিয়ে গেলো অথচ দিনগুলো কতো সুন্দর হতে পারতো?–শাস্তি হিসেবে আগামী একমাস আমার ধারে কাছে ঘেঁষার চেষ্টাও করবেন না!
–“ এখন সব দোষ আমার?
আশ্চর্য শুনালো শ্রেয়াণের কন্ঠ।প্রথা সন্দিহান গলায় জানতে চাইলো–“ তো কার? আমার?
দীর্ঘ শ্বাস ত্যাগ করলো শ্রেয়াণ। জবাব দিল না আর। কৌশলে প্রথার হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে আঙ্গুল ঢুকিয়ে বন্দী করে নিল দুহাত। অতঃপর মুখ বাড়িয়ে চুম্বন করলো প্রথার ডান গালে।ঘনঘন মাথা নাড়িয়ে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করে প্রথা–“ কি করছেন কী?সরুন উপর থেকে!অভ্যাস পাল্টাইনি না, সব সময় ছোঁয়া ছুঁয়ির ধান্দা?
–“ হালাল বৌ কে ছুঁয়ে দিচ্ছে তাতে তোমার এতো দ্বন্দ্ব কিসের বুঝে উঠতে পারলাম না আজো? চুপচাপ অনুভব করো, পাঁচ বছর চুমু হীন ছিলাম মনে রেখো!
প্রত্যুত্তর করতে না দিয়ে প্রথার থুতনিতে অধর ছোঁয়ায় শ্রেয়াণ। অতঃপর সম্পূর্ণে মুখশ্রীতে অধরের বর্ষণ ছিটিয়ে দিতে থাকে উম্মাদের ন্যায়।
—
নতুন ভোর।সকাল প্রায় সাড়ে আটটা ছুঁইছুঁই।রুমে চারদিকে রশ্মি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অবলিলায়।প্রথা ফ্রেশ হয়ে রান্নার জন্য ছুটে গেছে কিচেনে। যদিও আদওয়া আর চম্পা মানা করেছিলো কিন্তু প্রথার এই এক অভ্যাস।নিজের খাবার নিজে তৈরি করা।
খুব ভোরেই ঘুম ভাঙেছে নেহমাতের।যেই মুহুর্ত থেকে চোখ দুটো মেলেছে সেক্ষণ থেকে বাবার নিকটে বসে দুহাত মুখে ঠেসে স্নিগ্ধ চোখে পরখ করতে নেমেছে শ্রেয়াণ কে। সামনের কিছু ছোট ছোট চুল কপালে এসে নেমেছিলো শ্রেয়াণের,নেহমাত তা সন্তর্পণে ছোট্ট এবং কোমল হাতে সরিয়ে দিয়ে আরো নিকটে গিয়ে বাবাকে দেখতে থাকে। তৃপ্তি যেনো মিটছে না তবুও!এক পর্যায়ে নিদ্রা ছুটে শ্রেয়াণের।চুখ মেলে মেয়েকে তার দিকে গভীর নয়নে তাকাতে দেখে কাছে টেনে আদুরে গলায় বলে–“ গুড মর্নিং অ্যাঞ্জেল!কি দেখছো এভাবে?
–“ গুড মর্নিং পাপা!তোমায় দেখছিলাম। পাপা তুমি এতো সুন্দর কেনো, একদম প্রিন্সের মতো!
–“ তা’লে আমি কার মতো ?
রুমে মাত্রই প্রবেশ করছিলো প্রথা।নেহমাতের কথায় ফোড়ন কেটে বলে উঠলো।
–“ তুমি মাম্মির মতোই সুন্দর!
–“ মাম্মি কে আবার?
–“ কেনো, তুমিই?
তপ্ত শ্বাস টেনে এগিয়ে যায় প্রথা।হাত বাড়িয়ে বলে–’চলো ফ্রেশ হয়ে নিবে?
–“ নেভার!আমি পাপার কাছেই ফ্রেশ হবো?
বিড়াল ছানার মতো নিজেকে শ্রেয়াণের দিকে গুটিয়ে নিয়ে শুধায় নেহমাত। হতবাক হয়ে কেবল চেয়ে রইলো প্রথা। একদিনেই পাপার ভক্ত? কেমনে কি?ক দিন পেরোলে তো কেউ তাকে চিনতেই অস্বীকার করবে মনে হচ্ছে?
–“ এতো দিন আমিই ফ্রেশ করিয়ে দিয়েছে,আজ পাপা কেনো?
–“ এতো দিন পাপা ছিল না, এখন তো আছে!
বুঝতে অবকাশ নেই যে–বাবা মেয়ে একজোট হয়ে গেছে! তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেলে তাকালো প্রথা অথচ শ্রেয়াণের ভাবাবেগ এমন,যেনো কিছুই হয়নি! সে দিব্যি মেয়েকে আদর দিতে ব্যস্ত!হাতের শাড়িটা বিছানায় ছুড়ে ধফ করে বসল প্রথা। ছোট ছোট আঁখিতে দেখতে থাকলো দুজন কে। দুজনের ভালোবাসা আদান প্রদান দৃশ্য টা দেখতে ভালোই লাগছে!যত দেখছে ততই তৃষ্ণা পাচ্ছে। কিন্তু উপরে তা দেখালে হবে না,কারণ তারা প্রথা কে বঞ্চিত করছে।যেটা চরম অন্যায়!
আড়ালে হেসে শ্রেয়াণ চোখের ইশারায় নেহমাত কে কী যেনো বুঝিয়ে দিতেই বাচ্চাটা এগিয়ে এলো প্রথার দিকে।গলা জড়িয়ে গালে কয়েকটা চুমু খেলো টুপটাপ। মুখে নিষ্পাপ ভাব প্রকাশ করে বলল–“ আই লাভ ইউ মাম্মিই!তুমি কি আমার উপর ক্ষেপে আছো?
–“ আমি কেনো অকারণে তোমার উপর ক্ষেপতে যাবো?যাওনা,পাপার কাছে।যাও যাও!
—
ব্রেকফাস্ট সেরে ড্রয়িং রুমে বসেছে শ্রেয়াণ।হানিফা বেগম বসে আছেন তার নিকটে।কথা হচ্ছে দুজনের মাঝে কিছু কিছু।যার প্রথম বাক্যটা হলো–“ দাদুভাই রাত কেমন কাটলো?
–“ জবরদস্ত!
প্রফুল্ল চিত্তে জবাব দিল শ্রেয়াণ। হানিফা বেগম তাকে কাছে ডেকে ফিসফিসিয়ে বললো –“বহু বছর পর দুজন একঘরে ছিলে,নাতনিটা তোমাকে ছুঁতে টুতে দিয়েছে তো?নাকি দূর দূর করে একজায়গায় ফেলে রেখেছে!
মৃদু হাসে শ্রেয়াণ। অতঃপর আফসোসের সুরে বলে–“ কি আর বলবো দাদু? তোমার নাতনি যেই হিটলারের হিটলার,নিজ থেকে টাচ করবে না আর আমি করলেও যত আপত্তি! আফসোস..
–“ আফসোস কেনো করছো দাদুভাই? তুমি না , পুরুষ?না পারলে জোর করে আদায় করে নিবা!
–“ হ্যাঁ!তাই তো কাল বেড থেকে উষ্টা দিয়ে কোমরের পিন্ডি চটকে দিয়েছে!
বিড়বিড় করে শ্রেয়াণ।
–“ বড়ো করে বলো দাদুভাই! বয়স হয়েছে জানো তো? ছোট কথা শুনতে কষ্ট হয়!
–“ ও কিছু না দাদু।তা বলো শরীর কেমন?এতো দিন তো লাপাত্তা ছিলে, খুঁজ নেয়ার কোন পথ রাখো নি!
হতাশা দৃষ্টিতে তাকালেন বৃদ্ধা। কন্ঠে অসহায়ত্ব ঢেলে বললেন–“ আমার কি দোষ? সবটাই প্রথার ইচ্ছতে হয়েছিল!
কথা বাড়ায়নি শ্রেয়াণ।যা হয়েছে,হয়েছে! এসব নিয়ে আফসোস করলেও হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি ফিরে আসবে না।তার চেয়ে বরং সবকিছু নতুন করেই শুরু হোক?ক্ষণকাল বাদে সেখানে হাজির হয় প্রথা। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে।বুঝায় যাচ্ছে রান্না ঘর ছেড়ে এসেছে।
–“ অ্যাঞ্জেল কই? স্কুলে যাবে না?
–“ আদওয়ার কাছে আছে! তাছাড়া আজ শুক্রবার বার–অফ ডে!
হানিফা বেগমের পাশে বসতে বসতে জবাব দিল প্রথা।
–“ ওৌ! খুশীতে ভুলেই গেছিলাম আজ অফ ডে!
বৃদ্ধা হাক ছেড়ে চম্পা কে ডাক দিলেন। এতো দিন পর দুজন কপোত কপোতী একত্র হয়েছে,তাই তিনি সরে যেতে চাইছেন।যাতে করে দুজন আলাদা সময় ব্যায় করতে পারে।
—
চম্পা এসে বৃদ্ধা কে নিয়ে গেছে কিয়ৎক্ষণ হবে। সেই থেকে দুজন চুপচাপ বসে আছে।ক্ষণে ক্ষণে আড়চোখে তাকাচ্ছে একে অপরের দিকে, চোখাচোখি হতেই আবার নজর ফিরেছে নিচ্ছে অনতিবিলম্বে।বুক ভর্তি শ্বাস টেনে সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুজে নেয় শ্রেয়াণ।
–“ আমার কথা মনে করে কখনো অভিশাপ দিয়েছিলে?
বন্ধরত চোখে জানতে চাইলো শ্রেয়াণ। চকিতে তাকালো প্রথা।কি জবাব দেয়া উচিত তার? হ্যাঁ ,দিয়েছে অনেক কিছু,তবে তাকে হয়তো অভিশাপ বলা যাবে না, তাকে বলতে হবে অভিযোগ!যা প্রায়শই শ্রেয়াণের নামে আকাশের তারা কিংবা চাঁদের স্নিগ্ধ রশ্মি অথবা চার দেয়াল কে শুনিয়েছে প্রথা।
–“ কথা বলছো না যে?
প্রথা ফিরতি তাকায়। জবাব দেয়–“ অভিশাপ দেয় কিভাবে?আমি বোধহয় কাউকে ওটা ঠিক মতো দিতে পারি না!
–“ কিভাবে বুঝলে?
নড়েচড়ে বসে ফট করে চোখ মেলে জিজ্ঞেস করল শ্রেয়াণ।মজাই ফেলো প্রথা।বলল–“ অভিশাপ গুলো যদি সত্যি সত্যিই লেগে যেতো,তাহলে আপনি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন না আজ,কোমায় চলে যেতেন!
–“ কেমনে কি?কথা শুনে মনে হচ্ছে,রাত দিন এক করে আমায় অভিশাপ দিতে দিতেই কাটিয়েছো এতো বছর?
–“ কি মনে হয়?
ভ্রু কুটি করে প্রথা প্রশ্নাতীত চাহনি দিল। ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে উঠে দাঁড়ায় শ্রেয়াণ।প্রথার পাশে গিয়ে গাঁ ঘেঁষে বসতে বসতে বললো–“ আমি জানি, আমার ডার্লিং কখনো তার প্রাণ প্রিয় স্বামী কে অভিশাপ জিনিসটা দিতেই পারেনা। তবুও জানতে ইচ্ছে করলো আর কি!
–“ বয়রা না আমি, কথাগুলো দূর থেকে বললেও শুনতে পেতাম। এভাবে গাঁ ঘেঁষে ঘেঁষে বলার কি আছে? বাবার সামনে পড়লে মুখ লুকাবেন কি করে?
শ্রেয়াণ আরেকটু চেপে বসল।–“ কেনো তোমার আঁচলে?
রাগে দুহাত মুঠ করে চোখ খিচেঁ রাখে প্রথা। ইচ্ছে করছে শ্রেয়াণের চুল টেনে ধরতে, নিজেকে সংযত করে হিসহিসিয়ে বলল–“ স-ব স-ম-য় মজা করার মুড়ে থাকেন?ব্যাড হ্যাভিট!
–“ তুমি যেখানে পজেটিভ সেখানে আমি নেগে/টিভ হলে ক্ষতি কী? আফটার অল তুমি তো ফিরে এসেছো!
–“ বাজে কথা বন্ধ করুন আর দূরে সরে বসুন!
–“ ইশশ্ এতো বছর পর কাছে পেয়েছি! আমার তো ইচ্ছে করছে তোমার আঁচল ধরে বসে থাকতে!
মুখটায় হাত দিয়ে অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল প্রথা। শ্রেয়াণের কথা বলার ভাবভঙ্গি দেখে হাসিই আসছে তার।
সময় গড়িয়ে চললো আরো কিছুক্ষণ।শ্রেয়াণ ফোন স্ক্রোলিঙ করার ফাঁকে দেখতে পাচ্ছে প্রতাপ চৌধুরী কোথাও বেরোচ্ছেন।সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা পড়েছেন ভদ্রলোক,কাঁধে কালো রঙের মাফলার।চোখের আড়াল হতেই ফের নজর রাখে ফোনে।পাশেই আছে প্রথা। একবার টিভির দিকে চোখ দিচ্ছে তো অন্যবার আড়চোখে শ্রেয়াণের ফোন দেখার সুপ্ত প্রয়াস চালাচ্ছে রমণী।কিয়ৎক্ষণ পর সেখানে উপস্থিত হয় নেহমাত।হাতে প্রথার ফোন।লাইনে রয়েছে রাউনাফ। অন্যমনস্ক হয়ে ফোন দেখতে ব্যাস্ত শ্রেয়াণের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় হঠাৎ ই সজাগ হয়ে উঠে কারো কন্ঠ কর্ণকোঠরে পৌঁছাতেই। নিমেষেই স্থির হয়ে যায় চুক্ষদ্বয়।এই কন্ঠ আরো শুনেছে শ্রেয়াণ। কিন্তু কোথায়? তীর্যক দৃষ্টিতে পাশে ফিরে দেখে নেহমাতের হাত বন্দী ফোন থেকেই ভেসে আসছে কন্ঠ। তড়িৎ উঠে দাঁড়ায় শ্রেয়াণ। কাছে গিয়ে বাক্যব্যয় হীন নেহমাতের হাত থেকে ফোন নিয়ে কানের নিকটে তুলে ধরে, ভেসে আসে অপরপ্রান্তে হতে–“ প্রিন্সেস,পাপার সাথে সম য় কিভাবে কাটালে? আমাকে হয়তো ভুলেই গেছিলে তাই না!
চোখ বুঝে কন্ঠটা তীর্যক ভাবে অনুধাবন করার চেষ্টা করে শ্রেয়াণ।হ্যাঁ,এই সেই কন্ঠের অধিকারী, যাকে উম্মাদের মতো খুঁজেছে সে!কাল রাতেও শুনেছিল এই সুর। তখন এতোটা খেয়াল করেনি শ্রেয়াণ। কিন্তু আজ?লাইন বিচ্ছিন্ন করে উম্মাদের ন্যায় প্রথার সম্মুখে গিয়ে থামে। কিছু একটা ভেবে নেহমাতের দিকে তাকিয়ে আদওয়া কে ডেকে,তাকে নিয়ে যেতে বলে।ক্ষণকাল হতভম্ব চেয়ে থেকে সায় দেয় আদওয়া।নেহমাত কে নিয়ে তার কক্ষের দিকে অগ্রসর হয়। যাওয়ার সময় অবুঝ চোখে একবার পিছে ফিরে তাকায়।
শ্রেয়াণ প্রথার বাহু ধরে দাঁড় করায় মুখোমুখি। উদ্ভ্রান্তের মতো অস্থির গলায় বলে–“ রাউনাফ না কি যেন নাম?ওর সাথে কিভাবে পরিচয় তোমার?
আশ্চর্যান্বিত মুখাবয়বে চেয়ে রয় প্রথা। শ্রেয়াণকে হঠাৎ উদ্বিগ্ন হতে দেখে সম্বিত হারিয়ে ফেলছে।
–“ কিছু জিজ্ঞেস করছি তোমায়? উত্তর দিতে এতোক্ষণ লাগে?রাউনাফ কে কিভাবে চেনো তুমি? এটা ছাড়া আর কোন পরিচয় কিংবা নাম আছে ওর?
–“ আমি তেমন কিছু জানি না ওর ব্যাপারে?
–“ মনে করার চেষ্টা করো,ওর সেকন্ড কোন নাম আছে?
শ্রেয়াণ কে ইশারায় শান্ত হতে বলে ঠোঁটে ঠোঁট গুঁজে কপালে স্লাইড করে মনে করার প্রয়াস চালায় প্রথা।রাউনাফ ছাড়া দ্বিতীয় একটা নাম আছে, এমন শুনেছিল প্রথা বছর খানেক আছে! কিন্তু ঠিক মতো মনে পড়ছে না।
–“ মনে পড়েছে?
আরেকটু সময় চাইলো প্রথা হাতের ইশারায়।খানিকটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর হুট করে তাকালো শ্রেয়াণের উদ্দেশ্যে।তার দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে শ্রেয়াণ ফের শুধালঝ–“পড়েছে?কি নাম ওটা?
প্রথা মাথা ঝাঁকিয়ে মনে করার ভঙ্গিতে বলে–“ উমম,জ্ জুভান কা ইফ!ইয়েস,জুভান কাইফ ই ছিল!
প্রথাকে ছেড়ে দুকদম দূরে সরে দাঁড়ায় শ্রেয়াণ।আনমনে নামটা বিড়বিড় করে একবার।ক্ষণকাল পর হাতের আঙ্গুল দিয়ে কি যেনো কষতে কষতে বলে –“ জুভান–জে!কাইফ–কে!জে.কে?
#চলবে ইনশা-আল্লাহ
#চিত্তে_অঙ্কিত_কৃষ্ণরেখা
#পর্বঃ|১৯|
#ফাহমিদা_নূর
হুট করে সোফায় বসে পড়ে শ্রেয়াণ। মস্তিষ্ক যেনো নিস্ক্রিয় হয়ে আসছে ক্রমাগত। ফাঁকা ফাঁকা লাগছে চিন্তা ধারা।–যেই আতঙ্ক তার জীবনের পাঁচ বছর এলোমেলো করে দিয়েছে,যেই কাল বৈশাখী ঝড় তার ভালোবাসায় ফাটল ধরিয়েছে? এতো গুলো দিন তার পাঁজরগুলো ঔ আতঙ্কের কাছাকাছি ছিল? একসাথে উঠাবসা, চলাফেরা সব কিছুই তার সাথে? ভাবতেই গাঁ ছমছম করে উঠলো শ্রেয়াণের।ফট করে বিহম্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রথার দিকে তাকালো শ্রেয়াণ। সম্মুখে গিয়ে দু গালে হাত রেখে উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধায় –“ ঠিক আছো তুমি? শরীর ঠিক আছে?
–“ এভাবে বলছেন কেনো?কী হবে আমার?
প্রলম্বিত শ্বাস টেনে মাথার চুল খামচে ধরে শ্রেয়াণ।কি করা উচিত বা কি বলা উচিৎ ভেবে পায়না। চোখ মেলে ফের প্রথার বাহু আঁকড়ে ধরে উম্মাদের ন্যায় বলে উঠে –“ ঔ জে.কে’র সাথে কিভাবে পরিচয় হলো তোমার?যার জন্য এতো বছর আমরা বিচ্ছিন্ন ছিলাম,তার সাথে তোমার সম্পর্ক হলো কিভাবে?
–“ শুধু মাত্র কন্ঠ শুনেই কিভাবে জাজ করছেন যে রাউনাফ ই জে.কে?
–“ নাম টাও মিলেছে তো?
–“ এমন নামের তো হাজার জন আছে?
–“ বাট এমন কন্ঠের হাজার জন নেই আর না তারা পরিচয় গোপন রেখে তোমার নিকটে এসেছে? সেসব পরে ভাবা যাবে, এখন চট জলদি বলো–ওর সাথে কিভাবে পরিচয় হলো?
চোখ তুলে তাকালো প্রথা। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে–রাউনাফ ই জে.কে!এই পাঁচ বছর প্রথার সাথে তার বন্ধুত্ব।কখনো মনে হয়নি যে–সে তাদের কোন রকম ক্ষতি করতে পারে?এমন কি এটাও কোন দিন মনে হয়নি যে– রাউনাফ শ্রেয়াণ কে পূর্ব হতে চেনে! শ্রেয়াণের তাড়া তে ধ্যানে চ্যুত হয় প্রথার।গলা ভিজিয়ে বলা শুরু করে–“ সর্ব প্রথম পা রাখলাম নিউইয়র্কের কুইন্স সিটিতে।মা বলেছিলো কেউ আমায় রিসিভ করতে আসবে। তাই এয়ার পোর্টের বাইরে তার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।একটু সময় গড়াতেই অস্বস্তি হচ্ছিল বলে এক পা দু’পা হাঁটছিলাম সামনের রাস্তা ধরে। হঠাৎ একজনের সাথে ধাক্কা লাগলো,হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল পাসপোর্ট আর ভিসা। যখন ই আমি সেগুলো তুলে পেছনে ফিরবো তখন ই দেখতে পেলাম আমার সুটকেস সাথে ব্যাগ নিয়ে একজন পালিয়ে যাচ্ছে। ঘটনা এতো দ্রুতই ঘটে গেল বুঝে উঠতে সময় লাগলো। সম্বিত ফিরতেই আমি তার পিছু নিয়েছিলাম কিন্তু একটু দৌড়াতেই মনে হলো কেউ কিছু স্প্রে করেছে মুখের উপর।টের পাচ্ছিলাম আমার শরীর নেতিয়ে আসছে,ঘোলা ঘোলা চোখে দেখতে পাচ্ছিলাম একজন এগিয়ে আসছে কার থেকে।তার চেহারা ধারণ করার আগে পড়ে গেলাম জ্ঞান হারিয়ে!
থামলো প্রথা। তাকায় শ্রেয়াণের মুখশ্রীতে।তার চেহারা দেখে অভিব্যক্তি বুঝা যাচ্ছে না।মুখটা কেমন কাঠিন্যতায় চেয়ে গেছে ক্ষণকালের ব্যবধানে। চোয়াল শক্ত করে বসে আছে, দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছে সাদা ফকফকা ফ্লোরের দিকে।প্রথার গলা না পেয়ে মাথা তুলল শ্রেয়াণ।জানতে চাইলো এর পরের ঘটনা। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে প্রথা আবারো বলতে শুরু করে–“ জ্ঞান ফিরে নিজেকে হসপিটালে পাই। অপরিচিত পরিবেশে অপরিচিত মানুষ জন।ভয় জেঁকে বসেছিল অজানা। হঠাৎ খরা ধরা রোদ্দুরে এক পশলা বৃষ্টির মতো কেবিনে প্রবেশ করলো রাউনাফ।পরে জানতে পারলাম ওই আমাকে হসপিটালে এ্যাডমিট করিয়েছে।কথা হলো দু’জনের মাঝে টুকটাক।সে জানতে আগ্রহ দেখালো আমি নিউইয়র্ক স্টেটে’র কোন জায়গায় থাকি। সেদিন আমি জানিয়েছিলাম–যাওয়ার কোন স্থান নেই কেননা আমি সেখানে নতুন!
শ্বাস নিয়ে ফের বলে–“ একই দেশের মানুষ হওয়ার সুবাদে সাহায্য স্বরূপ রাউনাফ প্রথমে তার ফ্রেন্ড মানাসের বাসায় নিয়ে গেলো। অতঃপর সেখান থেকেই আমাদের ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।যেটা আজ..
দীর্ঘ শ্বাস ত্যাগ করে প্রথা।শ্রেয়াণ ক্ষণকাল নিরব থেকে জিজ্ঞেস করলো হঠাৎ –“ মার সাথে যোগাযোগ কেন বন্ধ করেছিলে? যেখানে যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিলে– পৌঁছাতেই জানাবে!
ফাঁকা ঢুক গিলে প্রথা। আমতা আমতা করতে করতে বলে–“ আমায় আপসেট দেখে রাউনাফ নিজ থেকেই আমার সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল।
এটুকু বলে শ্রেয়াণের দিকে তাকায়। চোখাচোখি হয় দুজনের। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে প্রথা ধীরে ধীরে বলে –“ ঝুঁকের বশে আমি তাকে সব শেয়ার করে ফেলেছিলাম। তখন সলিউশন হিসেবে সে বলেছে– যার ছায়া থেকে দূরে থাকতে দেশ ত্যাগ করেছি,সে বাড়ির কারো সাথে সম্পর্ক রাখলে যখন তখন মানুষটির সাথে আমার চোখাচোখি হতে পারে বা কথাও হতে পারে।এমন হলে আমি কখনো মুভ অন করতে পারবো না,তাই সম্পর্ক ছিন্ন করায় মঙ্গল।
বলেই মাথা নিচু করে নজর সরিয়ে নিল প্রথা। বিরাট বড়ো যে ভুল করেছে তা এখান উপলব্ধি হচ্ছে! কিন্তু তারই বা কি করার ছিলো?
শ্রেয়াণ ঠোঁটে ঠোঁট গুঁজে কপালে স্লাইড করতে করতে হিসেব কষছে কিছুর,খানিক বাদে বলে উঠে –“তোমার সুটকেস চুরি হওয়া,অজ্ঞান থেকে হসপিটালে এ্যাডমিট অতঃপর রাউনাফের সাথে বন্ধুত্ব?
তারমানে সব কিছুই ওর প্ল্যান অনুযায়ী?যাতে ও তোমার বিশ্বস্ত হয়ে উঠতে পারে?আর তোমার সাথে আমার কিংবা পরিবারের সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পারে?
হম্বিতম্বি করে শ্রেয়াণের নিকটে যায় প্রথা। উশখুশ ভঙ্গিতে তাকায়। নির্বোধ চেয়ে বলে–“ এসব করে ওর কি লাভ?
–“জানি না!
বলেই শ্রেয়াণ চায় অস্থির চোখে। তারপর কুঞ্চিত কপালে এক এক করে সেদিনের ঘটে যাওয়া কাহিনী উগলে দেয়ার নিমিত্তে বলতে লাগে–“ এমএমএস পাঠালো বাবার কিডন্যাপের ,যেটাতে উনাকে টর্চার করা হচ্ছিল। তারপর কল এলো ছয় ডিজিটের নাম্বার থেকে, যেটা ট্রেস করা অসম্ভব ছিল।আর তারপর? বাবা কে ছাড়ার বিনিময়ে শর্ত দিলো–তোমার সামনে অন্য নারীর সাথে আমায় ঘনিষ্ঠ হয়ে দেখাতে হবে আর তোমায় হার্ট করে কথা শুনাতে হবে! যতক্ষণ না বাবা তাদের কব্জায় থাকবে ততক্ষণ তোমার সামনে নিজেকে নির্দোষও প্রমাণ করতে পারবো না।
একটু থেমে আবারো বলে–“ তাই বাসায় না জানিয়েই লন্ডন আই মিন ইংল্যান্ড চলে গেলাম,আগে বাবা কে ফিরিয়ে আনতে!আর এসেই শুনি তুমি নেই?
কথা বলতে বলতে টি টেবিল থেকে গ্লাস নিয়ে খপ করে চেপে ধরলো শ্রেয়াণ। চোয়াল শক্ত হয়ে আছে তার। কপালের দুধারের রগ ফেঁপে ফেঁপে উঠছে।জোরে শক্তি প্রয়োগ করার ফলে তৎক্ষণাৎ ভেঙে যায় স্বচ্ছ কাঁচের গ্লাসটি। খটখটে এক অদ্ভুত শব্দের ঝঙ্কার উঠে ড্রয়িং রুমে।আঁতকে উঠলো প্রথা। অল্পক্ষণ হতভম্ব চেয়ে থেকে দ্রুত হাত টেনে নেয় নিজের কাছে।টপটপ করে রক্ত ঝড়ছে হাত থেকে। আটকে থাকা নিশ্বাস ছেড়ে হাত উপরে তুলে ধরে প্রথা। ভালোবাসার মানুষের শরীরে আঘাত লাগলে তা বিপরীত জনের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ সৃষ্টি করে,কথাটি যেনো চরম সত্য!যা পরিলক্ষিত হয় প্রথার ক্ষেত্রেও। রমণীর চোখের কোণে অশ্রু জমে উঠেছে শ্রেয়াণের হাতে রক্তের বিনিময়ে।দুহাতে শ্রেয়াণের হাত আগলে নিয়ে অশ্রু সিক্ত নয়নে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।শ্রেয়াণ নিজেও দেখে যায় শিতল দৃষ্টিতে।কিছু সময় অতিবাহিত হতেই আচমকা প্রথা কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শ্রেয়াণ। আলিঙ্গন করে খুব গভীর ভাবে।যাতে বন্দী হতে না ছুটি যেতে পারে। বাঁধা দেয়নি প্রথাও। চোখ বুজে একে অন্যকে অনুভবে মত্ত হয় দুজন।শ্রেয়াণ উদগ্রীব গলায় বলে –“ আমার কাছ থেকে তোমায় বিচ্ছিন্ন করতেই ওর এতো প্ল্যান! যেদিন থেকে তুমি চলে গেলে যেদিন থেকে ওর কোন পাত্তা নেই।আর যে জীবনে তুমি ফেরত এসেছো সেখানে ও নিশ্চই কিছুনা কিছু করবে! প্লিজ আমায় ভুল বুঝো না! একবার? একবার হারিয়েছি দ্বিতীয় বার সহ্য করতে পারবো না কিন্তু!
ডুকরে উঠে প্রথা। কান্নারা দলা পাকিয়ে আসছে যেনো। আটকানোর বৃথা চেষ্টা করতেই গলায় বিঁধে যেতে চাইছে। ক্রন্দনরত গলায় বলে–“ আমাদের আলাদা করে ওর কি লাভ?
–“ তা তো জানি না? কিন্তু জেনে নেবো খুব শিঘ্রই!
–“ আর কখনো আপনাকে অবিশ্বাস করবো না!
–“ মনে থাকে যেনো?
দুজনের কথার মাঝে ফোন বেজে উঠল শ্রেয়াণের।প্রথা সরে আসতে চাইলো তার বক্ষস্থল হতে কিন্তু ব্যার্থ হয়ে হার মেনে চুপ মেরে রইলো বুকের বাঁ পাশে। যেখানে হৃদস্পন্দন কথা বলছে।শ্রেয়াণ একহাতে ফোন তুলে কানে চেপে ধরে। অপরপ্রান্ত হতে ভেসে আসে পরিচিত এক কন্ঠস্বর –“ ড্রয়িং রুমে ইমোশনাল সিন?দেখতে কিন্তু ভালোই লাগছে! হৃদয় প্রফুল্ল হয়ে গেলো আমার!
একই কন্ঠ?একই কথার ধাঁচ?শ্রেয়াণের তীক্ষ্ণ মস্তিষ্ক ঠাহর করতে সময় নিল কিঞ্চিৎ। অতঃপর দাঁতে দাঁত নিষ্পেষিত করে বলে উঠলো –“ জে.কে?
–“ বাহ!বা বাহ!এতো বছরেও আমার কন্ঠ চিহ্নিত করতে খুব বেশী সময় লাগলো না শ্রেয়াণ জাওয়ানের? সত্যিই প্রসংশা পাওয়ার যোগ্য!
চট জলদি মাথা তুলে প্রথা।সেও শুনতে পাচ্ছে কণ্ঠটা। এতোক্ষণ মনের মাঝে কোথাও না কোথাও ভরসা ছিল যে–হয়তো রাউনাফ কে চিনতে শ্রেয়াণের ভুল হয়েছে! কিন্তু এখন মনে হচ্ছে প্রথা নিজেই ভুল
।এই কন্ঠের অধিকারী রাউনাফ ছাড়া দ্বিতীয় কেউ নয়!
অদ্ভুত নয়নে শ্রেয়াণের উদ্দেশ্যে চেয়ে থাকে রমণী। মস্তিস্কে বিচরণ করছে একটি প্রশ্ন — রাউনাফ কিভাবে জানলো যে,তারা ড্রয়িং রুমে?এই বাসায় তো অনেক দূর,ও-তো বিডি তেও নেই? তাহলে?
শ্রেয়াণ বুঝে নিল প্রথার চোখের ভাষা। ঠোঁট বেঁকিয়ে থাকলো ক্ষণকাল। অতঃপর জে.কে’র জবাব দিল–“ শ্রেয়াণ জাওয়ান সব কিছুতেই প্রসংশার যোগ্যতা রাখে!
–“ হুঁউহ!আমিও তাই বলছিলাম।
তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠ।
শ্রেয়াণের হাতে ভাঙা গ্লাসের অর্ধেক টুকরো তখনো আঁকড়ে ধরা। রক্ত রাঙা হাতে সেটাকে এদিক ওদিক দেখতে লাগলো,তাকে বড্ড নির্বিকার দেখালো সেই সময়।অপর প্রান্ত থেকে কিছুটা থমথমে গলায় আওয়াজ আসলো–“ অবশেষে আমি কে জেনেই নিলে?খুব ভালো!
প্রত্যুত্তর করলো না শ্রেয়াণ। বরং হাতের গ্লাসটা ছুড়ে মারলো ড্রয়িং রুমের ডান পাশের দেয়ালে স্থির থাকা বড়ো লাইটের উপর। লক্ষ্যচ্যুত হয় না মোটেও,ক্লাসের আঘাতে ঝন ঝন শব্দাঘাতে লাইট টুকরো টুকরো গুঁড়িয়ে পড়লো তৎক্ষণাৎ। সাথে দেয়াল ছিঁড়ে কালো রঙের ছোট্ট একটি যন্ত্র।আতঙ্কিত নেত্রে তাকায় প্রথা।দুকদম পিছু হটে যায় শঙ্কায়।কি করতে চাইছে শ্রেয়াণ?
শ্রেয়াণ একপল তার দিকে চেয়ে অধর বাঁকিয়ে মৃদু হেসে উঠে । অপেক্ষায় রইলো অপর প্রান্তের প্রতিক্রিয়া দেখার।
ল্যাপটপের সামনে থেকে তড়িৎ উঠে দাঁড়ায় রাউনাফ। চোখে তার ক্রুদের ধারা উপচে পড়ছে।রাগে ফুঁস ফুঁস নিঃশ্বাস নিচ্ছে বারংবার।
–“ মিস্টার শ্রেয়াণ জাওয়ান এটা কি করলে তুমি?
ক্রুদ মিশ্রিত কন্ঠে কথাটি বলেই পাশের টেবিলে অবস্থিত ফুলদানিতে থাবা বসিয়ে ছুড়ে মারে দূরে।ফের তাকায় ল্যাপটপের দিকে। সবকিছুই আঁধারে ঝিন ঝিন দেখাচ্ছে স্ক্রিনে।তার প্রতিক্রিয়া শ্রেয়াণ কে যেনো বড্ড মজা দিল। সোফায় বসে ফুরফুরে মেজাজে বলল–“ নজরের প্রসংশা আমার বরাবরই কাম্য!কালকেই আন্দাজ করেছিলাম লাইটের সাথে ক্যামেরা জাতীয় কিছু একটা ফিট আছে।আজ রাউনাফ ওরফে জে.কে’র চালচলন দেখে বুঝতে বাকি রইলো না যে ,এই মহান কাজটা ওনারি!
চোক চোক আফসোসের শব্দ করে উঠল শ্রেয়াণ।বলল–“ ড্রয়িং রুমে এখন যে আমরা রোমান্স করবো তা মিস হয়ে যাবে দ্যা গ্রেট জে.কের চোখে? ভারি অন্যায়!
–“ এই এই শ্রেয়াণ জাওয়ান!আমি ছাড়বো না তোকে!সব কিছু কেড়ে নেবো তোর! নিঃস্ব করে ছাড়বো!আই প্রমিজ ইউ!
#চলবে ইনশা-আল্লাহ