#চিত্রার্পিত_প্রেম
#সুমেধা_সরকার
|| ষষ্ঠ পর্ব ||
[অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ।]
শেখর মল্লিক বেশ কিছুদিন ধরেই তার বড় ছেলের বিয়ে নিয়ে ভাবনা চিন্তা করছেন। কিন্তু উপযুক্ত পাত্রী খুঁজে পাচ্ছেন না। তার মনে হয়, শ্রাবণের এবার বিয়ে করা উচিত। সাতাশ বছর বয়স তো হলো। আর কত দেরি করবে? সব কিছুরই একটা নির্দিষ্ট বয়স আছে। সময়ের কাজটা সময়েই করতে হয়। দেরি করলেই সমস্যা।
উমা দেবী, অর্থাৎ শ্রাবণের মা অন্য কোনো বিষয়ে মল্লিকমশাইয়ের সাথে একমত না হলেও এই বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, শ্রাবণের শীঘ্রই বিয়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে পাত্রী খুঁজে পাওয়াই। এমনিতেই শ্রাবণ এখন বিয়ে করতে চায়না। তার উপরে ওনারা জুতসই কোনো মেয়ে খুঁজেও পাচ্ছেন না। তাই এই দরকারি কাজটায় খালি দেরি হয়েই যাচ্ছে।
শেখর মল্লিকের দিনকালও আজকাল ভালো যাচ্ছে না। ব্যবসায় মন্দা চলছে মাস দুয়েক হলো। রাজনীতিতেও ওনার কপালে ফাঁড়া ঝুলছে। ওনার পছন্দের বিধানসভা সিট মনে হয় এবার ভাগ্যে জুটবে না। দলে ওনার প্রধান প্রতিপক্ষ, রণজিৎ তালুকদারের দিকেই পাল্লা ভারী। ওনার সাধের সিটটা বোধহয় রণজিৎ তালুকদারের হাতেই যাবে। কথাটা ভাবতেই ওনার গা চিড়বির করে উঠছে।
রণজিৎ তালুকদার লোকটা বিশেষ সুবিধার নয়। যদিও শেখর মল্লিক নিজেও সুবিধার লোক নন। তবুও, রণজিৎ তালুকদার একটু বেশিই দুর্নীতিগ্রস্ত। এটা মল্লিকমশাই জানেন। রণজিৎ তালুকদারের অনেক অপকর্ম সম্পর্কেই তিনি অবগত। আর, তাই যখন দেখেন এই লোকটা ওনাকে টেক্কা দিয়ে অনেক উন্নতি করে ফেলছে, সেটা মল্লিকমশাই একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। ফলস্বরূপ, রণজিৎ তালুকদার দিনে দিনে মল্লিকমশাইয়ের দুই চোখের বিষ হয়ে উঠেছেন।
এই মুহূর্তে, মল্লিকমশাইকে এমন কিছু করতে হবে, যাতে দলের উর্দ্ধতন নেতৃত্বের কাছে ওনার গুরুত্ব অনেকটা বেড়ে যায়। তাতে ওনার অনেক সুবিধা হবে। বিশেষত, রাজনীতি করার সুবাদে যেসব উপরি রোজগার ওনার হয়, সেগুলোও মসৃণ ভাবে চলবে। এখন ওনাকে ভালোরকম মাথা খাটাতে হবে।
____
ছাদময় পায়চারি করে বেড়াচ্ছে উর্জা। আগামী কাল কলেজে ওর এসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে, আর ও এখনও এসাইনমেন্ট লেখা শেষ করে উঠতে পারেনি। ও জানে ওর এখন বসে লেখা দরকার, কিন্তু ও তাও পারছে না। কারণ, ওর ডান হাতে ব্যান্ডেজ করা।
সকালে ফল কাটতে গিয়ে হাত কেটে ফেলেছে উর্জা। আসলে ও ছুরি দিয়ে ফল কাটতে পারলেও বটি দিয়ে কাটার অভ্যাস নেই। আর সকালে পাকামি মেরে বটি দিয়েই ফল কাটতে গিয়েছিলো ও। ফলস্বরূপ, হাত কেটে গিয়েছে অনেকটা। এই হাত দিয়ে লেখা তো দূরের কথা, কোনো কাজই করা সম্ভব হচ্ছে না।
কালকেই এসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার লাস্ট ডেট। কাল জমা না দিলে ইন্টারনালে মার্কস অনেকটা কমে যাবে ওর। এখন উর্জা তাই চিন্তায় চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছে যে ও কি করবে। কিন্তু ওর ছোট্ট মাথায় কোনো বুদ্ধিই আসছে না।
“উর্জাদি, এই সন্ধ্যাবেলায় একা একা ছাদে কি করছো তুমি?”
প্রজ্ঞার গলা পেয়ে পিছন ফিরে তাকালো উর্জা। আর তখনই ওর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেলো। ও প্রজ্ঞার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,
“প্রজ্ঞা, বনু আমার, একটা কাজ করে দিবি?”
“কি কাজ?”
“আমার এসাইনমেন্ট লিখে দিবি বনু? আমার হাতের অবস্থা তো দেখছিস, আমি লিখতে পারবো না। এদিকে কালকেই জমা দেওয়ার লাস্ট ডেট। একটু লিখে দে না!”
প্রজ্ঞা কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর বললো,
“লিখে দিতে পারি, তবে একটা শর্ত আছে।”
“কি শর্ত?”
“কাল তুমি আমায় এক প্লেট দই ফুচকা খাওয়াবে।”
“বহুত সেয়ানা হয়েছিস তুই। আচ্ছা, খাওয়াবো যা। তাও লিখে দে দয়া করে।”
উর্জা বাম হাত দিয়ে প্রজ্ঞার হাত ধরে ছুট লাগালো নিজের ঘরের দিকে। যাক, তাহলে ওর আর মার্কস কাটার চিন্তা নেই। বাঁচা গেলো!
____
বসে বসে একটা গল্পের বই পড়ছিলো শুভ্রা। আজকে ওদের কিচিরমিচির দলের আড্ডার আসর বসেনি। সবাই যে যার নিজের কাজে ব্যস্ত। কিন্তু শুভ্রার তো কাজও নেই সেরকম কোনো। ও তাই গল্পের বইয়ে মনোনিবেশ করেছে।
হঠাৎই, শুভ্রার মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটিয়ে সশব্দে বেজে উঠলো ওর মোবাইল ফোন। শুভ্রা তাড়াতাড়ি ফোনটা হাতে নিতেই দেখলো, স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে অনিকের নাম। নামটা দেখেই কেন জানি শুভ্রা সামান্য লজ্জা পেলো। তারপর তড়িঘড়ি রিসিভ করলো কলটা। ওপার থেকে অনিকের কণ্ঠ ভেসে আসলো,
“হ্যালো ম্যাডাম?”
“হ্যা- হ্যালো!”
“কি করছেন ম্যাডাম?”
“বই পড়ছি, আপনি কি করছেন?”
“আমার হবু স্ত্রীকে মনে করছিলাম। কি বই পড়ছেন?”
“রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা নৌকাডুবি।”
“বাহ্! আমার বেশ পছন্দের একটা বই।”
“ওহ।”
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। এপাশ থেকে শুভ্রা অনেক চেষ্টা করেও ওদের বাক্যালাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো কথা খুঁজে পেলো না। কিছুক্ষণ পর নীরবতা ভেঙে অনিকই বললো,
“শুভ্রা?”
“হুমম?”
“দেখা করবেন কাল?”
“দেখা? কিন্তু…. বাড়িতে যদি বকে?”
অনিক হেসে ফেললো শুভ্রার সারল্যে। তারপর বললো,
“বাড়িতে কিছুই বলবে না। বাড়ির লোকরা মিলেই আমাদের বিয়ে ঠিক করেছে। এখন আমরা একসাথে ঘুরতে যেতেই পারি।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে। কখন দেখা করবেন?”
“সন্ধ্যা ছটায় ফ্রি থাকবে? একবারে অফিস থেকে বেরিয়ে তোমায় পিক করে নেবো।”
“কিন্তু, আমাদের তো সন্ধ্যাবেলায় বাইরে যাওয়া বারণ। বিকেলের পর থেকে বাড়িতেই থাকতে বলেছে মেজোমামা।”
“আরেহ, সে তো তোমাদের একা বেরোনো বারণ। কাল তো আমি নিয়ে যাবো। বাড়ি থেকে নিয়ে যাবো আবার বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যাবো। চিন্তা নেই, আমি রণজিৎ আংকেলের সাথে কথা বলে নেবো।”
“আচ্ছা, তাহলে আমি তৈরী হয়ে থাকবো।”
“হুমম। একটা আবদার করি?”
“হ্যাঁ করুন?”
“কাল একটু শাড়ি পরো না প্লিজ!”
অনিকের বাচ্চাদের মতো করা আবদারে শুভ্রা হেসে ফেললো। হাসতে হাসতেই বললো,
“আচ্ছা, পরবো। আপনি বলুন, আপনার কোন রঙ পছন্দ?”
“হলুদ রঙ ভালো লাগে বেশ।”
“ঠিক আছে তবে। কাল হলুদ রঙের শাড়ীই পরবো।”
এর পরেও ওদের প্রেমালাপ চললো আরও অনেকক্ষণ। যদিও ওদের সম্পর্কটা তৈরী হয়েছে পরিবারের হাত ধরে, তবু এখন ওদের প্রেমপর্ব বেশ ভালোই চলছে। প্রথম প্রথম লজ্জা পেলেও শুভ্রা ধীরে ধীরে মানিয়ে নিচ্ছে অনিকের সাথে। বিয়ের পর ওদের সংসার সুখী হবে বলেই আশা করা যায়।
____
“জানিস তো রুশু, আগের দিন সেই যে ছেলেটা আমাকে বাড়ি দিয়ে গেলো, অরূপ সামন্ত, ছেলেটা দেখতে কিন্তু হ্যান্ডসাম ছিল।”
উর্মির উদাস গলায় বলা কথাটা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকালো রুশিতা। উর্মি আর ও বসে ঠাকুর পুজোর জন্য মালা গাঁথছে। এর মধ্যেই উর্মি হঠাৎ কথাটা বললো। রুশিতা সন্ধিহান কণ্ঠে বললো,
“কি ব্যাপার বলো তো উর্মিদি? তুমি কি সামন্ত না ফামন্তের প্রেমে পরে গেছো?”
উর্মি একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাকালো রুশিতার দিকে। তারপর বললো,
“ফামন্ত কি জিনিস রুশু? কোথা থেকে শিখিস এসব ভাষা?”
“উইমা, গায়ে লাগছে যে বড়? সত্যি করে বলো উর্মিদি, প্রেমে পরে গেছো তো?”
“মোটেই না! হুট্ করে দেখেই প্রেমে পরে যাবো কেন? দেখতে সুন্দর সেটাও বলা যাবে না?”
“না মানে, আগে কখনও বলতে শুনিনি তো। তাই বলছিলাম আরকি….”
“চুপ থাক রুশু! বড্ড পেকেছিস তুই। জেঠিমনির কাছে নালিশ করতে হবে তোর নামে।”
“হু হু, যখনই নিজেরা আমার সাথে পারো না তখনই মায়ের কাছে নালিশ করতে যাও। একা তো পারবে না আমার সাথে।”
“হয়েছে, থাম। তোর নামে যদি আমি নালিশ করা শুরু করি না, তাহলে জেঠিমনি তোকে ছাদে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখবে সারাদিন। নেহাত আমি ভালো মানুষ তাই কিছু বলি না।”
“হ্যাঁ, বড্ড উপকার করেন আমার। এতো বড় উপকার আমি এই জীবনে ভুলতে পারবো না। ধন্যবাদ দিদিমনি, অনেক ধন্যবাদ।”
নাটকীয় স্বরে কথাগুলো বলতে থাকলো রুশিতা। উর্মি হেসে ফেললো রুশিতার কান্ড দেখে। পাগলী মেয়ে একখানা। তবে এটাই সত্যি যে, এই মেয়েটাই শান্তিনিবাসের প্রাণ। পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখার ক্ষমতা রুশিতা একাই রাখে। রুশিতার যখন বিয়ে হবে, এই বাড়ি বড্ড নিষ্প্রান হয়ে যাবে।
____
কেসটা বর্তমানে জিগ-স-পাজল এর মতো লাগছে শ্রাবণের কাছে। সবটা সাজানোর পরেও কয়েকটা খোপ বাকি থেকে যাচ্ছে। এই ফাঁকা জায়গা গুলো ভর্তি করাই শ্রাবণের কাছে চ্যালেঞ্জ।
দিনরাত এক করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রতিটা কেস ফাইল স্টাডি করার পর শ্রাবণ একটা বিষয় ধরতে পেরেছে। প্রতিক্ষেত্রেই, মেয়েগুলো হঠাৎ করে উধাও হয়ে যায়। তারপর তিন চারদিন পর মেয়েগুলোর বিদ্ধস্ত দেহ পাওয়া যায়।
অর্থাৎ, মেয়েগুলোকে রেপিস্ট তার আস্তানায় অন্তত তিন থেকে চারদিন রাখে। কিন্তু সেই আস্তানাটাই বা শ্রাবণ খুঁজে পাবে কোথায়? কেসটা হাতে নেওয়ার পর ও বুঝতে পারছে, আদতে সরকার এই কেসে কোনো সাহায্যই করছে না। বরং উঁচু মহল থেকে চাপ আসছে কেস ক্লোজ করে দেওয়ার। শ্রাবণ বিভিন্ন হুমকিও পাচ্ছে।
শ্রাবণ ওর কিছু বিশ্বস্ত অফিসারকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছে, কোথাও কোনো মেয়ে নিখোঁজ হলেই যেন ওকে খবর দেওয়া হয়। এছাড়া যেহেতু মেয়েগুলোর শরীরে বীভৎস অত্যাচারের ছাপ পাওয়া গিয়েছে, এবং ফরেন্সিক রিপোর্ট অনুযায়ী ধারালো অস্ত্রের ব্যবহার করে সেই ক্ষতগুলো সৃষ্টি করা হয়েছে, তাই শ্রাবণ অস্ত্রের দোকানগুলোতেও জিজ্ঞাসাবাদ চালাচ্ছে যে রিসেন্টলি কেউ ধারালো অস্ত্র কিনেছে কিনা। কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই, এমন ক্রেতার সংখ্যা তো অনেক। সব মিলিয়ে শ্রাবণ কোনো কূল খুঁজে পাচ্ছে না।
চলবে….