#চিরন্তিনী
পর্ব – ০৪
‘ পরিবারের অমতে পালিয়ে বিয়ে করেছি। বাবা- মা’কে পুরো এলাকার সামনে অপদস্থ করেছি। তার সাজা’ই এখন ভোগ করছি। মানুষ টার বংশ পরিচয় দেখিনি, সেসব গোনায় ও ধরি নি। শুধু সবাইকে বুঝাতে চেয়েছি বাপ- দাদা চরিত্রহীন হলেই ছেলে চরিত্রহীন হয় না। এসব কুসংস্কার, কু-রীতি। আমার গর্ভবতী হওয়ার খবর শুনে পরিবারের মায়া হয়েছিলো। নিজেরা না আসলেও দেখা শোনার জন্য ছোটো বোন কে পাঠিয়েছিলো। বেশ কয়েক দিন ধরে আমার স্বামীর সাথে বোনের আপত্তিকর ঘেঁষাঘেঁষি তে সন্দেহ হয়েছিলো। ভেবেছিলাম, এটা হয়তো শুধু মাত্র আমার বোনের দিক থেকে, স্বামী ঠিক আছে। কিন্তু নাহ! ওইদিন বাড়ি খালি পেয়ে তারা আমার সে ধারণা টাই বদলে দেয়। এসে দেখি আমার ঘরে, বিছানায় বস্ত্রহীন, অশ্লীলভাবে শুয়ে আছে। আমাকে দেখে তারা ভয় পায়, ক্ষমা চায়, শেষে শাঁসায়। বিষয়গুলো আমার দেবরের চোখেও পড়ে। ভেবেছিলো আমি জানি না, তাই ওই দিন সকালে ডেকে বলছিলো এসব। কিন্তু নিজের কু- কীর্তি ঢাকতে আমার স্বামী জোরপূর্বক আমাকে চরিত্রহীন বানায়, অমানবিক নির্যাতন করে।
এক নাগাড়ে পাথরের মূর্তির ন্যায় কথাগুলো বলে গেলো তোহা। চোখে তার বিন্দু মাত্র ও জল নেই। দেখে শুকিয়ে যাওয়া কোনো সাগর মনে হবে। সারা শরীরে মারের তোড়ে অসম্ভব জ্বর উঠেছে। শরীর টা এখনো কাঁপছে। কোনো মতে নিজেকে চেয়ারের সাথে হেলান দিয়ে তাকিয়ে রইলো মাটির দিকে। কবিতা রাগে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। ক্ষুদ্ধ পায়ে এগিয়ে এসে ঠাস করে থাপ্পড় মারে গালে। বলে,
– বড় বোন হয়ে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ছোট বোনের গায়ে অপবাদ দিতে লজ্জা করে না? তোর ভালোর জন্য, তোরে দেখাশোনা করার জন্য মেয়েটাকে আমি পাঠাইছি। এটাই কি ভুল আমার! নিজের জীবন তো নষ্ট করছোই, এবার বোন টাকেও শেষ করবি? তোর তো তাও একটা সংসার আছে, এখানে টেকার জন্য পেটে একটা বাচ্চা আছে। তামান্নার কি আছে? এগুলো শোনার পর ওরে কেউ বিয়ে করবে? কিভাবে এগুলা বললি? আমি আমার মেয়েরে চিনি না?
তোহা ছলছল চোখে মায়ের দিকে তাকালো। অবাক দৃষ্টিতে তাকে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কিন্তু কবিতা গললো না। প্রথমে চোখ রাঙালো। পরক্ষণেই অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে চাপা কন্ঠে অনুরোধের সুরে বললো,
– ওর জীবন টা নষ্ট করিস না। ওরে আমার সাথে আজকেই নিয়া যাবো। তুই একটু সহ্য কর! সংসার টা শেষ করিস না। বাচ্চাটার কি হবে?
এই শব্দ গুলো কারো কর্ণপাত হলো না। সবাই তাকিয়ে আছে তামান্নার দিকে। সে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। ক্ষানিকক্ষণ পর বিরতি নিয়ে পূর্ণ দোষারোপ করলো তোহাকে। বললো,
– আপু এগুলা সব মিথ্যা কথা বলছে। শুধুমাত্র নিজের গা বাঁচানোর জন্য। শিমুল ভাইয়ার সাথে ওর সম্পর্ক আছে। আমি জানি, কিন্তু কাউকে তো বলি নাই। এমনকি মিতুল ভাইয়ের সাথে বিয়ের আগেও আরো দু- তিনটা ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিলো। আগাগোড়াই ওর চরিত্র খারাপ। কই আমি তো কোনো ছেলের হাত ধরে পালাইয়া যাই নাই, এমনকি এলাকায় আমার নামে কেউ বাজে একটা কথাও বলতে পারবে না। শুধুমাত্র তুই আর শিমুল ভাই নিজেদের বাঁচানোর জন্য এইগুলা বানাইয়া বলতেছিস। বাড়িতে তো আরো মানুষ থাকে, তারা কখনো দেখছে?
স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো তোহা। কথা বলতে রীতিমতো কষ্ট হচ্ছে। কান্নারা দলা পাকিয়ে কন্ঠনালি ঝাপটে ধরেছে। কবিতা বেগম আবারো এগিয়ে গেলেন ছোটো মেয়ের দিকে। পুণরায় শাসন স্বরুপ চড় মারলেন তামান্নাকেও। চাপা কন্ঠে শাসন স্বরুপ বললেন,
– চুপ কর! একটা বাজে কথাও বলবি না। তোদের আব্বা আসলে দুইটাকেই জবাই করে তারপর বাড়ি যাইতেন। আমি তোদের চিনি না কাউরে? আর একটা কথাও বলবি না। আমি কিন্তু একদম গলায় দড়ি দেবো।
তোহার আরো দুটো সম্পর্ক ছিলো! কথা টা যতবার কানে বাজছে ততবার ই রাগে সারা শরীর কাঁপছে মিতুলের। ইচ্ছে করছে লাত্থি মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিতে। কিন্তু তা সম্ভব নয়। শালিস চলছে, সবকিছু নিজের মতো করে সামলে তারপর যা করার করবে। শাশুড়ীর দিকে তাকিয়ে বজ্রকন্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো। বললো,
– তামান্নাকে আর কত থামাবেন? আপনার মেয়ের চরিত্র তো ধীরে ধীরে সামনে আসবে। আর কত চাপাবেন? আরেকজনের বাচ্চা আমার নামে বড় করতে চেয়েছে। ওকে আমি আর এক মিনিট ও ঘরে রাখবো না। নিজের নষ্টামি ঢাকার জন্য আমার নামে বদনাম রটাইছে। কোনো প্রমাণ আছে এসবের? কিন্তু আমার আছে। আমি ওরে শিমুলের ঘরে হাতে-নাতে ধরছি। সারা রাত ওই ঘরেই ছিলো। আমি ঘুমানোর পর যেতো, আবার ঘুম ভাঙার আগে আগে চলে আসতো। কিন্তু ভাগ্য ভালো, ওইদিন ধরে ফেলছি।
থেমে শ্বাস নিয়ে,
ঠিক আছে আমি মানছি, আমার সাথে তামান্নার সম্পর্ক আছে। তো এই বিষয়টা ওর বাপ- মা কাউকে জানাইছে? আমার বাপ-মা কে জানাইছে? আশেপাশের কাউকে জানাইছে? নাহ! জানাবে কিভাবে? এমন তো কিছু ঘটেই নাই। এটা তো ওরে হাতে নাতে ধরার পর শিমুল আর ও এসব বানাইছে, যাতে সবাই আমারে দোষী ভাবে।
উপস্থিত সকলে একে অপরের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করলো। মিতুলের কথা একটাও অযৌক্তিক নয়। তোহা নিস্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলো। মানুষ ঠিকই বলে। যারা অপরাধ করে বেড়ায়, তারা সেখান থেকে বের হওয়ার কৌশল জেনে তবেই অপরাধ করে। দোষ না করেও চরিত্র নিয়ে এতো প্রশ্ন সহ্য হচ্ছে না। আসলেই কি সে ভুল করেছে। কিন্তু কি করা উচিত ছিলো? তারই স্বামী তার অনুপস্থিতিতে তার নিজের বোনের সাথে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়েছে, এটা জনে জনে বলে বেড়াবে? কিভাবে? এটা তো একজন স্ত্রীর কাছে সবথেকে লজ্জার।
জ্বর ক্রমশ বাড়ছে। তোহা অসহায় চিত্তে তাকালো শিমুলের দিকে। তাকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করছে না। সে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে অবহেলায়। চাপা আর্তনাদে শিমুল কে উদ্দেশ্য করে বললো,
– শিমুল ভাই, কিছু তো অন্তত বলো।
শিমুল করুন দৃষ্টিতে তাকালো তোহার দিকে। জ্বরে ফর্সা মুখ টা লাল হয়ে গেছে। চেয়ারম্যান বাকিদের সাথে আলাপে ব্যস্ত। আলাপ শেষ করে বললেন,
– এর আর কি সালিশি করবো? মেয়ের যে চরিত্র খারাপ, তা তার মা-বোন, স্বামী সবার কথাতেই বোঝা যায়। প্রায় আট মাসের গর্ভবতী। বাচ্চা স্বামীর ও হইতে পারে, আবার দেওরের ও হইতে পারে। এ ব্যাপারে আমরা তো আর নিশ্চিত হইতে পারি না। এসব ডাক্তারি কাজ, বাচ্চা হওয়ার পর বুঝতে পারবো। ইমাম সাহেব, কিছু বলেন।
ইমাম নড়েচড়ে বসলেন। শান্ত গলায় বললেন,
– গর্ভবতী অবস্থায় তালাক হয় না। যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার তা বাচ্চা হওয়ার পর নেওয়া যাবে।
তড়িৎ গতিতে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লো মিতুল। গলা ছেড়ে বললো,
– এইই নষ্টা বেটি রে আমি এক মিনিট ও ঘরে রাখবো না।
ইমাম সাহেব বললেন,
– তুমি না রাখলেও তালাক দিতে পারবা না। এ কয়দিন না হয় বাপের বাড়িতে থাকুক।
কবিতা অস্বীকার করে উঠলো। বললো,
– ও যেদিন ঘর ছেড়ে পালাইছে, সেদিন ই ওর বাপ ত্যাজ্য করছে। তোহাকে ঘরে তুলবে না ওর বাবা। আর কেনোই বা যাবে আমার মেয়ে? এখনো কি প্রমাণ হইছে, এই বাচ্চা জামাইয়ের না? ভুল তো মানুষ করেই। ওরে ক্ষমা করা যায় না……
তোহার মাথা ঘুরছে। চোখ বন্ধ করে মাথা হেলিয়ে বসে রইলো। বন্ধ চোখের পাপড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ছে গরম জল। কি ভাগ্য তার! বাবা-মা, স্বামীর শখের হলেও, এখন সবাই আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে চলে যাচ্ছে। এতোটা অসম্মান, অপমান সহ্য করতে পারলো না শিমুল। এতোক্ষণের রাগ, ক্ষোভ সমস্তটা উগড়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
– বেশ! বাচ্চাও আমার, তোহা ও আমার। যেহেতু সবই আমার, তাই ও থাকবেও আমার কাছে। ওর দায়িত্ব নিতে হবে না কাউকে? আমি নেবো, বিয়ে করবো। আমার কাছেই থাকবে আজীবন।
কথাগুলো পাহাড় সমান ভারী। তোহা নিতে পারলো না এই বিষাক্ত বচন গুলো। ঢলে পড়ে গেলো চেয়ার ছেড়ে নিচে।
‘ অবশেষে স্বীকার করলো তো। আপনাদের বিশ্বাস হলো তো আমার কথা। ’
মিতুলের চিৎকারে ধ্যান ফিরলো সকলের। আহাম্মক হয়ে তাকিয়ে রইলো একে অপরের দিকে। ততক্ষণে মাটিতে লুটিয়ে পড়া তোহাকে কোলে নিয়ে ঘরের মধ্যে চলে গেছে শিমুল। সেসব সহ্য হলো না মিতুলের। গা কামড়ে বসে রইলো ওখানেই। এখন কিছু বললেই আবারো ঝামেলা ঘাড়ের উপর পড়বে। যা হচ্ছে হোক, পরে দেখা যাবে সেসব।
কবিতা হতদন্ত হয়ে ছোট মেয়ের হাত ধরলো। সালিশের লোকেরা ছি ছি করতে বেরিয়ে গেছে উঠোন ছেড়ে। তোহা থাক এখানেই। নিজের ভাগ্যের দুর্ভোগ সে নিজেই ডেকে এনেছে। এখানে থেকে আর অপমানিত হতে চায় না সে। তামান্নার হাত ধরে এপাশে এনে বললো,
– তোর জামা কাপড় গোছা। দশ মিনিটের মধ্যে আমার সাথে যাবি।
চমকে উঠলো তামান্না। মায়ের হাত ঝাড়া মেরে বললো,
– কোথায় যাবো? আমি কোথাও যাবো না। এখানেই থাকবো।
অবাক হয়ে গেলেন কবিতা। সন্দেহের জের ধরে বললেন,
– তোর লজ্জা সরম নাই। এতো কিছুর পরেও এখানে কেনো থাকবি?
তামান্না গম্ভীর হয়ে উঠলো। এতোক্ষণে নিজস্বতা প্রকাশ করে বললো,
– কোথায় যাবো আমি? তোমার মেয়ে ভালোই দূর্নাম ছড়াইছে আমার নামে। এবার কেউ কি বিয়ে করবে আমায়? আমি এখানেই থাকবো। দুলাভাই বলছে, আমাকে বিয়ে করবে।
স্তব্ধ হয়ে গেলেন কবিতা। কিছু বুঝতে আর বাকি রইলো না। অস্ফুটস্বরে বিশ্রী ভাবে বললেন,
– দুইটা বে/শ্যা জন্ম দিলাম আমি। তোর বাপ ই তো ঠিক করছে না এসে। আমি কেনো এলাম? সবাই যে এখনো জুতা ছুড়ে মারে নায় আমার কপালে, এই তো অনেক।
চলবে?