চুপিসারে পর্ব-১৯

0
466

#চুপিসারে (১৯)
কলমে #রেহানা_পুতুল
নদী তব্দা খেয়ে গেলো। শেষ বিকেলের মরা রোদের মতন আচমকা নদীর মলিন মুখখানি আরো মলিন হয়ে উঠলো।

জানালা দিয়ে শ্রাবণ নদীর মুখচ্ছবির পরিবর্তনটা ধরতে পারলো। মনে মনে বলল,

নদী, এমন একদিন আসবে তখন শ্রাবণ ঢলে ভেসে যাবে তুমি।

নদী শিখার সঙ্গে হাই হ্যালো করে পরিচিত হয়ে নিলো। কিছুক্ষণ কথা বলে নদী সরে গেলো। শ্রাবণ উঠে এসে রজত ও শিখার সঙ্গে কথা বলল। তারপর সে বাজারের দিকে চলে গেলো হাঁটতে হাঁটতে। রাফিয়া রাগে গজগজ করতে করতে বোরকা পরে বাড়ির পথ ধরলো। হাফসা বিবি বলল,

এত তাড়া কইরা যাস ক্যান? কাইল বেয়ানবেলায় চইলা যাইস।

না আম্মা ! ওই কুলাঙ্গারের সামনে রইলে আমি স্ট্রোক করমু। করলটা কি। দেখছেন? নদীরে বিয়া করতে পারেনাই দেইখা আরুরেও করব না। একটা ধইরা নিলো।

এমন চ্যাতস ক্যান। ও কইছে ওই মাইয়ারে বিয়া করবো? কইলো ওইটা ওর বান্ধবী।

আরেহ আম্মা আমার মাথায় কি গোবর সব? আমি বুঝি না?

রাফিয়া চলে গেলো। রজত ঘরের ভিতর থেকে দেখেও মায়ের যাওয়ায় বাঁধা দিল না। সুরমা, রজত ও শিখাকে নাস্তার পরে ভাত এনে দিলো। রজত মানা করলো সুরমাকে ভাত দিতে। সুরমা শুনল না।

মুচকি হাসি দিয়ে বলল,

ওমা কি কন? নদী আপার বিয়ার খাওন খাইবেন না? আপনেরাওতো বিয়া করবেন কয়দিন বাদে। তখন আমরা সবাই মিল্যা খামুনি।
তুই এত কথা বলিস কেন সুরমা?মনে হয় খই ফুটাস মুখে?

বিরক্ত হয়ে বলল রজত।

রজত ও শিখা খাওয়ার পরে সবাইর কাছে বলে চলে গেলো। নদীকে রজত বলল,

বিয়ে উপলক্ষে কি গিফট চাস বল?

কিছুই না রজত ভাই। ভালো থাকেন বলে নদী রজতের সামনে থেকে সরে গেলো। নদীর কথায় কেমন যেন একটা সূক্ষ্ণ অভিমান ফুটে উঠলো। বিষয়টা যেন এমন,
আপনি বলছেন আমাকে পছন্দ করতেন। ভালোবাসতেন। তাহলে কিভাবে পারলেন আমার বিয়ের দুদিন না গড়াতেই ফিয়ন্সে ম্যানেজ করে ফেলতে?

সেদিন রাতে একাকী রুমে রজতের অনেক কথাই মনে পড়লো নদীকে নিয়ে। আক্ষেপের সুরে দীর্ঘস্বাস ফেলে বলল,
আহা নদী। ছোট বেলা থেকে কত দুষ্টমিষ্ট স্মৃতি তোর সাথে। ভাবতেই পারিনি তোকে পাব না। অবশ্য এতে তোর আমার দুজনেরই কোন দোষ নেই। ভাগ্যতে বিলিভ করতে হবে আমাদের। শ্রাবণদের মতো আমাদের অতো অর্থবিত্ত নেই। তুই তার কাছেই সুখে থাকবি নদী। তুই সুখে থাকলেই আমার ভালোলাগবে।

নদী আগের মতই সারথির সাথে ঘুমায় রাতে। এ নিয়ে শ্রাবণ, তার বাবা মাও নদীকে ফোর্স করেনি। কারণ শ্রাবণ তার মা বাবাকে বুঝিয়েছে,

ও ওর মতই থাক। সময় হলে ঠিক হয়ে যাবে। আমার কোন অবজেকশন নেই এই নিয়ে। রফিক ও মোরশেদা পুত্রের কথায় সায় দিলো।

কিন্তু বাধ সাধলো হাফসা বিবি। বিয়ের কিছুদিন পর সে বড় ছেলের বাড়ি এলো নদীকে দেখতে। তখন সারথির নিকট শুনলো নদী তার সঙ্গেই ঘুমায় রাতে। দিনেও সেভাবে কথা বলে না শ্রাবণের সঙ্গে।

হাফসা বিবি নিরালায় নদীকে নিয়ে বিজ্ঞের মত বলল,

কলাগাছের মতন লম্বা হইছস। জ্ঞানবুদ্ধি তো কিচ্ছুই হয়নাই।

নদী নাক মুখ কুঁচকে ফেলল। বলল,
তোমার সমস্যা কি তাতে বুড়ী?

সমস্যা আমার না। তোর হইবো। আর হইলে পাড়ে আওনের কূল খুঁইজা পাবি না।

মানে কি বুড়ী?

মানে হইলো জোয়ান বয়স শাবনের। করলো তোরে বিয়া। তুই থাহস আলগা আলগা। তার মন অন্য মাইয়ার দিকে ঝুইঁকা যাইতে কতক্ষণ? দিল মোচড় খাইতে কতক্ষণ? সাপের মতন খোলস পাল্টাইতে কতক্ষণ। কই কি হুন, যদ্দুর পারস ওর লগে মিসস্যা থাহিস কাঁঠালের আঠার মতন। দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা দিতে শিখ। ভালো হইবো কইলাম। হাতে ধইরা সুখের জাল ছিইঁড়া ফালাইস না। পরে দিনরাইত এক কইরাও চউক্ষের পানি ফালাইয়া কাঁদলে কোন লাভ হইব না।

হ বুঝছি। অহন যাও।

নদী অবুঝের মতন ধুপধাপ পায়ে বাড়ির পিছনের দিকে চলে গেলো।
শ্রাবণ বাইরে থেকে এসে নিজের রুমে ঢুকলো। চার হাতার সিলিং ফ্যানটা ছেড়ে দিলো। তার পিছন দিয়েই হাফসা বিবি তার রুমে ঢুকে চেয়ার টেনে বসলো।

কি ব্যাপার দাদী? তোমার ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে কোন মতলব নিয়ে এসেছো?

রাজনীতি করস। তাই বুইঝা ফালাইছত। হ কামে আইছি ভাই।

ঝেড়ে কাশি দাও তাহলে। গিলে গিলে, চেপে চেপে কথা বলা আমার পছন্দ না।

আমি আইসা হুনলাম তোরা নাকি আলাদা ঘুমাস?

হুম তাই? আমি আমার রুমে। নদী সারথির রুমে। আগের মতই চলছে সব। সমস্যা কি ?সময় হলে দুজন এক হয়ে যাবো।

সময় হইবো কহন তোর? নদী কলেজের অন্য পোলার লগে পিরিত শুরু কইরা দিলে? ও তোরে কইতো ভাইয়া। এখন হঠাৎ কইরা হইছে তোর বউ। শরম পায় ম্যালা তোরে নদী। তুইও হের লগে দূরে দূরে থাকলে হইবো? খাঁচার পক্ষিরে বশ মানাইতে হয়।নইলে হে উড়াল মাইরা অন্য বেড়ার খাঁচায় চইলা যাইব। তহন ত বুক চাপড়াবি পিউর টাটকা জিনিস হারাইলি বইলা।

দাদী থামতো। তোমার কত অভিজ্ঞতা এসবের?

বহুত বৎসরের। কই কি হুন ভাই,

বাসর টা কইরা ফালা। আর তুই নদীরে কাছে ডাকিস নানা ছুতায়। পহেলা পহেলা না আইতে চাইলে পরে ঠিকই আইবো তোর ধারে।

জোর করে করব সব?

রোমান্টিক মুড়ে বলল শ্রাবণ।

আরেহ তুই চলবি ভাঁজে ভাঁজে। সাপ ও মরবে লাঠিও ভাঙ্গবে না। জোর করলে তোর উপর অনিহা চইলা আইবো নদীর।

আচ্ছা ঠিকাছে। তোমার কথামতো শীঘ্রই বউ কাছে আসার ট্রিটমেন্ট প্রয়োগ করবো।

হ ভাই তাই করিস। আল্লাহ তোগোরে পরকালেও যেন জোড় বাইন্ধা রাখে।

ইহকালের জোড় হচ্ছে না। তুমি আসছ পরকালের গান গাইতে।

দাদীকে কথা দিলেও শ্রাবণ নিজের ইগোর জন্য নদীকে কাছে ডাকতে পারে না। বরং আগে ভালোই ছিলো। যখন তখন কিছু বলা যেতো। শাসানো যেতো। এখন নদী তাকে দেখলেই লুকিয়ে থাকে যেন গর্তের ইঁদুরের মতো।

হাফসা বিবি অসুস্থ হয়ে গেলো। বার্ধক্যজনিত কারণে একটু একটু করে নানারকম জটিলতা সৃষ্টি হলো তার শরীরে। আজ এটা কাল ওটা। দিনে দিনে নরম হয়ে বিছানায় পড়ে গেলো হাফসা বিবি। আগের মতো মুখে কথার বুলি ফোটে না। অস্তমিত সূর্যের ন্যায় বিলীন হয়ে গেলো নাতি নাতনীদের সাথে তার রসপূর্ণ কথাগুলো। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে প্রিয় মুখগুলোর পানে। সবাই তাকে নিয়ে ডাক্তার, হাসপাতালে ছোটাছুটি করছে।

এভাবে কেটে গেলো আরো কিছুদিন। নদীর গান শেখাও নিয়মানুযায়ী এগিয়ে যাচ্ছে। কলেজে নদীর পরিক্ষা শেষ হয়ে গেলো। পরিক্ষার সময় শ্রাবণ ইচ্ছে করেই দূরে রইলো। শ্রাবণ খেয়াল করলো দেখলো, নদীর বুকে তার জন্য কোনভাবেই ঝড় উঠছে না। ঝড়ের পূর্বাভাসটুকুও দেখা যাচ্ছে না। শ্রাবণ ভাবছে নদীকে কি কি ভাবে ইম্প্রেস করা যায়।

সময়টা শ্রাবণ মাঝের কোন এক বর্ষণমুখর রাত। বাইরে গগন কাঁপিয়ে থেমে থেমে বজ্রপাত হচ্ছে। অঝোরধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। শ্রাবণ ভিজে চুপসে গেলো। বাসায় এসেই ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেস হয়ে নিলো। না খেয়ে বিছানার গা এলিয়ে দিলো। বেশ সময় ধরে গায়ে বৃষ্টি পড়ার দরুণ তার ঠান্ডা লেগে গিয়েছে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার খারাপ লাগতে শুরু করলো। এত রাতে মা বাবাকে ঘুম থেকে জেগে তোলা ঠিক হবে না। সুরমা ঘুমাচ্ছে অন্যঘরে। সারথি ছোটমানুষ। ঘুমিয়ে আছে আরামে ভেজা পরিবেশে। কি করা যায় ভেবেই শ্রাবণ উঠে গেলো সারথি ও নদীর রুমের সামনে।

দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শুনেই নদী উঠে দাঁড়ালো। এগিয়ে দরজার কাছে গেলো। দরজা ফাঁক করতেই দেখলো শ্রাবণ দাঁড়িয়ে আছে। শুকনো ঠোঁট দুটি কাঁপছে। কিছু বলতে পারছে না।

নদী ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
কি চাই?

আমার মনে হয় জর আসছে গায়ে। প্লিজ একটা কাঁথা নিয়ে আসো। দাঁড়াতে পারছি না।

শ্রাবণ রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো। নদী আলমারি খুলে একটা পাতলা কম্বল নিলো। শ্রাবণের রুমে গেলো। শ্রাবণ উপুড় হয়ে আছে। নদী কম্বল দিয়ে শ্রাবণের আপাদমস্তক ঢেকে দিলো। শ্রাবণের মাথার পাশে বসলো। কপালে হাত রাখলো আলতো করে। দেখলো ভীষণ জ্বর গায়ে। শ্রাবণ নদীর স্পর্শ টের পেয়েই তার কোমল হাতখানি চেপে ধরলো।

চাপা স্বরে বলল,

নদী প্লিজ একটু উষ্ণতা দিবে পাশে থেকে? ভীষণ ঠান্ডা লাগছে।

চলবে ১৯