চুপিসারে পর্ব-৫+৬

0
283

#চুপিসারে
৫+৬
(৫)
কলমে #রেহানা_পুতুল
তারপর মা রুবিনার একান্ত ইচ্ছায় নদী একদিন বিকেলে তার সবকিছু নিয়ে চলে যায় নিজের বাড়ি। তাকে দেখামাত্রই মাথায় হাত পড়ে তার চাচী নাহার বেগমের। তার চারদিন পরেই এক শান্ত ভোরে নদী এক অশান্ত কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেলল।

সেদিন নদী প্রভাতকালেই বিছানা ছেড়েছিলো। মুখ ঘুরিয়ে দেখলো তার দাদী হাফসা বিবি ঘুমিয়ে আছে। সে খালি পায়ে সন্তপর্ণে রুম থেকে বের হয়। আরুর রুমে যায়।গোটা রুম খালি। আরু তার নানাবাড়িতে গিয়েছে। নদী ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়। টেবিলের সাথের চেয়ারটিকে এনে দাঁড় করায় সিলিং ফ্যান বরাবর নিচে। তার উপরে একটি মোড়া বসিয়ে নেয়। সেটার উপরে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে নদী। নিজের বুকের ওড়নাকে সিলিং ফ্যানের ওপর দিয়ে ফেলে দেয়। পরে গলায় পেঁচিয়ে নেয়। এভাবেই সে আত্মহত্যা করার চূড়ান্ত চেষ্টা চালায়।

এর কারণ তার আগের দুপুরে নাহার বেগম তার গায়ে হাত তুলেছে। এবং অকথ্য ভাষায় তাকে গালিগালাজ করেছে। তার জন্য দাদীরও দশকথা হজম করতে হয়েছে চাচীর মুখে। নদীর অপরাধ ছিলো সামান্যই। সে বাড়িতে আসার পর হতেই ছোট্ট এক বয়াম তেঁতুলের আচার রোজ একটু একটু করে লুকিয়ে খেয়ে ফেলেছে। ধরা পড়েছে তার আগেরদিন দুপুরে।

ঠিক সেই মুহুর্তে দরজায় টোকা পড়ল। আরুর ছোটবোন নিরুর গলা শোনা যাচ্ছে। সে দরজা ধাক্কাতে লাগলো। ভিতর থেকে দরজা খোলা হচ্ছে না দেখে অবুঝ নিরু গিয়ে মাকে ডাকল। তখন নাহার বেগম আসে। ভেতর থেকে বন্ধ দেখে নাহার বেগম ঠাস করে দরজা খুলে ফেলে। পুরোনো ঘুর। হার্ডবোর্ডের নড়বড়ে দরজা। মরচে পড়া ছিটকিনি। তাই পরিশ্রম ছাড়াই দরজা খুলে যায়।

তার আগেই নদী চাচীর উপস্থিতি টের পেয়ে ভ্যাবাচেকা খেয়ে উঠে। চট করেই পায়ের নিচের মোড়া ঠেলে মাটিতে ফেলে দেয়। অমনিই ঝুলে যায় নদী।

নাহার বেগম নদীকে ঝুলানো অবস্থায় দেখেই চিৎকার দিয়ে উঠে। এবং নদীর পা দুটো ধরে ফেলে উপরে তুলে ধরে। হাফসা বিবি কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে আসে। বউকে মোড়া দেয় উঠে দাঁড়াবার জন্য। এভাবে নদীকে বাঁচিয়ে নেয়। নিকট বাজার থেকে ডাক্তার আনা হয়। দেখে জানালো কোন সমস্যা নেই। গলায় চাপ লেগেছে। একটু গরম পানি খেলেই সেরে যাবে।

নদীর লজ্জায় মাথাকাটা যায়। সেতো বাঁচতে চায়নি। এত অনাদর,অবজ্ঞা নিয়ে বেঁচে থাকা তার পক্ষে গ্লানিকর।
নাহার বেগম দেরী না করে ফোন দেওয়া শুরু করলো পরিবারের সবাইকে। নদীর ফুফু রাফিয়াকে ফোন দিয়ে বলতে লাগলো,

আমি আগেই ভাবছিলাম, এই মাইয়া একটা নয়, একটা অঘটন ঘটাবোই। আপনারা আসেন। ওরে কি করবেন করেন। আমার এত শখের আঁচার সব খেয়ে ফেলল রাক্ষুসীটায়। নিজেরে সামলাইতে না পাইরা একটু গায়ে হাত তুলছি। তাই মইরতে যাইবো। কন? মরলে তার মার কাছে গিয়া মরুক। আমার কাছে না। ওইতো আমগো সবাইরে জেলের ভাত খাওয়ানোর ধান্ধা করতাছে দেখছি। বইন আমার ডর লাগে। সে উলটাপালটা চইলবো। আমার মাথায় রাগ চড়বো। একটু বকাঝকা করুম। অমনি উনি এমন কাণ্ড করবো। নয়তো হাত পা কাইটা ফালাই বিপদে ফালাইবো আমগোরে। একটা কিছু করেন আপনারা।

তাই সেদিন বিকেলে সবাই আসে। নদীকে নিয়ে পারিবারিক বৈঠক বসে। নির্বাচনের অধিক ব্যস্ততায় শ্রাবণ আসতে পারেনি। রজত সিদ্ধান্ত দেয়,

দুই মামার বাড়িতেই থাকবে নদী। তাতে আর এক পরিবারে বেশি চাপ পড়বে না তাকে নিয়ে। উটকো ঝামেলাও ক্রিয়েট হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যাবে। এক স্থানে থাকলে নদীও বিরক্ত হবে বকাঝকা শুনলে। ওর বয়সটাইতো বিগড়ানোর বয়স। আবেগের বয়স। মামীও ধৈর্য ধরে থাকতে পারবে না।
এতে নদীর ইচ্ছে আছে কিনা, তা জানার তোয়াক্কা কেউই করলো না।

__________

রজত ঘরে ঢুকেই নানীর রুমে গেলো। দেখলো নানীকে ঘিরে মা, খালা, মা,মামীসহ সবাই খোশগল্পে মেতে আছে। পরে মা রাফিয়াকে ডেকে নিলো উঠানের মাঝে।

কিরে কি হইছে?

কি শুনলাম এটা মা?

কি শুনছস?

তুমি নাকি আমার বিয়ে ঠিক করেছ?

হ। সমস্যা নাকি তোর?

আমার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করলে না?

রাফিয়া গরম কড়াইতে তেল পড়ার মতো ছ্যাঁত করে উঠলো। বিরস মুখে বলল,

এভাবে কস ক্যান? আমি তোর সতাই মা? তোরে গাঙে ফেলে দিচ্ছি? আমার আপনা ভাইজির লগেইত ঠিক করছি। সমস্যার কিছুতো দেহি না সুবিধা ছাড়া। তোরে মান্য করে চলবে। যা কইবি তাই হুনবো। নিজের মতো কউরা চালাইতে পারবি।

আমার সুবিধা নয়। তোমার সুবিধা এসব। আসল কথা বলো। অন্য মেয়ে হলেতো তোমার খবরদারিত্ব গুঁড়িয়ে যাবে৷ তো কোন ভাইজির লগে ঠিক করছ শুনি?

ক্যান? কয়দিন আগে না তোরে কইলাম? তুইতো হাইসা দিলি তখন। মানাতো করসনাই।

আমিতো ভাবছি তুমি মজা করে বলছ। তাই গুরুত্ব না দিয়ে হেসে ফেলেছি। সিরিয়াসলি নিলে তো কথা বলতাম। বল পাত্রী কে?

কে আবার। আমাদের আরু।

শ্রাবণ যে বলল নদীর সাথে?

রাফিয়া তখন উঠানের এদিক ওদিক চাইলো। গলার স্বর নামিয়ে বলল,

শোন বাবা,শ্রাবণ পলিটিক্স করে। তাই নদীরে আমগো ঘাড়ে উঠায়া দিতে চায়। নয়তো কেউ যদি আবদার তোলে সে বিয়া করনের লাইগা। তাই সে আমাদের কথার মাঝে সাইকেল চালায়া দিলো। বোম ফাটার মতো কইরা কইলো,

রজতের লগে নদীর বিয়া দ্যান।

কি বদমাইশ পোলা। চিন্তা কইরতে পারিস। চেয়ারম্যান হইতে না হইতেই মাতব্বরি শুরু কইরা দিলো। ওর কথার খ্যাতা পুড়ি আমি। আমগো ভালোমন্দ আমরাই বুঝি। ওর কথায় কি আসে যায়। লাইফ আমগো। তাই সিদ্ধান্তও আমগো। তুই মাথা গরম করিস না। যা ঘরে যা। আবার ওরা কইবো মা পোলা মিলা কি ফুসরফাসুর করতাছে।

রাফিয়া থামলো এবার। রজত জিজ্ঞেস করলো,

বাকিরা কে কি বলল?

কার কন দিয়া আমাদের কি আসে যায়। তোর মাইজ্জা মামি রাজী। সকলেই রাজি। আরুর স্কুল লাইফ শ্যাষ হইলে কাবিন করুম। কলেজ পাস করলে বিয়া হইবো। বাকি পড়াশোনা আমগো বাড়িত থেইকা করতে পারবো।

রজত ক্ষেপে গেলো মায়ের উপরে। চনচন গলায় বলল,

বাহ বাহ বাহ! যার বিয়ে তার খবর নেই। পাড়া পড়শীর ঘুম নেই। আমি রাজি? আরু রাজি? নদী রাজী?
কারোই মত নেওয়া লাগবে না নাহ?

কি কইতে চাস তুই?

আমি কি কইতে চাই। সেটা পরে?
আগে আরু, নদী রাজী কিনা মত নাও।

ওই বজ্জাত পোলা। আরুতো ছোট। ওর সামনেতো আমরা এইসব আলাপ পাড়ি না। আর নদী? হ্যারেতো আমি বউ হিসেবে পছন্দই করি না।
ঘরে ল। মাথা ঠান্ডা কর বাপ।

তুমি ঘরে যাও। আমি বাড়িতে চলে যাচ্ছি।

আজিব তো। এই রাইতের কালে তুই বাড়িত যাবি ক্যান। আমার বাপের ঘরে কি তোর থাওনের জায়গার অভাব?

অবাক চোখে বলল রাফিয়া।

আমি অভাব বলছি? আমাদের বাড়িতে কি এমন সময় আর যাইনাই? লাগোয়া গ্রাম। এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না।

প্রগাঢ় বিরক্তি নিয়ে কথাগুলো বলেই পা বাড়ালো রজত। লম্বা লম্বা পায়ে উঠান ডিঙিয়ে চলে গেলো নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে।

রাফিয়া ঘরে ফিরে এসে মা,ভাবি, বোনকে রজতের সাথের আলাপ জানালো।

নাহার বেগম বলল,

ভাইগনা আমার শরম পাইছে। তাই তালবাহানা করে চলে গেলো। যাক। সমস্যা নাই। দুদিন বাদেই ঠিক হইয়া যাইব। দেইখেন।
সবাই হাসি তামাসায় গল্পগুজবে মশগুল হয়ে গেলো।

এদিকে চেয়ারম্যান ইশতিয়াকের ব্যস্ততা ক্রমাগতই বাড়ছে। সে আর পুরোনো বাড়িতে যেতে সময় পাচ্ছে না। সপ্তাহ খানেক পরে এক বিকেলে গেলো। হাফসা বিবির রুমে গিয়েই,

দাদী কি অবস্থা তোমার। ঘর ঠান্ডা কেন? চাচী কই?

তুইতো পদ পাইয়া দাদীর কথা ভুলে গেলি।হ্যার বাপের বাড়ি গ্যাছে।

নদীও গেলো নাকি?

নাহ। যায়নাই।

তোমার রুম অন্ধকার কেন?

কি হইছে? তোগো মতো আমার চাইর চোখ লাগে না। বাত্তি লাগেনা। চোখের বাত্তি দিয়াই সব ফকফকা দেহি।

আমরাতো তোমাদের মতো টাটকা খাবার পাই না। যা পাই তা খাই। সব ভেজাল আর ভেজাল। বলেই শ্রাবণ লাইট জ্বালিয়ে দিলো।

নদী পাশেই শুয়েছিলো। ওড়না দিয়ে পা থেকে মাথা অবধি ঢাকা তার। শ্রাবণের গলা শুনেই গুটিয়ে রইলো শোয়া থেকে। সরে যাওয়ার উপায় নেই।

এখানে কে বলেই শ্রাবণ নদীর পায়ের দিক হতে ওড়না টেনে কিছুটা নামিয়ে নিলো। অমনি নদীর মুখ দৃশ্যমান হলো। নদী চোখ বুঁজে রইলো।

কিরে নদী? মরার মত সোজা হয়ে মুখ ঢেকে আছিস কেন?

নদী কিছু বলছে না।

কিরে বোবা নাকি তুই?

হাফসা বিবি বকা দেওয়ার ঢংয়ে নদীকে বললেন,

খালি ত্যাড়ামি করে। এই তুই কথা কইতে পারস না? শরম পাস কেন শাবনরে? আমার হইছে যত জ্বালা এরে নিয়া। বাপ কব্বরে। মা বাপের বাড়ি। এর ভবিষ্যৎত পুরাই আন্ধার।

কিসের আন্ধার দাদী? ওইদিন না সেট করে দিলাম নদীর লাইফ।পুরাই সেটেল। বলল শ্রাবণ।

বাক্যগুলো শ্রবণ হতেই নদী পিটপিট চোখে তাকালো রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে।

শ্রাবণ বলল,

দেখলে দাদী। সব মতলবে চলে। ওই যে তোমার আহ্লাদী নাতনি এবার চোখ খুলছে। এই উঠে আয়। কথা আছে তোর সাথে।

নদী আস্তে করে বলল,
কি কথা বলেন ভাইয়া?

তুই উঠতে পারিস না? কি সমস্যা তোর?প্রাইভেট কথা। দাদীর সামনে বলা যাবে না। অন্যরুমে আয়।

নদী উঠে বসে আছে বিছানায়। নড়ছে না।

এই ফাজিল। চড় খাওয়ার আগে উঠে আমার সাথে অন্যরুমে আয় বলছি।

শ্রাবণ চোখ রাঙিয়ে জোরে ধমকে উঠলো নদীকে।

নদী দাদীর ইশারা পেয়ে কম্পিত বক্ষে পা টিপে টিপে শ্রাবণের সঙ্গে একাকী একটি রুমে প্রবেশ করলো।

চলবে

#চুপিসারে (৬)
কলমে #রেহানা_পুতুল
শ্রাবণ চোখ রাঙিয়ে জোরে ধমকে উঠলো নদীকে।
নদী দাদীর ইশারা পেয়ে কম্পিত বক্ষে পা টিপে টিপে শ্রাবণের সঙ্গে একাকী একটি রুমে প্রবেশ করলো।সেটা আরুর রুম।

শ্রাবণ রুমের ভিতরে ত্রস্ত পায়ে গিয়ে চেয়ার টেনে বসলো। নদীকে তার সামনে খাটের কিনারায় বসতে আদেশ দিলো। দরজা পুরোপুরি খোলাই রইলো। নদী জুবুথুবু হয়ে দুই হাঁটু ঝুলিয়ে বসলো শ্রাবণের সামনে।

সে কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে আগেই, কি বলা হবে তাকে এখন। নদী শ্রাবণের মুখ হতে কোন উপদেশ,জ্ঞান শুনতে চাচ্ছে না। লাভটা কি হবে বলে। ছোট চাচীর মানসিক নির্যাতন থেকে কি কেউ তাকে রক্ষা করতে পারবে? পারবে না। শ্রাবণের অবাধ্য হওয়ারও দুঃসাহস তার নেই। সে শিশুকাল থেকেই মায়ের সাথে নানাবাড়ি বড় হয়েছে। নিজের বাড়িতে এসেছে উপলক্ষ হলেই। যতবার এসেছে ততবার সে শ্রাবণকে দেখেওনি। যতটুকু দেখেছে ভয়ে তটস্থ রয়েছে।

শ্রাবণ স্বল্পভাষী নয় আবার মিষ্টিভাষীও নয়। তার স্বরে কেমন যেন একটা রুক্ষতা মিশে থাকে সবসময় শীতের প্রকৃতির মতো। পরিবারের ছোটদের সাথে সে বরাবরই শাসনের সুরে কথা বলেছে। নদীর সাথেও কখনো তেমন ভালোবাসা দিয়ে কথা বলেনি।

শ্রাবণ বিচলিত অথচ কোমল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো নদীকে,

নদী বলতো, এই পৃথিবীতে তোর সবচেয়ে আপন কে?

নদী উত্তর দিতে মুহূর্ত নিল না। মাটির দিকে চেয়ে একশব্দে বলল,
আমার আম্মা।

তোর আম্মার পৃথিবীতে সবচেয়ে আপন কে?

আমি।

ভেরি গুড! তো এবার বলতো,তাহলে তুই তোর সেই আম্মাকে একলা করে কেন চলে যেতে চেয়েছিলি?

নদী নিরব রয়। শ্রাবণ বলে উঠে,

ওকে। এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে না। হয়তো তখন তুই নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিস। এখন আমি তোকে বলতে চাই,

তুই একবার ভাব,এমন কিছু করলে তুই চলে যাবি। বেঁচে যাবি। কিন্তু তোকে সবকিছু বির্সজন দিয়ে যেই মানুষটা বুকে আগলে ধরে এত বড় করেছে। তার কি হবে? তাকে তো তুই জ্যান্ত মেরে ফেললি তাহলে। এই তোর মায়ের প্রতি ভালোবাসা নদী? এই তোর সবচেয়ে আপনজনের প্রতি কর্তব্য? আর তুই না ছোট বেলায় মাদ্রাসায় পড়েছিস? সেখানে কি এই শিখিয়েছে তোর ওস্তাদেরা? সুইসাইড করার মতো নিকৃষ্ট কাজ করতে? এটা যে কত বড় জঘন্য মহাপাপ এটা বলেনি তারা? একজন সন্তানের জীবনে একজন মা কতখানি অমুল্য রত্ন তা অনুধাবন করতে পারছিস তুই?

নদী মাথা হেঁট করে আগের মতই বসেই রইলো।

তুই কি এখন আমাকে কথা দিতে পারবি? যতকিছুই হোক। কিন্তু তুই এমন ভুল ও নিষ্ঠুর সিদ্বান্ত নিবি না?

নদী ভেবে পায় না কি বলবে। সে মৌন হয়ে রইলো।

শ্রাবণ রাগত স্বরে বলল,

আমার এই কথার জবাব নাই তোর কাছে? তুই কচি খুকি? তোর সাথেরগুলো কলেজে পড়ে। মাদ্রাসায় পড়ার জন্য তোর দুই বছর গ্যাপ গেলো। তুই পিছিয়ে গেলি। কিন্তু তোর বয়সতো পিছায়নি?

নদী মিনমিন কন্ঠে বলল,

চাচী মাঝে মাঝে এমন উপহাস করে কথা বলে, মেনে নেওয়া যায় না। মনে হয় আমি এই বাড়ি,এই পরিবারের মেয়ে নই। আশ্রিতা। সবার করুণায় এখানে আছি।

শ্রাবণ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। নদীর মাথার উপরে নির্ভরতার হাত রাখলো। বড় ভাইসুলভ ভঙ্গিতে বলল,

আমি এই পরিবারের সন্তান হিসেবে সবার কাছে যতটুকু গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক তুইও সমান গুরুত্বপূর্ণ। আমি এবং তুই এই দেওয়ান পরিবারে সমমর্যাদার অধিকারী। আমি রাজনীতি করি। চেয়ারম্যান হয়েছি। সেসব বাইরে। ঘরে নয়। ঘরের ভিতর তুই যা, আমিও তা।

সমস্যা আছে যেখানে, সেখানে সল্যুশানও আছে। মনে রাখিস। পৃথিবীতে কোন সমস্যাই চিরস্থায়ী নয়। ক্ষণস্থায়ী। সাময়িক।

পরিক্ষা শেষ হলেতো দুই পরিবারেই থাকবি ছয়মাস করে। মাঝে তোর আম্মার কাছেও যাবি। ব্যাস, বছর শেষ হয়ে যাবে। কোন পাগলামি করবি না৷ খবরদার। তোকে আরো কিছু কথা বলব। তবে এখন নয়। তোর পরিক্ষা শেষ হলে। তবেই।

শুনে নদী ধরে নিলো শ্রাবণ হয়তো এমন আরো কিছু উপদেশ বাণী শুনাবে তখন। তার মতো দুই আনার সস্তা কড়ির সাথে একজন শিক্ষিত, স্মার্ট, সুদর্শন চেয়ারম্যানের আর কিইবা কথা থাকতে পারে।

শ্রাবণ বলল,

এই ভিতরে বেশী খারাপ লাগলে আমাদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসিস আরু, নিরুকে নিয়ে। ভালোলাগবে। কেমন? মন দিয়ে পড়াশোনা কর। রেজাল্ট ভালো হলে যেটা চাইবি আমার কাছে সেটাই পাবি।

নদী মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানালো।

শ্রাবণ দাদীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। যেতে যেতে স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলল, নদীকে কিছুটা হলেও মোটিভেটেড করতে পেরেছে বলে।

হাফসা বিবি নদীকে জিজ্ঞেস করলো,
শ্রাবণ এতসময় তাকে কি বলছে?

নদী সব বলল দাদীকে।

শুনে হাফসা বিবি আক্ষেপের ঝড় তুলল নদীর নিয়তির কথা মনে করে। এবং বলল,

তাইলেতো শাবন ম্যালা ভালা কথাই কইছে। তোর মঙ্গলের কথাই কইলো।

নাহার শহরে চাকরি করা স্বামী শফিকের সাথে ফোনে আরুর বিষয়ে কথা বলল। দুজন ঠিক করলো আরু কয়দিন পর দশম শ্রেণীতে উঠবে। তখন মুখোমুখি বিয়ের কথা ফাইনাল করবে দুই পরিবার মিলে। বিষয়টা আরু কিংবা নদী কেউই জানে না। সবাই আপাতত তাদের দুজন থেকে এই বিষয়টা আড়াল করেছে পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটবে বলে।

নদীর এস এস সি পরিক্ষা সামনে। এই ভিতরে নাহার বেগম নদীর সাথে তেমন দুর্ব্যবহার করেনি। খাবারের সমবন্টন বা গৃহস্থালি কাজকর্ম নিয়ে গাইঁগুঁই করতে গিয়েও পারে না। আরু বাধ সাধে। মায়ের উপর অসন্তুষ্ট প্রকাশ করে। তবে নদীকে মিষ্ট ভাষায় তুষ্ট করতে জুড়ি মেলা ভার তার।

আমগো নদী জজ ব্যারিস্টার হইবো। উকিল হইবো। ডাক্তার হইবো। পরের বাড়ির গিয়া গতর খাটা লাইগবো না। নদীর মায় সাধে কি আর বাপ মরা মাইয়ারে আমার কাছে পাঠাইছে। বাপ নাই কি হইছে। হে মাইয়ারে বড় কিছু বানাইবো। নদী কিছু হইলেতো আমাদেরও তো বড় মুখ। আমরাও তো ফুটানি মারতে পারুম। আমগো দেওয়ান পরিবারের মাইয়া কত বড় কিছু হইছে এহন।
দেহি নদী যদি একটা কিছু হয়, তাইলে তার পিছন দিয়া আরু নিরুকেও একটা কিছু বানামু।

নাহার বেগমের ফোঁড়ন কাটার কথার সারবস্তু বুঝতে নদীর কোন অসুবিধা হয় না। তবুও নদী নিরব থাকে।

ও নদীইই.. কলপাড়ে পইড়ে থাকা বাসনগুলো ধুইয়া আন।

ও নদীইই…উঠান থেইকা কাপড় গুলান নিয়া আয়।

নদীইই…ধর তোর দাদীরে ভাত গুলান নিয়া দে।

নদীইই..ঘরটা এট্টু ঝাড় দিয়া দেনা। পানির মগটা ভইরা আন।

ও নদীইই..রসুই ঘর থেইকা লাকড়ি গুলান আইনা উঠানে রইদে মেইলা দে।

বিছানা চাদরটা বিছায়া পালা। তোগো তিন বইনের জামাকাপড়গুলা আলনায় গুছাইয়া রাখ।

সবার অলক্ষেই নদীকে দিয়ে নাহার বেগম এমন ফুট ফরমায়েস খাটায়।

নদীও নত মাথায় মলিন মুখে যা পারে তা সব কাজই করে দেয় চাচীকে।

রজত সেই যে গেলো আর দেওয়ান বাড়িতে পা রাখেনি। সে নদীর পড়ালেখার তদারকি করে তার স্কুলে গিয়ে। একদিন স্কুলের মাঠে দাঁড়িয়ে নদীকে নিয়ে ঝাল চটপটি খাচ্ছিলো রজত। প্রসঙ্গত নদীকে বলল,

তোর ফাইনাল পরিক্ষা শেষ হোক। আমার জরুরী কথা আছে তোর সাথে।

নদী পুলকিত অনুভব করলো। লাজুক হাসলো। মুখ ফুটে বলেই ফেলল,

আচ্ছা আমিও শুনব, কি এমন জরুরী কথা। আগে দোয়া করেন রজত ভাই। আমার পরিক্ষাটা যেনো ভালোর ভালো শেষ হয়ে যায়।

আমাদের পাগলীটা। তোর জন্য শুধু দোয়া? বুক ভরা ভালোবাসাও আছে আমার।

নদীর কোচিং শুরু হলে সে ক্লাসের ভিতরে চলে যায়। কিছু বলা হল না আর তার।

তার সপ্তাহ খানেক পরে এসএসসি পরিক্ষার্থীদের বিদায় উপলক্ষে স্কুলে মিলাদ মাহফিল ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। বিশেষ অতিথি নব নির্বাচিত চেয়ারম্যান ইশতিয়াক দেওয়ান শ্রাবণ।
স্কুলের নিকটবর্তী রজতদের বাড়ি। সেই সুবাদে এই স্কুলে রজতসহ এলাকার কিছু শিক্ষিত যুবক ছেলের নিরঙ্কুশ আধিপত্য রয়েছে। ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে তারাও ছাত্রছাত্রীদের সামনের সারিতে উপবিষ্ট রয়েছে।

একে একে শিক্ষকগণ সবাই বক্তৃতা দিলো বিদায়ী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে। চেয়ারম্যানও তার মূল্যবান বক্তব্য উপস্থাপন করলো। জমজমাট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হলো। সবাই প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। মাইক্রোফোনের সামনে গিয়ে কেউ গান,কেউ কবিতা,কেউ গল্প,কেউ কৌতুক,কেউ নাচ করলো। উপচে পড়া করতালিতে বিদ্যালয়ের হলরুম মুখরিত হয়ে উঠলো। আচমকা নাজমা নামে এক ম্যাডাম নদীর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। বলে উঠলেন,

এই নদী তুমি না গাইতে পারো। ছোট ভাইবোনদেরকে একটা গান শুনিয়ে দাও তোমার মিষ্টি গলায়।

শুনে রজত অবাক হলো। নদী গাইতে পারে?
শ্রাবণ চমকে উঠলো হঠাৎ এমন কিছু শুনে নদী সম্পর্কে। সে থম মেরে রইলো। তবে দৃষ্টি প্রসারিত নদীর মুখপানে।

নদী ইতস্ততবোধ করতে লাগলো। কাঁচুমাচু শুরু করলো। ক্লাসের বন্ধুরা তাকে উৎসাহ দিতে লাগলো গাওয়ার জন্য।

নদী উঠে আসো? সমস্যা নেইতো।

ম্যাম প্রস্তুতি নেই যে?

লাগবে না। মিউজিশিয়ানরাতো আছেনই। কাবার হয়ে যাবে।

সাধারণ পোশাক পরিহিত নদী ধীর পায়ে উঠে যায়। হাতে নেয় মাইক্রোফোন। গেয়ে উঠে গান।

” আ..আ..আ..চঞ্চলা হাওয়ারে ধীরে ধীরে চলরে,
গুন গুন গুঞ্জনে ঘুম দিয়ে যারে।

পরদেশী মেঘ রে,আর কোথা যাসনে।

বন্ধু ঘুমিয়ে আছে, দে ছায়া তারে, বন্ধু ঘুমায় রে..
আয়রে মেঘ আয়রে..

ওগো ফুল তুমি আজ ঝরে যাও না..
এই মধুক্ষণে বাসর সাজাও না…”

রজত চোখ বন্ধ করে বিবশ হয়ে শুনছে। তলিয়ে যাচ্ছে নদীর গভীরে।

শ্রাবণ মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় শুনছে নদীর গান। এক আশ্চর্য চোখে চেয়ে আছে নদীর দিকে। এ কোন নদী আবিষ্কার হলো আজ তার সম্মুখপানে।

নদীর সুরেলা গায়কীতে পুরো হলরুমজুড়ে এক অদ্ভুত সম্মোহনী পরিবেশ বিরাজ করছে।

নদীর পরিক্ষা শেষ হলে শ্রাবণ ও রজত কি বলবে তাকে? নাকি পরিবর্তিত রূপ ধারণ করবে দুজনের কথাগুলো। বদলে যাবে দৃশ্যপট?

চলবে ৬