#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-১৫
দিন শুরু হয়েছে কিঞ্চিৎ প্রহর পূর্বে। সময় গড়িয়ে রোদের প্রখরতা যত বৃদ্ধি পাচ্ছে ততই বাড়ছে ব্যস্ততা। অভ্যন্তরীণ কাজে মশগুল গৃহকর্মীরা। পাড়া-পড়শীর আনাগোনা বেশ। ক্ষণিকের জন্য এসে গল্প করে খোঁজ-খবর নিয়ে যাচ্ছেন। হয়তো কোন ছুঁত পেলই গুজব রটাবেন এই আশায়। পিছনে, বাগানের দিকে হলুদের জন্য সাজানো হচ্ছে স্টেজ। কাজ ঠিকমত হচ্ছে কি-না তারই তদারকি করছে নির্বাণ। স্টেজের বিপরীত মুখে খানিকটা দূরে, বাবুর্চিদের দিকে নজর রাখছে নাহিদ আর রাদিন সাহেবের ছোট ছেলে মৃদুল। বাকিরা অন্যসব কাজে নিয়োজিত। খালি হাতে বসে নেই কেউ-ই।
লাকড়ি চুলোর তাপে নাহিদের প্রায় যায় যায় অবস্থা। মাথার ঘাম ঝরছে চিবুক বেয়ে পা পর্যন্ত। উঁচু নাকের ডগায় জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝলমল করছে রৌদ্রের কিরণে। হাঁপিয়ে উঠার ফলে মুখমণ্ডল ধারণ করেছে রক্তিম বর্ণ। কিঞ্চিৎ আরামের আশায় গিয়ে দাঁড়ায় নিম গাছের বিশুদ্ধ ছায়ার তলে। ঠেশ্ দিয়ে দাঁড়ায় গাছের সাথে। বা হাত উঁচিয়ে বাতাস করতে থাকে। নাহিদের এমন অবস্থা দেখে মৃদুল এগিয়ে এসে বলে,
— কি ভাই? এইটুকুতেই অবস্থা খারাপ?
নাহিদ বিরক্তিকর কন্ঠে বলে, “নাইলে কি? এত গরমে চুলোর সামনে দাঁড়ানো যায়? ইতিমধ্যে হাফ তান্দুরি হয়ে গিয়েছি আমি।”
মৃদুল হেসে বলে, “বিয়ে খেতে এসেছো, খাটনি তো করতেই হবে মামু।”
“তেঁতুলের চাটনি আজাইরা খাটনি। আগে জানলে একবারে বিয়ের দিনই আসতাম আমি। কোথায় ভেবেছিলাম মাহিন ভাইয়ের বিয়েতে এসে সুন্দরী ললনাদের পটাবো, খাবো-দাবো ফুর্তি করবো। সেগুলো এখন গুড়ের বালি। গরমে মরছি এখন।”
মৃদুল সান্ত্বনা স্বরূপ নাহিদের কাঁধে দু’টো চাপড় মেরে বলে, “থাক ভাই! কষ্ট পাইও না। নিজের বিয়েতে সকল শখ-আহ্লাদ পূরণ করে নিও।”
নাহিদ ভ্রু কুঁচকে বলে, “তুই কি বলতে চাইছিস? নিজের বিয়েতে বউ রেখে অন্য মেয়েদের পিছনে ঘুরব আমি? এইসব নাউজুবিল্লাহ মার্কা কথা কই পাস তুই?”
মৃদুল কিছু বলার পূর্বেই পিছন থেকে কেউ ভরাট কন্ঠে বলে উঠে, “কাজ বাদ দিয়ে তোরা এইখানে কি করিস?”
নাহিদ চোখ তুলে সামনে তাকায়। নির্বাণকে সামনে দেখতে পেয়ে নাহিদ অবসন্ন কন্ঠে বলে, “ওইদিকে কি গরম দেখসো ভাই? দাঁড়ানো যাচ্ছে না জাস্ট। তাই এইদিকে এসে দাঁড়িয়েছি৷”
নির্বাণ ভ্রু কুটি কুঞ্চিত করে প্রখর কন্ঠে বলে, “যতসব কাজে ফাঁকি দেওয়ার ধান্দা। যাহ! এখনই ওইদিকে। দেখ কাজ কতটুকু এগিয়েছে।”
মৃদুল ঝারি শুনে আর দাঁড়ানোর সাহস পেল না। আগেভাগেই কেটে পড়লো৷ নাহিদ মুখটা ছোট করে বিরবির করে বলে, “জল্লাদ একটা।”
নির্বাণ পুনরায় তাড়া দিতেই নাহিদ বলে উঠে, “আরেহ ভাই! যাচ্ছি তো।”
নাহিদ মুখ ঘুচিয়ে সামনের দিকে যেতে নিলে পিছন থেকে নির্বাণ ডেকে উঠে, “এই নাহিদ শুন!”
নাহিদ পিছন ঘুরে বলে, “আবার কি?”
“বাবুর্চিদের বলেছিস না, কোন খাবারে যাতে বাদাম জাতীয় কিছু বা বাদামের পেস্ট ব্যবহার না করে?”
নাহিদ আশ্বস্ত কন্ঠে বলে, “হ্যাঁ ভাই বলেছি। একবার, দুইবার না তিনবার বলেছি।”
“তাও খেয়াল রাখিস। ভুল হলে তোর খবর আছে।” শাসিয়ে বলল কথাটা নির্বাণ।
নাহিদ মাথা দুলিয়ে বলে, “ভুল হবে না। নিশ্চিন্তে থাকো। কিন্তু বাদামে এলার্জি কার? আমাদের বাসার কেউ আছে বলে তো মনে হয় না।”
নির্বাণ অকপট রাগ দেখিয়ে বলে, “তোকে এত জানতে হবে না। যে কাজ দিয়েছি সেটা কর, যা।”
নাহিদ কথা বাড়ালো না। আপন মনে বিরবির করতে করতেই নিজের স্থান ত্যাগ করলো।
_________________
দুপুরের খাবারের জন্য ডাকতে বাগানের দিকে আসলো স্পর্শী। নাহিদদের বলে ভিতরে পাঠিয়ে দিয়ে এগিয়ে গেল নির্বাণের দিকে। উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে নির্বাণ। ঘর্মাক্ত শরীরের সাথে লেপ্টে আছে বেগুনি রঙের শার্টটি। তারই সামনে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে দুইটি অল্প বয়সী ছেলে। কাজে গাফলতি করায় তাদেরকেই অতি তীক্ষ্ণ কন্ঠে ঝাড়ছে নির্বাণ। কথার ধারেই কপোকাত করছে তাদের। ছেলেদের অভিব্যক্তি বেশ শোচনীয়। মনে মনে হয়ত এইটাই আওড়াচ্ছে, “ছেড়ে দে ভাই কেঁদে বাঁচি।”
স্পর্শী নির্বাণের পিছনে দাঁড়িয়ে নীরবে সবটাই দেখলো। মিনমিনে স্বরে নিজেই বলল, “এই যে এইটা হচ্ছে মানুষটার আসল রূপ। ধমকা-ধমকির ছাড়া একটা কথাও বলতে পারে না। কি হয় একটু নরম কন্ঠে কথা বললে?”
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে মনে সাহস জুগিয়ে স্পর্শী মৃদুস্বরে ডাকলো, “এই যে শুনছেন?”
মিষ্টি কন্ঠে বলা বাণীটি নির্বাণের কর্ণগোচর হওয়া মাত্র ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকায় সে। স্পর্শীকে দেখামাত্র তীর্যক দৃষ্টি হয় নরম। সে ছেলে দুইটাকে যেতে বলে স্পর্শীর দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। মূহুর্তেই তীক্ষ্ণ কন্ঠস্বর নামিয়ে কোমল কন্ঠে বলে, “হুম বল।”
নির্বাণের কন্ঠে হঠাৎ পরিবর্তিত হতে স্পর্শী বেশ চমকায়। কিন্তু পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে বলে, “মা, আপনাকে খাবারের জন্য ডাকছেন। ভিতরে আসুন।”
“আচ্ছা, চল।”
স্পর্শী নিঃশব্দে এগিয়ে যায়। তারই পাশে নির্বাণও হাঁটা দেয়। তিন-চার কদম এগিয়ে যেতেই নির্বাণ বলে উঠে, “তোমার বা হাতটা দেখাও তো?”
স্পর্শী বিস্মিত কন্ঠে বলে, “কেন?”
নির্বাণের কন্ঠে স্পষ্ট আদেশ, “দেখাতে বলেছি।”
স্পর্শী কিছুটা মন ক্ষুণ্ণ করে থেমে দাঁড়ায়। অতঃপর বা হাতটা উঁচিয়ে নির্বাণের সামনে তুলে ধরে। নির্বাণ আলতোভাবে স্পর্শীর হাতটা টেনে ধরে নিজের সামনে ধরে। মুহূর্তেই স্পর্শী মাঝে বয়ে যায় আলাদা এক শিহরণ৷ কিছুটা সময় এভাবেই নীরবে অতিবাহিত হিতে স্পর্শী নিজেকে স্বাভাবিক করে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে নির্বাণের দিকে তাকিয়ে বলে, “দেখা হয়েছে?”
নির্বাণ ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “তোমার মেহেদী লাল হলো না কেন? মেহেদীটা কি ভালো না?”
নির্বাণের প্রশ্ন শুনে স্পর্শী কিঞ্চিৎ হেসে উঠে বলে, “এই মেহেদীর রঙ হতে একটু সময় লাগে। চিন্তা নেই, সন্ধ্যার মধ্যে রঙ হয়ে যাবে।”
নির্বাণ ঠোঁট যুগল গোল করে বলে, “অহ আচ্ছা।”
“হুম। এখন চলুন ভিতরে।”
___________________
হলদেটে আকাশে সূর্য মহাশয় ক্ষান্ত হয়ে নিমজ্জিত হওয়া মাত্র আগমন হলো আঁধারের। জ্বলে উঠলো রঙে-বেরঙের মরিচ বাতি, সজ্জিত দেখালো শেখ বাড়ি। তবে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হলো আরও ঘণ্টাখানেক পরে। মেহমানের আনাগোনা বাড়তেই বাগানের কানায় কানায় দেখা দিল কোলাহল। বাড়ির ছেলেরা সব অনুষ্ঠানের জন্য তৈরি হয়ে গেলেও, পিছিয়ে রইলো মেয়েরা। তাদের সাজ এখনো শেষ হয়নি। ছেলেরা সব হতাশাজনক নিঃশ্বাস ছেড়ে যে যার মত লেগে পড়লো কাজে।
বাহিরে আয়োজন সব ঠিক-ঠাক আছে কি-না তা পর্যবেক্ষণ করে ঘরে ফিরে এলো নির্বাণ। এগিয়ে গেল নিজ রুমের দিকে। দরজা ভিজিয়ে রাখা ছিল বিধায় নক না করেই রুমের ভিতর ঢুকে পড়লো সে। অতঃপর কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হলো কারো সুক্ষ্ম কন্ঠের চিৎকার। হতভম্ব হয়ে নির্বাণ পড়লো নিজ স্থানেই। দৃষ্টি বড় বড় করে তাকালো সে, স্পর্শী তখন আঁচল ঠিক করতে ব্যস্ত। কোন মতে আঁচল ঠিক করে প্রখর কন্ঠে বলে সে, “নক করে আসবেন তো নাকি?”
ঘটনাক্রমে বুঝে উঠতে নির্বাণের কিঞ্চিৎ মুহূর্ত লেগে যায়। অতঃপর ঠোঁটের কোণে সুক্ষ্ম হাসি ফুটিয়ে সে বলে, “রুম থেকে শুরু যেখানে গোটা মানুষটাই আমার সেখানে নক করার প্রয়োজন আছে কি?”
স্পর্শী হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকায় নির্বাণের পানে৷ ঠোঁট যুগলের মাঝে আপনা-আপনি সৃষ্টি হয় দূরত্ব। সে মোটেও এমন এক উত্তরের আশা করেনি। ব্রীড়ানতা,বিমূঢ়তায় স্পর্শী খেই হারায়। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে শুধু। নির্বাণ সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে বলে, “আমার রূপ বাড়ে নি যে এইভাবে তাকিয়ে আছো।”
স্পর্শী দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। লজ্জায় মাথা কাঁটা যাচ্ছে তার এখন। মানুষটা এমন কেন? উফফ! নির্বাণ স্পর্শীর দিকে এতটা গুরুত্ব না দিয়ে দরজা ভিজিয়ে দিল। অতঃপর নিজের ব্যাগের কাছে এগিয়ে কি যেন খুঁজতে থাকে। স্পর্শী একপলক নির্বাণের দিকে তাকিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার ক্ষীণ চেষ্টা করলো৷ মনোযোগ দিল নিজ কাজে।
নির্বাণ ব্যাগ থেকে একটা চেক বইয়ের মত কিছু বের করে উঠে দাঁড়ালো। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো স্পর্শীর পানে। স্পর্শী হাতে সেফটিপিন নিয়ে পিঠের দিকে ব্লাউজের সাথে শাড়ি পিন করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হচ্ছে। নির্বাণ তা দেখে নিঃশব্দে এগিয়ে গেল। মুহূর্তেই স্পর্শীর হাত থেকে সেফটিপিনটা নিয়ে নিজে লাগিয়ে দিল। ঘটনাচক্রে স্পর্শী ভড়কে উঠে। আয়নার ভিতর দিয়েই গোল গোল চোখে তাকায় নির্বাণের দিকে। নির্বাণ কয়েক কদম পিছিয়ে গিয়ে স্বগতোক্তি কন্ঠে বলে, “এদিকে ঘুরো।”
নির্বাণের একবাক্যে স্পর্শী রোবটের ন্যায় ঘুরে দাঁড়ায়। নির্বাণ ভালো মত স্পর্শীকে একবার পরোক্ষ করে নেয়। ক্ষণেই তার চোখ দিয়ে আঁটকায় নিষিদ্ধ একস্থানে। নির্বাণ দ্রুত নিজের দৃষ্টি সংযত করে দৃঢ় কন্ঠে বলে, “সেফটিপিন দাও কয়েকটা আমায়।”
স্পর্শী নির্বিকার ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে কয়েকটা সেফটিপিন নিয়ে নির্বাণকে দেয়। নির্বাণ হাতের বইটা বিছানার উপর রেখে স্পর্শীর নিকটে এসে হাটু গেড়ে বসে। স্পর্শীর কোমরের পার্শ্বে শাড়ি ঠিক মত টেনে সেফটিপিনের সাহায্যে ভালোমত এঁটে দিয়ে বলে, “শাড়ি ঠিকমত পড়তে না পারলে পড়ো কেন? যতসব মানুষের মাথা নষ্ট করার ধান্দা।”
কথাটা বলেই নির্বাণ উঠে দাঁড়ায়। বিছানার উপর থেকে বইটা নিয়ে দ্রুত গতিতে পা চালিয়ে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। আর স্পর্শী পুনরায় হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দরজার দিকে। তার দিনটাই আজ বোধহয় বিহ্বলময়।
#চলবে।