#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৪৩
ঘড়ির কাঁটার বিরচণ তখন নয়ের ঘরে। পরিবেশ মোহিত রৌদ্রস্নাতের আবেশে। দূরে প্রগাঢ় আকাশের শেষ রেখায় মিলিত হয়েছে সমুদ্রের একাংশ। গা আবৃত নীলাঞ্জনছায়ায়। নয়ন যায় যেদিক, আরাম লাগে সেদিক। সতেজ নিঃশ্বাসে বন্য ফুলের ঘ্রাণ৷ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কমতি নেই কিঞ্চিৎ পরিমাণও৷ সৌন্দর্যের এই মাপকাঠি মাপতে মাপতে কখন যে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ফেলল স্পর্শী বুঝে উঠতে পারলো না। যখন বাস এসে থামল নিজ গন্তব্যে, ক্লান্তিমাখা শরীরগুলো নড়েচড়ে উঠল, কোলাহল বাড়লো মিনিটে মিনিটে ঠিক তখনই স্পর্শীর খেয়াল হলো নিজ অবস্থানের। বাস খালি হওয়ার পূর্বেই স্পর্শীরা নেমে পড়ে। বাস থেকে নেমে সর্বপ্রথম হোটেলে গিয়ে উঠে তারা। কোনমতে হাত-মুখ ধুয়ে ছুটে খাওয়ার উদ্দেশ্যে। নিজের আশ মিটিয়ে পুনরায় হোটেলে ফেরত আসে সকলে। দশ-বারো ঘন্টা রাস্তার আঁকেবাঁকে ঝাঁকুনি খেয়ে, নির্ঘুম-অর্ধনিদ্রিত রাত কাটানোর পর শরীর তীব্রভাবে টানছে বিছানাকে। আর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকা যেন দায় সকলের নিকট৷ বিশ্রামের জন্য বড্ড ক্লান্ত মন। সেই যে খাওয়া-দাওয়া করে একেকজন রুমে এসে দরজা দিয়েছে, খুলেছে পড়ন্ত সাঁঝের কয়েক প্রহর পূর্বে। খাওয়া-দাওয়া হলো দ্বিতীয়বারের মত। অতঃপর দুই জুটি বেরিয়ে পড়ে ঘুরার উদ্দেশ্যে৷ রাস্তায় পাঁচ মিনিটের দূরত্বে কলাতলী সি বিচ অবস্থিত হওয়ায় প্রথম যাওয়া হলো সেখানে। পশ্চিমাকাশে অর্ধনিমগ্ন সূর্যটি তখন সমুদ্রের গহীনে মিইয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। হলদেটে আকাশ, পেঁজো মেঘের সমারোহ বুকে ধারণ করে স্রোত বইছে অসমান। চারজনে হাতে ডাব নিয়ে সূর্যাস্তের প্রহর গুণতে থাকে একমনে। মাঝে মধ্যে গল্প চলে একে অপরের সাথে। সূর্যাস্তের পর ঘন্টাখানেক বিচেই ঘুরে-ফিরে রাত আটটার নাগাদ তারা হোটেল ফিরে আসে। খাওয়া-আড্ডায় রাত দশটা বাজে তাদের। রুমে কারো মন না টিকায় দ্বিতীয়বারের মত বেরিয়ে পরে তারা। স্পৃহা আর নাহিদ আশেপাশেই থেকে যায়। ঘুরে ঘুরে মার্কেট দেখতে থাকে আর খোশ আলাপে মত্ত হয়। এদিকে নির্বাণ আর স্পর্শী হাঁটতে হাঁটতে সমুদ্রসৈকতেই আসে। পরিবেশ তখন খানিকটা কোলাহলমুক্ত। সকাল-বিকালের মত মানুষের ঠ্যালা-ঠ্যালি নেই বললেই চলে। মুঠো ভর্তি তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আঁধারিয়া অম্বরে। মধ্যখানে নিখুঁত আকৃতির চন্দ্রমা খিলখিল করে হাসছে কৃষ্ণ জলের ধারায়৷ হাতের মাঝে হাত গলিয়ে স্পর্শী বালুময় পথে হেঁটে চলেছে। চোখের দেখায় অকৃত্রিম, অপার্থিব দৃশ্য স্মৃতি বন্দী করছে সে। হঠাৎ এক দামকা হাওয়ার আবির্ভাব হলো, এলোমেলো হলো রমনীর উন্মুক্ত কেশ। চোখে-মুখে এসে পড়ে কয়েক গাছি চুল। নির্বাণ থামে। হাত উঁচিয়ে খুব সন্তর্পণে চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দেয়। স্পর্শী মিষ্টি হাসে। আদুরে কন্ঠে বলে, ” ওদিক চলেন। পানিতে পা ভেজাব।”
নির্বাণ মাথা ঝাঁকায়, “আচ্ছা চল।”
নির্বাণের সম্মতি পাওয়া মাত্র স্পর্শী সেদিক ছুটে৷ এক কিনারে জুতো জোড়া খুলে রেখে শৈথিল্য জলে পা ডুবায়। নির্বাণ হাত শক্ত করে ধরে, খেয়াল তার স্পর্শীর দিকে। জমিন পিচ্ছিল, স্পর্শী পড়ে না যায়। এদিকে পানির সংস্পর্শে এসে বাচ্চাসুলভ হয়ে উঠে যুবতীর প্রাপ্তমনস্ক মন। দুই-এক পা ফেলে কদম মিলিয়ে চলার আহ্বান যায় নির্বাণকে। নাকচ করতে না মানবটি। শর্তক কন্ঠে বলে, “দেখে-শুনে হাঁটো। শামুক-ঝিনুক থাকে, পা কেটে যাবে।”
স্পর্শী হাসে,”কাঁটবে না।”
কথাটা বলে স্পর্শী আরও কিছু পানিতে হাঁটাচলা করে তীরে ফিরে আসে। সৈকতের পাশ দিয়ে চলাচলের সময় সামনের দিকে নজর যায় তার। কিছু হাত দূরত্বেই কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ নারী বিচের কিনার দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আর হাসি-মজা করছে। সম্ভবত রাশিয়ান তারা, ঘুরতে এসেছে এখানে। পড়নে তাদের শর্টস এবং ক্রোপ টপ। যার দরুন শরীরের বেশিরভাগ অংশই উন্মুক্ত। ভিনদেশি মুভি-সিরিজে এমন পোশাকে নারী অজস্রবার দেখেছে সে। কৃত্রিম পর্দায় স্বাভাবিক এবং তাদের মানানসই দেখালেও, বাস্তবে অস্বস্তিবোধ হয় স্পর্শীর। সাথে লজ্জা পায় কিছুটা। সে তার মনকে বোঝাতে অসক্ষম হয় যে, “তাদের সংস্কৃতি ভিন্ন। তারা এমন পোশাক পরিধান করতেই সাচ্ছন্দ্যবোধ করে। স্বস্তি অনুভব করে। তারা ভিনদেশি।”
শুধু আনমনে আওড়ায় যে, “এদের কি জামা-কাপড়ের অভাব নাকি? আরেকটু কাপড় পড়লে কি হতো?”
কথাটা বলে চোখ ঘুরিয়ে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় নির্বাণের পানে। নির্বাণ সামনের দিকেই তাকিয়ে আছে। মুহূর্তেই ফুঁসে ওঠে সে৷ পায়ের আঙুলের উপর ভর করে নির্বাণের গালের দুইপাশে হাত গলিয়ে জোড়পূর্বক নির্বাণের মুখ তার দিকে ঘুরায়। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে, “এদিক তাকান। ওদিক কি দেখছেন?”
নির্বাণ হতভম্ব হয়ে তাকায়। নিজের গাল থেকে স্পর্শীর হাত নামিয়ে হাতের মাঝে নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত কন্ঠে বলে, “মানে? কোথায় দেখছি আমি?”
“বউ থাকতে অন্য পর নারীদের দিকে তাকাতে লজ্জা করে না?”
নির্বাণ নিজের বিস্ময়কর ভাব তুকাতে না পেরে বলে, “কার দিকে তাকালাম আমি?”
স্পর্শী বলে, “ন্যাকা সাজবেন না। আমি দেখেছি।”
স্পর্শী কথা আগা-গোড়া বুঝতে না পেরে নির্বাণ এদিক-সেদিক তাকালো। দূরে শ্বেতাঙ্গ নারীদের দলদের চোখ পড়া মাত্র ঘটনা বুঝতে বেগ হয় না তাকায়। কিছু বলার পূর্বেই স্পর্শীর হাত ছাড়িয়ে পুনরায় নির্বাণের মুখ টেনে এদিক ঘুরায়। চেঁচিয়ে বলে, “আবার তাকিয়েছেন আপনি৷ সাহস তো কম না। আমি ব্যতীত অন্য কারো দিকে তাকানো নিষেধ আপনার। এক্কেবারে নিষেধ। বুঝেছেন?”
নির্বাণ হাসে। মেয়েটা যে এই মুহূর্তে বড্ড জেলাস ও ইন্সিকিউর তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ অবশিষ্ট রইলো না নির্বাণের। যদিও সে ভিনদেশি সেই নারীর দলবলকে খেয়ালই করে নি তবুও মজা নেওয়ার জন্য সে বলে, “বুঝলাম তবে এভাবে এভাবেই তো আর কথা দেওয়া যায় না, বিনিময়ে কিছু যে চাই আমার।”
স্পর্শী হতবিহ্বল নয়নে তাকায়, “মানে কি?”
নির্বাণ স্পর্শীর কানের পাশে ঝুঁকে, “সুন্দর এক দৃশ্য দেখা থেকে বঞ্চিত করছো আমায় তার বদলে বিশেষ কিছু কি আমার প্রাপ্য নয়?”
স্পর্শী চোখ পাকিয়ে তাকায়, “কিছু পাবেন না আপনি। চলেন আমার সাথে, এক্ষুনি হোটেল ফিরবো আমি।”
নির্বাণ গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলে, “তাহলে তুমি একা যাও। আমি থাকব আর কিছুক্ষণ।”
“বেশ! তাহলে থাকেন। কিছুক্ষণ কেন সারারাত থাকেন। ভুলেও রুমে ফেরত আসবেন না আর আপনি। কাল সকাল হোক চলে যাব আমি।”
কথাটা বলে স্পর্শী মুখ ঝামটা মেরে চলে যেতে নিলে নির্বাণ তার হাত ধরে টেনে নিজের সান্নিধ্যে নিয়ে আসে৷ স্পর্শীর মাথা নিজের বুকের মাঝে মিশিয়ে নিয়ে শান্ত কন্ঠে বলে, “তোমার থেকে দৃষ্টি সরলে না-হয় আমি অন্যের দিকে তাকাব।বুঝো না কেন তুমি? তখন মজা করছিলাম।”
স্পর্শী মুখ গুঁজে বলে, “মজা হোক আর যাই হোক আপনি বলবেন কেন এমন কথা?”
“আচ্ছা আর বলব না। ঠিক আছে?”
স্পর্শী স্মিত মুখে মুখে বলে, “হু আছে।”
স্পর্শীর কথা রাখতেই নির্বাণ সেখান থেকে হোটেলে ফিরে আসলো৷ লিফটের কাছে এসে বাটন প্রেস করতেই দরজা খুললো৷ সাথে সাথে চোখের সামনে ভেসে উঠলো আপত্তিকর এক দৃশ্য৷ ভিনদেশি এক যুগলের মধ্যকার একান্ত কিছু মুহূর্ত। স্পর্শী এবার আপাদমস্তক লজ্জায় বেষ্টিত হয়ে দ্রুত চোখ ঘুরিয়ে নির্বাণের বুকে মুখ গুঁজে বিরবির করে বলে, “তবা! তবা!”
তবে নির্বাণ নির্বিকার থেকেই দৃঢ় কন্ঠে বলে, “সরি টু ইন্টারাপ্ট।”
কথাটা বলে নির্বাণ স্পর্শীকে নিয়ে সিড়ির দিকে চলে আসে। স্পর্শী তখনো লজ্জায় কুঁকড়ে নির্বাণের সাথে লেগে আছে। সিড়ি দিয়ে উঠার সময় স্পর্শী বিরবির করে বলে, “কি নির্লজ্জ এরা। মাথায় কি সামান্যটুকু কান্ডজ্ঞান নেই নাকি? লিফটে কিভাবে.. ছিহ!”
বিরবির করে বলা সত্ত্বেও নির্বাণের কর্ণকুহর পর্যন্ত সম্পূর্ণ কথাটি এসে পৌঁছায়। সে থেমে স্পর্শীর কানের কাছে এসে বলে, “সবাই তো আর তোমার বরের মত এত ধৈর্যশীল না। বুঝলে!”
স্পর্শী কিছুক্ষণ থম মেরে থেকে নিবার্ণের বুকে কিল বসিয়ে বলে, “মুখে লাগাম নেই কেন আপনার? নির্লজ্জ একটা।”
নির্বাণ স্পর্শীর এক হাত ধরে বলে, “তাই নাকি? তা উপাধি যেহেতু দিয়েই দিয়েছ সেহেতু আজ তোমাকে নির্লজ্জের ডেফিনিশন না শিখিয়ে ছাড়ছি না আমি। আসো!”
স্পর্শী তৎক্ষনাৎ বলে ওঠে, “না..”
নির্বাণ স্পর্শীর ঠোঁটদ্বয়ের মাঝে আঙ্গুল চেপে ধরে, “হুস! কোন কথা না।”
অতঃপর স্পর্শীর হাত চেপে ধরে তাকে নিয়ে উপরে আসে। রুমে ঢুকে দরজা দেয় সে। শব্দ হয় কিঞ্চিৎ পরিমাণ। আড়চোখে তাকায় নিস্তব্ধতা।
________________
পরবর্তীদিন সকালে সকলে বের হলো হিমছড়ির উদ্দেশ্যে৷ একপাশে সুবিস্তৃত সমুদ্র সৈকত আর অন্যপাশে রয়েছে সবুজ পাহাড়ের সারি। আকাশ, সাগর, পাহাড়ের অপূর্ব বন্ধনে আবদ্ধ অপার্থিব সৌন্দর্যে মোড়ানো পরিবেশটা যে কারো মন ভালো করতে সক্ষম। নিস্পন্দ, নির্জন পাহাড়ের গহীনে জলপ্রপাতের কলধ্বনি সুধা যেন। স্পর্শী সবকিছুই ক্যামেরা বন্দী করে নেয়। স্মৃতি হিসাবে ক্ষুদ্র মেমোরিতে জমা পড়লো কয়েক’শ ছবি। সারাদিন ঘুরাঘুরি করার পর সন্ধ্যার একটু আগেই ফিরে আসে তারা৷ যে যার রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিল প্রথমে। স্পর্শী ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসতেই দেখে নির্বাণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে কার সাথে যেন কথা বলছে। স্পর্শী নিজের চুল মুছে এগিয়ে গেল সেদিক। ততক্ষণে নির্বাণ কল কেটে দিয়েছে। স্পর্শী জিজ্ঞেস করে, “কে ফোন করেছিল?”
নির্বাণ স্পর্শীর দিকে তাকায়৷ সিক্ত চুলে তখনও গড়িয়ে পানি পড়ছিল। স্নিগ্ধ মুখখানি একটু বেশি নিষ্পাপ লাগছিল। আবছা চন্দ্রপ্রভায় স্পর্শীর গলদেশে লেপ্টে থাকা গভীর প্রণয়ের লালাভ চিহ্নটি চোখে বিঁধলো খুব করে। নির্বাণ স্মিত হেসে স্পর্শীকে কাছে টেনে তার পিঠ নিজের বুকের সাথে ঠেশ দিয়ে ধরে। স্পর্শীর পেট জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুতনি রেখে বলে, “মৃন্ময় ফোন করেছিল। রুদ্রের কেস নিয়ে আপডেট দিতে।”
স্পর্শী কপালের ভাঁজ পড়ে, “কি বলল সে?”
“রুদ্রের কেসের রায় দিবে সামনের সপ্তাহে, যেতে বলেছে একবার। ওর সকল ক্রাইম প্রমানিত হয়েছে, আশা করা হচ্ছে চৌদ্দ বছরের জেল হবে। সাথে জরিমানা তো আছে।”
“হলে তো ভালোই।”
নির্বাণ স্পর্শীর গালের সাথে গাল লাগিয়ে বলে, “হুম। তা আমার কাছে কিন্তু একটা গুড নিউজ আছে।”
স্পর্শীর কন্ঠ কৌতূহল শোনায়, “কি সে-টা?”
নির্বাণ কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত কন্ঠে বলে, “আমার চাকরি হয়ে গিয়েছে।”
#চলবে
#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৪৪
নির্বাণ কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত কন্ঠে বলে, “আমার চাকরি হয়ে গিয়েছে।”
কথাটা কর্ণগোচর হওয়ামাত্র স্পর্শী হৃষ্টচিত্তে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় নির্বাণের দিকে, “সত্যি?”
নির্বাণ মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, “হ্যাঁ! এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এনালিটিক্যাল কেমিস্ট হিসেবে জয়েন করছি নেক্সট মান্থে।”
স্পর্শী শুকরিয়া আদায় করে বলে, “এটা হলো কবে?”
“তিনদিন আগে।”
স্পর্শী চোখ বড় বড় করে তাকায়, “আর আপনি আমাকে এখন জানাচ্ছেন? আগে জানান নি কেন?”
নির্বাণ হাতের বাঁধন শক্ত করে বলে, “এখানে এসে জানাতে চেয়েছিলাম। একান্ত ভাবে, তাই!”
স্পর্শী গাল ফুলিয়ে বলে, “নট ফেয়ার।”
নির্বাণ স্পর্শীর গালে আলতো করে আধর ছুঁয়ে বলল, “এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার।”
স্পর্শী আরও কিছুক্ষণ কপট রাগ দেখাতে চেয়েছিল কিন্তু নির্বাণের স্পর্শে সেটা পারলো না। গলে গেল মন তার। কন্ঠ মিহি হলো, “মাকে জানিয়েছিলেন?”
নির্বাণ সুক্ষ্মভাবে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ! প্রথমে তাকে এবং দ্বিতীয়তে তোমাকে। বাকি কেউ এখনো জানে না।”
“জানাবেন না?”
“ফিরে যাই তারপর।”
স্পর্শী মাথা দুলিয়ে আরও কয়েকটা প্রশ্ন করে। নির্বাণ সবগুলো প্রশ্নের উত্তরই বেশ গুছিয়ে দেয়। শেষে স্পর্শী জিজ্ঞেস করে, “আপনি কি আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন কোন সাইডে যাবেন?”
“হ্যাঁ কিছুটা। এই জবটার জন্য আরও মাস খানেক আগে থেকেই ট্রায় করছিলাম।”
“অহ আচ্ছা।”
“হ্যাঁ! ভার্সিটিতে পড়াকালীন আমাদের একজন প্রফেসর ছিলেন। কল্যাণ স্যার! সপ্তাহে একদিন বায়োকেমিস্ট্রি ক্লাস নিতেন তিনি। কিভাবে কিভাবে যেন তার সাথে আমার বেশ সখ্যতা হয়ে যায়। শিক্ষতার বাহিরে তিনি একজন রিসার্চার ছিলেন। আমি ল্যাব সাইডে ভালো ছিলাম বলে তিনি প্রায় তার ল্যাবে আমাকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্টগুলা দেখাতেন। বছর দুই-এক তার আন্ডারে ছিলামও। সেটাই এখন কাজে লেগেছে। আর কল্যান স্যারের সাথে এখন পর্যন্ত ভালো সম্পর্ক থাকায় আমার রেফারেন্সটাও তিনিই দেন।”
স্পর্শী চোখ ছোট ছোট করে বলে, “আপনি তো দেখছি গভীর জলের মাছ।”
নির্বাণ হাসে, “তাই নাকি?”
স্পর্শীর অকপট স্বীকারোক্তি, “অবশ্যই।”
নির্বাণ কথা বাড়ায় না। আলিঙ্গন শক্ত করে কথা ঘুরায়, “তোমাকে এখানে নিয়ে আসার মূল কারণ কি জানো?”
“না। কি?”
“তোমার সাথে কিছু সময় কাটানোর। পরবর্তী সময় আমার খুব ব্যস্ততায় যাবে, যোগাযোগ হয়তো ক্ষীণ হবে। দেখাদেখির সুযোগ হবে না তেমন। তাই ব্যস্ত হওয়ার পূর্বে চাইছিলাম পুরো সময়টা তোমাকে দিতে।”
স্পর্শী নির্বাণের আংশিক কথা বুঝলো আবার বুঝলোও না। সে প্রশ্নবোধক চাহনি নিক্ষেপ করে, “মানে?”
নির্বাণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে স্পর্শীকে নিজের দিকে ঘুরায়, “চাকরিটা আমার গুলসানের ওদিকে। এখান থেকে যেয়ে এসে করা সম্ভব না, তাই আমি সেদিকে শিফট হচ্ছি।”
স্পর্শী বার কয়েক পলক ফেলে। নির্বাণের সম্পূর্ণ কথার অর্থ বুঝতে পেরে অভিব্যক্তি মলিন হয়। নিষ্প্রভ চাহনিতে তাকায়, “অহ আচ্ছা। বুঝেছি!”
“কি মন খারাপ করলে?”
স্পর্শী জোরপূর্বক অধরের কোণ টেনে বলে, “নাহ! মন খারাপ হবে কেন?”
শরৎ প্রচ্ছন্ন আকাশে গোলাকৃত চন্দ্রপ্রভায় স্পর্শীর শ্যাম মুখটি একটু বেশি স্পষ্ট দেখাল। গায়ে চন্দ্রমা লেপ্টে আছে খুব আদুরে ভাবে। হিমেল বাতাসের দোলে অর্ধ-সিক্ত কেশ উড়ছে আলগোছে। নির্বাণ স্পর্শীর মুখের কাছে পড়ে থাকা অবাধ্য চুলগুলো খুব সন্তর্পণে কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে বলে, “অনেকক্ষেত্রে দূরত্ব অনুভূতি ফিকে না বরং প্রগাঢ় করে। আর আমার অনুভূতি কখনো ফিকে হওয়ার নয়। নিশ্চিন্তে থাকো। তোমার পাশে আমি সব সময় আছি।”
স্পর্শী অনিমেষ দৃষ্টিতে তাকায়। অধর ধারে মিহি রেখা বর্ধিত। মানুষটা তার মন পড়তে জানে নাকি? সে যে আসলেই এই ভাবনায় মত্ত ছিল। নির্বাণ স্পর্শীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “রুমে চল, খাবার অর্ডার দিচ্ছে। খেয়ে রেস্ট কর, ক্লান্ত তুমি।”
________________
রাত তখন দশটা৷ তিনতালা প্রায় ফাঁকা। কয়েকটা রুম সবেমাত্র খালি হয়েছে বলে কোলাহলও নেই তেমন। করিডরের মধ্যখানে জ্বলতে থাকা লাইটটা একবার জ্বলছে, আরেকবার বন্ধ হচ্ছে। কেমন যেন গা ছমছম পরিবেশ। এমন সময় স্পৃহা দরজা খুলে বেরিয়ে আসলো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দ্বিধাগ্রস্ত নয়নে এদিক-সেদিক তাকালো। হাতে থাকা ভাঙা চশমাটার ফ্রেমটা মুঠো করে ধরলো। আবছা দৃষ্টিতে ভুতুড়ে পরিবেশটা উপলব্ধি করতে পেরে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। দ্রুত পায়ে হেঁটে পাশের রুমটার দিকে এগিয়ে গেল। পাশের রুমটা নাহিদের। আপাতত নাহিদ ব্যতীত তার কোন গতি নেই। দ্রুত বেগে দরজায় কড়া নাড়ে স্পৃহা। মৃদু কন্ঠে ডাকে, “নাহিদ ভাইয়া! ভিতরে আছেন?”
মিনিটের মাঝেই নাহিদ দরজা খুলে ৷ বলে, “কি হয়েছে?”
স্পৃহা কিয়ৎকাল ইতস্তত করে বলে, “আমার একটা সাহায্য করতে পারবেন?”
নাহিদের ভ্রু কুঞ্চিত হয়, “কি?”
“আশেপাশে কোন চশমার দোকান থাকলে আমায় নিয়ে যেতে পারবেন? আমার চশমার ফ্রেম ভেঙে গিয়েছে। তাই এখন আর্জেন্ট একটা চশমা দরকার। আমি আবার চশমা ছাড়া স্পষ্ট কিছু দেখতে পাই না।”
নাহিদ অনুদ্ধত কন্ঠে জিগ্যেস করে,”ভাঙলো কি করে?”
স্পৃহা মাথা নুয়ে ফেলে। লজ্জায় তার মুখ ঈষৎ লাল দেখায়। আনমনে ভাবে, প্রশ্নটার উত্তর কি করে দিবে সে? সত্য এটা যে অসাবধানতার বশত সে চশমার উপরই বসে পড়েছিল। কিন্তু ব্যাপারটা ভীষণ লজ্জার। নাহিদকে বলবে হো হো করে আসবে সে। তার উপর এই ছেলের ঠোঁট যে পাতলা। ঠুস করে বলে বসবে কিছু একটা। তাই সেই মুহূর্তে মিথ্যের আশ্রয় নেওয়াটাই শ্রেয় মনে হলো স্পৃহার নিকট, “হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল।”
নাহিদ ঠোঁট গোল করে বলে, “অহ আচ্ছা।”
স্পৃহা মাথা ঝাঁকায়, “হ্যাঁ। দোকান আছে আশেপাশে? জানেন কি?”
নাহিদ মাথায় চুলকায়। আশেপাশে আদৌ কোন দোকান আছে কি-না তার জানা নেই। তবে যাই হোক ‘না’ বলবে না। সময় কাটানোর একটা সুযোগ হাতে এসেছে হাত ছাড়া করে কিভাবে সে? বের হয়ে দোকান না-হয় খুঁজে নেওয়া যাবে। এটা বড় ব্যাপার না। কথাটা ভেবে নাহিদ গলা পরিষ্কার করে। বলে, “থাকার কথা। আচ্ছা চল আমার সাথে দেখছি।”
“আচ্ছা।”
নাহিদ রুমের ভিতর থেকে চাবি নিয়ে দরজা ভালো মত আটকে বের হলো। হোটেল থেকে বের হয়ে রাস্তার ধারে পাশাপাশি হাঁটাতে শুরু করলো তারা। স্পৃহা সামনে সুব্যক্তভাবে দেখতে না পেয়ে হাঁটার সময় বেশ কয়েকবার হোঁচট খেল। নাহিদ বিষয়টা লক্ষ্য করে নিভৃতে স্পৃহার হাতটা শক্ত করে ধরলো। বলল, “হাতটা শক্ত করে ধরো। তোমাকে দেখার জন্য আছি আমি।”
স্পৃহা সরল মনেই বলে, “থ্যাংক ইউ।”
নাহিদ হাসে। আনমনে বলে, “আজীবন আছি।”
#চলবে।