চৈতির ডাইরি পর্ব-০২

0
71

#চৈতির_ডাইরি
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -২

আকাশ মেঘলা। অল্প অল্প বাতাস দিচ্ছে। তুলি বিছানার কোণায় গুটিগুটি হয়ে বসে আছে। তার শরীর আবারও খারাপ হতে শুরু করেছে। নানান চিন্তা মস্তিষ্ক ভারী হয়ে আছে। আশিক কি তাকে পা’চা’র করে দিতে চায় নাকি অন্য কোন পরিকল্পনা করছে? মাঝেমধ্যে রাত কাটিয়েছি বলতে কি বোঝাল? তার সাথে কাটানো রাতের কথা বলছে না তো? তুলি আর ভাবতে পারল না, দু’হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরলো। মাথার মধ্যে সূক্ষ্ম যন্ত্রণা হচ্ছে। শেষরাতের পর আর ঘুমতে পারেনি, ঘুমের ভান ধরে ছিল। মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে সে ঘুম জোড়া লাগানো যায়, তবে শেষরাতের ঘুম আর জোড়া লাগে না। আশিক বেলকনি থেকে এসে শুয়ে পড়ছে। তুলি জেগে আছে কি-না দেখার প্রয়োজন মনে করেনি।

ঘড়িতে সকাল ছয়টা বাজে। বাড়ির কেউ এত সকালে ঘুম থেকে ওঠে না। জাহানারা মাঝেমধ্যে উঠলেও আবার ঘুমিয়ে পড়েন। তুলি বিছানা ছেড়ে রান্নাঘরের দিকে গেল। এক কাপ চা পান করলে হয়তো মাথাটা ছেড়ে দিতে পারে। রজনী রান্নাঘরে একটা চেয়ারে বসে আছে। তুলি দেখে কোমল গলায় বলল, ” তোমার চোখ-মুখ এমন দেখাচ্ছে কেন? চা খাবে?”

গ্যাসের চুলায় পানি ফুটছে। তুলি সেদিকে তাকিয়ে রইল। যদিও তার কয়েকটা কঠিন কথা বলতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু বলল না। হালকা মাথা নাড়ালো। রজনী বলল, “তোমার চোখ-মুখ শুকনো দেখাচ্ছে কেন? রাতে ঘুম হয়নি?”

“হয়েছে অল্প। আজ-কাল শরীর খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। মাঝেমধ্যে খুব ক্লান্ত লাগে।”

“কিছুদিন ভালো কোন জায়গা থেকে ঘুরে আসা প্রয়োজন। তাহলে দেখবে এসবকিছু ঠিক হয়ে গেছে। বরকে বলে হানিমুনে চলে যেতে পারো। বিয়ের খুব বেশিদিন পার হয়নি।”

তুলি বিস্মিত চোখে বড় জায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। এই মহিলার সাথে আশিকের সম্পর্ক থাকলে সে নিশ্চয়ই হানিমুনে যাওয়ার বুদ্ধি দেবে না। নাকি এর অন্য কোন পরিকল্পনা আছে! তুলি একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস গোপন করে বলল, ” কিছু মনে না করলে একটা কথা জানতে চাইবো?”

চা বানানো শেষ। চুলা নিভিয়ে দেওয়া হচ্ছে। রজনী কাপে চা ঢালতে ঢালতে বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ বলো। কিছু মনে করবো কেন? তুমি তো আমার বোনের মতো।”

“গতকাল বিকেলে কোথায় ছিলেন? বাড়িতে দেখলাম না যে।”

“আমি তো মা-বাবার সাথে ওর দোকানে গিয়েছিলাম। মা সবাইকে যেতে বলেছিলেন, নববী যেতে চায়নি আর তুমি বিশ্রাম নিচ্ছিলে বিধায় বিরক্ত করিনি।”

“ওহ!”

রজনী তুলির শরীরে হাত রাখল। অসম্ভব কোমল গলায় বলল, “মনে হচ্ছে তোমার মন ভালো নেই। আশিকের সাথে কি কিছু হয়েছে? আমাকে বলতে পারো। আমি বুঝিয়ে বলব। ও আমায় নিজের বড় বোনের মতো সম্মান করে।”

তুলি মাথা নাড়লো। এই মহিলাকে তার সুবিধার মনে হয় না। সারাক্ষণ আশিকের আশেপাশে ঘুরঘুর করে। যেন এ বাড়িতে আশিকের ওপর তার অধিকারই সবচেয়ে বেশি। মেয়েরা নিজের স্বামীর পাশে অন্যমেয়ের ছায়াকে পর্যন্ত সহ্য করতে পারে না। সেখানে এই মহিলা রীতিমতো খবরদারী করে। তুলি ছোট ছোট চুমুকে চা শেষ করলো। বেলা বাড়ছে। রান্নার কাজ শুরু করতে হবে। রান্নার দিকটা রজনী দেখাশোনা করে। মাঝেমধ্যে কেউ কিছু সাহায্য করে দেয়। জাহানারা ছেলের বউদের মেয়ের মতো ভালোবাসেন। কাজের ভুল ধরেন না বললেই চলে। হঠাৎই তুলির কিছু খেয়াল হলো। রজনীর ব্যাপারে শাশুড়ি মাকে জিজ্ঞেস করলে মন্দ হয় না। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বললে উনি বুঝতে পারবে না।

জাহানারা বিছানার চাদর ঠিক করছিলেন। তুলি তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। নরম গলায় বলল, “মা, সকালে কি রান্না হবে? বড় আপাকে দেখলাম সবজি কাটছে।”

জাহানারা সহজ গলায় বললেন, ” কি রান্না হবে তা নিয়ে ভাবতে হবে না। রজনীকে সবকিছু বলে এসেছি। তোমার শরীর ভালো?”

তুলি মাথা নাড়লো। লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, “বড় আপা বলছিল- কাল আপনি আমার খোঁজ করছিলেন। সবাই ভাইয়ার দোকানে গেছিল।”

“হ্যাঁ। সবাইকে নিয়ে বের হতে চেয়েছিলাম। তুমি ঘুমচ্ছিলে, নববী যেতে চাইল না। পরে তোমার শশুর আর রজনীকে নিয়ে গেছিলাম।”

তুলি একটু কেঁপে উঠল। জাহানারা মিথ্যে কথা বলেন না। সে এ বাড়িতে আসার পর থেকে জাহানারাকে কখনও মিথ্যে বলতে দেখেনি । তবে কি নববী মিথ্যে বলছে? কিন্তু কেন? তুলির সাথে নববীর কোন দন্দ নেই। ঝগড়া তো অনেক দূরের কথা সামান্য কথা কাটাকাটি পর্যন্ত হয়নি। সে কেন এমন মিথ্যে বলতে গেল? তুলি চিন্তিত মুখে শাশুড়ির ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নববীর সাথে এ ব্যাপারে কথা বলতে হবে। কিছু রহস্য নিশ্চয়ই আছে!

নববীর ঘুম ভাঙেনি। বেশিরভাগ দিন সে বেলা দশটা পর্যন্ত শুয়ে থাকে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বিছানায় শুয়ে কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে আছে। তালেব ঘরে নেই। তুলি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। আশিক অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছে। গোসল শেষ করে গায়ে কালো শার্ট চাপিয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে। দেখতে ভালো লাগছে। তুলি বিছানায় বসল। আশিক বলল, “কিছু হয়েছে? মন ম’রা দেখাচ্ছে কেন?”

তুলি চমকে উঠলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “এমনিতেই। কিছু হয়নি?”

আশিক অসম্ভব কোমল গলায় বলল,” বাড়ির কথা মনে পড়ছে? মা’য়ের কাছে যেতে চাও?”

“অনেকদিন হয়ে গেছে মা-বাবার সাথে দেখা হয় না। যেতে পারলে খুব ভালো হয়।”

“একা যেতে পারবে? নাকি আমার নিয়ে যেতে হবে?”

“আপনি নিয়ে যাবেন?”

“যাব না কেন? আচ্ছা। তাহলে আগামী বৃহস্পতিবার চলো। রাতের টিকিট কাটবো। অফিস থেকে ফিরে রওনা দেবো। কোন সমস্যা হবে?”

তুলি উৎসুক দৃষ্টিতে আশিকের দিকে তাকালো। ঝলমলে গলায় বলল, “না না। কোন সমস্যা হবে না। আমি মা বাবাকে বলে রাখবো।”

তুলি মন ভালো হয়ে গেছে। কতদিন বাদে মা বাবার সাথে দেখা হবে, কথা বলতে পারবে। ভাবতেই ভালো লাগছে। মন আনন্দে নেচে উঠছে। আশিক অফিসে চলে গেছে। নববীর সাথে কথা হয়নি। তুলি ঠিক করলো- নববীকে আচ্ছা করে বকা দিয়ে দেবে। এভাবে সংসারের ভাঙন ধরানোর মানে কি? আশিক বড় জায়ের ঘরে ছিল ঠিকই কিন্তু বড় জা তখন ঘরে ছিল না। ওইসব শব্দ সবকিছু মিথ্যে। তুলি একটু চিন্তিত হয়ে পড়ল। নববী কোন শত্রুতা করছে না তো?

দুপুরে খাওয়ার পরপরই তুলি হাই তুলতে শুরু করলো। ঘুমে তার চোখ জুড়িয়ে আসছে। জাহানারা বললেন, “তোমার শরীর খারাপ নাকি?”

“না মা, ঘুম পাচ্ছে।”

“তাহলে গিয়ে শুয়ে পড়ো।”

তুলি কথা বাড়ালো না। এলোমেলো পায়ে ঘর পর্যন্ত গিয়ে বিছানায় পিঠ এলিয়ে দিলো এবং প্রায় সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুম ভাঙলো দুঃস্বপ্ন দেখে। ভয়ংকর রকমের দুঃস্বপ্ন।
তুলি পরপর কয়েকটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বিছানায় উঠে বসলো। স্বপ্নের কথাগুলো মনে করতে পারছে না। তার শরীর ঘেমে গেছে। সে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালো। দিনের আলো চকচক করছে। কথায় বলে দিবাস্বপ্ন সত্যি হয় না। তবুও তুলির বুক কাঁপতে লাগলো। বালিশের পাশ থেকে মোবাইল হাতে নিয়ে মা’য়ের নম্বরে কল দিলো। ফোনের ওপাশ থেকে মধ্যে বয়স্ক মহিলার গলার আওয়াজ শোনা গেল। তিনি যথাসম্ভব গম্ভীর গলায় বলছেন, “কেমন আছিস? সবকিছু ঠিকঠাক আছে?”

তুলি কাঁপা গলায় বলল, “না মা, কিছু ঠিক নেই। খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখেছি।”

রেশমা বেগম চিন্তিত গলায় বললেন, “দুঃস্বপ্ন দেখা ভালো কথা না। তুই একটা কাজ কর। নদীর পাড় দিয়ে একটু ঘুরে আয়।”

“নদীর পাড়ে গেলে কি হবে মা?”

“মনে অশান্তি থাকলে মানুষ এমন বাজে স্বপ্ন দেখে। নদীর মনের অশান্তিকে চুষে নেয়।”

তুলি খফোন নামিয়ে রাখলো। তার মা’য়ের কাছে এই একটা সমাধানই আছে। কিছু হলেই নদীর পাড়ে গিয়ে বসে লম্বা লম্বা শ্বাস নিতে হবে। ছোটবেলা দুঃস্বপ্ন দেখলে তার মা তাকে নিয়ে নদীর পাড়ে গিয়ে বসে থাকতো। তুলি মা’য়ের আদেশ অমান্য করল না। কখনো করেও না। তড়িঘড়ি করে তৈরি হয়ে নিলো। আশিকদের বাড়ির পাশে ছোটমতো একটা নদী আছে। কয়েক পা হেঁটে গেলেই সরু মতো খাল চোখে পড়ে। অবশ্য কোন এক কালে এ নদীর বিশালতা ছিল। অজস্র জলরাশি বুকে নিয়ে সাগর পানে ছুটতো। আজ তার সে ক্ষমতা নেই। ম’রে গিয়ে খালের মতো হয়ে গেছে। তুলি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

আলো ম’রে এসেছে। চারদিক অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। আকাশে লাল আভা ফুটে উঠেছে। তুলি নদীর দিক থেকে চোখ সরালো। বাড়ি ফিরতে হবে। দ্রুত পায়ে বাড়ির পথে হাঁটা শুরু করলো। তড়িঘড়ির জন্য পায়ে শাড়ি জড়িয়ে যাচ্ছে। তুলি যখন বাড়ির সামনে পৌঁছালো ততক্ষণে চারদিক অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। রাস্তার আলো জ্বলেনি। হঠাৎই তার নজর পড়লো একটা ছায়ার দিকে! ছায়ামূর্তিটা কারো সাথে কথা বলছে। তুলি অবাক চোখে সেদিকে এগিয়ে গেল। নববী কোন ছেলের সাথে কথা বলছে। তুলি বলল, “কি হচ্ছে এখানে?”

নববী মেকি হেসে বলল, “একটা পার্সেল অর্ডার করেছিলাম। ওটাই নিতে এসেছি।”

তুলি কিছু না বলে বাড়ির ভেতর চলে গেল। যেতে যেতে শুনতে পেল ছেলেটা বলছে- মেডাম সই করুন। এই যে চৈতি লেখা আছে এখানে।

চলবে