চৈতির ডাইরি পর্ব-০৩

0
69

#চৈতির_ডাইরি
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট – ৩

রাত দশটার মতো বাজে। তুলি বারান্দার কোণায় বসে আছে। হাতে চায়ের কাপ। চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। সেদিকে খেয়াল নেই তার। এক দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। আশিক এখনও বাড়ি ফেরেনি। ফোনে কথা হয়েছে। তার ফিরতে দেরি হবে। হঠাৎই নববী এসে তুলির পাশে বসলো। ধরা গলায় বলল, ” তোমাকে আমার একটা কাজ করে দিতে হবে। দিতেই হবে কিন্তু!”

তুলি ভাবলেশহীন গলায় বলল, “কি কাজ করতে হবে?”

“তালেবের খোঁজ এনে দিতে হবে। সে কোথাও চলে গেছে।”

“চলে গেছে মানে?”

“চলে গেছে মানে হারিয়ে গেছে। আমার সাথে ঝগড়া করে হারিয়ে গেছে।”

” আগে তুমি একটু শান্ত হয়ে বসো। কি হয়েছে খুলে বলো। এমন ছটফট করছ কেন?”

নববী তরল গলায় বলল, “তালেবের অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে। এখন সে আর আমার সাথে সংসার করবে না।ওই মেয়েকে বিয়ে করতে চায়।”

তুলি খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। সরু গলায় বলল, “এখানে আমি কি করতে পারি? তুমি বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলো। উনারা ভালো বুঝবেন। তাছাড়া তালেবের সাথে আমার তেমন কোন সম্পর্ক নেই। ঠিকমতো কথাও হয় না। এখানে আমার কিছুই করার নেই।”

নববী হতাশ চোখে তুলির দিকে তাকিয়ে আছে। তার ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত হাসি খেলা করছে। তুলি সে হাসি ধরতে পারল না। যথাসম্ভব শক্ত গলায় বলল, “শোনো নববী! তোমাকে একটা কথা বলি। অন্যের ঘর ভাঙতে চাইলে নিজের ঘরও ঠিক থাকে না। সেদিন আশিক বড় আপার ঘরে গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু আপা ঘরে ছিল না। তুমি অযথা আমায় ওইসব কথা বলেছিলে। কেন বলেছিলে? আমার সংসারে ঝামেলা বাঁধিয়ে তোমার কি লাভ?”

নববী ঠোঁট উল্টে হাসলো। তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “তুমি বড় আপার কথা বিশ্বাস করে নিলে? ওই মহিলা কেমন ঘুঘু তা তোমার জানা নেই। সময় হোক, তখন বুঝতে পারবে। আমি ভালোর জন্যই বলেছিলাম।”

তুলি জাহানারার কথা বলতে গিয়েও থেমে গেল। নববীর ভাব লক্ষণ সুবিধার মনে হচ্ছে না। নববী কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই আশিক এলো। গম্ভীর গলায় বলল, “এখানে বসে আছো কেন? ঘরে এসো।”

তুলি কিছু না বলে উঠে দাঁড়ালো। ধীর পায়ে আশিককে অনুসরণ করে ঘরের দিকে যেতে লাগলো। নববী অদ্ভুত চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। তার ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি ফুটে উঠেছে।

আশিক বলল, “নববীর সাথে কি কথা বলছিলে?”

“তেমন কিছু না। তালেবের সাথে নাকি ঝগড়া হয়েছে তাই বলছিল।”

আশিক তুলির পাশে বসলো। সহজ ভঙ্গিতে তুলির কাঁধে হাত রেখে বলল, “ওদের এই ঝামেলা নতুন কিছু নয়। বিয়ের আগে থেকে শুরু হয়েছে। তুমি এসব ব্যাপারে মাথা দিতে যেও না। নববীকে যতটা সোজা সরল মনে হয়, বাস্তবে সে অতো সহজ না।”

“একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”

“বলো।”

“নববীর সাথে তালেবের বিয়েটা কি স্বাভাবিকভাবে হয়েছিল? আসলে আমি অনেক কিছুই শুনেছি, সেজন্য জানতে চাইলাম।”

“তুমি কি শুনেছ, আমি বুঝতে পারছি। কথাগুলোর নব্বইভাগ সত্য। বাকি দশভাগ মিথ্যে।”

তুলি ভ্রু কুঁচকে বলল, “দশ ভাগ মিথ্যে বলতে?”

“তালেবের সাথে নববীর সম্পর্ক ছিল এটা সত্যি। কিন্তু সেদিন ওই বাড়িতে অনৈতিক কিছু হয়নি। আমার কথা বুঝতে পারছ?”

তুলি মাথা নাড়লো। আশিক শীতল গলায় বলল, ” বিয়ের কয়েকদিন আগে নববীর বাবা মা দুজনের কেউ বাড়ি ছিলেন না। নববী তালেবকে কল দিয়ে বলল – সে খুব অসুস্থ। বাড়িতে কেউ নেই। তালেব এ কথা শুনে ঠিক থাকতে পারেনি। ভালোবাসার মানুষের অসুস্থতা খরব কোন পুরুষকে স্বাভাবিক রাখতে পারে না। দূর্বল করে ফেলে। তালেবের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলো না। সবকিছু ভুলে সে নববীর বাড়িতে চলে গেল।”

“তারপর?”

“ও বাড়িতে গিয়ে দেখে নববী সত্যিই খুব অসুস্থ। কাত হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। ক্রমাগত বমি করছে। তালেব গিয়ে তার কাছে বসলো। ব্যস্ত গলায় বলল- তোমাকে এমন অসুস্থ রেখে আংকেল আন্টি গেলেন কিভাবে? নববী কিছু বলল না। শূন্য দৃষ্টিতে তালেবের দিকে তাকিয়ে রইলো।”

“এসব কথা আপনাকে কে বলেছে?”

“তালেব বলেছে। এই গল্পের সবচেয়ে মজার অংশ এখনও বলা হয়নি। নববীর অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছিল। তালেব ওকে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য জোর করতে লাগলো। কিন্তু নববী রাজি হয়নি। ঘর ফাঁকা রেখে সে কোথাও যেতে পারবে না। তালেব তাকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেছে। লাভ হয়নি। শেষে আর কি করবে! তালেব একজন ডাক্তার খুঁজতে বের হলো। বাচ্চা ছেলে! ভালোবাসার মানুষের অবস্থা দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি। সেদিন তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে তালেবের বাইক এ’ক্সি’ডে’ন্ট হয়। অচেতন অবস্থায় রাস্তার পাশে পড়ে ছিল। লোকজন ওকে ধরে হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাত-পায়ের কিছু না হলেও মাথায় খুব জোর চোট পেয়েছিল। পরেরদিন তালেবের জ্ঞান ফেরে। জ্ঞান ফেরার সাথে সাথে নববীর খোঁজ করতে থাকে। বারবার নববীকে কল দেয়, ওর বান্ধবীদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু কোন লাভ হয় না। নববীর খোঁজ পাওয়া যায় না। শেষ পর্যন্ত তালেব কারোর কথা না শুনে নববীর বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। অনেক বোঝানোর পরও কারো কথা কানে তোলেনি। নববীদের বাড়িতে যাওয়ার পর কি হয়েছিল তা আমার জানা নেই। সন্ধ্যার দিকে ওরা দু’জনে বিয়ে করে বাড়ি ফেরে। এসব নিয়ে অনেক ঝামেলা হয়েছিল। তারপর থেকে তালেব কেমন অদ্ভুত হয়ে গেছে। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করে না, কারোর সাথে কথা বলে না। সারাক্ষণ চুপচাপ থাকে। যেন সে অন্য জগতের মানুষ!”

“এসব নিয়ে ওকে কখনো প্রশ্ন করেননি? কি হয়েছিল না হয়েছিল?”

“করেছি। উত্তর দিতে চায় না। এড়িয়ে যায়।”

“তাহলে ওর এ’ক্সি’ডে’ন্টের কথা আপনি কিভাবে জানেন?”

“যেদিন এক্সিডেন্ট হয় সেদিন এক লোক ওর মোবাইল থেকে নম্বর নিয়ে আমায় কল দিয়েছিল। বাবা মা জানলে চিন্তা করবে বিধায় কাউকে কিছু বলিনি।”

“সেদিন নববীর বাড়িতে কি হয়েছিল আপনারা কেউ জানেন না?”

“শুনেছি তালেব নববীর সাথে খারাপ কিছু করেছিল। তারপর ওর মা বাবা জোর করে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। এ কথাগুলো শুধু শুনেছি। বিশ্বাস করতে পারিনি। তালেবও আর কিছু বলেনি।”

তুলির খটকা লাগতে লাগল। তালেব যদি নববীকে এতোটাই ভালোবাসে তাহলে বিয়ের পর হঠাৎ এমন বদলে গেল কেন? নাকি সব পুরুষই বিয়ের পর বদলে যায়? প্রেমিকা আর বউ কি কখনও এক হয় না?

শেষ রাতের দিকে মুষলধারে বৃষ্টি নামলো। প্রায় সাথে সাথেই ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেল। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঘরের পরিবেশ ধীরে ধীরে বরফ শীতল হয়ে যাচ্ছে। আশিক তুলির দিকে বেশ খানিকটা এগিয়ে এলো। শরীরের উষ্ণতা শীতের তীব্রতা কমিয়ে দেয়।

খুব ভোরে তুলির ঘুম ভাঙলো। তখনও অন্ধকার পুরোপুরি কাটেনি। আকাশে চাঁদ দেখা যাচ্ছে। তুলি বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। তাদের ঘরের উল্টোদিকে তালেবের ঘর। দু’টো ঘরের মাঝামাঝি বিশাল বারান্দা। বারান্দার চারপাশে রেলিং দিয়ে ঘেরা। তুলি আগে কখনও এমন অদ্ভুত বাড়ি দেখেনি। কোন আর্কিটেক্ট বাড়ির ডিজাইন করেছিল কে জানে! তুলি একটা লম্বা শ্বাস নিলো। বারান্দায় শেষ মাথায় কিছু একটা পড়ে আছে। ম্যাড়মেড়ে আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তুলি কাছে গিয়ে জিনিসটা হাতে নিলো। একটা ডাইরি। সবুজ রঙের কভারের ওপর কালো কালি দিয়ে চৈতি লেখা। কিন্তু এটা এখানে এলো কিভাবে? এ বাড়িতে চৈতি নামের কেউ নেই। তুলি আশেপাশে তাকালো। কেউ কোথাও নেই। দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আকাশে শুকতারা ফুটেছে। ডাইরির বেশিরভাগ পৃষ্ঠায় কিছু লেখা আছে। তুলির খুব কৌতুহল হলো। কৌতুহল বশত ডাইরিটা সে নিজের কাছেই রেখে দিলো।

রজনী রান্নাঘরে সকালের নাস্তা তৈরি করছিল। বিশেষ কিছু নয়। ভর্তা ভাত। তুকি তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। নিচু গলায় বলল, “বড় আপা চৈতি নামের কাউকে চেনো নাকি?”

রজনী মাথা দোলাতে দোলাতে বলল, “আশিকের এক বান্ধবীর নাম ছিল চৈতি। মেয়েটা বেশ কয়েকবার এ বাড়িতেও এসেছে। তুমি হঠাৎ এসব জিজ্ঞেস করছ কেন?”

তুলি শান্ত গলায় বলল, “তেমন কিছু না। একটা খাতায় নামটা দেখলাম। সেজন্যই!”

“মেয়েটা আশিকের সাথে এক ক্লাসে পড়ত। কখনো লিখে থাকবে।”

“আচ্ছা বাদ দাও। কি রান্না করছ? আলু ভর্তা, ডিম ভর্তা?”

রজনী মাথা নাড়ালো। তুলি বলল, “তাহলে আমি পেঁয়াজ কুঁচি করে ফেলি। তুমি মরিচগুলো ভেজে ফেলো। খাবার সময় হয়ে এসেছে।”

রজনী মাথা নাড়ালো। তুলি চিন্তিত মুখে পেঁয়াজ কাটতে লাগলো। ডাইরির কথাটা এই মুহুর্তে কাউকে বলা ঠিক হবে না। আগে পড়ে দেখতে হবে ওখানে কি লেখা আছে।

তুলি ডাইরি পড়ার সুযোগ খুঁজছিল। একান্নবর্তী পরিবারের এই এক সমস্যা। ব্যক্তিগত সময় পাওয়া যায় না। আশিক অফিসে গিয়েছে অনেকক্ষণ আগে। তুলি ঘরে ঢুকে দরজায় ছিটকিনি লাগালো। পরম যত্নে ডাইরিটা বের করে বিছানায় উপুড় হয়ে বসলো। হাতের লেখা স্পষ্ট। পড়তে অসুবিধা হয় না।

প্রথম পৃষ্ঠা

বহুদিন বাদে আজ বাড়ি ফিরছি। মনের মাঝে অদ্ভুত শিহরণ হচ্ছে। কতদিন বাদে নিজের ঘর, চিরপরিচিত বিছানা। পছন্দের কোলবালিশ। ভাবতেই ভালো লাগছে। এয়ারপোর্টে থেকেই ডাইরিটা কিনলাম। দেশের সফরের বর্ণনা এখানেই লিখে রাখব। সাম্মী আসতে চেয়েছিল। মেয়েটার বাংলাদেশ দেখার খুব শখ ছিল। ও এসব পড়ে এনজয় করতে পারবে। প্লেন থেকেই লেখা শুরু করলাম। আমার পাশের সিটে একটা ছেলে বসেছে। ফর্সা মতো চেহারা, পাতলা ঠোঁট, গালভরা চাপ দাঁড়ি। এক কথায় সিনেমার নায়ক। একবার তাকালে চোখ ফেরানো দায়! অবশ্য আমি ছেলেটির গায়ে পড়ে কথা বলতে যাইনি। চুপচাপ নিজের মতো করে লেখালেখি করছি। ছেলেটা সেদিকে নজর দিচ্ছে না। চোখ বন্ধ করে সিটের সাথে হেলান দিয়ে আছে। কোন মানে হয়? সুন্দরী মেয়েদের প্রতি কি তার কোন আগ্রহ নেই?

তুলি দ্বিতীয় পৃষ্ঠা উল্টাতে যাবে এমন সময় দরজার কড়া নড়ে উঠলো। ওপাশ থেকে আশিকের গলা শোনা যাচ্ছে। সে খুব ব্যস্ত ভঙ্গিতে তুলির নাম ধরে ডাকছে।

চলবে