চৈতির ডাইরি পর্ব-০৪

0
73

#চৈতির_ডাইরি
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৪

তুলির বিছানা থেকে নামতে ইচ্ছে করছে না। এই ইচ্ছে কারণ নরম বিছানা নয়, সবুজ কভারে মোড়ানো ডাইরিটা। একগুচ্ছ কাগজ তাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করছে। কালিতে ছাপা হরফগুলো যেন তাকে ডেকে বলছে এই মেয়ে আমাকে পড়ে দেখো। আমায় তোমার জন্যই সাজানো হয়েছে। বিকট শব্দে তুলির ধ্যান ভাঙলো। আশিক খুব জোরে দরজা ধাকাচ্ছে, ভাব দেখে মনে হচ্ছে দরজা ভেঙে ফেলবে। তুলি ব্যস্ত ভঙ্গিতে ডাইরি লুকিয়ে রাখলো। দু-হাত দিয়ে নিজের চুলগুলো এলোমেলো করে দরজা খুলে দিয়ে লজ্জিত গলায় বলল, “ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। দুঃখিত।”

আশিক ভালো-মন্দ কিছু বলল না। দ্রুত পায়ে বাথরুমে ঢুকলো এবং পরমুহূর্তেই বেরিয়ে এলো। চোখ-মুখ ভেজা। তুলি তোয়ালে এগিয়ে দিয়ে বলল, “কিছু কি হয়েছে? এভাবে ফিরে এলেন যে!”

“তেমন কিছু না। অফিসের ফাইল নিতে ভুলে গেছিলাম। কিন্তু কোথায় যে রেখেছি ঠিক মনে করতে পারছি না।”

তুলি টেবিলের ওপর থেকে ফাইল এনে আশিকের হাতে দিয়ে বলল, “টেবিলের ওপর রেখে চলে গেছিলেন।” আশিক মুচকি হাসলো। কোমল গলায় বলল, “ধন্যবাদ।”

তুলিও হাসলো। সংসার জীবনের বেশকিছু সুন্দর মুহুর্তের মাঝে এই সময়টা লিখে রাখা যায়। আশিক ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে তুলির কপাল স্পর্শ করলো। ভালোবাসার কোমল স্পর্শ। যার জন্য একজন নারী আজীবন তৃষিত থাকে।

রোদ পড়ে এসেছে। দুপুরের খাওয়া শেষে বাড়ির সবাই নিজের ঘরে থাকে। জাহানারা এই সময়কে বিশ্রামের সময় ঘোষণা করছেন। এ সময় কেউ ঘর থেকে বের হয় না। তুলি এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলো না। কাপড়ের নিচ থেকে ডাইরি বের করে ইজিচেয়ারে বসলো। চেয়ারটা ঘরের দক্ষিণ কোণে জানালার পাশে রাখা। চেয়ারের সামনে ছোট একটা টেবিল। টেবিলের ওপর মাঝারি সাইজের এঁটেল মাটির ফুলদানি, তবে তাতে ফুল রাখা হয় না। কলম পেন্সিল থাকে। তুলি বাটিভর্তি চানাচুর নিয়ে টেবিলের ওপর রাখলো। জগ থেকে পানি ঢেলে গ্লাসের ওপর ঢাকনা দিলো।

পৃষ্ঠা দুই

অবশেষে বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলাম। মনটা হালকা হয়ে গেছে। সারা শরীরে শীতল বাতাস বয়ে যাচ্ছে। এটাই আমার সুখ। আসার আগে বাবা মা’কে জানানো হয়নি। কাউকে না জানিয়েই দেশে চলে এসেছি। ওদের রিয়াকশন কেমন হবে তা ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে অনুমান করা যায় -বাবা মা খানিকক্ষণ হতবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে, কয়েকটা কড়া কথা শোনাবে। অথচ চোখের কোণে আনন্দাশ্রু! কতদিন বাদে মেয়েকে নিজের চোখে দেখলো। মা বাবারা এমনই হয়। মুখে কড়া কথা শোনালেও মন থেকে বেজার হতে পারে না। আমার থেকে দুই মিনিটে বড় আপা নিশ্চয়ই চোখ-মুখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকবে। বিরক্ত গলায় বলবে, ” আমার খাট দখল করতে চলে এসেছে।”

পাশের সীটে বসা ছেলের সাথে কথা হয়েছে। উনার নাম সৌরভ। সৌরভকে দেখে যতটা গম্ভীর মনে হয়েছিল সে ততটাও গম্ভীর নয়। নিজ থেকে আগ বাড়িয়ে কথা বলল। কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, বাড়িতে কে কে আছে, একে একে সবকিছু জানতে চাইলো। লোকটাকে আমার খুব একটা সুবিধার মনে হয়নি। কেমন অদ্ভুত ধরনের! তবে খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারে। তার সাথে কথা বলে আরাম পাওয়া যায়। টেলিফোন নম্বর নিয়ে এসেছি। অবসর সময়ে গল্পগুজব করা যাবে।

পৃষ্ঠা তিন

সবকিছু এমন অদ্ভুতভাবে বদলে যাবে ভাবতে পারিনি। মা ঠিকই বলে- আমি এই পরিবারের অভিশাপ। আমি এখানে থাকলে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। কেউ বাঁচতে পারবে না। ঠিক যেমন করে নববী আপা বাঁচতে পারল না। কিন্তু এতে আমার কি দোষ? আমি কি করেছি? খুব করে লিখতে ইচ্ছে করছে, কলম চলছে না।

তুলি হাত বাড়িয়ে পানির গ্লাস আনলো। এক নিঃশ্বাসে সবটুকু পানি শেষ করে চোখ বন্ধ করে ফেলল। হঠাৎই নববীর নাম দেখে চমকে উঠেছে। একই নামে হাজারও মানুষ থাকতে পারে। কিন্তু সবকিছু কাকতালীয় হতে পারে না। চতুর্থ পৃষ্ঠায় কিছু লেখা নেই। পরপর বেশ কয়েকটা পাতাই কিছু লেখা নেই। তুলি বিষন্ন ভঙ্গিতে পাতা উল্টে গেল।

বেশ কয়েক পৃষ্ঠা পর থেকে নতুন করে লেখা শুরু করা হয়েছে। তুলি মনযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করলো।

বেশ অনেকক্ষণ কলম হাতে নিয়ে বসে আছি। লিখতে পারছি না। মা’য়ের মুখে শুনেছি- আমাদের জন্ম হয়েছিল সদর হাসপাতালে বারান্দায়। বর্ষাকালের কথা। রাত দুইটার দিকে মায়ের ব্যাথা উঠলো। সে-কি ব্যাথা! মা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। বাবা অনেক কষ্টে একটা ভ্যান জোগাড় করলেন। সেই ভ্যানে মা’কে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। বাবা মায়ের মাথায় ছাতা ধরে আছে। নানি করুণ গলায় আল্লাহকে ডাকছে।
রাত চারটার দিকে নববী আপার জন্ম হয়। তার দুই মিনিট পর আমার। নার্স বলল, “আপনাদের কি ভাগ্য। জমজ মেয়ে হয়েছে।” বাবা খুশি হলেও মা খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তার ইচ্ছে ছিল একটা ছেলে হোক। বংশের প্রদীপ জ্বলুক।

মা’য়ের পাশের বেডে যে মহিলা ছিল। তিনি এক পীরের বিবি। পীর সাহেব নিয়মিত নিজের বিবিকে দেখতে আসতেন। তিনিই নাকি আমায় দেখে বলেছিলেন- এই মেয়ে আপনার সংসারের অশুভ ছায়া। একে পরিবার থেকে দূরে রাখবেন। মা পীর সাহেবের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। আমাদের জন্মের আট বছর পর ছোট খালার বাচ্চা হয়। দূর্ভাগ্যবশত বাচ্চাটা মা’রা যায়। খালার শোক ভুলাতে মা আমায় খালার কাছে দিয়ে দিলেন। তারপর থেকে সেখানেই জীবন কেটেছে। মাঝেমধ্যে মা-বাবাকে দেখতে আসতাম। আমার দুই মিনিটের বড় বোনের নাম নববী। সে বাবা-মায়ের কাছে থাকত। তার সাথে আমার সম্পর্ক বিশেষ ভালো ছিল না। দেখা সাক্ষাৎ হতো না। খুব একটা কথাবার্তাও হতো না। দু’জন দু’জনকে সহ্য করতে পারতাম না। তবুও কোথায় না কোথাও দু’জনের খুব টান ছিল। ভালোবাসা ছিল। যা কখনও প্রকাশিত হয়নি। তবে ছিল।

নববী আপার মৃ’ত্যু আমাকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। আয়নার সামনে দাঁড়ালে তার চেহারা চোখের সামনে ভাসে। আল্লাহ কি আমাদের চেহারা ভিন্ন করতে পারতেন না? জমজ বোন না হলে তো আর এই সমস্যা হতো না। নিশ্চিন্তে দিন কাটাতে পারতাম। তবে আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ওই ছেলেটাকে খুঁজে বের করব। তার পাপের শা’স্তি তাকে পেতেই হবে। যে কোন মূল্যে পেতে হবে! ওই মানুষটার জন্য মা বাবা আপার মৃ’ত্যুর খবরটা পর্যন্ত প্রকাশ করতে পারেনি। আপার লা’শটা মেঝেতে পড়ে ছিল। বাবা বিরক্ত চোখে লা’শের দিকে তাকালেন। ভাঙা গলায় বললেন, “গোটা জীবন পাপে পূর্ণ হয়ে গেছে। না হলে আমার মেয়েকে কি-না এইভাবে মা’রা হয়।”

মা কাঁদছিলেন। তিনি চোখ মুছে বললেন, “এখন কি করবে? পুলিশে খবর দাও। তদন্ত হওয়ার জরুরি।”

“কোন তদন্ত নয়। সামনের মাসে আমার ইলেকশন। এখনই এসব ঝামেলা হলে দলের টিকিট পাওয়া যাবে না। যে চলে যাওয়ার সে চলে গেছে। তার জন্য নিজের ভাগ্য নষ্ট করার কোন মানে হয় না।”

মা ভীষণ হতাশ হয়ে পড়লেন। শেষ বয়সে বাবাকে রাজনীতির নেশায় পেয়েছে। এই নেশায় দুর্নীতি মেশানো থাকলে মানুষ পশুর চেয়ে খারাপ হয়ে যায়। বাবাকেও তেমন মনে হচ্ছে। না হলে কেউ কিভাবে এ ধরনের কথা বলতে পারে?

অনেক চেষ্টা করলাম। লাভ হলো না। বাবা কারো কথা কানে তুললেন না। রাতের আঁধারে আপার লা’শ পুঁতে ফেললেন। তার এক কথা- লোক জানাজানি করলে মেয়ে ফিরে আসবে না। কাজেই থানা পুলিশের কোন মানে হয় না। বাবার এমন আচরণের মা পাথরের মুর্তির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। আমিও কিছু বলার সাহস পেলাম না।

আজ সকালে সদর দরজা ওপরে একটা সিসি ক্যামেরা লাগালো দেখলাম। মা বলল, ” বেশ কয়েকদিন ধরে চুরিচামারি হচ্ছিল। সেজন্য তোর বাবা লাগিয়েছে।”

মাকে আর কিছু বললাম না। বাবার থেকে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ নিয়ে দেখতে শুরু করলাম। বাবা অবশ্য রাজি হচ্ছিলেন না। এসব ঝামেলা তার ভালো লাগে না। বারবার সর্তক করছিলেন- আমি যেন উল্টো পাল্টা কিছু না করি। নিবার্চনের পরে তিনি নিজেই সবকিছুর বিচার করবেন। ততদিন আমাকে নববী আপার ভান ধরে ঘুরে বেড়াতে হবে।

এতটুকু পড়ার পর তুলি ডাইরি বন্ধ করলো। আবছা হলেও তার কাছে গোটা ঘটনা পরিষ্কার হয়ে গেছে। ডাইরিটা চৈতির, যে এই মুহুর্তে নববী সেজে তালেবের বউ হয়ে আছে। তালেবকে শাস্তি দেওয়া তার মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু কি শাস্তি? মৃ’ত্যু নাকি অন্যকিছু?

দিনের আলো ম’রে আসছে। অন্যদিনের তুলনায় আজ একটু তাড়াতাড়ি অন্ধকার হয়ে গেছে। পাখিরা ঘরে ফেরার ব্যস্ততা দেখাচ্ছে। তুলি ডাইরি লুকিয়ে রাখলো। দুপুরবেলা ছাঁদে কাপড় শুকাতে দিয়েছে। সেগুলো আনতে যেতে হবে।
ছাঁদের এক কোণে নববী দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ-মুখ শুকনো। তুলি বলল, ” তালেব ফিরেছে?”

নববী মাথা নাড়ালো। যার অর্থ হ্যাঁ হতে পারে আনার না-ও হতে পারে। তুলি বেশ বিরক্ত হলো। চিকন গলায় বলল, “তোমাদের ঝামেলা মিটছে?”

“না। এই ঝামেলা আর কখনোই মিটবে না।”

“কেন মিটবে না?”

নববী বিষন্ন স্বরে বলল, “কোন কারণ ছাড়াই।”

তুলি অত্যন্ত বিরক্ত হলো। এই মেয়েকে সোজাভাবে সবকিছু জিজ্ঞেস করতে হবে। সে চায় না তার শশুর বাড়ির লোকের কোন ক্ষতি হোক। বিশেষ করে তালেবের। আশিকের কথা শুনে মনে হয়েছে তালেব নির্দোষ। সে নববীর কোন ক্ষতি করতে পারে। এই কাহিনিতে রহস্য নিশ্চয়ই আছে। খুব গভীর কোন রহস্য! হঠাৎই তুলির নজর পড়ল নববীর হাতের দিকে। নববীর বাম হাত থেকে চুইয়ে চুইয়ে র’ক্ত পড়ছে।

চলবে