চৈতির ডাইরি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব

0
89

#চৈতির_ডাইরি
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
শেষ পার্ট

ঝিঁঝি ডাকছে। পোকাগুলো ডাকছে বেশ জিরিয়ে জিরিয়ে। তুলি কান খাঁড়া করে ঝিঁঝির ডাক শুনছে। এমন মনে হচ্ছে যেন পোকারা তাকেই কিছু বলার চেষ্টা করছে। আশিক দরজা ঠেলে ঘরের ভেতর ঢুকলো। সরু গলায় বলল, “জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছো কেন? কি করছ ওখানে?”

“এমনিতেই। কিছু করছি না।”

“রাতের বেলা কখনো ওখানে দাঁড়াবে না।”

“দাঁড়াব না কেন? এই বাড়িতে ভূত টূত আছে নাকি?”

“ভূত নেই। তবে এ ঘরে একটা পরি আছে। রাতেরবেলা জানালার কাছে দাঁড়ালে রাস্তা দিয়ে তাকে দেখা যায়। ব্যক্তিগত পরিকে রাস্তার লোক দেখবে এটা মেনে নেওয়া যায় না। অন্তত আমার পক্ষে সম্ভব না।”

তুলি কয়েক মুহুর্তের জন্য চুপ হয়ে গেল। আশিক প্রথমবারের মতো এসব কথা বলছে। জানালার পাশে দাঁড়ালে রাস্তার লোক তাকে দেখে ফেলবে, সে আশিকের ব্যক্তিগত পরি। তুলির চোখ ভিজে উঠলো। অশ্রু লুকানোর চেষ্টা চেষ্টা করতে করতে বলল, “রাতে খাবেন নাকি খেয়ে এসেছেন?”

“যদি বলো- তুমি না খেয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছ তাহলে খাবো। একা একা খেতে ইচ্ছে করছে না। মানুষেরা একা একা খাবার খেতে পারে না। একমাত্র পশুরাই একা একা খাবার খায়।”

“আচ্ছা চলুন।”

“তুমি রোজ রোজ না খেয়ে অপেক্ষা করো, ব্যাপারটা আমার ভালো লাগে না। তবে শান্তি পাই।”

“বুঝলাম না।”

“কিছু না। তুমি কি আমায় জড়িয়ে ধরতে চাও? অনেকক্ষণ থেকে চোখের পানি লুকানোর চেষ্টা করছ।”

তুলি অল্প হাসলো। তার হাত কাঁপছে। এই মুহূর্তে আশিককে তালেবের কথা জানানোর প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেসব কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। প্রিয় মানুষের হৃৎস্পন্দন শোনার মুহুর্তগুলো একটু বেশিই সুন্দর। এ সময়ে অন্যকিছু প্রাধান্য পায় না।

চৈতি শেষবারের মতো তালেবের বন্ধুর নম্বরে ডায়াল করলো। এই ছেলেটা বেশিরভাগ সময় তালেবের সাথে থাকে। বিয়ের পরপর পরিচয় হয়েছিল, যোগাযোগ রেখেছে। ওপাশ থেকে কেউ কল ধরলো না। চৈতি চোখ বন্ধ করলো। কয়েক ফোঁটা অশ্রু মেঝেতে পড়লো। চৈতির মাথায় ভেতর সূক্ষ্ণ যন্ত্রণা হচ্ছে। সে যন্ত্রণা ক্রমশ সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। পারছে না। দম আটকে আসছে। অনেক হয়েছে! এবার আর লুকোচুরি নয়। তালেবকে সোজাভাবে সবকিছু বলে দেবে। তাতে যা হওয়ার হবে। এ পাথর বহন করা সম্ভব নয়।

জাহানারা শোবার আয়োজন করছিলেন। আজ তিনি একা ঘুমচ্ছেন। বেশ কয়েকদিন ধরে তাকে গল্পের নেশায় ধরেছে। রাত জেগে গল্প পড়া নিয়ে প্রায়ই আশিকের বাবার সাথে ঝামেলা হয়। আজও হয়েছে। ঝামেলা এমন চরম পর্যায়ে চলে গেছে যে জাহানারা আলাদা ঘরে বিছানা করেছেন। চৈতি তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। ভেজা গলায় বলল, “মা, আপনার ছেলে বাড়ি আসছে না।”

জাহানারা শান্ত ভঙ্গিতে ঘড়ির দিকে তাকালেন। ভাবলেশহীন গলায় বললেন, “খুব বেশি রাত হয়নি। চলে আসবে। তুমি চিন্তা করো না।”

“আসবে না।”

“কেন আসবে না?”

“আমার সাথে ঝগড়া হয়েছে। রাগ করে চলে গেছে।”

জাহানারা অল্প হাসলেন। অসম্ভব কোমল গলায় বললেন, “স্বামী স্ত্রী ঝগড়া অতি সামান্য ব্যাপার। তালেব ঠিক চলে আসবে। তুমি চিন্তা করো না।”

চৈতি নিজেকে শান্ত করতে পারল না। খাটের কোণে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলতে লাগল। জাহানারা হাত ধরে তাকে বসালেন। গল্প পড়া নিয়ে ঝগড়ার ব্যাপারটা তাকে খুলে বললেন। ব্যাপারটা বলতে তার একটুও লজ্জা করল না। বরং ভালো লাগল। তিনি খেয়াল করলেন গল্পটা বলতে তার জড়তা কাজ করছে না এবং বেশ গুছিয়ে বলছেন। চৈতির ভয় কাটলো না। সে চুপসে বসে রইলো। গল্প শুনতে ভালো লাগছে না। কিন্তু শাশুড়ির মুখের ওপর কিছু বলতে পারল না। চিন্তিত মুখে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো।

রাত প্রায় শেষ। তালেব তখনও অচেতন হয়ে পড়ে আছে। মশার কামড়ে তার শরীরের বিভিন্ন জায়গা ফুলে লাল হয়ে আছে। কেউ একজন তালেবের মাথার পাশে বসলো। থলে থেকে পানির বোতল বের অচেতন ব্যক্তির চোখে-মুখে ছিটিয়ে দিয়ে বলল, “এখানে পড়ে আছিস কেন?”

পানির ঝাপটায় তালেবের জ্ঞান ফিরলো। মাথায় হাত দিয়ে উঠে বসতে বসতে বলল, “কে আপনি? এখানে কি করছেন?”

“আমি ভিকারি মানুষ। শেষ রাতে নদীর পাড়ে হওয়া খেতে এসেছি। তোকে দেখে তো ভদ্র ঘরের ছেলে মনে হয়। রাত দুপুরের এখানে পড়ে আছিস কেন?”

তালেব কথার জবাব দিলো না। পকেট থেকে দু’শ টাকার নোট বের করে বৃদ্ধর হাতে ধরিয়ে দিয়ে হনহন করে চলে গেল। ছেলেটা খুব দ্রুত হাঁটছে। হাঁটছে বেশ শক্ত পায়ে, এলোমেলো পা ফেলছে না। বৃদ্ধ ভিকারি সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আনমনে বলে উঠল- ছেলেটা বেঁচে থাকলে আজ এমনই শক্ত সামর্থ্য হতো!

রাতের বেলা হাঁটাহাঁটি করার মজাই আলাদা। লোকজন থাকে না। মাঝেমধ্যে দুই একটা কুকুর দেখা যায়। তালেব বাড়ির সামনে থমকে দাঁড়ালো। দূর থেকে একটা ছায়ামূর্তি দেখা যাচ্ছে। তালেবের বুকের মধ্যে ধক করে উঠলো। সে দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। বিস্মিত গলায় বলল, “এত রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছ কেন?”

চৈতি ভাঙা গলায় বলল, “আপনার সাথে আমার অনেক কথা আছে। খুব জরুরি।”

“তুমি এভাবে কাঁপছ কেন? কি হয়েছে?”

চৈতি তালেবের হাত ধরে ঘরের মধ্যে ঢুকলো। নিজের সমস্ত শক্তি একসাথ করে নববীর ব্যাপারে সবকিছু খুলে বলল। তালেব কোন কথা বলছে না। মনযোগ দিয়ে শুনছে। চৈতি কথা শেষ করে দু’হাতে মুখ ঢাকলো। সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তালেব একটুও উত্তেজিত হলো না। শান্ত ভঙ্গিতে চৈতিকে কাছে টেনে নিলো। একটা হাত রাখলো তার পিঠে। অসম্ভব কোমল গলায় বলল, “কাঁদে না।”

চৈতি সমানে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে। তবে সে নিজেকে তালেবের বাহুর বন্ধন থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করলো না। সে হয়তো নববী নয় কিন্তু তালেবের বিবাহিত বউ। এই সম্পর্কের কি কোন মূল্য থাকবে? তালেব কি তাকে মেনে নিয়ে সংসার করতে চাইবে অথবা সে কি পারবে তালেবের সঙ্গে গোটা জীবন কাটানোর প্রস্তুতি নিতে? দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আবহাওয়া তুলনামূলক শীতল। চাঁদ ডুবে যাচ্ছে। ধরনীর বুকে নতুন দিনের আগমন। তালেব বলল, “আমাকে নববীর ক’ব’রের কাছে নিয়ে যেতে পারবে?”

চৈতি মাথা নাড়ালো। ফ্যাসফেসে গলায় বলল, “পারব।”
তার খুব শান্তি লাগছে। মনে হচ্ছে বুকের ওপর থেকে একটা পাথর সরে গেছে। সত্য বলার প্রশান্তি অদ্ভুত সুন্দর। সবার অনুভব করার ক্ষমতা থাকে না।

সাত দিন পরের কথা,
তুলি ব্যস্ত ভঙ্গিতে কাপড়চোপড় গোছাচ্ছে। আশিকের চাকরির বদলি হয়েছে। আজ থেকে তারা দু’জনে আলাদা বাসায় থাকবে। হুট করেই যেন আশিক তাকে বুঝতে শুরু করেছে। তুলি মন বেশ ভালো। সে গুনগুন করে গান করছে। রজনী এসে তার পাশে বসলো। সহজ গলায় বলল, “আশা করি এরপর থেকে ভালো থাকবে। মনোযোগ দিয়ে সংসার করবে।”

তুলি চমকে উঠলো, নিজেকে সামলাতে সামলাতে বলল, “এমন কথা বললে যে?”

“শোনো তুলি, আমিও একজন মেয়ে। স্বামী সংসার আছে। এতদিন তোমার মনের অবস্থা আমি বেশ বুঝতে পেরেছি। আশিকের সাথে আমার অন্য ধরনের সম্পর্ক নেই। ছোট থেকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি। সেই থেকে আমায় বোনের মতো জানে। আমিও ওকে ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করি। না জেনে যদি কখনো তোমায় কষ্ট দিয়ে থাকি। তবে আমায় মাফ করে দিও।” কথাগুলো বলে রজনী ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নিজের প্রতি তার প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে। মেয়ে হয়ে অন্য মেয়ের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তা সে ভাবতে পারছে না। তার আগেই বোঝা উচিত ছিল- সবার মন মানসিকতা একরকম হয় না। সবাই সব বিষয়কে সহজভাবে নিতে পারে না। এতে সেই মানুষটার কোন দোষ নেই। প্রাকৃতিকভাবেই আমরা ভিন্ন, আমাদের মতামত আলাদা। এবং এটাই স্বাভাবিক।

সূর্য ডোবার সময় হয়ে এসেছে। সোনালি আলো লালচে বর্ন ধারণ করেছে। আশিক নববীর ক’ব’র দিকে থেকে চোখ সরিয়ে চৈতির দিকে তাকালো। বরফ শীতল গলায় বলল, “ঠিক কি জন্য নববীর মৃ’ত্যু হয়েছে?”

চৈতি ম’রা গলায় বলল, “জানি না। ভেবেছিলাম আপনি খু’ন করেছেন। এ ছাড়া আলাদাভাবে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিছু জানতে পারিনি।”

“তোমার বাবা? সে কিছু করেনি?”

“নেতা হওয়ার পর অনেক খোঁজ খবর করেছে। কিছু মেলাতে পারেনি৷ এসব অবশ্য লোক মুখে শুনেছি। বাবার সাথে আমার কথা হয় না।”

“তুমি কি কেন ব্যাপার নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছ?”

“না। তেমন কিছু নেই।”

“তুমি কি জানতে তোমার ব্যাপারে আমি আগে থেকেই সবকিছু জানি।”

“না, আমি জানতাম না।”

“আচ্ছা।”

“আপনি কি সত্যি জানতেন?”

“তুমি যে নববী নও তা বুঝতে বেশিদিন সময় লাগেনি। তারপর নিজের মতো করে খোঁজ নেওয়া শুরু করেছিলাম। মাসখানেক হলো সবকিছু জেনেছি। শুধু নববীর ক’ব’রটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।”

চৈতি ভাবলেশহীন গলায় ওহ বলল। তার কিছু ভালো লাগছে না। হঠাৎ শরীর অবশ হয়ে আসছে। তালেব স্বাভাবিক চোখে চৈতির দিকে তাকালো।

“চৈতি?”

“বলেন।”

“যদি আমি তোমাকে তোমার নামে বিয়ে করতে চাই। তুমি কি রাজি হবে?”

চৈতি শান্ত চোখে তালেবের দিকে তাকালো। তার চোখের তারা জ্বলজ্বল করছে। চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সূর্য একদম ডুবে গেছে। চারদিকে অন্ধকার। এই আঁধারের মাঝেও দু’জনকে বেশ সুন্দর লাগছে। ভবিষ্যৎ যে অনিশ্চিত! যেখানে কোন সমাপ্তি মানানসই নয়!

সমাপ্ত