#চৈত্রের_শেষে_বৃষ্টি (০৫)শেষ
#ছনিয়া_তাবাচ্ছুম
দুপুরের তীব্র রোদ,সাথে প্রচুর গরম। এই ভ্যাবসা গরমে সবার বেহাল অবস্থা। শশী সিলিং ফ্যানের নিচে বসে বাতাস খাচ্ছে। তখনই বাসার কলিং বেলের আওয়াজ পায়। ড্রয়িংরুমে সবাই আছে বিধায় রুম থেকে বের হয় না সে। তবে কি মনে করে যেন রুম থেকে বের হয়। রুমের বাইরে এসে দেখে তার ফুপি সৌহার্দ্য ভাই আর উৎসব। এদের কে দেখে শশী অবাক কারণ তার বাবা বলছে নতুন মেহমান আসবে। তাহলে ফুপিরা কেন আসছে। সৌহার্দ্য ভাইয়ের সাথে তার বিয়ে দেওয়ার জন্য নয়তো ভেবে আঁতকে ওঠে শশী। না না এটা হতে পারে না, সৌহার্দ্য ভাইয়া বলছে সে কখনোই আমার লাইফ টা নষ্ট হতে দেবে না। শশী দৌড়ে রুমে এসে দরজা আঁটকে দেয়। রুম জুড়ে পায়চারি করছে। এখন মনে হচ্ছে বাবা’র কাছে না শুনে সবচেয়ে বড়ো ভুল করছে। যদি একটু জোর করে শুনতো তাহলে অবশ্যই বলত তাকে। মিনিট পাঁচেক অতিবাহিত হওয়ার পর আবারও কলিংবেল বেজে ওঠে। শশী আর বাইরে বের হয় না। একটুপর দরজায় কেউ এসে নক করে। শশী ভদ্র মেয়ের মতো দরজা খুলে সামনে তাকিয়ে ঊর্মি কে দেখে অবাক হয়। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“- তুই এখানে কেন?
ঊর্মি মুখ ভেঙচি দিয়ে বলে,
“- কেন রে আমার আসা কি বারণ? আমি কি আসতে পারব না? ধর তোর ভাগ্নে কে বলে উৎসব কে শশী’র কোলে তুলে দেয়। শশী কিছু না বলে উৎসব কে নিয়ে খাটে এসে বসে। শশী’র পিছন পিছন ঊর্মিও খাটে এসে বসে।
ওম্মা খানিকক্ষণ পরে আবারো বেল বেজে ওঠে। শশী ভেবে পাচ্ছে না তাদের বাড়িতে এত কারা আসছে। বারংবার বেল বাজছে শশী ঊর্মি কে জিজ্ঞেস করে ,
“- ঊর্মি কারা আসছে রে জানিস নাকি কিছু?
ঊর্মি ভ্রু কুচকে বলল,
“- আমি ক্যাম্বাই জানুম। তোর বাড়ি, তোর ঘর, তোর বাপ, তোর জামাই, সব তোর তাহলে আমি জানব কেমনে ভাই?
ঊর্মির কথা’য় চোখ ছোটো ছোটো করে তাকায় শশী। ভ্রু নাচিয়ে বলে,
“- সব না হয় মানলাম। বাট আমার জামাই আসলো কোন হান থেকে আফা। যদি একটু কইতেন তাহলে মোর একটু ভাল্লাগতো।
ঊর্মি বোকা বোকা হেসে বলে,
“- আরে ছেড়ি মু্ই তো মুখ ফসকে কইয়া ফেলছি। আর কইছি তাতে তোর কি? তুই বিয়ে করলে তোর জামাই হইবো না তুই ক?
শশী’র মনে খটকা লাগে। কাউকে তার সুবিধা লাগছে। সবাই মনে হচ্ছে তার থেকে কিছু লুকাচ্ছে তবে সে গা’য়ে না মাখিয়ে দুই বান্ধবী আড্ডা দিতে লেগে যায়।
________________
ড্রয়িংরুমে বসে আছেন আনোয়ার নওয়াজ, পরশ শান্ত তাদের বোন সাবা আর তার মা মরিয়ম নওয়াজ। আনোয়ার নওয়াজ হেঁসে হেসে কথা বলছেন সুলাইমান সাহেব ও সৌহার্দ্য এর সাথে। শশী’র ফুপি আর মা দু’জন সবার জন্য নাস্তা নিয়ে আসেন। পরশ ভদ্র ছেলের ন্যায় চুপচাপ বসে সবার কথা শুনছে। পাশ থেকে শান্ত বারবার খোঁচা দিচ্ছে তাকে। পরশ দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছে। সবার সামনে কিছু বলতেও পারছে না। কথার এক পর্যায়ে সুলাইমান সাহেব স্ত্রী কে বলেন, শশী কে আনতে। তিনি মেয়ে’র রুমে এসে বলেন,
“- ঊর্মি শশী কে নিয়ে নিচে আসো তো মা।
মা’য়ের কথা’য় আশ্চর্য হয়ে যায় শশী। তবে কিছু বলার আগেই তার মা চলে যান। সেজন্য আর কিছু বলতে পারে না। তাই ঊর্মি কে জিজ্ঞেস করে,
“- নিচে কারা? আর আম্মু আমাকে নিচে নিয়ে যেতে বলছে ক্যান?
ঊর্মি শুধু বলল,
“- নিচে গেলেই বুঝতে পারবি। এখন কোনো কথা না বলে চুপচাপ চল। ঊর্মি শশী কে নিয়ে নিচে নেমে আসে।
শশী স্বাভাবিক ভাবে ই মাথায় উড়না দিয়ে সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসছে। তার চোখ জোড়া সিঁড়িতে সীমাবদ্ধ। তবে একজনের চোখ যে তার দিকে আঁটকে আছে সেটা খেয়াল করে না শশী। ড্রয়িংরুমে অনেকের কথার আওয়াজ পেয়ে শশী মাথা তুলে ড্রয়িংরুমের দিকে তাকায়। ড্রয়িংরুমে কয়েকজন অপরিচিত মুখ তাদের মধ্যে দু’জনকে দেখে চমকে ওঠে শশী। সাথে ঊর্মিও একজন কে দেখে অবাক হয়। দু’জনের মুখ অটোমেটিক হা হয়ে যায়। থেমে যায় পা দুটো। শশী বিস্ময়ে চোখ ডলা দিয়ে আবারো তাকায়। তবে সে যা দেখেছে ফের সেটাই দেখছে। শশী’র অবস্থা দেখে পরশ মুচকি মুচকি হাসে। চোখ দিয়ে ইশারা করে স্বাভাবিক হতে বলে। তাহমিনা আক্তার মেয়েকে দেখে হাসিমুখে ড্রয়িংরুমে এনে বসায়। শশী ভদ্র মেয়ের মতো সবাইকে সালাম দিয়ে বাবা’র পাশে বসে। আনোয়ার নওয়াজ আর মরিয়ম নওয়াজ শশী কে দেখে খুবই পছন্দ করেন। সেজন্য আনোয়ার নওয়াজ সুলাইমান সাহেব কে বলেন,
“- ভাই সাহেব আমরা আর দেড়ি করতে চাইছি না। আজকেই আমরা শশী মা কে আমাদের বাসায় নিয়ে যেতে চাই।
একথা শুনে শশী অবাক হয়ে বাবা মা য়ের দিকে তাকায়। সুলাইমান সাহেব মেয়েকে আস্বস্ত করেন। সুলাইমান সাহেব রাজি হয়ে যান। অনেক ইচ্ছা থাকলেও তিনি ছোটো মেয়েকে ধুমধাম করে বিয়ে দিতে পারবেন না। কেননা তার বড়ো মেয়েটা যে নেই। যে মেয়ে ছোটো বোনের বিয়ে নিয়ে অনেক বেশি এক্সাইটেড ছিল। তার অনুপস্থিতিতে কিভাবে পারবেন? শশীও তার বাবা কে আগে থেকে বলেছিল তার বিয়ে টা যেন ঘরোয়া ভাবেই হয়।
********
পরশ আর শশী কে আলাদা কথা বলার জন্য সুযোগ করে দেয় সবাই৷ পরশের সাথে শান্ত আর শশী’র সাথে ঊর্মি। ছাদে পাশাপাশি দাড়িয়ে আছে পরশ শশী। আর শান্ত আর ঊর্মি চিলেকোঠার দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।
শশী অবাক হয়ে পরশ কে জিজ্ঞেস করে,
“- এসব কি পরশ? আমি তো এর আগামাতা কিছুই জানি না। আমাকে একবার জানার প্রয়োজন বোধটুকুও করলে না? অভিমান নিয়ে বলে।
পরশ মুচকি হেসে জবাব দেয়,
“- সারপ্রাইজ চাঁদ! তোমাকে তো বলেছিলাম তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে। এখন যদি বলো আমি কিছু বলিনি তাহলে বলব এতে আমার কোনো দোষ নেই৷
পরশের কথা’য় হেঁসে ওঠে শশী৷ তবে পরক্ষণে দু-চোখে অশ্রু এসে জমা হয়। প্রেয়সীর চোখে পানি দেখে বুক কেঁপে ওঠে পরশের। এগিয়ে এসে শশী’র চোখের পানি মুছিয়ে বলে,
“- কাঁদছো কেন চাঁদ। আজ তো আমাদের খুশির দিন। আজ আমাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে? তুমি খুশি হওনি।
শশী ডুকরে কেঁদে ওঠে বলে,
“- বড়ো আপাই এর কথা খুব মনে পড়ছে পরশ। আপুর খুব ইচ্ছা ছিল আমার বিয়ে নিয়ে। অথচ আজ,,,, আর বলতে পারে না শশী কেঁদে ওঠে।
শশী’র কষ্টটা যে আর কেউ বুঝবে না৷ বড়ো বোন মানে যে কি সেটা যার আছে সেই বুঝে। আর থেকেও যা হারিয়ে যায় সেটা সহ্য করা যে খুব কঠিন।
পরশ শশী কে বুকের সাথে চেপে ধরে সান্ত্বনা দেয়। কয়েক মিনিট পর শান্ত আর ঊর্মি এসে বলে,
“- বাহ্! বাহ্ কি প্রেম! পরশ শশী দু’জনে ছিটকে দুরে সরে দাঁড়ায়। শশী চোখের পানি মুছে নেয়। শশী কথা ঘুরানোর জন্য বলে,
“- পরশ এই ছেলেটা তোমার কে হয়? শান্তর দিকে আঙুল তাক করে?
শশী’র কথা’য় শান্ত শুকনো ঢোক গিলে। সে ভাবছিল শশী হয়তো কোনো রিয়াক্ট করবে না। কিন্তু তার ধারনা টা ভুল প্রনাণিত হলো।
পরশ শান্ত র দিকে তাকিয়ে শয়তানি হেঁসে বলে,
“- আমার ছোটো ভাই। তোমার একমাত্র দেবর।
শশী ভ্রু কুচকে শান্তর দিকে তাকিয়ে ঊর্মির দিকে তাকায়। ঊর্মি মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
শশী স্বাভাবিক ভাবে বলে,
“- দেবর মশাইইই।
শান্ত লাফ দিয়ে ভাইয়ের পিছনে দাঁড়িয়ে বলে,
“- জ্ব- জ্বি ভাবি৷
“- ভালো আছো?
শশী’র কথা’য় হেঁসে ওঠে পরশ। পরশকে হাসতে দেখে শশী রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
“- হাসছো কেন? হাসার মতো কি বলেছি।
পরশ মুখ গোমড়া করে বলে, কিছু না। তুমি কন্টিনিউ করো? বলে চুপ করে দাঁড়ায়।
শশী বাঁকা হেঁসে ঊর্মির দিকে তাকিয়ে বলে,
“- ঊর্মি বেবি কাল রাতে কি বলছিলে আমায়?
ঊর্মি মুখ ছোট করে বলে,
“- কি বলছিলাম?
“- ভুলে গেলি। প্রবলেম নেই আমার ব্রেন খুবই স্ট্রং। আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি। তুই কাল রাতে আমাকে বলছি ফারদার যদি সেই ছেলেটার সাথে দেখা হয়ে যায় ভাগ্য ক্রমে তাহলে তুই তাকে গুনে গুনে চারটা থাপ্পড় মারবি।
শশী’র কথা’য় শান্ত পরশ চোখ বড়বড় করে তাকায়। শশী আবার বলে,
“- সেই ছেলেটা যে তোর সামনেই আছে এবার ফটাফট চারটা থাপ্পড় মেরে দেখিয়ে দাও তো সোনাাা।
ঊর্মি আমতাআমতা করে বলে,
“- ছেলেটা তোর দেবর শশী।
শশী ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে,
“- সেজন্যই তো থাপ্পড় টা তোকে মারতে বলছি। আমার দেবর না হইলে আমিই মারতাম কি বলো দেবর মশাইই।
শান্ত ইনোসেন্ট ফেস করে বলে, ভাবি ও ভাবি মাফ করো। আমি মজা করে করছিলাম। জীবনে আর কোনো দিন মজা করব না প্রমিজ। শশী ঊর্মি বলে জোরে ডাক দেয়। ঊর্মি শান্ত র কাছে এগিয়ে এসে বলে, মাফ করবেন। আমি ইচ্ছে করে কিছু করছি না। এতে আমার কোনো দোষ নেই বলে থাপ্পড় দিতে গেলে শশী স্টপ বলে চেচিয়ে ওঠে। তারপর বলে,
“- তোর এত বড়ো সাহস আমার সামনে আমার দেবর কে থাপ্পড় মারিস?
শশী’র কথা’য় সবাই যেন আকাশ থেকে পড়ল। তিনজনে চোখ বড়বড় করে তাকায়। সবার তাকানো দেখে শশী উচ্চস্বরে হেঁসে ওঠে। শশী’র হাসি দেখে বাকি তিনজনেও হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে চারজনে নিচে নেমে আসে ।
________________
রাত এগারোটা। বাসর ঘরে বসে আছে শশী। অনেক্ক্ষণ ধরে ঘোমটা দিয়ে বসে থাকায় গরমে ঘেমে গেছে। ফ্যান চলছে তবুও যেন তার যেন একটু বেশিই গরম লাগছে। তখনই রুমে আসে পরশ। শশী খাট থেকে নেমে সালাম না করে পরশের বুকে মাথা রেখে বলে,
“- সালাম টা তো করতে দিতে না। তাই তুমি যেটা করতে সেটা আমিই করে নিলাম। বলে হেঁসে ওঠে সাথে পরশও।
অতঃপর দু’জন ফ্রেশ হয়ে বেলকনিতে বসে। শশী পরশের কাঁধে মাথা দিয়ে বসে আছে। আর পরশ শশীর মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে। তখন পরশ বলে,
“- চাঁদ।
শশী উহু বলে সায় দেয়। পরশ আবার বলে,
“- দেখতে দেখতে কতগুলো দিন কেটে গেলো তাই না। তোমার মনে আছে আমার আর তোমার কোথায়,কবে দেখা হয়েছিল?
শশী হালকা হেঁসে বলে,
“- মনে থাকবে না এটা কি কখনো হয়। আজ থেকে কয়েকবছর আগে আমি সদ্য ভার্সিটির স্টুডেন্ট। হঠাৎ একদিন ক্লাস শেষ করে রুম থেকে বেড়িয়ে আসি আর তখনই দমকা ঝড় শুরু হয়। তারপর আচমকা বৃষ্টি, আমি দৌড়ে যাচ্ছিলাম ঠিক তখনই তোমার সাথে আমার ধাক্কা লাগে। ভাগ্য ক্রমে নিচে পড়ি নাই বেঁচে গিছিলাম। তখন তোমার সাথে কি ঝগড়া টায় না করছিলাম।
“- হ্যাঁ হ্যাঁ এত কিছু মনে আছে আর এটা মনে নেই।
“- কোনটা অবাক হয়ে বলে।
পরশ ঠোঁটের কোণে চওড়া হাসি নিয়ে বলে,
“- তখন ছিল নতুন বছর। সবে চৈত্র মাস শেষ হয়ে বৈশাখ মাসে পা দিছিল। মাসের শেষে বৃষ্টি কি সুন্দর একটা মুহূর্ত। সেদিন বাসায় ফিরে বারবার শুধু তোমার চেহারা ভেসে উঠছিল। সেজন্যই তো তোমার আমার প্রেম কাহিনির নাম দিয়েছি ❝ চৈত্রের শেষে বৃষ্টি ❞ সুন্দর না বলো?
শশী আনন্দিত হয়ে পরশের গলা জড়িয়ে ধরে একটা চুমো দিয়ে বলে,
“- খুব সুন্দর নাম পরশ। আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমাদের যখন বাচ্চা হবে তখন তাদের বলব, জানিস তোদের বাবা মা’য়ের প্রেমের নাম ছিল ❝ চৈত্রের শেষে বৃষ্টি ❞। সহসা তখনই আকাশে বিদ্যুৎ চমকায় ওঠে। চারপাশে বাতাস বইতে শুরু করে। অতঃপর ঝুপঝাপ করে বৃষ্টি পড়া শুরু করে। পরশ আর শশী একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠে বলে, ❝ চৈত্রের শেষে বৃষ্টি ❞ । নতুন বছরে আমাদের ভালোবাসা পূর্নতা পেলো। আমাদের মতো সবাই যেন তাদের ভালোবাসার মানুষ কে পায়। এভাবেই সব ভালোবাসা পূর্নতা পাক।
[ সমাপ্ত ]