চৈত্র শেষে পর্ব-১৪

0
106

#চৈত্র_শেষে
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ১৪

ভ্যাপসা গরম। তপ্ত গরমে গায়ের ঘাম ঝরে ঝরে পড়ছে।চারদিকে নাজেহাল অবস্থা। ভাদ্র মাস শেষ হলো বুঝি। গ্রামের লোকদের কথা অনুসারে চৈত্র মাস বসন্তের মাস হলেও এতে গরম আরো বেশি পড়ে। অনুর মনে হয়, গাছগাছালীর ঝরে যাওয়া পাতাগুলোর জন্যই হয়ত এমন গা জ্ব’লে যাওয়ার মতো গরম। যেন নতুন পাতার সঙ্গে ঝরে পড়া পাতাগুলোর বিরহবিচ্ছেদ। কেমন একটা রুক্ষ রুক্ষ ভাব!
অগোছালো মন নিয়ে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে অনু। সামনের মাস থেকে অনুর ক্লাস শুরু। ছোট মামার বিয়ের তারিখ একমাস পিছিয়ে আনা হয়েছে। গুনে গুনে আজ দুইমাস শেষ অনুর। নানুরবাড়িতে সবাই কমবেশি চলে এসেছে। অনুও এসেছে সকালে। আনিস মিয়া মেয়েকে দিয়েই চলে গিয়েছে।
অনু বাঁধা দিয়েছিল কিন্তু আনিস মিয়া চলে গেল। এতো এতো পরিচিত মানুষের মাঝে অনুর নিজেকে অপরিচিত মনে হচ্ছে। সে কিছুতেই আসতে চায়নি। এতবছর পরে সবার মুখোমুখি হবে। তাওবা একটা অপ্রীতিকর অবস্থায়। যা ভাবতেই অনুর অস্বস্তি হচ্ছে। বাবা চলে যাওয়াতে তার মন আরো খারাপ হয়ে গেল।
সে জানালার পর্দা টেনে দিয়ে বিছানায় এসে শুয়ে রইল। পাশের রুম থেকে সবার উচ্চস্বরে হাসির আওয়াজ আসছে। অনুর আগে এসব ভালো লাগলেও এখন অস্বস্তি লাগে। তার মনে হয়, সে গেলে সবাই তার অতীত টেনে কথা বলবে। এতে আড্ডার মূল খুশিটা আড়াল হয়ে যাবে। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অনু যায়নি। মূলত তার মনে হচ্ছে সবার মাঝে সে কেমন যেন অপরিচিত হয়ে গিয়েছে।
অনু চোখ বন্ধ করে নিল। চিরচেনা সেই প্ৰিয় জায়গাটাকে আজ এতো অচেনা কেন মনে হচ্ছে! অনু বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে উঠল। সে এতটা আলাদা কীভাবে হয়ে গেল! আজ মনে হচ্ছে তার কেউ নেই। সে একা। চারদিকে তৈ তৈ স্রোতের মধ্যে সে বিপরীতে একা দাঁড়িয়ে আছে। তার ফুঁপানো বেড়েই চলছে। আজ কেউ এসে তার মাথায় হাত রাখলো না।
অনু ঐভাবেই চোখ বন্ধ করে নিল।

বেশ কিছুক্ষন পরে কারোর কণ্ঠস্বর পেয়ে অনু চোখ খুলে তাকালো।
“অনু মা?”
অনু ঝাঁপসা চোখে তাকালো। সালিহা আন্টি দাঁড়িয়ে আছে। অনু উঠে বসলো।
“এভাবে বিকালে শুয়ে আছিস কেন? কী হয়েছে তোর?”
বলেই সালিহা বেগম তড়িঘড়ি করে রুমের বাতি জ্বালিয়ে দিলেন।
অনু উঠে বসে শুধালো,
“ও কিছু না। লাইট না দিয়ে জানালা টেনে দাও। আলো আসবে আন্টি।”
“সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে রে। এখন আর বাইর থেকে আলো আসবে না।”
অনু খাট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।
“তুমি কখন আসলে আন্টি?”

“এইতো বিকেল নাগাদ আসলাম। তুই আসছিস জেনে দেখতে এলাম। আগেও একবার এসেছিলাম। তখন মনে হয় ঘুমিয়ে ছিলি তাই ডাকিনি। একা একা শুয়ে আছিস কেন? আয় সবার সাথে বসে হাসি ঠাট্টা করবি। মন ভালো থাকবে।”
বলতে বলতেই তিনি এগিয়ে এসে গালে হাত রাখতে গিয়েই চমকে তাকালেন,
“সে কি! তোর গা গরম কেন? জ্বর উঠলো না কি! তুই আমাদের ডাকবি না?”

“ও কিছু না আন্টি। একটু গরম পড়ছে তাই গায়ের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়েছে। তুমি ব্যস্ত হয়ো না। তুমি যাও। আমি আসছি।”

“ও কিছু না মানে? তুই আমাদের বলবি না? এভাবে একা মন বিষণ্ণ করে থাকলে হয়? এভাবে থাকলে তো আরো মন খারাপ লাগবে। আয় কিছু খেয়ে ওষুধ খেয়ে নিবি। তারপর সবার সাথে বসবি।” বলেই তিনি এগিয়ে গেলেন।
অনু খোলা চুলগুলো হাতখোপা করে নিয়ে উড়না গায়ে ভালোমতো জড়িয়ে সালিহা আন্টির পেছনে পেছনে বেরিয়ে আসলো।
এই একটা মানুষকে দেখলে অনুর নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে। মায়ের একদম মমতা মিশ্রিত আচরণগুলো এই মানুষটি বেশি করে। মা যাওয়ার পর থেকে এই একটা মানুষকে দেখেই তো অনু নিজের মায়ের মমতা অনুধাবন করতে পারে।

অনু বেরিয়ে আসতেই দেখলো সবাই হাতে হাতে কাজ করে করে রান্নার তোড়জোড় চালাচ্ছে। অনু এগিয়ে গিয়ে নিজেও কাজে হাত লাগানোর চেষ্ঠা করলো। কিন্তু সবার বারণে আর পারলো না।
সালিহা আন্টি যুথিকে ডাক দিলেন। যুথি আসতেই তিনি জানালেন,
“যা তোর অনু আপুকেও ছাদে নিয়ে যা।”
যুথি এসে অনুকে ডাকতেই অনু পিছু পিছু এগিয়ে গেল। খেয়াল করলো, যুথি আর আগের মতো তাকে অতটাও মায়া করে না। যুথি অনুর তিনবছরের ছোট। মেয়েটাও এখন বড়ো হয়ে গিয়েছে। ভারী মিষ্টি চেহারা। আগে মেয়েটা একটুখানি ছিল। তখন অনু আসলে সারাদিন “অনু আপু” করে করে পিছনে ঘুরঘুর করতো। অথচ এখন! বড়ো হওয়ার সাথে সাথে সব পাল্টে গিয়েছে।
অনু হাসলো। পাল্টাবে না কেন! সে নিজেও তো পাল্টিয়েছে! আর মাঝখানে এতগুলো বছর পেরিয়ে গেছে। সবার আচরণ তো বদলাবেই।
যুথি চুপচাপ সিঁড়ির একেকটা ধাপ এগোচ্ছে। আর বারবার পেছনে ফিরে ফিরে অনুর দিকে তাকাচ্ছে। যেন একটু তাড়াহুড়ো করে গেলেই অনু ধমক দিবে। যুথির কর্মকান্ডে মনে হচ্ছে ও অনুকে ভয় বা সংকোচ করছে। অনু মেলার চেষ্টা করলো।
সে যুথির পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। একসাথে সিঁড়ির ধাপে ধাপে পা মিলিয়ে পা বাড়ালো।
“যুথি তুই এখন কিসে পড়িস?”

“মাধ্যমিক দিয়েছি। কলেজে ভর্তি হয়েছি।”

“বাহ্ খুব বড়ো হয়ে গেলি তো! তোর মনে আছে? আমি যখন শেষবার এসেছিলাম তখন তুই মাত্র পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ছিলি। সারাদিন অনু আপু করে করে পেছনে ঘুরঘুর করতিস। আর এখন পুরোই পাল্টে গিয়েছিস।”

যুথি হাসলো। হেসে শুধালো,
“তুমিও তো পাল্টিয়েছো আপু। সেইভাবে আমাদের সাথে আর মিশছো না।”
অনু হাসলো। হেসে শুধালো, “এইতো মিশলাম।”

“তুমি না অন্যরকম হয়ে গিয়েছো আপু!”

অনু হাসলো।
যুথি আবারো বলল, “আগের মতো আর নেই। তোমাকে কেমন জানি লাগে। মনে হচ্ছে তুমি সেই নও। সেই অনু আপু নও।”

“হয়ত।”
বলতে বলতেই অনু ছাদে পৌছালো।
পৌঁছে দেখলো সবাই জড়ো হয়ে বসে আছে। গোল হয়ে হয়ত আড্ডা দিচ্ছে। অনু হাসলো। আগে এরকম আড্ডায় তার কী যে ভালো লাগতো। নিমিষেই মিশে যেত কিন্তু আজ! আজ সবাই আড্ডাতে আছে শুধু অনুই ছিল না।
অনু এগিয়ে গেল। সবার দৃষ্টি অনুর দিকে। রিমা অনুর দিকে তাকিয়ে আছে। আগে কাজিনদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রিমার সাথে সম্পর্ক ভালো ছিল। মাত্র একবছরের বড়ো ছিল রিমা। সমবয়সীর মতো থাকতো ওরা। অনু তো রিমা আপু বলতেই পা’গ’ল ছিল। অথচ আজ চাইলেও ঐভাবে করে আর কথা বলা হয়নি। সম্পর্কটা কেমন জানি আলগা হয়ে গিয়েছে! রিমা এখন ঢাকাতে নামকরা এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। অথচ তখন থেকে অনু বলতো, উচ্চমাধ্যমিক শেষে রিমা আপুর সাথেই একসাথে তারা পড়বে। একসাথে সব করবে। অথচ এখন মাঝখানে কত ফাটল!
অনু যেতেই সবাই আড্ডা থামিয়ে অনুর দিকে এক ফলক তাকালো। সবার দৃষ্টি অনুর দিকে পড়তেই তাকে অস্বস্তি ঘিরে ধরলো।
এমন না যে অনু সবার বড়ো। এখানে বড়ো রিমা আপুও আছে কিন্তু অনুকে দেখেই সবাই অদ্ভুত করে তাকিয়ে আছে।
অনু হাসলো, “কেমন আছো তোমরা?”

অনুর দৃষ্টি রিমার দিকে পড়তেই সে নজর সরিয়ে ফেলল। অনু এগিয়ে গেল। বাবা বলেছিল, মানুষের কাছ থেকে সরে সরে থাকলে সম্পর্ক আরো আড়ালে ঢেকে যায়। কিন্তু অনু চায় না সম্পর্কটা আর আড়াল হোক। সেই পুরোনো সুন্দর সম্পর্কটা সে ফিরে আনতে চায়।
সে এগিয়ে তার একসময়ের প্ৰিয় রিমা আপুর পাশে গিয়ে বসলো।
রিমা সরে বসলো।
“কথা বলবে না আমার সাথে?” অনুর কথায় রিমার যেন অভিমান সব ঝরে পড়লো। সে অভিমানী সুরে শুধালো,
“তোর কী মনে ছিল আর আমাকে?”

“ওমা তোমাদের ভুলি কী করে!”

“তাহলে এতবছর থাকলি কীভাবে কোনো যোগাযোগ ছাড়া? সেই দিনগুলো এতো সহজে ভুলে গেলি?”

“ভুললে কী আসতাম? এখন এখানে এসে তোমাদের সাথে বসতাম?”
অনুর কথায় সবাই কমবেশি অনুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। সেই আগের কাজিনমহলটা যেন ফিরে আসলো।
সবাই আবারো আগের মতো মিশে গেল। কিন্তু অনুর মুখ থেকে হাসি সরে গেল।

“আচ্ছা সাহিল ভাইয়া এসেছে তো অনেকক্ষন হলো। উনি এখন আর আগের মতো আড্ডায় বসে না কেন?” মিরা জিজ্ঞেস করতেই অনু তাকালো। তার মন কিছু ভাবতে নিতেই সে ভাবনা সরিয়ে ফেলল। আর কোনো পাপী সে হবে না।

“সাহিল ভাইয়া এখানে নানুরবাড়ি এসেছে এই ঢের। আড্ডার কথা বাদ দেয়। দেখা পেয়েছিস এই অনেক। ব্যস্ত মানুষ বলে কথা।” রিমার কথায় সবাই মাথা নাড়লো।
“আসলেই কত বড়ো ডাক্তার। সানিধ্য পেয়েছি এটাই শুকরিয়া।”

“সাহিল ভাইয়া ডাক্তার?” অনুর কথায় সবাই যেন ভুত দেখার মতো চমকে তাকালো।
“কী বলো? তুমি জানো না? আমাদের সাহিল ভাইয়া এখন বড়ো নামকরা ডাক্তার। বাহির থেকে স্কলারশিপে ডাক্তারি পড়ে এসেছে।”
অনুর মন আরো খারাপ হয়ে গেল। সবাই ভালো ভালো পজিশনে চলে গিয়েছে খালি অনুই পিছনে পড়ে ছিল। অনু ছোট করে “অহ।” উচ্চারণ করলো।

আড্ডা শেষে রিমা অনুকে নিয়ে এলো।
“আমার সাথে থাকবি তুই।”
অনু হ্যাঁ বোধক মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। কিন্তু মন থেকে তার ইচ্ছেটা নেই। অথচ আগে অনু নিজেই সেধে রিমার কাছে আসতো। সেধেই আগে থেকে বলে রাখতো যাতে তার পাশে অনুর জায়গা রাখে আর আজ!

“আচ্ছা অনু তুই এমন হয়ে গেলি ক্যান? মনে হচ্ছে তুই সেই চঞ্চল অনু নস।”

“সময়ের সাথে সাথে কত কিছুই তো পাল্টে যায় আপু।”

“তোর কথা এখন রহস্যজনক লাগে। এখন ঘুমা। কাল কথা হবে।” বলেই রিমা পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো।
রিমা ঘুমিয়ে গেলেও অনু ঘুমাতে পারলো না। তার ছটপট লেগে উঠল। হুট্ করে দমবন্ধ লাগছে। এই অভ্যাসটা আগে ছিলো না, ইদানিং সব আগের অভ্যাসগুলো ফিরে ফিরে আসছে।
অনু রাতের আঁধারে ছাদে উঠে গেল। গভীর রাতে ঠান্ডা হাওয়ায় সে দেয়ালের কিনার ঘেঁষে দাঁড়ালো। বেশ কিছুক্ষন পরে ছাদে কারোর পদচারণ বুঝতে পেরে অনুর ভয় অনুভব হলো। সে ওখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।

“অনুপমা?”
অনু চমকে উঠল। কতগুলো বছর পরে সম্পূর্ণ নাম! এই পুরোনামে তো শুধু একজনেই ডাকে। সে দ্রুত ফিরে তাকাতেই আঁধারের মাঝে সেই ছায়া পেল। যে ছায়ার জন্য একটা সময় সারাদিন অপেক্ষায় থাকতো। অনুর মনের কোথাও জানি ধক করে উঠলো। খোলা মৃদু বাতাসের মাঝে হুট্ করেই তার শীত শীত অনুভূতি হলো।

#চলবে ইন শা আল্লাহ