চৈত্র শেষে পর্ব-১৭

0
118

#চৈত্র_শেষে
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ১৭

অনুর ঠান্ডা অনুভূতি হচ্ছে। ঘুমের মাঝেই তার কাঁপাকাঁপি ছুটলো। চোখ বন্ধ অবস্থায় অনু বুঝতে পারলো বেলা বেড়েছে। রিমা অনেক আগেই উঠে রুম থেকে বেরিয়ে গেছে। বেরিয়ে যাওয়ার আগে বার দুয়েক ডাকলো। কিন্তু অনু তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল। রিমা মনে করলো, হয়ত আরেকটু ঘুমাবে তাই সে আর বিরক্ত করেনি। বেরিয়ে গেল।
এভাবেই বেশ কিছুক্ষন হলো। বেলা বেড়েছে। গ্রামে বেলা বাড়ার সাথে সাথে সূর্যের আলোর সাথে সাথে সবার একেক কাজের প্রতিযোগিতা বেড়ে যায়। তার উপর আজ ছোট মামার বিয়ের জন্য সবাই শপিং এ যাবে।
রিমা দৌড়ে এলো। এসে অনুকে ডাকলো,
“এই অনু উঠ। তৈরী হয়ে নেয়। শপিং এ যাবি না?”

অনু চোখ খুলে তাকালো। তার ইচ্ছে নেই কোথাও যাওয়ার। ভোরে হেঁটে এসে পা ব্যথা করছে ভীষণ। এখন আবার শপিং এ গেলে পা ব্যথা আরো বেড়ে যাবে। মেয়েদের শপিং কী জিনিস তা অনু ভালো মতোই জানে। কারণ সেও আগে একই কাজ করতো। এখন আর ভালো লাগে না। সময়ের সাথে সাথে শপিং করার তৃষ্ণাটা তার হারিয়ে গিয়েছে।
অনু উঠে বসলো। ভোরে সাহিল ভাইয়ের সাথে হেঁটে এসে দেখে তখনো কেউ উঠেনি। আর তখন সবেমাত্র ছটা। অনু বিরক্ত হয়ে রিমার পাশে শুয়েছিল। কোন সময় চোখ লেগে এসেছিল টেরই পায়নি।
“অনু?”

রিমার ডাকে অনু তাকালো।
“তৈরী হয়ে নেয়। আজ ছোট মামা সবাইকে শপিং করে দিবে। তুইও চল।”

“আমার ভালো লাগছে না আপু। আমি না যাই?”

“সে কী! কেন যাবি না? সবাই যাবে। তুই একা থাকবি?”

“না আপু। আমি থাকতে পারবো। তোমরা যাও।”
রিমা বেরিয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষন পরে সালিহা আন্টি আর ছোট মামা ফিরে এলো।

“কিরে? যাবি না কেন?”

ছোট মামার এহেন কথায় অনু জবাব দিতে পারলো না। সে ছোট করে জানালো,
“এমনি মামা।”

“এমনি কেন? তোর মামীকে দেখার ইচ্ছে নেই?”

“সে তো পরশু বিয়ের দিন দেখতে পারবো।”

“তাই বলে আজ একা থাকবি?”

“দেখি শরীর খারাপ হলো না কি!” বলেই সালিহা বেগম এসে কপালে হাত দিলেন।
“কই শরীর তো ঠান্ডা। তাহলে যাচ্ছিস না ক্যান?”

“এমনি আন্টি।”

“থাকতে পারবি?”

“হ্যাঁ পারবো।”
সালিহা বেগম ভরসা করতে পারলেন না। তিনি ভাইয়ের উদ্দেশ্যে জানালেন,
“আমি বরং না যাই। অনু একা।”

অনু বাঁধ সাধলো।
“আরে আন্টি যাও তুমি। আমি থাকতে পারবো।”

“পারবি?”

“হ্যাঁ।”
“দেখিস। কিছু লাগলে কল দিস।”

“ঠিক আছে।”
ওরা চল গেল। অনু দরজা বন্ধ করে ছাদে উঠে গেল। ছাদে উঠে সে বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইল। এই ছাদ, এই শেউলা ভরা রঙসটে ছাদ, এই কাঁঠালগাছ। এই ভরা বাড়ি। তার কতই না পরিচিত! তবে আজ কেন সব অপরিচিত লাগছে! কেন!
অনুর শিরশিরে অনুভূতি হতেই সে নিচে নেমে এলো। রুমে এসে খাটে শুয়ে বেশ কিছুক্ষন চোখ বন্ধ করে রইল। ধ্যান ভাঙলো দরজার আওয়াজে।
অনুর মনে হলো কেউ বাইর থেকে তালা খুলছে। কিন্তু চাবি তো শুধু অনু আর আন্টিদের কাছে আছে। তবে কে আসবে! ওরা কী ফিরে এলো! কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি কীভাবে ফিরবে! না কি ঘর একা পেয়ে কেউ আসছে! চোর নয় তো! হতে পারে! এই গ্রামে নানুদের বাড়ি অনেক বড়ো বাড়ি। আগেও এমন অনেক বার হয়েছে।
অনুর ভয় লাগলো। সে এদিক ওদিক খুঁজে একটা লা’ঠি পেল। লা’ঠি নিয়ে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। হুট্ করে দরজা খুলতেই কারোর সাথে ধাক্কা খেয়ে মেঝেতে পড়ে গেল। অনু বুঝে উঠতে পারেনি। এতো তাড়াতাড়ি চো’র তালা ভাঙতে পারে!

“আরে অনুপমা তুমি?”

অনু থমকালো। সাহিল ভাই! উনি এখানে!

সে চোখ তুলে তাকালো। অনু অপর হাতে থাকা লা’ঠিটা উড়না দিয়ে আড়াল করার চেষ্ঠা করলো। সাহিল হেসে দিল।
এই প্রথম গম্ভীর মুখশ্রীতে হাসি দেখেছে অনু। আগে এই হাসিটার জন্য অনু কতই না তৃষ্ণার্ত হতো আর আজ!

“অনুপমা! তুমি লা’ঠি নিয়ে ঘুরছো? আর ওটা আড়াল করছো কেন? আমি তো দেখে নিয়েছি।”

অনু এবার হাসির কারণ বুঝতে পারলো।
সে হাত মুছে উঠে দাঁড়ালো। হাত দুটোতে ব্যথা লেগেছে ভালোই। সে আমতা আমতা করে বোঝানোর চেষ্টা করলো,
“ওটা এমনি নিলাম।”

“এমনি ঘরে কেউ লাঠি নিয়ে ঘুরে জানা ছিলো না তো।”

অনুর লজ্জা লাগলো। সে লজ্জা আড়াল করার চেষ্টায় শুধালো,
“জানেন না যখন জেনে নিন। লা’ঠি নিয়ে ঘুরা যায় না বুঝি!”

সাহিল হুট্ করে এগিয়ে এলো। ফিসফিস কণ্ঠে জানালো,
“আমি ভেবেছিলাম তুমি ভীতু ছিলে। এখন নেই। কিন্তু আমি ভুল। তুমি তো দেখি এখনো ভীতুই রয়ে গেলে।”

অনু লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলল। সে কথা ঘুরানোর চেষ্টায় বলল,

“আপনি যাননি মামাদের সাথে?”

“আমি তো অন্য গ্রামের ক্যাম্পে গিয়েছিলাম। ভোরে হেঁটেই বেরিয়ে পড়লাম। তোমার মতো আর ঘুমায়নি। কিছুক্ষন রেস্ট নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়বো।” বলেই প্রস্থান করলো।
অনুর অপমানবোধ হলো। সে মাথা নিচু করে লাঠি ফেলে দিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো।

——–

সালিহা বেগম ফিরে এলেন।
অনু রুম থেকে বেরিয়ে এলো। সালিহা বেগমের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়লো,
“আন্টি তুমি? ”

“হ্যাঁ, তুই একা তাই চলে এলাম।”

“এটা কোনো ব্যাপার না। আমার জন্য তোমরা কেন ভুগবে?”

“তোর মায়ের অস্তিত্ব আমরা তোর মধ্যেই দেখি। তোর জন্য এটা কোনো ভোগা হলো?” বলেই তিনি হাতে থাকা প্যাকেটটা এগিয়ে দিতে দিতে জানালো,
“চল, খেয়ে নিবি।”

“আন্টি সাহিল ভাই আছে। আমি একা কীভাবে খাবো?”

“ও এসেছে? আর ও আসলেও খেয়ে এসেছে। তুই চিন্তা করিস না। তুই খেয়ে নেয়।” বলেই তিনি রুমের দিকে এগিয়ে গেলেন।
অনুও পিছু পিছু এগিয়ে গেল।
“তুই হাতমুখ ধুয়ে আয়।”
অনু হাত ধুয়ে যেতেই দেখে ইতিমধ্যে তিনি প্লেটে খাবার নিয়ে বসে আছে। অনু খেতে বসে পড়লো।

সালিহা বেগম তাকিয়ে রইলেন। অনু খেতে খেতে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।
“আন্টি কিছু বলবে?”

“তুই পুরো তোর মায়ের মতো। তোর মা আর আমি ছিলাম পিঠেপিঠি বয়সের। তখন আমি তোর মাকে কিছু শেয়ার না করে পারতাম না। কোথাও কিছু হলে শুধু পেটের ভেতর সেটাই ঘুরতো। যতক্ষণ না তোর মাকে এসে না বলতাম ততক্ষন শান্তি পেতাম না।”
অনু খেতে খেতে তাকিয়ে শুধালো,
“তো এখন কী কোনো গুরুত্বপূর্ন কথা আছে? পেটে কোনো কথা আছে? ঘুরঘুর করছে?”

“বেশি পাকনামি হয়ে গেছিস।” বলেই উনি সতর্ক দৃষ্টিরে রুমের বাইরে উঁকি দিয়ে ফিসফিস কণ্ঠে জানালো,
“শোন কাউকে বলিস না। আমি একটা সাহিলের জন্য মেয়ে দেখেছি। কী যে মিষ্টি!রূপে গুনে সেরা।”

অনু ভাতের লোকমা দিতে গিয়ে থেমে গেল। লোকমাটা আর ভেতরে ঢুকলো মা। মনে হলো যা খেয়েছে সব যেন গলায় আটকে গিয়েছে।

“কিরে! কী ভাবছিস?”

অনু নিজেকে সামলাল। সে কেন ভেঙে পড়বে! এটা তো হওয়ারই কথা। সবারই তো এগিয়ে যেতে হবে। যেমনটা সে নিজেও যাচ্ছে।

“বল।” সালিহা বেগম উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে।
“সাহিল ভাই জানে?”

“ও তো গত দুইবছর ধরে ঘুরাচ্ছে। এবার আর কোনো জিজ্ঞেস করা হবে না। জিজ্ঞেস করলে সে কথা ঘুরায়। এইবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি,সোজা মেয়ে নিয়ে হাজির হবো। পাকা করে ফেলবো। তারপর জানাবো।”
বলেই তিনি মোবাইলে থাকা একটা ছবি অনুর দিকে এগিয়ে দিলেন,
“দেখ দেখ কী সুন্দর মেয়ে! ওরা তো এক পায়ে রাজি। আমার সাহিলের মতো ছেলে আছে না কি!”

অনু তাকালো। ভারী মিষ্টি! এমন মেয়েই তো সাহিল ভাইয়ের সাথে মানাবে। তবু কোথাও জানি অনুর খারাপ লাগা কাজ করছে। এটা আর ক’দিন আগে হলে এমন খারাপ লাগতো না।

“ভারী সুন্দর। একদম মানাবে।” বলতে বলতেই অনুর চোখ ঝাঁপসা হয়ে এলো।

বিকেল গড়াতেই অনুর গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো। একরকম বাড়াবাড়ির জ্বর। অনু জানে এই জ্বরের কারণ। তার হুট্ করে কান্না পেয়ে গেল। সবাই এটা ওটার কথা বললেও অনু মানলো না। সে বুঝতে পারলো, তার এখানে থাকা চলবে না। এখন একমাত্র বাবার কাছে ফিরে গেলেই সে ভালো থাকবে। অনু মোবাইল হাতড়ে আনিস মিয়াকে কল লাগালো। যেভাবেই হোক ওকে এখান থেকে বিদায় নিতে হবে।

#চলবে ইন শা আল্লাহ।