#চৈত্র_শেষে
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ২১(অন্তিম পর্ব )
গ্রামের একদম শুরুর বাড়ি। সূর্যের তির্যক তেজ যেন দুপুরের সময়টা জানান দিচ্ছে। ঘামে জর্জরিত মানুষ এগিয়ে চলেছে গ্রামের শুরুতে আনিস মিয়ার বাড়িতে। সাহিল গাড়ি থেকে নেমেই দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল। সেই বহুল প্রত্যাশীত বাড়িটির দিকে। কিন্তু আজ আর সেই বাড়ি সুখের নেই। থেমে থেমে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে।
বারান্দায় রাখা আছে এক সাদা কাপনে আবৃত নিথর দেহ। তার পাশেই পাথরের ন্যায় বসে আছে একটা মেয়ে। যে মেয়েকে সাহিল একদিন নিজের রাজ্যের রানী বানাতে চেয়েছিল। সাহিল অনুর এমন অবস্থা মানতে পারলো না। সে ভরসার হাত বাড়িয়ে দিতে পা বাড়াতে গিয়েও থেমে গেল। কিছুক্ষন আগে সে অন্য একজনকে নিজের জীবনের সাথে আবদ্ধ করেছে সেটা মনে পড়তেই সে পিছিয়ে গেল।
—–
“বাবা তুমি এভাবে আমার সাথে থাকবে তো?কথা দাও।”
“দূর পাগলী। মেয়ের কাছে থাকতে হলে আবার কথা দেওয়া লাগবে না কি! আমি সবসময় আছি।”
“তাই যেন হয়।”
“হবে হবে। তুমি শুধু মন দিয়ে পড়াশোনা করে একটা সুন্দর ক্যারিয়ার করো। তারপর বড়ো ডাক্তার হয়ে সবাইকে সেবা দিবে। আমি আছি আমার মেয়ের সাথে। নিজেকে কোনোদিন একা ভাববে না।”
অনু নিথর দেহের সামনে মেঝেতে বসে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সে আপনমনেই আওড়ালো,”তুমি তোমার কথা রাখোনি বাবা। তোমার মেয়ে তোমাকে ছাড়া একমুহূর্তও কল্পনা করেনি। তা জেনেও কীভাবে পারলে কথা ভঙ্গ করতে! এতো স্বার্থপর কবে থেকে হলে বাবা!”
অনু যেন পাথর হয়ে গিয়েছে। আজ আর চোখে পানি ঝরছে না। বাবা বলতো, কষ্ট পেলে মন খুলে কেঁদে নিও। তাহলে মনের বোঝা হাল্কা হয়ে যাবে। তবে সে কেন কাঁদতে পারছে না! অনুর মনে হলো কেউ তার বুঁকের ভেতর যেন পাথর বসিয়ে দিয়েছে!
অনুর মুখ বিড়বিড় করে চলেছে। সে আনিস মিয়ার হাত ধরে বসে রইল। চুল উস্কো ফুস্কো হয়ে আছে। অনুর ইচ্ছে করলো চিৎকারের সহিত জানাতে, “বাবা এ তো কথা ছিল না! তুমি আমার সাথে রয়ে যাবে বলেছিলে। কথা দিয়েছিলে। তবে আজ তোমার কথা কই? তুমি তোমার মেয়েকে দেওয়া কথা রাখতে পারলে না! এ কেমন বাবা তুমি। পুরো দুনিয়ায় আমাকে একা করে চলে গেলে। আমাকে সান্ত্বনা বাণী গুলো কে দিবে বাবা?”
অনু মাথা চেপে ধরলো। নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগছে। সে আপনমনেই পাগলের মতো বিড়বিড় করে কেঁদে উঠলো।
সাহিল অনুর এমন অবস্থা মানতে পারলো না। সে তার অবস্থা ভুলে এগিয়ে গেল। কিন্তু কাছে গিয়ে মেয়েটার মাথায় ভরসার হাত রাখতে গিয়েও রাখতে পারলো না। আজ সে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিসের ভিত্তিতে সে হাত রাখবে!
সালিহা বেগম দৌড়ে এগিয়ে অনুকে বুঁকের সাথে আগলে নিলেন। এমন একটা শুভ দিনে এমন আকস্মিক ঘটনা তিনি মানতে পারছেন না। এমন একটা পরিস্থিতিতে তিনি কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। আরেকদিন আগে হলে হয়ত পরিস্থিতিটা অন্যরকম হতো।
সালিহা বেগমের ভাবনায় কিছু আসতেই তিনি সাহিলের দিকে তাকালেন। ছেলের মন পড়ে তিনি চোখ নামিয়ে নিলেন। সে ব্যর্থ সবকিছু দিয়ে।
——–
সারাদিন পরে রাত গড়িয়ে আসলো। দাফন কার্য শেষ হবার পরে ধীরে ধীরে ঘর খালি হয়ে গেল। সবার দায়িত্ব শেষ। সবাই এখন যার যার স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরে যাবে, শুধু অনুই পারবে না। তার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে একমাত্র যে বাবাই পারে। কিন্তু আজ ভিন্ন। সেই বাবা আজ নেই। অনু কেঁদে উঠল। এই মানুষটাকে ছাড়া সে থাকবে কীভাবে! এমন হবে জানলে অনু কোথাও যেত না। আগেই ডাক্তার দেখিয়ে ফেলতো। সকালে কথা বলতে বলতেই আনিস মিয়ার শ্বাসকষ্ট হুট্ করে বেড়ে গিয়েছিল। নিরাময়ের সবকিছু দিয়েও নিরাময় হয়নি। দ্রুত হাসপাতালে নেয়ার পথেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
অনু কেঁদে উঠল। এতো তাড়াতাড়ি বাবা ছেড়ে গেল সে সেটা বিশ্বাস করতে পারছে না। মনে হচ্ছে, এইতো এই রুমে গেলেই বাবাকে পাবে। কাল সকালে উঠে ছাদে দুইকাপ চা নিয়ে গেলেই আনিস মিয়া সাথে এসে বসবে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে অনুকে উপদেশ দিবে।
অনুর দম বন্ধ হয়ে আসছে যেন। সে হা করে শ্বাস স্বাভাবিক করলো। অনু খোলা আকাশের দিকে তাকাল,’কেন আমাকেও সাথে করে নিয়ে গেলে না বাবা!’
সালিহা বেগম এসে দাঁড়ালেন। অনুকে এমন বসে থাকতে দেখে তার মায়া হলো। তার মনে হচ্ছে সব ব্যর্থ। আগে হলে সাহিলের বিয়ে সে কিছুতেই হতে দিতো না। মেয়েটাকে যে এখন সাথে করে নেওয়াও যাবে না! তিনি এগিয়ে অনুর মাথায় হাত দিলেন।
অনু সালিহা বেগমকে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল। তিনি সময় নিলেন। অনুর কান্নার আওয়াজ কমে এলেই তিনি বলার চেষ্ঠা করলেন,
“মা সাহিলকে একটু বুঝা। সে যেন চলে যায়।”
অনু নীরব রইল। তিনি থেমে আবারো শুধালেন,
“আজকে সবেমাত্র বিয়ে হয়েছে। বিয়ে হয়েই বৌকে একা রেখে সাহিল চলে এসেছিল। এরপর আমরা আসছি। হাজার হোক একটা মেয়ে অনেক স্বপ্ন নিয়ে বিয়ে করে এসেছে। এর মধ্যে সাহিল এখানে রয়ে গেলে কেমন হয়! বিয়ের প্রথম রাত!”
অনু চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো। তার অপরাধবোধ হলো। পরিস্থিতি তো তার খারাপ হয়েছে, আর কারোর তো নয়। তাহলে অন্যরা কেন তার জন্য ভুগবে!
অনু ভাঙা মন নিয়ে উঠানের দিকে এগিয়ে গেল। সাহিল ভাই দাঁড়িয়ে আছে। অনু পেছনে গিয়ে দাঁড়াতেই সাহিল ফিরে তাকালো।
“সাহিল ভাই আপনি চলে যান।”
সাহিল অবাক হলো।
“চলে যেতে বলছো? এভাবে এই পরিস্থিতিতে!”
” একটা মেয়ে আপনার পথ চেয়ে বসে আছে। আপনার উচিত চলে যাওয়া।”
“শুধুই ওই মেয়েটার জন্য?”
“ভালোবাসা অনেক বড়ো। মেয়েটা একটা স্বপ্ন নিয়ে এসেছে আপনার বাড়ি। আপনার এখানে থাকা উচিত হবে না।”
সাহিল তাকালো। সে আর জবাব দিতে পারলো না।
সাহিল অনুর কথা রেখেছে। রাতের অন্ধকারে সে প্রস্থান করলো। আর অনু আঁধারেই সাহিলের যাওয়ার পানে ঝাঁপসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আর কোনোদিন এইভাবে দেখা হবে না। অনু ভেঙে পড়লো। আজ কেউ নেই তার। সম্পূর্ণ একা অনু। বাবাও নেই আজ ভরসা দেওয়ার জন্য।
——-
সময় এগিয়েছে। আজ সাতবছর। অনু সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। সূর্য উঠছে। যেখানে বাবা আর অনু একসাথে বসে চা উপভোগ করতো। মাঝখানে থাকা দুই কাপ চা থেকে অনু এক কাপ চা নিলো। মনে হচ্ছে আনিস মিয়ার জন্যই অপেক্ষায় আছে অন্য কাপটা!
ঠিক যেভাবে অনু এখনো সেই আগের স্থানে বসে আছে সেইভাবে সময়টাতেও আটকে আছে। পাল্টে গেছে সবকিছু। অনু আজ বড়ো ডাক্তার। সেদিন হয়ত সাহিল ভাইয়ের মন বুঝলে আজ জীবনটা অন্যরকম হতো। কোনো আফসোস থাকতো না। সেদিন বাবার বলা কথাটা অনুর মন নাড়িয়ে দিয়েছিলো। আদিত্যর কথা যেদিন অনু আনিস মিয়াকে জানাতে গিয়েছিল সেদিন আনিস মিয়া এসেছিলো আরেকটা কথা বলতে। যেটা খুশিতে অনুর শোনা হয়নি। অনুর খুশিতে দুঃখ দিতে আনিস মিয়া চাননি। তাই তো আর বলেনি। সেদিন সালিহা বেগম ফোন করে জানিয়েছিল, সাহিলের জন্য যাতে অনুকে দেওয়া হয়।বিপরীতে আনিস মিয়া জানিয়েছিল, মেয়ে রাজি কিনা দেখতে হবে। সালিহা বেগম খুশি খুশি কণ্ঠে জানিয়েছিল, রাজি হবে। অনু পছন্দ করে সাহিলকে। সাহিল নিজেই দেশে এসে এ কথা বলেছে। কিন্তু অনুর আদিত্যকে নিয়ে আসা দেখে আনিস মিয়া মেয়েকে দোটানায় ভোগার জন্য আর সাহিলের কথা বলেনি। সেদিন সালিহা বেগমের সাথে একেবারের জন্য যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। যেটার কিছুই অনু জানতো না। আর অনু কিনা ভেবেছিল! সাহিল হয়ত তাকে ভালোইবাসেনি। তাই তো এড়িয়ে বাইরে চলে গিয়েছিল। অনুর ভুলের দায়বার শুধুই তার। অনু হাসলো। পরবর্তীতেও সাহিল ভাই তারই অপেক্ষায় ছিল কিন্তু অনু পাপী হতে চায়নি! অনু অদূরে ঝাঁপসা দৃষ্টিতে তাকালো। মানুষটা সত্যি ছিল কিন্তু সময়টা সঠিক ছিল না।
আদিত্যও ফিরে এসেছিলো। অনুর কাছে মাফ চেয়েছে। রিহির সাথে বনিবনা না হওয়াতে রিহি চলে গিয়েছে। তার বৃদ্ধ মা অসুখে কাতরাচ্ছে। উনার চিকিৎসার ভার অনু নিজের কাঁধে নিয়েছে। আদিত্য ক্ষমা চেয়েছিল যাতে অনু ফিরে যায়। আর আগের মতো নতুন করে সংসার করতে পারে। অনু মাফ করেছে ঠিকই কিন্তু ফিরে যায়নি। আর যাবেও না।
সেদিনের পরে আর সাহিলের সাথে দেখা হয়নি। সে এখন বাইরের দেশে সেটেল। ভালোভাবে সুখী সংসার করছে।
অনু হাসলো। সে আপনমনে বিড়বিড় করে আওড়ালো,
“পুরুষ তার জীবনে আসা দ্বিতীয় নারীটিকেই বেশি ভালোবাসে। কারণ প্রথম নারী হারিয়ে গেলে সে অনুভব করে। পরবর্তীতে সে ভুল শুধরিয়ে পরিস্থিতি বুঝে দ্বিতীয় নারীটিকে সর্বস্ব উৎসর্গ করে ভালোবাসে।”
আর অনু! সে ছিল বরাবরই প্রথম জন। তাই তো হয়ত কপাল এমন লেখাই ছিল! ভেবেছিল চৈত্রের কাঠফাটা রোদ্দুর শেষে বুঝি একফোঁটা বৃষ্টি পাবে কিন্তু তা না হয়ে একেবারে আশার বাইরে খরা অপেক্ষা করতো কে জানতো!
অনু মা!”
অনু ফিরে তাকালো। রাহেলা বেগম দাঁড়িয়ে আছে।
“সকাল থেকে তো কিছুই খাসনি। আই খেয়ে নিবি। কিছুক্ষন পরে রোগী দেখা শুরু করলে আর খাবিই না।”
“তুমি যাও। আমি আসছি।”
“আয়,আমি বাড়ছি।” বলেই রাহেলা বেগম চলে গেলেন। আর অনু অদূরে দৃষ্টি দিল। সময় পাল্টেছে। মানুষের অবস্থাও পাল্টেছে। আজকের অনুকে সবাই পছন্দ করে। এর পেছনে মূল ক্রেডিট শুধুমাত্র বাবার।
বাবার কথায় ঠিক, সমাজে আজ অনুর নাম ডাক অনেক। যারা অনুর একসময় পিঠে পিছে কথা বলতো তারাই আজ অনুকে দোয়ার হাত বাড়িয়ে দেয়। অনুও নিজের মতো করে সেবা দেয়। অনুর চোখ ঝাঁপসা হয়ে এলো। সে ঝাঁপসা দৃষ্টিতে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আপনমনেই বিড়বিড় করে আওড়ালো,’বাবা আমি তোমার কথা রেখেছি। তোমার কথা সত্য, এখন তোমার মেয়ে এই গ্রামের মানুষের মুখ বন্ধ করে দোয়া নিচ্ছে। শুধু তুমিই তোমার কথাটা রাখলে না। আমাকে একা করে দিয়ে চলে গেলে। কেউ নেই আমার। কোথাও কেউ নেই!’
অনু অশ্রুমাখা চোখে অদূরে তাকিয়ে রইল। সূর্য ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছে। চারদিকে আঁধার নেমে আসছে। সাথে অনুর জীবনেও।
#সমাপ্ত