ছদ্মবেশে লুকানো ভালোবাসা পর্ব-১৩

0
1242

#ছদ্মবেশে_লুকানো_ভালোবাসা
#মৌমি_দত্ত
#পর্ব_১৩

– আফিম চল,, কেক কেটে ফেলবি। এরপর ইনায়াত গান ও নাচের ব্যবস্থা করেছে।
জোসেফ হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো। লাবিবা অস্থিরমুখে বললো,,
– কিন্তু ইনায়াত কোথায়?? এতোসব ব্যবস্থা করে মেয়েটা কি নিজেই উধাও হয়ে গেলো??
– ওয়াও ভাবী!!!
লাবিবার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আফরার মুখে ভাবী ডাক শুনে আফিম সহ সবাই সেদিকে তাকালো। নীল রঙ্গের সিল্কের একটা শাড়ি,, সাথে কালো ব্লাউজ ফুল হাতা। ঘন চুলগুলো খোলা। সাজগোজ বলতে আইলাইনার,, লিপস্টিক আর টিপ কিন্তু এতেই অসাধারণ রুপশী লাগছে ইনায়াতকে। আফিমের মুখে হাসি ফুঁটলো তার অজান্তেই। আফিম গিয়ে কেক কাটলো। ইনায়াত আফিমের কাছে গেলো না। আফিম আড়চোখে ইনায়াতকে দেখে নিলো।
– এই মেয়ে আমাকে ইগনোর করছে নাকি আমার কথা মেনে চলছে??
নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলো আফিম। একটা কেক হাতে তুলে নিলো। লাবিবা,, জোসেফ আর আফরাকে খাওয়ালো। কিছু একটা ভেবে এগিয়ে গেলো ইনায়াতের দিকে। আফিমকে নিজের দিকে আসতে দেখে ইনায়াত হাতে টিস্যুর বক্স নিয়ে দাঁড়ালো। আফিম আসতেই টিস্যুর বক্স এগিয়ে দিলো ইনায়াত। আফিম বাম হাতে টিস্যুর বক্সটা নিয়ে কিছু বলতে যাবে ততোক্ষনে ইনায়াত চলে গেছে অন্যদিকে। যাবে নাই বা কেন?? ইনায়াতের স্পষ্ট মনে আছে আফিম তাকে সকালে বলেছে আফিম ইনায়াতের মুখ দেখতে চায় না।
– ঠিক আছ কণা ভালো ছিলো না,, নীলা আপু কষ্ট পেয়েছে একটা মেয়ের জন্য। কিন্তু আফরা আপুও একটা মেয়েই তো। আর আমি তো জাস্ট উনার পিএ। বৌ তো হতে যাচ্ছি না। অদ্ভুত!!
মনে মনে বলতে লাগলো ইনায়াত।
.
.
নিজের বোনকে দেখতে পেয়ে স্পন্দনের মন যেন ভরে গেলো। নিজের রকিং চেয়ারে বসে মৃদু হেসে বললো,, ” আমার বোনু,, আমার আদুরি বোনু “। ডুবে গেলো সুদর্শন যুবকটি অতীতে। বাবা মায়ের ঝগড়া দেখে বড় হয়েছে স্পন্দন আজাদ। বাবা হাবিব আজাদ খুব ভেঙে পড়েছিলেন যেদিন পালিয়ে গেলো তার স্ত্রী মহুয়া আজাদ। মানুষের অপমান আর কথা শুনে বেঁচে থাকার মতো কঠিন কাজ তার দ্বারা সম্ভব না করা। তাই আত্মহত্যা করেছিলেন তিনি। দশ বছরের স্পন্দন তখন থেকে নিজেকে আস্তে আস্তে গড়ে তুলেছে। মাফিয়া লাইফটা তার বোনকে খুঁজে বের করতেই জয়েন হয়েছে। কিন্তু আসলেই সে ভালো একজন হার্ট সার্জন। হুশ ফিরলো স্পন্দনের। মৃদু হেসে বললো,,
– খুব শীঘ্রই আমার পুতুল বোনুটা আমার কাছে ভালোবাসায় আর যত্নে থাকবে। আমি আসছি বোনু।
বাবার প্রতি কোন অভিযোগ নেই স্পন্দনের। আর মায়ের প্রতি অভিযোগ থাকলেও বোনকে সে অনেক ভালোবাসে। কখনো কাছে যাওয়ার সুযোগ না পেলেও আড়ালে অনেকবার দেখেছে আদরের বোনটিকে। ইরশাদ যখন নিজের রুপে চলে এলো। তখন নিজের বোনের আড়ালে থেকে আর কি করবে স্পন্দন?? সেও নিজের আসল রূপ নিয়ে যাবে তার বোনের কাছে। তার বোনটা একদমই মায়ের মতো হয়নি। বাবার ছোঁয়া না পেলেও ইনায়াত যে হাবিব আজাদের মতোই হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই স্পন্দনের।
.
.
পার্টি ভালোই ভালোই শেষ হলো। রাত প্রায় ১২ টা বাজে। আফিম যেন এটাই চাইছিলো। ইনায়াতকে থেকে যেতে বলবে। এতে করে ইনায়াতকে সরি বলা যাবে। কিন্তু আফিমের মুখ দিয়ে সরি তো বের হতেই চায় না!! সব কাজ শেষ করে লাবিবা,, আফরা সোফায় বসলো। ইনায়াত সবাইকে পেমেন্ট করছে। আফিম ডাইনিং টেবিলে বসে কেক খাচ্ছে চামচে তুলে তুলে। অবশ্য কেকের প্রতি কোন মন নেই তার। সে ভাবছে ইনায়াত কখন বের হতে যাবে আর সে আটকাবে। জোসেফ সাহেব ফ্রেশ হয়ে এসে লাবিবার পাশে সোফায় বসলেন। ইনায়াত সব শেষে এগিয়ে আসলো জোসেফ ও লাবিবার কাছে।
– স্যার!! ম্যাম!! আমি আসছি। কালকে অফিসের জন্য চলে আসবো।
জোসেফ আর লাবিবা অবাক হলো খুব। ইনায়াত এখন কেন স্যার বা ম্যাম বলছে?? আফিম উঠে দাঁড়ালো। কোট ঠিক করতে কর‍তে বললো,,,
– ইনায়াত এখন অনেক রাত হয়েছে। তুমি থেকে যেতে পারো।
কোন উত্তর না পেয়ে মাথা তুলে তাকালো সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। আর আশেপাশে কোথাও ইনায়াত নেই। গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার আওয়াজ আসলো। ইনায়াত জোসেফ আর লাবিবাকে কথাটা বলেও দ্রুত পা চালিয়ে বের হয়ে চলে এসছে।
– ইনায়াত তো গেছে বাবা!! তুই আর কোন ইনায়াতকে বলছিস??
লাবিবা বোকা মুখ করে জানতে চাইলো। আফরা মুচকি মুচকি হাসছে। এমন অবস্থায় কি করতে হয় তা জানা নেই আফিমের। তাই সবগুলো দাঁত দেখিয়ে একটা বোকা হাসি দিয়ে পা চালিয়ে উঠে গেলো নিজের রুমে।
ফ্রেশ হয়ে এসে রাগে ফুসতে ফুসতে মদের বোতল হাতে তুলে নিলো আফিম। হঠাৎই চোখের সামনে ভেসে উঠলো ছেলেরূপী ইনায়াত কিভাবে তার সাথে মদের বোতল নিয়ে কাড়াকাড়ি করতো না খাওয়ার জন্য। আফিম রেগেমেগে মদের বোতলটা রেখে দিলো আবারও।
– মেয়েটা একদম ভাইরাসের মতো। আমার লাইফে একটা মিনিটও কি বাকি রাখেনি যেখানে আমি একটু আরাম করে সময় কাটাতে পেরেছি একা একা???
আফিম বিরক্তি নিয়েই ঘুমিয়ে পড়লো।
.
.
সকাল সকাল কেও আফিমকে ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে সমানতালে। মৃদু চোখ খুলে ঘুমের ঘোরেই বুঝলো কোন ছেলে অবয়ব। আফিম ঘুমের মাঝেই কোনমতে উঠে বসে জড়িয়ে ধরলো সেই অবয়বকে।
– ইউ আর ফায়ার্ড ইনায়াত। ইউ আর ফায়ার্ড। বাট আই মিসড ইউ ইয়ার। তোমার এই রুপ,, এই কথাবার্তা গুলো মিস করেছি খুব।
– স্যার,,, ছাড়ুন। ও স্যার!! ছাড়েন না স্যার!!
আফিম এতো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো যে দীপ না থাকতে পেরে কেঁদেই দিতে লাগলো। পিছনে লাবিবা,, আফরা আর ইনায়াত দাঁড়িয়ে আছে। লাবিবা আর আফরা তো হা। আর ইনায়াত হা হয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো। পরক্ষনেই অস্বস্তিতে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো।
– মাথাটা গেছে স্যারের।
মনে মনে বললো ইনায়াত নিজেকে নিজে। কি আর করার!! গায়ের ওরনা ভালো করে কোমড়ে গুঁজে এগিয়ে গেলো আফিমের খাটের দিকে। দীপকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলতে লাগলো,,,
– স্যার!! ও স্যার উঠুন!! স্যার দেরি হচ্ছে অফিসের!! স্যার!!! স্যার উঠুনন নায়ায়ায়ায়ায়ায়া!!!
ইনায়াতের ধাক্কাধাক্কিতে আফিমের ঘুম ভাঙলো আর দীপকে ধরে রাখা হাত ছুটে গেলো। আফিম বিরক্তি নিয়ে ইনায়াতের দিকে তাকিয়েই দীপকে আবারও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,,
– ইউ আর ফায়ার্ড ইনায়াত!! ইউ আর ফায়ার্ড!!
– স্যার!! আগুন পানি ফায়ার্ড,, ওয়াটার্ড সব পরে করবেন। আজকে আমাদের আজাদ গ্রুপে সাথে ডিল আছে তো স্যার!!!!!!!!!!! ‌‌
আফিম মৃদু বিরক্তি নিয়ে নিজের ধরে রাখা মানুষটার দিকে তাকাতেই দেখলো দীপ কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছে আফিমের দিকে। আফিম যখন দেখলো আফিম দীপকে জড়িয়ে ধরে আছে। আফিম দ্রুত ছেড়ে দিলো এক ঝটকায়। দীপ গিয়ে দাঁড়ালো লাবিবার পিছনে। আফরা হো হো করে হেসে ফেললো। লাবিবা এখনো হা হয়ে তাকিয়ে আছে ইনায়াত আর আফিমের দিকে। ইনায়াত যে আসলে এতো যুদ্ধ করে এতোদিন তার ছেলেকে জাগিয়েছে তা জানা ছিলো না তার। আফিম কিছু না বলে অস্বস্তি নিয়েই চলে গেলো ওয়াসরুমের ভেতর। ইনায়াত টাওয়েল হাতে দ্রুত দৌড়ে বললো,,
– টাওয়েল!!
ইনায়াতের এভাবে দৌড়ে এসে টাওয়েল দেওয়ার দৃশ্য দেখে লাবিবার মুখে কেমন এক হাসি ফুঁটে উঠলো। আফিম অস্বস্তি নিয়ে একবার লাবিবা আর আফরার দিকে তাকালো। পরমূহুর্তেই রাগ নিয়ে দাঁতে দাঁত ঘষতে ঘষতে টাওয়েল একপ্রকার কেড়ে নিয়ে ঢুকে গেলো ওয়াসরুমে। ইনায়াত দীপের দিকে ঘুরে বললো,,
– আর্লি ব্রেকফাস্ট রেডি করো। নাহয় তোমাদের স্যার খাবে না আর।
ইনায়াত দ্রুত পায়ে দৌড়ে দৌড়ে রুম গোছাতে লাগলো। বিছানা ভাঁজ করে আফিমের জামাকাপড় বের করে খাটের উপর রাখলো। জোসেফ এতোক্ষন ইনায়াতের কাজগুলো লাবিবাদের সাথেই দাঁড়িয়ে হা হয়ে দেখছে। দীপ ততোক্ষনে ট্রে করে লাবিবা,,, আফরা,, ইনায়াত,, জোসেফ আর আফিমের ব্রেকফাস্ট নিয়ে এসছে। আফিম বাথরুম থেকেই আওয়াজ দিলো ” আমার চেঞ্জ “। ইনায়াত পুরো ঘর ছিমছাম করে ফেলেছে ততোক্ষনে। আফিম ডাক দিতেই বিছানার উপরের কাপড়চোপড় গুলো নিয়ে আফিমের বের করে রাখা হাতে দিয়ে দিলো। এরপর এসে ক্লান্ত হয়ে ধুপ করে চেয়ারে বসতেই খেয়াল হলো ৩ জোড়া চোখ হা হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ইনায়াত আবারও তড়াক করে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। সবার এমন চাহনী দিয়ে একটা বোকা বোকা হাসি দিলো,,
– এই কাজগুলো কি তুমিই করো নাকি ভাবী??
আফরার প্রশ্ন। ইনায়াত কিছুক্ষন অবাক হয়ে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ জানালো।
– কয়দিন ধরে করো??
লাবিবার গম্ভীর প্রশ্ন। ইনায়াত অবাক হলো।
– কেন ম্যাম!! যেদিন জবে জয়েন করেছি এই ৩ দিন পর থেকেই করি। মানে প্রায় আড়াই সপ্তাহ।
লাবিবা অবাক হয়ে জোসেফের দিকে তাকিয়ে চোখে চোখে ইশারা করলো কিছু একটা।
– আফিম কিছু বলে না??
– নাতো!!
জোসেফ প্রশ্নের উত্তর না পাবে তা আশা করেনি। তখনই আফিম ওয়াসরুম থেকে বের হয়ে ভেজা টাওয়েল খাটে ছুড়ে মেরে দিলো। ইনায়াত দ্রুত গিয়ে ভেজা টাওয়েলটা উঠিয়ে নিজ জায়গায় গুছিয়ে রাখলো। সবাইকে নিজের রুমে দেখে আফিম অবাক হলো।
– কোন সমস্যা??
– ভাবীই তোর সব কাজ করে দেয়?? সকাল থেকে রাত??
আফরা ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকে বললো। আফিম আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করতে করতে বললো,,
– হ্যাঁ!! তোর ভাবীই করে দেয়। কেন??
লাবিবা আর জোসেফ তো হা। এখন ইনায়াতও হা। আফিম কেন ” তোর ভাবী ” বলছে??
– তোর জিনিসে ওকে হাত লাগাতে দিস??
লাবিবা প্রশ্ন করলো।
– ও করে দেয় বলেই তো চিন্তা করতে হয় না।
– ও তোর পিএ হয় নাকি বৌ??
জোসেফ প্রশ্ন করলো। আফিম তখন থেকে নিজের মতো করে উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলো। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েও সে চুপ হয়ে গেলো। ইনায়াত আর আফিম একবার একে অপরের দিকে তাকিয়ে অস্বস্তি নিয়ে হাসার চেষ্টা করলো।
.
.
তাহজিব আড়মোড়া ভেঙ্গে ঘুম থেকে উঠে দেখলো তার বুকের মাঝেই গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে রুহি।
– আজকে আবারও??
মৃদু শব্দে জিজ্ঞেস করলো তাহজিব। চোখ বন্ধ অবস্থায় রুহি বলে উঠলো,,
– বাসার বিছানাটা চেঞ্জ করাচ্ছে তাই ঘুমোতে এসছি।
– এই পিচ্চি,, বাসায় আর রুম ছিলো না??
– বাসায় রুম,, বিছানা সব ছিলো। আপনি ছিলেন না।
রুহি উঠে পড়লো।
– আমি ব্রেকফাস্ট বানিয়েই রুমে এসছি। নিচে সার্ভ করছি। ফ্রেশ হয়ে নিন। আজ যে মিটিং আছে ইম্পর্ট্যান্ট মাথায় আছে তা??
তাহজিবের মনে পড়ে গেলো। দ্রুত নেমে পড়লো খাট থেকে। রুহি টাওয়েল এগিয়ে দিলো তাহজিবের দিকে। তাহজিব তা নিয়েই ঢুকে পড়লো ওয়াসরুমে। রুহি সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,,
– আমি আপনাকে টাওয়েল এগিয়ে দিলাম,, আপনার বুকে ঘুমালাম। আপনি বিরক্ত হলেন না কেন??
কিন্তু তাহজিব ততোক্ষনে ওয়াসরুমে। তাই শুনলোই না।

তাহজিব আর রুহি?? পিচ্চি রুহি নিজের ভালোবাসার রঙ্গ কিভাবে লাগাবে তাহজিবের মনে?? আফিম কিভাবে বুঝবে ইনায়াতের প্রতি তার অনুভুতি??

চলবে,,,