ছদ্মবেশে লুকানো ভালোবাসা পর্ব-২৩

0
1078

#ছদ্মবেশে_লুকানো_ভালোবাসা
#মৌমি_দত্ত
#পর্ব_২৩

তাহজিব ইতোমধ্যে তার সামর্থ্যের সবটা যোগাড় করেছে। নিজের সব থেকে বেস্ট ফাইটার ও শ্যুটার গার্ডসদের নিয়েছে। লোকেশন ট্রেস হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। এই শহরেরই একদম শেষ মাথার এক পোড়াবাড়িতে লোকেশন দেখাচ্ছে। আসিফ খুব চিন্তায় আছে। তার ভয় হচ্ছে কোন ভুল না হয়ে যায়। তাহজিব ইতোমধ্যে একবার কল করেছে রুহিকে তারা ঠিক আছে কিনা জানবার জন্য। স্পন্দন,, কামাল আর আফিম এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করে সোজা তাহজিবের বাসার উদ্দেশ্যে উঠেছে গাড়িতে। ইন্টারন্যাশনাল লেভেলের একজন মাফিয়া হওয়াতে কম বেশি সব জায়গায় নিজের ক্ষমতা আছে স্পন্দনের। ফ্লাইটের উঠবার আগেই কল করে সে গাড়ি আর গার্ডসদের ব্যবস্থা করে ফেলেছে। পুরো রাস্তা আফিম হাতের নখ কামড়েছে আর নাহয় ঘেমে গেছে। স্পন্দনের অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। কলিজার বোন বলে কথা। তবে মাফিয়া লাইনে থেকে সবটা শান্ত মস্তিষ্কে সামাল দেওয়ার শিক্ষা তার আছে। আর কামালও স্পন্দনের থেকেই সবটা শিখেছে।
– আফিম!! খুব টেস্টি??
বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো স্পন্দন। আফিম বুঝলো না কি নিয়ে কথা বলছে স্পন্দন। তাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,,
– মানে কি?? কিসের টেস্ট??
আফিমের প্রশ্নে রাগ বাড়লো হুহু করে। এতোটা প্যানিক কেন করছে আফিম তা নিয়ে বিরক্ত স্পন্দন।
– তোমার নখ!! খুব টেস্টি??
আফিম এতোক্ষনে বুঝলো সে কতোটা বিচ্ছিরি ভাবে নিজের হাতের নখ কাটছিলো। আফিম হালকা কেশে হাত নামিয়ে নিলো।
তাহজিবের বাসার সামনে এসে গাড়ি থামলো স্পন্দনদের। আর তখনই তাহজিব গাড়ি নিয়ে বের হচ্ছিলো। স্পন্দন আর তাহজিবদের গাড়ি মুখোমুখি হতেই তাহজিবদের গাড়ি থেকে নেমে এলো আসিফ আর তাহজিব। আর স্পন্দনদের গাড়ি থেকে নেমে এলো স্পন্দন,, কামাল আর আফিম। এস.এ’কে কেও দেখেনি। তাই তাহজিব চিনতে পারলো না স্পন্দন আজাদই যে এস.এ। বিষয়টা কামাল বুঝতে পারলো।
– এস.এ এসেছে। আর কোন চিন্তা করবেন না খান স্যার!!
তাহজিব আর আসিফ ভ্রু কুঁচকে এতোক্ষন তাকিয়ে ছিলো স্পন্দনদের দিকে।কামালের কথা শুনে বুঝতে পারলো সবটা।
-এস.এ মানে স্পন্দন আজাদ,, নামকরা ডাক্তার ও বিজনেস ম্যান!!
আসিফ অবাক হয়ে বললো। আফিম বিরক্ত এদের সবার উপরেই। ওদিকে ইনায়াতের জান সংকট আর এরা এখানে হাই হ্যালো নিয়ে বসে আছে।
– হ্যালো!! সবটা পড়ে হবে। আগে আমরা রুহি আর ইনায়াতকে প্রায়োরিটি দিলে ভালো হয়।
আফিমের কথা শুনে তাহজিবের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,,
– আপনার এখানে কাজ ছিলো না।
আফিম রেগে বললো,,
– আমার জিন্দেগি,, আমার ইনায়াত ওখানে বন্দী। আর আপনি কি চাইছিলেন মিস্টার খান?? আমি আমার অফিসে বসে ক্রেস্ট’স এন্ড সার্টিফিকেটস মুছি??
আফিমের গলার টোনে কিছু একটা ছিলো যা শুমে স্পন্দন আর তাহজিব অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। তাহজিব সবাইকে নিয়ে ভেতরে গেলো। ইতোমধ্যে তাহজিবদের বাসার সামনে ৬ টা বড় বড় জীপে করে তাহজিবের গার্ডস চলে এসেছে রেডি হয়ে। আর স্পন্দনও নিজের ফোর্স কাজে লাগিয়ে ৮ জীপ গার্ডস আনিয়েছে।
– আপনারা কোথাও বের হচ্ছিলেন মনে হয়। কোথায় যাচ্ছিলেন খান স্যার??
প্রশ্ন করলো কামাল। এতে করে স্পন্দন আর আফিমও তাকালো তাহজিবের দিকে। তাহজিবের মাথায় সবটা এলো।
– এস.এ,, রুহি,,ইনায়াতের লোকেশন ট্রেস করা হয়ে গেছে খুব ইজিলি।
স্পন্দন যেন অবাক হলো,,,
– মানে?? এতো ইজি কিভাবে সম্ভব??
জানতে চাইলো আফিম। তাহজিব বিজয়ী হেসে বললো,,
– আমার উডবি রুহি খান,,, সে পুলিশ কমিশনারের মেয়ে। বাবার কাছে কেস আর এসবের গল্প শুনে সে নিজেও একজন সাহসী হিসেবে নিজেকে গড়েছে। কিডন্যাপাররা যখন রুহিকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে রুমাল মুখে চেপে ধরেছিলো। তখন অতি সন্তর্পনে রুহি সবার চোখ বাঁচিয়ে মোবাইল নিয়ে নিয়েছে নিজের সাথে। একটু আগেই সে কল দিয়েছে।
তাহজিব রুহির কল দেওয়া সম্পর্কে সবটা বললো। সবটা শুনে অবাক হলো স্পন্দন আর আফিম। আসলেই রুহি যে সাহসী তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। নাহয় তেমন একটা সময়ে জাস্ট একটা ১৬/১৭ বছর বয়সী মেয়ে নিজেকে শান্ত রেখে এতোটা করতে পারে না। তাহজিব এর পাশাপাশি নিজের সাজানো প্ল্যানটাও বলতে লাগলো স্পন্দন ও আফিমকে। কে কোনদিক থেকে এট্যাক করবে,,, কয়জন থাকতে পারে এসব নিয়ে কথা চললো আরো কিছু মিনিট। তাহজিব সবাইকে বুঝিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াতেই স্পন্দন ভ্রু কুঁচকে তাকালো তাহজিবের দিকে।
– রানা কোথায়?? ও ইরশাদের সাথে যাওয়ার মতো মানুষ না।
– রানা ইরশাদের সাথে যাওয়ার মতো মানুষ না বলেই হয়তো আল্লাহর কাছে চলে গেছে।
স্পন্দন আর আফিম অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকালো। আসিফ খুলে বললো রানার মৃত্যুর খবর। স্পন্দনের ব্যাপারটাতে আসলেই খারাপ লাগলো। সেদিন একটু সতর্ক হয়ে রানাকে সাথে নিয়ে গেলে সে বেঁচে থাকতো। স্পন্দন বের হয়ে এলো। কামাল আর আসিফও নিজেদের মধ্যে প্ল্যান নিয়ে আলোচনা করতে করতে বের হয়ে এলো। আফিম তাহজিবের দিকে তাকাতেই মাথায় খেলে গেলো ভয়ানক এক প্রশ্ন।
– ইনায়াতকে বাঁচানোর পর তাহজিব দাবি করবে না তো??
পরক্ষনেই নিজেকেই নিজে গালাগালি দিলো।
– ধ্যাত!! ইনায়াত একটা মানুষ কোন পণ্য না। ওকে দাবি করলেই পাওয়া যাবে নাকি?? সেভাবে হলে আমিও দাবি করতাম আর পেয়ে যেতাম। কিন্তু আশা করি তাহজিব ইনায়াতকে সত্যিই ভালোবাসলে তেমন কিছু করবে না।
পরক্ষনেই আরো একটু প্রশ্ন মাথায় ধাক্কা খেলো আফিমের।
– তাহজিব কি ইনায়াতকে এখনো ভালোবাসে??
বিদ্ধস্ত অবস্থায় কিছু সেকেন্ড নিজের হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকলো। পরক্ষনেই নিজের ভাবনায় নিজে হেসে দিলো।
– রিয়েলি আফিম?? আর ইউ ম্যাড?? তাহজিব তো বললো স্পষ্ট ” আমার উডবি রুহি খান “। তার মানে আমার ইনু অলরাইট থাকবে। ইয়েস!!
এই প্রশ্ন শেষ হতে আবারও মাথায় প্রশ্ন এলো আফিমের।
– ইনায়াতকে বাঁচানোর পর স্পন্দন যদি ইনুকে নিজের কাছে রাখে আর আমাকে না দেয়?? ইনুকে ছাড়া আমি তো ঘুম যেতে বা উঠতেও পারিনা। ও-ই সব করতো আমার।
আফিমের ধারনা সে মনে মনে কথা বলছে। কিন্তু অতিরিক্ত উত্তেজনায় আসলে যে সে মুখে জোড়ে জোড়েই কথা বলছে তা তার খেয়ালই হয়নি। স্পন্দন আর তাহজিব আফিমের দুই পাশে বুকের কাছে হাত ভাঁজ করে এতোক্ষন কথাগুলো শুনছিলো।
– মিস্টার আফিম!! আমি ছ্যাচড়া না!!
তাহজিবের গলার আওয়াজে চমকে উঠে তাকালো আফিম তার বাম পাশে। তাহজিবের ভ্রু কুঁচকে কড়া চাহনি দেখে অবাক হলো। সবে অবাকের রেশ কাটাতে চাইছিলো আফিম তখনই আফিমের ডান পাশ থেকে কথা বলে উঠলো স্পন্দন।
– এন্ড!! ইয়েস। ইনায়াত যদি না চায় তোমার ওকে পাওয়া যাতে কখনো না হয় তার খেয়াল আমি রাখবো।
হঠাৎ স্পন্দনের আওয়াজ শুনে চমকে স্পন্দনের দিকে তাকালো আফিম। বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন স্পন্দনের দিকে।
– কিন্তু আমি কি ভাবছি তা এরা বুঝলো কিভাবে??
অতিরিক্ত চিন্তায় মাথা কাজ করছে না আফিমের। আর আফিমের এই বোকামো দেখে স্পন্দন তাহজিবের দিকে ইশারা করে বের হয়ে এলো রুম থেকে। তাহজিব জোড়ে একটা শ্বাস নিয়ে আফিমের কাঁধে চাপর মেরে বললো,,
– মিস্টার আফিম!! আপনি অতিরিক্ত উত্তেজনায় এতোটাই পাগল হয়ে গেছেন যে এটাও বুঝতে পারছেনা। আপনি মনে মনে না জোরে জোরে মুখ চালিয়ে কথা বলছেন।
আফিম চমকে উঠলো। ভাগ্যিস তাহজিব তাকে ধরিয়ে দিয়েছে। নাহয় সে রাস্তাতেও হয়তো কথা বলতো এভাবে। আফিম হালকা কেশে নিজের কোটের হাতা ঠিক করলো এমন ভাণ করে যেন কিছু হয়নি। তাহজিব আবারও আফিমের কাঁধে চাপড় মেরে বললো,,
– যাওয়া যাক?
আফিম মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালো। তাহজিব বের হয়ে এলো। আর পিছন পিছন মাথা চুলকাতে চুলকাতে বের হয়ে এলো আফিম।
.
.
রুহি বসে বসে সবটা জায়গা দেখে নিচ্ছিলো রুমের। ইতোমধ্যেই রুমের দরজা সে খুলে দিয়েছে। এখন শুধু ইনায়াতের ঘুম ভাঙ্গার দেরি। ইনায়াত নড়েচড়ে উঠলো ধীরে। আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে নিজেকে অপরিচিত জায়গায় আবিষ্কার করে চিৎকার করতে যাচ্ছিলো ইনায়াত। তখনই রুহি মুখ চেপে ধরলো ইনায়াতের।
– আপি,, শান্ত হও। এখন চিৎকার করলে ওরা সব এসে যাবে।
রুহিকে দেখে অবাক হলো ইনায়াত। শান্ত হলো। রুহি ইনায়াতের মুখ থেকে হাত সড়িয়ে রুহির পাশে বসলো।
– আপি,,, সময় খুব কম। আমি যা বলছি কোন প্রশ্ন ছাড়া মন দিয়ে শুনো। আর আমি এও জানি তুমি প্রমাণ খুঁজবে। আর হ্যাঁ আমি জানি তুমি প্রমাণ পেয়েও যাবে। তবে আবেগের বশে পাগলামী করো না প্লিজ। আমরা দুজনেই খুব বিপদে আছি।
রুহির কথায় ইনায়াত অবাক হলো। তবুও মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালো। রুহি এক এক করে তার বাবার ও তাহজিবের কাছে শোনা সবটা কথা বললো। ইরশাদ কতোটা খারাপ,, কিভাবে মহুয়াকে মেরেছে,, কিভাবে এতোদিন ভালোমানুষীর মুখোশ পড়েছিলো,, তাহজিব সবটা জানতে পেরে ইনায়াতকে বাঁচাতেই সবাইকে বন্দী করেছিলো তাও জানালো। আরো জানালো কিভাবে ইরশাদ তাদের দুজনকে এখানে ধরে এনেছে। নিজের বাবার সম্পর্কে এমন সব কথা জেনে ইনায়াত যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। এতোকিছুর মধ্যে তো বেচারির জানাই হলো না যে ইরশাদ আসলে তার আসল বাবা না,, তার আসল বাবা হাবিব আজাদ। আর স্পন্দন তার আসল ভাই। কেননা এই কথা আরভিদ সাহেব বা তাহজিব জানতো না। তাই রুহিও জানেনা। আর তাই বলাও হয়নি। ইনায়াত বেখেয়ালি অবস্থাতেই বললো,,
– তুমি পিচ্চি একটা মেয়ে। এগুলো বানানো গল্প। আমি স্বপ্ন দেখছি।
– আপি!! আমি পিচ্চি মেয়ে মানছি। তবে এসব সত্যি। আর এটা স্বপ্ন না।
– প্রমান কি তোমার এতোসব কথার??
– প্রমাণ!! একটু পরেই তোমার বাবা আসবে রুমে। তোমাকে কোন না কোন ভাবে,, কোন না কোন পেপারসে সাইন করতে বলবে। ওগুলো আসলে প্রোপার্টি পেপারস। দেখে নিও।
ইনায়াত শূন্যে উদ্দেশ্যহীন ভাবে তাকিয়ে আছে। সবটা যে তাকে অনেক আঘাত করেছে মানসিক ভাবে তা বুঝতে সমস্যা হলো না রুহির। তবে তারও বা কি করবার ছিলো?? নিজেদের বাঁচাতে বলতেই হতো।
– আপি!! এখন আমি যা বলি তা মন দিয়ে শুনো।
নিজেদের বাঁচানোর একটা প্ল্যান এতোক্ষন বানিয়েছিলো রুহি। তাই খুলে বললো ইনায়াতকে। ইনায়াত না চাইতেও মন দিয়ে শুনলো। কেন যেন রুহিকে দেখে মনে হচ্ছে না তার যে রুহি মিথ্যে বা বানোয়াট কোন গল্প বলে মজা নিচ্ছে।

সামনের পর্বের জন্য কে কে অপেক্ষায় থাকবেন?? আসছে #পরানসখা,, ঠিক এই গল্পের পর। তাই সাথে থাকবেন।

চলবে,,,