ছদ্মবেশে লুকানো ভালোবাসা পর্ব-২৫

0
1125

#ছদ্মবেশে_লুকানো_ভালোবাসা
#মৌমি_দত্ত
#পর্ব_২৫

স্পন্দন,, তাহজিব ও আফিমের এই অবস্থা দেখে এগিয়ে এলো আসিফ ও কামাল। আসিফ তাহজিবের পাশে গিয়ে বললো,,
– স্যার!! হুশ ফিরান নিজেদের। এখন ভেঙ্গে পড়বার সময় না
দ্রুত একশন নিতে হবে। দুজনেই বিপদে আছে কিন্তু।
তাহজিব মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে বললো,,
– একদম নীরব। আগে ওদের গার্ডসদের ডাউন করতে হবে।
– জন এখন নিজের বিচ্ছিরি মনোভাব উপভোগ করবে বলে উত্তেজিত। তাই কোন স্টেপ ও নেবে না। নিতেই পারবে না। আর ইরশাদ এখন বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে।
আফিম বললো হালকা ভেবে। স্পন্দন তখন বলে উঠলো,,
– ওকে!!
গার্ডসদের নিয়ে পায়ে হেঁটেই এগিয়ে যেতে লাগলো পোড়াবাড়ির দিকে। আল্লাহকে ডাকছে সবাই। যে করেই হোক বাঁচাতে হবে ইনায়াত ও রুহিকে।
.
.
ইনায়াতের হাতে এখন একটা মুর্তি আছে। জানলার পর্দা সে ইতোমধ্যেই খুলে নিয়েছে দুটো। গিট দিয়ে বেঁধে নিলো শক্ত করে একটার সাথে আরেকটা। এন্টিক দেখতে মুর্তিটা একটা খুবই ধারালো তলোয়ার ধরা। ইনায়াত ভেবে নিয়েছে সে কি করবে। এই জানোয়ার ধরনের মানুষগুলোকে যদি মারে তাহলে কোন গুনাহ হবে না তার। ইনায়াত ইচ্ছে করেই গার্ডস দুটোকে ভরকে দিয়ে দরজা খুলে দিলো লুকিয়ে থেকে। আপনা আপনি দরজা খুলে যেতে দেখেই বাইরের গার্ডস দুটো অবাক হলো। আরো অবাক হলো যখন অনেকটা সময় পর কেও বের হচ্ছে না দেখতে পেলো। গার্ডস দুটো ধীর পায়ে রুমে প্রবেশ করলো অনেকটাই। খাটের মাঝখানে কাওকে বাঁধা অবস্থায় দেখে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইনায়াত ঐ পর্দা দিয়ে গলা পেঁচিয়ে ধরলো দুজনের। এরপর ঐ ভারী আসবাব দিয়ে দুটো করে আঘাত করলো গার্ডস গুলোর মাথায়। মূহুর্তেই পড়ে গেলো গার্ডস দুটো মাটিতে। ইনায়াত চেক করলো দ্রুত পালস আছে কিনা। বুঝলো পালস চলছে। ইনায়াত সেই পর্দার কাপড় দিয়েই বেঁধে দিলো দুজনকে। মেঝেতেই ফেলে রাখলো তাদের। একজনের মাথা থেকে রক্তপাত হচ্ছে। তা দেখে বুক কেঁপে উঠলো ইনায়াতের। বড় বড় ঢোক গিলে দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো কোনভাবে। গার্ডসদের পকেট হাতড়ে দেখলো দুজনের কাছে দুটো বন্দুক আছে। ব্যবসায়িক শত্রুতা থাকার ভয়ে ইরশাদের কাছেও বন্দুক ছিলো। তাই বন্দুক সম্পর্কে মোটামুটি অনেকটা জ্ঞান আছে ইনায়াতের। একজনের বন্দুক সাইলেন্সার লাগানো। দুটো বন্দুকই নিয়ে নিলো ইনায়াত। তবে হাতে রাখলো সাইলেন্সার লাগানো বন্দুকটা। আরেকটা গুঁজে রাখলো ছোট্ট একটা কাপড় কনুইয়ের উপরে বেঁধে তাতে। বন্দুকটা নিয়েই বের হয়ে এলো দ্রুত রুম থেকে। এদিকটা খালি। ইনায়াত ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো করিডর ধরে।
.
.
তাহজিব,, স্পন্দন আর আফিম গান হাতে এগিয়ে যাচ্ছে পোড়াবাড়ির ভিতর। বাড়িটা দেখেই থমকে গেলো সবাই। এখানে মানুষ আসে তা অবিশ্বাসযোগ্য। তাহলে কি কোন ভুল হলো। স্পন্দন তখন অর্ডার দিলো,,
– পুরো জায়গা খুঁজে দেখো। সব জায়গা!!
গার্ডসরা খুঁজতে লাগলো। আফিম,, স্পন্দন আর তাহজিবও খুঁজতে লাগলো। কিন্তু কোথাও কিছু পেলো না। তখনই বাড়ির একদম শেষের দিকে আফিমের চোখ পড়লো একটা ছোট্ট টেবিলে। মানুষজনের আসা যাওয়া নেই। তবে খুব দামী পরিষ্কার একটা খালি বোতল আছে মদের। আফিম ভ্রু কুঁচকে তা হাতে উঠিয়ে নিতে গিয়ে অবাক হলো। কেননা ওটা উঠাতে গেলেও পুরোটা উঠলো না আফিমের হাতে। কাঠের সাথে লেগে থাকা অবস্থাতেই খানিকটা উঠলো। এরপর কাছেই কোথাও বিপ বিপ করে দুবার আওয়াজ হয়ে বেসমেন্টের মতো একটা জায়গার দরজা খুলে গেলো যা এতোক্ষন খুব সাধারণ মেঝে মনে হচ্ছিলো সবার। স্পন্দনের মুখে হাসি ফুঁটে উঠলো। তাহজিব গার্ডসদের ইশারা করলো। সামনের দিকে তাহজিব,, স্পন্দন আর আফিম। এর পিছনে আসিফ ও কামাল। এরও পিছনে গার্ডস।
ইনায়াত করিডর দিয়ে হেঁটে আসতে না আসতেই দেখতে পেলো একটা সিড়ি বেয়ে নামছে স্পন্দন,, তাহজিব আর আফিম। ইনায়াতকে দেখেই তিনজন এগিয়ে এলো দ্রুত। স্পন্দন জড়িয়ে ধরলো আদরের বোনকে। ইনায়াতও জড়িয়ে ধরলো স্পন্দনকে। স্পন্দন ইনায়াতকে ছাড়তেই আফিম এগিয়ে এলো রাগী চোখে।
– হাতে এটা কি?? নিজেকে কি হাসিনা পার্কার ভেবেছো?? লেডি ডন হতে এসেছো?? নাহ?? ইউ আর ফায়ার্ড ইনায়াত। ইউ আর ফায়ার্ড।
আফিমের কথাগুলো শুনে মুচকি হাসলো ইনায়াত। আফিমের লাস্টের এই লাইনটা অনেকটা দীর্ঘ সময় শোনা হয়নি তার। তাহজিবকে দেখেই ঘাবড়ে গেলো ইনায়াত স্বভাববশত। খামচে ধরলো আফিমের কোটের হাতা। আফিম বিষয়টা বুঝতে পেরে জড়িয়ে ধরলো ইনায়াতকে। স্পন্দন রেগেমেগে তাকালো আফিমের দিকে। কিন্তু আফিমের সেদিকে খেয়াল নেই। তাহজিব বিষয়টা বুঝতে পেরে এগিয়ে এসে বললো,,,
– আমার রুহি কোথায় ইনায়াত??
ইনায়াত আস্তে করে ছেড়ে দিলো আফিমের কোটের হাতা। মনে পড়লো কিভাবে তাহজিব তাকে বাঁচাতেই সবার সাথে লড়েছিলো বলে বলেছে রুহি। ইনায়াতের মনে পড়ে গেলো ইরশাদের কথা। ইনায়াতের চোখে পানি জমলো। আফিম শক্ত করে জড়িয়ে রাখলো ইনায়াতকে। ইনায়াত দ্রুত নিজেকে সামলে বললো,,
– আমি জানিনা। এই করিডোর ধরেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। গার্ডস এখানে বেশি নেই বলে মনে হচ্ছে।
তাহজিব,, আফিম আর স্পন্দন এগিয়ে যেতে লাগলো করিডর ধরে। আসিফ আর কামালের পিছনে ইনায়াত। তাকে এখানে রেখে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফিরে তাকালো আফিম।
– ইনায়াত!! তুমি আসিফ আর কামালের সাথে এখানেই থাকো প্লিজ।
স্পন্দনও রাজি হলো এই কথায়। ইনায়াত শক্ত ভাবেই জবাব দিলো।
– না!! আমি যাবো। আর এটা নিয়ে কোন কথা না। কারণ আমি মানবো না স্যার।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেলো সবাই। ইনায়াতও আসতে লাগলো। গার্ডস নেই ভেবেছিলো সবাই। কিন্তু বোকামি ছিলো তা। করিডরের এই প্রান্তে প্রতি এক হাত পরপর গার্ডস। তা জানা ছিলো না কারোর। স্পন্দনদের দেখে ভরকে যায় গার্ডস দুটো।
– শ্যুট!!
বলেই চিৎকার করে উঠে গার্ডস দুটো। উপস্থিত প্রায় ১২ জন গার্ডস একসাথে বন্দুক তাক করে এগিয়ে আসে। তাহজিব অস্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে সামনের দরজা পেরোলেই তার রুহি আছে ঐ জনের সাথে। নাহয় এখানে এতোগুলো গার্ডস রাখতো না। তাহজিব হাত হালকা বাঁকিয়ে পিছনে নিয়ে ইশারা করলো আসিফ ও কামালের দিকে যাতে ওরা কেও শ্যুট না করে। ১২ জন গার্ডস এসে যেই ঘিরে ফেলেছে তখনই আচমকা পিছন থেকে এসে শ্যুট করে দিলো স্পন্দন্দের গার্ডসরা। আফিম,, তাহজিব আর স্পন্দন ইনায়াতকে নিয়ে বের হয়ে এলো দরজার কাছে। আসিফ আর কামাল ব্যাকআপ হিসেবে আসছে
তাদের সাথে খুব সাবধানে। ঐদিকে গোলাগুলি হচ্ছে বুঝতে কষ্ট হলো না তাদের। তাহজিব দ্রুত দৌড়ে গিয়ে দরজার লকে গুলি করলো ৩ টা। এরপর ঠেলে ঢুকে পড়লো রুমে। ভিতরে ঢুকে যা দেখলো তা দেখে কলিজা কেঁপে উঠলো তাহজিব সহ সকলের। খাটে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে রুহি। রুহির নাকে মুখে সব জায়গায় রক্ত। আর জন শোচনীয় অবস্থায় পড়ে আছে মাটিতে। ক্রমশ উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তার পেটে আর হাঁটুতে গেঁথে আছে একটা করে কাঁটাচামচ। আরেক পায়ের পাতায় গেঁথে আছে নাইফ। আসিফ ও কামাল এগিয়ে গিয়ে বন্দুক তাক করলো জনের দিকে। তাহজিব এগিয়ে গেলো রুহির দিকে। বুঝতে অসুবিধা হলো না যে রুহির আবার শরীর খারাপ করেছে। তাহজিব রুহির পাশে বসে পড়লো। রুহির জামাকাপড়ের অবস্থা দেখে বোঝা যাচ্ছে তার সাথে প্রচুর জোড় জবরদস্তি করবার চেষ্টা করা হয়েছে। তাহজিব রুহিকে জড়িয়ে নিলো নিজের বুকে। মেয়েটাকে নিয়ে ডাক্তার এমনিও ওয়ার্নিং দিয়ে দিয়েছে যেন দুই সপ্তাহের মাথায় হসপিটালাইজড করা হয়। আফিম ইনায়াতকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ইনায়াত কান্না করছে। স্পন্দন এগিয়ে গেলো জনের দিকে। নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে নিয়েছে জন।
– তাহলে এটা তোর কাজ জন??
জন ঘৃনা ভরা চোখে তাকালো স্পন্দনের দিকে।
– তোকে একমাত্র আমিই শেষ করবো এস.এ। তাই নিঃসন্দেহে এই কাজের সাহস শুধুই আমার।
স্পন্দন লাথি বসিয়ে দিলো জনের বুকে। জন পড়ে গেলো হঠাৎ লাথি খেয়ে মাটিতে। কঁকিয়ে উঠলো জনাথন।তাহজিব ততোক্ষনে রুহির জ্ঞান ফিরিয়েছে চোখে পানির ছিটা দিয়ে। বেডসাইড টেবিলে খাবারের ট্রে রাখা ছিলো। রুহি জ্ঞান ফিরতেই উঠে বসলো তাহজিবকে ধরে। একটু সময় নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে তাকালো ইনায়াতের দিকে। ইনায়াত দ্রুত এলো রুহির কাছে।
– ঠিক আছো তুমি বোন??
রুহি হালকা মলিন হেসে বললো,,
– আমি ঠিক আছি আপি।
– জন তোমাকে স্পর্শ করেছে??
তাহজিবের শক্ত মুখ করে প্রশ্ন করা শুনে রুহি তাহজিবের দিকে তাকাতেই দেখলো,, তাহজিব রাগে বোম হয়ে তাকিয়ে আছে জনের দিকে। যে কিনা স্পন্দনের লাথি খেতে ব্যস্ত। রুহি তাহজিবের হাতের উপর নিজের হাত রাখলো। তাহজিব ফিরে তাকালো রুহির দিকে।
– উনি যাতে মারা না যায় এখন তাহজিব। তবে এমন অবস্থা করুন যেন মারা যাওয়ার আগে জাহান্নাম হয়ে যায় তার জীবন। মেয়েদের দিকে তাকানোর কথা দুঃস্বপ্ন মনে হবে ওর। এটা আমার একটা রিকুয়েস্ট ধরে নিন।
তাহজিব রুহিকে বুকে জড়িয়ে নিলো।
– স্পন্দন,,, উনাকে আমার জন্য ছেড়ে দিন।
তাহজিবের গলার স্বর শুনে পিছু ফিরে তাকালো স্পন্দন। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে সড়ে এলো। রুহি আবারও মাথা চেপে ধরলো। তাহজিব অস্থির হয়ে পড়লো। আফিম বললো,,
– আমাদের এখন বের হওয়া উচিত। রুহির শরীর ভালো না। মাথায় আঘাত পেয়েছে হয়তো।
তাহজিব ততোক্ষনে রুহিকে নিয়ে বের হয়ে গেছে। আসিফ আফিমের কথা শুনে উত্তর দিলো।
– রুহি মাথায় আঘাত পায়নি। রুহির লিউকেমিয়া অর্থাৎ ব্লাড ক্যান্সার । আগামী ২/৩ সপ্তাহের মধ্যে ওকে দ্রুত হাসপাতালে এডমিট করতে হবে। নাহয়,,,
সবাই চমকে তাকালো আসিফের দিকে। আসিফ মলিন হেসে বের হয়ে এলো রুম থেকে। কিছু সেকেন্ড বাদে বের হয়ে এলো রুমে উপস্থিত সবাই।
জনের গার্ডসরা কেওই বেঁচে নেয়। স্পন্দন ও তাহজিবেরও কিছু গার্ডস ঘায়েল হয়েছে। স্পন্দন তাদের হাসপাতালে ভর্তি করাতে বললো কামালকে। আর সুস্থ কিছু গার্ডসদের বললো জন কে সড়িয়ে পুরো বাড়িতে আগুন লাগিয়ে চলে যেতে। ইনায়াতের বুক কেঁপে উঠলো।
– ভাইয়া!! আব্বু,,,
আফিম ইনায়াতের কথা আটকে বললো।
– তোমার আব্বুর ব্যবস্থা হচ্ছে।
স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে ইশারা করতেই স্পন্দন কিছু গার্ডসদের বলে ইরশাদ মির্জাকে বাইরে আনলো। বাঁধা অবস্থাতেই তাকে গাড়ির ব্যাকসিটে ফেলা হলো। কামাল আহত গার্ডসদের নিয়ে গাড়িতে উঠলো। তাহজিব আর রুহিও গাড়িতে উঠলো। রুহি এর মধ্যেই আবারও সেন্স হারিয়ে ফেলেছে। সবাই এখন ফিরে যাবে।

ইনায়াত স্পন্দন ও ইরশাদের আসল পরিচয় পরের পর্বে জানবে। আফিম ইনায়াতের মিল এর পরের পর্ব থেকে হবে। রুহিও সুস্থ হবে। তাহজিব আর রুহিও মিলবে। সব হবে। কিন্তু……..

চলবে,,,