#ছদ্মবেশে_লুকানো_ভালোবাসা
#মৌমি_দত্ত
#পর্ব_২৬
রুহিকে ডাক্তার মাত্র চেকাপ করে গেছে। ঘুমের ঔষধ দিয়েছে। আর বলে গেছে ২ সপ্তাহের মধ্যে দ্রুত হাসপাতালে ট্রিটমেন্ট করাতে। তাহজিব রুহির পাশে রুহির এক হাত ধরে বসে আছে খাটে। রুমে ইনায়াত ছাড়া সবাই জড়ো হয়ে আছে। এতো বাচ্চা একটা মেয়ের লিউকেমিয়া অসম্ভব না তবে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে সবার। ইরশাদ আর জনকে তাহজিবের বেসমেন্টে আটকে রাখা হয়েছে। তাহজিব ইতোমধ্যে আরভিদ সাহেবকে কল করেছেন তবে রিসিভ হয়নি। অবশ্য হওয়ার কথাও না। কেননা আরভিদ সাহেব খুব কনফেডেনশিয়াল একটা মিশনে গেছে যেখানে কোনো মোবাইল এলাউড না। রুহিকে রেখে সবাই বাইরে এলো। ইনায়াত ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছে মুখ চেপে ধরে। তার শরীর বারবার কেঁপে উঠছে যা দেখে বুঝাই যাচ্ছে ইনায়াত কাঁদছে। আসিফ,, কামাল,, তাহজিব,, আফিম আর স্পন্দন এসে বসলো সোফায়। কামাল একটু আগেই গার্ডসদের হাসপাতালে ভর্তি করে এসছে। স্পন্দন বসেছে ইনায়াতের পাশে। স্পন্দন ইনায়াতের কাঁধে হাত রাখলো। ইনায়াত মুখ তুলে তাকালো স্পন্দনের দিকে। ইনায়াতের চোখ লাল হয়ে গেছে ফুলে কান্না করতে করতে। ইনায়াত ঘাড় ঘুড়িয়ে সবার দিকে তাকালো। ভাঙ্গা গলায় জানতে চাইলো,,
– রুহি কেমন আছে?
তাহজিব মৃদু স্বরে জবাব দিলো।
– হুম ভালো আছে। ঘুমের ঔষধ দিয়েছে ডাক্তার।
ইনায়াত মাথা নিচু করে বসে আছে। তাহজিবও একই ভঙ্গীতে বসে আছে। কারণ কোনো না কোনো ভাবে ইনায়াতের কাছে অপরাধী তাহজিব।
– এখন সবটা ক্লিয়ার করা দরকার স্পন্দন।
আফিমের গলার স্বর শুনে সবাই তার দিকে তাকালো। স্পন্দন মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। আফিমই দায়িত্ব নিলো শুরু করবার।
– ইনায়াত!! তোমাকে সবারই কিছু না কিছু জানানোর আছে। জানি আজকে একদিনেই সবটা জানার পর মেনে নেওয়া তোমার জন্য অনেকটা কঠিন হয়ে যাবে। তবুও জানা দরকার তোমার।
ইনায়াত অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আফিমের দিকে। বুকের ভেতর রীতিমতো হাতুড়ি পিটাচ্ছে যেন কেও। আরো কি জানতে হবে ভেবেই মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিতে চাইছে ক্লান্তিতে। স্পন্দন বলা শুরু করলো সবার আগে।
– বোনু!! সবার আগে বলি তুই ইনায়াত মির্জা চাঁদ না। তোর আসল পরিচয় হলো ইনায়াত আজাদ চাঁদ।
ছোট্ট এই লাইনটা শুনেই চমকে তাকালো ইনায়াত স্পন্দনের দিকে। ছিটকে দূরে সড়ে এলো স্পন্দনের পাশ থেকে। আফিম উঠে এসে ইনায়াতের পাশে বসে ইনায়াতের হাত শক্ত করে চেপে ধরলো সাহস দিতে। ইনায়াত ঘাড় ঘুড়িয়ে একবার আফিমের দিকে তাকালো। যেন চোখের ইশারায় আফিমের কাছে জানতে চাইছে এই কথাটা সত্যি কিনা। আফিম চোখের পলক ফেলে হ্যাঁ জানাতেই ইনায়াতের হাত পা কাঁপতে শুরু করলো। বিষয়টা যে ইনায়াতের মস্তিষ্ক স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারছে না তা বুঝতে কষ্ট হলো না উপস্থিত সবার। আফিম ইনায়াতকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। আফিমের বুকে ইনায়াতের পিঠে লেপ্টে রইলো। ইনায়াত আফিমের হাত শক্ত করে চেপে ধরে আছে। স্পন্দন একবার সেদিকে তাকিয়ে রাগে কটমট করলো। পরক্ষনেই কামালের দিকে চোখ যেতেই দেখলো কামাল ইশারায় শান্ত হতে বলছে। স্পন্দন নিজেকে শান্ত করলো আর বলতে শুরু করলো। শুরু থেকে শেষ সবটা বললো স্পন্দন এক এক করে। কিভাবে মহুয়া আর ইরশাদ বিয়ে করে নিলো,, হাবিবের আত্মহত্যা,,, মহুয়ার কনসিভ করা,, ইরশাদের বাইরে বিভিন্ন রিলেশন,, মহুয়ার জেনে যাওয়া,,, মহুয়াকে ইরশাদের খুন করা। স্পন্দনের একা বেড়ে উঠা,,, আড়াল থেকেই বোন ইনায়াতকে দেখা।
স্পন্দন সবটা বলে থামলো। ইনায়াত আফিমের বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। একটা মেয়ের জন্য বিষয়টা অনেক কঠিন মেনে নেওয়া। যাকে বাবা বলে মেনে এসেছে সে আসলে তার বাবা না। তার থেকেও বেশি কঠিন একটা মেয়ের পক্ষে এটা মেনে নেওয়া যে তার মা এতো বড় একটা ভুল করেছে। নিজের স্বামীকে ছেড়ে পরকীয়ায় লিপ্ত হয়েছে। ছেলেদের থেকে মেয়েরা বেশি কাছের হয় মায়েদের। মায়েরা যেমন মেয়েকে নিজের অংশ আর নিজের রূপ বলেই মনে করে। তেমনি মেয়েরা মায়ের মতো হতে চায় আর হয়। স্পন্দন সিদ্ধান্ত নিলো আরো একটা সত্য যা বাকি তাও এখন বলে ফেলবে বোনকে। বারবার বোনকে আঘাত দিতে সে চায় না।
– আরো একটা সত্য আছে ইনায়াত। আমি স্পন্দন আজাদই আন্ডারওয়ার্ল্ডের এস.এ। জানিনা আমি মাফিয়া এটা জেনে তুই কোনো আমাকে ঘৃনা করবি কিনা। আমি এও জানিনা তুই আমাকে মেনে নিবি কিনা ভাই হিসেবে। তবে আমার কলিজার বোনকে আমি সবসময় ভালোবেসেছি আর বেসে যাবো।
স্পন্দনের চোখের কোণেও জমলো জল। ইনায়াত আফিমের বুক থেকে মুখ তুলে নিজেকে সামলে নিলো। গম্ভীর স্বরে বললো,,
– বোন হিসেবে একটা জিনিস চাইতে পারি??
স্পন্দন মাথা তুলে তাকালো বোনের দিকে।
– বল না বোন কি লাগবে?? একবার বল। সব দেবো তোকে।
– আমার বাবাকে দেখার সুযোগ আমার হয়নি। আমার মাকেও বুদ্ধি হবার পর জীবিত দেখবার সুযোগ আমার হয়নি। এর শাস্তি স্বরুপ আমি চাই ইরশাদ মির্জাকে যেন পৃথিবীর কঠিন শাস্তিটা দেওয়া হয়। পারবে না ভাইয়া??
ইনায়াতের কথা শুনে মুখে হাসি ফুটলো স্পন্দনের। ইনায়াতকে বুকে টেনে নিয়ে বললো,,
– একদম পারবো বোন। তুই বলেছিস আর হয়ে গেছে ধরে নে। ঐ ইরশাদকে আমি জঘন্য একটা মৃত্যু দেবো।
আফিমের মুখেও হাসি ফুটলো। তার প্রিয়তমা এখন ভালোবাসা,, আদর,, পরিবার এসবের ছোঁয়া পাবে।
– এই সম্পত্তি নিয়েই যখন এতো কিছু এই সম্পত্তি আমি চাইনা। আমাকে একটু তোমার কাছে থাকতে দেবে?? প্লিজ ভাইয়া?? আমি এই সমস্ত সম্পত্তির বোঝা নিজের থেকে আলাদা করতে চাই। প্লিজ ভাইয়া!!
ইনায়াতের এমন কথা শুনে অভিমান হলো স্পন্দন এর।
– এভাবে বলছিস কেন বোন?? তুই না চাইলেও আমি তোকে আমার কাছেই রাখতাম। আমার বোনকে আমি নিজের কাছে না রেখে কোথায় রাখবো?? এই সম্পত্তিও আমি দান করে দেবো। তুই আমার প্রিন্সেস হয়ে থাকবি,, আমার বেবি সিস্টার হয়ে থাকবি।
ভাই বোনের এই দৃশ্য দেখে আফিমের মনে পড়ে গেলো তারও একটা বোন আছে। আফিম মোবাইল বের করে আফরাকে একটা ছোট্ট মেসেজ পাঠালো ” ভালোবাসি বোনু “। এরপর মোবাইলটাতে খিচাখিচ কয়েকটা ছবি তুলে নিলো স্পন্দন ও ইনায়াতের। তাহজিব হালকা কেশে নিজের গলা পরিষ্কার করে সবার নজর নিজের দিকে টানলো। এতোক্ষন সে এই জিনিসটার জন্যই নিজেকে প্রস্তুত করছিলো।
– চাঁদ,,
চাঁদ নামটা সম্বোধন করেই চুপ হয়ে গেলো তাহজিব। একটু থেমে আবারও বললো,,
– মিস আজাদ!! আই এম সরি।
ইনায়াত অবাক হলো তাহজিবের হঠাৎ সরি বলাতে। স্পন্দনের মুখ শক্ত হয়ে এলো। এতোকিছুর মধ্যে সে ভুলেনি কিভাবে তার বোনকে ভয়ে ভয়ে বাঁচতে হয়েছে তাহজিবের জন্য।
– আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি তাই ভুল করে ফেলেছি। আফিম ছাড়া এখানে উপস্থিত সবাই কোনো না কোনো ভাবে ফ্যামিলি বঞ্চিত। আমিও তেমনই একজন। আমার মা খুব ভালো একজন মা ও স্ত্রী ছিলো। কিন্তু আমার বাবা?? সে ছিলো পশু,, জানোয়ার!! অনেক মেয়ের সাথে অবৈধ সম্পর্ক রেখে আমার মায়ের উপর ঘরে অত্যাচার চালাতো রুম বন্ধ করে। বাবার দেওয়া আঘাতগুলোর আওয়াজ যখন মায়ের চিৎকার আর হাহাকার,, আর্তনাদের সাথে মিশে আসতো কানে। শিউরে উঠতাম আমি। একদিন মাকে এতোই মারধর করলো রাগ ঝাড়তে। মা আর রুম থেকে বের হলো না। খুব ছোট ছিলাম আমি,, বয়স ছিলো ৭। গুটিগুটি পায়ে রুমে গিয়ে দেখলাম মা রক্তাত্ব পড়ে আছে মেঝেতে। মা প্রায়ই সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে যেতো। আমি ভেবেছিলাম এবারও তাই হয়েছে। অনেক ডাকলাম প্রতিবারের মতো মাকে। কিন্তু মা না আর কখনো উঠেনি। আমার জীবনের প্রথম অন্যায় আর খুন করেছি ৭ বছর বয়সে,, আমার বাবাকে নিজ হাতে খুন করেছি। যখন দেখলাম নতুন বিয়ে করে আনা স্ত্রীকেও সে কদিন যেতে না যেতেই অত্যাচার শুরু করলো। এরপর আস্তে আস্তে কখন যে এই জগতে চলে আসলাম আমি নিজেও জানিনা। আমার এই জগতে থাকাটাই তো একমাত্র কারণ ছিলো তুমি আমাকে মেনে না নেওয়ার। কিন্তু দেখো,, এই জগত থেকে সড়ে আসতেই আমার তোমাকে দরকার ছিলো,, ভালোবাসা দরকার ছিলো। তবে আমি জানি তুমি কেন আমার হওনি। কারণ তুমি আমার জন্য তৈরি হওনি। আমার জন্য রুহিই ঠিক আছে। যে বাচ্চামো আর সহজ সরল মনোভাবের জন্য তোমার কাছে আমি মন হারিয়েছিলাম। সেই একই জিনিসগুলো আমি রুহির মধ্যে খুঁজে পেয়েছি। আমার জন্য যে পাগলামি মেয়েটা করে বা করেছে বা করতে পারে। তা হয়তো আর কেও পারবে না।
তাহজিব এক এক করে বললো কিভাবে রুহির সাথে তার পরিচয়। কিভাবে রুহি তাকে সামলেছে। রুহিই যে ইনায়াতের খোঁজ দিয়েছে তা শুনে সবাই অবাক হলো। এই ছোট বয়সে এতোটা গভীর ভাবে ভালোবাসা কিভাবে সম্ভব। আসলে সত্যিই!! ভালোবাসা বয়স দিয়ে হয় না। যার মধ্যে ম্যাচুরিটি আসে যে বয়সে,,, সে সেই বয়সে ভালোবাসার অর্থ বুঝে। পুরো রুম নিস্তব্ধ হয়ে আছে। আফিমের এখন তাহজিবের জন্য খারাপ লাগছে। স্পন্দনের মুখেও রা নেই কোন। ইনায়াতের কান্না থেমে গেছে। স্পন্দনের বুকে নীরবে পড়ে আছে। স্পন্দন বললো আসলেই,, জীবন অনেক কঠিন হতে পারে। আমরা আমাদের জীবন কঠিন বলে আফসোস করি। কিন্তু বুঝে উঠি না এই যে আমার পাশের মানুষটার জীবন আমার থেকেও হয়তো কঠিন হতে পারে। আসিফ আর কামালের জীবনটাও যে সুন্দর তা নয়।তখন আসিফ বললো,,
– আসলেই তাই। আমার তো কোনো ফ্যামিলি আছে বলে কখনো জানারও সুযোগ পাইনি। আমি এতিম ছিলাম। তবে মজার বিষয় আমাকে এতিম খানা থেকে নিজের সব করার সামর্থ্য করে দিয়েছে তাহজিব স্যার। বড় ভাইয়ের মতো পাশে ছিলো,, বন্ধুর মতো নিজের চিন্তা আমাকে জানিয়েছে,, আমার চিন্তাগুলো নিজের করে ভেবেছে।
আসিফ বললো। আসিফের চোখে জল। তাহজিব আসিফের কাঁধে চাপড় মারলো হালকা হেসে।
– আপনার এই লাইনে আসবার কারণ কি কামাল ভাই??
ইনায়াত স্পন্দনের বুকে গুটিশুটি মেরে বসেই জিজ্ঞেস করলো বাচ্চাদের মতো। স্পন্দন ইনায়াতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আজ থেকে ইনায়াতের কোন বাঁধা রইলো না বাচ্চামোতে। সে একটা স্বাধীন জীবন পাবে। যেখানে সবমানুষগুলো তার মতোই,, আঘাত পাওয়া। ইনায়াতের প্রশ্নে মাথা নিচু করে হাসলো কামাল। স্পন্দন নিজেই বললো,,,
– এক নেতার রাগের স্বীকার কামালের পরিবার। কামালের বাবা একজন জার্নালিস্ট ছিলো। এক নেতার অপকর্মের উপর রিপোর্ট বানাচ্ছিলো। বানানো শেষ করবার আগেই মারা গেলো সে। কামালের বাসায় ঢুকে মেরেছে। কামালের বয়স তখন ১৮ ছিলো। ওকে মারধর করে আধমরা করে ওর সামনেই ওর মাকে ধর্ষন করা হয়। এরপর ওর মাকে মেরে ফেলা হয়। কামালকেও গুলি করেছিলো। ওর বাবাকে ঘরেই ফেলে রেখেছিলো। ওর মাকে ফেলেছিলো এক জায়গায়। আরো দূরে এক রাস্তায় কামালকে মৃত ভেবে ফেলে দিয়েছিলো। কেও খুঁজবে না ভেবে তিনজনকে তিন জায়গায় ফেলেছিলো তারা। ঐ রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিলাম আমি। মেডিকেল স্টুডেন্ট ছিলাম। কামালকে দেখেই তুলে নিই। ওকে বাঁচানোর পর সবটা শুনে ওর কাছে ওকে সাহায্য করলাম ঐ নেতাকে শেষ করতে। এরপর ওকে বলেছিলাম নিজের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে। আমি সব ব্যবস্থা করে দিতেও রাজি ছিলাম। কিন্তু পাগলটা ততোদিনে আমার সাথে থেকে থেকে,, আমার সবটা জেনে আমার মায়ায় পড়ে গেছিলো। আর গেলোই না। তখন থেকে ও আমাকে সামলেছে আমার ছোট ভাইয়ের মতো। কামাল তোরও ভাই এটা জেনে রাখ।
কামালের মুখে ফুঁটে উঠলো কৃতজ্ঞতা। চোখের জলেই স্পষ্ট যে,, সে খুব খুশী এই সম্মান পেয়ে। সবাই সবারটা বলছে দেখে আফিমের মনটা ভারী হয়ে এলো নীলার কথা মনে করে। তার বোনটাকে সে খুব ভালোবাসতো। আফিম মুখ খুললো।
– তাহজিব,,একটা কথা কি জানো??আমি ফ্যামিলি বঞ্চিত না। তবে আমিও তোমাদের মতো আঘাত পাওয়া। তাই আমাকে তোমাদের দলে টেনে নিতে পারো।তোমাদের থেকে কোনো অংশে কম আঘাত পাইনি আমিও।
আফিমের কথার অর্থ বুঝলো না কেও ইনায়াত ছাড়া। ইনায়াতের তো সবটাই জানা। ইনায়াতই তাই বলা শুরু করলো,,
– উনার জীবনটাও খুব একটা সহজ ছিলো না। নিজের বোনকে হারালো,,, ভুল মানুষকে ভালোবেসে আঘাত পাওয়া,, বন্ধুর কাছ থেকে বিশ্বাসঘাতকতা।
স্পন্দন ভ্রু কুঁচকে তাকালো ইনায়াতের দিকে। আফরা তো আছেই। আফরা হারায়নি তো। তাহলে কোন বোনের কথা বলছে বুঝলো না স্পন্দন। ইনায়াতই সবটা খুলে বললো আফিমের জমজ বোন নীলার ব্যাপারে। কনার বিশ্বাসঘাতকতা,, মাহিমের আঘাত সবটাই বললো ইনায়াত। এরপর আফরাকে খুঁজে পাওয়া,,,, নিজের বোনের জায়গা দেওয়া সবটা জানালো। রুমের সবাই স্তব্ধ। যে মানুষটা কম সহ্য করেছে ভাবলো সবাই। সেই মানুষটাই এক ধাক্কায় অনেক কিছু সহ্য করেছে ভেবে অবাক সবাই। আফিমের চোখের কোণে পানি। আফিম নিজের চোখের জল মুছে বললো,,
– স্পন্দন,,, সবটা জেনে আমার বোনকে ছেড়ে দেবে না তো?? জানি ছাড়বে না। তবুও ভাই তো!! যতোই খারাপ হইনা কেন বোনের জন্য কিছুতে ছাড় দিইনা।
স্পন্দন এতোক্ষন সবটা শুনে অবাক হলো। তার বৌটাকে এতোকিছু সহ্য করতে হয়েছে তার কোনো ধারনা ছিলো না স্পন্দনের। আফিমের কথা শুনে মৃদু হেসে বললো,,
– ভুলেও ভেবো না আমাকে ছাড়া অন্য কারোর হাতে ওর হাত দেবে।
আফিমও হেসে ফেললো। তাহজিব সহ সকলের মুখে হাসি। আর ইনায়াতের চোখে মুখে বিষ্ময়।
– মানে!!কিছু বুঝলাম না।
ইনায়াতের দিকে তাকালো সবাই। স্পন্দন জিহ্বায় কামড় দিলো। এরপর আদুরি গলায় বললো,,
– ইয়ে আসলে,,, আমি না আফরাকে পছন্দ করি বোন।
আফিম শয়তানি হেসে বললো,,
– শুধুই পছন্দ করা?? ভালোবাসো না?? বিয়ে করবে না?? আচ্ছা ঠিক আছে আমি অন্য কাওকে খুঁজে নিবো।
আফিমের কথা শুনে বাচ্চাদের মতো স্পন্দন দ্রুত বললো,,
– ভালোবাসি তো,, ঐটা আমার বৌ। অন্য কাওরে কেন দিবে ভাই??
স্পন্দন উত্তেজিত হয়ে কথাটা বলে ফেলার পর বুঝলো সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। সেকেন্ড পরেই উপস্থিত সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। স্পন্দন একটু লজ্জাই পেলো যেন। ইনায়াত কোমড়ে হাত রেখে বসে থেকেই বললো,,
– কিইই?? কবে থেকে চলছে এসব?? তুমি আমার ভাই এটা নাহয় আজকে বললে। কিন্তু ভাই তো তোমাকে আগেই মানতাম। তাও আমাকে বললে না?? পঁচা ভাইয়া। কথা বলবে না আর আমার সাথে।
ইনায়াতের কথা শুনে স্পন্দন মৃদু হাসলো। ইনায়াতের গাল টেনে বুকে জড়িয়ে নিতেই ইনায়াত নিজের মিথ্যে রাগ ভুলে হেসে ফেললো।
.
.
আস্তে ধীরে ঘুম ভাঙ্গলো রুহির। দীর্ঘক্ষণ চোখ বন্ধ রাখার ফলে হঠাৎ খুলতে কষ্ট হলো। ভারী হয়ে আছে চোখের পাতা। কয়েকবার চোখ পিটপিট করে চোখের সামনের ঝাপসা ভাবটা কাটিয়ে উঠলো। শরীরটা ভারী লাগছে খুব। বুঝতে পারছে দুইদিন ফ্রেশ না হবার ফলে এই অবস্থা। গুটিগুটি পায়ে বিছানা থেকে নেমে তাহজিবের কাবার্ড থেকে নিজের জামা নিতে এগিয়ে গেলো। যে দশদিন এখানে ছিলো তাহজিব রুহির জন্য জামা কিনে এনেছে। কিছু জামা একদম ঢোলা হয় রুহিকে আর কিছু জামা পার্ফেক্ট। রুহি অবশ্য এতেই খুশী যে,,তার জন্য জামা এনেছে তাহজিব। সেখান থেকেই একটা জামা নিয়ে সোজা ঢুকে পড়লো ওয়াসরুমে। দ্রুত স্নান সেড়ে বের হয়ে ঘড়ি দেখলো। লাঞ্চ টাইম পার হয়ে গেছে অনেক আগে। কেও নিশ্চয় খায়নি। শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে বুঝলো পুরো রুমটা ঠিক তেমনই গোছানো আছে যেভাবে সেদিন সকালে সে গুছিয়ে গিয়েছিলো। অর্থাৎ তাহজিব নাওয়া খাওয়া করেনি। দ্রুত পায়ে বের হয়ে আসলো রুম থেকে ড্রয়িং রুমের দিকে চোখ যেতেই দেখলো সবাই বসে আছে। বুঝলো সবাই লাঞ্চের কথা ভাবতেও ভুলে গেছে। রুহি কিচেনে গিয়ে পাস্তা বানিয়ে নিলো দ্রুত হাতে। পাস্তা,, চিকেন নাগেটস,,চিকেন ফ্রাই আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই করে,, সার্ভেন্টকে রেডি করে টেবিলে দিতে বললো। এরপর রুহি এগিয়ে এলো ড্রয়িং রুমে।
– শুধু কথা বললেই হবে?? সবার কিছু খেতেও তো হবে।
রুহির কন্ঠস্বর শুনে সবাই সেদিকে তাকালো। তাহজিব দ্রুত হাতঘড়ি দেখলো। আড্ডায় যে প্রায় ৪ ঘন্টার মতো সময় পার হয়ে গেছে বুঝলোই না। পরক্ষনেই রেগেমেগে তাকালো রুহির দিকে।
– তুমি খাট থেকে নামলে কেন?? আর এই অসময়ে গোসলের মানে কি?? চুল থেকে এভাবে পানি পড়ছে কেন?? খিদে পেয়েছে তোমার??
তাহজিবের এমন অবস্থা দেখে সবাই মুখ টিপে হাসছে। তা তাহজিবের চোখে না পড়লেও রুহির চোখে পড়লো। রুহির এখন রীতিমতো লজ্জা লাগছে তাহজিবের এমন কান্ডে। তবে এখন তার লজ্জা পাওয়ার সময় নেই। সবাই না খেয়ে আছে। তাই রুহিও কপট রাগ দেখিয়ে বললো,,
– তোমার নাহয় খিদে পায় না। তুমি ভীনদেশী এলিয়েন। কিন্তু এরা তো মানুষ। লাঞ্চের টাইম পার হয়ে গেছে জানো?? আর আমি জানি যে তোমার খেয়াল নেই ওদের লাঞ্চের কথা জিজ্ঞেস করবে তা।
তাহজিবের নিজেরও মনে হলো সত্যি তো!! লাঞ্চের টাইম চলে গেছে আর সে জিজ্ঞেসও করলো না?? তাহজিব হালকা লজ্জাই পেলো নিজের কাজে। রুহি বিষয়টা বুঝতে পেরে বললো,,
– এখন যাও ফ্রেশ হয়ে নাও দ্রুত। আসিফ ভাইয়া,, তুমি ভাইয়াদেরকে রুম দেখিয়ে দাও আর ফ্রেশ হয়ে নাও। আর আপু,, তুমি এসো,, আমি তোমাকে জামা দিচ্ছি। পাক্কা একদিন বন্দী ছিলে। তাই ফ্রেশ হয়ে নাও,, রিলেক্স লাগবে।
তাহজিব রুহির চোখের আড়াল হতে দ্রুত উঠে দাঁড়ালো। স্পন্দন,,আফিম আর কামালের দিকে তাকিয়ে বললো,,
– ভালো কথা। চলো তোমরাও ফ্রেশ হয়ে নাও।
সবাই মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো। আসিফ সবাইকে রুম দেখাতে নিয়ে গেলো। আর তাহজিবও নিজের রুমে চলে গেলো। রুহি তাহজিবের রুমে গিয়ে একসেট কাপড় নিয়ে এলো ইনায়াতের জন্যে যা তাকে খুব বড় হয়। ইনায়াতকে রুম দেখিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিতে বললো। তাহজিব সব ছেলেদের জন্য কাপড় পাঠালো কামাল ছাড়া। আসিফ প্রায়ই এখানে থাকে বলে তার জামাকাপড় এখানেই ছিলো। কামালের জন্য কাপড় সেই পাঠালো। কেননা কামাল আর আসিফের হাইট একই। তাহজিব,, আফিম আর স্পন্দন একটু লম্বা আসিফ আর কামালের থেকে। স্পন্দন,, আফিম আর কামাল প্রথমে নিতে না চাইলেও বাধ্য হয়ে নিলো।
.
.
সবাই ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে আসার সময় হয়ে এলো । রুহি ততোক্ষনে সব খাবার প্লেইটে প্লেইটে দিচ্ছে। সবাই আসার আগে তাহজিব এসে গেছে। রুহিকে কাজ করতে দেখে তাহজিব বললো,,
– তোমার শরীর ভালো নেই। তাও কেন ঢুকলে রান্নাঘরে?? কি সমস্যা তোমার??
– তুমি যদি এতো বুড়ো হয়েও নিজের খেয়াল রাখতে না পারো তাহলে আমাকে দৌড়াতেই হবে।
তাহজিব গাল ফুলিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো,,
– আমি বুড়া?? তাহলে এই বুড়াকে ভালোবাসো কেন??
– কি করবো বলো?? ভুল তো মানুষের হয়েই যায়। তবে এখন ইনায়াত আপু এসে গেছে তো। ব্যাপার না!! সব বুঝিয়ে দেবো তাকে।
রুহির বুঝতে দেরি নেই যে তাহজিব তাকে নিজের মনে জায়গা দিয়ে দিয়েছে। বিষয়টি কিডন্যাপ হবার পর তাহজিবকে কল দিয়ে তাহজিবের গলার স্বর আর বলা কথা শুনেই বুঝে গেছিলো রুহি। কিন্তু এখন তাহজিবকে কয়েকদিন খোঁচা তো রুহি দেবেই। এতোদিন পর এসে যখন বুঝেছে কয়েকদিন খোঁচা খাক।
– শুনো!! আমার ইনায়াতকে লাগবে না। ওর নামের পাশে খান স্যুট করবে না।
তাহজিবের কথা শুনে রুহি বোকা বনে গেলো। ” এত্তো গেঁড়ো কেন মানুষটা?? ভালোবাসে বা ভালোলাগে বললে কি মুখের চামড়া খুলে যাবে?? ” ভাবলো রুহি মনে মনে। রেগেমেগে তাহজিবের দিকে তাকিয়েই মুখ ফিরিয়ে নিলো। তাহজিব সবগুলো দাঁত দেখিয়ে ক্লোজআপ মার্কা এড শুরু করতে না করতেই সবাই চলে এলো। তাহজিবও হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে নিজের ফর্মে ফিরে গেলো। রুহি সবাইকে সিটে বসতে বললো।
– রুহি তুমি আমার ছোট বোনের মতো। তুই করে বললে রাগ করবে না তো??
ইনায়াত হাসি মুখে জানতে চাইলো। রুহি ভ্রু কুঁচকে তাকালো ইনায়াতের দিকে। রুহির এমন মুখভঙ্গী দেখে সবার হাসি হাসি করে তাকানো মুখ চুপসে গেলো। এমনকি ইনায়াতের মুখেরও অবস্তা খারাপ। রুহি ভ্রু কুঁচকে সবার বাটিতে সস দিতে দিতে বললো,,
– ছোট বোনকে জিজ্ঞেস করে তুই কে বলে?? আমি দেখিনি তো কোনো বড় বোনকে এমন করতে!!
সবাই হেসে উঠে । ইনায়াতও হেসে উঠলো । শুরু হলো ইনায়াত আর রুহির গার্লস টকিং। ছেলেরা সবাই একবার সেদিকে তাকিয়ে দেখলো ” নো এন্ট্রি ” দেওয়া। কারণ বর্তমানে রুহি আর ইনায়াত নেলপলিশের কালার থেকে পার্ফিউমের ব্র্যান্ড নিয়ে কথা বলে দুনিয়ে উলটে দিচ্ছে। তাই ছেলেরা নিজেদের মধ্যে কথা চালাবে ভাবলো।
– আজকে কিন্তু থেকে যাবেন স্পন্দন। আশা করি নাম করে বলছি বলে মাইন্ড করবেন না।
তাহজিব বললো। স্পন্দন মৃদু হেসে বললো,,
– আসিফ আর কামাল বয়সে ছোটই হবে। কিন্তু আফিম,, আমি আর তুমি সমবয়সী। তাই অতো ফর্মাল হওয়ার দরকার নেই। তুমি করে বলো,, আর নাম ধরে ডাকো। ভালো হবে।
– আমার কোনো প্রব্লেম নেই।
তাহজিব মুচকি হেসে বললো। আসিফ আর কামাল ততোক্ষনে নিজেদের মধ্যে ভাব জমিয়ে নিয়েছে। তারা নিজেদের আড্ডা চালাতে ব্যস্ত। আফিমের মধ্যে হালকা অস্বস্তি দেখা যাচ্ছে। বিষয়টা সবার আগে চোখে পড়লো তাহজিবের।
– এনি প্রব্লেম আফিম??
আফিম দ্রুত মাথা তুলে তাকালো তাহজিব আর স্পন্দনের দিকে। স্পন্দনও ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে আফিমের দিকে। আফিম হালকা অস্বস্তি নিয়ে বললো,,
– আসলে আমি সমবয়সী ছেলেদের সাথে অতোটা ভালো যাইনা। মাহিম যা করলো এরপর থেকে ভয় হয়। নিজের অজান্তেই ছেলেদের আশেপাশে থাকা,, বন্ডিং ক্রিয়েট করা,, ইনফর্মাল,, ফ্রেন্ডলি বিহেব করতে ভয় হয়। ইনায়াত আমার কাছে ছেলে হিসেবেই এসছিলো। বয়সে ছোট ছিলো বলে তার সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে। আর তাছাড়াও ইনায়াত নিজেও কিভাবে যেন পুরোটা দখল করে নিলো আমার জীবন।
তাহজিব আর স্পন্দন বিষয়টা বুঝলো। স্পন্দন তখন নিজেই বললো,,
– লিসেন!! ফ্রেন্ডশিপ,, আড্ডা,, ইনফর্মাল বিহেভিয়ের আর বন্ডিং এসব নিয়ে তোমার ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু কতোদিন আগের কথা ধরে বসে থাকবে?? লাইফে মুভ অন করা প্রয়োজন।
আফিম মৃদু হাসলো সম্মতিসূচক ভাবে।
কি পাঠক ও পাঠিকারা??? পর্ব কেমন লাগলো?? স্পন্দন,, আফিম আর তাহজিবের একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক কে কে আশা করছো?? সব জুটির মিল হবে। সবুর করো সবাই। আর আজকের পার্ট নিয়ে কি বলবে?? ২৯৬৭ টা শব্দের শুধু গল্প,, টাইটেল,, রাইটার নেইম,, পর্ব আর নিচের এই লেখা বাদে। এরপরেও ছোট হইসে বলে কান্না করবা ইনবক্সে তোমরা?? 😐
যাহোক সবই হবে। কিন্তু….
চলবে,,