ছাদ পর্ব-০২

0
154

#দ্বিতীয়_পর্ব
#ছাদ
#অনিন্দিতা_মুখার্জী_সাহা
Feminine Wisdom (কলমে অনিন্দিতা)

দ্বিতীয় পর্ব

” কিছু আছে আজ অফিসে ? ” – জিজ্ঞেস করলো জয়া। নিলয়ের দিকে এবার সরাসরি তাকালো ! আজ বেশ লাগছে নিলয়কে ! অফিসে সাধারণত কালো রংয়ের বা গাঢ় রংয়ের শার্ট পরেনা ও! সবসময় হালকা রংই পছন্দ করে অফিসের জন্য।

কিন্তু কালোতে বড্ডো উজ্জ্বল লাগে নিলয়কে। পাড়ার রুমকি দিদির বিয়ের সময় প্রথম যখন ওর বর প্রভাত দাকে দেখেছিলো জয়া তখন থেকে বর শব্দটার সম্পর্কে পরিচিত হয় ! বর মানে বৌয়ের আবদার রাখা , বৌকে মাথায় তুলে রাখা ! বৌকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া !হেসে হেসে গল্প করা মানে প্রভাতদা তো এরকমটাই করতো রুমকি দিদির সাথে ! কত বয়স হবে তখন জয়ার! চোদ্দ !

মাধ্যমিক দিয়েছে তখন ! শাহরুখ খান তখন ওর মন জুড়ে কত কি স্বপ্ন দেখাতো ! জয়াকে ভালো লাগতো অনেকেরই কিন্তু জয়ার ! না পায়নি সেরকম কারোকে ! যে প্রভাতদার মতো সবসময় আগলে রাখবে ওকে ! রাখে তো আগলে নিলয় ! বড্ডো আগলে রাখে জয়াকে ! এমন আগলে রাখে মনে হয় শেকল দিয়ে বাধা আছে ও !

” কি ম্যাডাম কি দেখছো অমন করে ?” – নিলয় জিজ্ঞেস করলো জয়াকে ! তাতে জয়া একটু লজ্জা পেলো বোধহয় ! এমন ড্যাবড্যাব করে ছেলেদের দিকে তাকানোর অভ্যেস জয়ার নেই। নিজেকে সামলে নিয়ে বললো ” বললে না আজ অফিসে কি আছে ?” জয়া সাধারণত কোনো প্রশ্ন মনে এলেও করেনা ! কারণ তার সেরকম উত্তর পায়না ও ! তখন বড্ডো মানে লাগে ! আসলে নীলাজিৎ সিকদার কারোর কাছে কোনো জবাব দেবে না ! এরকমটাই একদিন নিলয় নিজে বলেছিলো ! জয়াকে নয় ফোনে, কারোকে !

” আজ আমার অফিসে একটু পায়ের ধুলো দিতে হবে আপনাকে !” -জয়ার ঘাড়ের কাছে এসে বললো নিলয় ! চশমা পরা ছেলে খুব পছন্দ করতো জয়া ! যেমন যেমন স্বপ্নে দেখতো ঠিক তেমনি এই নিলয় ! কিন্তু স্বপ্নের মানুষটা ও নয় ! ” বলো যাবে না ?” – আবার জিজ্ঞেস করলো নিলয় !

নিলয়কে এতো রোমান্টিক হতে আগেও দেখেছে জয়া !জয়াও সাড়া দিয়েছে তাতে ! কিন্তু ভুল করেছিল। মস্ত ভুল ! নাহলে সেই রাতটা এতো ভয়ঙ্কর হতো না ! সত্যি প্রচন্ড অসুস্থ ছিল সেদিন জয়া ! মাথা তুলতেই পারছিলো না ! এরকমই রোমান্টিক হওয়ার চেষ্টা করেছিল নিলয় ! জয়া সাড়া দেয়নি ! মানে দিতে পারেনি। এতটাই অসুস্থ ছিল যে সেই ক্ষমতাটাই ছিল না।

” আজ ওমেন্স ডে ডিয়ার! আজ তোমাদের দিন ! তাই আমার অফিসে আজ তোমার নিমন্ত্রণ ! তুমি এসে আমার অফিসের সমস্ত উইমেন্স দের তোমার মিষ্টি হাত দিয়ে সম্বর্ধনা দেবে !আমি এটাই চাই ! ” – চিবিয়ে চিবিয়ে কথা গুলো বললো নিলয় ! উইমেন্স ডে! মানে নারী দিবস ! তার জন্য মেয়েদের সম্মান দেবে নিলয় ! তাও আবার কাকে দিয়ে -জয়াকে দিয়ে ! এতটা সম্মান করে ও জয়াকে !
তাহলে সেদিন কি হয়েছিল ! ঐদিন রাতে ! যখন গায়ে জ্বর নিয়ে সাড়া শরীর ব্যাথা নিয়ে বিছানায় পড়েছিল ! অনেকবার না করেছিল জয়া ! কিন্তু যত না করছিলো তত গায়ের জোর বাড়ছিল নিলয়ের ! সেই যন্ত্রনা যেন আজও শরীরের কোথাও বেঁচে আছে।

আর কোথাও না থাক এই মনে আছে ! মন জুড়ে যে তীব্র যন্ত্রণা সেটা কি করে ভুলে যাবে জয়া ! গায়ের যন্ত্রণা তো প্যারাসিটামল ভুলিয়ে দেয় কিন্তু মন! অপমান!

” উফফ সারাদিন কি যে এতো ভেবে চলেছো! যাই হোক আমি বেরোলাম। ভুলে যেও না ঠিক সাড়ে বারোটা!গ্ল্যামার্স ওয়ার্ল্ডের সুমি দি লোক পাঠাবে, ওঁর পার্লারেরই – যা যা করানোর করিয়ে নিও! ফেসিয়াল, পেডিকিওর, ম্যানিকিওর, যা যা লাগবে! আজ কিন্তু বেস্ট লুকটা চাই! মিসেস নীলাজিৎ তুমি! বুঝতে পারছো গ্ল্যামারটা! কত মেয়ে আছে যারা এই পদটা পাওয়ার জন্য মুখিয়ে ছিল!

“পদ মানে? “- বিস্ময়ের তুঙ্গে জয়া। পদ? বউ একটা পদ? মানে পোস্ট? এটা কি কোনো চাকরি? অফিস? অবাক হয়ে যাচ্ছে জয়া। বিয়ের এক বছর চার মাসে এসেও রোজ কিছু না কিছু কারণে অবাক হচ্ছে জয়া!
” পদ, পদ মানে পোস্ট! আমরা যে যেই ভূমিকায় আছি সেটা তো একটা পোস্টই! যাইহোক তুমি তাড়াতাড়ি এসো! অপেক্ষায় থাকবো! বুঝলে মিসেস নীলাজিৎ!”

বলেই ঠকঠক করে হেঁটে গেল নিলয়। ছেলেদের হাঁটাতেও যে এতো জোর আছে এর আগে জানতো না জয়া। এই জোর শুধু উঁচু শু – তলার জন্য নয়- ব্যক্তিত্ব, আত্মবিশ্বাস, অহং বোধ, উচ্চাকাঙ্খা আর মানুষকে অবজ্ঞা সব মিলিয়ে এমন মিশ্র একটা শব্দ সবসময় পাওয়া যায় যখনই হেঁটে যায় নিলয় ।

জয়া বেখেয়ালে কত কি ভেবে চলেছে। সিকদার ভবনের তিনতলার পুব দিকের বিশাল ঘরটায় দাঁড়িয়ে কত কি ভাবছে! এরকম একটা বাড়িরই তো স্বপ্ন দেখতো জয়া। সুখ, টাকা, কি নেই জয়ার। ওর এতো এতো বন্ধু – স্কুল কলেজ, পাড়ার সবের মধ্যে আজ জয়া সবচেয়ে ধনী। কি নেই ওর!

বাড়ি, গাড়ি, গয়না, নাম! নাম? কিসের নাম! আজকাল তো ওর নামটাই হারাতে বসেছে। বাইরের সবাই মিসেস সিকদার বা মিসেস নীলাজিৎ এই এখন জয়ার পরিচয়।

বাবার দেওয়া জয়া যেন হারিয়ে যাচ্ছে রোজ রোজ। বাবার কথা আবার মনে পড়লো জয়ার। হাতের থেকেও বড় সাইজের ফোনটা থেকে বাবাকে ফোন করলো জয়া।

রিং হচ্ছে। অনেকবার হওয়ার পর কাঁপা কাঁপা গলায় মা ডাকটা শুনতে পেলো জয়া!চোখ দুটো বুজে ফেললো জয়া! এই ডাকটাই যে এমন।

মা, মা রে! জয়া মা – ডাকতে ডাকতে ডাকতে ঢুকলেন প্রতাপ। পরনে ধুতি খালি গা পায়ের চটি টা বোধহয় এই ছিঁড়লো! কিনতে বললেই একই কথা কি দরকার অপচয়ের! মাঠে ঘাটে এই ঠিক আছে!

” মা রে জল দে ” – পাশেই বসে আছে রত্না কিন্তু হবে না! মাঠ থেকে এসে মেয়ের হাতের এক গ্লাস জল না খেলে তেষ্টা যেন মেটেই না প্রতাপের। বাড়ির উঠোনে ততক্ষনে প্যান্ডেল বানানো শেষ। লাল নীল সবুজ কাপড় দিয়ে কি অপূর্ব প্যান্ডেল হয়েছে। উঠোন জুড়ে রঙিন প্যান্ডেল। মস্ত আয়োজন। হবে না! বাড়িতে
বিয়ে বলে কথা! উঠোনের একদিক জুড়ে রান্নাবান্নার দারুণ আয়োজন। লুচি, ছোলার ডাল, ভাত, মাছ, মাংস কি নেই! জয়াও যে কি সাংঘাতিক ব্যস্ত সকাল থেকে! ওরই তো বেশী ব্যস্ত হওয়ার কথা! কারণ মেয়েটা যে ওরই। তাই দায় কম!

” জয়া বাবা জল চাইছে! এসে দে! ওঁর তো আবার তোর দেওয়া জল না খেলে গলা পরিষ্কার হবে না!” – রত্না বারান্দায় বসে সলতে পাকাতে পাকাতে বললো! জয়া তখন ওর মেয়েকে কোলে বসিয়ে গায়ে হলুদ দিচ্ছিলো! রান্নাঘর থেকে হলুদ এনে সেটায় বেশ করে জল মিশিয়ে কাদা বানিয়েছে জয়া। আর তা দিয়ে মেয়ের গায়ে হলুদ হচ্ছে আজ।

” মা দাঁড়াও তো! বাবাকে আজ তুমি জল দিয়ে দাও! দেখছো আজ কত ব্যস্ত আমি!” – জয়ার কথায় গলা চড়ালো রত্না। ” ব্যস্ত না ছাই! আমার পরিষ্কার শাড়িগুলো বিছিয়ে নোংরা করছে। মেয়ের বিয়ে দেবে! দেখো সারাদিন জলা জমি ঘুরে গোল গোল পাতা এনে লুচি বানিয়েছে! জানো জলা থেকে ছোট মাছ গুলো ধরে মেরে মাছের ঝোল বানাচ্ছে। গুগলি গুলো নাকি মাংস।

রত্না মুখ বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে বলছে আর হেসে গড়িয়ে যাচ্ছেন প্রতাপ।
” ছাড়ো গো মেয়েমানুষ খেলে নিক একদিন তো নিজেরই সংসার হবে। তখন আর বালির ভাত না দামী চালের ভাত বানাবে। নিজের হাতে আয়োজন করে দেখবে তোমাকে কেমন খেতে দেয়! ” প্রতাপের কথায় রত্না রেগে বললো ” মেয়েকে এতটা আস্কারা দিও না! তোমার আদরে মেয়ে কিন্তু ধরাকে সরা জ্ঞান করছে! বলে কিনা মেয়ের বিয়ে দেবে কিন্তু ছেলের বাড়ি পাঠাবে না! মেয়ে বিয়ের পর এই বাড়িতেই থাকবে! কে দেখবে এতো জমি বাড়ি!”

রত্নার কথায় আবার হেসে ফেললো প্রতাপ। এ তো ওঁরই কথা! ওই তো বলে মেয়েকে বিয়ে দেবে না! বিয়ে দিলেও এই বাড়িতে রেখে দেবে! দরকার পড়লে জামাই এসে থাকবে এই বাড়িতে! মেয়ে জামাই বউ সব স্বপ্ন কেমন ছারখার হয়ে গেল প্রতাপের।কি হয়েছিল আজও জানে না জয়া। শুধু মনে আছে পাশের পারুল পিসিমণি গিয়ে ডেকে এনেছিল স্কুল থেকে। জয়া চল মা শিগগির চল দেখবি চল তোর মা জ্বলে যাচ্ছে জয়া! চল মা!……

চলবে।