#জগন্নাথ_হোটেল
#অনিন্দিতা_মুখার্জী_সাহা
#প্রথম_পর্ব
Feminine Wisdom
দ্বিতীয় বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রায় হন্তদন্ত হয়ে দৌড়াচ্ছে সবুজ। ঘড়িতে সাড়ে দশটা বাজে ! পঞ্চুদা তো চিৎকার করে মাথা খেয়ে নেবে ! ভয়ে ভয়ে দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালো সবুজ! বড় বড় করে লেখা জগন্নাথ হোটেল! যতই ঠাকুরের নাম দিক পঞ্চুদা কী আদৌ ভালো মানুষ! এক্ষুণি কত কথা শোনাবে সবুজকে দেরি হয়েছে বলে!
কি করবে সব সবুজ! প্রথম পড়ানোর বাড়িতেই ঢুকতে ঢুকতে সাড়ে সাতটা বেজে গেছিলো আজ ! বেরোনোর আগে বাবার এমন জ্বর এলো, কী করে ফেলে আসতো ! এমনিতেই অমন একটা রোগ বহন করছে!
যেখানে ও সাড়ে ছটায় ঢোকে ! সময় পুরো বাধা ! প্রথম বাচ্চাটাকে সাড়ে ছটা থেকে আটটা আরেকটা বাড়িতে সাড়ে আটটা থেকে দশটা ! একটু জোরে সাইকেল চালিয়ে দশটা দশে পঞ্চুদার দোকানে ঢুকে যায় সবুজ !
ওর বাড়ির এই অবস্থা দেখে পাশের পাড়ার পঞ্চুদা নিজে এসে বলেছে ওর হোটেলের ক্যাশ কাউন্টারটা সামলাতে! আসলে ও নিজে আরেকটা হোটেল খুলেছে সিঁথিতে সেখানে থাকবে! এখানেও ছোট্ট ভাতের হোটেল পঞ্চুদার! সারাদিন সেখানকার হিসেব নিকেশ করতে হবে শুনে খারাপ লাগেনি সবুজের কাজটা!
বাবা মানে প্রভাতও বেশ খুশি জেনে যে একাউন্টস নিয়ে পড়া ওঁর ছেলেটা যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পেয়েছে! সেভাবেই চলছিল! পঞ্চুদা সকালে এই দোকানে এসে ঘন্টা খানেক থাকে তারপর সবুজ ঢুকলেই বেরিয়ে যায় নতুন হোটেলটায়! সারাদিন ক্যাশ বাক্স সামলানোর দায়িত্ব সবুজের! খারাপ কাটছিলো না দিনগুলো! অভাব থাকলেও শান্তি ছিল কিন্তু এখন! হঠাৎ দোকানের বাসন মাজার মেয়েটা ছেড়ে দিলো! একদিন অনুরোধ করলো পঞ্চুদা বাসন গুলো সবুজকে মেজে দেওয়ার জন্য!
অতিরিক্ত টাকার লোভে কাজটা করতে গিয়ে সেই দায়িত্ব ধীরে ধীরে সবুজের ওপর এসে দাঁড়ালো! ক্যাশ বাক্সের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে সোজা রান্নাঘরের বেসিনে! সারাদিন এঁটো থালা ধুচ্ছে সবুজ! রোজ মনে হয় আর যাবেনা! একটা গ্র্যাজুয়েশন করা ছেলে শেষে কিনা বাসন ধোবে! কিন্তু যখনই মনে পড়ে বাবা অসুস্থ! তারপর মাস গেলে চারটা হাজার টাকা! তখন আর কোনো কাজই ছোটো মনে হয় না! কম লোককে বলেছে একটা ভালো কাজের জন্য!
” পঞ্চুদা বাবার খুব জ্বর গো!” – এইটুকু বলতেই পঞ্চু থামিয়ে বললো ” সেসব পরে শুনবো আগে রাতের বাসনগুলো মাজ! কতবার বলেছি! কাজ ফেলে রেখে যাস না! রাতের বাসনগুলো সব মেজে গেলে তো ঝামেলাই থাকেনা! এই তো এগারোটা থেকে লোকজন ভরে যাবে!” – পঞ্চু মিষ্টি কথায় বলছে ঠিকই কিন্তু শব্দের সাথে সাথে মুখের অভিব্যক্তিটা বেশ বুঝতে পারছে সবুজ পুরো বিষ!
” কী করবো তোমার এখান থেকে গিয়ে রাতে আরও দুটো পড়াই আবার, তাই তো চলে যাই !” – সবুজের কথায় এবার বেশ রেগে পঞ্চু বললো ” হুম ওই কর! বাচ্চাদের ওয়ান টু শেখা! ঐসব করে কী হবে, কত টাকা দেয় ওরা!”
পঞ্চুদার কথাগুলো শোনার জন্য আর দাঁড়ায় না সবুজ! এখন যা সব বলবে মাথা আগুন হয়ে যাবে! শুধু পড়ায় বলে এই কাজটা পুষিয়ে যায়! নাহলে গ্র্যাজুয়েশন করে বাসন মাজা! আবার চোখ ফেটে জল এলো সবুজের! মনোজদা বলেছিলো জি এস টি টা শিখিয়ে দেবে! ট্যালি টা দেখিয়ে দেবে তাহলে দু একটা কোম্পানিতে গিয়ে একটু দাঁড়াতে পারবে চাকরির খোঁজে! মনোজদা বলে যা বাজার এখন গ্র্যাজুয়েশনটা কোনো যোগ্যতাই নয়!
বাসন মাজতে মাজতে দেখলো পাশের ঘরে রান্না শেষ প্রায়! মানদা মাসি রান্না করে এই হোটেলে! রোজ একই- এক নৌকো পেঁয়াজের লাল ঝোল! যে যা চায় তাতে মিশিয়েও দিয়ে দেয়! রুই, কাতলা, ট্যাংড়া, ত্যালাপিয়া, ডিম, মুরগি! আর একটা পেঁয়াজ ছাড়া ঝোল সেটাই যখন যেমন দরকার আলু পটল, সয়াবিন, পনির! সাথে ডাল এক নৌকো আর আলু-উচ্ছে ভাজা! সকাল ন’টা থেকে রান্না চলে! আগেরদিনের থেকে যাওয়া ঝোল আবার মিশিয়ে তাতে আরেকটু নুন লঙ্কা দিয়ে সাংঘাতিক কেরামতি মানদা মাসির! আর তাতে খুব খুশি পঞ্চুদা!
এদের দেখে মনে হয় সবুজের লোক ঠকানো কত সহজ! আর সত্যি তো খায় কারা – পাশের লোহা কারখানার মজুররা! যাদের কাছে সব অনুভূতিগুলো একই! ওখানে একটা কাজ পেয়েছিলো সবুজ, কিন্তু দিন মজুর হতে চায়নি ও!
কেন চাইবে ও! মা হারা ছেলেটাকে তো স্বপ্ন দেখিয়েছে বাবাই – আকাশ ছোঁয়ার! অনেক ছোটবেলায় মা মারা গেছে ওর! সেই থেকেই বাবা-ই বাবা আবার বাবা-ই মা! রান্না থেকে অফিস করা – সব বাবা একা! আজ যখন সেই মানুষটা মুখ থুবড়ে পড়েছে! হার্টের সমস্যা, সুগার, প্রেসারে জর্জরিত তার জন্য হাসতে হাসতে বাসন মাজতে পারে সবুজ!
এখন কোনো দিকে তাকাবে না ও! ওর একটাই লক্ষ্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাবার হার্টের অপারেশনটা করিয়ে ফেলা!
বাসন মাজতে মাজতেই সামনের ছবির দিকে চোখ গেলো সবুজের! প্রেমিকাকে নিয়ে দিব্বি সুখে আছেন ভদ্রলোক! কে দুঃখে আছে কে সুখে আছে ওঁর সেদিকে খেয়াল নেই! এদিকে বড় বড় বুলি! গাল ভরা তার আবার নাম রেখেছে মহাভারত! আরে ভাই পয়সা থাকলে সব ধর্ম জ্ঞানই হজম হয়! পকেটে একটা টাকা নেই ধর্মজ্ঞান!
এইচ. এস পাস করার পর গীতা নিয়ে মহাভারত নিয়ে খুব জ্ঞানী হতে চেয়েছিলো সবুজ! খুব নৈতিক বোধ জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলো! আর শ্রীকৃষ্ণ ছিল ওর পথ প্রদর্শক! কিন্তু বুঝেছে সবুজ যখন রাতে খাবারের জ্বালায় পেট ডাকে তখন এই মানদা মাসির বেঁচে যাওয়া ভাতটাই লুকিয়ে নিয়ে যেতে হয়! অসুস্থ বাবার মুখে দুটো দানা তো পড়লো! চুরি করা মহাপাপ!
এই নীতিটা এখন ভিত্তিহীন মনে হয় সবুজের! তাড়াতাড়ি করে হাত চালাচ্ছে সবুজ! সামনে এখনো অনেক বাসন! সহ্য হচ্ছে না কিছু! পেট খিদেয় চুঁই চুঁই করছে! সেই সকালে এক কাপ লিকার চা আর দুটো বিস্কুট, প্রথম বাড়িতে এইটুকুই পায় আর দ্বিতীয় বাড়িতে পড়াতে গেলে টুকটাক টিফিন দেয় সেটা মাঝে মাঝে! আর মাঝে মাঝে দেয়না আজ সেরকমই একটা দিন! এখন মানদা মাসিকে বললে একটু ভাত হয়তো দেবে, কিন্তু কত কথা শোনাবে!
মাঝে মাঝে মনে হয় এর থেকে বোধহয় লোহার কারখানায় ঢুকে গেলেও ভালো হতো! সম্মান আর কত বাঁচাতে পেরেছে ও!
” আজিব দাস্তাঁ হ্যায় ইয়ে, কাঁহা শুরু কাঁহা খতম…..!”
রেডিওতে গান বাজছে! পঞ্চুদার এই এক স্বভাব! সারাদিন গান চালিয়ে রাখে! কখনও মন ভালো থাকলে ভালো লাগে কখনো মন অস্থির থাকলে এই গান গুলোই বিষ লাগে! কিন্তু ওই যে কর্তার ইচ্ছেতেই কর্ম! গান তারপর ওই রেডিও জকি গুলোর ভাঁড়ামো! হুম ওরকমই লাগে আজকাল সবুজের সব কিছু! অথচ আগে একটা চিরুনিকে মাইক বানিয়ে কত কী বলতো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে !
একবার স্বপ্ন ছিল রেডিও জকি বা অ্যাঙ্কার হবে! কত স্বপ্ন এলো আর গেলো এখন ও জগন্নাথ হোটেলের বাসন মাজার লোক!
” সত্যি জীবনকে প্রেডিক্ট করা যায়না!
ওই শুরু হলো আবার -জকির বাতেলা! ভাবতে ভাবতেই শেষ বাসনটা মাজলো সবুজ!
“জীবন যে কোন দিক থেকে কোন দিকে ঘুরে যাবে কেউ জানে না! আপনি কী জানেন যে আপনার ভাগ্যেই এবার আছে পুরীতে জগন্নাথ দর্শন করার সুযোগ! বুঝলেন না তো! এই বছর ‘জগন্নাথ সেবা সংঘ’ গরিব, অসুস্থ ও বৃদ্ধদের জন্য রথযাত্রা দর্শনে বিশেষ বাস চালাচ্ছে। নির্দিষ্ট আবেদন ফর্ম পূরণ করে বাছাই হলে পুরী দর্শনের সুযোগ পাবেন। যোগাযোগ করুন 998745……”
কী বলছে সুমন! আর জে সুমন! মাথা মুন্ডু ঢুকছে না শুধু নাম্বার টা বারবার আওড়াচ্ছে সবুজ ! বাসন মাজতে মাজতেই বলে নিচ্ছে 998745…..দুদিন আগেও বাবা বলেছিলো ” আমার আর কোনো শখ নেই পারলে আমাকে একটু জগন্নাথ দর্শনে নিয়ে যাস!”
কোথা থেকে নেবে সবুজ! ওই সব মিলিয়ে হাজার ছয় টাকা পায়! বাবার চিকিৎসা ওষুধেই দুই শেষ! তারপর টুকটাক লোন! সব করে মাসের শেষে খাওয়াটাই জুটবে কিনা ঠিক থাকেনা! জগন্নাথ দর্শন!
আবার চোখ গেলো শ্রীকৃষ্ণের ছবির দিকে! সাংঘাতিক রাগ হচ্ছে সবুজের! আজকাল ওর সবেতেই রাগ হয়ে যায়!
চলবে।