জগন্নাথ হোটেল পর্ব-০৪ এবং শেষ পর্ব

0
6

#জগন্নাথ_হোটেল
#অনিন্দিতা_মুখার্জী_সাহা
#শেষ_পর্ব

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে থমকে গেছে সবুজ! কী হলো এটা! তাকালো আবার ছবি গুলোর দিকে! কৃষ্ণ ঠাকুরের মালাটা আজ দারুণ পরানো হয়েছে! বজরংবলীর নীচের তাকটায় জবা ফুলটা পড়ে আছে! জগন্নাথ দেবের মুখ দেখে কিছু বোঝা না গেলেও সবুজ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে উনি হাসছেন।
কী হলো তাহলে এটা!

সবুজ এঁটো গুলো নিয়ে যা!” – ডাক আসতেই ছুটলো সবুজ! এটাই বোধহয় ওর ভবিতব্য! কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছে না সবুজ! বড্ড অস্থির লাগছে! মাথাটা ঘোরাচ্ছে, বমি বমি পাচ্ছে! চোখে মুখে অন্ধকার দেখছে! বিশ্বাস ভাঙার জ্বালা মারাত্মক! অনেক কঠিন রোগের থেকেও মারাত্মক!

কিন্তু কে ওর বিশ্বাস ভাঙলো! জগন্নাথ সেবা কেন্দ্রের রিসেপশনের সেই বয়স্ক ভদ্রলোক! যাকে কত দুঃখ নিয়ে নিজের দুঃখের কথা গুলো বলেছে সবুজ ! কিন্তু কেন বলেছে সবুজ! কী মনে হয়েছে সব আত্মীয় বন্ধু বান্ধব যাদের সবুজ স্বার্থপর মনে করে এই অপরিচিত লোকটা এদের থেকে আলাদা! কী ভেবেছে সবুজ যে উনি এসে সাহায্য করবে ওকে! কোন ভরসায় বলেছে! বড্ড বোকা মনে হচ্ছে নিজেকে সবুজের!

রিসেপশনের লোকদের অনেক ক্ষমতা থাকে!! চাইলে বাবার ফর্ম টাকে ওপরে রাখতে পারতো! পারলে ওটাকে এগিয়ে দিত! আর ভাবনাটা আসবে নাই বা কেন পরের দিনও তো ফোন করে বললো বাবার প্রেসক্রিপশন টা দিয়ে যেতে! সেটা কী এমনি! কোনো আশা না থাকলে আবার প্রেসক্রিপশন চায়! শুনেই ছুটেছিলো সবুজ! একটুও দেরি করেনি! সেদিনও ভদ্রলোক বললেন চিন্তা করো না ব্যবস্থা ঠিক একটা হবে!

এতো কিছু পরপর হয়েছিল বলেই তো এতটা আশা দেখেছিলো সবুজ! থালা গুলো ধুতে ধুতে আবার চোখ গেলো জানলার ওপারে ওই পোড়ো জগন্নাথ মন্দিরের দিকে! মনে হচ্ছে ছুটে যায় একবার! না কোনো কিছুর আশায় না! শুধু সামনে গিয়ে বসে থাকবে! একবারও জবাব চাইবে না যে কেন এরকম হলো কেন বাবার এইটুকু ইচ্ছে পূরণ করতে দিলে না ! একবারও জিজ্ঞেস করবে না যে এতো ভালো পড়াশোনায় হয়েও কেন এরকম একটা অবস্থা হলো সবুজের!

বাসন ধোয়া শেষ! হোটেল এখন অনেক ফাঁকা! একজন খাচ্ছে! এ চলে গেলেই মানদা মাসি এবার ডাকবে সবুজ খাবি আয়! মায়ের মতো ডাক! ওই পচা খাবার গুলোও শুধু এই ডাকেই অমৃত লাগে তখন সবুজের! আজকাল তো কেউ ডেকে খাওয়ায় না ওকে! খাওয়া তো দূর খোঁজই নেয়না! পাছে কিছু চায় সবুজ!

বেসিনের জলে ভালো করে হাত দুটো ধুলো সবুজ! ঘড়িতে চারটে বাজে! এই সময়েই মানদা মাসি আর সবুজ খেতে বসে! খেয়ে উঠেই দু কেজি আটা মাখে! আর মানদা মাসি বানায় তর্কা , ঘুগনি আরও কত কী! রাতে আর বসে খাওয়ার ব্যবস্থা করেনা পঞ্চু! যা হবে হাতে হাতে! তাই রান্নার বাসন গুলো রেখে দেয় মানদা মাসি! সবুজ সকালে এসে ওগুলো মেজে দেয়! আর ভালো লাগেনা এই কাজগুলো করতে! আজ সকাল থেকে খুব মনে হচ্ছিলো এবার বোধহয় সব ভালো হবে!

ওপরের দেওয়ালে বারবার চোখ গেলেও তাকাচ্ছে না সবুজ! এমন অভিমান! হয় সবুজের মনে বড্ড অভিমান জন্মায়! সবার ওপর নয় যাকে ভালোবাসে তার ওপর! কৃষ্ণ ঠাকুরকে তো নিজের বন্ধুই ভাবতো! এতো নাকি লীলা তার! পারতো তো বাবার শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করতে!

শেষ ভাবছে কেন সবুজ! বাবা তো ওর দিব্বি আছে! রাতে গা ঘেঁষে শোয় সবুজের! অনেকের তো সেটাও থাকে না! পুরী না যাওয়া হোক বাবা সুস্থ থাক! ওর বাবা আছে! দিনের শেষে ঘরে লোক আছে!অনেকের তো সেটাও থাকে না! ডাক্তার বলেছেন হার্টের অবস্থা খুব খারাপ কিন্তু কৃষ্ণ ঠাকুর বাঁচিয়ে তো রেখেছে! প্রায় এক বছরের ওপর বাবা অসুস্থ! কৃষ্ণ ঠাকুর এইটুকু দয়া তো করেছেন!

ভাবনাটা এরকম সাজতেই মনটা শান্ত হলো সবুজের! না আর অভিমান হচ্ছে না সরাসরি তাকালো কৃষ্ণ ঠাকুরের দিকে! তাকিয়েই আছে! কী অপূর্ব প্রেম মাখা মুখ! না আর রাগও হচ্ছে না! বাবা সুস্হ থাকলেই হবে ওর !

” সবুজ খেতে আয়!” – মানদা মাসি ডাকলো – এটা আরেক টুকরো ভালোবাসা ওর জীবনের! কে বলে সবুজের কিছু নেই!

হাতটা আরেকবার ধুয়ে নিলো সবুজ! অনুভব করছে পেটটা গুড়গুড় করছে বেশ! খাওয়া মনে ডাল আর শাক ভাজা আর মানদা মাসি যদি লুকিয়ে দুটো মাছ ভাজা আনে! মাছ আনলেই নিজেরটা বাবার জন্য সরিয়ে রাখে সবুজ, কী করে খাবে একা ও! বাবাও যে একটা সময় নিজের ভাগেরটা তুলে দিয়েছে সবুজের পাতে! এখন সেই সব চুকিয়ে দেওয়ার পালা! সবুজের এই কান্ড দেখে মানদা মাসি এখন তিন টুকরো মাছই সরিয়ে রাখে রান্নার সময়!

তাহলে এই সুখ সুখ নয় কী! হঠাৎ পকেটের ভেতর থেকে ফোনটা বেজে উঠলো! হাত ঢুকিয়ে বের করতেই দেখলো অচেনা নাম্বার! সবুজ দেখেছে অনেকের ফোনেই ট্রু কলার থাকে সেখানে অচেনা নাম্বারেরও নাম ওঠে কিন্তু সবুজের এই ছোট্ট ফোনে এতো সুবিধা কোথায়!

ফোনটা রিং শেষ হওয়ার আগেই ধরে ফেললো সবুজ! ” সবুজ বলছো? ” ওপাশ থেকে বলতেই সবুজ বললো ” বলছি!” ” ধরো ডাক্তার বাবু কথা বলবে! ” ভদ্রলোক বলেই ফোনটা হোল্ড করে রাখলেন! একটা সুন্দর মিউজিক বাজছে!”

কিন্তু কোন ডাক্তার বাবু! বাবার কিছু হলো আবার,! ওকে খবর না দিয়েই কী নিয়ে গেলো ডাক্তারের কাছে! বুকটা ধকধক করছে সবুজের! এই তো দুপুরে কথা হলো! বললো পাশের ঘর থেকে জেঠিমা লটে মাছ দিয়ে গেছে! তাহলে!

” হ্যালো! সবুজ!” সবুজ শুনলো কী গম্ভীর অথচ মিষ্টি গলা! ” হুম ” বললো সবুজ! এর বেশি আওয়াজ বেরোচ্ছে না গলা দিয়ে! ” সবুজ আমি অনির্বান ডাক্তার! ” অনির্বাণ ডাক্তার কে তো চেনে না সবুজ! বাবার ডাক্তার তো সুমিত বসু! তাহলে! ” আমি জগন্নাথ সেবা কেন্দ্রের মিহির বাবুর থেকে তোমার নাম্বার পেয়েছি!” কথাটা শুনেই কেমন আবার আশার আলোটা জ্বলে উঠলো! মনে পড়লো ওই ডাক্তারের নাম অনির্বাণ যিনি জগন্নাথ দর্শনের উদ্যোগটা নিয়েছেন!

বুক জুড়ে ড্রাম বাজছে! মনে হচ্ছে সব স্বপ্ন গুলো সত্যি হবে এবার! এখানে থাকা যাবে না তাই মানদা মাসিকে হাত দেখিয়ে বেরিয়ে গেল হোটেল থেকে! হাঁটতে লাগলো সামনের দিকে!

” সবুজ তোমার সাথে একটু কথা আছে! তোমার বাবা প্রভাত বাবু! আমি ওঁনার প্রেসক্রিপশন দেখেছি! ওঁনার অবস্থা কিন্তু খুব ভালো নয়! ওঁনাকে যে ওষুধ গুলো দিয়েছেন সুমিত বাবু ওগুলো কিন্তু সাপোর্ট দিয়ে রেখেছে! ” ভয় পেয়ে গেছে সবুজ! সব জানা তাও ভয় লাগছে! আমতা আমতা করে বললো ” বাবা খুব অসুস্থ জানি! ”

” জানলে তো হবে না বাবা! ওঁনার অপারেশন করাতে হবে!!” ডাক্তারের কথা শেষ হওয়ার আগেই সবুজ বললো ” সে তো অনেক টাকা!” অনির্বান বাবু বললেন ” সে তো লাগবেই কিন্তু তাই বলে ফেলে রাখা তো যায়না! তুমি এক কাজ করো কাল আমার নার্সিংহোমে ওঁনাকে ভর্তি করে দাও! আমি দেখে নেবো বাকিটা!”

সবুজ কিচ্ছু বুঝতে পারছে না কোথা থেকে কী হচ্ছে! এই ছিল পুরী সেখান থেকে ডাক্তার তারপর নার্সিংহোম অপারেশন! ডাক্তারবাবু যে নার্সিংহোমের কথা বলছেন সেটাই তো খুব খরচ! এতো কিছু সামলাবে কী করে! একটু ভেবে সবুজ বললো

” ডাক্তারবাবু আপনাকে অনেক ধন্যবাদ! বাবার অপারেশন আমি ঠিক করিয়ে নেবো! আপনি আমার বাবার জগন্নাথ দর্শনের একটা সুযোগ করে দিন!” – পুরী যাওয়ার বিষয়টা যে এই ডাক্তারের হাতে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না সবুজের!

” তোমার বাবা খুব অসুস্থ! অতটা জার্নির ধকল ওঁনার শরীর নিতে পারবে না! ওঁনার হার্টের নব্বই শতাংশ ব্লকেজ! এক্ষুনি স্টেন বসাতেই হবে!আর টাকা নিয়ে তোমায় চিন্তা করতে হবে না!” – বলেই যাচ্ছেন অনির্বাণ! কিন্তু সবুজ বুঝতে পারছে না এতে ডাক্তারের কী স্বার্থ! কী লাভ হবে! উনি তো চেনা কেউ না সবুজের!

” শুধু!” এইটুকু বলতেই সবুজ বললো ” শুধু? ” অনির্বাণ বললেন ” তুমি তো জগন্নাথ হোটেলে কাজ করো! ” সবুজ হুম বলতেই অনির্বান বললেন ” ওটা ছেড়ে দিতে হবে তোমায়! তুমি জগন্নাথ হোটেলেই কাজ করবে কিন্তু এখানে নয়!”

কীসব হেয়ালি বুঝতে পারছে না সবুজ! একটু বিরক্ত হয়েই বললো ” বুঝলাম না!” অনির্বাণ বললেন ” পুরীতে আমার জগন্নাথ হোটেল আছে! সেখানে একজন ম্যানেজার লাগবে! তুমি বাবার অপারেশন টা করিয়ে মাস খানেক পর ওটার দায়িত্ব যদি নিতে! নিয়ে যেও বাবাকে তখন! হোটেলেরই একতলায় থাকার ব্যবস্থা করে দেবো তোমাদের! বাবাকেও একটা দায়িত্ব দিয়ে দেবো! দেখবে সমুদ্রের হাওয়ায় উনি কেমন সুস্থ হয়ে যাবেন! ”

ডাক্তারবাবু! শুধু এইটুকুই বললো সবুজ! এঁর বেশি কিছু বলার সাহস নেই ওর! কী বলবে ধন্যবাদ? কী বলবে আপনি খুব ভালো! কী বলবে আমি আপনার ঋণ কোনোদিনও শোধ করতে পারবো না!

” চিন্তা নেই! আমি তোমার মাইনে থেকে বাবার অপারেশনের টাকা কেটে নেবো! আমি চাইনা বাবার জন্য তুমি অন্য কারোর কাছে হাত পাতো! আপাতত কাল আসো নটার মধ্যে! আমি ঠিকানাটা মেসেজ করে দিচ্ছি!”

বলেই কেটে দিলেন ভদ্রলোক ফোনটা! কেন এরকম করলেন উনি! এতো ভালো মানুষ সাধারণত সবুজের জীবনে আসেনি! কেন করবে উনি বাবার জন্য! উনি তো আত্মীয় নয়! পরিচিতও নয়!

ভাবতে ভাবতেই সবুজ দেখলো ও জগন্নাথ মন্দিরের পোড়ো দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে! মন্দির খোলা! সন্ধ্যে বাতি দেবে বলে খোলা! জগন্নাথ দেবকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সবুজ! জুতো খুলে ঢুকে গেলো মন্দিরে!

বসে পড়লো হাটু মুড়ে! তারপর বিড়বিড় করে বললো ” তুমি তো বলেছিলে আমরা দুজনেই পুরী যাবো! বিশ্বাস করিনি! অন্যায় করেছি!ক্ষমা করো আমায়! আমি তোমায় অবিশ্বাস করে ফেলেছি! ”

কেঁদেই যাচ্ছে সবুজ! এই কান্না দুঃখের নয়! হেরে যাওয়ার নয় বরং হঠাৎ জিতে যাওয়ার, ভগবানের সান্নিধ্য পাওয়ার! আজ জগন্নাথ দেব স্বয়ং এসেছে সবুজের কাছে অনির্বাণ ডাক্তারের মধ্যে দিয়ে! আর কী চায় সবুজ!

“জয় জগন্নাথ!🙏🏻🙏🏻🙏🏻🙏🏻

শ্রদ্ধাভান্‌ লভতে জ্ঞানং, তৎপরঃ সংযতেন্দ্রিয়ঃ।
জ্ঞানং লভ্ধ্বা পরাং শান্তিম্‌ অচিরেণাধিগচ্ছতি॥
— শ্রীমদ্ভগবদগীতা ৪.৩৯

“যিনি বিশ্বাসসহকারে অধ্যয়ন করেন, সংযমে থাকেন, তিনি জ্ঞান লাভ করেন;
এবং সেই জ্ঞান লাভের মাধ্যমে তিনি তাড়াতাড়ি চরম শান্তি (সফলতা ও বিজয়) অর্জন করেন।

যদি তোমার মধ্যে বিশ্বাস থাকে—তুমি জ্ঞান, আত্মশক্তি ও শান্তির মাধ্যমে জয়ী হতে পারো।

সমাপ্ত।