#জলতরঙ্গের_সুর
পর্ব – ০১
লেখা – আসফিয়া রহমান
সিট নম্বর ২৫।
হ্যাঁ এটাই তো! নম্বর মিলিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিজের সিটে বসলো মেয়েটি। এটা যে উইন্ডো সিট নয় সেটা দেখে খানিকটা মনক্ষুন্ন হলো তার। প্রথমবার ট্রেনে একা যাবে- তার ওপর আবার উইন্ডো সিট পায়নি; সবমিলিয়ে মনটাই খারাপ হয়ে গেল মেয়েটার। তাকিয়ে দেখল পাশের উইন্ডো সিটের মালিক এখনো এসে পৌঁছায়নি।
আকাশ কুসুম চিন্তা-ভাবনার মাঝেই হুইসেল দিয়ে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। ট্রেনের গতি বাড়ছে ধীরে ধীরে, জানালার বাইরের দৃশ্যগুলো যেন চলন্ত ছবি হয়ে ছুটতে শুরু করেছে। মেয়েটা একবার জানালার দিকে, একবার দরজার দিকে তাকায়। পাশের সিটটা এখনো ফাঁকা।
হঠাৎ একটা ঝাঁকুনিতে ট্রেনের ছন্দে তাল মেলাতে না পেরে খানিকটা কেঁপে উঠে মেয়েটা। চোখ দুটো আবার জানালার যায় দিকে। মনে মনে ভাবে, “পাশের সিটটা হয়তো খালি, কিংবা যার সিট সে যদি ট্রেনই মিস করে থাকে?” একটু আশা জাগে মনে।
এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ পেছন দিক থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে আসে, “এক্সকিউজ মি, এইটা কি সিট নম্বর ২৬?”
মেয়েটা চমকে উঠে মুখ তুলে তাকালো। ২৬ নম্বর সিটের মালিক একটা ব্যাকপ্যাক কাঁধে ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পড়নে হালকা নীল রঙের পোলো শার্ট, ডেনিম প্যান্ট। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, চেহারায় গম্ভীর ভাব।মেয়েটাকে উত্তর দিতে না দেখে সে আবার বলল,
“সিট ২৬ তো এটাই, না?”
মেয়েটা মাথা নেড়ে সায় জানালো, হ্যাঁ। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ভেতরে বসার জায়গা করে দিল। ছেলেটা একবার ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“থ্যাংকস!”
বলতে বলতে ছেলেটা ব্যাগটা গুছিয়ে জানালার পাশের সিটে বসে পড়লো। মেয়েটা ভারী বিরক্তবোধ করল।
টিকিট কাউন্টারের লোকেদের কি কোন আক্কেল জ্ঞান নেই? ছেলেদেরকে উইন্ডো সিট দেবার কি দরকার?
ছেলেটা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। ট্রেন তখন শহরের অলি-গলি পেরিয়ে ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে খোলা প্রান্তরে।
“ছেলেটাকে কি একবার রিকোয়েস্ট করব সিটটা এক্সচেঞ্জ করার জন্য?” মনে মনে ভাবল মেয়েটা।
“নাহ্, অপরিচিত একজনের কাছে এভাবে কোন কিছু রিকোয়েস্ট করা যায় না!”
কিছু সময় পার হয়ে গেল। ট্রেন এখন ছুটছে প্রকৃতির মাঝ দিয়ে। পাখির পাল উড়ে যাচ্ছে, কোথাও ধানক্ষেত, কোথাও দুএকটা বাড়ি চোখে পড়ছে।
মেয়েটা একটু নড়েচড়ে বসল।
“আচ্ছা, কথা বললে কি খুব খারাপ হয়?”
ছেলেটা তখনো জানালার বাইরে তাকিয়ে। বাইরের দ্রুত পাল্টে যাওয়া দৃশ্যের দিকে তার দৃষ্টি স্থির। মেয়েটা একটু দ্বিধাভরে তাকিয়ে বলল,
“উম্… এই যে শুনছেন, মিস্টার…”
ছেলেটা মুখ ঘুরিয়ে তাকালো এদিকে,
“জ্বী, বলুন?”
“আ…আমি কি উইন্ডো সিটটায় বসতে পারি? একচুয়ালি প্রথমবার ট্রেনে একা যাচ্ছি আর তাছাড়া জানালার পাশে বসা আমার খুব পছন্দ।”
ছেলেটা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল,
“তাহলে বসুন।”
মেয়েটা কেমন যেন থতমত খেয়ে গেল। এমন সহজভাবে রাজি হয়ে যাবে ভাবেনি ও। ও এবার একটু ইতস্তত করল, “না মানে, আপনার প্রবলেম হবে না তো?
ছেলেটা একবার তাকাল, তারপর উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো, “প্রবলেম হওয়ার কিছু নেই! আমি যেকোনো পাশেই কমফোর্টেবল। সো ইউ ক্যান!”
ধন্যবাদ জানাল মেয়েটা, আর কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। ছেলেটার মধ্যে কোনো বাড়াবাড়ি সৌজন্যতা নেই, কোনো চটুলতা নেই। এমনকি জিজ্ঞেসও করল না, কেন সিটটা বদলাতে চায় ও!
মেয়েটা চুপচাপ জানালার পাশে বসল। এতক্ষণে যেন ট্রেনে ওঠার আসল মজা অনুভূত হচ্ছে। বাইরের দৃশ্যগুলো এখন আর শুধুই চলন্ত নয়, মনে হচ্ছে যেন খোলা মাঠ, ছুটে চলা গাছ, রেললাইনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ঘরগুলো বলে যাচ্ছে একেকটা নিঃশব্দ গল্প।
“এক্সকিউজ মি স্যার! কিছু লাগবে?” ওয়েটারের আওয়াজ শুনে জানালা থেকে মুখ ফেরালো মেয়েটা।
“ইয়েস! ওয়ান ব্লাক কফি উইথআউট সুগার।”
“ম্যাম, আপনি কিছু নেবেন?”
“হ্যাঁ, কফি… তবে উইথ মিল্ক এন্ড সুগার।” আড়চোখে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল মেয়েটা।
ওয়েটার চলে গেলে ছেলেটা ব্যাগ থেকে একটা বই বের করল। বইয়ের মলাট দেখে মেয়েটা খানিক অবাক হল।
“হুমায়ূন আহমেদের ‘দেয়াল’?”
ছেলেটা বইয়ের পাতায় চোখ রেখেই হালকা গলায় বলল,
“আপনি যদি জানালা খোলা রাখতে চান, রাখতে পারেন। আমার সমস্যা নেই।”
মেয়েটা চমকে তাকাল। ছেলেটা কি বুঝে ফেলেছে যে ও এতক্ষণ ছেলেটার বের করা বইটার দিকে তাকিয়ে ছিল?
“ঠিক আছে!” জানালার দিকে ফিরে তাকাতে তাকাতে ধীর স্বরে উত্তর দিল মেয়েটা।
__________________________________
ট্রেনের গতি হঠাৎ কমে আসতে আসতে একটা অচেনা ছোট্ট স্টেশনে এসে থেমে গেল।
মিনিট পাঁচেক পরে ঘোষণায় বলা হলো,
“ট্রেনের ইঞ্জিনে সামান্য যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দিয়েছে। শিগগিরই ঠিক করে আবার যাত্রা শুরু হবে।”
জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল মেয়েটা। কিছু কিছু যাত্রী ইতিমধ্যেই ট্রেন থেকে নেমে পড়েছে। ছোট্ট স্টেশন, চারপাশে কাঁচা রাস্তাঘেরা দু-একটা দোকানপাট, ধানক্ষেতের প্রান্ত ছুঁয়ে যাচ্ছে দৃষ্টি।
নামবে কি নামবে না সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না মেয়েটা। তখনই পাশের সিটে বসে থাকা ছেলেটা উঠে দাঁড়ালো।
ব্যাগের ভেতর বইটা ঢুকিয়ে রেখে নেমে গেল ট্রেন থেকে।
মেয়েটা কিছুক্ষণ বসে রইল। তারপর নিজেকেই বলল,
“আমি একা কেন বসে থাকব ? আমিও নামি…”
ট্রেন থেকে নেমে নিচে এসে দাঁড়াল ও। চোখ ঘুরিয়ে তাকাল চারদিকে। সামনেই কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে সেই ছেলেটা। সে ওকে দেখে নি।
মেয়েটা একটু এগিয়ে গেল, কিন্তু কথা বলল না।
একটু দূরেই একটা ছোট চায়ের দোকান। পাশেই কাঠের বেঞ্চ, আর পেছনে সরু মেঠো পথ চলে গেছে ধানক্ষেতের মাঝখান দিয়ে।
ছেলেটা এবার লক্ষ্য করল ওকে।
“আপনিও নামলেন?”
মেয়েটা হেসে বলল,
“এই সুযোগে জায়গাটা একটু দেখে নেওয়া যায় না?”
ছেলেটা কাঁধ ঝাঁকালো, “অবশ্যই। ঘুরে আসুন। জায়গাটা খারাপ না।”
মেয়েটা একটু ইতস্তত করে বলল,
“ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, একসাথে হাঁটলে কোনো আপত্তি আছে?”
ছেলেটা চমকাল না। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর মুখে সেই একই নির্লিপ্ত ভঙ্গি রেখে বলল,
“না, আপত্তি নেই। ট্রেন যেহেতু এখনই ছাড়বে না…”
দুজনেই হাঁটতে শুরু করল স্টেশনের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া কাঁচা রাস্তা ধরে। দুটো মানুষ পাশে পাশে হাঁটছে, কিন্তু অদ্ভুতভাবে তাদের মধ্যে বিরাজ করছে কঠিন নীরবতা। কেউই কিছু বলছে না।
মেয়েটাই পা চালাতে চালাতে আগ বাড়িয়ে কথা বলল,
“এতক্ষণ ধরে একসাথে আছি, আপনার নামটাই জানা হলো না!”
ছেলেটা খানিকক্ষণ চুপ রইল। যেন নামটা বলার আগে ভেবে নিচ্ছে, আদৌ বলার দরকার আছে কিনা।
মেয়েটা একবার তাকালো ছেলেটার মুখের দিকে। তারপর ঠোঁটের আগায় এক টুকরো হাসি টেনে বলল,
“না মানে… পাশাপাশি সিটে বসে যাচ্ছি, জানালার পাশে সিটটাও আপনার ছেড়ে দেওয়া, এখন আবার একসাথে হাঁটা… নাম না জানলে ব্যাপারটা বেশ আনঅফিশিয়াল লাগে না?”
ছেলেটা এবার সোজা সামনে তাকিয়ে বলল,
“কল্লোল।”
মেয়েটা একটু থেমে বলল, “মানে… নদীর কল্লোল?”
“হুম!” ছেলেটার উত্তর সংক্ষিপ্ত। যেন বাড়তি কিছু বলা মানে মাপচোখে ভার বাড়ানো।
মেয়েটা এবার নিজের নাম বলল,
“আমি ঊর্মি।”
ছেলেটা তাকাল না, নিম্নস্বরে উচ্চারণ করল, “ঊর্মি।”
একটা মৃদু বিরতি।
তারপর হঠাৎ করেই কল্লোল নামের ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, “আপনার নামের অর্থ জানেন?”
ঊর্মি একটু অবাক হয়ে তাকাল, “হুম… ঊর্মি মানে ঢেউ। সমুদ্রের তরঙ্গ। আপনার নামের অর্থ কী?”
“শব্দ। নিঃসৃত শব্দ।” তারপর একটুখানি থেমে আবার বলল, “ঢেউ যখন কোনো কিছুর গায়ে আছড়ে পড়ে, তখন যে শব্দ হয়— সেটা-ই কল্লোল।”
ঊর্মি চুপ করে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। মনে হলো যেন সমুদ্রের দুটো রূপ পাশাপাশি হাঁটছে। একটা তরঙ্গ, আরেকটা তার অনুরণন।
ওরা ধানক্ষেতের পাশ ঘেঁষে আরও কিছুটা হাঁটল। জুনের আকাশ মেঘলা হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে।
কল্লোল হাঁটতে হাঁটতে নির্লিপ্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”
“দাদুবাড়িতে। আমার কাজিনের বিয়ে। আপনি?”
“আমিও একটা বিয়েতেই যাচ্ছি। আমার ফ্রেন্ডের।”
“ওহ্….”
ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠলো। সম্ভবত ইঞ্জিন ঠিক হয়ে গেছে। কল্লোল বলল,
“চলেন, ট্রেনে ফিরি?”
ঊর্মি মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ…”
দুজনেই হাঁটার গতি বাড়াল। হঠাৎই ঊর্মির ডান পা রাস্তার মাঝখানে পড়ে থাকা এক টুকরো উঁচু পাথরের সাথে হোঁচট খেল।
“আহ্…!”
উল্টে পড়ে যাওয়ার আগেই কল্লোল এগিয়ে এসে চট করে ধরে ফেলল ওর হাতের কনুই।
ঊর্মি সামলে নিল নিজেকে। একরাশ জড়তা নিয়ে বলল,
“থ্যাংক ইউ!”
কল্লোল সংক্ষেপে মাথা নাড়ল।
“দেখেশুনে হাঁটবেন। রাস্তা খুব একটা সমান না।”
তারপর আবার হাঁটতে শুরু করল, যেন কিছুই হয়নি।
ঊর্মি কিছু বলল না, শুধু একবার ওর দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবল, “এই ছেলেটা কি স্বভাবতই এমন গম্ভীর?”
__________________________________
ট্রেন আবার পুরনো ছন্দে চলতে শুরু করেছে। জানালার বাইরের দৃশ্যগুলো দৌড়াচ্ছে একটানা, ধানক্ষেতের ফাঁকে ফাঁকে হালকা কুয়াশার মতো সন্ধ্যা নামলো। ট্রেনের কামরার ভেতরে চাপা গুঞ্জন, কেউ কেউ গল্প করছে, কেউ চোখ বুজে বসে আছে।
বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে হঠাৎ করে কল্লোলের চোখ গেল পাশের সিটে। পাশের সিটে বসা ঊর্মি নামের মেয়েটা জানালার কাঁচে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ট্রেনের দুলুনিতে মাথাটা একটু পরপর ঠোক্কর খাচ্ছে জানালার পাশের সাদা দেয়ালে। ঘুমের মধ্যে মেয়েটা দু-একবার নড়েচড়ে উঠছে ধাক্কা খেয়ে।
কল্লোল একটু তাকিয়ে থাকে। তারপর ধীরে হাত বাড়িয়ে ওর মাথাটা সামান্য সোজা করে দেয়। একটুখানি সময় স্বস্তিতে ঘুমায় মেয়েটা, কিন্তু কিছুক্ষণ না যেতেই ট্রেনের দুলুনিতে মাথাটা আবার হেলে পড়ে জানালার দিকে।
আরেকবার সোজা করে দেয় কল্লোল। এবারও একই ঘটনা ঘটে। একবার সেদিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে আস্তে করে নিজের কাঁধটা এগিয়ে দেয় মেয়েটার কাছাকাছি।
ঊর্মির মাথাটা এবার ওর কাঁধে এসে পড়ে। এবার আর মেয়েটা নড়েচড়ে ওঠে না। চোখ বুজে থাকে নিশ্চিন্তে। ট্রেন এগিয়ে চলে নিজস্ব গতিতে, জানালার বাইরে আলো ঝাপসা হতে থাকে আস্তে আস্তে।
কল্লোল ফের বইয়ে মনোযোগ দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু চোখ ঘুরে ফিরে বারবার চলে যাচ্ছে এই মুহূর্তে নিশ্চিন্তে ওর কাঁধে অবস্থান করা নিতান্তই অপরিচিত মেয়েটার দিকে।
প্রচন্ড বাতাসের ধাক্কায় মসৃণ চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ঢেকে রেখেছে মেয়েটার মুখ। ক’গাছি চুল উড়ে এসে সুড়সুড়ি দিচ্ছে কল্লোলের চোখে মুখে। চুলগুলো সরিয়ে দেয় না ও। মেয়েটার গা থেকে একটা মিষ্টি মিষ্টি সুগন্ধ ভেসে আসছে। গন্ধটা যেন বেশ জোর করেই পৌঁছাচ্ছে ওর নাসারন্ধ্রে। সেটাই মূলত বিগড়ে দিচ্ছে ওর মনোযোগটা।
এই প্রথমবার কোন নারী ওর এতটা কাছে। নারীঘটিত যে কোন বিষয় থেকে ও বরাবরই শ’হাত দূরে থাকে। নিজের নিয়ন্ত্রিত জগতে কারোর অনধিকার প্রবেশ কখনোই বরদাস্ত করে না ও।
তবে আজ কী হলো?
কেন এই মেয়েটাকে সরে যেতে বলছে না ও?
কেনই বা নিজে থেকে একটা অপরিচিত মেয়ের ঘুমের সুবিধার্থে নিজের কাঁধ পেতে রেখেছে?
কল্লোল মুখ ফিরিয়ে জানালার বাইরে তাকায়। নিজের মনোযোগের এই বিচ্যুতি তার নিজের কাছেই ভীষণ অপ্রত্যাশিত।
__________________________________
হঠাৎ ট্রেনটা একটা স্টেশনে থামল সামান্য ঝাঁকুনি দিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে ঊর্মির চোখ খুলে গেল। কয়েক সেকেন্ড কিছুই বুঝে উঠতে পারল না ও। তারপর কয়েক মুহূর্ত পর টের পেল, ওর মাথা কোথায় রাখা ছিল এতক্ষণ!
তড়িঘড়ি করে সোজা হয়ে বসল ও। বিস্ময়ে মার্বেল আকৃতির চোখ নিয়ে টেনেটুনে ঠিক করতে লাগলো গায়ে থাকা টপসটা।
কল্লোল তখনও বইয়ের পাতার দিকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু ওর মনোযোগ নেই সেখানে। ছায়ার মতো টের পাচ্ছে ও পাশের মানুষটার অপ্রস্তুত গা-ছমছমে অস্বস্তি।
একটু পরে, খুবই স্বাভাবিক গলায় কল্লোল বলল,
“ঘুম ভাঙলো?”
ঊর্মি চমকে উঠে নিজের কণ্ঠ স্বাভাবিক রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করল, কিন্তু তারপরেও তুতলে গেল কন্ঠস্বর,
“হ্যাঁ… মানে… আমি কি… আমি কি আপনার কাঁধে…?”
কল্লোল এবার বইয়ের পাতাটা উল্টে ফেলল।
“হুম, জানালায় মাথা ঠুকছিলেন বারবার।”
ঊর্মি নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। খুব নিচু স্বরে বলল, “স্যরি… আমি বুঝতেই পারিনি…”
“ইটস ওকে! আপনি তো ঘুমাচ্ছিলেন…” একটা নির্লিপ্ত জবাব এলো।
কিছুক্ষণের নীরবতা।
ঊর্মি জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল। তারপর মুখ ফিরিয়ে আস্তে বলল,
“ধন্যবাদ!”
কল্লোল একবার তাকালো, খুবই সামান্য সময়ের জন্য। তারপর আবার দৃষ্টি ফেরালো বইয়ের পাতায়।
____________________________________
কাঙ্খিত স্টেশন চলে আসতেই কাকতালীয়ভাবে দুজনেই নামার তোড়জোড় করতে শুরু করল। ট্রেন ধীরে ধীরে নিজের গতি কমাচ্ছে, জানালার বাইরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে স্টেশনের চেনা ব্যস্ততা।
ঊর্মি জানালার ধারে বসে ছিল বলে প্রথমে উঠে দাঁড়াল। ট্রলিটা নামিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল ট্রেন থেমে যাবার। কল্লোলও উঠে দাঁড়িয়ে নিজের ব্যাগটা কাঁধে চাপাল, এরপর স্বাভাবিক স্বরে বলল, “দ্যা দে ওয়াজ নট ব্যাড!”
ঊর্মি থমকে তাকাল ওর দিকে। একটা ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠল ঠোঁটের আগায়, “হুম, নট ব্যাড!”
প্রকাণ্ড হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন থেমে গেল। দুজনেই পরপর নামল ট্রেন থেকে। স্টেশনের চত্বরে পা রেখেই একটা গরম বাতাস এসে লাগল মুখে। আশপাশে মানুষজন ছুটছে, কেউ খুঁজছে কাউকে, কেউ আবার বিদায় জানাচ্ছে প্রিয়জনকে।
ঊর্মি সৌজন্যতামূলক হেসে জিজ্ঞেস করল,
“আপনার গন্তব্য কোনদিকে?”
“উত্তর গেট ধরে বের হলেই সিএনজি পাওয়া যায়।সেদিকেই যাবো।” কল্লোল বলল।
“আচ্ছা… আমি অপজিট সাইড থেকে রিকশা নেব।”
“ওকে!”
দুজনেই একসাথে এগিয়ে চলল স্টেশনের ভীড় ঠেলে।
হয়তো এই মুহূর্তেই আবার একবার চোখাচোখি হলো তাদের, অথবা হলো না। হয়তো এটাই শেষ দেখা, বা নতুন কোনো গল্পের শুরুটা হয়তো হবে এই পরিচয়ের হাত ধরেই…?
কে বলতে পারে কি হতে চলেছে অদূর ভবিষ্যতে?
To be continued…?