জলতরঙ্গের সুর পর্ব-০৩

0
2

#জলতরঙ্গের_সুর
পর্ব – ০৩
লেখা – আসফিয়া রহমান
অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ❌

ঊর্মি সবে গোসল সেরে বেরিয়েছে। চুল থেকে এখনো টপটপ করে পড়ছে পানির ফোঁটা। পাতলা একটা সাদা তোয়ালে দিয়ে ও চুলটা মোছার চেষ্টা করছে, কিন্তু ভেজা চুল ঠিকমতো পেঁচিয়ে আসছে না। গালে ঈষৎ লালচে আভা, যেন জল ছুঁয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে গায়ের রং।

বারান্দায় কাপড় মেলতে এসে ও দেখল সামির ভাইয়ের মুখে কিছু একটা লাগিয়ে দিচ্ছে ইশা। কাপড় মেলা শেষ করে নিচে নেমে এলো ও।
“এটা আবার কি?”

“মুলতানি মাটি লাগানো হচ্ছে বরের মুখে! যাতে স্কিন গ্লোয়িং হয় আর আমাদের হবু ভাবি তা দেখে ঠাস করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়!” বলেই হো হো করে হাসতে লাগলো ইশা।

“কি উল্টাপাল্টা বকছিস?” ধমকে উঠল সামির।

ঊর্মি এবার এক হাত কোমরে রেখে, ভেজা চুল থেকে তোয়ালে নামিয়ে বলল,
“তোমার স্কিনের গ্লো দেখেই যদি ভাবি অজ্ঞান হয়ে পড়ে, তাহলে তো সেটা খুব আতঙ্কজনক প্রতিক্রিয়া হবে,‌ সামির ভাই!”

সামির অবাক হয়ে তাকালো,
“ঊর্মি! তুইও এই গাধাটার সাথে যোগ দিলি?”

ইশার থামার নাম নেই, মাটি মাখা আঙুল তুলে বলল,
“ভাবি ফোনে বারবার বলেছে, বরটা যেন চকচকে থাকে! আমি শুধু তার চাওয়া পূরণ করছি।”

ঊর্মি এবার ইশার পাশে গিয়ে দাঁড়াল, গম্ভীর মুখ করে বলল, “তা ঠিক। বর যখন একবারই আসবে, তখন তার মুখ তো এমন চকচকে থাকা উচিত যেন ক্যামেরা ফ্ল্যাশকেও কাঁচকলা দেখানো যায়! তাই না সামির ভাই?”

তারপর ওরা দুজন আবার হো হো করে হেসে উঠল।

সামির মুখ তখন গম্ভীর, কিন্তু ও সেটা ধরে রাখতে পারল না বেশিক্ষণ, “তোরা দুই বোন একসাথে হলে জীবনটা এই ফেসপ্যাকের মতো শুকনো হয়ে যায়।”

ঊর্মি চোখ টিপ মেরে বলল,
“শুকিয়ে গেলে গ্লো আসে। মানিয়ে নাও।”

আরেক দফা হাসি ছড়িয়ে পড়ল ওদের মধ্যে।

হাসির মাঝখানে একবার থেমে ইশা বলল, “ভাবি এলে আমাদের দল আরো ভারী হবে, কি বলো আপু?”

কথার মাঝখানে, ঊর্মির চোখ একবার চলে গেল পাশের করিডোরে। হঠাৎ করে যেন কিছু খুঁজছে ও। নাহ্, নেই। কেউ নেই। অন্যমনস্কভাবে জবাব দিল ও, “হ্যাঁ…”

“কি ব্যাপার আপু? কাউকে খুঁজছো?” ঊর্মির পাশে সরে গেছে ফিসফিস করে বলল ইশা।

“হ্যাঁ? ন-ন-না কাকে খুঁজব? কাউকে খুজছি না!” ইশার কথায় চমকে উঠলো ও।

ইশা একটু বাঁকা হাসল, চোখ টিপে ফিসফিস করে বলল,
“আচ্ছা! ভেজা ভেজা চুল, লাল লাল গাল, চোখ ঘোরাফেরা করছে এদিক ওদিক…! বল আপু, নামটা বলেই দাও!”

ঊর্মি তো তখন হালকা ঘেমে গেছে যেন! তাড়াতাড়ি তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে লাগল, মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,
“তুই চুপ করবি? সামির ভাই দাঁড়িয়ে আছে এখানে, যা ইচ্ছে তাই বলছিস!”

ইশা তখনো থামে না, গুনগুন করে গাইতে শুরু করল,
“তোমাকে খুঁজে পেতে আমার এই ভেজা ভেজা সকাল…”

“কিরে তোরা কী গুজুর গুজুর করছিস?”

“আপু মনে হয় কাউকে খুঁজছে, সেটাই বলছিলাম…”

“এই চুপ! ক-কাউকে খুঁজছি না… সামির ভাই! এই ইশাটা সব সময় বেশি বেশি করে…”

ঊর্মি ইশার মাথায় চাটি মেরে ওদের পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে যেতে যেতে থেমে গেল এক মুহূর্ত, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল দরজার কাছে। বাইরে থেকে এখনো ইশার হাসির শব্দ ভেসে আসছে, কিন্তু ওর ভেতরে হঠাৎ যেন নেমে এল একচিলতে নিরবতা।

সত্যিই কি ও খুঁজছিল কাউকে?

না… ও তো কেবল দেখছিল, করিডোরে কেউ আসছে কি না। অথবা…
আসতে পারত কি না…!

ও তারপর চোখ বন্ধ করল এক মুহূর্তের জন্য। ঠিক সেই সময় মনে পড়ল, “হাতে বেশি সময় নেই! তাড়াতাড়ি রেডি হতে হবে। বরযাত্রী বের হবে একটু পরেই!”

___________________________________

মাইক্রোটা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ঝকঝকে কালো গাড়িটা সাজানো হয়েছে গোলাপ আর রজনীগন্ধার স্টিক দিয়ে। মাইক্রোর দরজা খোলা, একে একে উঠছে সবাই।

পেছনের সিটে ঊর্মির ছোট ছোট দু তিনটে কাজিন ঝগড়া করছে- কে জানালার পাশে বসবে তা নিয়ে। সামনের দিকে উর্মির বাবা আর চাচা গম্ভীর মুখে বসে, একটু পরপর তাড়া দিচ্ছেন জলদি বের হওয়ার জন্য।

সামির পাগড়ী হাতে নিয়ে মাইক্রোর কাছাকাছি এগিয়ে এলো। ওর এক পাশে ইশা আরেক পাশে ঊর্মি।

কল্লোল তখন ফোনের স্ক্রিনে চোখ আটকে দাঁড়িয়ে আছে
মাইক্রোর পাশে।

“কিরে, গাড়িতে উঠবি না?” সামির এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল কল্লোলকে।

কল্লোল ফোনটা পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে গম্ভীর মুখে বলল, “আমি মাইক্রোতে যাচ্ছি না। তোর বাইক বের কর, বাইকে যাব…”

সামির চোখ বড় বড় করে তাকালো, বলল, “আমি এখন এই বর বেশে বাইকে উঠব? পাগল হলি তুই?”

কল্লোল বিরক্তিতে চ সূচক শব্দ করল।
“তোকে উঠতে কে বলেছে ইডিয়েট! আমি যাব।”

“আচ্ছা! গ্যারেজে আছে, নিয়ে আয়… এই যে চাবি!”

কল্লোল ক্যাচ ধরে গ্যারেজের দিকে চলে গেল বাইক আনতে।

“ঊর্মি, ইশা, তোরা গাড়িতে উঠ তাড়াতাড়ি। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে।” ওদের দিকে তাকিয়ে বলল সামির।

“কিন্তু ভাইয়া মাইক্রোতে তো আমার বমি হয়!” ঊর্মি ঠোঁট উল্টে তাকালো।

“ওহ্ তাইতো! ভুলে গেছি! তাহলে এখন? তারপর একটু থেমে আবার বলল, “আচ্ছা তুই এক কাজ কর, কল্লোলের সাথে বাইকে আয়…”

বলতে বলতেই কল্লোল বাইক ঠেলে গ্যারেজ থেকে বের করল। হেলমেটটা এক হাতে ধরে পেছন থেকে রোদে চকচক করে ওঠা বাইকের পেছনের সিটে একবার তাকিয়ে আবার সামনে ফিরল।

“হ্যাঁ? আমি? ওই গোমড়ামুখো লোকটার সাথে? জীবনেও না! তার থেকে বমি করতে করতে মাইক্রোতে যাওয়া ভালো!” নিজের মনে বিড়বিড় করলো ঊর্মি।

“ঊর্মি, ও হচ্ছে কল্লোল- আমার ফ্রেন্ড… পরিচয় হয়েছে তোর সাথে? কালকে তোকে যার কথা বলছিলাম…”

তারপর একটু থেমে কল্লোলের দিকে তাকিয়ে বলল, “কল্লোল, ও ঊর্মি, আমার কাজিন। ওর মাইক্রোতে উঠতে প্রবলেম হয়। তুই ওকে তোর সাথে বাইকে নিয়ে যা…”

“ন-ন-না! না মানে আমি মাইক্রোতেই যাব…”

সামির হতাশ ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল,
“তাহলে যা, গাড়িতে উঠ। এখন আমার মাথা গরম করিস না।”

ঊর্মি মুখ বাঁকা করে বলল,
“ওই গোমড়ামুখোর সাথে কে যাবে, হুহ্! যখনই দেখবে পেঁচার মত মুখ করে রেখেছে… করোলা কোথাকার! করোলাও তো মনে হয় খেতে এর চেয়ে মিষ্টি হয়…”

ইশা পাশ থেকে ফিসফিস করে বলল,
“আপু…চুপ করো! এত জোরে বলছো কেন… তোমার ওই ‘করোলা’ কিন্তু পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।”

“এই এই! আমার করোলা মানে?”

ইশা কেশে গলা পরিষ্কার করল। সামির ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, “ঊর্মি, তুই তাহলে…”

“না ভাইয়া, আমি মাইক্রোতেই যাচ্ছি!” ঊর্মি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো।

কল্লোল এক মুহূর্তের জন্য ওর দিকে তাকাল। তারপর সামিরের দিকে তাকিয়ে বলল, “তাড়াতাড়ি গাড়িতে ওঠ? রওনা দিতে দিতেই তো দুপুর শেষ করে ফেললি!”

“উঠছি… ঊর্মি এখনো সময় আছে… তাড়াতাড়ি বল, বাইকে যাবি কিনা!”

ঊর্মি একপা পেছনে পেছালো, আবার একপা সামনে এল। ইশা কনুই দিয়ে গুঁতো মারল ওকে, ফিসফিস করে বলল, “কি করছো? রাজি হও না! এতো ভাবাভাবির কি আছে?”

ঊর্মি চাপা গলায় বলল,
“এই করোলা সাহেবের সাথে পুরো রাস্তা… আমার কি মাথা খারাপ?”

সামির বিরক্ত গলায় বলল,
“ঊর্মি, বাইকে যাবি কিনা? সময় দিচ্ছি এক মিনিট। তারপর মাইক্রো ছেড়ে দিচ্ছি!”

ঊর্মি তাকাল কল্লোলের দিকে। বাইকের গ্লাভস পরে ইতিমধ্যে হ্যান্ডলে হাত রেখেছে সে। চোখেমুখে কোনো তাড়া নেই, নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে এদিকে।

ঊর্মি ঠোঁট কামড়ে নিচু গলায় বলল,
“ঠিক আছে… বাইকেই যাব।”

কল্লোলে ঠোঁটের আগায় সবার অগোচরে খুব ধীরে ধীরে ফুটে উঠল একটুকরো হাসির রেখা। ধুলো উড়িয়ে পরপর দুটো মাইক্রো বেরিয়ে গেল মুহূর্তেই।

ঊর্মি এগিয়ে গেল বাইকের দিকে। কল্লোল ওর দিকে না তাকিয়ে একখানা হেলমেট বাড়িয়ে দিল।
“পরে নিন।”

“না পরলে হয় না?” ঊর্মি বিরক্ত চোখে তাকালো। এসব ফালতু জিনিস পরতে একদমই ইচ্ছে করে না ওর।

“না।” একশব্দে উত্তর দিল কল্লোল।

ঊর্মি এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। হেলমেটটা হাতে নিয়ে তাকাল কল্লোলের মুখের দিকে।

কী একটা বলতে চাইলো বোধহয়, কিন্তু বলল না। আড়ালে ভেংচি কাটল, “গোমড়ামুখো করোলা কোথাকার!”

তারপর হেলমেটটা মাথায় পরে নিল নিঃশব্দে।

কল্লোল তখন পেছনের সিটের দিকে ইঙ্গিত করল,
“ধরে বসুন।”

ঊর্মি ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কাকে?”

“কাউকে না,” কল্লোল ঠান্ডা স্বরে বলল,
“পেছনের হ্যান্ডলটা ধরুন। ভারসাম্য ঠিক রাখতে পারবেন।”

ঊর্মি অপ্রস্তুত মুখখানা লুকাতে অন্যদিকে তাকালো। গালটা যেন একটু বেশি লালচে হয়ে উঠেছে ওর। মনে মনে নিজেকে ধমকে ইতস্তত করে শাড়ি সামলে ধীরে ধীরে উঠে বসলো বাইকের পেছনে।

বাইকের ইঞ্জিন গর্জে উঠল। এক মুহূর্তের মধ্যে সুসজ্জিত বিয়ের গেট পেছনে ফেলে ওরা ছুটে চলল নির্দিষ্ট গন্তব্যে, এই ধূলিমাখা জুনের উত্তপ্ত দুপুরে।

To be continued…