জলতরঙ্গের সুর পর্ব-০৪

0
2

#জলতরঙ্গের_সুর
পর্ব – ০৪
লেখা – আসফিয়া রহমান
অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ❌

বিয়ে বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেল। কনে পক্ষের গেট আটকানোর হাবিজাবি লেনদেন মিটিয়ে বরপক্ষ যখন বাড়িতে ঢুকল তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায়। উচ্চস্বরে গানের শব্দ, হই-হুল্লোড়, আতশবাজির
আলো— সব মিলিয়ে জমজমাট পুরো বিয়ে বাড়ি।

বাড়িটা বেশ বড়। একটা পুরনো পুরনো গন্ধ আছে বাড়িটায়।

ঊর্মি একটু দূরে দাঁড়িয়ে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল আশপাশের মুখগুলোতে। কিছু চেনা, অচেনা কিছু। সবাই ব্যস্ত, হৈচৈ আর হুড়োহুড়িতে। মেয়েরা কনে সাজাতে ব্যস্ত, ছেলেরা বিভিন্ন জিনিসপত্র নিয়ে দৌড়াচ্ছে এদিক-ওদিক।

“বাড়িটা একটু ঘুরে দেখলে কেমন হয়?”
নিজের মনে ভাবল মেয়েটা। এরকম পুরোনো ধরনের বাড়ি ওর বেশ পছন্দ। যেই ভাবা সেই কাজ। ও বেরিয়ে পড়ল পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখতে।

ঊর্মি পেছনের করিডোর পেরিয়ে ভিতরের উঠোনে এল। উঠোনের মাঝে একটা বড়সর আমগাছ, শাখাগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঢেকে রেখেছে চারদিক, যেন নিজের হাতে বাড়ির এই অংশটুকু আগলে রেখেছে সযত্নে। গাছের গায়ে পুরনো দাগ, নিচে খোলা মাটি, আর তার একপাশে পুরনো কাঠের দোতলা সিঁড়ি।

ঊর্মি ওদিকে এগিয়ে গেল।

সিঁড়িতে পা রাখতেই বয়সের ভারে একটু যেন দুলে উঠল কাঠটা। তারপর ও আস্তে আস্তে উঠে গেল ওপরে। ওপরতলায় ছাদটা বেশ বড়, ছাদের একপাশে চিলেকোঠার ঘর। ছাদ থেকে দূরে তাকালে দেখা যায় গ্রামের প্রান্তর। কোথাও ধোঁয়া উঠছে রান্নাঘরে, কোথাও সন্ধ্যার আগে আগে খেলা শেষে বাড়ি ফিরছে ছোকড়ার দল।

ছাদের এক প্রান্তে পুরনো ধাতব জানালাওলা চিলেকোঠার ঘর। তালা নেই, দরজাটা আধাখোলা। কৌতূহলবশত ও দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকল।

ভেতরে ধুলোমাখা পুরোনো চেয়ার, বিবর্ণ রংয়ের দেয়ালের একপাশে ঝুলছে মাকড়সার জাল, মেঝেতে রাখা একটা ভাঙা আয়নাসহ আরো কিছু হাবিজাবি জিনিসপত্র। রুমটা বোধহয় স্টোর রুম হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

হঠাৎ করে ভাঙা আয়নাটার পেছন থেকে কিছু একটা দৌড়ে গেল মনে হল! ফিসফিস একটা শব্দও হলো বোধ হয়।

ঊর্মির বুক ধক করে উঠল।

“ক-ক-কী… কী ছিল ওটা?”
ও চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকল আয়নাটার দিকে। কিন্তু আয়নাটা তখনও নিঃসঙ্গভাবে চুপ করে পড়ে আছে মেঝেতে, যেন কিছুই হয়নি।

এক পা পিছিয়ে আসতেই হঠাৎ করে একটা শব্দ হলো

“ঠাস!”

ঘরে জ্বলতে থাকা স্বল্প পাওয়ারের আলো নিভে গেল। অন্ধকার যেন এক মুহূর্তে গিলে ফেলল আলোটাকে। বাজতে থাকা গানের শব্দও থেমে গেছে এক মুহূর্তের মধ্যে, কারেন্ট চলে গেছে পুরো বাড়িতেই।

“আল্লাহ!” চমকে উঠল ঊর্মি। হতবাক অবস্থায় হাত দিয়ে হাতরাতে চেষ্টা করল সামনের অন্ধকারটা।

কঠিন নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। বাইরে আতশবাজি, গানের শব্দ— সব থেমে গেছে। পুরো বাড়িটা যেন হঠাৎ করেই দম বন্ধ করে নিঃশব্দ হয়ে গেছে। ঘরটা আরো গা ছমছমে হয়ে উঠেছে। অন্ধকারে আয়নাটা কীভাবে যেন আরো বেশি বিকৃত দেখাচ্ছে। একটা খসখস শব্দ হলো আবারও।

ঊর্মি নিঃশ্বাস আটকে গেছে বলে মনে হচ্ছে ওর। কণ্ঠনালী শুকিয়ে গেছে, গলা দিয়ে শব্দ বের করতে পারছে না ও।

ঠিক তখনই পেছন দিক থেকে একটা পায়ের শব্দ হলো।

টক্… টক্… ভারী কাঠের মেঝেতে যেন হাঁটছে কেউ। কেউ… ওর দিকে এগিয়ে আসছে!

ঊর্মির বুক ধড়ফড় করতে শুরু করলো। ভয় আর অজানা আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে ফেলল ও।

দোয়া ইউনুস মনে করার চেষ্টা চালালো।
“লা ইলাহা ইল্লা আনতা…”
কিন্তু ভয়ের ঠেলায় তালগোল পাকিয়ে গেছে সবকিছু। পরের অংশ আর মনে আসছে না।

আর এক মুহূর্তও না ভেবে আস্তে আস্তে পেছাতে শুরু করলো ও। পেছাতে পেছাতে ধাক্কা খেলো দরজার কাঠের পাটাতনে। আরেক দফা চমকে উঠল ও।

ঘরটা থেকে কোনোরকমে বের হয়ে ছাদের খোলা বাতাসে এসে দাঁড়ালো উর্মি। ছাদে এসে কিছুটা হালকা হবার কথা। কিন্তু না, এখানে আরও বেশি সুনসান। নিঃশব্দ, চাপা একটা শূন্যতা বিরাজ করছে চারপাশে।

আকাশ কালো। আকাশে চাঁদ নেই আজ। দু একটা তারা অবশ্য দেখা যাচ্ছে; তবে তাতে অন্ধকার বাড়ছে বৈ কমছে না।

হঠাৎ করে ও দেখল একটা দীর্ঘ অবয়ব এগিয়ে আসছে ওর দিকেই।

উর্মির হাঁটু কেঁপে উঠল। গলার স্বর ফিরে এল না ওর।নিঃশ্বাস আটকে আসছে; কী করবে ভেবে পেল না ও।

আবারো পেছাতে গিয়ে ধাক্কা খেলো ছাদের এক পাশে রাখা টিনের বালতিতে। একটা ধাতব শব্দে চূর্ণ হলো চারপাশের নিস্তব্ধতা।

“ঊর্মি?” একটা স্বল্প পরিচিত কণ্ঠ ভেসে এল অন্ধকারের ভেতর থেকে।

ও চমকে উঠল, কিন্তু সেই স্বল্প চেনা গলার ভরসায় ভেতরের ভয়, আতঙ্ক সবকিছু যেন হঠাৎ পাথরের মতো গলা ছেড়ে নামতে শুরু করল বুকের ভেতর।

কল্লোল!

আর কিছু না ভেবে, কোনোদিকে না তাকিয়ে, অন্ধকারের মধ্যেই সেই অবয়বটার দিকে দৌড়ে গেল ঊর্মি।
কল্লোল কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঊর্মি তীব্রগতিতে জাপটে জড়িয়ে ধরল ওকে।

একটা শক্ত কাঁধ, গায়ে মৃদু পারফিউমের গন্ধ…
চাপা কণ্ঠে কেঁপে ওঠা গলায় ঊর্মি বলল,
“আ-মি… আ-মি ভ-ভ-য় পেয়েছি… খ-খুব ভয় পেয়েছি…”

কল্লোল এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। ওর দু’হাত তখন ওপরে হ্যান্ডস আপ ভঙ্গিতে উঁচু করে রাখা।

তারপর ও ধীরে ধীরে নিচে নামিয়ে আনল হাতদুটো, হাত রাখল ঊর্মির কাঁধে। গম্ভীর স্বরটা প্রথমবারের মতো নরম হলো বোধহয়, “ঊর্মি… আপনি অন্ধকারে ভয় পান?”

ঊর্মি কিছু বলল না। মাথা নিচু করে রইল। কাঁধটা একটু নড়ল ওর। মনে হল যেন ওর শরীর এখনো কাঁপছে।

কল্লোল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

“আসুন, এদিকটায় রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াই–”

ঊর্মি চুপচাপ অনুসরণ করল কল্লোলকে। ছাদের এক কোণে রেলিং ঘেঁষে গিয়ে দাঁড়াল ওরা দু’জন। নিচে অনেকগুলো ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলে উঠছে ইতিমধ্যে, বিয়েবাড়ির শব্দ, হুল্লোড় আবারো শুরু হয়েছে অন্ধকারের মধ্যেই। অথচ ছাদটা যেন একদম অন্য একটা জগৎ… শান্ত, নিঃস্তব্ধ, তীব্র অন্ধকারে মোড়া।

ঊর্মি নিঃশব্দে কল্লোলের পাশে দাঁড়াল। কয়েক মুহূর্ত কেউ কিছু বলল না।

তারপর কল্লোলই হালকা গলায় বলল,
“এই বাড়ির ছাদে উঠে কি এমন অ্যাডভেঞ্চার করার ইচ্ছে ছিল, নাকি একেবারেই প্ল্যান ছাড়া?”

ঊর্মি একবার তাকাল ওর দিকে। অন্ধকারে ঠিকঠাক চেহারা দেখা যাচ্ছে না, গলার ভঙ্গিতে যেন একটা মৃদু কৌতুকের আভাস।

“আমি… আমি শুধু বাড়িটা ঘুরে দেখতে চেয়েছিলাম। পুরোনো বাড়ি, পুরনো বাড়ি দেখার আমার খুব শখ। জানেন তো… একেকটা ইট, দেয়াল, জানালা সবাই মিলে যেন একটা গল্প বলে।”

“গল্প?” কল্লোল হেলান দিয়ে দাঁড়াল রেলিংয়ে,
“আপনি বুঝি গল্প শুনতে পছন্দ করেন?”

“শুনতেও, ভাবতেও…” ঊর্মি হালকা গলায় বলল।
তারপর একটু থেমে, নিচে বিয়েবাড়ির দিক তাকিয়ে ও আবার বলল, “কিন্তু আজকে আমার গল্পটা একটু ভৌতিক ধরনের হয়ে গেল!”

কল্লোলের ঠোঁটের কোনায় প্রথমবারের মতো দেখা গেল মৃদু হাসির রেখা।
“তাও তো আমি আপনার গল্পে ‘ভালো ভূত’ হয়ে হাজির হলাম। কেউ না থাকলে আপনি এতক্ষণ কী করতেন কে জানে!”

ঊর্মি ভ্রু কুঁচকে তাকালো এবার।
“আপনি ভূত না, আপনি হচ্ছেন একটা ছায়ামানব! আপনার জন্যই আমি বেশি ভয় পেয়েছি…”

কল্লোল অবাক হয়ে তাকালো, “ছায়ামানব?”

ঊর্মি চোখ সরিয়ে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকাল। তারপর বলল,
“হ্যাঁ, ছায়া মানব। অন্ধকারে ছায়ার মতো নীরবভাবে চলাফেরা করেন, কথাও বলেন খুবই অল্প, আবার হঠাৎ হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ান আর মানুষের আত্মা কাঁপিয়ে তোলেন!”

কল্লোল কাঁধ ঝাঁকালো, হাসল না।
“আচ্ছা! তাহলে তো আপনি খুব সাহসী, ছায়া মানবের মুখোমুখি হয়েও পালাননি। বরং জড়িয়ে ধরেছেন?”

ঊর্মি তড়িঘড়ি করে বলল, “ওটা এক্সিডেন্ট ছিল! ভয় পেয়ে কাকে ধরছি, সেটা তখন বোঝার অবস্থায় ছিলাম না আমি!”

“ভুল করেও সোজা আমার দিকে দৌড়ে এলেন?” কল্লোল ভ্রু উঁচিয়ে তাকাল, তবে অন্ধকারে দৃশ্যমান হলো না সেটা।

ঊর্মি একটু চুপ করে গেল এবার।
তারপর আস্তে করে বলল, “আমার ছোটবেলা থেকেই অন্ধকারে খুব ভয় লাগে। ছোটবেলায় একবার লিফটে আটকে গিয়েছিলাম— বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল, দরজা খুলছিল না। আমি চিৎকার করছিলাম… অনেকক্ষণ ধরে। কিন্তু কেউ শুনতে পায়নি।
সেই আধঘণ্টা মনে হয়েছিল ঘণ্টার পর ঘণ্টা…
আমি ঘেমে উঠেছিলাম, মাথা ঘুরছিল, দম নিতে পারছিলাম না।

…শেষে যখন দরজা খোলা হয়েছিল, আমি প্রায় সেন্সলেস… সেই থেকে এই ভয়টা রয়ে গেছে।”

কল্লোল এবার আর ঠাট্টা করল না। চোখের ভাব যেন খানিকটা নরম হয়ে এলো ওর।
“আপনার ভয়টা তাহলে খুব সত্যি, তাই না?”

ঊর্মি মাথা নাড়ল ধীরে।
“সবাই ভয় পায় কিছু না কিছুতে। কেউ সেটা লুকাতে পারে, কেউ পারে না।”

“আর আপনি?”

“আমি মাঝে মাঝে লুকাতে পারি,” বলে একটু হেসে ফেলল মেয়েটা, “আর মাঝে মাঝে… ছায়ামানবদের জড়িয়ে ধরি!”

কল্লোল কিছু বলল না। ঠোঁটের কোণায় যেন খুব গোপনে খেলে গেল এক বিন্দু নরম হাসির রেখা, ঠিক যেমন হঠাৎ করে আকাশের মেঘের ফাঁকে দেখা দেয় একফালি চাঁদের কিরণ।

অন্ধকারটা আর আগের মতো ভারী লাগছে না এখন। যেন কারো শ্বাস, কারো শব্দ, কারো উপস্থিতি একে উষ্ণ করে তুলেছে অনেকখানি।

নিচে বিয়ে বাড়ির চিৎকার, হাসি, শোরগোল ভেসে আসছে, আর বিপরীতে ছাদে বহমান এক চিলতে নিরবতা, এই বিশাল অন্ধকার আকাশের নিচে।

To be continued…