জলতরঙ্গের সুর পর্ব-০৫

0
1

#জলতরঙ্গের_সুর
পর্ব – ০৫
লেখা – আসফিয়া রহমান
অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ❌

সকাল থেকেই পুরো বাড়িজুড়ে অস্থির ব্যস্ততা। ঊর্মিদের বাড়িতে রিসেপশন প্রোগ্ৰাম আজ। ভোরের আলো ফোটার আগেই ঘুম ভেঙেছে সবার। সকাল থেকেই যেন নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই কারও।

উঠানে অস্থায়ী প্যান্ডেল তোলা হয়েছে আগেই, আজ সকালে সেই প্যান্ডেলের নিচে সাজানো হয়েছে সাদা-সোনালি কাপড়ে মোড়ানো চেয়ার আর টেবিল। লাইটিং-এর তারগুলো বাড়ির ছাদ, গেট, আমগাছ— সব জায়গায় জটলা পাকিয়ে ঝুলছে।

রান্নাঘরের পাশ থেকে এলোমেলোভাবে ভেসে আসছে মসলা-পোড়া আর রেজালার গন্ধ। সামিরের মা বারবার বলছেন, “পোলাওটা যেন ঠিক মতো ফোটে!”
ঊর্মির বাবা বারান্দায় দাঁড়িয়ে একবার ঝাড়ুদারকে ডাকছেন, একবার ক্যাটারিং-ওয়ালার সঙ্গে ফোনে কথা বলছেন, আর ফাঁকে ফাঁকে সবাইকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, “দুপুর ১টার মধ্যেই কিন্তু অতিথিরা চলে আসবে সবাই!”

সামির তার রিসেপশনের শেরওয়ানি পরে এখনো পুরোপুরি রেডি হয়নি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এখনো চুল ঠিকঠাক করছে সে।

বাড়ির পরিবেশটা একরকম ‘আনন্দের বিশৃঙ্খলা’য় পরিণত হয়েছে। প্রতিটা ঘরে আলাদা করে বসেছে ব্যস্ততা, গল্প, আর হইচইয়ের আসর।

ঊর্মি তখন থেকে শাড়ি পরে একবার বারান্দায়, তো একবার অতিথিদের বসার ঘরে দৌড়াদৌড়ি করছে। ওর মা ধমকাচ্ছে বারবার,
“তুই একটু শান্ত হয়ে বস তো, এত ছোটাছুটি করছিস কেন!”

“আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সব ওভার! এখন না ছুটলে এসব সামাল দিবে কে?” বলে আবার ছুট লাগায় ও।

শাড়ির কুঁচি বারবার পেঁচিয়ে যাচ্ছে পায়ের সাথে।
তবুও থামছে না ও। ছুটেই যাচ্ছে চলন্ত ট্রেনের মত।

“ঊর্মি আপু! ফ্রিজে রাখা চাটনিটা বের করবেন?”

“আচ্ছা যাচ্ছি!” বলেই ও আবার দৌড় লাগাল রান্নাঘরের দিকে।

ঠিক তখনই,
শাড়ির কুচিগুলো ভিষণ বাজেভাবে পায়ে জড়িয়ে গেল ওর। পাতলা শরীরটা হঠাৎ করে ভারসাম্য হারিয়ে সামনের দিকে হুমড়ি খেতে শুরু করল।

ধপ্…

না! পড়ে যায় নি ও। কে যেন ঠিক সময়মতো ওকে ধরে ফেলেছে শক্ত করে।

ঊর্মি চোখ খুলে দেখল, সামনে দাঁড়িয়ে আছে কল্লোল!একহাতে ওর একটা হাতটা ধরা, অন্য হাতে ওর কোমড় আঁকড়ে সামলে নিয়েছে ধাক্কাটা।

“কী সমস্যা? আপনি সবসময় এত ছোটাছুটি করেন কেন বলুনতো?” ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর স্বরে বলল কল্লোল।

ঊর্মি মুখ ভার করে ফেলল,
“আপনার আশেপাশে এলেই আমি শুধু হোঁচট খাই!”

কল্লোল এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকাল ওর দিকে। ওর গলায় কোনোরকম রসিকতার ছোঁয়া নেই, তার বদলে গম্ভীরতা বিরাজ করছে পুরো কন্ঠস্বর জুড়ে।

“আচ্ছা? তাহলে আশেপাশে আসবেন না।”
শব্দগুলো খুব শান্ত, কিন্তু কাঁটার মতো টুক করে যেন বিঁধে গেল ঊর্মির বুকের ভেতর।

ও আস্তে করে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল।

“সরি… আমি তো শুধু বললাম…”

“কিছু বলার প্রয়োজন নেই। গো ব্যাক টু ইওর ওয়ার্ক।”

ঊর্মি স্থির দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। এটা কী হলো?
হঠাৎ করেই আনন্দময় পরিবেশটা গুমোট হয়ে উঠল। পেছন ফিরে চলে যাওয়া কল্লোলের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করেই বড্ড অচেনা ঠেকলো ওর চোখে।

অবশ্য, অচেনাই তো!
ঊর্মি কদিন ধরে চেনে ওই মানুষটাকে? মানুষটা পেশায় কী করে, কী খেতে পছন্দ করে, বিকেলবেলা চুপচাপ থাকে নাকি আড্ডা দেয়— কিছুই তো জানে না ও।
তবে কিসের এত চিন্তা? এত অভিমান?

ওর বুকের ভেতরটা কেন যেন টনটন করে উঠল, বুঝতে পারল না ও। চোখে জমলো ধোঁয়াটে অভিমান। একটা কথাও আর বের হলো না ওর মুখ থেকে।

শাড়ির কুচিগুলো সামলে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল ঊর্মি। মাথা নামিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে বেরিয়ে গেল ওখান থেকে।
কেউ তাকালো, কেউ ডাকল না, কেউ থামাল না।
কল্লোলও না।

__________________________________

আকাশের রং তখন বদলাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে, সূর্যটা হেলে পড়েছে পশ্চিম দিকে। শেষ বিকেলের আবছা আলো গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ছায়া ফেলছে উঠান জুড়ে। বাড়ির মানুষগুলো এখনো ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে এদিক-ওদিক।

বাড়ির পেছনের বাগানে রোদের ধারে দাঁড়িয়ে আছে নারকেল গাছে বসে থাকা কাক, বাতাসে পাতারা নেচে উঠছে ঝিরঝির করে— যেন তারাও বুঝেছে আজ অন্যরকম একটা দিন। পুকুরের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছগুলো দীর্ঘ ছায়া ফেলেছে উঠোন পেরিয়ে ঘরের বারান্দা অবধি। ঘাট বাঁধানো পুকুর পাড়ে পকেটে দুহাত গুঁজে একা একা দাঁড়িয়ে আছে কল্লোল।

দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে পুকুরের টলটলে পানিতে। পুকুরের পানিটা টলমল করছে মৃদু বাতাসে। যেন ওর নিজের ভিতরের অস্থিরতাটাই প্রতিফলিত হচ্ছে পানিতে।

এক হাত পকেটে রেখে, অন্য হাত দিয়ে কপাল চেপে ধরল ও। বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে মুহূর্তটা। শাড়ির কুচিতে পা জড়িয়ে পড়ে যাওয়ার ভয়ে ভীত সেই মুখটা, শক্ত করে বন্ধ করে রাখা চোখের ঘন পাপড়িগুলো আর ওর নিজের মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসা কড়া কথাগুলো।

“তাহলে আশেপাশে আসবেন না।”

আচমকা কি একটু বেশি কড়া হয়ে গেল না ও?
কিন্তু ও নরম ছিলই বা কবে?
ও তো বরাবরই এমন— শক্ত, কড়া, গম্ভীর।

ভেতরটা নরম ছিল কি না, সে হিসেব আর কে কবে করেছে? নিজের অনুভূতি কবে গুরুত্ব পেয়েছে ওর কাছে?

যতটুকু জরুরি, ততটুকুই প্রকাশ করে এসেছে সবসময়। তার বাইরে কিছু বলার, শোনার, ভাবার বা বোঝানোর মত সময় ছিল কোথায়?

সমুদ্রের মাঝে দাঁড়িয়ে যখন বাতাসে ভেসে আসে
সংকেত—
“ALPHA BRAVO… MISSION INBOUND…”
তখন অনুভূতি নয়, কর্তব্যই হয়ে ওঠে একমাত্র সত্য।

যে জীবন ও বেছে নিয়েছে, সেখানে সামান্য দ্বিধাবোধও হতে পারে বড় ক্ষয়ক্ষতির কারণ। কমান্ড দিতে হয় ঠান্ডা মাথায়, চোখে চোখ রেখে।

নরম হলে চলে না। অবসরে এসেও সেই অভ্যেসে ভাঙন ধরেনি।

তাই হয়তো আজও, এমন এক স্পর্শকাতর পরিস্থিতিতে… ও ঠিক উল্টোটা বলে ফেলল।
কিন্তু কথা কি আর ফেরানো যায়?

ঊর্মির চোখের সেই হতবিহ্বলতা, অপমানিত, থমকে যাওয়া মুখটা বারবার ভেসে উঠছে চোখের সামনে।
চারপাশে সবাই ব্যস্ত এখন। কেউ জানেও না, একটু আগে একটুখানি ভুল একটা ছোট্ট হৃদয়ে ঠিক কতখানি আঁচড় কেটেছে।

কল্লোল দুহাতে মুখ ঢেকে একটা দীর্ঘ, ভারী নিঃশ্বাস ফেলল।

সারা জীবন মেয়েদেরকে উপেক্ষা করে আসা ও কেন আজ একটা অর্ধ পরিচিত মেয়ের অনুভূতি নিয়ে এতটা ভাবছে?

পুকুরের জল একটু আগে যে রকম টলটল করছিল বাতাসে, এখন সেটা স্থির…
শুধু কল্লোলের ভিতরেই ঢেউ উঠছে,
নিঃশব্দ, দুর্বোধ্য, উত্তাল ঢেউ…

To be continued…