#জলতরঙ্গের_সুর
পর্ব – ০৬
লেখা – আসফিয়া রহমান
অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ❌
সকালের আলতো রোদে উঠোনটা ছাওয়া। হালকা ঝিরঝিরে বাতাসটা উপভোগ করতে করতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে ঊর্মি। চারপাশটা এখন শান্ত, সবাই গাঢ় ঘুমে বিভোর।
ঊর্মি সাতসকালে উঠে পড়েছে আজ। অন্যরা কেউ এখনো ওঠেনি। একা একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল ঊর্মি, এমন সময় ইশা এসে উপস্থিত হলো সেখানে।
“আপু, কী করো?”
ঊর্মি চমকে উঠলো।
“তুই কখন এলি?”
সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ইশা আবার বললো,
“কার কথা চিন্তা করছিলে যে, আমাকে দেখতেই চমকে উঠলে?”
“সব সময় খালি উল্টাপাল্টা কথা বলিস কেন? কেউ এখনো ওঠেনি, তাই হঠাৎ করে তোকে দেখে চমকে উঠেছি।”
“কল্লোল ভাই আজকে চলে যাবে, জানো?”
ঊর্মি কফির কাপটা আঁকড়ে ধরল শক্ত করে।
“আজই চলে যাবে নাকি?”
ইশা এবার একটু অবাক গলায় বলল,
“হ্যাঁ তো, তুমি জানতে না?
ঊর্মির ঠোঁট ছুঁয়ে থাকা কফির কাপে আর চুমুক পড়ল না। মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে ও বলল,
“আমার কি জানার কথা নাকি!”
ইশা একটু থতমত খেল ওর কথা শুনে।
“মানে… আমি তো ভেবেছি তুমি জানো। গতকাল রাতে শুনেছিলাম, সকালে চলে যাবে…”
ঊর্মি ঠোঁট শক্ত করে রাখল।
কফির কাপটা এখনো হাতে ধরা, কিন্তু ওর দৃষ্টি এখন বারান্দার ছাড়িয়ে দূরে কোথাও। যেন আর কোনো শব্দ ওর কানে পৌঁছাচ্ছে না। কী এক অজানা ধাক্কা যেন এসে লেগেছে বুকের মাঝখানে।
ও তো ভেবেছিল… আরো কদিন থাকবে হয়তো।
কথাও হবে হয়তো আবার,
একটা স্বাভাবিক “বাই” তো অন্তত বলা যাবে…
কালকের ঘটনার পর আর কোনো কথা হয়নি দুজনের। কী থেকে যে কী হয়ে গেল, এখনো ঠিক ঠাহর করতে পারে না ঊর্মি। ও তো মজা করে ওরকম বলেছিল। তাতেই যে ওই গোমড়ামুখো ছায়ামানবটা এত রেগে যাবে কে জানতো?
কোনো কথাই শুনলো না সে আর? নিজের যা মনে হলো বলে চলে গেল? কী অদ্ভুত! সাধে কি আর ঊর্মি ওই খারুশ ব্যাটাকে এমন নাম দিয়েছে?
গোমড়ামুখো করোলা কোথাকার!
“এখন কোথায় সে?” ওর গলা খানিকটা শুকনো শোনাল বোধহয়।
“জানি না। রুমে হয়তো…”
ঊর্মি ঠোঁট চেপে রইল। মনে মনে ভাবল,
কেন এমন লাগছে? ও ক’দিন চেনে কল্লোলকে?
বুকের ভেতরটা ভার ভার লাগছে কেন?
কল্লোলের আচরণ ছিল ঠান্ডা, গম্ভীর, এমনকি কিছুটা নিষ্ঠুরও। তবুও যেন প্রথম থেকেই ওর প্রতি একটা নীরব সম্মোহন কাজ করেছে ঊর্মির।
ঊর্মি কি যাবে ওর সাথে একবার দেখা করতে? না যাবে না? এই দ্বিধা নিয়েই দাঁড়িয়ে রইল ও। গেলে যদি আবারও উল্টাপাল্টা কিছু বলে বসে?
ঊর্মি আজ হালকা রঙের একটা সালোয়ার কামিজ পরেছে। চুলগুলো এলোমেলো, চোখে খানিকটা ক্লান্তির ছাপ। রিসেপশনের ঝকঝকে সাজের পর আজ যেন ওকে খুব সাধারণ দেখাচ্ছে। আর সেই সাধারণত্বেই যেন একটা অন্যমাত্রার টান আছে।
গেস্টরুমের সামনে বারান্দায় চেয়ারে বসে একটা বই পড়ছিল কল্লোল। তবে অনেক্ষণ থেকেই ওর চোখ ঊর্মির ওপর। ওর যাওয়ার কথা শুনে ঊর্মির অভিব্যক্তিটা ও পাল্টে যেতে দেখেছে স্পষ্ট। চোখের দৃষ্টি নিস্পন্দ হয়ে গিয়েছিল হঠাৎ। কফির কাপটা একটু একটু করে চেপে ধরছিল শক্ত করে।
ও টের পেয়েছে, অবাক হয়েছে। ঊর্মির কাছ থেকে এমন প্রতিক্রিয়া আশা করে নি ও।
যাবার আগে ও হয়তো একবার দেখা করতেই পারত, বলতে পারত, “আমি যাচ্ছি। ভালো থাকবেন।”
কিন্তু সেই বলার অভ্যেসটা ওর জীবন কখনো শেখায়নি।
নেভি-র কঠিন ট্রেনিং আর শৃঙ্খলার মাঝে “নিজের অনুভূতি” বলে কিছু খুব বেশি গুরুত্ব পায়নি কখনো।
এমনকি প্রিয় মানুষদের কাছেও না।
প্রিয় মানুষ?
শব্দটা অনেক দূরের লাগে।
ওর জীবনে এমন কেউ কখনো ছিল না।
হয়তো হওয়ার সুযোগই পায়নি।
ঠোঁট শক্ত রেখেই চোখ ফিরিয়ে নিল কল্লোল। জোর করে মনোযোগ দিল বইয়ের পাতায়।
ও চলে যাবে।
ঊর্মির দিকে না তাকিয়েই।
না কিছু বলে, কোনো ব্যাখ্যা না দিয়ে।
মায়া বাড়াতে চায় না ও। ওর জীবনঅভ্যাসে মায়ার কোনো জায়গা নেই।
ঊর্মি জানে, হয়তো এটাই শেষবার দেখা।
অচেনা সহযাত্রী আগন্তুককে জানার যতটুকু সুযোগ হয়েছিল সেটাই বা কম কি?
ভালো লাগা একতরফা হলে কথা শুরু করা যায় না।
যা শুরুই হয়নি, তার শেষ কাকে বলে?
____________________π_________________
নেভির জাহাজটা তখন অবস্থান করছে গভীর সমুদ্রে।
চারদিকজুড়ে বিরাজ করছে অনন্ত জলরাশি, যেন নীল এক নিঃসঙ্গতা।
জাহাজের ডেকের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছেন ক্যাপ্টেন আবরার ইমতিয়াজ কল্লোল। তার চোখে কালো সানগ্লাস, দাঁড়ানোর ভঙ্গিমায় কঠিন দৃঢ়তা। কিন্তু বাহিরের আবরণ বাদ দিলে ভেতরের মানুষটা যেন স্তব্ধ হয়ে আছে একরকম।
তিনদিন হলো জাহাজ ঘাট ছেড়েছে।
এই তিনদিনে কেউ জানে না, কীভাবে ও বারবার নিজের বুকের বাঁপাশে একটা চাপা অস্বস্তি টের পাচ্ছে।
একটা মুখ বারবার ভেসে উঠছে মানসপটে…
একটা বিস্মিত অভিব্যক্তি, শক্ত করে ধরা কফির কাপ…
আর ক্লান্ত দৃষ্টিতে মোড়ানো একটা এলোমেলো সকাল।
কল্লোল চোখ মেলে সামনে তাকাল।
সমুদ্র এখন শান্ত।
ঠিক যেমন শান্ত তার চেহারা।
বুকের ভেতরে দুএকটা ঢেউ উঠছে নিঃশব্দে।
কল্লোল জানে, এই অংশটা ওর জীবনে ঘটে যাওয়া একটা ছোট্ট অংশ মাত্র। এই ছোট্ট অংশের প্রভাবে ওর জীবনকে ‘থামিয়ে’ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ওর টিম রুটিন ডাইভ ট্রেনিংয়ের একটা হাই রিস্ক মিশনে যাবে। নতুন ক্যাডেটদের ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ সুপারভাইজ করতে হবে ওকে।
কর্তব্যের কাছে কোনো আবেগ স্থান পায় না।
“Captain, the diving squad is ready, Sir.”
ক্লিপবোর্ড হাতে রিপোর্ট করল সাব লেফটেন্যান্ট নাভিদ।
কল্লোল চশমাটা খুলল। চোখদুটো অবিচল নিবদ্ধ সমুদ্রের নোনা জলে। শান্ত, স্পষ্ট স্বরে নেই কোনো আবেগের ছিটেফোঁটা।
“Proceed to phase one. Watch the oxygen logs closely.”
কিছুক্ষণ পরেই ডাইভ টিম একে একে জলে নামল।
জাহাজের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল ছোট ছোট তরঙ্গ।
জাহাজের কন্ট্রোলরুমে মনিটরে চোখ রাখছেন কল্লোল।
ডাইভারদের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করছেন নিবিড়ভাবে।
একজন ক্যাডেট এসে বলল,
“Sir, coffee?”
কল্লোল এক মুহূর্ত থামলেন। তারপর মাথা নাড়লেন হালকাভাবে।
“No. Not now.”
তারপর আবার দৃষ্টি ফেরালেন মনিটরে।
___________________________________
সাগরের বুকজুড়ে অবিরাম বয়ে চলেছে অগনিত ঢেউ। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা।
বঙ্গোপসাগরের নির্দিষ্ট সীমানা বরাবর ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে নৌবাহিনীর একটি প্যাট্রোল জাহাজ।
ডেকের ওপর আলোর রেখা, আর চারপাশে শূন্যতা, অন্ধকার আর নিঃস্তব্ধতা যেন মিশে গেছে সাগরের রহস্যময়তায়।
ক্যাপ্টেন আবরার ইমতিয়াজ কল্লোল দাঁড়িয়ে আছেন BNS জাহাজের রাডার ঘরের কাচঘেরা ওয়ার রুমে। তাঁর চোখের সামনে রঙিন sonar, ড্রোন ফিড আর স্যাটেলাইট ম্যাপের ছবিতে ভরা বেশ কয়েকটা মনিটর। স্ক্রিনের আলোতে ছায়া ফেলেছে তাঁর চোখে, ভ্রুজোড়া কপাটের মতো স্থির। ওয়ার রুমের কাঁচের জানালার ওধারে তাকালে দেখা যায় রাতের রহস্যময় সমুদ্র।
কল্লোল দাঁড়িয়ে আছেন মনিটরের সামনে, তার দৃষ্টি স্থির স্ক্রিনের ওপর। তার পাশে দাঁড়ানো কমিউনিকেশন অফিসার গম্ভীর গলায় বললেন,
“Sir, this vessel has been hovering close to our economic zone for the last 90 minutes. No AIS signal.”
[ স্যার, ওরা প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে আমাদের ইকোনমিক জোনের কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করছে। অথচ কোনো সিগন্যাল নেই। AIS একটিভ না। ]
কল্লোল কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না, চোখ সরালেন sonar স্ক্রিনে। একটা বিন্দু ধীরে ধীরে নড়ছে।
“Thermal feed?”
[ থার্মাল ইমেজ আছে?]
“Live. No visible movement on deck.”
[ জাই ভাইভ। ডেকে কেউ নড়াচড়া করছে না। ]
কল্লোল ঠান্ডা গলায় নিজের অনুমান ব্যক্ত করলেন,
“They’re fishing for something. Not fish. They’re testing our response time.”
[ ওরা এখানে মাছ ধরতে আসেনি। আমাদের উপকূলীয় নৌ চলাচলের রুট স্ক্যান করছে। ]
তারপর চোখ নামালেন একটা মিনি কনসোল ম্যাপে, তারপর চিবুকের কাছে হাত নিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, “Initiate silent drone sweep. Passive. No light.” [ ড্রোন পাঠাও। সাইলেন্ট মোডে। আলো যেন না থাকে। ]
দুই মিনিটের মধ্যে স্ক্রিনে ভেসে উঠল ড্রোনের ইনফ্রারেড ফিড। ছোট্ট নৌকা, ডেকে কয়েকজন মানুষের উপস্থিতি।
কোনো দেশের পতাকা নেই, কিছু যন্ত্রপাতি দেখা যাচ্ছে—একটা ছোট রাডার অ্যান্টেনা।
বাহ্যিকভাবে দেখতে লাগছে সিভিল বোটের মতো, কিন্তু খুব সম্ভবত এটা তাদের ছদ্মবেশ।
গম্ভীর স্বরে কমিউনিকেশন অফিসারকে নির্দেশ ছুঁড়লেন কল্লোল—
“Let’s make contact. Send the warning protocol. Channel 16, Bengali & English both.”
[ বার্তা পাঠাও। চ্যানেল ১৬ তে, বাংলা ও ইংরেজি দুটো ভাষাতেই। ]
বার্তা পাঠানো হলো:
> “You are in Bangladesh Naval territory. Identify yourself or turn back immediately.”
> [ আপনি বাংলাদেশের নৌসীমায় প্রবেশ করেছেন। দয়া করে নিজের পরিচয় দিন অথবা এখনই সীমানা ত্যাগ করুন। ]
ওয়ার রুমের পরিবেশ যথেষ্ট থমথমে। পাশে দাঁড়ানো একজন জুনিয়র অফিসার উদ্বিগ্নস্বরে বলল,
“স্যার, আমাদের কি ইন্টারসেপ্ট টিম প্রস্তুত রাখতে হবে?”
কল্লোল মাথা নাড়লেন, চোখ এখনো স্ক্রিনে নিবদ্ধ।
“No. Not yet. Let them choose the easy way.”
[ না। এখনো না। ওদের সহজ পথটাই নিতে দাও। ]
পরমুহূর্তে দেখা গেল—
বোটটি দিক পাল্টে ফিরছে সীমানার বাইরে। উপস্থিত সবার মধ্যে যেন নেমে এলো এক মুহূর্তের স্বস্তি।
কল্লোল নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলেন স্ক্রিনের দিকে। তারপর ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“Record their path. Next time, we will board.”
[ ওদের গতিপথের রেকর্ড রাখো। পরের বার ছেড়ে দেব না। ]
ডেকের ওপরে হঠাৎ একটা ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেল যেন।
কল্লোল জানালার দিকে তাকালেন।
চাঁদের আলো সমুদ্রের কুঁচকে যাওয়া ঢেউয়ে পড়ে মিলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। চারদিকে ছড়িয়ে থাকা ধোঁয়াটে ঘোরলাগা অন্ধকারে, একের পর এক ঢেউ আর সমুদ্রের গর্জন মিলে তৈরি করেছে এক গভীর রহস্য।
কোনো সংঘাত-বিস্ফোরণ ছাড়াই একটা অলিখিত লড়াই শেষ হলো আজও। এই মাঝসমুদ্রে ‘বীরত্ব’ মানে রক্তপাত নয়, বরং প্রতিপক্ষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ঠান্ডা মাথায় নেওয়া একেকটা সঠিক সিদ্ধান্ত।
কল্লোল ঘুরে দাঁড়ালেন।
সামনের মাপজোক, ফিড, তথ্য সবকিছু বাকিদের হাতে ছেড়ে দিয়ে, রাডার ঘরের আলো পেছনে ফেলে ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেলেন। বাইরে রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল তার সাদা ইউনিফর্মের ছায়া আর নিঃশব্দ উপস্থিতি।
To be continued…