#জলতরঙ্গের_সুর
পর্ব – ০৯
লেখা – আসফিয়া রহমান
অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ❌
বাস থামল সদরঘাট টার্মিনালের একটু আগে। গেটের কাছেই মানুষের ভিড়। গরমে ক্লান্ত ভিড়টা ঘামের পসরা সাজায়, আশেপাশের দোকানদাররা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে জিনিসপত্র বিক্রি করছে।
ঊর্মি আর মেহরিন বাস থেকে নেমে দাঁড়ায়। মেহরিনের হাতে পানির বোতল, ঊর্মির কাঁধে এখনো সেই গোলাপি ব্যাকপ্যাক। দুজনেই কিছুটা ক্লান্ত, কিন্তু এতদিন পর সবার সাথে দেখা হবার উত্তেজনার কাছে তা বড়ই ম্লান।
“ওরা এখনো আসেনি মনে হয়… ” মেহরিন চারপাশে তাকিয়ে বলে।
ঊর্মি তখন একটু দূরে তাকিয়ে একটা পরিচিত মুখ দেখতে পায়।
“ওই তো নিশাত!”
চট্টগ্রামের নিশাত, সবসময় হুল্লোড়প্রিয় আর প্রাণচঞ্চল। ট্রলি ব্যাগের উপর বসে হাত বুলাচ্ছে ঝাঁকড়া চুলে। ওদের দেখেই হাত নেড়ে উঠে দাঁড়ায় ও, “ঊর্মি! মেহরিন! শেষমেশ তোরা এসে গেছিস সত্যিই! আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না…”
ওরা তিনজন জড়িয়ে ধরল একে অপরকে। কতদিন পর দেখা হল! কুশলাদি বিনিময় করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ওরা।
এরমধ্যে বাস থেকে নামে তানিয়া, রাজশাহী থেকে একা এসেছে ও। কাঁধে ব্যাকপ্যাক আর বুকের সঙ্গে চেপে ধরা একটা বই। শান্ত স্বভাবের মেয়েটা, কিন্তু চোখে একটা চাপা কৌতূহল আছে ওর।
“তানিয়াও এসেছে! ভেবেছিলাম, শেষ মুহূর্তে আবার ক্যান্সেলই করে দেয় নাকি!” নিশাত হাসতে হাসতে বলে।
তানিয়া ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি টেনে বলে,
“মন চাইছিল খুব… তাই এলাম।”
ঊর্মি তখন জানে না, সামনে কী ঘটতে চলেছে। ও কেবল এটাই জানে যে, বহুদিন পর পুরোনো সব মুখ একসাথে হয়েছে।
আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর আসে রুবেল।
কাঁধে ব্যাগ, পরনে ট্র্যাভেল গিয়ার। চেহারায় অভিজ্ঞ আত্মবিশ্বাস, কিন্তু সবার সামনে এসে সেটা কমিয়ে আনে একটু।
“সবাই এসে পড়েছো দেখছি, রেডি তো?”
তারপর ম্যাপে হাত রেখে বলে,
“এদিকে যাব আমরা। একটু অফরুট। নেটওয়ার্ক আসবে না। টাওয়ার নেই। তবে সমুদ্র আছে, নিস্তব্ধতা আছে। ভয় পেও না কেউ।”
_____________________
সকালের রোদ এখন খানিকটা চড়া।
রুবেল ওদের নিয়ে এগোয় ঘাটের দিকটায়। নোঙর করা বোটগুলোর পাশে পাথরের সিঁড়ি, নিচে ঘোলা জল উথালপাথাল করছে মাঝেমধ্যে আসা ঢেউয়ে।
ঊর্মি এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে দেখে সমুদ্রকে। এটা ওর চেনা শহরকে ছাড়িয়ে প্রথমবারের মতো এভাবে অচেনা কোনো জলপথে পা ফেলার প্রস্তুতি। তারওপর আবার বাড়ির কাউকে না জানিয়ে!
“এইটাই আমাদের বোট।” রুবেল একটা মাঝারি মাপের ইঞ্জিনচালিত নৌকার দিকে দেখিয়ে বলল। বোটের নাম লেখা আছে নীল রঙে— “Sea Whisper”।
নিশাত আগে আগে উঠে যায়, “উফ্! আমি জানতাম না আমি এতটা এক্সাইটেড!” বলে বসে পড়ে সিটে।
মেহরিন তানিয়াকে ধরে ধীরে ধীরে উঠে, ওরা দুজনে সিট বেছে নেয় পিছনের দিকে। রুবেল শেষবার চেক করে ইঞ্জিন, রেডিও আর লাইফ জ্যাকেট।
ঊর্মি দাঁড়িয়ে থাকে একটু থেমে। সমুদ্র পাড়ের বাতাস এসে চুল উড়িয়ে দেয় ওর মুখে।
ওর মনের ভিতরে অদ্ভুত এক অনুভূতি কাজ করে—
যেন এই বোটের যাত্রা শুধু নিখাদ আনন্দ নয়, কোথাও যেন কোনো অতল ডাকে ওকে, গভীর কোনো নাম না-জানা কিছুর হাতছানি।
“ঊর্মি, উঠছিস না কেন?” মেহরিন ডাকে।
ঊর্মি হেসে ওঠে সামান্য, পা রাখে নৌকায়।
বোট ছাড়ে একটু পরেই। ইঞ্জিনের গর্জনে চাপা পড়ে ভেসে থাকা গল্পগুজবগুলো।
কিন্তু খানিক বাদেই শোনা যায় সবার উচ্ছ্বসিত চিৎকার—
“দেখ, সামনের জলটা কেমন টলটলে!”
“আকাশ আর সমুদ্র কেমন এক হয়ে গেছে!”
“একটা ছবি তোল! প্লিজ!
ঊর্মি এক পাশে বসে থাকে, চোখ বুজে শোনে জল কেটে যাওয়ার সেই গভীর সুর।
ও জানে না, ঠিক কতটা পথ পাড়ি দেবে ওরা।
কিন্তু এটুকু জানে— এই সমুদ্র, এই ঢেউ, এই যাত্রা—
কোনো না কোনোভাবে ওকে গড়ে দেবে নতুন করে।
__________________
ট্রলারের ছোট্ট জানালা দিয়ে প্রথমবার সেন্ট মার্টিন দেখতে পেল ঊর্মি। একটানা দীর্ঘপথ পেরিয়ে এসে যখন নীল আর সবুজের দোলাচলে ছেয়ে থাকা একটা দ্বীপ চোখে পড়ল, তখন ওর বুকের ভেতর কেমন করে উঠল।
নিশাত বলে উঠল,
“এই না হলে সমুদ্র! ঢাকার ধোঁয়া আর জ্যাম ভুলে যেতে ঠিক এইরকম কিছুই লাগত।”
তানিয়া জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিল। বলল,
“এই প্রথম এত কাছ থেকে সমুদ্র দেখছি। কেমন যেন স্বপ্নের মতো।”
মেহরিন হালকা হেসে বলল,
“আরও স্বপ্নময় হবে যদি এখানে রবীন্দ্রনাথ বা কবি নজরুল এসে একটু কবিতা বলে!”
ঊর্মি কিছু বলল না। তাকিয়ে রইল বিস্তীর্ণ নীল জলরাশির দিকে।
সেন্ট মার্টিন ঘাটে নেমে সবাই একটা হোটেলে চেক-ইন করল ওরা। খুব বড় না হলেও জায়গাটা বেশ পরিষ্কার আর ছিমছাম।
রুমে ঢুকেই নিশাত বলল,
“আমি তো ব্যাগ ফেলে এখনই বিচে যাব!”
রুবেল ঘড়ি দেখল,
“তোমরা ঘণ্টাখানেক ঘুরে আসো। বিকেলে আমি ম্যাপ নিয়ে বসব। কাল খুব ভোরে রওনা হব মূল গন্তব্যে।”
______________________________
ঊর্মি আর মেহরিন হাঁটছে নুড়ি-পাথর আর বালির মিশ্রণ ধরে। তানিয়া সাগরের ধারে বসে ছবি তুলছে, নিশাত হাঁটু পানিতে নেমে গিয়েছে, হাসছে ছেলেমানুষি আনন্দে।
সূর্যটা তখন ধীরে ধীরে পশ্চিমে হেলে পড়ছে। সমুদ্রের গভীরে আড়াআড়িভাবে পড়ছে আলোটা।
ঊর্মি আর মেহরিন বালির উপরে পায়ের ছাপ ফেলে হেঁটে চলেছে সমুদ্রতট বরাবর। সেদিকে বারবার এসে গা ঘেঁষে যাচ্ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঢেউ। উর্মির পায়ে লেগে থাকা কাদা আর নোনাজলের শীতলতা যেন শরীরের ক্লান্তি টেনে নিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে।
আকাশ তখন রং বদলাচ্ছে। নীলের গায়ে মাখছে কমলা, তার মধ্যে কোথাও কোথাও হালকা লালচে ছোপ। বাতাসে লবণাক্ততা মিশে গন্ধ ছড়াচ্ছে। সেদ্ধ শামুক, কাঁচা মাছ আর চিংড়ি ভাজার ধোঁয়া যেন একইসাথে ধাক্কা দিচ্ছে ইন্দ্রিয়ে।
তানিয়া একটু দূরে দাঁড়িয়ে নিজের ডিএসএলআরে ক্যামেরা ফ্রেম ঠিক করছে। তার চোখে একটা নিরব কৌতূহল, যেন প্রতিটা ঢেউয়ের ভাঁজে সে খুঁজে নিচ্ছে একেকটা গল্প।
নিশাত তো পুরোটাই অন্য জগতে। সে প্যান্ট গুটিয়ে হাঁটু পর্যন্ত পানিতে নেমে গেছে। হাত তুলে চুল বাঁধছে আবার খুলে দিচ্ছে… একেবারে স্কুলের পুরোনো সেই চঞ্চল নিশাতই যেন ফিরে এসেছে এতদিন পর।
মেহরিন হাসিমুখে বলল,
“এই মেয়েটা এত বছরেও বদলায়নি।”
ঊর্মি হাসে। ওর মুখে এসে পড়েছে গোধূলির নরম আলো।
একটা জায়গায় গিয়ে ওরা সবাই বসে পড়ে, নুড়িপাথর আর শুকনো শামুকের পাশে, সামনের খোলা জলরাশির দিকে মুখ করে।
রুবেল তখন এসে পাশে বসে ম্যাপটা খুলে দেখায়।
ম্যাপটা তার ফোনেই, তবে এবার ও কাগজে ছাপা একটা সংস্করণ এনেছে, কিছু কিছু জায়গায় মার্ক করা সেখানে।
“এই যে দেখো,” সে আঙুল রাখে একটা ছোট্ট বিন্দুর ওপর, “এটা সেন্ট মার্টিন।”
তারপাশেই একটু ঘোলা, অচেনা, নামবিহীন একটা দ্বীপের দিকে ইশারা করে বলে,
“আর এখানে যাব কাল ভোরে। এটা কিন্তু কোনো সরকারি ট্যুরিস্ট ম্যাপে নেই। কিছু কিছু জেলে মাঝে মাঝে মাছ ধরতে যায়, কিন্তু এখন প্রায় নির্জন।”
নিশাত চিৎকার করে ওঠে,
“ঠিক এইরকম জায়গা চাইছিলাম! উইথ নো ওয়াইফাই, নো লোক, নো লাইফ!”
তানিয়া হালকা গলায় বলে,
“নো লাইফ? শুনে একটু ভয়ই লাগছে…”
ঊর্মি তখনও তাকিয়ে আছে ম্যাপের সেই অচেনা দ্বীপটার দিকে। মনে মনে ভাবছে, ঠিক এইরকম একটা দ্বীপে গেলে কী হয়? যেখানে নেটওয়ার্ক নেই, আওয়াজ নেই, কোনোরকম খবরের কাগজও পৌঁছায় না যেখানে।
নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায় নাকি?
ওর বুকের গভীরের কোথাও যেন প্রশ্নটা টিক টিক করতে থাকলো।
হঠাৎ নিশাত ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“ঊর্মি, তুই এখানে আসার পর থেকেই বেশ চুপচাপ হয়ে গেছিস দেখছি! ব্যাপার কী?”
ঊর্মি একটু হেসে বলল,
“কোন ব্যাপারই না! উপভোগ করছি জায়গাটা। এতদিন যেন আমি এরকম একটা জায়গারই খোঁজ করছিলাম মনে মনে… কিন্তু ভাবিনি সমুদ্রই হতে পারে সেই জায়গাটা।”
“এখনো তো কিছুই দেখনি! সমুদ্রের আসল রূপ দেখা যাবে ওই দ্বীপটাতে গিয়ে। নির্জনতা ছাড়া সমুদ্র উপভোগ করা যায়?” রুবেল একটু চঞ্চল কণ্ঠে বলল,
“তাই বলে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি তো আছি!”
সবাই হাসল। ঐ অচেনা দ্বীপের প্রতি আগ্রহ আর কৌতূহল যেন আরও গভীর হলো প্রত্যেকের।
To be continued…