জলতরঙ্গের সুর পর্ব-১৫+১৬

0
5

#জলতরঙ্গের_সুর
পর্ব – ১৫
লেখা – আসফিয়া রহমান
অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ❌

সকালটা শুরু হয়েছিল খুব সাধারণভাবেই।
জাহাজের ডেকে হালকা বাতাস, দূরে নীলচে সাগরের রেখার সঙ্গে মিশে গেছে আকাশের মেঘ। সাগরের বুকজুড়ে সোনালি আলো ছড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু জাহাজের অভ্যন্তরীণ আবহাওয়াটা আজ যেন ঘন কালো কুয়াশায় ঢাকা।

সেটা চোখে দেখা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়।
একটা অদৃশ্য চাপ, একটা গুমোটতা, একটা নিঃশব্দ ফিসফাস যেন ছড়িয়ে পড়েছে পুরো জাহাজজুড়ে।

নেভিগেশন ডেকে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন কর্মকর্তা আজকাল একটু অন্যরকম চোখে তাকাচ্ছে ক্যাপ্টেনের দিকে। ক্যান্টিনে চা খেতে খেতে কেউ একজন বলছিল, “ক্যাপ্টেন সম্পর্কে আমার ধারণা পুরোই অন্যরকম ছিল। অন ডিউটিতে এরকম… এখনো অবিশ্বাস্য লাগছে আমার কাছে…”

এই কথাগুলো তখনও কল্লোলের কানে পৌঁছায়নি। কিন্তু পরবর্তীতে যা পৌঁছাল, সেটা এর চেয়েও বেশি সাংঘাতিক।

__________________

বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ, জাহাজের কমিউনিকেশন
কন্ট্রোল রুমে ঢোকার সময় কল্লোলের চোখ পড়ল মনিটরের কোণায় জ্বলতে থাকা একটা মৃদু লাল আলোয়।

তাকে অনুসরণ করে দাঁড়িয়ে থাকা এক অপারেটর আস্তে বলল, “Sir, incoming encrypted request from HQ. Priority: Command-level.”

কল্লোল থমকে দাঁড়ালেন। একটা দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে বললেন, “Patch it through. I’ll take it on the main feed.”

মনিটরের সামনে বসে ভরদুপুরের রোদ ছাওয়া সাগরের বিপরীতে গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ।
মনিটরে ভেসে উঠল একটা পরিচিত চেহারা, সিনিয়র রিজিওনাল অফিসার, রিয়ার অ্যাডমিরাল আজিম রহমান।

> “Captain Abrar Imtiaz Kallol,”
“Good morning. I hope you’re holding steady out there.”

কল্লোল মাথা নাড়লেন,
> “Good morning, sir. All is under control.”

> “Excellent. However,”
“We’ve received a small civilian concern lodged this morning. It’s been flagged as ‘non-critical but context-sensitive.’
The concern suggests there may have been a personal engagement during your on-duty hours, specifically the evening before yesterday, involving a female civilian.”
[আজ সকালে একটি ছোটখাটো বেসামরিক অভিযোগ এসেছে। এটিকে ‘গুরুত্বহীন কিন্তু প্রেক্ষাপট অনুযায়ী সংবেদনশীল’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
অভিযোগ অনুযায়ী, গতকালের আগের সন্ধ্যায় আপনার কর্তব্যকালীন সময়ে একজন সিভিলিয়ন নারীর সঙ্গে আপনার ব্যক্তিগত সম্পৃক্ততা থাকতে পারে।]

এক মুহূর্তের জন্য কঠিন নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেল পুরো কন্ট্রোল রুম। কল্লোলের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল, গলার স্বর গম্ভীর।

> “Yes, sir, There was a brief interaction on the upper deck. She was asking about the next-day evacuation protocols and I just updated her about it.
The deck was within surveillance range. No regulations were breached.”
[আপার ডেকে একটি সংক্ষিপ্ত আলাপ হয়েছিল। তিনি পরদিনের উদ্ধারের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিলেন, আমি শুধু তথ্য জানিয়েছিলাম।
ডেকটি নজরদারির আওতায় ছিল। কোনো নিয়ম লঙ্ঘন হয়নি।]

রিয়ার অ্যাডমিরাল একটু থেমে বললেন,

> “Was there any… physical proximity involved?”
[কোনো… শারীরিক ঘনিষ্ঠতা কি ঘটেছিল?]

কল্লোলের গলার স্বর এইবার আগের চেয়েও শীতল হলো। চিড়বিড়িয়ে ওঠা মস্তিষ্ককে সামলে স্ক্রিনের মাঝখানে চেয়ে ছুড়ির ফলার মত শানিত স্বরে উত্তর দিলেন তিনি,

> “Around 18:37, we were hit by a moderate wave from the southwest.
The civilian stumbled. I instinctively secured her for safety near the railing. The contact lasted less than a second.
Deck surveillance logs can confirm this, sir.”
[১৮:৩৭ নাগাদ দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে মাঝারি ধাক্কার একটি ঢেউ এসেছিল। ওই সিভিলিয়ান নারী হঠাৎই হোঁচট খান। আমি স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাকে রেলিংয়ের কাছে নিরাপদে ধরেছিলাম। সংস্পর্শ এক সেকেন্ডেরও কম সময়ের জন্য ছিল। ডেকের নজরদারি ফুটেজেই এটি প্রমাণিত হবে, স্যার।]

একটু চুপ থেকে রিয়ার অ্যাডমিরাল আজিম রহমান এবার স্বর নরম করলেন।

> “Captain, your record stands spotless. I’m trusting your discretion. But these days, perception spreads faster than truth.
Keep that in mind.”
[ক্যাপ্টেন, আপনার রেকর্ড নিখুঁত। আমি আপনার বিচক্ষণতার ওপর ভরসা করছি। তবে আজকাল মানুষ যা দেখে বা ভাবে, তা-ই সত্যের চেয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সেটা মাথায় রাখবেন।]

কল্লোল খুব স্বাভাবিক স্বরে বললেন,

> “Understood, sir. Thank you for the heads-up.”
[বুঝেছি, স্যার। সতর্ক করার জন্য ধন্যবাদ।]

মনিটরের স্ক্রিন অন্ধকার হয়ে গেল নিঃশব্দে।
কন্ট্রোল রুম আবার ফিরে এল নিজের স্বাভাবিক ছন্দে।

কল্লোল কিছুক্ষণ নিঃস্পন্দ হয়ে তাকিয়ে রইলেন সেই অন্ধকার স্ক্রিনের দিকে; যেখানে কিছুক্ষণ আগে রিয়ার অ্যাডমিরালের মুখ ভেসে উঠেছিল।

কল্লোলের মুখ কঠিন হয়ে উঠল ধীরে ধীরে। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। আজকের ঘটনাটাকে শুধুমাত্র অভিযোগ বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না, এর পেছনে নিশ্চিত দাঁড়িয়ে আছে কারো বিষাক্ত উদ্দেশ্য।

“‘Rational civilian concern’— বাহ, বেশ চমৎকার উপায়!” কল্লোলের ঠোঁটের কোণায় তিক্ত একটা হাসি ফুটে উঠল।

ঘুরে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কন্ট্রোল রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি। পায়ের নিচের ধাতব মেঝেতে তার জুতোর শব্দটা একটু বেশি জোরে বাজল যেন।

___________________

কন্ট্রোল রুম থেকে বেরিয়ে কল্লোল সোজা চলে গেলেন সিকিউরিটি মডিউল রুমে।
সেখানে সারি সারি মনিটর, ডেটা স্টোরেজ ইউনিট আর অপারেটরদের ঠান্ডা মুখ— সবাই কাজ করছে নিবিড় মনোযোগে।

একজন ডিউটিতে থাকা নেভাল কমিউনিকেশন অফিসার উঠে দাঁড়ালেন কল্লোলকে দেখে।

“Sir, আপনি এখানে? Any problem?”

কল্লোল ঠান্ডা কণ্ঠে বললেন,
“I need deck footage. করিডোর আর আপার অবজারভেশন ডেকের। Timestamp— eighteen-thirty to nineteen-hundred. The evening before yesterday.”

অফিসার মাথা নেড়ে স্ক্রিনে টাইম লাইন খুললেন। সার্চ প্রোটোকল শুরু হলো— একটার পর একটা ফুটেজ স্ক্রিনে ভেসে উঠছে।

কল্লোলের চোখ তখন স্থির মনিটরের উপর।

ক্লিক… ফুটেজ বদল হলো আবার।

মনিটরে ফুটে উঠল সেদিন সন্ধ্যার আগ মুহূর্তের আলো-ছায়ার দৃশ্য… ওপেন ডেকে ঊর্মি দাঁড়িয়ে আছে একা, বাতাসে উড়ছে ওর চুল, একটু পরে কল্লোল সেখানে এলো। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলল ওরা। আর তারপরেই ঢেউয়ের ধাক্কায় হেলে পড়া… ঠিক সময়ে কল্লোলের দুই বাহুতে আটকে পড়া মেয়েটা…

কল্লোল ঠান্ডা চোখে মনিটরে তাকিয়ে রইলেন পুরোটা সময়। একবারও চোখের পলক পড়ল না তার। ও যে ঊর্মির কপালে চুমু খেয়েছিল সেই দৃশ্য ক্যামেরায় ধরা পড়েনি। ক্যামেরায় কল্লোলের পেছন দিক দেখা যাচ্ছে, বিশালদেহী মানুষটার আড়ালে ঊর্মির ছোটখাটো শরীরটা একপ্রকার লুকিয়ে আছে যেন।

কল্লোল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন,
“Now switch to Corridor-Cam— starboard corner. Zoom in.”

ক্লিক করতেই মনিটরে স্পষ্ট হলো সেই অংশটা— জাহাজের এক কোণার অন্ধকার করিডোর।

সেখানে… কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে।

“Pause. Enhance that frame.”

স্পষ্ট দেখা গেল, একজন পুরুষ দাঁড়িয়ে। মুখটা ঝাপসা, আলো বিপরীতে অবস্থান করায় চেহারাটা স্পষ্ট নয়। কিন্তু পরনের পোশাক আর হাইট অনুযায়ী কল্লোল বুঝে গেল, তার সন্দেহ ঠিক ছিল।

কল্লোলের চোয়াল শক্ত হলো। মুখে ফুটে উঠল ধাতব দৃঢ়তা।

সেই ব্যক্তি পুরো ঘটনা দেখছে। তারপর ধীরে ধীরে পেছন ঘুরে চলে গেল।

কল্লোল ঠাণ্ডা গলায় বললেন,
“Export this footage. আলাদা করে সেভ করুন। Access log ডেটা সহ।”

অফিসার একটু দ্বিধায় পড়ল, “Sir, এটা তো Classified footage zone, আমি অনুমতি ছাড়া…”

কল্লোল এবার একটু এগিয়ে গেলেন, ঠান্ডা স্বরে বললেন,
“You’ll receive a formal order in ten minutes. Just prepare the frame. I’ll take care of the rest.”

অফিসার মাথা নাড়লেন।

কল্লোল ঘুরে দাঁড়ালেন চলে যাওয়ার জন্য। তার চোখ তখন কঠিন—‌ চোখে তখন ঝড়ে শাণিত ইস্পাতের মতো দৃঢ়তা। দরজার কাছে এসে একটু থেমে গেলেন তিনি।
তারপর খুব নিচু স্বরে, যেন নিজের মনে, অথবা যেন সমুদ্রকেই উদ্দেশ্য করে বললেন,
“Waves don’t deceive me—
I’ve learned to read the wind while battling the sea.”
[ঢেউ আমাকে ধোঁকা দিতে পারে না—
সাগরের সাথে লড়তে লড়তে আমি বাতাস পড়তেও শিখেছি।]

_______________________________

সেদিন রাতের সেই মুহূর্তে— জাহাজ যখন ঢেউয়ের ধাক্কায় সামান্য কাত হয়েছিল একপাশে; আর উর্মি ভারসাম্য হারিয়ে হেলে পড়ার আগেই কল্লোল তৎক্ষণাৎ দুহাতে আগলে নিয়েছিল ওকে।

ওর প্রশস্থ বাহুডোরে আটকে গিয়েছিল মেয়েটা, বিষ্ময় আর আতঙ্কের দোলাচলে অস্থির হয়ে খেয়াল করেনি আশেপাশের কিছুই… খেয়াল করেনি ঠিক সেই সময় করিডোরের কোণার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কেউ একজন পর্যবেক্ষণ করছিল ওদের। তার
চোখেমুখে তখন বিস্ময় নয়, জ্বলছিল প্রতিহিংসার আগুন।

ডেকের আলো-ছায়ার এক কোণার অন্ধকারের চুপিসারে দাঁড়িয়ে থাকা রুবেলকে দেখতে পায়নি ওরা কেউই। সে তখন দাঁড়িয়ে দেখেছিল, কীভাবে ঊর্মি এক মুহূর্তের জন্য মাথা রেখেছিল কল্লোলের বুকের উপর।
এই দৃশ্য দেখার সাথে সাথে ওর চোখে যেন ধক করে জ্বলে উঠেছিল প্রতিহিংসার আগুন।
নিজের কার্য হাসিলের শুধু একটা সুযোগ খুঁজছিল ও।

পরদিন সকালটা ছিল রোদ ঝলমলে।
জাহাজের ইঞ্জিন কন্ট্রোল রুমের পেছন দিকে, যেখানে সাধারণত কেউ না থাকাটাই স্বাভাবিক, সেখানে একজন জুনিয়র টেকনিক্যাল ক্রু কিছু সার্ভার লাইন চেক করছিলেন।

রুবেল ওদিকেই এল, যেন হঠাৎ করেই পায়চারি করতে করতে সেখানে এসে পড়েছে। মুখে একেবারে নিরীহ ভাব।

“ভাই, আপনি তো এখানে কাজ করেন, তাই না?”

ছেলেটা ভদ্রভাবে হাসল, “জি, আপনি কিছু বলবেন?”

রুবেল অকারণে নরম গলায় হেসে বলল,
“মানে, আমরা তো সাধারণ মানুষ। নিয়ম-কানুন জানি না। কিন্তু গতকাল ডেকে একটা দৃশ্য দেখলাম… মানে…কাল রাতের কথা… আমি ডেকে হেঁটে যাচ্ছিলাম। দেখি, ক্যাপ্টেন… মানে, কল্লোল স্যার একটা মেয়ের খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিলেন। এমনকি… মেয়েটা ওনার গায়ে মাথা রেখেছিল এক পর্যায়ে…”

ক্রু তখন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
একটু থেমে কৃত্রিম দ্বিধার ভান করে রুবেল নিঃশ্বাস ফেলল। “মানে, বুঝতেই পারছেন… ওনার মতো দায়িত্বশীল একজন অফিসার, আর এইভাবে… একজন সিভিলিয়ানের সঙ্গে… এত রাতে… উনি কি তখন ডিউটিতে ছিলেন না…?”

ক্রুটার মুখ তখন থমথমে। তার চোখে অবিশ্বাস আর দ্বিধা। সে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“উনি ডিউটিতে ছিলেন, কিন্তু আপনি হয়তো ভুল দেখেছেন। ক্যাপ্টেন এরকম মানুষ নন…”

রুবেল হেসে ফেলল মৃদু,
“সবাইকে বাইরে থেকে যেমন দেখায়, তারা সবসময় তেমন হয় না, ভাই। মানুষ তো… একা থাকলে অনেক কিছু করে ফেলে। আমি দোষ দিচ্ছি না, আমি শুধু
বলছি— যে কেউ এই জিনিস ভুলভাবে নিতে পারে। একজন সামরিক অফিসার যদি জাহাজে সিভিলিয়ান মেয়েদের সাথে এমনভাবে মিশে… তা একটু তো দৃষ্টিকটু লাগে, না?”

ক্রু কিছু বলেনি। কিন্তু তার অভিব্যক্তিতে টের পাওয়া গেল, সন্দেহের বীজ রুবেল পুঁতে দিতে পেরেছে।
রুবেল বুঝে গেল, তীরটা ঠিক জায়গায় লেগেছে। ওর কাজ শেষ!

ও এবার মুখে চিন্তার ছায়া এনে শেষ চালটা চাললো,
“আমি আসলে ব্যাপারটা কাউকে বলতাম না, কিন্তু এরকম একটা বিষয়, সিভিলিয়ন কোন মেয়ের জন্য এটা অনেক সময় সমস্যার ব্যাপার হয়ে দাঁড়াতে পারে… আপনি বুঝছেন তো, কী বলছি…”

তারপর একটু থেমে আবার বলল, আমি শুধু… মানে, আমি যেটা দেখেছি সেটা জানিয়ে দিলাম, যাতে ভুল কিছু না হয়। আপনারা তো সামরিক নিয়মে অভ্যস্ত, তাই…”

ক্রুকে অবিশ্বাস আর দ্বিধাদ্বন্দ্বের দোলাচলে ভাসিয়ে রুবেল যেমন করে এসেছিল, ঠিক সেভাবেই পেছনে ফিরে হেঁটে চলে গেল ধীরে ধীরে। ওর মুখে তখন একরাশ নিঃসঙ্গতার মুখোশ, আর চোখে যেন ঝলমল করছিল অদৃশ্য এক দূরভিসন্ধির ঝিলিক।

To be continued…

#জলতরঙ্গের_সুর
পর্ব – ১৬
লেখা – আসফিয়া রহমান
অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ❌

ঘটনার পরদিন দুপুর। সাগরের মাঝখানে জাহাজ ধীরে এগিয়ে চলেছে পূর্বের দিগন্তের দিকে। গা ছমছমে নীরব দুপুর। সূর্য কিছুটা নরম, বাতাসে লবণাক্ততা মেশানো ঘ্রাণ।

জাহাজের একটি নির্জন করিডোরে রুবেল একা দাঁড়িয়ে আছে রেলিং ধরে। বাইরে তাকিয়ে সমুদ্র দেখছে— অস্থির চোখে তাকিয়ে আছে ঢেউয়ের দিকে। সমুদ্রের নীলতা ওর চোখে পড়ছে না, ও দেখছে নিজের কল্পিত জয়। ঠোঁটের কোণে বিরাজ করছে একটুকরো তৃপ্তির হাসি।

ঠিক তখনই পেছন থেকে ধীরপায়ে এগিয়ে আসে একটা ছায়া। একটা গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে আসে কানে,
“রুবেল সাহেব, সমুদ্র কেমন লাগছে আজ?”

রুবেল চমকে ঘুরে তাকায়। শুকনো ঢোক গেলে।
কল্লোল!
সাদা ইউনিফর্মে সমুদ্রের নীলচে আভা পড়ে যেন আরও কঠিন মনে হচ্ছে মানুষটাকে।
চোখেমুখে সেই চিরচেনা প্রশান্ত ভাব, কিন্তু চোখের দৃষ্টিতে শীতলতা— ঠিক যেন নিঃশব্দ ঢেউয়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুনামির পূর্বাভাস।

রুবেল শুকনো গলায় বলে, “স্যার! আপনি এখানে?”
একটু হাসার চেষ্টা করে ও।

কল্লোল ধীরে ধীরে এগিয়ে আসলেন, দাঁড়ালেন একদম রুবেলের পাশেই। তারপর বললেন, “আপনাকে দেখলাম একা একা দাঁড়িয়ে আছেন। তাই ভাবলাম, একটু কথা বলা যাক।”

রুবেল মাথা নাড়ালো।
“জ্বী… জ্বী বলুন স্যার।”

কল্লোল স্থির গলায় বললেন,
“দুপুরটা আজ বেশ শান্ত, তাই না?”

রুবেল আমতা আমতা করল,
“জি… হ্যাঁ… একদম শান্ত।”

কল্লোল এবার ধীর স্বরে বললেন,
“শান্ত জায়গা পছন্দ আপনার… করিডোরে একা দাঁড়াতে দেখি প্রায়ই। বিশেষ করে… রাতে।”

রুবেল হঠাৎ অপ্রস্তুত হয়ে গেল,
“আমি আসলে… একা থাকতে পছন্দ করি। ভাবনা-চিন্তা করতে… ভালো লাগে।”

কল্লোল রুবেলের উপর থেকে চোখ সরিয়ে সাগরের দিকে তাকালেন, “ভাবনার জন্য রাতই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়… অন্ধকার অনেক কিছু ঢেকে ফেলে।
মানুষ নিজেকে আড়াল করতে পারে।”

রুবেল জোর করে হাসার চেষ্টা করল,
“মানে ঠিক বুঝলাম না, স্যার?”

কল্লোল একটু হেসে মাথা নাড়লেন, তবে সে হাসিতে ছিল না একবিন্দু উষ্ণতা। তারপর নিচু স্বরে, ধীরে ধীরে বললেন, “আপনার যা বোঝার, আপনি ঠিকই বুঝেছেন— আমি শুধু মনে করিয়ে দিচ্ছি। রাতের অন্ধকারকে যে আপনি আশ্রয় করার চেষ্টা করেছিলেন… আপনার সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের জাহাজে, রাতেও ক্যামেরা কাজ করে, রুবেল সাহেব। প্রতিটি করিডোরের প্রতিটি কোণ রেকর্ড হয়ে থাকে।”

রুবেলের গলা শুকিয়ে এলো। ও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু কল্লোল এক হাত তুলে থামালেন।

“আপনার কথোপকথনও রেকর্ড হয়েছে। আপনি যে নিরীহ মুখ করে ‘চিন্তিত সিভিলিয়ান’ সেজেছিলেন, তাও HQ অবগত।”

রুবেল এবার মুখ ঘুরিয়ে সাগরের দিকে তাকাল, ওর চোখে হঠাৎ জেগে ওঠা আতঙ্ক। মুখে নিরীহ ভাব রেখে ও বলতে চেষ্টা করল, “…আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, আপনি কি বলতে চাইছেন।”

কল্লোল ঠাণ্ডা গলায় বললেন,
“আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, রুবেল।অন-ডিউটিতে থাকা অবস্থায় ‘পারসোনাল এনগেজমেন্ট’-এর অভিযোগ।”

রুবেল চোখ বড় বড় করে তাকালো,
“স্যার… আপনি কী বলতে চাইছেন? আমি কিছু বলেছি নাকি? আমি তো কিছু জানিই না এসব ব্যাপারে।”

কল্লোল এক পা সামনে এগিয়ে এসে খুব নিচু স্বরে বললেন, “তোমার নাম নেই রিপোর্টে। তবে তোমার ‘ছায়া’ স্পষ্টভাবে আছে— প্রতিটা লাইনের ফাঁকে।
তুমি কারো কান ভরেছো… তারপর সে লিখেছে।
তুমি কিছু করোনি, তবু তুমি করেছো।”

“স্যার, এটা ভিত্তিহীন। আমি কেন এমন করব? আমি তো স্রেফ একজন… সিভিলিয়ান।”
রুবেল কড়া কন্ঠে বলার চেষ্টা করল।

কল্লোল এবার ওর দিকে ফিরে তাকালেন। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে, শীতল গলায় বললেন,

“একটা কথা শুনেছো কখনো?
‘Mirror is a dangerous place for liars. They can’t hold their gaze for long.’

তুমি নিজেও জানো এটা ভিত্তিহীন নয়।
কিন্তু তোমার সৌভাগ্য— আমি এখনো তোমাকে অভিযুক্ত করিনি। তবে সাবধান করছি— ঊর্মি আমার সহানুভূতির জায়গা নয়। And you are just a stranger. Strangers don’t get second warnings. Mind it.”

রুবেল একদৃষ্টে চেয়ে থাকল ওনার দিকে। কল্লোল কিছু বললেন না আর। কিছুক্ষণ ঠান্ডা দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে তারপর ঘুরে চলে গেলেন নিঃশব্দে।

সাদা ইউনিফর্মের ওপর সূর্যের আলো পড়ে এক দীর্ঘ ছায়া ফেলল করিডোরে। রুবেলের ঠোঁটে ধীরে ধীরে ফুটে উঠলো একটা ব্যর্থ চাতুর্যের হাসি।

_______________________________

জাহাজের পেছনের ডেক | বিকেল সাড়ে চারটা

আকাশ ধীরে ধীরে রং বদলাচ্ছে।
এক পাশে সূর্যের রং লালচে হতে শুরু করেছে, অন্য পাশে সাগরের গায়ে তার রঙ লেগে তৈরি হচ্ছে অদ্ভুত এক নীরব সৌন্দর্য।

ডেকের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে ঊর্মি।
চুলে বাতাস লেগে এলোমেলো হয়ে গেছে ওর, চোখে চিন্তার ছায়া। হয়তো জাহাজের বদলানো আবহ, না বলা কিছু গুঞ্জন, না বোঝা কিছু দৃষ্টি ওকে একটু অস্থির করে রেখেছে।

আনমনা হয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে পেছন থেকে ধীরে ধীরে কল্লোল এসে দাঁড়াল ওর পাশে।

ঊর্মি ওর উপস্থিতি টের পেয়ে একটু চমকে তাকাল।
“আপনি…?”

“হ্যাঁ, ভাবলাম আপনি নিশ্চয়ই এখানে দাঁড়িয়ে আছেন। আপনি আর সমুদ্র যেভাবে বন্ধু হয়ে উঠেছেন- তাতে আপনাকে নিশ্চিত এখানেই পাওয়া যাবে। তাই চলে এলাম…”

ঊর্মি হেসে ফেলল,
“ভালোই খেয়াল রাখেন দেখছি!”

কল্লোলের চোখে সরল হাসি, কিছু বলল না ও।

ঊর্মি হঠাৎ করে একটু গম্ভীর হয়ে গেল,
“শিপে সবকিছু ঠিক আছে তো, ক্যাপ্টেন? মানে…”

কল্লোল এক মুহূর্তে সচেতন হয়ে উঠে মাঝপথে কথাটা আটকে দিল,”সব ঠিক আছে। আবহাওয়ার রিপোর্ট নিয়ে একটু ঝামেলা হয়েছিল। Nothing else.”

“তাহলে আপনি সেদিন সন্ধ্যার পর থেকে কোথায় হারিয়ে গেছিলেন?” ঊর্মি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইল ওর দিকে।

কল্লোল হেসে রেলিংয়ের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়াল।
সামনের দিকে তাকিয়ে বলল,”সমুদ্রের সাথে বন্ধুত্ব করার সময় দিচ্ছিলাম আপনাকে!”

ঊর্মির ঠোঁটে একটুকরো ছেলেমানুষী হাসি ফুটল এবার,
“তাই?”

কল্লোল কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
“হুম। আপনি আর সমুদ্র বেশ আরামে গল্প করছিলেন— আমি মাঝখানে ঢুকে পড়লে, সেটা তো মোটেই ভদ্রতা হতো না, তাই না?”

ঊর্মি হাসলো,”ভদ্র ক্যাপ্টেন!”

কল্লোল এবার অন্যরকম গলায় বলল, “আমি আসলে কাছেই ছিলাম, আপনাকে আড়াল থেকে দেখতে ভালো লাগছিল।”

ঊর্মি ওর দিকে তাকাল। ওর চোখে একটু বিস্ময়, একটু অনিশ্চয়তা।

কল্লোল ধীরে ধীরে বলল,
“সবসময় পাশে এসে দাঁড়ানো যায় না, মিস। কখনো কখনো দূর থেকেই নিশ্চিত হতে হয়, কেউ ঠিক আছে কিনা।”

ঊর্মি চোখ সরিয়ে নিল। বাতাসে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস মিলিয়ে গেল যেন।
“আপনি বরাবরই এত… রহস্যময়?” ও জিজ্ঞেস করল হালকা গলায়।

কল্লোল হাসল,
“না। শুধু আপনার সামনে এলেই রহস্যময় হয়ে যাই!”

ঊর্মি একটু চুপ করে থেকে হঠাৎ বলল,
“আপনি তো ক্যাপ্টেন… মানে, অনেক দায়িত্বশীল মানুষ। কিন্তু আমি লক্ষ্য করেছি, মাঝে মাঝে আপনার মধ্যে একটা দুষ্টু ছেলের ছাপ ফুটে ওঠে!”

কল্লোল ভ্রু কুঁচকে হাসলো,
“দুষ্টু ছেলে? আমি?! নাহ্… একদম অন্যায় অভিযোগ!”

ঊর্মি চোখ ছোট ছোট করে চোখ বুলাল ওর পুরো মুখে, যেন খুব গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করছে। তারপর কপট গম্ভীর গলায় বলল,”হুম… আপনার হাসি, আপনার চুপচাপ তাকিয়ে থাকা, আর গম্ভীর স্বরে কথা বলা— সব কিছুই সন্দেহজনক!”

কল্লোল ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটিয়ে বলল,
“চুপচাপ মানুষ মানেই দুষ্টু— এই গবেষণার উৎস কী, ম্যাডাম? আপনি নিজেই না আমার দিকে চেয়ে হাসছিলেন সেদিন?”

ঊর্মি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো,
“আরে না! আমি তো শুধু ভাবছিলাম… একটা মানুষ এত চুপচাপ হয় কী করে!”

কল্লোল দুষ্টু হেসে তাকালো ওর দিকে।
“ভাবছেন তো অনেক কিছুই। শুধু স্বীকার করছেন না।”

ঊর্মির মুখ লাল হয়ে উঠল এবার।
“এত খেয়াল রাখা ঠিক না!”

“নেভিগেশনে খেয়াল না রাখলে জাহাজ ডুবে যায়, ম্যাডাম। আর… মানুষ?”
কল্লোল দৃষ্টি ঘুরিয়ে সমুদ্রের দিকে চাইল,
“মানুষের অনুভূতিও ডুবে যায়, যদি সঠিক সময়ে সেটা মূল্যায়ন না করা হয়।”

ঊর্মি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল,
“আপনার সহজ কথার মাঝেও এত গভীর কিছু লুকিয়ে থাকে কেন?”

কল্লোল একবার তাকাল ওর দিকে, তারপর রেলিংয়ের ওপারে বিস্তৃত সমুদ্রের দিকে।
“সমুদ্রের কাছাকাছি থাকার প্রভাব বোধহয়। এই যে ঢেউগুলো দেখছেন, এই ঢেউগুলো চুপচাপ আসে, নিঃশব্দে রেখে যায় অনেক কিছু।”

তারপর সমুদ্রের উপর থেকে চোখ ঘুরিয়ে ঊর্মির দিকে তাকাল ও, চোখে দুষ্টুমির ঝিলিক নিয়ে বলল,
“সমুদ্রের কাছ থেকে শিখেছি বলেই তো আপনাকে নিয়ে এত গবেষণা করতে পারছি… ঢেউ যেমন কখনো নিঃশব্দে আসে, আবার কখনো তীব্রভাবে আছড়ে পড়ে তীরে… কাছাকাছি থাকা সব কিছু লন্ডভন্ড করে দেয়, আপনি ঠিক তেমনই। প্রথমবার নিঃশব্দে এলেন; আর এবার তীব্রভাবে এসে লণ্ডভণ্ড করে দিলেন আমাকে।

ঊর্মি অবাক হয়ে তাকাল ওর দিকে।
“আমি? আমি আপনাকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছি?”

“হুম,” কল্লোল চোখ ছোট করে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল,
“প্রথমে ভাবলাম আপনি খুব শান্ত মেয়ে। তারপর বুঝলাম, না… আপনি একটা দুরন্ত ঢেউ, যেটা একবার ছুঁয়ে গেলে কোনো কিছুই আর আগের মতো থাকে না।”

ঊর্মি ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
“এই তো! বললাম না, আপনার মধ্যে একটা দুষ্টু মানুষ লুকিয়ে আছে!”

কল্লোল দুষ্টু হাসলো,
“দুষ্টুমি করলে যদি কারও এমন ফুলো ফুলো ঠোঁট দেখতে পাওয়া যায়, তবে মন্দ কি!”

ঊর্মি চোখ বড় বড় করে তাকাল, তারপর ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেলল, “আপনি একদম সহ্য করার মতো না!”

কল্লোল কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
“এই অভিযোগ খুবই স্বাভাবিক। তবে আপনি বললে না হয় আর দুষ্টুমি করব না… তবে একটা শর্ত আছে।

ঊর্মি সন্দিহান নজরে তাকাল,
“কী শর্ত?”

“আজকে রাত দশটায় আমরা জাহাজের ছাদে উঠে আকাশ দেখব।” কল্লোল ওর দিকে তাকিয়ে বলল।

“কেন? আজকে কি বিশেষ কিছু?”

“হ্যাঁ, আজ প্ল্যানেট ভেনাস আর মুন একসাথে থাকবে। এমন দৃশ্য সচরাচর দেখা যায় না। এই বিশেষ দৃশ্যটা আপনাকে পাশে নিয়ে দেখতে চাই।”

ঊর্মি থমকে গেল,
“আপনি কি সব মেয়েদের এমন অফার দেন?”

“না, একদম না,” কল্লোল চোখ সরিয়ে রেলিংয়ে হাত রাখে, গলায় মজা মিশিয়ে বলে,
“যে মেয়েটা আচমকা জলোচ্ছ্বাসের মতো এসে আমাকে ওলটপালট করে দিয়েছে শুধু তাকেই দিচ্ছি। মেয়েটা কি অফারটা গ্রহণ করবে?”

ঊর্মি ভ্রু কুঁচকে তাকাল, ওর ঠোঁটের কোণে চাপা হাসি।
তারপর ধীরে ধীরে চোখ নামিয়ে রেলিংয়ের দিকে তাকিয়ে রইল, যেন ঢেউয়ের তালে নিজের মনের কথাগুলো খুঁজছে।

তারপর এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল,
“মেয়েটা এখনো ভাবছে… জলোচ্ছ্বাস হলে সে কোথায় গিয়ে আশ্রয় নেবে— ছাদের নিচে, নাকি কারো হৃদয়ে…”

কল্লোলের চোখে একটুকরো মুগ্ধতা জমল,
“হৃদয়েই আশ্রয় নেওয়া উচিত মনে হয়। কারণ সেই হৃদয়টা তো আগে থেকেই…” কথা শেষ করল না ও।

ঊর্মি তাকাল ওর দিকে, ওর চোখে কৌতূহলের ছায়া।
“আগে থেকেই কী?”

কল্লোল তাকাল না, চোখ রাখল সাগরের নীলতায়। গলায় গাঢ় ভরসা মিশিয়ে বলল,
“আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল… শুধু কারোর জলোচ্ছ্বাসের অপেক্ষায়।”

ঊর্মির নিঃশ্বাস আটকে গেল বুঝি!
রেলিংয়ের ওপাশে সূর্য তখন পুরোপুরি লালচে; সমুদ্রের গা ছুঁয়ে ছুঁয়ে নামছে অতলে। মাঝ আকাশে একঝাঁক গাঙচিল ডানা মেলে উড়ে গেল দু’জনের মাঝখান দিয়ে।

ঊর্মি কিছু বলল না।
মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে একটা গভীর নিঃশ্বাস নিল… যেন এই একটা মুহূর্তকে মনে গেঁথে রাখবে চিরদিন।

কল্লোল চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল ওর পানে চেয়ে।
মেয়েটার চোখের নীচের কণামাত্র কম্পনটাও যেন সূক্ষ্মভাবে বুঝে নিতে চাইছিল ও।

ঊর্মির মুখে তখন কোনো কথা ছিল না, ও শুধু চোখ তুলে একবার চেয়ে দেখল সেই মানুষটার দিকে-
যে মানুষটা ওকে না ছুঁয়েও ছুঁয়ে ফেলল শুধুমাত্র কথা দিয়ে।

তারপর ধীরে, খুব ধীরে কল্লোল বলল,
“আজ রাত ন’টা পঞ্চান্ন… ছাদে দেখা হচ্ছে।”

রেলিং ধরে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকল দুজন। সমুদ্রের নীল নিঃশব্দ ঢেউ ভাঙছে একের পর এক, তার মাঝখানে তৈরি হওয়া এই অদ্ভুত বোঝাপড়ায় বাতাসও যেন থমকে গেছে। চুপ করে সে শুনছিল এতক্ষণ- দুটো সমুদ্রের কথোপকথনের দুষ্টু-মিষ্টি ঢেউ।

To be continued…