#জলতরঙ্গের_সুর
পর্ব – ১৭
লেখা – আসফিয়া রহমান
অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ❌
আকাশের নীলচে-কালো মখমলের গালিচায় মেলা বসিয়েছে অসংখ্য তারারা। ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস বইছে চারপাশে। নিচে জাহাজের গা ঘেঁষে ঢেউ উঠছে একের পর এক। সমুদ্র থেকে থেকে শব্দ করে জানিয়ে দিচ্ছে তার অস্তিত্ব। সেই ঢেউয়ের শব্দে একটা ছন্দ আছে, ঘুম পাড়ানী গানের মতো ছন্দ।
আকাশের বিশাল গালিচায় সবচেয়ে উজ্জ্বল যে তারাটি, তার নাম শুকতারা। চাঁদের নিচে একটু বাঁদিকে— সে জ্বলছে দিপ্তী ছড়িয়ে। অন্য সব তারারা যেন একটু দূরে সরে দাঁড়িয়ে তার জ্যোতির জন্য জায়গা করে দিচ্ছে। শুকতারার আসল নাম শুক্রগ্রহ— ভেনাস। প্রেম, সৌন্দর্য আর রহস্যের প্রতীক।
কল্লোল ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। ঠান্ডা হাওয়ায় সব সময়ের পরিপাটি চুলগুলো খানিকটা এলোমেলো। ওর গায়ে একটা হালকা জ্যাকেট, তার নিচে সাদা টিশার্ট, পরনে ঢিলাঢালা ট্রাউজার।
ছাদের ফ্লাডলাইটগুলো বন্ধ। আকাশ যেন ভালোভাবে দেখা যায় তাই এই ব্যবস্থা। চাঁদের আলো ছাদকে আবছা আলোকিত করেছে। কল্লোলের চোখ আকাশের দিকে স্থির, তবে মন অস্থির কারো অপেক্ষায়।
এমন সময় পেছন থেকে জুতোর শব্দ শোনা গেল ধীর ধীরে।
কল্লোল ঘুরে তাকাল পিছে—
ঊর্মি এসেছে।
ঊর্মির গায়ে সাদা টপসের উপর হালকা নীল রঙের একটা পাতলা শাল জড়ানো, চুলগুলো খোলা, সবসময়ের চঞ্চল চোখদুটো ভীষণ শান্ত আজ।
কল্লোল মুগ্ধ চোখে দেখল ওকে। পেলব শরীরে চাঁদের আলো পড়ে কি স্নিগ্ধ, মায়াবী দেখাচ্ছে মেয়েটাকে।
“এমন করে কি দেখছেন?” ঊর্মি ওর কাছাকাছি এগিয়ে এসে শুধালো নিচু গলায়।
“দেখছি, জাহাজের ছাদে নেমে আসা চাঁদটাকে দেখছি…”
ঊর্মির দুগাল লাল হয়ে উঠলো অদৃশ্যভাবে। ও হাত দিয়ে কল্লোলের মুখটা ঘুরিয়ে দিল আকাশের দিকে।
“চাঁদ আকাশেই আছে, ওদিকে দেখুন…”
“আমার তো এই চাঁদটা বেশি পছন্দ হয়েছে!”
কল্লোল আবারো ফিরে তাকালো ঊর্মির দিকে। একহাত বাড়িয়ে ওর কোমর জড়িয়ে টেনে নিল নিজের কাছে।
ঊর্মি রীতিমতো চমকে উঠলো। চোখদুটো বিষ্ময় লুকোতে না পেরে হয়ে উঠলো মার্বেল আকৃতির। কোমর জড়িয়ে ধরা কল্লোলের হাতটা খামচে ধরলো ও। কম্পিত স্বরে বলার চেষ্টা করল কিছু।
“ক-ক-কী ক-করছেন! ছ-ছাড়ুন, ক-কেউ দ-দেখে ফেলবে…”
কল্লোল বাঁকা হাসল, “কে দেখবে? এখানে আপনি আর আমি ছাড়া কেউ নেই ম্যাডাম!”
ঊর্মির বিস্ময়ে বড় বড় চোখ নিয়ে এক পা পিছিয়ে সরে যেতে চাইল। পা বাড়াতে গিয়েই থমকে গেল ও, কারণ কল্লোলের হাত তখনও জড়িয়ে আছে ওর কোমর।
হঠাৎ শরীরের সমস্ত সজীব স্নায়ু যেন জেগে উঠল ওর। বুকের ভেতর ধুকপুক করে ওঠা হৃদস্পন্দনের শব্দটা যেন নিজেই শুনতে পাচ্ছে ও। গাল দুটো গরম হয়ে উঠছে সহসাই, গলা শুকিয়ে কাঠ।
“ক-ক্যাপ্টেন… আ-আপনি…”
ওর গলা কেঁপে উঠল, স্বর খুঁজে পেতে কষ্ট হলো যেন।
কল্লোলের হাত ওর কোমর থেকে নামার বদলে হঠাৎ চাপটা আরো দৃঢ় হলো। একহাতে ওর কোমর পেঁচিয়ে কল্লোল এক ঝটকায় ওকে বসিয়ে দিল ছাদের রেলিংয়ের ওপর। ঘটনা হঠাৎ এত দ্রুত আর নিঃশব্দে ঘটল যে, ঊর্মির কয়েক মুহূর্ত সময় লাগলো ঠিক কি ঘটেছে বুঝে উঠতে।
বুঝে ওঠার সাথে সাথেই ও দুই হাতে কল্লোলের জ্যাকেটটার দুপ্রান্ত শক্ত করে খামচে ধরে ছোটোখাটো একটা চিৎকার দিল। কল্লোল তার মাঝপথে আরেক হাতের তালু দিয়ে ঝড়ের গতিতে চেপে ধরল ওর মুখ।
“What happen, ঊর্মি!” কল্লোলের গলার স্বর নিচু কিন্তু তীব্র,”কি করছেন আপনি! নিচে কেউ শুনে ফেলবে তো!”
ঊর্মি একদম থমকে গেল। চোখ বিস্ফারিত, শরীর অনড়, যেন হিম হয়ে গেছে ওর সমস্ত শরীর।
কল্লোল ধীরে হাত সরাল ঊর্মির ঠোঁটের উপর থেকে। হাত সরে যেতেই যেন এক ঝটকায় ঊর্মির হুঁশ ফিরে এলো— নিজেকে আবিষ্কার করল রেলিংয়ের ওপর বসা অবস্থায়।
রেলিংয়ে বসা অবস্থায় ঊর্মির উচ্চতা কল্লোলের সমান সমান। ঊর্মি একবার মাথা ঘুরিয়ে পেছনের সমুদ্রের দিকে তাকাল। একটার পর একটা অশান্ত ঢেউ এসে ধাক্কা দিচ্ছে জাহাজের গায়ে। তারপর ফিরে তাকালো কল্লোলের দিকে। কল্লোলের দিকে ফিরে তাকানোর সাথে সাথেই আবার শুরু হয়ে গেল ওর ছটফটানি।
“ন-ন-নামান আমাকে ক্যাপ্টেন!” ওর চোখে আতঙ্ক,
“ভ-ভয় লাগছে তো… প-প্লিজ নামান…”
কল্লোল শান্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল ওর দিকে।
ওর হাত এখনও ঊর্মির কোমর জড়িয়ে আছে। ওর গলার স্বর এবার অনেক নরম হলো আগের তুলনায়,
“Don’t be afraid. আমি আপনাকে পড়তে দেব না। কিন্তু নামাবোও না।”
ঊর্মি হতচকিত।
“ক-ক-কেন?” ওর গলা কেঁপে উঠল অজানা আশঙ্কায়।
কল্লোল এবার একটু গা ঘেঁষে এল ওর দিকে, ওর চোখের খুব কাছাকাছি এসে বলল,
“কারণ… এত কষ্ট করে আপনাকে ধরেছি। এত সহজে ছেড়ে দিলে তো আমার কষ্টটাই বৃথা, তাই না?”
কল্লোল চোখ টিপল।
ঊর্মি ছটফটানি থামিয়ে হা করে তাকিয়ে রইল ওর দিকে।
ওর চোখে বিস্ময়, কল্লোলের এহেন রূপ কখনো কল্পনাতেও ছিল না ওর। ও কিছু একটা বলতে চেয়ে ঠোঁট ফাঁক করলো, কিন্তু শব্দ ফুটল না।
কল্লোল এবার এক হাত বাড়িয়ে ওর মুখের উপর উড়তে থাকা চুলগুলো গুঁজে দিল কানের পেছনে।
“আপনার চোখদুটো যেন জীবন্ত নেশা। এখানে তাকিয়ে দুনিয়া ভুলে থাকা যাবে ঊর্মি।
ঊর্মি তীব্র লজ্জা লুকোতে সাথে সাথে মুখ ঘুরিয়ে নিল, চুলে হাত দিল অস্থিরভাবে।
“আপনি খুব অসহ্য!” ফিসফিস করে উঠল ও, কিন্তু চোখের কোণায় মুচকি হাসি তখন লুকোচুরি খেলছে।
কল্লোল হেসে ফেলল নিচু স্বরে।
“হুঁ… এটা নতুন না। আমাকে সহ্য করা যায় না— অনেকেই বলে। তবে আপনি এখনও তো আছেন… এতক্ষণ ধরে।”
ঊর্মি ওর দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল। মাথার ভেতরে যেন শব্দশূন্যভাবে বাজছে কিছু একটা। বুকের ভেতরের শব্দটা দ্রুত, এলোমেলো আর অজানা উত্তেজনায় ভরা।
কল্লোল ওর চিবুকে আলতো করে আঙুল রাখল, মুখটা ধীরে ঘুরিয়ে আনল নিজের দিকে। তারপর প্রায় ফিসফিস করে বলল,
“আপনি কি জানেন… লজ্জা পেলে আপনার সৌন্দর্য দ্বিগুণ হয়ে যায়?”
উর্মির কানের খুব কাছে ফিসফিস করে বজ্রপাত হলো যেন। ও চমকে তাকাল কল্লোলের দিকে। পরপর চোখ সরিয়ে নিল দ্রুত।
গালজোড়া যেন আগুন হয়ে উঠেছে ওর, চোখের পলক পড়ছে ঘনঘন। ওর হাতের আঙুলগুলো তখন রেলিংয়ের ধাতব গায়ে আঁচড় কাটছে, নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টায়।
ও নিজের অজান্তেই কল্লোলের হাতের ছোঁয়া থেকে নিজেকে একটু সরিয়ে নিতে চাইল, কিন্তু পেছনে তখন শুধু রেলিং, আর নিচে ঢেউয়ের অন্ধকার অতল।
কল্লোল মাথাটা একটু কাত করে তাকিয়ে রইল ওর দিকে; চোখে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে।
ঊর্মির চোখে লজ্জা আর অস্বস্তির মিশ্রণ। লজ্জায় হাঁসফাঁস করে উঠলো ও। অসহায় চোখে তাকালো কল্লোলের দিকে।
“আপনি না আমাকে আজকে আকাশ দেখাবেন বলেছিলেন?”
“বলেছিলাম নাকি? কই এরকম কিছু তো মনে পড়ছে না আমার!” কল্লোল নাটকীয় ভঙ্গিতে ভুলে যাওয়া কথা মনে করার চেষ্টা করল।
ঊর্মি চোখ বড় বড় করে তাকাল,
“আপনি না একদম অসহ্য!”
কল্লোল হেসে ফেলল,
“তা তো আগেই বলেছিলেন! কিন্তু ম্যাডাম, কেউ যদি একদম সামনে বসে এভাবে চোখ বড় করে
বলে—‘আমাকে আকাশ দেখাবেন বলেছিলেন’… তাহলে তার মানে কিন্তু অন্য কিছুও হতে পারে!”
ঊর্মি এবার রেলিং ধরে ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেলল।
“উফ্! আপনি চুপ করুন! একদম চুপ!”
কল্লোল একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকাল,”ঠিক আছে, চুপ রইলাম। তবে আকাশটাও কিন্তু আপনাকে দেখে যাচ্ছে তখন থেকে…”
ঊর্মি চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল। মাথার উপর আকাশজুড়ে নীল-কালো গালিচায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে তারা, চাঁদ আর তার নিচে উজ্জ্বল শুকতারা।
“মুন আর ভেনাস একসাথে… কী দারুণ!”
উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল ঊর্মি।
কল্লোল ঊর্মির উচ্ছ্বসিত চোখে চেয়ে খুব নিচু স্বরে বলল,
“হ্যাঁ খুব দারুণ! তবে আমার সামনে বসে থাকা মেয়েটা হচ্ছে— earth’s most dazzling discovery!”
কল্লোলের গলায় যেন মুগ্ধতার ছোঁয়া।
ঊর্মি চোখ ছোট করে তাকালো ওর দিকে। কনুই দিয়ে হালকা করে খোঁচা মারল ওর পেটে।
“আবার শুরু করলেন! আমি কিন্তু এখনই নিচে চলে যাব!” চোখে রাগ রাগ ভাব আনার চেষ্টা করলেও, ওর ঠোঁটের কোণার মুচকি হাসিটা লুকানো গেল না।
কল্লোল হঠাৎ করে ঊর্মির খুব কাছাকাছি এগিয়ে গেল। ওর আর ঊর্মির মুখের দূরত্ব মাত্র কয়েক ইঞ্চির। ওকে আচমকা এগোতে দেখে ঊর্মির দম বন্ধ হয়ে এল সহসা।
ভয় আর নার্ভাসনেসে ওর অবস্থা বেগতিক। ও চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলল শক্ত করে।
কল্লোল ওর মুখের খুব কাছাকাছি এগিয়ে এসে ফুঁ দিল ওর চোখে। ঊর্মি শিউরে উঠলো। ওর দম যেন আটকে গেল এক মুহূর্তের জন্য। শীতল হাওয়ার মাঝে সেই গরম নিঃশ্বাসের ছোঁয়া ওর চোখের পাতায় পড়তেই সারা শরীরটা কেঁপে উঠল ওর।
ঊর্মির কোমরে কল্লোলের হাতের বাধন দৃঢ় হলো। ও দুষ্টু হেসে আস্তে করে বলল,
“ভয় পেলেন ঊর্মি?
ঊর্মি চোখ খুলে পিটপিট করে তাকাল কল্লোলের দিকে, অপ্রস্তুত গলায় কী বলবে খুঁজে পেল না ও।
“ন-না, আমি তো…”
“আপনি কি ভেবেছিলেন… কি করতে যাচ্ছি?”
কল্লোলের মুখের হাসি বিস্তৃত হল এবার।
ঊর্মি ঠোঁট নাড়াতে গিয়ে থেমে গেল।
ওর চোখের পলক পড়ছে ঘনঘন, গালজোড়া লাল হয়ে উঠছে আবারও, ঠোঁটের কোণ যেন কাঁপছে অনিচ্ছাসত্ত্বেও।
ওর চোখে অজানা ধরা পড়ে যাওয়ার লজ্জা আর থমকে যাওয়া স্পর্শ। মস্তিষ্কে অনেক্ষণ হাতরিয়েও কোনো উত্তর খুঁজে পেল না ও। শেষমেষ এই লজ্জার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে অভিমানী গলায় বলল,
“আপনি খুব… খুব খারাপ!”
কল্লোল হেসে ফেলল। ঊর্মির দিকে আরেকটু এগিয়ে এসে বলল, “খারাপ?”
ওর কণ্ঠে প্রশ্রয়ের সুর, যেন শব্দটা ওর খুব পছন্দ হয়েছে।
“আপনি কি জানেন, ঊর্মি… এই ‘খারাপ’ শব্দটাও, আপনার মুখে অসম্ভব সুন্দর শোনায়।”
ঊর্মি ওর দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ— অসহায় চোখে, যেখানে লজ্জা, রাগ, অভিমান সব মিশে একাকার।
ওর চোখের ভেতরে অনেক প্রশ্ন, কল্লোল যেন প্রত্যেকটা পড়ে ফেলছে নিঃশব্দে।
“আমি কিন্তু কিছু করিনি,” ও ফিসফিস করে বলল,
“শুধু আপনার রিঅ্যাকশনটা দেখতে চেয়েছিলাম—”
ঊর্মি চোখ ঘুরিয়ে নিল, কিন্তু ঠোঁটে সেই অভিমান মিশে আছে এখনও।
“আপনার এসব কথা বন্ধ করুন…”
কল্লোল একটু হাসল।
“আচ্ছা বন্ধ করব… কিন্তু একটাই শর্ত—”
ও হঠাৎ করে আরও এক ধাপ এগিয়ে এলো, এত কাছে যে ঊর্মির নিঃশ্বাস আটকে এল এক মুহূর্তের মধ্যে।
“আপনি যদি বলেন… আমি একটুও খারাপ নই।”
ঊর্মি তাকাল ওর দিকে—
তীব্র বিরক্তির অভিনয় করতে গিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,”আপনি… অসহ্য!”
ঊর্মির ঠোঁট ফুলে আছে অভিমানী ভঙ্গিতে।
কল্লোল কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সেই ঠোঁটের দিকে—চুপচাপ, নিঃশব্দে। তারপর… হঠাৎ টুপ করে একটা চুমু খেল ওর ফুলিয়ে রাখা ঠোঁটদুটোতে।
ওর শরীরটা যেন কেঁপে উঠল। হতবিহ্বল ঊর্মির চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম প্রায়! মুখটা হা হয়ে গেল নিঃশব্দে।
“আ-আ-আপনি…!!!”
ওর কথা আটকে গেল মাঝপথে।
কল্লোল তর্জনী ঠেকিয়েছে ওর ঠোঁটের উপর।
“শশশ্… Calm down, little bird!”
ঊর্মির চোখ কপালে উঠে গেল এবার, বুক ধুকপুক করছে অস্বাভাবিক ছন্দে। নিশ্বাস আটকে গেছে ইতিমধ্যেই, দৃশ্যমানরূপে আরেকবার কেঁপে উঠল ও। কল্লোলের তর্জনীর ছোঁয়ায় থেমে গেল কথার ধারা।
কল্লোল এবার ওর চোখের গভীরে নজর দিল, মৃদু স্বরে দুষ্টু হেসে বলল, “আমার এরকম হুটহাট ছোঁয়ায় অভ্যাস করতে হবে লিটল বার্ড!”
ঊর্মির গালের লালিমা এক লহমায় বেড়ে দ্বিগুণ হলো। লজ্জায় হাঁসফাঁস করে কী করবে বুঝে উঠতে পারল না ও। খুব একটা নড়াচড়াও করতে পারছে না— বিপজ্জনকভাবে রেলিংয়ের ওপর বসে থাকার কারণে।
ওর চোখ দুটো কেবল দিগ্বিদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে— পালানোর পথ খুঁজছে যেন। কিন্তু কল্লোলের দুই হাতে আটকে গেছে সে পথও।
কল্লোল মাথাটা একদিকে কাত করে সেই লালিমায় মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে বলল,”আমার লিটল বার্ড যদি এভাবেই লজ্জা পায় তাহলে তো আমার তাকে আরো বেশি লজ্জা দিতে ইচ্ছে করবে!”
ঊর্মি চোখ তুলে একবার তাকালো ওর ওই মুগ্ধ চোখদুটোতে, তারপর আবার তড়িঘড়ি করে অন্যদিকে তাকালো। ওর মনে হচ্ছে, ওর বুকের ভেতর লাফাতে থাকা হৃদপিন্ডের অস্থির শব্দটা পুরো জাহাজ জুড়ে শোনা যাচ্ছে।
“আপনি একদমই ভালো না! একদমই না! নামান আমাকে, আমি নিচে যাব…” কল্লোলের বুকের উপর ছোট ছোট কিল বসালো ও।
কল্লোল ওর ছোট ছোট কিলগুলো গায়ে মাখল না। উল্টো, ওর ঠোঁটে আবার ফিরে এলো সেই পরিচিত দুষ্টু হাসিটা।
“Why are you too cute, Urmi?”
ওর দুষ্টুমি মেশানো স্বর ঊর্মির হৃদস্পন্দন আরও বাড়িয়ে দিল খানিকটা।
“আপনি শুনতে পাচ্ছেন না? আমি বলেছি আমাকে নামান!” ঊর্মি এবার রীতিমতো গাল ফুলিয়ে বসলো, চোখে অল্প জল চলে এসেছে, ঠিক কান্না নয়— লজ্জা, রাগ আর ঘাবড়ে যাওয়ার সংমিশ্রণ।
কল্লোল ওর দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর আস্তে করে হাত রাখল ওর গালে, গলার স্বর এবার খানিকটা কোমল হলো ওর,
“আচ্ছা আচ্ছা, নামাচ্ছি… কিন্তু একটা শর্তে।”
ঊর্মি সন্দেহভরে তাকাল ওর দিকে, “আবার কি শর্ত? আর কোন উল্টাপাল্টা শর্ত আমি মানতে পারবো না কিন্তু! আপনি একদিনেই আমার দেয়া ‘ভদ্র ট্যাগ’কে মিথ্যে প্রমাণ করেছেন!”
কল্লোল এবার হেসে ফেলল শব্দ করে, যেন ওর নিষ্পাপ প্রতিবাদে দারুণ আনন্দ পেয়েছে।
“ভদ্র ট্যাগ! আহা, এমন দামী একখানা সম্মাননা আমি ধরে রাখতে পারলাম না! দুঃখজনক! কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে, আপনি সেটা একটু তাড়াহুড়ো করে দিয়ে ফেলেছিলেন!
ঊর্মি ভ্রু কুঁচকে তাকাল ওর দিকে, চোখে এখনও লাজ, অভিমান আর একটু একটু জেদ।
“মানে? আপনি আবার কী বলতে চাইছেন?”
কল্লোল এবার ওর চোখের দিকে তাকিয়ে একটু মনখারাপ কর ভঙ্গিতে বলল, “আপনি আমাকে ভদ্র ভেবেছিলেন, এখন যদি জানতে পারেন, আমি পুরোপুরি ভদ্র না— তখন কি ট্যাগটা তুলে নেবেন ঊর্মি?”
ঊর্মি চোখ গোল করে তাকিয়ে রইল। তারপর গাল ফুলিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল,
“হুহ্! আপনার এসব কথায় আমি আর ভুলবো না। আপনার ট্যাগ বাতিল হয়েছে। এখন শর্তটা বলুন!”
কল্লোল এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল নাটুকে ভঙ্গিতে, “হাহ্! বাতিল! ট্যাগও গেল, সম্মানও গেল! এখন একমাত্র আশা, আপনি শর্তটা মেনে কৃপা করবেন!”
ঊর্মি মুখ ফিরিয়ে থাকলেও চোখে-মুখে খেলা করছে চাপা হাসির রেখা, যদিও ও সেটা লুকাতে ব্যস্ত।
“শর্তটা খুব কঠিন না,” কল্লোল এবার ওর কানের কাছে একটু ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে বলল,
“শুধু একটা মিষ্টি হাসি… সেই একদম মন আসা খাঁটি হাসি— যেটা আপনি মাঝে মাঝে নিজেও লুকাতে পারেন না।”
ঊর্মি থমকে গেল এক মুহূর্ত। তারপর ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে তাকাল কল্লোলের দিকে। চোখে দ্বিধা, কিন্তু ঠোঁটের কোণে ইতিমধ্যেই ফুটে উঠেছে হাসির কুঁড়ি। মাথা নুইয়ে হেসে ফেলল ও, খুব ছোট্ট করে।
কল্লোল তৃপ্ত ভঙ্গিতে বলল, “এক্স্যাক্টলি, এই হাসিটাই!
“আচ্ছা, নামান এবার…”
হাসি থামিয়ে হঠাৎ করে গলার স্বর গম্ভীর করে ফেলল ও, কিন্তু সেই গম্ভীরতাও যেন বেশ কষ্ট করে ধরে রাখা।
কল্লোল হাসলো,”আপনি খুব ছটফট করেন, জানেন? ঠিক একটা ছোট্ট পাখির মত!”
তারপর ওর কোমরে হাত রেখে পরম যত্নে ওকে নামিয়ে দিল রেলিং থেকে।
জাহাজের ছাদে ঠান্ডা বাতাস বইছে তখনও, চাঁদ ছুঁয়ে দিচ্ছে দু’জনকেই, সমুদ্রের ঢেউ আর ওদের মাথার উপর আকাশজোড়া তারা তখন মিটিমিটি হাসছে, পুরো দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে।
To be continued…
#জলতরঙ্গের_সুর
পর্ব – ১৮ (প্রথম অংশ)
লেখা – আসফিয়া রহমান
অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ❌
সূর্যের আলো তখনও ঠিকঠাক ছড়িয়ে পড়েনি সমুদ্রের বুকে। আকাশ নীলচে-ধূসর, সাদা তুলোর মতো মেঘের স্তর ভাসছে দিগন্তের ওপরে।
সমুদ্র নিঃশব্দ, যেন ক্লান্ত হয়ে ডুবে আছে গভীর ঘুমে।
ডেক পুরোপুরি ফাঁকা— দু’একটা চেয়ার ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এদিক ওদিক, মানুষজন নেই। ডেকের এক কোণায় একা একা দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ে।
তার হাতে ধোঁয়া ওঠা কফির মগ। দু’হাতে ধরে আছে মগটা, যেন কফির উষ্ণতায় কাটাতে চাইছে ভোরের হালকা শীত শীত ভাবটা।
চুলগুলো খোলা, অবিন্যস্ত হয়ে পড়ে আছে এক কাঁধের উপর, ঠাণ্ডা বাতাসে উড়ছে একটু একটু করে।
ওর ঠোঁট ছুঁয়ে আছে কফি কাপের প্রান্ত, চুমুক পড়ছে না একটাও। চোখ সামনের নীল জলরাশিতে— কিন্তু মন?
সেটা তখনো মাঝরাতের ছাদে আটকে।
রাতের কথা মনে পড়তেই আরক্তিম হয়ে উঠল কপোল।
ঠিক তখনই পেছন থেকে ভেসে আসে পায়ের শব্দ।
কল্লোল এসেছে।
ওর পরনে এখনো কাল রাতের ঢিলেঢালা ট্রাউজার আর জ্যাকেটটা। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে এলিয়ে আছে কপালের উপর। চেহারায় সদ্য ঘুম ভাঙার ছাপ স্পষ্ট।
ওর হাতেও কফির মগ।
ডেকে চোখ বুলিয়ে হঠাৎ স্থির হলো ওর দৃষ্টি।
ঊর্মি।
ঊর্মিও ওকে দেখেছে, কিন্তু দেখেও চোখ ফেরালো সঙ্গে সঙ্গেই। তড়িঘড়ি করে কফির মগে চোখ গুঁজে ফেলল- যেন খুব গুরুত্বপূর্ণ কোন দৃশ্য ভাসছে সেখানে।
কল্লোল এগিয়ে এসে ওর পাশে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে, তারপর খুব স্বাভাবিক গলায় বলে,
“ঘুম হয়েছে ঠিকঠাক?”
কল্লোলের গলা যেন ঠিক ওর কানের পাশ থেকে এল। চমকে তাকানোর বদলে ঊর্মি ভ্রু কুঁচকে সামনে তাকিয়ে থাকল। ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে মুখে কোনো হাবভাব না এনে স্রেফ মাথা নাড়ল আস্তে।
“হুঁ।”
কল্লোলের চোখে চোখ রাখল না ঊর্মি। এতে অবাক হলো কল্লোল; তবে সেটাকে পাত্তা না দিয়ে আবার বলল,“আজকে এত সকাল সকাল…?”
ঊর্মি চোখ নামিয়ে খুব নিচু গলায় উত্তর দিল,
“ঘুম ভেঙে গেল…”
কল্লোল কফিতে চুমুক দিয়ে হাসলো,
“দেরিতে ঘুমোতে গেছেন… তারপরও ঘুম ভেঙে গেল?”
ওর গলায় রসিকতার ছোঁয়া টের পেয়ে ঊর্মি ঠোঁট টিপে মগের দিকে তাকাল, গলাটা শুকিয়ে গেছে। একটা জবাব খুঁজছিল, কিন্তু সহজ কোনো শব্দ খুঁজে পেল না। অগত্যা চুপ করেই দাঁড়িয়ে রইল।
কল্লোল কফিতে আরেক চুমুক দিল। চোখদুটো কিঞ্চিৎ সরু করে লক্ষ্য করল উর্মিকে।
একবারও তাকাচ্ছে না ওর দিকে।
আপাতদৃষ্টিতে নিরপেক্ষ ভঙ্গি, কিন্তু একটু খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায়— কোথাও যেন অস্বস্তি ঘুরপাক খাচ্ছে সমস্ত চোখেমুখজুড়ে।
কয়েকপল ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকার পর আসল বিষয়টা বুঝতে পেরে ওর ঠোঁটের হাসিটা বিস্তৃত হলো। খুব নিচু স্বরে নিজের মনে বিড়বিড় করলো,
“কাল রাতে ডোজটা একটু বেশি হয়ে গেছে বোধহয়!”
চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা ঊর্মির দিকে তাকিয়ে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল কল্লোল। তারপর আবার নিজেই ভাঙল নীরবতা,”Relax little bird,”
ওর গলায় কাল রাতের পরিচিত দুষ্টু স্বরটা ফিরে এসেছে আবারো, “আমি আজকে একদম জেন্টলম্যান মুডে আছি।”
আগে থেকেই ঊর্মির পলাশরাঙা হয়ে থাকা গালদুটোর উত্তাপ এবার ছাড়িয়ে গেল কফির উষ্ণতাকেও। কফির মগটাকে আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরল ও, যেন এটাকে টেনে নিজের সামনে দেয়াল বানাতে পারলে ভালো হতো!
সকাল সকাল কী শুরু করেছে করোলাটা! কল্লোলের চোখে চোখ রাখার সাহস হলো না ওর। বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডটা যেন জাহাজের ইঞ্জিনের চেয়েও জোরে শব্দ করছে।
“আপনি—”
গলার স্বর খুঁজে না পেয়ে শেষমেশ আবার চুপ করে গেল লজ্জায় জুবুথুবু হয়ে যাওয়া মেয়েটা। কফির দিকে তাকিয়ে রইল একদৃষ্টিতে- পলক পড়ল না একবারও।
কল্লোল ঠোঁটের কোণের মুচকি হাসিটা লুকাল না এবার। মুগ্ধ চোখে একবার ভালো করে দেখল ওকে।
এই চুপ থাকা, চোখে চোখ না রাখা, মুখ ঘুরিয়ে থাকা—সব মিলিয়ে যেন ও নতুন রঙে আবিষ্কার করলো ঊর্মিকে।
ঊর্মি কফির মগে চোখ গুঁজে রেখেছে ঠিকই, কিন্তু ওর মনে মনে চলছে অদৃশ্য যুদ্ধ।
ও ঠিক করেছে, স্বাভাবিক থাকবে।
একটা রাতের দুষ্টুমি, কিছু কথা, একটা হঠাৎ চুমু—এসবের জন্য নিজেকে এত দুর্বল দেখানো যাবে না!
এই লোকটার সামনে তো একদমই না।
‘আমি ঠিক আছি…’
কিন্তু যতই ও নিজেকে বোঝাতে চাচ্ছে, মাথার ভেতরে ততই ঘুরে ফিরে আসছে কাল রাতের সেই চুমু খাওয়ার মুহূর্তটা।
কল্লোলের মুখ ওর মুখের খুব কাছে, ও ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল, কল্লোলের সেই দুষ্টু হাসি, আর—
ঊর্মি চোখ বন্ধ করে ফেলল। ভেতরে ভেতরে বিরক্তি লাগছিল নিজের উপরেই—
‘তুই কেন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছিস এখনো? স্বাভাবিকভাবে কথা বল, ঊর্মি! স্বাভাবিক!’
কিন্তু যতটা জোরে ভেতর থেকে নিজেকে ধমক দিচ্ছিল, বাইরে তার অর্ধেকটাও প্রকাশ করতে পারছে না।
ও জানে, কল্লোল লক্ষ্য করছে— প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি, প্রতিটি অনুচ্চারিত শব্দ।
ও জানে, ওর চোখে এখন যা কিছু লেখা, সবটাই পড়ে ফেলছে লোকটা।
এই জানাটাই আরও অস্বস্তিকর করে তুলছে পরিস্থিতিটা। আচ্ছা, ও যদি এখন হঠাৎ করে মুখ তুলে তাকায়… সরাসরি কল্লোলের চোখে চোখ রাখে—
তাহলে কি ও হাসবে?
নাকি আবার বলবে কিছু… এমন কিছু—
যেটা শুনলে আমার নিঃশ্বাস আটকে যাবে?
ঊর্মি নিজের অজান্তেই ঠোঁট কামড়ে ধরল।
কফির মগটা মুখে তুলে নিজেকে আড়াল করে আবারো। মনে হচ্ছে, এই মগের ভিতর যদি মুখ গুঁজে থাকা যেত, তাহলে অন্তত এই ছায়ামানবটার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যেত!
এই করোলা সাহেবের তোতোভাব এক রাতের মধ্যেই হাওয়া? ট্রান্সফর্মেশনটা বড্ড তাড়াতাড়ি হয়ে গেল না?
কল্লোল পাশ থেকে খেয়াল করল ওর অভিব্যক্তি, আরেকবার কফিতে চুমুক দিয়ে মৃদু গলায় বলল,
“আপনার মগের ভেতরে কি খুব দর্শনীয় কিছু লুকিয়ে আছে, মিস ঢেউ?”
ঊর্মি চমকে গেল কল্লোলের কথায়।
হঠাৎ করে যেন মনে হলো— ওর চিন্তাগুলো সব ফাঁস হয়ে গেছে, এই লোকটা ফিসফিস করে পড়ে ফেলেছে প্রতিটা পৃষ্ঠা।
ও চট করে কিছু বলতে পারল না। চোখ বড় করে তাকানোর সাহসও হলো না। ঠোঁট টিপে একটা দীর্ঘশ্বাস চাপতে গিয়ে কেশে ফেলল ও, তারপর ঠোঁট ছুঁয়ে থাকা মগটা সরিয়ে খুব ধীরে বলল, “কফিতে মিষ্টি হয়নি, তাই…”
কল্লোল এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো ওর দিকে।
“তাই?”
কল্লোল নিষ্পলক দৃষ্টিতে চুপচাপ ওকে দেখল কয়েক সেকেন্ড। তারপর এক ঝটকায় ওর হাত থেকে নিয়ে নিল মগটা।
“Let me taste…”
ঊর্মি আজ সকালে প্রথমবারের মতো চোখ রাখল কল্লোলের চোখে- হতবাক দৃষ্টিতে।
কল্লোল মগটা হাতে নিয়ে ওর দিকে একবার তাকাল, পরপর তাকালো মগের ভেতর—
তারপর ঠোঁট লাগিয়ে চুমুক দিল।
এক সেকেন্ড… দুই সেকেন্ড… কল্লোল ভ্রু কুঁচকে পরিমাপ করল কফির মিষ্টতা। তারপর চোখ তুলে তাকাল উর্মির দিকে।
“মিষ্টি নেই?” কল্লোলের একটা ভ্রু আপনাআপনি উঠে গেছে উপরের দিকে।
ঊর্মি ধরা পড়ে গিয়ে কী বলবে খুঁজে পেল না। বহুকষ্টে চোখেমুখে নিষ্পাপ ভাব ফুটিয়ে তুলে কোনোরকমে বলল, “মিষ্টি নেই, সত্যি বলছি!”
কল্লোল এখনো ভ্রু উঁচিয়ে তাকিয়ে আছে, মগটা একটু নাড়িয়ে দেখল ও, “আচ্ছা? তাহলে এই মিষ্টি মিষ্টি স্বাদটা কোথা থেকে এলো?”
ঊর্মির চোখ বড় করে তাকালো, কপালে ভাঁজ পড়ল ওর।
“আমি তো বললাম মিষ্টি নেই…”
কল্লোল ধীরেসুস্থে হাসল, তারপর একটু কাছে এগিয়ে এসে গম্ভীর স্বরে বলল,, “কোনো সমস্যা নেই, ম্যাডাম। অতিরিক্ত চিন্তায় আপনার টেস্টবাড কাজ করছে না নিশ্চয়ই! তবে আপনার হয়ে আমি চিন্তাভাবনা করে ফেলতে পারি। গতরাতের ডোজের রিঅ্যাকশন এখনো বিদ্যমান— এটাই তো?”
ঊর্মি চোখ এবার কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম।
এই করোলাটা বলে কি!
“আ-আপনি…!”
তীব্র প্রতিবাদে ফুঁসে উঠলো ওর ভেতরটা, কিন্তু ঠোঁটদুটো বরাবরের মতো অবাধ্য। তারা প্রতিবাদ করতে প্রস্তুত নয়!
তার বদলে গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে ছোট্ট এক ফুঁস্!
কল্লোল হেসে ফেললো আবারো।
“Don’t worry, little bird!”
ও ঊর্মির প্রায় ঠান্ডা হয়ে আসা কফিতে চুমুক দিয়ে বলল,”আমি আবার একই ডোজ দেবো না। আজকে একটু হালকা রাখব। সকাল সকাল এত তীব্রতা মানাবে না, ঠিক না?” ওর মুখে বাঁকা হাসি।
ঊর্মির কানদুটো ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো। কল্লোলের হাসি, ওর ভঙ্গিমা, ওর কথা— সবকিছু মিলে যেন পলকে ওর মস্তিষ্ক অবশ করে দিল।
এই লোক নির্ঘাত পাগল হয়ে গেছে— ও নিশ্চিত!
কি থেকে কি বলছে নিজেই জানে না বোধহয়!
“আমার মগ দিন…” চোখেমুখ লাল করে ঊর্মি হাত বাড়াল মগটা ছিনিয়ে নিতে, কিন্তু কল্লোল তৎক্ষণাৎ সেটা সরিয়ে ফেলল ওর নাগালের বাইরে।
“এত তাড়া কিসের, little bird! Let me taste it first properly… আমার ঠোঁটের স্পর্শে কফিটাকে মিষ্টি বানানোর চেষ্টা করছি, যাতে আপনার জিভে আর তেতো না লাগে!” ওর মুখভঙ্গি সিরিয়াস— যেন সত্যিই কফির স্বাদ বিশ্লেষণ করাই ওর জীবনের সবচেয়ে জরুরি দায়িত্ব।
ঊর্মির উচ্চতা কল্লোলের কাঁধ বরাবর। দুই পা উঁচিয়েও উঁচু করে রাখা মগের নাগাল পেল না ও। অগত্যা দুই হাত কোমরে রেখে ভ্রু কুঁচকে রীতিমতো বিরক্ত গলায় বলল, “এমন করলে কিন্তু আমি থাকবো না এখানে!”
কল্লোল বাঁকা হাসলো,
“এই মাঝসমুদ্রে কোথায় যাবেন?”
ঊর্মি চোখ ছোট করে তাকাল।
“আমি সিরিয়াস!”
“আমিও তো সিরিয়াস! এখানে মজা করছে কে?”
মুখটা গম্ভীর করে বলল ও।
ঊর্মি যারপরনাই বিরক্ত।
এই করোলাটা তো খুব খারাপ!
রাতে হঠাৎ একটা চুমু দিয়ে সকালবেলা বসে আছে ওর কফির মগ নিয়ে— সিরিয়াস মুখে “টেস্ট” করছে!
এই লোকের লজ্জা বলে কিছু নেই নাকি?
ও গলার স্বর খানিক নামিয়ে বলল,
“দেখুন, জাহাজ থেকে তো নামতেই হবে একদিন। তখন কিন্তু—”
“তখন কী?”
কল্লোল চোখ কুঁচকে তাকাল।
“তখন আমার সাথে আর কথা বলবেন না, তাই তো?”
ঊর্মি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“হ্যাঁ, তাই।”
কল্লোল কফির মগে শেষ একটা চুমুক দিল, তারপর মগটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে দুষ্টু হাসলো,
“এই নিন ম্যাডাম, আপনার অতিমূল্যবান কফি।
তবে একটাই অনুরোধ— পরেরবার যদি মিষ্টি না হয়, আমাকে চিনি হিসেবে ব্যবহার করতে চাইবেন না, প্লিজ।”
ঊর্মি বিস্ময়ে মার্বেল আকৃতির চোখ নিয়ে ফুঁসে উঠলো,
“আপনি… আপনি একটা… করোলা!” বলেই থমকে গেল ও।
‘শিট্! ওহ্ গড! কী হবে এখন?
ঊর্মি রে… তুই শেষ আজকে!’
কল্লোলের ভ্রু এক লাফে ওপরে উঠলো,
“…করোলা?!”
উর্মি কফির মগটা ওর হাত থেকে নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে ফেলল তড়িৎগতিতে,
“আমি… আমি এই যে এই কফির কথা বলছিলাম। খুব তেতো হয়েছে।”
কল্লোল হো হো করে হেসে উঠলো,
“Wow. So now I’m officially a vegetable!”
পরমুহূর্তেই হাসি থামিয়ে গম্ভীর হলো মুখটা।
ঊর্মি ভয়ে ঢোক গিলল।
“ইয়া মাবুদ, রক্ষা করো! আমি তো ইচ্ছে করে জোরে বলিনি! মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে…”
ঊর্মির ভাবনার মাঝেই কল্লোল মুখ খুলল। গম্ভীর গলায় বলল, “আমাকে টেস্ট না করেই তেতো বলছেন? Very bad, Urmi! কী করে বুঝলেন? আমি আদৌ মিষ্টি না তেতো?”
ঊর্মি ভড়কে গিয়ে চোখ গোল গোল করে তাকালো।
“না মানে… আমি… আপনি তো… ওই কফির কথাই বলছিলাম আমি! আ-আপনি ভুল বুঝছেন…”
ওর কণ্ঠস্বরে ভয় আর লজ্জা মিশে গেছে অদ্ভুতভাবে।
কল্লোলের চোখে তখন দুষ্টু ঝিলিক— কিন্তু সেটা আপাতত ধরা পড়ছে না ঊর্মির ভড়কে যাওয়া চোখে।
কল্লোলের মুখ গম্ভীর, ভয়ানক গম্ভীর।
“আচ্ছা? আমি তাহলে ভুল বুঝেছি, তাই তো?”
বলতে বলতে কল্লোল একটু একটু করে এগোতে শুরু করলো সামনের দিকে। ঊর্মি সেদিন তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলে এক পা দুই পা করে পেছাতে শুরু করলো ধীরে ধীরে…
To be continued…
#জলতরঙ্গের_সুর
পর্ব – ১৮ (শেষ অংশ) [রোমান্টিক এলার্ট ‼️]
লেখা – আসফিয়া রহমান
অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ❌
“আচ্ছা? আমি তাহলে ভুল বুঝেছি, তাই তো?
বলতে বলতে কল্লোল একটু একটু করে এগোতে শুরু করলো সামনের দিকে। ঊর্মি শুকনো ঢোক গিলে এক পা দুই পা করে পেছাতে শুরু করলো ধীরে ধীরে।
“আ-আ-আপনি এ-এগোচ্ছেন ক-ক-কেন?”
বলতে বলতে ডেকের রেলিংয়ে পিঠ ঠেকে গেল মেয়েটার। মুখমণ্ডল রক্তিম। গলা শুকিয়ে কাঠ।
এ-এবার? এবার কী হবে?
এক মুহূর্তের জন্য গত রাতের দৃশ্য ভেসে উঠল মানসপটে। আবারো শুকনো ঢোক গিলল ও।
কল্লোল এগিয়ে এসে দাঁড়ালো একদম ওর মুখোমুখি, চোখে চোখ রেখে খুব নিচু গলায় বলল,
“আপনার এই ‘করোলা’ আসলে কতটা তেতো, সেটা না জেনে কীভাবে রায় দিলেন? You should taste me first, little bird ! না জেনে আমার সম্পর্কে ভুলভাল রায় দিচ্ছেন এটা তো মেনে নেওয়া যায় না, তাই না?”
ঊর্মির হৃদস্পন্দন মুহূর্তে গলা পর্যন্ত উঠে এলো। চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। চোখে মুখে লজ্জা, ভয় আর বিস্ময়ের তীব্র ধাক্কা।
ও এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না— এটা নিছক ঠাট্টা, নাকি সত্যিই…
শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া গলায় আর ঢোক গেলা যাচ্ছে না। ঊর্মি আরেকটু পেছাতে চেষ্টা করল, কিন্তু ওর পিঠ রেলিংয়ে ঠেকে গেছে অনেক আগেই।
ওর নিঃশ্বাস ধরা ধরা, বুকটা অকারণে উঠানামা করছে।
কল্লোল মাত্র তিন ইঞ্চি দূরে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে ওর প্রতিটি অভিব্যক্তি।
কল্লোল ঊর্মির দুপাশ থেকে হাত রাখল রেলিংয়ে। নিজের বলয়ে আটকে ফেলল বোকা মানবীকে- যে এই মুহূর্তে নিজের জালে ফেঁসে গেছে নিজেই। পালাবার পথ না পেয়ে ছটফট করছে এখন।
কল্লোল ওর পুরো মুখে দৃষ্টি ঘোরালো।
ঊর্মির ঘনঘন পলক পড়তে থাকা চোখে, নিশ্বাসে, গালের লালচে আভায়।
তারপর—
হঠাৎ করে খুব কাছাকাছি ঝুঁকে এল ও।
মোলায়েম চুলগুলো ভেদ করে হাত রাখল মেয়েটার দুগালে। তর্জনী ছুঁয়ে গেল কান বরাবর, আঙুলের ডগার শিরশিরে স্পর্শে কেঁপে উঠল মেয়েটার লোমকূপ।
ঊর্মির চোখ জ্বলজ্বল করছে— বিস্ময়, শঙ্কা আর লজ্জায়। নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ করে আছে ও, বুকের ভেতর শব্দ করে কাঁপছে হৃদস্পন্দন, শব্দটা এত তীব্র যেন গলার কাছে উঠে এসেছে হৃদপিণ্ড।
কল্লোলের চোখে তখন অদ্ভুত এক স্থিরতা। যেন ও কিছু অনুভব করতে চাইছে, কিছু যাচাই করতে চাইছে—নিজের ভেতরের দ্বন্দ্বটা ঊর্মির চোখে খুঁজে নিতে চাইছে।
কল্লোল এগিয়ে এলো আরো একধাপ।
এতটাই কাছে, যে ঊর্মি চোখ বুজে ফেলল… নিজের অজান্তেই।
এতক্ষণ ধরে বহমান ঠাণ্ডা হাওয়া সরে গেল ওদের মাঝখান থেকে। ঊর্মির কাঁধে একপাশে পড়ে থাকা ঝরঝরে চুলগুলোও কেঁপে উঠল, কল্লোলের গরম নিঃশ্বাসের তোপে।
তারপর…
এক অদ্ভুত মায়াবী স্তব্ধতার মাঝে কল্লোলের ঠোঁট স্পর্শ করল ঊর্মির ঠোঁটে।
ঊর্মি কেঁপে উঠলো বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো। নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেল। হাতে ধরে রাখা মগটা বেখেয়ালে ছেড়ে দিলে সেটা এক মুহূর্তে আছড়ে পড়ল মেঝেতে। ভোরের নিস্তব্ধতাকে খান খান করে বিকট শব্দ তুলে কাঁচের টুকরোগুলো ছড়িয়ে পড়লো ডেকের ধাতব মেঝেতে।
কল্লোলের কোনো ধ্যান জ্ঞান নেই সেদিকে। সে তো মত্ত হয়েছে প্রেয়সীর অধরসুধা পানে।
কিন্তু তার প্রেয়সী চমকে উঠে চোখ মেললো। হুঁশ ফিরে পেতেই বুকের কাছটায় হাত রেখে ঠেলে সরাতে চাইল তাকে। কিন্তু শীর্ণ হাতদুটো দিয়ে একচুলও নড়ানো গেল না শক্তপোক্ত শরীরের অধিকারী দীর্ঘদেহী মানুষটাকে।
উল্টে নিজের নির্বিঘ্ন কাজে বাঁধা পেয়ে বলিষ্ঠ হাতদুটো প্রেয়সীর নরম তুলতুলে গাল ছেড়ে নেমে এসে খপ করে আটকে ফেলল বাঁধা প্রদানকারী শীর্ণকায় হাতদুটি।
বলিষ্ঠ হাতে ধরা পড়া শীর্ণকায় হাতদুটো কাঁপছে, কিন্তু তবুও এই গভীর ছোঁয়া সে অস্বীকার করতে পারছে না কিছুতেই।
তারপর আরো কিছু সময় অতিক্রান্ত হবার পর কল্লোল ধীরে, খুব ধীরে সরে এলো প্রেয়সীর নরম তুলতুলে ঠোঁটের উপর থেকে। ওর কপাল এখন ঠেকে আছে ঊর্মির কপালের সঙ্গে, চোখে খেলছে নিঃশব্দ আগুন।
“তেতো লাগল, ঊর্মি?”
শ্বাসরুদ্ধকর চাপা স্বরে ফিসফিসিয়ে বললো সে,
“নাকি একটু বেশি মিষ্টি হয়ে গেল?”
দুষ্টুমি মাখা কথাগুলো মেয়েটার কানে পৌঁছাল কিনা কে জানে। নাজুক মেয়েটা এখনো শ্বাস নিতে পারছে না ঠিকঠাক। হাপড়ের মতো ওঠানামা করছে তার বুক। আধখোলা চোখদুটো মেলে তাকানোর শক্তিটুকুও পাচ্ছে না ভেতর থেকে। জীবনে প্রথমবারের মতো কোনো পুরুষের এহেন অপ্রত্যাশিত গভীর স্পর্শে ওর শরীর-মন দুটোই যেন ধাক্কা খেয়েছে একই সঙ্গে।
কল্লোল সেটা খুব স্পষ্টভাবে টের পেল।
শীর্ণ হাতজোড়া ছেড়ে দিয়ে ঊর্মির কপাল ছুঁয়ে থাকা নিজের কপাল পিছিয়ে নিলো আলতো করে। তারপর দুই হাত বাড়িয়ে খুব সাবধানে ধরল প্রেয়সীর কাঁধে, যেন হঠাৎ আসা দমকা হাওয়ায় ভেঙে না যায় এই নরম, কাচের মতো দুর্বল মুহূর্তটা।
“ঊর্মি…?”
ওর গলায় এবার আর দুষ্টুমি নেই। উদ্বেগ মেশানো স্বরে সে জানতে চায়, “Are you alright?”
ঊর্মি উত্তর দেয় না। শুধু খুব ধীরে মাথা নাড়ে একবার—না কি হ্যাঁ, বোঝা মুশকিল।
চোখ বন্ধ, দম নিতে কষ্ট হচ্ছে।
কল্লোল ওর কাঁধে হাত রাখতেই টের পেয়েছে, পাতলা শরীরটা কাঁপছে থরথর করে।
“Breathe, little bird… slow… ধীরে নিঃশ্বাস নাও।”
ঊর্মিকে স্পেস দেয়ার জন্য নিজের শরীরটা সরিয়ে নেয় ও।
ওর কথায় ঊর্মি চেষ্টা করল ধীরে শ্বাস নেওয়ার। খরখরে গলায় বারকয়েক কাশল মেয়েটা।
কল্লোল আর এক মুহূর্ত দেরি করল না। খুব ধীরে ওর হাতটা ধরল, “চলো, বসো এখানে একটু।”
ওর গলা আগের তুলনায় অনেক বেশি কোমল।
ঊর্মিকে একটু দূরে থাকা চেয়ারে বসালো কল্লোল। তারপর নিজে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল ওর সামনে।
ঊর্মির এক হাত নিজের হাতে নিয়ে আঙুলের ফাঁকে রেখে স্পর্শ করল আলতো করে। তারপর একটু অবাক হয়ে বলল,”তোমার হাত ঠান্ডা হয়ে গেছে ঊর্মি… এতটা ভয় পেয়েছো?”
ঊর্মির শ্বাস কিছুটা স্বাভাবিক, তবে এখনো বেশ অনিয়মিত। ধীরে মাথা নাড়ল ও। না-র মতো, অথচ পুরোপুরি হ্যাঁ।
কল্লোল এবার গলায় অপরাধবোধ মিশিয়ে বলল,
I’m sorry, my little bird!” ঊর্মির হাতটা টেনে একটা ভেজা চুমু খেল ও,”আমি বুঝতে পারিনি তুমি এতটা ঘাবড়ে যাবে…”
ঊর্মির শরীর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে।
ফুসফুসে একটু একটু করে ঢুকছে বাতাস, বুকের হড়বড়ে ওঠানামা এখন অনেকটা থেমেছে। আধবোজা চোখে সে তাকিয়ে দেখছে সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসা ছেলেটাকে— তার মুখে এখন আর দুষ্টুমির ছায়া নেই; তার বদলে একরাশ অপরাধবোধ বিরাজ করছে সেখানে।
কল্লোল নরম গলায় আবার বলে,
“তুমি ঠিক আছো তো, ঊর্মি? পানি খাবে?”
ঊর্মি চোখ খুলে একটুখানি তাকায়।
ওর চোখের কোণায় এখনো একফোঁটা পানি চিকচিক করছে। ও ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে একবার।
জবাবটা যেন শুধু কল্লোলকে নয়, নিজেকেও বিশ্বাস করানোর প্রয়াস।
কল্লোল ওর হাতের উপর নিজের হাতটা রেখে ওর আঙুলগুলো আবার আলতো করে চেপে ধরল।
“ভয় পাওয়া খুব স্বাভাবিক, little bird. It’s okay.
তবে আমি… তোমার কোনো ক্ষতি করার জন্য কাছে আসিনি। আমাকে বিশ্বাস করো তো ঊর্মি?”
ঊর্মি কোনো উত্তর দেয় না।
শুধু নিচের ঠোঁটটা একটু কেঁপে ওঠে ওর।
চোখের পলক পড়ে, আবার ওঠে। তারপর ধীরে খুব ধীরে, যেন বহুদিন ধরে জড়তা কাটানোর চেষ্টা করছে, ওর হাতটা এগিয়ে যায় কল্লোলের হাতে ধরা ওর হাতের উপর— আরও খানিকটা চেপে ধরতে।
কল্লোল ওর স্পর্শে থেমে যায় এক মুহূর্তের জন্য।
চোখে ধরা পড়ে স্বস্তি— একটা দমকা ছেড়ে দেওয়া স্বস্তির প্রশ্বাস।
ঊর্মি এবার মুখ তুলে ওর দিকে তাকায়। গলার স্বর এখনো মৃদু, ভরসা মেশানো স্বরে বলে,
“I trust you Captain,”
একটু থেমে চোখ নামিয়ে ফেলে ও,
“কিন্তু আমার জন্য অনুভূতিটা… নতুন, অচেনা। তাই… নিজেকে সামলে উঠতে পারিনি ঠিকঠাক।”
কল্লোল হাত বাড়িয়ে ওর মুখের সামনে এলিয়ে আসা চুলগুলো গুছিয়ে দেয় কানের পাশে, খুব ধীরে, আলতো করে।
“তুমি সময় নাও ঊর্মি। যতটা লাগে… তোমার নিয়মে, তোমার মতো করে। কোনো তাড়াহুড়ো নেই।”
ঊর্মির চোখে এবার ছোট্ট একটা হাসি খেলে যায় ধীরে।
খুব হালকা, খুব অনভ্যস্ত— কিন্তু মন থেকে আসা।
ও মাথা নাড়ে একবার। তারপর মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা ভাঙা কাঁচের টুকরোগুলোর দিকে তাকিয়ে চিন্তিত মুখে বলে,”ক্যাপ্টেন, এই কাঁচগুলোর কী হবে?”
কল্লোল ওর কথার ভঙ্গি শুনে মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ালো।
“Don’t worry, কাউকে দিয়ে পরিষ্কার করাচ্ছি।”
তারপর হঠাৎ করে কিছু একটা মনে পড়ে যাওয়ায় আবার ঊর্মির দিকে তাকিয়ে বলে, “কিন্তু তুমি তো আমার প্রশ্নের উত্তর দাওনি!”
“কোন প্রশ্ন?” ঊর্মি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায়।
কল্লোল এক ধাপ এগিয়ে এলো ওর দিকে, চোখে সেই পুরনো দুষ্টুমিটা আবার ফিরে এসেছে।
“আপনার করোলা কেমন লেগেছে, ম্যাডাম?”
ওর ঠোঁটে টেনে আনা বাঁকা হাসি,
“তেতো, না একটু বেশি মিষ্টি হয়ে গেল?”
ঊর্মি থমকে যায় এক মুহূর্ত।
চোখ গোল করে তাকিয়ে থাকে কল্লোলের দিকে, তারপর তড়িৎগতিতে চোখ নামিয়ে ফেলে লজ্জায়।
গালটা আবার গরম হয়ে আসছে ধীরে ধীরে।
ওর ঠোঁটে একটা ক্ষীণ হাসির রেখা খেলে যায়,
“এই প্রশ্নের উত্তর… রিপোর্ট করে জানানো হবে, ক্যাপ্টেন।”
কল্লোল এবার হো হো করে হেসে ওঠে।
“আচ্ছা, উত্তরটা তাহলে সময় নিয়ে দেওয়ার মতো কিছু!”
তারপর আবার বলে,”তাহলে কাল ফেরার পর মনে করে রিপোর্টটা মেইল করে দেবেন ম্যাডাম…”
ঊর্মি মুহূর্তে থমকে যায়। পুরো কথার মধ্যে ওর কানে শুধু বাজে একটা অংশ,”কাল… ফেরার পর?”
ওর গলার স্বর একেবারে নিচু হয়ে গেছে, যেন নিজেকেই বলছে এতটাই মৃদু।
কল্লোল ওর হঠাৎ পাল্টে যাওয়া অভিব্যক্তি খেয়াল করলো। হাসি থামিয়ে ওর মুখটাও গম্ভীর হলো এবার,
“হ্যাঁ। আমাদের রুটিনমাফিক শিডিউল। কাল সকালে পোর্ট করব। দুদিনের ছুটি— তারপর আবার বের হবো।”
ঊর্মির চোখের দৃষ্টি ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে আসে।
ওর মুখের রঙ বদলে যায়— এই খবরটা যেন হঠাৎ করেই ওর বুকের কোথাও একটা গিয়ে বিঁধে গেল প্রচন্ডভাবে।
“তুমি শুনলেই মন খারাপ করবে, তাই তোমাকে জানাইনি ঊর্মি।”
ঊর্মি চেয়ার থেকে উঠে রেলিংয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।
সূর্যের আলো তখনো পুরোপুরি উজ্বল হয়ে ওঠেনি,
আকাশে ছড়িয়ে আছে ধূসর-কমলা মেশানো হালকা মেঘের রেখা। সমুদ্রের উপর দিয়ে বয়ে চলা ঠাণ্ডা বাতাসটা যেন সারা রাতের ঘুমিয়ে থাকা ঢেউগুলোকে জাগিয়ে তুলছে ধীরে ধীরে।
ঊর্মি একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল বিস্তৃত দিগন্তের দিকে—
যেখানে আকাশ আর সমুদ্র মিলেছে একটা অস্পষ্ট রেখায়। সেদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, ঠোঁট কাঁপে ওর, মৃদু গলায় প্রায় না শোনার মতো করে বলে,
“আমাদের আবার কবে দেখা হবে, ক্যাপ্টেন?”
কল্লোল উত্তর দেয় না।
চুপচাপ তাকিয়ে থাকে প্রেয়সীর মেঘ ঘনিয়ে আসা চোখদুটোর দিকে। দীঘল কালো চঞ্চল চোখজোড়ায় বাড়ছে ধূসর মেঘের আনাগোনা। যেকোনো সময় বৃষ্টি নামার সম্ভাবনা প্রবল।
সেদিকে তাকিয়ে নির্বিকার মানুষটার বুকের ভেতরটাও টনটন করে ওঠে অব্যক্ত বেদনায়।
ওদের পরিচয় অনেক দিনের হলেও এই তিনদিনে যেন এক সমুদ্র পথ হেঁটে এসেছে ওরা একসাথে—
নিজেদেরকে ঠিকঠাক বুঝে ওঠার আগেই আবার দাঁড়াতে হচ্ছে বিচ্ছেদের দ্বারপ্রান্তে।
প্রেয়সীর নীল জলরাশির দিকে নিবদ্ধ আঁখিদুটোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কল্লোল খুব আলতো করে তার হাতটা ধরল। ওর কণ্ঠস্বর নিস্তব্ধ সকাল ভেদ করে আসে অনেক নিচু হয়ে— একটুকরো প্রতিশ্রুতি ছুঁয়ে যায় সেই স্বরের ভেতর।
“দেখা তো হতেই হবে, ঊর্মি।
ঊর্মি আর কল্লোল যে একে অপরের অনুরণন…”
ঊর্মির দৃষ্টি ফিরে আসে ধীরে ধীরে।
আকাশের রেখা ছেড়ে, সমুদ্রের ঢেউ ছেড়ে—
দৃষ্টি স্থির হয় ঠিক সেই চোখদুটোর ওপর,
গত তিনদিন ধরে যে চেখে শুধু আশ্রয় খুঁজেছে ওর তৃষ্ণার্ত মন।
ক্যাপ্টেনের চোখের গভীরে অচেনা কিছুর উপস্থিতি অনুভব করে ও। একটা শীতল আত্মবিশ্বাস— যে জিনিসকে সে ভালোবেসে ফেলেছে একবার, তাকে কোনো ঝড়েই টলাতে পারবে না কেউ।
একটা অপার শান্তি— সেই শান্তির গা ঘেঁষে আছে একটা শূন্যতা, একটা অসমাপ্ত কল্পনার দহন।
ঊর্মির বুক কেমন হুহু করে ওঠে।
এই কদিনে বুঝেছে ও, এই লোকটা নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে না কখনো।
তবু আজ, তার চোখের চাহনি, মুখের অভিব্যক্তি—
সবই যেন কিছু একটা বলে ফেলতে চাইছে, কিন্তু শব্দ হয়ে ফুটছে না কিছুই।
ঊর্মি এক পা এগিয়ে যায়।
খুব ধীরে, যেন একেকটা পদক্ষেপে জমে থাকা হাজারটা সঙ্কোচ ফেলে যাচ্ছে পেছনে।
ওর হাতদুটো উঠে আসে নিজে থেকেই,
আলতোভাবে স্থির হয় প্রেমিক পুরুষের বুকের ওপর।
ওর হাতের নিচে মানুষটার হৃদস্পন্দন স্পষ্ট।
তার স্বভাবের মতো গম্ভীর তার হৃদপিণ্ডটাও।
একেকটা স্পন্দন তার কি ভারী…
ঊর্মির দুই হাতের নিচে কল্লোলের বুক যেন থেমে থাকা সমুদ্র, ভেতরে ঢেউ চলেছে বটে—
তবে তার শব্দ নেই, চঞ্চলতা নেই, গভীর, নিস্তব্ধ তার বিস্তার।
ঊর্মির চোখ তুলে তাকায় কল্লোলের চোখে।
তীক্ষ্ণ, দৃঢ়, অথচ অদ্ভুতভাবে কোমল সেই মুখটা এখন এতটাই কাছাকাছি যে, ওর দম আটকে আসে আবার।
এক পলক, দুই পলক—
তারপর ও হারিয়ে যায় সেই বিস্তৃত নীল জলরাশির মতো চোখদুটোর গভীরে।
কল্লোল এক হাতে প্রেয়সীর কপালের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দেয় আলতো করে। তারপর ঠোঁট ছোঁয়ায় সেই নির্জন স্থানে। যেখানে মুহূর্ত আগেও ছিল অস্থিরতা, এখন কেবল শান্তি।
আবেশে তার প্রেয়সীর চোখ বন্ধ হয়ে আসে আপনা হতেই। খুব গোপনে একটা নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাস বেরোয় বুক চিরে, যেন বহুদিন ধরে খুঁজে ফেরা সমুদ্রের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ও অবশেষে।
এই একটুখানি স্পর্শে,
ওর সমস্ত অজানা আশঙ্কাগুলো নিঃশব্দে গলে যায়
কল্লোল নামের একটা নিশ্চয়তার ভিতর।
ক্যাপ্টেন তার প্রেয়সীর কপালে নিজের কপাল ছুঁইয়ে রাখে, দুই চোখ বন্ধ করে অনেকটা সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে সেভাবেই।
সমুদ্র তখনো নিঃশব্দে গর্জে চলছে পেছনে,
জেগে ওঠা সূর্যের আলো ছায়া ফেলেছে ডেকের ওপরে।
দুটো মানুষ নিঃশব্দ প্রতিজ্ঞার মতো দাঁড়িয়ে থাকে…
কোনো শব্দ ছাড়া, একটানা ভালোবাসার নিরব প্রতীক্ষায়।
To be continued…