জলতরঙ্গের সুর পর্ব-১৯+২০

0
5

#জলতরঙ্গের_সুর
পর্ব – ১৯
লেখা – আসফিয়া রহমান
অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ❌

ক্যান্টিনে একসাথে দুপুরের খাবার খেতে বসেছে ওরা সবাই। ঊর্মি, নিশাত, তানিয়া, মেহেরিন, রুবেল।

আজকে জাহাজে ওদের শেষ দিন। একটুআধটু মনখারাপ সবারই। তবে ঊর্মির মন বেশ ভার। ও কথা বলছে না কারো সাথেই। খাচ্ছেও না ঠিকঠাক। অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে চামচ নাড়াচাড়া করছে সেই কখন থেকে।

নিশাত একবার ওর দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় তানিয়াকে কিছু বোঝালো, পরপর তানিয়া হালকা স্বরে বলে,”কি রে ঊর্মি, এত চুপচাপ কেন? তোকে তো একদম চেনাই যাচ্ছে না আজকে!”

ঊর্মি মুখ তুললো না। যেন শুনতে পায়নি।
পাশে বসা মেহেরিন একটু ঝুঁকে পড়ে ওর মুখের দিকে তাকালো,”তোর মন খারাপ?”

ঊর্মি মাথা নাড়লো, ছোট করে বলল,
“দিনক’টা কেমন তাড়াতাড়ি চলে গেল যেন…”

নিশাত মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
তানিয়া ধীর গলায় বলে,
“এই রকম ছুটি আর এভাবে একসাথে কবে পাওয়া হবে কে জানে!”

রুবেল তখনও চুপচাপ খাচ্ছিল। কিন্তু তানিয়ার কথাটা শুনে ও থেমে যায় একটু। চোখ তুলে একবার তাকায় ঊর্মির দিকে। তারপর বলে,
“আমরা তো আবারও দেখা করবো, তাই না?”

একটা ক্ষণিক নীরবতা নেমে আসে টেবিল জুড়ে।
জাহাজের ক্যান্টিনের জানালা দিয়ে ঢুকে পড়া বাতাস দোল তোলে ঊর্মির চুলে।

নিশাত পাশ থেকে বলে,
“চল না, পরে কোনো একদিন আবার এমন একটা ট্রিপ প্ল্যান করি! আরও বড়, আরও মজার!”

মেহেরিন মুখ বাঁকালো,
“আমি আর তোদের এসব উল্টাপাল্টা প্ল্যানে নেই, বাবা! এবার জোর বাঁচা বেঁচে গেছি…”

ঊর্মি এবার একটু হাসে, খুব ক্ষীণভাবে।
সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা সম্পর্কে কে বলতে পারে?
এই ট্রিপে ঊর্মি এসেছিল নিজেকে খুঁজতে, নির্জনতাকে ছুঁয়ে দেখতে। অথচ সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনায় কি ভীষণ অদ্ভুতভাবে সবকিছু বদলে গেল; অপ্রত্যাশিতভাবে ও দেখা পেয়ে গেল সেই মানুষটার- যে মানুষটার ছায়াও আর কোনোদিন মাড়াবে না বলে ভেবেছিল।

আর আজ যখন সেই মানুষটাকেই ছেড়ে যেতে হচ্ছে,
বুকটা মুচড়ে উঠছে নিঃশব্দে, তীব্র ব্যথায়।

সময়!
সময় বড় অদ্ভুত জিনিস।
সময়ের পালাবদলে যা কোনোদিন ঘটার কথা নয় তা-ও ঘটে ভীষণ অবলীলায়। নিঃশব্দে। কোনরকম আগামবার্তা ছাড়াই।

_______________________________

ধরনীর বুকে সন্ধ্যা নেমেছে। অন্ধকার নিঃশব্দে গ্ৰাস করেছে দিনের উজ্জ্বল আলোটাকে। আকাশকে রাঙিয়ে রাখা লালচে আভাটাও মিলিয়ে যাচ্ছে ধীরগতিতে।

ঊর্মি পায়চারি করছে লম্বা ডেক বরাবর। ওর মাথার ওপরে ধূসর শূন্যতায় ক্রমশ গাঢ় হতে থাকা আকাশ। ও খুব করে চাইছে কল্লোল আসুক এখানে, এই মুহূর্তে। ক্যাপ্টেনের সাথে কথা বলার জন্য মনটা আনচান করছে ওর। অথচ ক্যাপ্টেন আসছে না।

অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করবার পরেও যখন ক্যাপ্টেন এলো না, মনটা ঝুপ করে নিভে গেল ওর। কেবিনে ফিরে যাওয়ার জন্য যখন ও ঘুরে দাঁড়িয়েছে, ঠিক তখনই দেখতে পেল রুবেল আসছে এদিকেই। ও তাকিয়ে থাকতে থাকতেই রুবেল এসে থামলো ওর সামনে।

“ওদিকের আড্ডা ছেড়ে তুমি এখানে একা একা দাঁড়িয়ে আছো যে?”

“এমনি, হইহুল্লোড় ভালো লাগছিল না… তাই।”

রুবেল এক পলক ওর মুখের দিকে ভালো করে তাকালো। মন খারাপটা স্পষ্ট ওর চেহারায়। তারপর বলল, “একটা জায়গায় যাবে?”

ঊর্মি ভ্রু কুঁচকে তাকালো, একটু দ্বিধা নিয়ে জিজ্ঞেস করল,”কোথায়?”

রুবেলের চোখে তখন অদ্ভুত স্থিরতা।
ওর গলার স্বর স্বাভাবিক, কিন্তু সেই স্বাভাবিকতার আড়ালে চাপা অন্য কিছু।

“পুরো জাহাজটা ঘুরে দেখেছো? চলো, তোমাকে ঘুরে দেখাই আজকে।”

“পুরো জাহাজ?” ঊর্মি অবাক হয়ে তাকালো, “জাহাজের প্রায় জায়গাই তো সিভিলিয়ানদের জন্য রেস্ট্রিকটেড!”

রুবেল হাসে, “হ্যাঁ, রেস্ট্রিকটেড তো বটেই… তবে আজ জাহাজে কড়াকড়ি নেই আপাতত। অফিসাররা সবাই একটা মিশনে গেছে জাহাজের বাইরে।”

ঊর্মির কপালে আবারো ভাঁজ পড়লো। মনে মনে হিসেব মেলানোর চেষ্টা করে ও।
ক্যাপ্টেনও কি জাহাজে নেই?
মিশনে গেছে? তাহলে…
সেই জন্যই ওর কাছেও আসেনি?
সন্ধ্যার এতটা সময় কেটে গেল— ও অপেক্ষা করেছে, হাঁটাহাঁটি করেছে ডেকে, চোখ রেখেছে দরজার দিকে… কেউ আসেনি।

ঊর্মির এতক্ষণ একটা ব্যাখ্যা খুঁজছিল—
কেন আসছে না ক্যাপ্টেন।
এখন রুবেলের কথায় যেন সেই ব্যাখ্যাটা মিলে গেল।
তবু ওর মনের ভেতর কোথাও ছোট্ট একটা অভিমান, যেটা মাথা নোয়াতে চাইছে না যুক্তির কাছে।

“তুমি কি ঠিক বলছো, আসলেই জাহাজে কেউ নেই?” নিশ্চিত হতে রুবেলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল ঊর্মি।

রুবেল মাথা নাড়ল,”আছে, তবে অল্প কয়েকজন। আমি একটু আগেই ইঞ্জিন রুমের কাছাকাছি গিয়েছিলাম, তখন মিশনের কথা শুনেছি। আজ সন্ধ্যার দিকে হেলিকপ্টারেও কিছু লোক পাঠানো হয়েছে, জরুরি কিছু পর্যবেক্ষণ কাজের জন্য।”

ঊর্মি একটুখানি নিঃশ্বাস ছাড়ে।
মনে হয় কথাটা বিশ্বাস করতে চাইছে ও।
নিজেকে বোঝাচ্ছে— হয়তো এই কারণেই… ক্যাপ্টেন আসেনি।

ওর দৃষ্টি চলে যায় দূরের সমুদ্ররেখার দিকে। দূরের সমুদ্ররেখা তখন অন্ধকারে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে ধীরে ধীরে।
অন্ধকার আরও গাঢ় হয়েছে, সাগরের গর্জন আরও তীব্র।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে, রুবেল শান্ত গলায় বলে,
“চলো, দেখার মতো অনেক কিছু বাকি আছে।”
ওর স্বরে কোনো তাড়া নেই, শুধু বন্ধুত্বের সহজ আহ্বান।

ঊর্মি এবার আর দ্বিধা করে না।
নিঃশব্দে পা মেলায় রুবেলের সাথে।

——-

রুবেল প্রথমে ওকে নিয়ে যায় জাহাজের পেছনের দিকে, হেলিপ্যাডের কাছে। সেখানে এখন কেউ নেই— শুধু শো শো বাতাস, আর জাহাজের নিচে ছুটে চলা সাগরের শব্দ।

“এই জায়গাটা জানো, দিনে যতটা রোদ ঢোকে, রাতে ঠিক ততটাই শীতল হয়।”
রুবেল রেলিংয়ে হাত রেখে নিচের দিকে তাকায়।
ঊর্মিও একপা এগিয়ে এসে দাঁড়ায় ওর পাশে, জাহাজের প্রান্ত থেকে তাকিয়ে থাকে অন্ধকার জলে।

“তুমি আজকাল খুব চুপচাপ হয়ে গেছো ঊর্মি…”
রুবেল বলে ফেলে হঠাৎ করে, কোনো ভূমিকা ছাড়াই।

ঊর্মি একমুহূর্ত চুপ থাকে। তারপর আস্তে বলে,
“এই ট্রিপটা সবকিছু ওলট-পালট করে দিয়েছে রুবেল… মানুষ, মুহূর্ত, আবেগ… সবকিছু যেন একসাথে মিশে যাচ্ছে। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না, সামলে উঠতে পারছি না।”

রুবেল ওর কথাটা শুনে হেসে ফেলল—
সত্যিকারের হাসি নয়, চাপা ঈর্ষা মেশানো হাসি।
“কি অদ্ভুত না, ঊর্মি? কারো সাথে দু’চারটে মুহূর্ত তোমার পুরো পৃথিবীটা ওলট-পালট করে দিতে পারে…”

ঊর্মি একটু চমকে তাকায়।
রুবেলের স্বরটা ঠান্ডা, ভেতরে কোথাও যেন কল্লোলের প্রতি একটা চাপা ক্ষোভ লুকিয়ে আছে মনে হলো। ঈর্ষার ছায়া পড়েছে প্রতিটা শব্দের শরীরে।

ঊর্মি অবাক হয়। বোঝে না, রুবেল কেন এমন করবে?

রুবেল চোখ ফেরায় না, রেলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলে যায়,”চল, আরেকটা জায়গা দেখাই তোমাকে। তারপর অন্য একটা দারুণ জায়গা দেখাব।”

ঊর্মি তাকিয়ে থাকে রুবেলের দিকে—
কোনো উদ্দেশ্য খুঁজে না পেয়ে একটুকরো দ্বিধা মেশানো অস্বস্তি নিয়েই আবারো হাঁটতে শুরু করে ওর সাথে।

করিডোরটা পেরিয়ে এবার ওরা পৌঁছালো কমিউনিকেশন টাওয়ারের নিচের খোলা ডেকে।
চারপাশে ছড়ানো অন্ধকার আলো-আঁধারি খেলছে জাহাজের নির্জনতায়।

ঊর্মি আকাশের দিকে তাকালো।
সমস্ত আলো থেকে দূরে সরে এসে এখানে আকাশটা আসল রূপে ধরা দিচ্ছে চোখে।
নিভন্ত তারা, এক-আধটা জ্বলে উঠছে,
তার নিচে— একটি সুনসান ডেক,
বাতাসে ঊর্মির বাঁধা চুলগুলো উড়ছে,
নিচে সাগরের গর্জন স্পষ্ট, কোনো চাপা কথোপকথনের মতোই একটানা।

রুবেল পাশেই দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু কথা বলছে না।
ওর চোখে তখনো একই রকম স্থিরতা—
নিঃশব্দে পর্যবেক্ষণ করছে ঊর্মিকে।

ঊর্মি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলে,
“এখান থেকে রাতের আকাশটা অনেক স্পষ্ট লাগে, তাই না?”

রুবেল ওর দিকে তাকিয়েই মাথা নাড়ল, শান্ত স্বরে বলল,
“হ্যাঁ। দিনের আলোতে যা দেখা যায় না, কখনো কখনো অন্ধকারে সেটা ধরা পড়ে— একদম চুপিসারে।”

ঊর্মি আকাশের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রুবেলের দিকে তাকালো। ধীরে কন্ঠে বলল,
“তুমি আজ অদ্ভুতভাবে কথা বলছো, রুবেল।”

রুবেল হেসে ফেলে— ঠান্ডা হাসি। কিন্তু বোকা ঊর্মির চোখে সেটা বেশ সাধারণই লাগে।

“আজ আমাদের শেষ রাত এখানে, ঊর্মি। চলো আজ রাতটাকে স্মরণীয় করে রাখি…”

ঊর্মি কিছু বলার আগেই রুবেল ইশারা করে,
“এই দিকটায় চলো। এইপাশে একটা পুরনো অবজারভেশন রুম আছে। এখন আর কেউ ব্যবহার করে না। ভীষণ চুপচাপ, আর জানালাটা ঠিক সাগরের দিকে খোলা… সন্ধ্যাবেলার সাগর দেখতে হলে ওটা বেস্ট স্পট।”

“এরকম পুরোনো ধরনের জায়গা আমার ভালো লাগে না, রুবেল। আমি যাবো না, তুমি যাও।” ঊর্মির পছন্দ হলো না ওর প্রস্তাবটা।

রুবেল থমকে দাঁড়ালো।
এক মুহূর্ত ওর মুখটা কেমন যেন শক্ত হয়ে গেল—
তবু গলার স্বরটা নরম রাখার চেষ্টা করে ও,
“তুমি তো এমন ছিলে না, ঊর্মি। সাহসী, কৌতূহলী… সব দেখার, জানার আগ্রহ ছিল তোমার। এখন একটু পুরনো ঘর শুনলেই ভয় পেয়ে যাচ্ছো?”

ঊর্মি চোখ সরিয়ে ফেলল, ঠোঁট একটু কেঁপে ওঠে ওর।
“ভয় না… অন্ধকার জায়গা… আমার ভালো লাগে না। তোমাকে তো বলেছিলাম বোধহয়, আমি ছোটবেলা থেকেই অন্ধকার ভয় পাই। তুমি আমার বন্ধু বলেই তো বলেছিলাম, ভুলে গেছো?”

রুবেল মাথা ঝাঁকালো, বিদ্রুপ মেশানো হাসিটা দীর্ঘ হলো এবার,”বন্ধুত্ব? হ্যাঁ… ভুলিনি। মনে আছে। তবে একটুখানি সময়, ঊর্মি। এখান থেকে আজকের শেষ রাতটা খুব সুন্দরভাবে উপভোগ করতে পারবে তুমি।”

ঊর্মি দ্বিধায় পড়লো। কী করবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।

রুবেল তখন এক পা এগিয়ে আসে ওর দিকে, খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে,
“ভয় পাওয়ার কিছু নেই, ঊর্মি। আমি আছি না? তোমার অনেক ভালো লাগবে জায়গাটা। দেখবে চলো…”

ঊর্মি এবার আর কিছু বলল না।
পা মিলিয়ে হাঁটতে শুরু করল রুবেলের পাশে পাশে,
অজানা নৈঃশব্দ্যকে অনুসরণ করে।

_____________________

ধীরে ধীরে করিডোর পেরিয়ে ওরা পৌঁছে গেল জাহাজের পেছনের দিকে, যেখানে পুরনো অবজারভেশন রুমটা নিঃশব্দে অপেক্ষা করছিল ওদের জন্য। দরজাটা অল্প খোলা আগে থেকেই; হয়তো কেউ নিশ্চিত ছিল ঊর্মি আসবে।

রুমের ভেতরটা বেশ বড়। দেখে মনে হচ্ছে খুব বেশিদিনের অব্যবহৃত নয়। দেয়ালের রঙটা অন্ধকারে অস্পষ্ট। ঘরটার একদিকে পুরো দেয়াজুড়ে কাচের জানালা, আর সেই জানালার ওপারে—
অসীম, গভীর, অন্ধকারে নিমজ্জিত সমুদ্র।

ঘরের এককোনায় রাখা দুটো ধূলোপড়া চেয়ার,
যার একটা একটু দুলছে খোলা জানালা দিয়ে আসা শো শো বাতাসে, মনে হচ্ছে কেউ যেন কিছুক্ষণ আগেই উঠেছে ওখান থেকে। তার একপাশে একটা ভাঙ্গাচোরা টেবিলও আছে।

ঊর্মি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে দরজার কাছে। ভেতরে ঢোকার সাহস পাচ্ছে না ও। রুমটা ভেতরটা ঠান্ডা, কেমন যেন একটা নিস্তব্ধতা জমে আছে বাতাসে। ও দরজার ওখানে দাঁড়িয়েই কাঁচের জানালাটার দিকে তাকিয়ে সাগরের অন্ধকাররেখা বোঝার চেষ্টা করে।
সেই বিশাল শূন্যতায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না—
শুধু একটানা ঢেউয়ের শব্দ, যেন কারও অশ্রুত কথার পুনরাবৃত্তি।

রুবেল ভেতরে ঢুকে পড়ে প্রথমে, তারপর পেছন ফিরে ঊর্মির দিকে তাকালো,”ভেতরে এসো, ঊর্মি। একবার এই জানালার সামনে দাঁড়ালেই তোমার ভয় কেটে যাবে।”

ঊর্মি নিঃশব্দে পা রাখলো ভেতরে।
চোখ ঘুরিয়ে দেখে নেয় চারপাশ।

রুবেল তখন একটা চেয়ারের দিকে ইশারা করে বললো,
“বসবে?”

ঊর্মি কোনো কথা না বলে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কাঁচের বাইরে রাতটা যেন থেমে গেছে।
চাঁদ নেই, অন্ধকার আকাশে দু-একটা তারা জ্বলছে মিটিমিটি। ধূসর অন্ধকারের বুক চিরে সাদা ফেনা তুলে এগিয়ে চলেছে বিশাল জাহাজটা।

ঊর্মি জানালার কাঁচে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
ওর হাতের তালু ঘেমে উঠেছে অজান্তেই।
হাঁসফাঁস করছে বুকের ভেতরটা।

ঊর্মি চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস নিলো।
“রুবেল… চলো ফিরে যাই।”

কোনো উত্তর আসে না।
ঊর্মি ধীরে পেছনে ঘুরে তাকায়।

রুবেল ওর দিকে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে। এক হাতে দরজার হাতল ধরে, অন্য হাতে একটা কিছু নাড়ছে— ঊর্মি অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছে না ঠিকঠাক।

ঊর্মির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল এক মুহূর্তে।
“তুমি কী করছো রুবেল?”

রুবেল ফিরে তাকায় না।

ঊর্মি কিছু বুঝে উঠতে পারছে না, ভয় ও সন্দেহ মিশে গলার স্বর কেঁপে ওঠে ওর,”রুবেল… দরজার সাথে তুমি কী করছো? প্লিজ বলো!”

এইবার রুবেল ধীরে ঘুরে দাঁড়ায়। ওর মুখটা অন্ধকারে পুরো স্পষ্ট নয়, তবু চোখদুটো জ্বলছে অন্ধকারেও…
সেই চোখে বন্ধুত্বের দৃষ্টি নেই।

কেমন হিম হয়ে যাওয়া গলায় ও বলে,
“তুই না বলেছিলি, অন্ধকারে থাকতে পারিস না? তাই ভাবলাম, আজকে একটু অন্ধকারে থাকার অভ্যাস কর…” তারপর ঠান্ডা গলায় হেসে ওঠে— ভেতরে জমে থাকা তীক্ষ্ণ বিদ্রুপ যেন ছিটকে পড়ে সে হাসিতে। হাসতে হাসতে আচমকা একটানে সশব্দে বন্ধ করে ফেলে দরজাটা।

ঠাস!

দরজাটা বন্ধ হয়ে গেছে। ঊর্মি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে বন্ধ দরজাটার দিকে। ওর মস্তিষ্কে ব্যাপারটা প্রসেস করতে সময় লাগছে— ঠিক কী ঘটেছে এই মুহূর্তে!

To be continued…

#জলতরঙ্গের_সুর
পর্ব – ২০
লেখা – আসফিয়া রহমান
অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ❌

ঠাস!

দরজাটা বন্ধ হয়ে গেছে। ঊর্মি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে বন্ধ দরজাটার দিকে। ওর মস্তিষ্কে ব্যাপারটা প্রসেস করতে সময় লাগছে— ঠিক কী ঘটেছে এই মুহূর্তে!

রুবেল!
ওদের বন্ধু রুবেল!
সে এরকম একটা কাজ করেছে?

ঊর্মি একছুটে গেল দরজার দিকে,
“রুবেল! দরজাটা খোলো! আমি ভয় পাচ্ছি রুবেল! রুবেল…”

কোনো সাড়া আসে না দরজার ওপাশ থেকে।
ঊর্মির গলা শুকিয়ে গেল। ও দরজায় ধাক্কা দিল একবার, দুইবার— আবারও।

“রুবেল! রুবেল! এটা কোনো খেলা না! আমি বলেছিলাম না তোমায়— আমি অন্ধকারে থাকতে পারি না…”
অনবরত দরজায় ধাক্কা দেয় ও, কিন্তু কিছুই হয় না।লোহার শরীর নড়ে না এতটুকু।

“তুমি… তুমি এমন করতে পারো না, রুবেল! আমরা বন্ধু ছিলাম! আমি তোমাকে বিশ্বাস করতাম…”

ঊর্মির চোখ ছলছলিয়ে উঠলো।
বুকের ভেতরটা যেন চেপে ধরছে কেউ—
অন্ধকার সমুদ্রের মধ্যে নিজেকে হঠাৎ করে খুব ক্ষুদ্র, একা, আর অসহায় মনে হলো ওর।

ঊর্মি বসে পড়লো দরজা ঘেঁষে। অন্ধকারের ঘনত্ব যেন বেড়ে গেছে মুহূর্তে। জানালার বাইরে তীব্র শব্দে ফুঁসছে রাতের সমুদ্র। চাপা একটা ঠান্ডা বাষ্প উঠছে কাঁচের জানালা বেয়ে।

ঊর্মির গা কাঁপতে শুরু করলো।
শো শো বাতাসে টলতে থাকা চেয়ারটার খটাস খটাস শব্দে চমকে উঠলো ও। চোখে যেন অন্ধকার নেমে আসছে, শরীরটা হালকা লাগছে হঠাৎ করে।
ওর নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে উঠছে।

খুব দ্রুত।
একটা একটা করে গলা দিয়ে নিঃশ্বাস ওঠা-নামা করছে যেন ঢেউয়ের মতোই— অথচ স্বস্তি আসছে না একটুও।

“না… না না না…”
ঊর্মি কাঁপা গলায় ফিসফিস করলো,
“আমি এখানে আটকে গেছি… কেউ নেই… কেউ নেই…”

দরজার গায়ে ঠেস দিয়ে ওর হাত দুটো জড়িয়ে ধরল নিজের কাঁধ। শরীর ঝিম ধরে এসেছে, ঠান্ডা ঘামে ভিজে গেছে তালু। নাকের ডগা ঠান্ডা, ঠোঁট ফ্যাকাশে।
ঝিমঝিম করছে মাথাটা।

ঊর্মির বুকের ভেতরে একটা কাটা দাগ যেন চওড়া হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ।

শ্বাস নিতে পারছে না ও।
প্রাণপণ চেষ্টা করেও বুকের ভেতর অক্সিজেন ঢুকছে না একফোঁটাও। চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসছে সব রেখা, সবকিছু কেমন দুলছে, কেমন যেন ভাসমান লাগছে শরীরটাও।

“… আমি…” ওর ঠোঁট ফাঁক হয়ে থাকে। শব্দ বেরোয় না।

গলাটা যেন চেপে ধরা হচ্ছে ভেতর থেকে!
পেটের ভেতর তীব্র মোচড়, বুকের মাঝখানে একটা চাপা ব্যথা।

হৃৎস্পন্দন দ্রুত হচ্ছে। ভীষণ দ্রুত।
প্রতিটা মুহূর্তে মনে হচ্ছে বুকটা ফেটে যাবে,
বা থেমে যাবে একেবারে।

ঊর্মি আস্তে আস্তে হেলে পড়লো দরজায়।
গালটা ঠেকে গেল ধাতব অংশে— ঠান্ডা লোহায় ঠেকতেই আরেকটা কাঁপুনি উঠলো সারা শরীরে।

“আমি…”
হাতদুটো বুকের উপর চাপ দিয়ে ধরল, কিন্তু কিছুতেই আটকে রাখতে পারছে না সেই অদৃশ্য আতঙ্ক।

চোখ দুটো আবার ছলছল করে উঠলো ওর—
তবে এবার কান্না নয়, নিঃশ্বাসের সঙ্গে মিশে থাকা হাহাকারে।

অবচেতনভাবে কুঁকড়ে আসছে শরীর।
তখন— একটা দমকা বাতাস ঢোকে জানালার ফাঁক দিয়ে। কেমন হিম! কেমন শীতল!

ঊর্মির গা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে আবার পড়ে যায়। একটা হাত ছুঁয়ে যায় ঠান্ডা মেঝে। পালস ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকে আচমকা।

একটানা গুমরে ওঠে একটা ফিসফিসানি কণ্ঠ—
“ক-ক্যা-ক্যাপ্টেন… আ-মি…”

আর তারপর—
একটি তীব্র শ্বাসের পর,
সব থেমে যায়।

ঊর্মির প্রায় নিস্তেজ শরীরটা নিঃশব্দে সংজ্ঞা হারিয়ে পড়ে যায় দরজার পাশের মেঝেতে। একটা নিস্তব্ধ অন্ধকার নেমে আসে কক্ষের ভেতর।

শুধু জানালার বাইরে ফুঁসতে থাকে রাতের সমুদ্র।
আর বাতাসে দুলতে থাকে সেই একাকী চেয়ারটা—

“খট… খট… খট…”

_____________________π____________________

কল্লোল যখন জাহাজে ফিরে এলো তখন বেশ রাত। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এসে নিজের বরাদ্ধকৃত কেবিনে ঢুকলো ও। চারপাশটা কেমন চুপচাপ— ডেকে থাকা নাবিকদেরও আওয়াজ নেই। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে বোধহয়।

বুটজোড়া খুলে ঘরের এক কোনায় ঠেলে দিয়ে বাথরুমে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়ালো ও। পানি ছিটালো চোখে মুখে। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল।
আজকের মিশনটা ছোট হলেও ক্লান্তিকর ছিল।

ওয়াশরুম থেকে বেরোতেই ঊর্মির কথা মনে পড়লো ওর। ওরা কালকে চলে যাবে, অথচ শেষ দিন কল্লোল ওকে সময় দিতে পারল না। সকালেও মেয়েটার মন খারাপ ছিল। এরপর আর সারাদিন দেখা হলো না ওর সাথে।

আজকের মিশনটা হঠাৎ করেই চলে এলো যে, ওর কিছুই করার ছিল না। তার ওপর মিশনে বেরোবার আগেও বলে যেতে পারেনি মেয়েটাকে।

তোয়ালেটা গলায় ঝুলিয়ে জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢোকার সময় ওর চোখ গেল ঘড়ির কাঁটার দিকে।

রাত প্রায় একটা।

এক মুহূর্ত থেমে গেল ও।
ঊর্মির কথা আবারও ঘুরেফিরে আসছে মনে। দেখতে ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে।

মনে পড়ে গেল সকালবেলা ডেকে ঊর্মির মুখটা— চোখেমুখ ভার।
সেই ভার কি এখনো কাটেনি?

কল্লোলের আবার মনে হলো, মেয়েটাকে একনজর দেখতেই হবে ওর। নাহলে ও নিজে শান্তি পাচ্ছে না।

কিন্তু ও ঘুমিয়ে গেছে নিশ্চয়ই…
এই যুক্তিটা দিয়ে নিজেকে বোঝাতে চাইল,
কিন্তু মন তৎক্ষণাৎ বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসলো—
ঘুমন্ত মুখটা হলেও দেখা চাই!

—–

ঘড়ির কাঁটা একটার ঘরে দাঁড়িয়ে।

কল্লোল তোয়ালেটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে ইউনিফর্ম না পাল্টেই বেরিয়ে পড়ল দরজা খুলে।

প্যাসেজটা একদম ফাঁকা।
লাইটগুলো ঝিমঝিম করছে পুরো করিডোরজুড়ে।

ও দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে যায় গেস্ট কেবিনের দিকে।
ঊর্মির কেবিনের দরজার সামনে এসে থামে।

দরজা বন্ধ।

কিছুক্ষণ কান পেতে দাঁড়িয়ে থাকে কল্লোল।
ভেতর থেকে কোনো শব্দ আসে না।

আচ্ছা… মেয়েটা কি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছে?

দরজার গায়ে টোকা দেয়ার জন্য হাত উঠিয়েও হাতটা নামিয়ে নেয় ও। দরজার নবটা আলতো করে ঘোরাতেই খুলে গেল দরজাটা।

একি!
দরজা খোলা কেন?
ঊর্মি কি দরজা খোলা রেখেই ঘুমিয়েছে?

ঘরের ভিতর ঘুটঘুটে অন্ধকার। কল্লোল সুইচবোর্ড হাতড়ে আলো জ্বালালো।

আলোকপাত হতেই যা দেখা গেল, তাতে কল্লোলের হৃদস্পন্দন থমকে গেল সেই মুহূর্তেই।

ঘরটা একেবারে ফাঁকা।
ঊর্মি নেই।

ঘরের সবকিছু গোছানো।
মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে ঊর্মি ঘরেই আসেনি।
কল্লোল কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে নিঃশব্দে।

মেয়েটা কোথায় গেল?
রাত একটা বাজে।
এই সময় ও কোথায় যেতে পারে?

নিশাত, মেহেরিনদের সাথে নেই তো?
কল্লোল কি ওদের কেবিনে একবার খোঁজ করবে?

একটা অস্বস্তি জেঁকে বসলো শরীরে। নাহ্, এত রাতে ওখানে যাওয়াটা ঠিক হবে না। তার চেয়ে বরং ঊর্মিকে কল করা যাক।

কল্লোল পকেট থেকে ফোনটা বের করল। নেটওয়ার্ক টুকটাক থাকলেও ভরসা করার মতো কিছু না।

কন্টাক্ট লিস্টে ঢুকতেই আচমকা ধাক্কা খেল ও—
ঊর্মির নম্বরটাই তো নেই ওর ফোনে!
কখনো চাওয়া হয়নি, আর মেয়েটাও কখনো নিজে থেকে দেয়নি।

উফ্! এখন কী হবে?
কিন্তু ওকে না দেখে তো কল্লোল শান্ত হতে পারছে না। ওকে দেখার তৃষ্ণাটা বাড়ছে ক্রমশ।

ঘরের বাইরে পা রেখে ও সিদ্ধান্ত নিল নিশাতদের রুমে যাবে। একটু আগে যে চিন্তাটা ওকে অস্বস্তিতে ফেলেছিল; সেটাই এখন যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে।

কল্লোল ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটা দিল নিশাতদের কেবিনের দিকে। দরজার সামনে পৌঁছে একবার দম নিলো গভীরভাবে। তারপর দরজায় টোকা দিল পরপর দু’বার। টোকা দিয়ে খুব হালকা গলায় ডাকলো,

“নিশাত? নিশাত, একটু দরজাটা খুলুন তো…”

কিছুক্ষণ কোন শব্দ হলো না।
তারপর দরজার ওপাশ থেকে একটা গলা ভেসে এলো,
“কে?” একটা ঘুমজড়ানো কন্ঠ।

“আমি… ক্যাপ্টেন কল্লোল। একটু দরকার ছিল।”

ভেতর থেকে ছিটকিনি খোলার শব্দ হলো।
দরজাটা আধা খোলা হতেই নিশাত চমকে উঠল,
“আপনি এই সময়? কিছু হয়েছে নাকি ক্যাপ্টেন?”

কল্লোল নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল,
“ঊর্মি কি আপনাদের সাথে শুয়েছে?”

নিশাত ভ্রু কুঁচকে তাকালো, “না তো!”

নিশাতের উত্তর শুনে কল্লোলের চোখের দৃষ্টিটা স্থির হয়ে গেল— ভেতরে ভেতরে একটা ধাক্কা খেল ও।

“না তো!”
এই দুটো শব্দ যেন বুকের ভেতর কাঁপন ধরিয়ে দিল মুহূর্তেই।

কল্লোল কণ্ঠ নামিয়ে আবারও জিজ্ঞেস করল,
“আপনারা কখন ওকে শেষ দেখেছেন?”

মেহেরিনও ততক্ষণে ঘুম জড়ানো চোখে এসে দাঁড়িয়েছে দরজার কাছে,”কখন দেখেছি মানে? ঊর্মি ওর কেবিনে নেই?”

কল্লোল কিছু না বলে দুপাশে মাথা নাড়লো।

এক মুহূর্তের মধ্যে ওদের দুজনের ঘুম এক লাফে উবে গেল। তানিয়াও ততক্ষণে উঠে এসেছে ওদের পাশে,
“নেই মানে… এতরাতে কোথায় যাবে? ও তো দুপুর থেকে একদম চুপচাপ ছিল আজকে। সন্ধ্যাবেলায় আমাদের সাথে আড্ডা দিতেও আসেনি…”

কল্লোলের মাথায় যেন বাজ পড়লো।
সন্ধ্যা থেকে নেই?
ঊর্মি কারো সাথে নেই?

মাথাটা বনবন করে ঘুরে উঠলো। আচমকা চাপ অনুভূত হলো বুকের বাঁ-পাশটায়। কি করবে, কোথায় খুঁজবে মাথা কাজ করলো না ওর।

———-

কল্লোলের চোখমুখ শক্ত। নিশাতদের কাছ থেকে ফিরে এসে কিছু বুঝে উঠতে না পেরে দাঁড়িয়ে থাকল এক মুহূর্ত। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে সোজা প্যাসেজ ধরে হাঁটতে শুরু করল— পদক্ষেপগুলো দ্রুত, অস্থির।

প্রথমেই ও গেল জাহাজের নিরাপত্তা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত জুনিয়র অফিসারের কেবিনে।

ঠক ঠক ঠক!
কড়া শব্দে দরজায় টোকা দিলেন কল্লোল।

ভেতর থেকে গলাটা ভেসে এলো, “কে?”

কল্লোলের কণ্ঠে কোনো আবেগ নেই তখন,
“ক্যাপ্টেন কল্লোল। দরজা খোলো, ইমিডিয়েটলি।”

দরজা খুলতেই ঘুমচোখে উদ্ভ্রান্ত হয়ে তাকায় ছেলেটা।
কল্লোল ঠান্ডা কন্ঠে এক নাগাড়ে বলে গেলেন,
“একজন সিভিলিয়ান— মিস আরওয়া মাহজাবীন, সন্ধ্যার পর থেকে নিখোঁজ। স্টার্ন থেকে ফোরক্যাসল পর্যন্ত পুরো জাহাজ খুঁজে দেখবে। একঘন্টার মধ্যে রিপোর্ট চাই। ডেকের প্রতিটি করিডোরে লোক পাঠাও। স্পেশালি ইঞ্জিন রুম আর সার্ভিস এলাকা।”

অফিসার ছেলেটা এক মুহূর্ত থেমে গেল। মনে হয়, কিছু বলতে চাইছে… হয়তো ‘সার্চ ওয়ারেন্ট’ বা অনুমতির কথা মাথায় এসেছে। কিন্তু ক্যাপ্টেনের ঝলসে ওঠা চোখ দেখে কথা আটকে গেল তার। সে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, “জ্বি, স্যার।”

——–

কল্লোলের নির্দেশ পাওয়ার পরেই নিরাপত্তা অফিসারের কমান্ডে জাহাজের বিভিন্ন বিভাগে ছড়িয়ে পড়ে টিমগুলো।

স্টার্ন থেকে শুরু করে ফোরক্যাসল পর্যন্ত, প্রতিটি করিডোরে ঘুরছে সাদা পোশাকধারী ক্রু। মাঝরাতে আচমকাই সরগরম হয়ে উঠেছে পুরো জাহাজ।

কল্লোল দাঁড়িয়ে আছে করিডোরের মাঝখানে।
প্রচন্ড উদ্বেগ আর অস্থিরতায় অসহায় বোধ হচ্ছে ওর। ঊর্মি কোথায়?
এই বিশাল জাহাজের কোথায় হারিয়ে যাবে মেয়েটা?
পুরো জাহাজ ওলট-পালট করে ফেলার পরও ওকে পাওয়া যাচ্ছে না কেন?
এত সিকিউরিটি সিস্টেম থাকার পরেও একটা জলজ্যান্ত মানুষ উধাও হয়ে যায় কিভাবে?

অসহায় বোধটা রাগে পরিণত হতে সময় নিল না। এতক্ষণ ধরে কপাল চেপে রাখা হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ হলো এবার। কিন্তু সেই রাগ ঠিক কাকে উদ্দেশ্য করে— নিজেকে, না পরিস্থিতিকে… বুঝে উঠতে পারল না ও।

কল্লোল একবার চোখ বন্ধ করে গভীর নিঃশ্বাস নিল। বুকের মধ্যে ভারী পাথরের মতো চেপে আছে দুঃশ্চিন্তাটা।

সকালবেলার দৃশ্য ঝাপসা হয়ে উঠলো ওর চোখে—
ওদের ঘনিষ্ঠ হওয়ার দৃশ্যটা।

ঊর্মির এলোমেলো নিঃশ্বাস, গালের রক্তিম উষ্ণতা,
আর—

কল্লোল চোখ খুলে তাকালেন করিডোরের অস্পষ্ট আলোয়। নিরাপত্তা অফিসার এসে দাঁড়িয়েছে ওর সামনে।

“ক্যাপ্টেন, আমরা সিসিটিভি ফুটেজ চেক করছি। সন্ধ্যার পর থেকে ঊর্মির গতিবিধি সনাক্ত করা যাচ্ছে। প্লিজ আসুন!”

কল্লোল অস্থির ভঙ্গিতে অফিসারের সাথে এগিয়ে গেলেন সিকিউরিটি মডিউল রুমের‌ দিকে,
“দ্রুত দেখাও আমাকে, কোন করিডোরে, কখন,
কোথায় গেছে ও।”

To be continued…