#জলতরঙ্গের_সুর
পর্ব – ২১
লেখা – আসফিয়া রহমান
অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ❌
সিকিউরিটি রুমের কড়া আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যায় কিছুক্ষণের জন্য। মাল্টি-স্ক্রিন মনিটরে ফুটেজ চলছে—
ডেট, টাইমস্ট্যাম্প, লোকেশন— সব ভেসে উঠেছে একসাথে।
ক্যাপ্টেন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন স্ক্রিনের দিকে।
১৯:৩২:১৯ | ডেক ৪
স্ক্রিনে দৃশ্যমান হলো ঊর্মির অবয়ব।
ঊর্মি শান্ত ভঙ্গিতে পায়চারি করছে ডেকের ওপরে।
এমাথা থেকে ওমাথা। একবার—দুবার—তিনবার—
ডেকের রেলিং ছুঁয়ে আবার ঘুরে আসছে ও।
এমন ভাবে পায়চারি করছে, দেখে মনে হচ্ছে কারো জন্য অপেক্ষা করছিল। ওর অপেক্ষমান অবয়বটা যেন গেঁথে বসলো কল্লোলের বুকে।
১৯:৩৪:৪০ | ডেক ৪
স্ক্রিনের বাঁ পাশে হঠাৎ করে উদয় হলো আরেকটা অবয়ব। সে এগিয়ে এসে থামলো ঊর্মির ঠিক সামনে।
রুবেল।
ওর মুখটা ক্যামেরার উল্টোদিকে হলেও ওর হাঁটার ভঙ্গি কল্লোল এক মুহূর্তেই চিনে ফেললেন।
সাথে সাথে রক্ত যেন মাথায় উঠে গেল তার।
“স্টপ করো এখানে!”
কঠিন গলায় আদেশ ছুঁড়লেন কল্লোল।
অফিসার ক্লিক করে দৃশ্যটা পজ করল। একবার তাকালো ক্যাপ্টেনের মুখের দিকে।
কল্লোলের মুখ পাথরের মতো—
চোয়াল শক্ত, নাকের পাটা ফুলে উঠছে প্রতিবার নিঃশ্বাসে।
“রিউইন্ড করো।
ধীরে চালাও। পুরোটা।”
ফুটেজ চলতে শুরু করলো আবার।
রুবেল এসে দাঁড়িয়েছে ঊর্মির সামনে।
কিছু বলছে, ঊর্মির মুখ দেখে মনে হয় ও ব্যাখ্যা দিচ্ছে কিছুর। সেই মুখ, সেই চোখ— এতক্ষণ যে চোখে অপেক্ষার ছাপ ছিল, সেখানে এখন হতাশা জমছে ধীরে ধীরে।
কল্লোল অনুভব করলো বুকের ভেতরটা ধকধক করে উঠছে। একটু পরে ঊর্মি কিছু একটা বলতেই রুবেলের ঠোঁটে হাসি দেখা গেল।
তবে সেটাকে “সাধারণ” বলা যায় না।
ক্যামেরার কনট্রাস্টে স্পষ্ট হয়ে উঠল ঠোঁট টেনে রাখা ঠান্ডা অভিব্যক্তিটা।
ঊর্মি একটুখানি দাঁড়িয়ে থেকে তারপর ওর সাথে হাঁটতে শুরু করল। মুষ্টিবদ্ধ হলো ক্যাপ্টেনের বলিষ্ঠ হাতজোড়া।
১৯:৪৮ – হেলিপ্যাড।
১৯:৫৯ – টাওয়ারের নিচের খোলা ডেক।
২০:১৮ – করিডোর ৫বি।
২০:২২ – অবজারভেশন রুম।
কল্লোল থেমে গেলেন।
ঘাড়ের রগ ফুলে উঠেছে তার।
চোখের পলক পড়ছে না একবারের জন্যেও।
মনিটরে দেখা গেল ঊর্মি দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে।
রুবেল ভেতরে ঢুকেছে আগে। কিছু বলছে।
ঊর্মি একটু দোনোমনা করে…
তারপর নিঃশব্দে পা রাখে রুমের ভেতর।
কিছুক্ষণ পরে রুবেলকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল।
একা। সঙ্গে ঊর্মি নেই। কল্লোলের চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো এবার।
রুবেল দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে।
দুই সেকেন্ড।
তিন…
ঠাস!
দরজা সজোরে বন্ধ হয়ে গেল।
ফুটেজ থেমে গেছে।
কল্লোলের মুষ্টিবদ্ধ হাত সশব্দে প্রবলবেগে আঘাত করল টেবিলের কাঁচে।
“Fucking bastard!” ঠোঁটের কোণায় থরথর করে কেঁপে উঠলো শব্দটা।
মনিটর কেঁপে উঠল মুহূর্তেই। ফাটল ধরল স্বচ্ছ কাঁচে। পাশের অফিসার ভয়াবহ চমকে পিছিয়ে গেলেন দুকদম।
পিনপতন নীরবতা নেমে এলো পুরো কক্ষজুড়ে।
কেউ নড়ল না। যেন নিঃশ্বাস ফেলারও সাহস করল না কেউ। কথা বলা তো অনেক দূরের ব্যাপার। ক্যাপ্টেনকে এতবছরে এতটা রাগতে দেখেনি ওরা কোনদিন।
এ রাগ কি শুধুই দায়িত্বের দায়বদ্ধতা, নাকি ব্যক্তিগত আক্রোশ?
নিঃশব্দ ঘরে কল্লোন গর্জে উঠলেন আবার,
“Next footage?”
অফিসার নিচু গলায় বলল, “এরপর ক্যামেরা ডিসকানেক্টেড, ক্যাপ্টেন… ঐ ঘরটা পুরনো, ইন্টারনাল ফিড সবসময় কাজ করে না…”
কল্লোল কিছু শুনলেন কিনা বোঝা গেল না।
তার কানে শুধু প্রতিধ্বনিত হচ্ছে একটাই শব্দ—
ঠাস! ঠাস! ঠাস!
“এত সিকিউরিটি থাকা সত্ত্বেও ওই বাস্টার্ডটা এত সাহস পেল কি করে? Answer me.” কঠিন গলায় ধমকে উঠলেন কল্লোল।
তারপর আচমকাই নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠলো ওর।
ঊর্মি এখন ওখানে… একা…
চার ঘন্টারও বেশি সময় ধরে…
একটা অন্ধকার রুমে।
ও জানে—
ঊর্মি অন্ধকার ভয় পায়।
ভয় পেলে নিঃশ্বাস আটকে আসে ওর।
সেবার সামিরের বিয়েতে ভয় পেয়ে কিভাবে প্রবলবেগে আছড়ে পড়েছিল ওর বুকের উপর।
কল্লোলের শরীর জমে গেল মুহূর্তেই।
“ওখানে লোক পাঠাও। দরজা খোলার ব্যবস্থা করো। I’m coming. We are already too late. Hurry up.
কল্লোল কঠিন গলায় আদেশ ছুঁড়লেন অফিসারের উদ্দেশ্যে।
__________________________
অনেকগুলো বুটের শব্দ একসাথে ধ্বনিত হচ্ছে পুরো করিডোর জুড়ে। অবজারভেশন রুমের সামনে এসে থেমে গেল সবগুলো পা।
“Open the door. Quick!”
কন্ঠের অস্থিরতা লুকাতে পারলেন না কল্লোল।
ইলেকট্রিক্যাল টেকনিশিয়ান তৎক্ষণাৎ মাস্টার কী ঢুকিয়েছে দরজার ইলেকট্রনিক লক-স্লটের ভিতর।
টিক…টিক…টিক… সিস্টেম স্ক্যান করছে, কিন্তু বারবার লাল আলো জ্বলে উঠছে স্ক্রিনে।
“স্যার, লকড ইন— হ্যাঁকিং লাগবে বা ভেঙে ফেলতে হবে।”
“Break it.”
ক্রমশ অধৈর্য হয়ে ওঠা কল্লোলের গলা দিয়ে বেরোলো চাপা হুংকার।
আজ্ঞাবহ সেনার মতো একজন দমকাল কর্মী সামনে এগিয়ে এলো হাইড্রোলিক ব্রীচিং টুল নিয়ে।
কল্লোল নিজে দু’পা পিছিয়ে দাঁড়ালেন দরজার মুখ থেকে, চোখ সরালেন না এক সেকেন্ডের জন্যও।
ধাতব যন্ত্র ঢুকলো দরজার পাশে,
দাঁতের মতো যন্ত্র খাঁজে খাঁজে কেটে নিচ্ছে লোহার শরীর।
দরজার ওপাশ থেকে তখনো কোনো সাড়া নেই—
আর ঠিক তখনই কল্লোলের মনে হলো—
আরও এক সেকেন্ড দেরি হলে হয়তো…
“আরও জোরে, Faster!”
কল্লোল খারাপ চিন্তাগুলোকে মাথা থেকে সরাতে পারছেন না কিছুতেই।
কল্লোলের অস্থির চিত্ত, কঠিন গলার ধমক আর আতঙ্ক—সব মিলিয়ে একটা যুদ্ধাবস্থার মতো মুহূর্ত।
“ঠাস!”
শেষমেশ দরজাটা কেঁপে উঠে খুলে গেল এক বিকট শব্দে। ভেতর থেকে একটা গুমোট হাওয়া বেরিয়ে এলো—
একটা নিঃশব্দ কান্না যেন গলাধাক্কা দিয়ে পালাতে চাইল সেই বাতাসের সাথে।
কল্লোল উম্মাদের মত ছুটলো ঘরের ভেতরে।
“ঊর্মি! Are you there? তুমি আছো এখানে? ঊর্মি?”
কয়েকটা টর্চের আলো একসাথে ছুটলো ঘরের গাঢ় অন্ধকারে। চেয়ার, দেয়াল, জানালার ছায়া পেরিয়ে এসে আলো থেমে গেল দরজার পাশের মেঝেতে।
একজন চিৎকার করে উঠলো, “স্যার— ওখানে!”
সব আলো মুহূর্তে একত্রিত হলো সেই স্থানে।
দরজার একদম গা ঘেঁষে পড়ে আছে ঊর্মির নিঃসাড় শরীর।
কল্লোল যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়লো স্থির। এক পাও সামনে এগোলো না।
পিছে থেকে আবারো একটা উদ্বিগ্ন গলা শোনা গেল,
“Captain, she is senseless!”
কল্লোল শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ঊর্মির দিকে। পেছন থেকে আসা গলাটা শুনে সম্বিত ফিরল ওর।
ততক্ষণাৎ ছুটে গেল সেই আলোর কেন্দ্রে।
দরজার গায়ে হেলে থাকা শরীরটা অবহেলায় পড়ে আছে মেঝেতে। চোখ দুটো বোঁজা, ঠোঁট ফ্যাকাশে হয়ে আসছে, শরীরটা পুরোপুরি নিস্তেজ।
কল্লোল হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল ওর পাশে। মাথার নিচে হাত রেখে ওর মাথাটা উঁচু করে রাখল হাতের উপর।
“ঊর্মি! ঊর্মি— না না না… আমার দিকে তাকাও, শুনতে পাচ্ছো? ঊর্মি!”
হাত ছুঁতেই বোঝা গেল—
শরীরটা বরফ ঠান্ডা হয়ে আছে।
“Pulse… check the pulse!”
কল্লোলের কণ্ঠ আতঙ্কে থরথর করছে, তবুও নির্দেশ ছুঁড়লেন স্পষ্টভাবে।
পেছন থেকে একজন মেডিকেল অফিসার ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলেন, দ্রুত হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন ঊর্মির পাশে। আঙুল রাখলেন কবজিতে— তারপর মুখ তুললেন, গলা নিচু হলেও তীব্র শঙ্কা লুকোনো নেই তাতে,
“Pulse আছে… তবে খুব দুর্বল। রেসপিরেশন স্লো…”
তারপর চোখ চলে গেল কপালের দিকে, গলার স্বর মুহূর্তেই বদলে গেল তার,
“ক্যাপ্টেন… কপালটা ফেটেছে… রক্ত পড়ছে। সম্ভবত একটু আগে দরজা ভাঙার সময় ধাক্কা লেগেছে!”
কল্লোল এক মুহূর্তের জন্য নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেল।
আলতো করে ওর কপালের চুল সরালো, যেন ওর অস্থির স্পর্শে ব্যথা পাবে প্রেয়সীর সংজ্ঞাহীন শরীর।
কপালের বাম পাশের চামড়া ছড়ে গেছে, গভীর কাটা দাগ। সেখান থেকে গাঢ় লাল রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে গালের কিনার বেয়ে।
এক ফোঁটা, দু’ফোঁটা, তিন…
অন্ধকার ঘরে টর্চের আলোয় রক্তের সেই চিকচিকে রেখা যেন ছুরির মতো কেটেকুটে ফেলল কল্লোলের ভেতরটা।
“ঊর্মি…” ওর গলা ভাঙল। ও চোখ বন্ধ করে একটা মুহূর্তের জন্য মাথা নিচু করল—
অস্থিরতায়, অপরাধবোধে, আতঙ্কে…
অফিসারের হাত তখনো ঊর্মির কবজিতে,
“Pulse আছে, but shallow… ওকে দ্রুত বের করতে হবে ক্যাপ্টেন। সময় নেই।”
কল্লোল চোখ মেললেন। গিলে ফেললেন উথলে আসা অনুভূতিটুকু। তারপর দূরে দাঁড়ানো জুনিয়রদের দিয়ে তাকিয়ে অস্থির কন্ঠে আদেশ ছুঁড়লেন,
“Stretcher! Bring the stretcher, Immediately! She’s bleeding!”
নিস্তেজ ঊর্মির শরীরটা বুকে চেপে ধরল কল্লোল। মূহুর্তেই তাজা রক্তে মাখামাখি হলো সাদা ইউনিফর্মটা।
“আমি ছিলাম না… আমি থাকতে পারি নি ওই মুহূর্তে…”
অনুচ্চারিত অপরাধবোধটা যেন গিলে খেতে চাইলো ওকে।
বুকে টেনে নেয়া ঊর্মির নিস্তেজ শরীরটা
যেন নিঃশব্দে বলছিল— “তুমি দেরি করেছো ক্যাপ্টেন…”
একজন জুনিয়র ছুটে গিয়েছিল স্ট্রেচারের খোঁজে। কিন্তু এক মিনিট… দুই মিনিট… সময় যেন অনন্তকাল ধরে বয়ে যাচ্ছে।
কল্লোল আবার গর্জে উঠলেন,
“Where is the stretcher?! Bring it NOW!”
কেউ পেছন থেকে তাড়াহুড়ো করে জবাব দিল,
“স্যার, স্টোরেজ রুম লকড ছিল— তালা খুলতে হচ্ছে… Give us five minutes!”
“Five minutes?”
কল্লোলের কন্ঠে রাগ আর অসহায়ত্ব ছলকে উঠলো একসঙ্গে।
মেডিকেল অফিসার তাড়া দিলেন,
“ব্লিডিং বেড়ে যাচ্ছে ক্যাপ্টেন… হয় এখানেই ফার্স্ট এইড… না হলে আর দেরি হলে মেডিকেল ইউনিট পর্যন্ত শরীরে শক সইবে না।”
কল্লোল আর কিছু না ভেবে মুহূর্তে ঊর্মিকে পাঁজাকোলে তুলে উঠে দাঁড়ালো। পাতলা শরীরটা ওর দুবাহুর মধ্যে মিশে গেছে যেন। মাথাটা হেলে পড়েছে বুকের ওপর। একফোঁটা রক্ত টপ করে পড়ল কল্লোলের বুকের কাছটায়— কোনো উষ্ণতা নেই, ঠান্ডা, ঘন লাল। ইউনিফর্মটা আরও একবার লালচে হয়ে উঠলো।
“Move! Everyone out of the way!”
চিৎকার করে উঠলো কল্লোল।
ছিটকে সরে গেল সবাই।
কল্লোল দ্রুত পা চালাতে চালাতে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ওর বুকে নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকা প্রেয়সীর মুখটার দিকে।
“Stay with me, my little bird… আরেকটু… শুধু আরেকটু,” ওর ঠোঁটের কোণায় ফিসফিসে স্বর।
ঊর্মির বাঁ গালের উপরের চুলগুলো এলোমেলো হয়ে লেপ্টে আছে লাল রক্তে। ঠোঁটের কিনারায় রক্তের ধারা জমাট বেঁধেছে, চোখের পাতাগুলো ডুবে আছে নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে।
হঠাৎ করে মৃদু একটা শব্দ হলো ওর বুকের কাছে—
অস্ফুট কিছু, যেন নিঃশ্বাসের ভেতরে আটকে থাকা কোনো হাহাকার।
কল্লোল হকচকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো,
“ঊর্মি? তুমি কিছু বললে? ঊর্মি??”
কোনো জবাব নেই।
ঠিক তখনই করিডোরের মাথায় দৌড়ে এল কয়েকজন, “Stretcher is here, sir!”
ধাতব শব্দ তুলে সাদা স্ট্রেচার ছুটে এলো করিডোর ধরে। তার সাথে এসেছে তানিয়া, নিশাত, মেহেরিন। ঊর্মির অবস্থা দেখে হতভম্ব হলো ওরা।
কল্লোল থামল না।
স্ট্রেচার কাছে চলে এলেও নিজের বাহু থেকে ঊর্মিকে ছাড়তে পারছিল না ও।
একজন অফিসার বলল,
“স্যার, এখানে দিন… We’ll handle.”
কল্লোল চোখ তুললেন— ঠাণ্ডা, রক্তিম চোখজোড়া।
তারপর খুব ধীরে নিচু হয়ে এলেন স্ট্রেচারের উপর, যেন কোনো মূল্যবান বস্তু নামিয়ে রাখছেন। আলতো করে ঊর্মিকে শুইয়ে দিল ও, নিজের হাতে ওর লেপ্টে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিল কপাল থেকে। কপালের ক্ষতটা আরও ছড়িয়ে পড়েছে, রক্ত থামছে না।
একজন নার্স এগিয়ে এসে অক্সিজেন মাস্ক মুখে ফিট করে দিল।
“Vitals dropping… let’s move fast!” মেডিকেল অফিসার বলে উঠলেন।
চাকার গর্জন তুলে স্ট্রেচার ছুটে চলল মেডিকেল ইউনিটের দিকে। কল্লোলও দৌড়ে চলল তার সাথে—
সাদা ইউনিফর্মে মাখানো লাল রক্ত, পায়ের নিচে কাঁপতে থাকা ধাতব করিডোর, আর বুকের ভিতর ছুটে চলা অপরাধবোধে আর আতঙ্কে মিশ্রিত বিষাক্ত ঢেউ সঙ্গে করে…
‘তুমি দেরি করেছো ক্যাপ্টেন…’
ঊর্মির নিঃসাড় মুখটা যেন সেই এক কথা বলে যাচ্ছে বারবার।
To be continued…
#জলতরঙ্গের_সুর
পর্ব – ২২
লেখা – আসফিয়া রহমান
অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ❌
জাহাজের মেডিকেল ইউনিট।
কাঁচের দরজার ওপাশে ছোট কিন্তু পূর্ণ-সজ্জিত একটি কক্ষ। চারপাশে স্টেইনলেস স্টিলের দেয়াল, দেয়ালের সঙ্গে আটকে থাকা অক্সিজেন ইউনিট, মনিটর, প্রাথমিক চিকিৎসার যন্ত্রপাতি। বাতাসে ভেসে আছে স্যাভলনের গন্ধ, আর থেমে থেমে বেজে চলেছে মনিটরের বিপ-বিপ শব্দটা।
ঊর্মির স্ট্রেচার ঢুকতেই ভেতরে তৎপরতা শুরু হয়ে গেল।
“She’s bleeding heavily. Laceration on the temple. BP dropping.”
“Get the suction. Clean the wound— fast!”
একজন নার্স কাঁচির ফলা চালালেন গলায় লেপ্টে থাকা রক্তমাখা কাপড়ের কিনারে। জামার গলার কাছে রক্তে চপচপে হয়ে আটকে থাকা অংশটা আস্তে করে কেটে খুলে ফেললেন তিনি— যেখানে কপাল থেকে গড়িয়ে পড়া ঘন রক্ত চুল বেয়ে এসে জামা লেপ্টে দিয়েছিল। আরেকজন অ্যানটাসেপটিক স্প্রে করে প্যাড চেপে ধরলেন ক্ষত স্থানটায়।
কল্লোল সেই কাঁচঘেরা দরজার ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে ঠোঁট চেপে রেখেছে শক্ত করে। দুহাত মুষ্টিবদ্ধ। ভেতরের আলো তার সাদা ইউনিফর্মের রক্তমাখা দাগগুলোকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে।
ঊর্মির স্ট্রেচার ঢোকার সাথে সাথেই দরজাটা স্লাইড করে বন্ধ হয়ে গেছে নিজে থেকেই— একটা অনতিক্রম্য দেওয়াল যেন দাঁড়িয়ে গেছে কল্লোলের সামনে। কল্লোলের সাথে সাথে তানিয়ারাও এসেছিল। দাঁড়াতে চেয়েছিল এখানে। কল্লোল জোর করে কেবিনে পাঠিয়ে দিয়েছে ওদের।
কাঁচের ওপাশে দেখা যাচ্ছিল ব্যস্ততা— একজন নার্স ওর বাম হাতটা বাড়িয়ে ধরেছে— সেই হালকা, শীর্ণ হাতটা— যে হাতটা কল্লোল চেপে ধরেছিল আজ সকালে।আরেকজন নিখুঁত দক্ষতায় শিরায় সূঁচ ঢুকিয়ে দিলেন, ছোট একটা প্লাস্টিক টিউব বেয়ে নিচের দিকে গড়িয়ে চললো রক্ত-তুল্য তরল।
অন্যদিকে কপালের ক্ষতটায় তখনও প্যাড চেপে ধরা।
ডাক্তার এগিয়ে এলেন সেলাইয়ের কিট হাতে।
একটা শ্বাসরুদ্ধ মুহূর্তের ভেতরে—
তীক্ষ্ণ সূচের একেকটা ফোঁড়, সুতোর পর সুতোর প্যাঁচ,
সাদা গজ ভিজে উঠলো তাজা রক্তে,
আর মনিটরের ধীরে চলা শব্দটা যেন ধ্বনিত হলো সেই অস্পষ্ট জীবনের অনুরণন হিসেবে।
—
একজন নার্স বারবার স্ক্যান করছেন পালস।
ঊর্মি তখনো নিস্তেজ। চোখ বন্ধ। চুল এলোমেলো। কপাল থেকে গড়িয়ে পড়া রক্তের দাগ এখনো শুকিয়ে আসেনি।
কল্লোল আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না দরজার বাইরে।
দু’পা এগিয়ে গিয়ে দরজার পাশে থাকা কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাকাল। একটুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ করেই ইন্টারকমের বোতাম চেপে ধরলো। কণ্ঠস্বর ভারী, নিচু, তবুও স্পষ্টভাবে অস্থির—
“Let me in… আমি ভিতরে যেতে চাই।”
দু’সেকেন্ড পর ভেতর থেকে শান্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, “Sorry, Captain. It’s sterile zone. আপনি এখন ভেতরে এলে পেশেন্টের ইনফেকশনের রিস্ক বেড়ে যাবে। Give us ten more minutes.”
কল্লোল চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো।
মনিটরের স্ক্রিনে এখনও উঠানামা করছে রেখাগুলো— তবে ছন্দটা যেন মাঝে মাঝে একটু ধীর হয়ে আসে। একজন নার্স বারবার স্ক্যান করছেন পালস। অন্য একজন রক্তচাপ মাপছেন আবার।
ঊর্মি তখনো নিস্তেজ। চোখ বন্ধ। কপালে সাদা ব্যান্ডেজ, মাথার পাশে বেডস্ট্যান্ডে ঝুলছে স্যালাইনের বোতল।
চোখের সামনে দুর্ভেদ্য কাঁচ, আর ভেতরে দৃশ্যমান
ব্যস্ততা— নার্সরা টুকটাক যন্ত্রপাতি সামলাচ্ছেন, একজন ডাক্তার স্টেথোস্কোপ কানে দিয়ে হার্টবিট শুনছেন।
ঊর্মি নড়ছে না— তবে মুখে একটা স্থির প্রশান্তি। কোনো ব্যথার ভাঁজ নেই। মনিটরের শব্দটাও স্বাভাবিক লয়ে ফিরে এসেছে কিছুটা—
“বিপ… বিপ…”
কল্লোলের বুকের ভেতর জমে থাকা ভারটা হঠাৎ ফুঁসে উঠলো। ও কল্পনা করতে চেষ্টা করল ঊর্মিকে— একা, নিঃসঙ্গ, ওই অন্ধকার ঘরটায়।
ওর ঠোঁট কেঁপে উঠলো। নিজের কাছেই চাপা গলায় ফিসফিসিয়ে বলল,
“আমি জানতাম ও অন্ধকারে ভয় পায়… কিন্তু এতটা?”
তখনই ওর কানে ভেসে উঠলো পুরোনো দিনের একটা কণ্ঠস্বর— ঊর্মির নিজের কণ্ঠ।
“আমার ছোটবেলা থেকেই অন্ধকারে খুব ভয় লাগে। ছোটবেলায় একবার লিফটে আটকে গিয়েছিলাম— বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল, দরজা খুলছিল না। আমি চিৎকার করছিলাম… অনেকক্ষণ ধরে। কিন্তু কেউ শুনতে পায়নি।
সেই আধঘণ্টা মনে হয়েছিল ঘণ্টার পর ঘণ্টা…
আমি ঘেমে উঠেছিলাম, মাথা ঘুরছিল, দম নিতে পারছিলাম না।
…শেষে যখন দরজা খোলা হয়েছিল, আমি প্রায় সেন্সলেস… সেই থেকে এই ভয়টা রয়ে গেছে।”
কল্লোলের বুকের ভেতর একটা ভারী ঢেউ উঠল।
হঠাৎ ওর মনে হলো, এই মুহূর্তটা ঠিক সেই ভয়ংকর লিফটটারই পুনরাবৃত্তি—
শুধু এবার দরজাটা স্টিলের না, কাঁচের…
আর এবার কেউ চিৎকার করছে না— কারণ ঊর্মির পুরো শরীরটাই নিস্তেজ এখন।
ওর নিজের কণ্ঠস্বরও যেন হঠাৎ কাজ করছে না।
একবার ঠোঁট নাড়িয়ে ফিসফিস করে বলল—
“তুমি তো আমাকে বলেছিলে… আমি জানতাম… অথচ… ওই বাস্টার্ডটা… আমি তোমাকে সাবধান না করে ভুল করেছি ঊর্মি। I should’ve warned you… আমি জানতাম না ওই জানোয়ারটা এমন কিছু করতে পারে…”
ওর আঙুল মুঠো বেঁধে আসছে, নখ চেপে বসছে তালুর ভেতরে। হঠাৎই যেন বিস্ফোরণ হলো ওর ভেতরে—
উথলে আসা রাগটা সামলাতে পারল না।
সজোরে ঘুষি বসাল পাশের ধাতব দেয়ালটায়।
“I will kill you, fucking bastard. Didn’t I warn you to stay away from my little bird?”
ধাতব প্যানেল কেঁপে উঠল শব্দে,
একটা যন্ত্রপাতি রাখা ট্রলির উপর থেকে ছিটকে পড়ল একটা স্টেইনলেস ট্রে—
নিচে পড়ে শব্দ করে বাজল একটা দীর্ঘ ধাতব ধ্বনি।
ওর বুকটা উঠে-নেমে চলেছে দমবন্ধ ক্ষোভে,
আর চোখের দৃষ্টি আটকে আছে কাঁচের দরজার
ওপারেই—
——
সময় কতটা কেটেছে, কল্লোল জানে না।
হয়তো পাঁচ মিনিট, হয়তো পনেরো—
কিন্তু প্রতিটি সেকেন্ড যেন হৃদপিণ্ড চেপে ধরেছিল একেকটা ইস্পাতের চোঙে।
মনিটরের স্ক্রিনে এখনও স্পন্দনের ওঠানামা দেখা যাচ্ছে। ছন্দটা স্থির না হলেও থেমে নেই।
হৃদস্পন্দনের সেই চেনা “বিপ… বিপ…” শব্দটা—
ভেতরে তৎপরতা এখনও পুরোপুরি থামেনি।
দুজন নার্স ঊর্মির পাশে দাঁড়িয়ে ভাইটাল চেক করছেন,
একজন ডাক্তার বেডের পাশেই ঝুঁকে আছেন, হাতে ক্লিপবোর্ড।
কোনো একজন নার্স নিচু গলায় কিছু একটা বললেন।
তারপরেই ইন্টারকমে ডাক্তার নিজেই এগিয়ে এলেন। ক্লান্তি মেশানো একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো ওপাশ থেকে—
“She’s still weak, but stable now. You may come in, Captain— just for a few minutes.”
কল্লোল আর এক মুহূর্তও দাঁড়িয়ে থাকলো না।
পা-দুটো যেন নিজে থেকেই চলতে শুরু করল তীব্র পদক্ষেপে।
স্লাইডিং ডোরটা খুলে গেল নিঃশব্দে।
ভেতরের বাতাসে মেডিসিনের ঝাঁঝালো গন্ধ।
বেডের পাশের মনিটরে এখন ছন্দময় ঢেউ।
একটা ছোট আলো ব্লিঙ্ক করছে— জীবনের প্রত্যাবর্তনের চিহ্ন হিসেবে।
ঊর্মি তখনো অচেতন।
মাথায় ব্যান্ডেজ, কপালের বাঁদিকের সেলাইয়ের উপর পেঁচিয়ে আছে ধবধবে সাদা গজ।
অক্সিজেন মাস্কের সাহায্যে চলছে মৃদু শ্বাস-প্রশ্বাস।
চোখের পাতা ভারী, তবে… মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে খুব সামান্য। সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে খেয়াল না করলে বোঝা যায় না।
কল্লোল ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল বেডের পাশে।
দুইজন মেডিকেল অফিসার তখনও ঘরে আছে।
একজন চোখ রাখছে মনিটরের স্ক্রিনে, অন্যজন নার্সকে বলছে,
“Vitals holding steady. Observation maintain করো। ক্যাপ্টেন থাকতে পারেন কিছুক্ষণ।”
নার্স হালকা মাথা নাড়ল।
দুই অফিসার দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন।
বেরোনোর ঠিক আগমুহূর্তে একজন থেমে বললেন,
“We’ll give you a few minutes, Captain. Let us know if there’s any change.”
দরজাটা স্লাইড করে বন্ধ হয়ে গেল আবার।
ভেতরে এক অপার্থিব নিস্তব্ধতা।
শুধু মনিটরের বিপ… বিপ…
আর স্যাভলন-মেশানো জীবাণুনাশকের গন্ধে ভারী বাতাস।
কল্লোল নিঃশব্দে টুল টেনে বসল বেডের পাশে।
অস্থির চোখে দেখলো অক্সিজেন মাস্কে ঢাকা ঊর্মির নিস্তেজ মুখখানা। মাথার সাদা ব্যান্ডেজটার উপরে এসে থেমে গেল ওর চোখদুটো।
তারপর চোখ নামিয়ে তাকালো ক্যানোলা লাগানো হাতের দিকে। কল্লোলের কাঁপা কাঁপা আঙুলগুলো আলতো করে স্পর্শ করল ঊর্মির স্থির আঙুল।
কল্লোল সাবধানে ওর হাতটা উঠিয়ে পরপর কয়েকটা ভেজা চুমু খেলো হাতের উল্টোপিঠে। এতেও যেন আঁশ মিটলো না ওর। ঝুঁকে পড়ে দুহাতের আজলায় অক্সিজেন মাস্কে আর ব্যান্ডেজে প্রায় ঢাকা পড়ে যাওয়া ছোট্ট মুখখানা তুলে ধরে অস্থিরভঙ্গিতে অনেকগুলো চুমু খেলো। তপ্ত ঠোঁটদুটো সন্তর্পণে ছুয়ে গেল ব্যান্ডেজ ঢাকা ক্ষতটার ওপর।
তারপর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে শুধালো,
“তোমার ক্যাপ্টেন এসেছে little bird, চোখ মেলে দেখবে না?”
___________________________________
কল্লোল এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে গত কয়েকদিন ধরে রুবেলের জন্য বরাদ্দকৃত কেবিনটার সামনে। দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। অন্ধকারের বুক চিরে বন্দরের দিকে এগিয়ে চলছে জাহাজ। ঢেউয়ের একেকটা গর্জনের সাথে সমানতালে ফুঁসছে কল্লোলও।
কল্লোলের হাত অস্থির ভঙ্গিতে দরজায় অনবরত শব্দ করল কিছুক্ষণ।
“রুবেল, দরজা খোল।”
তীক্ষ্ণ গর্জনে কেঁপে উঠল জাহাজের পাটাতন। ভেতর থেকে কোন সাড়া এলো না। কল্লোল দাঁতে দাঁত চেপে আবার মুঠি দিয়ে দরজায় আঘাত করল— ধাতব শব্দ প্রতিধ্বনিত হলো করিডোরে।
“রুবেল যদি তুই ভেবে থাকিস, দরজা না খুললে বেঁচে যাবি তাহলে ভুল ভাবছিস!”ওর কণ্ঠস্বর এখন একেবারে নিচু, কিন্তু প্রতিটি শব্দে ছুরি-ধারার মতো ধারালো হুমকি।
ভেতরে হালকা একটা শব্দ হলো, তারপরই নব ঘোরানোর শব্দ।
দরজা আধখোলা হতেই কল্লোল দেরি করল
না— শার্টের কলার মুঠো করে টেনে বের করে আনল রুবেলকে, আর মুহূর্তের মধ্যে প্রচণ্ড এক ঘুষি গিয়ে বসলো ওর নাক বরাবর।
“How dare you fucking bastard? ঊর্মির ক্ষতি করার চিন্তা করার সাহস হলো কি করে তোর?”
ঘুষিটা এমন আচমকা এলো যে রুবেল প্রতিরোধ করার সময় কিংবা সুযোগ কোনটাই পেল না। আঘাতের ধাক্কায় মাথা হেলে গেল একপাশে, নাক দিয়ে গলগল করে নামলো রক্তের ধারা।
কল্লোলের মুখ ঠিক ওর মুখের সামনে, রাগে শ্বাস ঘন হয়ে আসছে, বুকটা উঠানামা করছে ঢেউয়ের মতো।
চিৎকারের শব্দে করিডোর কেঁপে উঠল— জাহাজে অবস্থানরত ক্রু আর অফিসাররা ছুটে এলো তৎক্ষণাৎ।
“Sir! Stop, sir!”
দু’জন অফিসার দুই দিক থেকে কল্লোলকে আটকানোর চেষ্টা করল, কিন্তু সে তখনও বজ্রমুঠিতে চেপে আছে রুবেলের শার্টের কলার।
রুবেল এক হাত তুলে গড়িয়ে পড়া রক্ত মুছল। একপলক তাকালো কল্লোলের সাদা ইউনিফর্মের বুকের কাছটায় খয়েরি রঙের ছোপ ছোপ দাগের ওপর। তারপর চোখ তুলে তাকিয়ে বলল,
“আপনি এটা ঠিক করলেন না ক্যাপ্টেন…”
কল্লোল হঠাৎ করে আবার হাত তুলল, তৎক্ষণাৎ অফিসাররা দুই দিক থেকে টেনে ধরল ওকে।
“Sir, let him go! This is not the way!”
“I’ll kill you…” কল্লোলের চোখ থেকে এই মুহূর্তে ঝরছে আগুনের ফুলকি। অফিসারদের হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল ও, বলিষ্ঠ পেশির টান আর ফুঁসে ওঠা ক্রোধে হাঁপিয়ে উঠল দু’জন অফিসারই।
“Sir, enough!”
এক অফিসার কল্লোলের কাঁধে জোরে চাপ দিল, আরেকজন কোমরে হাত দিয়ে টেনে ধরল। দু’জন মিলে প্রায় জোর করেই তাকে রুবেলের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে আনল ওকে।
কল্লোল শেষ মুহূর্তেও রুবেলের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল, বুকের ভেতর থেকে যেন গর্জন বেরোচ্ছে ওর— “এটা শেষ ওয়ার্নিং রুবেল। Next time I will kill you.”
অফিসাররা কোনোমতে ওকে করিডোরের মোড় ঘুরিয়ে একটা ফাঁকা রুমে ঢুকিয়ে দিল।
দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে একজন বলল, “Captain, control yourself! আপনি নিজের ক্যারিয়ার শেষ করে ফেলবেন!”
কল্লোল ধপ করে বসে পড়ল চেয়ারে, ওর শরীর কাঁপছে ক্রোধে, শ্বাস ভারী, চোখের রক্তিম আগুন নেভেনি এখনো।
প্রচন্ড ক্রোধে দিশেহারা অবস্থাতেও কল্লোলের চোখের সামনে একটাই মুখ ভেসে উঠলো। রুবেলের মুখে পড়া ঘুষির সন্তুষ্টি মিলিয়ে গেল মুহূর্তেই, তার বদলে জায়গা নিল এক অদ্ভুত আতঙ্ক।
উর্মি এখন কেমন আছে? ওর জ্ঞান ফিরেছে কি?
ওকে দেখার সময়টুকু এত স্বল্প ছিল যে তাতে ক্যাপ্টেনের চোখের তৃষ্ণা মেটেনি। মেডিকেল রুমের সেই নিঃশব্দ সাদা আলোতে শুয়ে থাকা উর্মির মুখটা যেন আরও ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো কল্লোলের মনে।
ওর বুকের ভেতর থেকে অজান্তেই বেরিয়ে এল একটা দীর্ঘশ্বাস। পাশ থেকে অফিসার কফির মগ এগিয়ে দিলেন; কল্লোল সেটা নিল না। ফিসফিস করে বলল, “She needs me right now… আর আমি এখানে বসে আছি?”
কল্লোল চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো, ওকে উঠে দাঁড়াতে দেখিয়ে দুজন অফিসারই ব্যস্ত হয়ে উঠলো।
“কি হলো ক্যাপ্টেন?”
“Nothing. আমি বাইরে যাচ্ছি।”
অফিসার দুজন একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকালো। তাদেরকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কল্লোল দরজা খুলে বেরিয়ে গেল মেডিকেল ইউনিটের উদ্দেশ্যে।
To be continued…